The Silent Manor part 26
Dayna Imrose lucky
‘মারা যায়নি মেরে ফেলেছে।’ বাক্যটি শুনে ফারদিনার শিরদাঁড়া বেয়ে স্রোত নেমে গেল। খানিকটা বিস্ময়ের সাথে বলল “কি বলছো তুমি?মেরে ফেলেছে মানে?
“আমরা নিজে নিজে কি মা’রা যেতে পারি! সৃষ্টিকর্তা আমাদের নিয়ে যান।আমি এটাই বললাম।”
ফারদিনা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।বলল “তুমি কখনো কখনো ভয় পাইয়ে দাও।”
“আমি যতক্ষন তোমার সাথে আছি ভয় পাবার কোন কারণ নেই।”
ফারদিনা ঘার টান করে বাড়ির মূল ফটকের দিকে তাকাল।হাতে খঞ্জর নিয়ে কিছু পাহারাদার পায়চারি করছে। ওদের লম্বাটে দানবের মত শরীর দেখা যাচ্ছে। সুফিয়ান জিজ্ঞেস করল “কি দেখছো?
“দেখছিলাম,কেউ এদিকে আসছে কি না”
“ভয় পাচ্ছ?
ফারদিনা মাথা আওড়ালো ‘না’।
সুফিয়ান কিছু বলার আগে অশ্বের খুরের ধুবধুব শব্দ ভেসে আসল।তাঁদের ডান দিকে বিশাল ক্ষেত।ক্ষেত এর ওপারে বাগান। সচরাচর সেদিকে কেউ যায়না। সুফিয়ান কান খাঁড়া করে শোনার চেষ্টা করল। স্পষ্ট শোনা গেল শব্দ। সুফিয়ান ফারদিনার দিকে চেয়ে বলল “তুমি বাড়ি ফিরে যাও।আমি আসছি’
“কোথায় যাবে? ফারদিনা প্রশ্নে বিদ্ধ করল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সুফিয়ান কোন জবাব না দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সেদিকে চোখ মেলানো যেদিক থেকে অশ্বের দৌড়ের আওয়াজ আসলো। সুফিয়ান এর অভিব্যক্তি দেখে ফারদিনা দাঁড়িয়ে বলল “কি দেখছো ওদিকে?
সুফিয়ান সত্য কথা বলল না। কিন্তু মিথ্যা বলতে তাঁর এখন মোটেই ইচ্ছা করছে না।সত্য মিথ্যায় সে যেন হঠাৎ করে চাপা পড়ল।সুফিয়ান জবাব দেয়ার আগে ফারদিনা বলল “চুপ করে আছো কেন?
“জবাব দেয়ার আগে প্রশ্ন করলে চুপ তো থাকতেই হবে।”
“এখন বলো”
“শব্দ শুনতে পেলে?
“কিসের? ফারদিনা সুফিয়ান এর পেছনের দিকে দেখল।সে কোন শব্দ পেল না।খুরের ধুবধুব শব্দ এখন আর আসছে না। সুফিয়ান ঘুরে একবার বাগানের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার ফারদিনার দিকে চেয়ে বলল “আমি অশ্বের দৌড়ের আওয়াজ পেয়েছিলাম।এত রাতে কারা অশ্ব নিয়ে ছুটাছুটি করছে!সেটাই দেখতে চেয়েছিলাম।”
“আমিও যাব তোমার সাথে”
“মেয়ে মানুষ নিয়ে ঝুঁকি নিতে হয় না, বিশেষ করে তোমাকে নিয়ে ঝুঁকি নেয়া যাবে না। তুমি বাড়িতে চলে যাও।”
ফারদিনা নিষ্প্রাণ মুখে বলল “আমিও যাব”
সুফিয়ান বলল “মেয়ে মানুষ আর কিছু পারুক আর না পারুক, পুরুষের মন গলাতে ঠিকই পারে। যদি ওরা ডাকা’তের দল হয় তো?
“আমরা চেচাবো, তারপর ওদের ধরিয়ে দেব।”
“কাদের দিয়ে ধরিয়ে দিবে?
“আমার ভাইদের!” কথা শেষ করতে পারল না।বাগান থেকে একই শব্দ পুনরায় ভেসে আসল। এবার অশ্বের হ্রেষাধ্বনি আসল। সাধারণত অশ্ব হ্রেষাধ্বনি তুললে এতটা তির্যক আওয়াজ আসে না।যদি কোন অশ্বকে দিয়ে জোড় করে কোন কঠিন কাজ করানো হয় তবেই এরকম হ্রেষাধ্বনি তুলবে। রাঙা কে কিনে আনার পর থেকে সুফিয়ান এর অশ্বের প্রতি বেশ ধারণা হয়েছে।
ফারদিনা বলল “অশ্বের হ্রেষাধ্বনি শুনতে পেয়েছি। কিন্তু এত রাতে অশ্ব নিয়ে কে ছুটছে?” ফারদিনা চিন্তিত মূলক কন্ঠে বলল। সুফিয়ান বলল “কে না,বলো কারা ছুটছে। একাধিক অশ্বের খুরের ধুবধুব শব্দ আসছে।”
“তুমি নিশ্চিত করে কিভাবে বলছো?
“আমি তোমার মত গা’ধা না।”
“আমি গা’ধা? ফারদিনা দু কোমরে হাত চেপে জিজ্ঞেস করল।
“সুন্দরী মেয়েরা গাধাই হয়।’
‘প্রসংশা করছো না গাধা বলেই সম্বোধন করছো?
“দুটোই।” ফারদিনা মুখে গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে আসল। সুফিয়ান অস্পষ্ট ভাবে বলল “গাধার মত আবদার করে,নিজেই মুখ গম্ভীর করে ফেলে। অদ্ভুত।”
সুফিয়ান অস্পষ্ট ভাবে কথাগুলো বললেও ফারদিনা গাধা শব্দটি পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে।
“শোনো, মেয়েদের বুদ্ধি দিয়ে কিছুই হয় না, তাঁদের কাজ হচ্ছে স্বামীর সেবা করা, সন্তানদের বড় করা, সংসার সামলানো। এখানে বুদ্ধির দরকার নেই।”
“শোনো, বুদ্ধিমান পুরুষরা সবসময় গাধা বউই পায়।বুঝেছো?
“বুঝেছি।”
“কি বুঝেছো? সুফিয়ান ফারদিনার দিকে কিছুটা ঝুঁকে প্রশ্ন করল।
ফারদিনা চাপা স্বরে হাসলো। মৃদু কন্ঠে বলল “আমি তোমার বউ।বউ বলে ডেকেছো।”
সুফিয়ান নিঃশব্দে পুনরায় বলল “এইজন্যই বলে মেয়ে মানুষ গা’ধা।”
“চলো ডা’কাত খুঁজতে যাই।” ফারদিনা বেশ উৎফুল্ল হল। এখানে খুশি হওয়ার কারণ টা সুফিয়ান ঠিক বুঝতে পারল না।মনে হচ্ছে ডা’কাতরা মিলন-মেলার আয়োজন করেছে। সেখানে প্রধান অতিথি ফারদিনা। সুফিয়ান কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে বলল “ওরা যদি সত্যিই ডা’কাত হয়,আর যদি আমাকে আক্রমন করে তবে আমি তোমাকে ওদের কাছে দিয়ে পালাব।”
“কাপুরুষ।” বিড়বিড় করল ফারদিনা।
“আসল পুরুষ। কাপুরুষ বলছো কেন?
ফারদিনা মুখ বাঁকিয়ে বলল “তোমাকে দেখে মনে হয় না তুমি পুরুষ।”
সুফিয়ান ভ্রু উঁচিয়ে বলল “বাচ্চা মেয়ে বলে ছেড়ে দিলাম।ডা’কাত দল এর কাছে যাবে?
“চলো।”
আকাশে কাদাতে মেঘ।রাত ঘন হয়ে এসেছে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে চারদিক। ক্ষেতের আইল এর উপর দিয়ে ধীরে ধীরে বাগানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাঁরা।পায়ের নিচে ভেজা ঘাস চুপচাপ সরে যাচ্ছে।দূরে কোথাও পেঁচার ডাকে কেঁপে উঠছে রাতটা।ফারদিনার হাতে লন্ঠন। সুফিয়ান ফারদিনার ডান হাতটা ধরে রেখেছে। শক্ত করে,যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। সুফিয়ান এর বলিষ্ঠ হাত অনুসরণ করে ফারদিনা তাকাল সুফিয়ান এর মুখের দিকে।এক পাশ দেখা যাচ্ছে।শ্যাম বর্ণের পুরুষ এর সৌন্দর্য রাতে ফুটে উঠে না। কিন্তু ফারদিনা দেখছে সুফিয়ান এর সৌন্দর্য যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল।পথের ভেজা,মাটি,ঘাস সেদিকে খেয়াল নেই। সুফিয়ান হাত ধরে রেখেছে,পথ আলাদা করে দেখার দরকার নেই।ফারদিনা দৃষ্টি সরিয়ে এক-ফালি হাঁসি দিল।
ক্ষেত এর শেষে প্রান্তে তাঁরা। সামনে বিশাল এক নিস্তব্ধ বাগান।এতটাই সুনসান যেন,নীরবতাই আক্র’মণ এর জন্য ওত পেতে আছে। সুফিয়ান বাগানের ভেতরে প্রবেশ করার আগে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। মজিদ মিয়া একবার বলেছিল, তালুকদার বাড়ির সামনে থেকে যে ক্ষেত চলে গেছে, তারপরে যে বাগান টা আছে, সেটা মোটেই সুবিধার না।দিনের বেলায়ও এখানে কেউ আসে না। সুফিয়ান তখন বলেছিল, “বাঘ আছে না ভাল্লুক” মজিদ মিয়া সরু চোখে জবাব দিয়েছিল “থাকলেও থাকতে পারে।”
মজিদ মিয়া মাঝেমধ্যে উল্টো পাল্টা কথা বলে।সবাই বলে তার মাথায় সমস্যা। সমস্যা না হলে, নিজের মেয়েকে দশ বছর পর আবার কেউ মারতে পারে!গত কয়েকদিন ধরে মজিদ মিয়ার খবর নেই। সুফিয়ান ফারদিনার জন্য তাঁর খোঁজ খবর নিতে পারছে না। নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হল।
সুফিয়ান দাঁড়িয়ে আছে বলে ফারদিনা জিজ্ঞেস করল “বাগানের ভেতরে যেতে ভয় পাচ্ছ? দাঁড়িয়ে আছো কেন?
সুফিয়ান রসিকতা করে বলল “সুন্দরী বউ কে যদি ডাকা’তরা চেয়ে বসে।আমি সেই ভয়ে আছি।”
“ডাকা’ত দলের কাছে আমাকে দিয়ে দাও সমস্যা নেই। কিন্তু সে-ই সুবাদে অন্তত বউ তো ডাকলে। আমার বেশ ভালোই লাগছে।”
সুফিয়ান বলল “বেহায়া মেয়ে।”
রাত বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা ঠিক ক’টায় এসে বিঁধছে বলা মুশকিল। চাঁদের গায়ে মেঘ ঘনিষ্ঠ হয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ।এখন আস্তেধীরে উড়ে যাচ্ছে মেঘ। চাঁদের আলো বাগানে পড়েছে।দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে।সবে মাত্র শোনা গেল ওদের ডাক। এতক্ষণ সবকিছু নির্বাক ছিল।যেন ওরা সুফিয়ান এবং ফারদিনাকে দেখেই চিৎকার করছে।
তাঁরা ধীর পায়ে হেঁটে বাগানের মধ্যভাগে চলে গেল।ফারদিনা হঠাৎ করে থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সুফিয়ান ফারদিনার চোখের দিকে চেয়ে বলল “এমন ভাবে চেয়ে আছো যেন তোমার সামনে ভূত পড়েছে।”
ফারদিনা হাতের ইশারায় দূরে দেখিয়ে দিল।বেশ কিছু জায়গা জুড়ে মশাল এর আলো দেখা যাচ্ছে। সুফিয়ান তাকাল।ফারদিনা ঢোক গিলে বলল “সত্যিই ডা’কাত হবে ওরা।লো আমরা ফিরে যাই।”
“প্রমাণ ব্যতীত কাউকে সন্দেহ করা ঠিক না।”
“তাহলে ওরা নিশ্চয়ই পূণ্যের কাজ করছে।” ফারদিনার কন্ঠে ক্রোধ।সুফিয়ান ফারদিনার রেশ টেনে বলল “হতেও পারে। কিছু মানুষ দিনে ভালো কাজ করতে সুযোগ পায় না,তাই রাতে করে।রাতের অন্ধকার ওদের জন্য উপযুক্ত সময়।চলো আমরা আড়াল থেকে দেখি ওরা ঠিক কি করছে”?
সুফিয়ান ও ফারদিনা পরবর্তী পা ফেলতেই একটা কালো রঙের বিড়াল লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেলো তাঁদের সামনে থেকে। হঠাৎ কালো বিড়াল এর আহ্ববানে ফারদিনা চমকে উঠল। শ্বাস প্রশ্বাস কিছুটা ভারী হল। সুফিয়ান ফারদিনাকে সাহস দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল।বিড়াল এর কাজ রাতে ঘোরাফেরা করা। ইঁদুর এর খোঁজ করা।যেন ইঁদুরই ওর একমাত্র শিকার।
আজ রাতটা যেন কোনো অশুভ।বাগানের পাতাগুলো নিঃশব্দে কাঁপছে, দূরে কোথাও চাঁদের আলো গিলে ফেলেছে ঘন মেঘ।সুফিয়ান ও ফারদিনা পুরোনো পাথরের ফোয়ারার আড়ালে লুকিয়ে, চোখ রাখল মশাল এর আলোর দিকে।বেশ কিছু মশাল জ্বলছে।বাতাসে হঠাৎ এক অদ্ভুত গন্ধ।স্যাঁতসেঁতে মাটি, আর পচা ফুলের মিশ্রণ।
তারপর, ঝোপ সরিয়ে বেরিয়ে এলো র’ক্তেশ্বরী বাঘ।চোখ লাল, থাবায় মাটি খুঁড়ে ফেলছে, যেন অস্থির ক্ষুধা তাকে পাগল করে তুলেছে।কিন্তু ওর ঘাড়ে,একটা চামড়ার কলার বাঁধা!
ফারদিনা বিস্ফারিত চোখে ফিসফিস করল,
—“ওটা… ওটা তো কারো পোষা বাঘ মনে হচ্ছে ।””সুফিয়ান আঙুলের ইশারায় হুঁশ শব্দে চুপ থাকতে বলল।
বাঘটা থেমে গেল, কান খাড়া করল।
তারপর অন্ধকারের ভেতর থেকে ভেসে এলো এক কণ্ঠ“শান্ত হও, র’ক্তেশ্বরী”
বাঘের গর্জন থেমে গেল মুহূর্তে।ছায়ার মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো এক মানুষ,লম্বা কালো চাদরে ঢাকা মুখ, হাতে তামার লণ্ঠন। আলোয় তার মুখ স্পষ্ট হলো না, শুধু ঠোঁটের কোণে এক বিকৃত হাসি। এরপর তিনটি অশ্ব বেরিয়ে আসল।অশ্বের পৃষ্ঠায় চেপে বসা তিনজন মুখোশধারী।সাথে বেশ কয়েকজন অনুচারী।অশ্ব থেকে একজন মুখোশধারী নেমে বাঘটার মাথায় হাত রাখল।বাঘটা যেন বিড়ালের মতো শান্ত হয়ে গেল, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
মানুষটি মৃদু স্বরে বলল “আজ একজন পেয়েছি, রক্তেশ্বরী। কিন্তু খুব শিগগিরই অনেকেই আসবে তোর খিদে মেটাতে।তোর শরীরে শক্তি না থাকলে, আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে তুই লড়াই করবি কিভাবে!”
ফারদিনার বুক কাঁপছে, সুফিয়ান নিঃশব্দে মুঠি চেপে ধরল।বাঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া লোকটির শুধু চোখ দেখা গেলেও তাকে শনাক্ত করা গেল।সায়েম এর কন্ঠ।ফারদিনা নিচু স্বরে বলল “ভাই।” সুফিয়ান কিছু বলল না। শুধু চেয়ে রইল। তাঁদের উদ্দেশ্য দেখার পালা।এই কালরাত্রি শুধু বন্য নয়, মানুষের তৈরি এক দানবীয় আয়োজন।
দ্বিতীয়জন অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়াল। সে অনুচারীকে লক্ষ্য করে বলল “বাঘের তাজা খাদ্য নিয়ে আয়।দেরি হয়ে যাচ্ছে।দিনের আলো ফুটলে অশুভ হবে।” থেমে গেল তাঁর কন্ঠ। এরপর শুধু হাসির বন্য শুরু হল।
সুফিয়ান ফারদিনাকে বলল “তোমার ভাই রায়ান। কিন্তু ওরা কি করছে?
“আমি কিছুই জানি না। চলো এখান থেকে।আমাদের দেখে ফেললে শেষ করে ফেলবে।”
“দাঁড়াও। তোমার ভাইয়েরা কি পূণ্যের কাজ করছে,এটা দেখা দরকার।”
রায়ানা সায়েম সহ সবাই হাঁসি থামাল। শেষমেষ ভেসে আসল আরিব এর কন্ঠ। প্রকৃতি যেন তারই অপেক্ষা করছিল।আরিব বলল “আজকের রাতটার নাম কি দেয়া যায়? প্রশ্ন টা যেন সবাইকে ঘিরে করল।সায়েম আগ বাড়িয়ে বেশ প্রফুল্ল মনে বলল “ভাই, আজকের রাতের নাম দাও র’ক্তের আহার।”
রায়ান বলল “আমাদের ছোট্ট ভাইয়ের মাথায় বুদ্ধি আছে, পরবর্তী জমিদার ও হলেও হতে পারে।” সায়েম বেশ তির্যক আওয়াজে আসল।যেন এই মন্তব্য এর আসায় ছিল।আরিব একটা পাথরের খন্ড এর উপরে বসল। সামনে অগ্নিকুণ্ড।আ’গুনের ঝলকানিতে আরিব এর চোখ দুটো লাল দেখাচ্ছে। মুখমণ্ডলে র’ক্ত উঠে এসেছে।
চাদর মুড়ি দেয়া তামার লন্ঠন হাতে এগিয়ে আসল লোকটি। হঠাৎ বাতাস বয়ে যাওয়ায় তাঁর মুখ থেকে চাদরটা উড়ে গেল। সে চোখ বুজে আবার মেলল।একটি চোখ নেই তাঁর।খোদাই করা অংশ টি।যেন কেউ ইচ্ছা করেই চোখ উপড়ে ফেলেছে।
ফারদিনা হা’ জাতীয় ফিসফিস শব্দ করে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ চেপে ধরে। সেদিন রাতে স্বপ্নে সে দেখেছিল, একজন বৃদ্ধা ঝিলমিল এর কাছে তাঁর জন্য চিঠি পাঠিয়েছে।লোকটির একটি চোখ ছিল না। স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সত্যি হয় না।তবে আজ কেন, তাঁর সামনে অন্ধ লোক হাজির হল।তার ভাইদের সাথে সে কি করছে? তাঁর ভাইয়েরাও বা কি করছে?ঠিক কিছুদিন আগে একজন কে নির্ম’মভাবে হ’ত্যা করেছে তাঁরা।কুমিরের জন্য। তাঁদের বাড়িতে প্রাচীন ফাঁদ আছে। ফাঁদের কিছু অংশ আছে। সেখানে পা রাখলেই কুমিরের খাদ্য হিসেবে পরিখায় পড়ে যাবে। সে-ই জবাব মিলেছিল। কিন্তু আজ র’ক্তশোষী বাঘ কেন?বাঘ কিভাবে শ’ত্রুদের মোকাবেলা করে?ফারদিনা কোন জবাব পেল না। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে শুধু তাকিয়ে রইল।যদি জবাব মিলে।
রায়ান বলল ‘জলদি করে ওকে নিয়ে আয়।’ ক’জন অনুচারী একজন কে পাকড়াও করে ধরে এনেছে।লোকটি ছোটার জন্য ছটফট করছে।পারছে না ছুটতে। দানবের মত শরীরের অধিকারী অনুচারীগন। ওদের দেখে মনে হচ্ছে জ’ল্লাদ।কারো গলা কাঁ’টার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।
পীড়িত ব্যক্তি উম উম শব্দে গোঙাচ্ছে।হাত দুটো বাধা।মুখে কালো মুখোশ। শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ছুটে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু অসম্ভব ওদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া। এতক্ষণ টের না পেলেও এখন পাচ্ছে।
রায়ান বলল “ওর মুখোশ খুলে দে।হাত খুলে দে। মানুষের মৃ’ত্যুর আগে ওর শেষ ইচ্ছা জানতে হয়।” রায়ান এর কন্ঠে হিংস্র পশুর মত হুংকার। পীড়িত ব্যক্তি নিশ্চিত হল, তাঁর বাঁচার আর উপায় নেই।সরদার উপস্থিত।যে আদেশ দিচ্ছে সে নিশ্চয়ই সরদার। আগুনের আভা ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। একাধিক লোকের পায়ের শব্দ ওর কানে যাচ্ছে। মৃ’ত্যু ওর জন্য উপস্থিত হয়েছে।
অনুচারী ওর মুখোশ খুলে ফেলল। সুফিয়ান পীড়িত ব্যক্তি কে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেরুদন্ড যেন শীতল হয়ে গেল।ফারদিনা বলল ‘কি হয়েছে? এভাবে কি দেখছো?
“তোমার ভাইয়েরা যাকে ধরেছে ও হচ্ছে সামসুল। সামসুল নীরিহ মানুষ। ওকে কেন ওরা শিকার করল।’
“তুমি ওকে চেনো?
“ভালো করে চিনি। আমার ক্ষেতে এক সময় কাজ করত।হাতটা ছাড়ো, আমার চোখের সামনে ওর কিছু হতে দিতে পারি না’
ফারদিনা আকুতি কন্ঠে বলল ‘তুমি যাবে না,ওরা তোমাকেও মে’রে ফেলবে।’
‘হাত ছাড়ো ফারদিনা” সুফিয়ান নীরবতার মাঝেই ক্ষিপ্ত হল।ফারদিনা বলল “তুমি যদি সত্যিই যাও,তবে আমি আমার মৃ’ত্যু ডেকে আনব।’ সুফিয়ান ফারদিনার মুখে কথাটা শুনে থমকে গেল। ঘুরে একবার ফারদিনার দিকে তাকাল। চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রাগে। কিন্তু প্রকাশ করতে পারল না। নিজেকে শান্ত করে তাঁর জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল।
সামসুল হাত জোর করে বলল ‘আপনারা আমায় কেন শিকার করলেন, আমার মত নিরীহ মানুষের ওপর অত্যা’চার কইরেন না। আল্লাহ সইবো না।” কন্ঠ কাঁপছে ওর। চোখে জল ভেসে উঠেছে। বেঁচে থাকার তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করল।
সায়েম বলল “তোকে অত্যা’চার করব না তো,তোকে আজ বাঘের খাদ্য বানাব।শোন, গরীবদের এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকার কোন মানেই হয় না। শুধু শুধু কষ্ট।’ বলে হেসে উঠল। তাঁর হাসির সাথে সবাই হেসে উঠল।সায়েম হাতে একটা তলো’য়ার নিয়ে বলল “যার শরীর পুরোপুরি সুস্থ, নিখুঁত, একমাত্র সন্তান, তাকে যদি আমরা অন্ধকার রাতে,জ’বাই করি তাহলে আমাদের আরো উন্নতি হবে জমিদারিতে।”
সামসুল বলল ‘এগুলা কুসংস্কার। এগুলার বাস্তব জীবনের লগে কোন মিল নাই।আপনারা এগুলা বিশ্বাস কইরেন না।”
আরিব সায়েম এর দিকে তাকিয়ে বলল “ছোট্ট ভাই,ভুল বলে ফেলেছিস, আজকের দিনে জবাই করলে আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল হবে না।হাকিম কি বলেছে ভুলে গেছিস?
সায়েম সত্যিই ভুলে গেছে।মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু মনে পড়ল না।রায়ান পায়চারি করতে করতে বলল “ভুলে যেতেই পারিস,কোন ব্যাপার না।আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আজকের দিনে কারো শরীরে তলো’য়ার বা ছু’ড়ি লাগানো যাবে না। আমাদের হাত দিয়ে ওর পরিপূর্ণ শরীর কে অর্ধেক করতে হবে। তারপর বাঘ কে খেতে দিতে হবে।”
একচোখা ব্যক্তি লন্ঠন এর আলোতে নিজের মুখকে স্পষ্ট করে বলল “কিন্তু এইডা কেমনে সম্ভব?
সায়েম চিন্তা করছে।আরিব, রায়ান ও চেতনার শহরে ডুবে গেল। সামসুল অনুরোধ মূলক কন্ঠে বলল ‘আমারে যাইতে দেন, আমার লগে এরুম কইরেন না।আমি বাঁচতে চাই।আপনারা যা করতেছেন এগুলা পাপ। কুসংস্কার বিশ্বাস কইরেন না।”
রায়ান সামসুল এর দিকে তেড়ে এসেই এক লাত্থি মারল। সামসুল ছিটকে এক পাশে পড়ে গিয়ে ধুম করে আওয়াজ সৃষ্টি করল।রায়ান বলল “এগুলো কুসংস্কার না। বাস্তব।আমরা এত বছর ধরে জমিদারিতে এভাবেই টিকে আছি।এই বাঘ মানুষ কে খেয়েও ফেলে আবার রক্ষাও করে। আমাদের ও রক্ষা করেছে অনেক বার।এর পড়েও করবে।তোর বেঁচে থেকে কি হবে।’
একচোখা ব্যক্তি বলল ‘তাহলে দেরি ক্যান,রাত শেষ প্রহরে পইরা গেছে।সময় কম। কেমনে কি করবা কইরা ফালাও।’
আরিব বলল ‘তলো’য়ার,ছু’ড়ি না লাগিয়ে কিভাবে মারবো?
সায়েম বলল ‘আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে।বলব?
“অনুমতি চাইছিস কেন!বল” বলল রায়ান।
সায়েম অভিব্যক্তি কঠিন করে বলল ‘এই যে চিকন গাছটা দেখছো,ওকে এইখানে বসিয়ে দাও। তারপর ওর দু হাত আমরা দু’জনে ধরে পেছনের দিকে টানব।ও সমান ভাগে মাঝখানে বসে থাকবে। যখনই আমরা ওর হাত দুটো টানব,ওর হাত দুটো ছিঁড়ে যাবে। তাহলেই ও পরিপূর্ণ মানব থেকে অর্ধেক হয়ে যাবে। কারণ যার দুটো হাতই নেই সে পূর্ণ হয় কিভাবে?” সায়েম এর কথা শুনে একচোখা সহ বাকিরা বাহবা দিল।আরিব বলল “তুই নিশ্চিত থাক, পরবর্তী জমিদার তুই হবি।’ সায়েম খুশি মনে আরিব এর পা ধরে সালাম করল।বলল ‘বড় ভাই পিতার সমতুল্য। তুমি দোয়া করো ভাই, একদিন আমি এই আলিমনগর এর জমিদার হব।”
রায়ান গলা পরিষ্কার করল। র’ক্তশোষী বাঘ টা মাটিতে গা চেপে শুয়ে আছে।একটু পর পর গর্জে উঠছে।আরিব বলল ‘সময় নিচ্ছিস কেন,যা করার দ্রুত কর।কে কে হাত ছিঁড়বি ওর?”
সায়েম বলল আমি আর রায়ান ভাই।”
সামসুল আশেপাশে তাকাল।পালাবার পথ নেই। চারদিকে অনুচারী।সবাই একটা গোল চক্রের মধ্যে।যেন র’ক্তের খেলা শুরু হবে এখুনি।ও শেষবারের মত আশেপাশে দেখে পালানোর পথ খুঁজল। না,কোন পথ নেই।আরিব ওর কাছেই আসতেই পা ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল ‘আমারে ছাইড়া দেন,এই পাপ কইরেন না, অভিশাপ লাগব,ছাইড়া দেন আমারে।” ওর কথায় কারো মন গলল না।আরিব ওর কলার ধরে গাছের সাথে বসিয়ে দেয়। সামসুল কাঁদছে।সায়েম এসে সামসুল এর এক হাত ধরল।আরিব আর একহাত ধরল। দুজনে গাছের পেছনে সরে ওর দু হাত শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করে টানতে থাকল। সামসুল এর চিৎকারে গোটা বাগান কেঁপে উঠল। জীবিত অবস্থায় কারো অঙ্গ ছিঁড়ে নেওয়া হলে সেই যন্ত্রণা মৃ’ত্যু ব্যতীত সমস্ত যন্ত্রণাকে হার মানায়।
সামসুল এর শরীরের চামড়া ধীরে ধীরে ছিঁড়ে যাচ্ছে। র’ক্তে ইতিমধ্যে শরীর ভিজে গেছে। একচোখা ব্যক্তি বলল “আরো জোরে টানো।” বাঘটা র’ক্তের গন্ধে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো।সায়েম আরিব কে লক্ষ্য করে বলল “ভাই,আরো জোরে টানো। এখুনি ছিঁড়ে যাবে।”
The Silent Manor part 25
বলতে না বলতেই সামসুল এর হাত দুটো চট শব্দে ছিঁড়ে যায়। সামসুল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কাতরাচ্ছে।গলা থেকে স্বর বের হল না।তবুও নির্বাক কন্ঠে শেষ বারের মত বলল ‘এই কুসংস্কার একদিন তোদের শেষ কইরা দেব।”
ফারদিনা চেঁচিয়ে উঠতেই সুফিয়ান মুখ চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে ঠেকিয়ে নিল ফারদিনাকে।বলল “ভয় পেয়ো না,কিছুই দেখোনি তুমি। কিচ্ছু হয়নি। শান্ত হও।”
সায়েম বলল “ভাই এবার বাঘকে খেতে দাও।ওর খিদে পেয়েছে।”
