The Silent Manor part 22

The Silent Manor part 22
Dayna Imrose lucky

আযান এর সুর ভেসে আসছে। সুফিয়ান এর ঘুম ভাঙ্গে আযানের সুরে।সে অস্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।পাশে থাকা পাত্র থেকে জল ঢকঢক করে খেয়ে নিল। কপালে ঘাম জমেছে।হাত দিয়ে মুছে ফেলল। হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক নয়।রাঙার হ্রেষাধ্বনি ভেসে আসল। সুফিয়ান বিছানা থেকে নেমে শালটা পেঁচিয়ে দরজা খুলে ঘরের বাইরে আসল।রাঙা ছটফট করছে।কাছে খড় জল আছে।ও খাচ্ছে না।ওর পেটের দিকে তাকাল।পেট খালি খালি লাগছে। নিশ্চয়ই সে-ই কখন থেকে খায়নি।রাঙাকে কিনে আনার পর থেকে ও না খেয়ে থেকেছে এমনটি হয়নি।আজ খায়নি।

চোখে জল ওর।সুফিয়ান আলতো হাতে ওকে ছুঁইয়ে দিল।রাঙা আবারো হ্রেষাধ্বনি তুলল।চোখ থেকে ওর জল পড়ছেই ।সুফিয়ান নরম গলায় বলল ‘কি হয়েছে,তোর? তুই ও কি আমার মত খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস?রাঙা নিশ্চুপ।এবার শুধু লেচ নাড়াচ্ছে। সুফিয়ান বলল ‘স্বপ্ন সবসময় সত্যি হয় না। স্বপ্ন অর্থহীন ও হয়।ভয় পাস না।আমি আছিতো।’
আজ সকাল থেকেই পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ।সকালে মোরগ ডেকেছিল। সুফিয়ান এর ঘুম ভাঙ্গার পড়ে। তাঁর ঘুম ভাঙ্গে খারাপ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নের কথা আর মনে করতে চাইলো না। কিন্তু না চাইতেও দৃশ্য গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মানুষ সারাদিন যা ভাবে, তার একটি খন্ডাংশ কখনো কখনো স্বপ্নে চলে আসে। গতকাল তাঁর ভাবনা থেকে স্বপ্ন আসেনি। ভয়ংকর স্বপ্ন।যা সে কখনোই কল্পনা করেনি। কখনো কখনো স্বপ্ন আগাম বার্তা দেয়। কিন্তু সুফিয়ান খারাপ কিছু হবে ভাবতে পারল না। স্বপ্ন অর্থহীন হয়।এর ব্যাখা হয় না। মনে মনে স্বীকার করল।

ঠান্ডা জলে হাত মুখ ধুয়ে নিল।একটু আরাম লাগছে।চা তৈরি করার জন্য একটা ছোট্ট পাত্রে জল নিল।চুলায় বসিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। মিনিট কয়েক পর জল ফুটতে শুরু করে। সুফিয়ান এর সেদিকে খেয়াল নেই।চোখ তাঁর গোলাপ গাছের দিকে। শীঘ্রই গোলাপ ফুটবে।কলির মাথা দেখা যাচ্ছে। গোলাপ ফুটলে ফারদিনাকে দিবে। শুধু দিবেই না,প্রেম নিবেদন করবে। ভালোবাসি তিনটে শব্দের তাঁর কাছে মূল্য নেই। কিন্তু ফারদিনার ইচ্ছে, সুফিয়ান তাকে প্রেম নিবেদন করবে।ফারদিনার ইচ্ছে সে শীঘ্রই পূর্ণ করবে। মুখের কোণে হাঁসি চলে আসল। মুহূর্তেই আবার হাঁসি বিলীন হয়ে গেল। শেষ রাতের স্বপ্ন এর কথা মনে পড়ল। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস এর সাথে ভাবনার পৃথিবী থেকে বিদায় নিল।
চা এর জল ফুটে উপযুক্ত হয়েছে।চা পাতা দিয়ে দিল। মাটির তৈরি কাপে চা ঠেলে নিল। মাটির কাপটি সে নিজের হাতে বানিয়েছে।এতে কোনো রাসায়নিক লেপ থাকে না, তাই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ও নিরাপদ। কিন্তু একবার এর বেশি মাটির কাপ ব্যবহার করা যায় না।আজ প্রথম করছে।

চা হাতে নিয়ে টেবিলে বসল।চা গরম।ঠান্ডা হওয়া অবধি অপেক্ষা করা যাক।ততক্ষণে হতে কলম তুলে নিল। নতুন একটি পৃষ্ঠা নিল।কালির দোয়াতে ডুবিয়ে লিখছে – রাতে খাওয়া দাওয়ার পর চোখ ঘুমে লেগে যায়। গতকাল সে ইচ্ছে করে ফারদিনার সাথে রাতে দেখা করেনি।ফারদিনাও বলেছে আসবে না ।আমিও জোড় করিনি।দিনে অনেক সময় ওর সাথে কাটিয়েছি।রাতে ঘুমানোর সময় সারাদিন এর ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো ভেসে উঠে চোখের সামনে। সুন্দরতম মুহূর্ত গুলো ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যাই। শেষ রাতের দিকে স্বপ্ন দেখি ফারদিনা আজমাত এর সাথে ঢলে পড়ে কথা বলছে। আমার নাম তুচ্ছ করছে। আমাকে সে ভালোবাসে না। আমার বাঁশির সুর তাঁর কানে পৌঁছায় না।আমি স্বপ্নের ঘোরেই থমকে যাই। পাথরের মত শক্ত হয়ে যাই আমি।মনে হয়েছে আমি মাটির তৈরি মানুষ না।অন্য ধাতু দিয়ে তৈরি। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল।ঠিক সেই মুহূর্তে ফজরের আযানের সুরে ঘুম ভাঙ্গে আমার। তখন বুঝতে পারলাম,আমি স্বপ্ন দেখছি।লোকে বলে স্বপ্ন কারো কাছে বলতে নাই। কিন্তু আমি রাঙার কাছে বলেছি।’-

হাত থামাল সুফিয়ান।ডাক আসে তার “সুফিয়ান ভাই ঘরে আছেন? সোলেমান এর কন্ঠ। সুফিয়ান খাতা বন্ধ করে বাইরে আসল। মুখের চিন্তার ছাপ দূর করে হাসতে চাচ্ছে।নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে।পারছে না। হাঁসি আসছে না।ভেজা মুখখানা দেখল সোলেমান।সেজে গুজে এসেছে ও।বলল ‘আপনাকে ওরকম দেখাচ্ছে কেন?
‘কি রকম? সুফিয়ান বারান্দায় বসে সিগারেট ধরাল।গত দুদিন ধরে সিগারেট কম খাওয়া হচ্ছে।আজ চেয়েছিল খাবেই না। দুশ্চিন্তার কারণে সিগারেট ধরাল। লম্বা লম্বা টানে ধোঁয়া ছাড়ল।
“মনে হয়,খুব চিন্তিত”’
সুফিয়ান স্বপ্নের কথা সোলেমান কে বলল। স্বপ্নের কথা কাউকে বললে কিছুই হয় না।লোকে ভুল বলে। সোলেমান তাঁর স্বপ্নের কথা শুনে বলল “স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে নাই। আপনি বলছেন কাউকে?

“রাঙা কে।”
‘ও কি বলল?
‘ও ওর ভাষায় বলেছে স্বপ্নের অর্থ হয় না।’
“বলেছে?
‘হুম।
“যাক। তাহলে তো ভালোই। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।যাবেন না?
“কোথায়? সুফিয়ান চোখ তুলে তাকাল।
“আজ মেলা।ভুলে গেলেন।সব কৃষক রা এবং গ্রামের সবাই নদীর পাড়ে উপস্থিত হবে।বিশাল করে মেলার আয়োজন করা হয়েছে।”
সুফিয়ান সত্যিই ভুলে গিয়েছিল। গতকাল আদিব বলে গিয়েছিল উপস্থিত থাকতে। গ্রামের সবাই আজকের দিনে মেলায় আনন্দ করবে।নাচ গান এর ব্যবস্থা করা হয়। বলল ‘তালুকদার বাড়ির সবাই গিয়েছে?
‘না। সবে তো সবাই যাওয়া শুরু করেছে। তাঁরা তো প্রধান অতিথি।শুনেছি কৃষ্ণপুর গ্রামের লোকেরাও আসে।’
“উনারা প্রতি বছরেই আসে।’
‘আপনি যাবেন?

“তোরা যা। আমার ইচ্ছে করছে না যেতে।বিকেল হওয়ার আগে সিদ্ধান্ত বদলালে যাব।’ তাঁর কথাগুলো গম্ভীর শোনাল।সোলেমান এর কাছে সুফিয়ান এর আচরণ অদ্ভুত লাগল। সোলেমান আর কিছু না বলে চলে যায়।
আলিমনগর গ্রামের রাজস্ব শেষের দিনটা গ্রামবাসীর কাছে উৎসবের মত। সারাবছর জমি-জমার হিসাব, ধান কাটার ঝক্কি, খাজনা মেটানোর তাড়া।সবকিছু পেরিয়ে আসে সেই প্রতীক্ষিত দিন।আলিমনগরের বার্ষিক মেলা। নদীর পাড় ঘেঁষে এক বিস্তীর্ণ বালুচরে বসে এই মেলা। দূর দূরান্তের হাটের লোকেরা, গাঁয়ের কৃষক, জেলে, কামার, কুমোর—সবাই আসে এখানে, যেন এই একদিনেই পুরো গ্রামের প্রাণ জেগে ওঠে।

মেলার আগের রাত থেকেই নদীর বাতাসে অন্যরকম গন্ধ মেশে। কোথাও মাটির হাঁড়িতে ফুটছে মিষ্টি গুড়ের পায়েস, কোথাও কুমোরেরা সাজাচ্ছে মাটির বাঁশি, খেলনা ঘোড়া, আর লাল রঙের পুতুল। দূর থেকে দেখা যায় যেন আকাশজুড়ে ঝুলছে ছোট ছোট তেলের প্রদীপ।মেলা প্রাঙ্গণের চারপাশ যেন রঙিন হয়ে উঠেছে।
সকালের সূর্য উঠেনি। কিন্তু শুরু হয় কোলাহল। গ্রামের পথজুড়ে মানুষ। গরুর গাড়ি, পালকি, পায়ে হেঁটে আসা দলবেঁধে নারী-পুরুষ, কেউ মাথায় চাঁদি, কেউ হাতে মাটির হাঁড়ি নিয়ে এগিয়ে আসে মেলার দিকে। শিশুদের চোখে উজ্জ্বল আলো।তাদের কাছে মেলাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময়। বাঁশের খুঁটিতে বাঁধা পতাকা গুলো বাতাসে দুলছে, লাল, নীল, হলুদ কাপড়ে মোড়া সেই খুঁটিগুলো যেন গ্রামের আনন্দের প্রতীক।

মেলা বসেছে তিন ভাগে। প্রথম ভাগে দোকানপাট গুড়, চিঁড়া, মুড়ি, তেল, খেলনা, কাপড়, কাঠের তৈরি গয়না। সারি সারি দোকান। দোকানদাররা উচ্চ স্বরে ডাক দিচ্ছে “এই দ্যাখো মিঠাই! এক পয়সায় দুইটা!” পাশের দোকানে বাজছে ঢোল, তার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ আবার বাঁশি বাজাচ্ছে। বাতাসে মিষ্টির গন্ধ, গুড়ের মিষ্টি আর মানুষের শরীরের ঘাম মিশে এক অদ্ভুত গন্ধ তৈরি করেছে যেটা কেবল মেলাতেই পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় ভাগে শুরু হয়েছে নাচগান। খোলা আকাশের নিচে বাঁশের মঞ্চ, তার ওপর ঝুলছে রঙিন কাপড়। ঢাক-ঢোল বাজছে, বেহালা ও হারমোনিয়ামের সুরে একদল গায়েন গাইছে পালাগান। তাদের গলায় সুর, মুখে হাসি, চোখে আলো। গল্পের তালে তালে গ্রামের মানুষ তালি দিচ্ছে, কেউ হাসছে, কেউ আবার কান পেতে শুনছে। পালাগানের পাশে বসেছে বায়োস্কোপওয়ালা।কাঠের বাক্সে চোখ লাগিয়ে দেখা যায় অদ্ভুত সব চলমান ছবি। বাচ্চারা গুচ্ছ গুচ্ছ দাঁড়িয়ে আছে, এক পয়সা দিয়ে সেই যাদু দেখা যেন জীবনের বড় প্রাপ্তি।

তৃতীয় ভাগে আছে পশুর হাট। গরু, ছাগল, অশ্ব,সবই এখানে আসে বিক্রির জন্য। কৃষকেরা গরুর দাঁত দেখে, দড়ি টেনে দেখে শক্তি মাপে। কারো গলায় দরদী আওয়াজ “এই গরুটা দ্যাখো, ধান খায় কম, দুধ দেয় বেশি।” হাটের ভেতর কাদা, গরুর পায়ে জল ছিটকে পড়ছে মানুষের গায়ে। তবু কারও মুখে বিরক্তি নেই,সবাই মুগ্ধ, উত্তেজিত। কারও চোখে নতুন গরু কেনার স্বপ্ন, কারও মনে পুরনো গরু বিক্রি করে কিছু টাকা হাতে আসার আশ্বাস।
জমিদার রশীদ তালুকদার এর জন্য আলাদা মঞ্চ করা হয়েছে।সে বসে আছে মনোভাব নিয়ে।পরনে ঝমকালো পোশাক।কেউ কেউ এসে আদব এবং সম্মান এর সাথে রশীদ কে ফুল দিয়ে সম্মান জানাচ্ছে। পেছনে দাড়িয়ে অনুচারীগন চোখ ঘুরিয়ে চারদিকে দেখছে।রায়ান,সায়েম আরিব এক সাথে বসে গল্প করছে।

ফারদিনা ও ঝিলমিল পাশাপাশি বসা। গ্রামের ছোট বড় অনেকেই ফারদিনার রুপ দেখছে। সচরাচর তালুকদার বাড়ির মেয়েকে কেউ দেখে না।আজ দেখছে। একজন অন্য জন এর সাথে কানা ফিসফিস করছে। কিন্তু মন আজ ভীষণ ভারী ফারদিনার।মেলায় এসে সে একবার চোখ তুলে অবধি চারদিকে দেখেনি। ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল “তোর মন খারাপ ক্যান? সুফিয়ান আসে নাই দেইখা?আইবো,সবে তো মেলা শুরু।’
ফারদিনা মর্মাহত মুখে বলল ‘আমি অন্য কারনে চিন্তিত।”
‘কি কারন? ঝিলমিল ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল।
‘গতকাল রাতে আমি ভয়ংকর একটা স্বপ্ন দেখেছি। রীতিমত দম আটকে যাওয়ার উপক্রম।”
‘কি দেখছিস?

“আমি দেখলাম,আজমাত এর সাথে আমি মিসছি।ওর কাছে সুফিয়ান এর দুর্নাম করছি। সুফিয়ান এর বাঁশির সুর আমি শুনতে পাচ্ছি না।”
“তারপর?
‘তারমধ্যে তুই একটা চিঠি নিয়ে এসেছিস। চিঠিতে লেখা ছিল -আমি যাকে ভরসা করছি,সেই সব থেকে বড় শত্রু আমার।আমি আব্বা,চার ভাই,তোকে এবং সুফিয়ান কে অনেক ভরসা করি।”
ঝিলমিল হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল “এসব তোর মনের ভুলভাল ভাবনা।”
ফারদিনা এবার আহত কন্ঠে বলল ‘আমি আরো একটা স্বপ্ন দেখেছি। স্পষ্ট ছিল না।তবে এরকম, সুফিয়ান ক্রোধের আগুনে আমাকে মে’রে ফেলছে। শ্বাস রোধ করে।”
ঝিলমিল ঠোঁট বেঁকিয়ে হেসে বলল ‘স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না।চল বায়োস্কোপ ওয়ালার ঐখানে যাই।উনি অনেক দৃশ্য দেখায়।আমরাও দেখি,
ফারদিনা না করল। ঝিলমিল শুনল না।

বায়োস্কোপ ওয়ালার কাছে গিয়ে ফারদিনা কাঠের বাক্সে চিত্র দেখছে। চিত্রটি একটি গ্রামের। একজন রাখাল ছেলে বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। সুদর্শন যুবক। তাঁর বাঁশির সুর শুনে জমিদার এক কন্যা ছুটে এসেছে। দৃশ্য পাল্টালো। বাঁশিওয়ালা তাঁর পেছনে দাড়িয়ে হঠাৎ তাঁর মুখ চেপে ধরল।
ফারদিনা চমকে গেল। বায়োস্কোপ থেকে ছুটে সরে গেল। ঝিলমিল বলল ‘দৃশ্যটা সুন্দর আছিলো না?
“তুই কি দেখলি? বিমর্ষ রূপে তলিয়ে গেল ফারদিনা।

“একজন বাঁশিওয়ালা বাঁশি বাজাইছে। তাঁর সুর শুইনা একজন সুন্দরী কন্যা দৌড়াই আইলো।পরের দৃশ্যে তাঁদের বিয়া হইলো।” বলে হাসল ঝিলমিল। ফারদিনা গম্ভীর মুখে চোখ মাটিতে নিল। চোখে মুখে হতাশার ছাপ দেখে ঝিলমিল জিজ্ঞেস করল “কি হইছে তোর,আজ তোরে এমন লাগতাছে কেন?
ফারদিনা চোখ তুলে বলল “আমি অন্য কিছু দেখলাম। বাঁশিওয়ালা ছুটে আসা মেয়েটিকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে।’ তাঁর কথা তোয়াক্কা না করে ঝিলমিল বলল ‘তুই যা স্বপ্ন দেখছিস সেই ঘোর থাইকা গেছে।চল, নদীর তীরে হাঁটি। ওদিকটায় যাই।মেলা থেইকা দূরে।তোর ভালো লাগব।”
সূর্যের আলো উঁকি মেরে আবার মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যাচ্ছে।বাতাস বইছে।মেলা থেকে সবার কোলা’হল শোনা যাচ্ছে।ফারদিনা উদ্ভ্রান্ত পথিক এর মত হাঁটছে। ঝিলমিল মনের সুখে ভাজা পিঠা খাচ্ছে।ফারদিনা কে পিঠা সেদে বলল

“নে পিঠা খা’।’
“মজা করিস না।’
‘পিঠা খাইলে মন ভালো থাকে।খাবি?
“খাব না।’
ঝিলমিল মুখ ভেংচে দিয়ে বলল ‘তুই পিঠা খাবি কেন,তুই খাবি সুফিয়ান রে।’ বলে জিহ্বা কামড় দিল।মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে বাক্যটি।ফারদিনা বিদ্ধ চোখে তাকাল ওর দিকে। ঝিলমিল হেসে বলল ‘জ্বালাইয়া মাথা খাবার কথা কইতে ছিলাম। আচ্ছা, সুফিয়ান আজ আইলো না কেন?
“ও আমাকে হয়ত ভালোই বাসে না”

ঝিলমিল অগ্রাহ্য করল তাঁর কথা।কোন প্রতিক্রিয়া করল না।নদীর তীরে কিছু নৌকা বাঁধা।ঘাষে তীর সবুজ হয়ে আছে।ফারদিনা পা হালকা করে বিছিয়ে ঘাসের উপর বসল।হাঁটুর উপর হাত রেখে থুতনির ভর রাখল।কানে শো শো শব্দ আসছে বাতাসের। ঝিলমিল খাওয়া ছেড়ে বলল “তোর এত মন খারাপ,তোর শুকনা মুখ আমার মোটেই ভালো লাগতেছে না,কি সব স্বপ্ন দেখছিস,দেখ স্বপ্ন সত্যি হয় না।”
“তবে সুফিয়ান কেন মেলাতে আসল না?
‘হয়ত তাঁর কাজ আছে,তাই আসে নাই। তাঁর লইগা মন খারাপ করবি!”ঝিলমিল এর কন্ঠ ক্লান্ত।ফারদিনা কিছু না বলে নদীর ঢেউয়ের দিকে চেয়ে রইল।কোন জবাব দিল না ‌।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে। সূর্যের আলো ঢলে পড়ছে নদীর জলে, আর সেই সঙ্গে মেলার চূড়ান্ত রূপ। ঢোলের আওয়াজ আরও জোরে বাজল।দোকানের সামনে ভিড় আরও ঘন হল। মেয়েরা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে হাসছে, কিশোররা ঘুড়ি উড়াচ্ছে, আর শিশুরা ঘুরছে নাগরদোলায় উঠছে,নামছে,চিৎকারে আকাশ কাঁপছে। এক পাশে চলছে যাত্রা, আরেক পাশে জাদু দেখাচ্ছে এক জাদুকর,সে মাটিতে পাটি পেতে পাখি উড়িয়ে দিচ্ছে, ফুল বের করছে হাতার ভেতর থেকে। চারদিকে হাসি, বিস্ময় আর হাততালির ঝড়।
এমন সময় সায়েম ফারদিনাকে কোথাও দেখতে পেল না। একজন অনুচারীকে বলল “ফারদিনা কোথায় আছে, খুঁজে দেখ।জলদি”- “অনুচারী মাথা কাত করে সম্মতি জানালো।

আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। সূর্য এর আলো দেখা যাচ্ছে না। চারদিক আপছা কুয়াশায় ডুবে যাচ্ছে। ঝিলমিল ফারদিনা কে বলল “তুই সুফিয়ান কে অনেক ভালোবাসো তাই তো?
ফারদিনা নিচু কন্ঠে হুম শব্দ করে উত্তর দিল।
‘সুফিয়ান আসেনাই বইলা তোর মন খারাপ?
মাথা আওড়ালো ‘হু’
“এখন যদি দেখোছ, সুফিয়ান তোর পাশে ! নির্বিকার প্রশ্ন ঝিলমিল এর।ফারদিনা আত্মবিশ্বাস এর সাথে বলল ‘আসবে না। আমাকে ও ভালোবাসে না।’
‘তুই নিশ্চিত?
‘তা নয়ত কি!’

“তোমার আত্মবিশ্বাস দেখে আমি অবাক” সুফিয়ান এর কন্ঠ।ফারদিনা দ্রুত চাহনি তে পেছন ঘুরল। সুফিয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। এরপর ফারদিনার পাশে বসল।ফারদিনা চোখ বড় করে,থ’ হয়ে তাকিয়ে রইল। ঝিলমিল হেসে বলল ‘আমি তারে দেইখাই তোরে এই প্রশ্ন করছি।দূর থেইকা অশ্ব নিয়ে আইতে দেখছি। আমারে ইশারায় তোরে কইতে মানা করছে।” ফারদিনা মুখের হাঁসি ইচ্ছে করে লুকালো। হাঁসি চেপে রাখাও কষ্টের।সে বুঝতে দিবে না সে খুশি হয়েছে সুফিয়ান কে দেখে। ঝিলমিল এর দিকে ঘুরে বলল “তুই আমার সাথে মজা করেছিস না,এর শোধ নেব।”
সুফিয়ান বলল “ওর দোষ নেই। আমাকে বকো”
ফারদিনা কিছু বলল না। ঝিলমিল বলল ‘আমি দূরে যাই,তোরা কথা ক!”
ফারদিনা এখন রেগে নেই। কিন্তু চোখের সামনে ভেসে উঠছে রাতের স্বপ্ন। কঠিন স্বপ্ন।তখন থেকেই তাঁর ভেতরে ভয়,আতঙ্ক বিরাজ করছে। সুফিয়ান কে বলা দরকার?না-কি সে চিন্তা করবে? আবার ভাব,সে হয়ত অগ্রাহ্য করে উড়িয়ে দিবে।বলবে ‘স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। স্বপ্নের ঘোর কেটে গেলে ভয় ও কেটে যাবে।সে বলতে চাইলো না।

“মন খারাপ? সুফিয়ান বিমর্ষ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।
“না।”
“চুপ করে আছো যে, আমার সাথে কথা বলবে না?
ফারদিনা দু চোখ সহ ভ্রু কুঁচকে কিঞ্চিৎ বিস্ময়ে তাকাল সুফিয়ান এর দিকে। সুফিয়ান এর কন্ঠে যেন আজ রেশ নেই। বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছে তাঁর মুখখানি।সুফিয়ান এর চেহারার সাথে এরুপ অভিব্যক্তি যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। সুফিয়ান ফারদিনা কে চুপ থাকতে দেখে বলল ‘আজ ময়না পাখি শান্ত কেন?এত চুপচাপ ক্লান্ত চেহারা তোমার সাথে যাচ্ছে না।” ফারদিনা এখন আর একটু দ্বিধায় পড়ল। তাঁর ভাবনার সাথে সুফিয়ান এর ভাবনার সাথে কিভাবে মিলল? তাঁর ভাবনার শহর থেকে যেন সুফিয়ান তাকে পাল্টা প্রশ্ন করল। ফারদিনা বলল “তুমি আসতে দেরি করেছো,তাই মন খারাপ”

“মেয়েরা মিথ্যা বললে ওদের চোখ তা বলে দেয়। তুমি মিথ্যা বলছো। আমি আসাতে দেরি করেছি,এর জন্য একটু মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু তুমি বিষন্নতায় ভুগছো মেয়ে”
ফারদিনা কিছুতেই স্বপ্নের কথা বলতে চাইছে না।এখন কি জবাব দিবে?মাথা নিচু করে নখ খুঁটতে শুরু করল। সুফিয়ান শীতের শালটাকে ডান হাতের নিচ থেকে নিয়ে বা কাঁধে রাখল। সিগারেট বের করল।বাতাসে দুবার সিগারেট ধরাতে ব্যর্থ হয়। তৃতীয় বার ধরাতে পারল।
ফারদিনার মুখ গম্ভীর। সুফিয়ান ফারদিনার দিকে ঝুঁকে বলল “জানো আমি কি স্বপ্ন দেখেছি?
ফারদিনা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল।চোখ মুখে প্রশ্ন ফুটে উঠল।সেও স্বপ্ন দেখেছে।কি দেখেছে?ফারদিনা আগ্রহ প্রকাশ করে বলল “কি দেখেছো?

The Silent Manor part 21

“তুমি ধলা বিলাই এর সাথে প্রেম করছো। আমার সাথে বেইমানি করেছো।আমার বাঁশির সুর শুনতে পাওনি।” থেমে গেল সুফিয়ান। দৃষ্টি নদীর ওপারে।ফারদিনা বলল “তারপর?
সুফিয়ান সিগারেট এর ধোঁয়া ছেড়ে বলল “বাকিটা আপছা আপছা দেখেছি,তবে মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে মেরে ফেলছি।” বলে আওয়াজ করে হেসে উঠলো।ফারদিনার কাছে এই হাঁসি রহস্যময় মনে হল।বলল “হাসছো কেন?
সুফিয়ান মোহময় কন্ঠে বলল “ স্বপ্নরাও স্বপ্নে আমাদের স্বপ্ন এর জগত নিয়ে খেলা করে।নয়ত,যে মানুষ টা কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি,তাকে কি কখনো নিজের হাতে মারা যায়?
ফারদিনার দুচোখে আতঙ্ক ছড়িয়ে জল জমলো।ঢোক গিলল। দু’জন মানুষ একই দিনে একি স্বপ্ন কিভাবে দেখল? সে যেন প্রশ্নের জগতে হারিয়ে গেল।

The Silent Manor part 23

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here