The Silent Manor part 3
Dayna Imrose lucky
ভোরের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে বিশাল চৌধুরী নিবাসন এর আঙিনায়। শিশির ভেজা বাতাসে ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে আছে। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু দূরে পাখিদের কিচিরমিচির আর কুয়াশা ভেদ করে আসা সূর্যের কোমল আলো আঙিনার লাল ইটের মেঝেতে পড়ে এক অদ্ভুত সোনালি আভা ছড়াচ্ছে।
বাড়ির উঁচু ফটক ধীরে ধীরে খোলা হয়েছে, দরজার কপাটে কড়া নাড়ার শব্দ যেন সকালের নিস্তব্ধতাকে আরও গভীর করে তুলেছে। দোতলার বারান্দা থেকে সাদা রঙের মোটা খুঁটির ফাঁক দিয়ে সকালের আলো নেমে আসছে। বারান্দার লোহার রেলিঙে শিশিরে ভেজা মানিকজোড় পায়রা বসে ডানায় আলো মেখে নিচ্ছে।
আঙিনার একপাশে শান বাঁধানো পুকুর, তার জলে সকালের প্রথম সূর্যরশ্মি পড়ে চিকচিক করছে। জল নাড়াচাড়া করছে কচুরিপানা আর মাঝেমাঝে মাছ লাফিয়ে ওঠার তরঙ্গ। পুকুরঘাটে কয়েকজন দাসী ঘোমটা টেনে জল তুলছে, তাদের কণ্ঠের সুরেলা আড্ডা ভেসে আসছে সকালের শান্ত আবহে।
বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে চুলায় কাঠ জ্বালানোর গন্ধ আর রান্নার প্রথম ধোঁয়া। পুরনো দেয়ালের ছায়া ভেদ করে নতুন দিনের প্রাণচাঞ্চল্য ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এমন সকাল যেন জমিদার বাড়ির প্রাচীন ইতিহাসকেও সজীব করে তোলে।
পুকুর পাড়ে বসে আছে মায়া। তৃষ্ণা শেষ শানে নেমে মুখ ধুচ্ছে।মীর সেখানে উপস্থিত হয়। কিছুক্ষণ হয় রহিমাদের বাড়ি থেকে ফিরেছে। মায়াকে একা বসে থাকতে দেখে মীরও পুকুর পাড়ে উপস্থিত হয়।মীর কে দেখে তৃষ্ণা বাড়ির ভেতরে চলে যায়।মীর কালো রঙের শার্ট এবং এ্যাশ রঙ এর প্যান্ট পড়ে আছে।হাতে একটা সোনালী রঙের ঘড়ি।মীর গিয়ে বসে মায়ার পাশে।মায়া মীর এর থেকে মুখ সরিয়ে নেয়।মীর কিছুটা কোমল কন্ঠে বলল “রুপসী’ বোনটি কোন কারণে রাগ করে আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু কি কারণে রাগ হয়ে আছে বলা যাবে কি?”
মায়া বলল “আমি কারো সাথে কথা বলতে চাই না। আপনার সাথে ও নয়।আর আপনি একটা মিথ্যাবাদী।”
“তা কোন কারণে আমাকে মিথ্যাবাদী বলা হচ্ছে জানতে পারি কি?
“গতকাল আপনি আমার সাথে মিথ্যা বলেছেন।ঐ ছুরিটি দিয়ে নিশ্চয়ই কিছু করেছেন,নয়তো করবেন।আর আমার সাথে মিথ্যা বললেন।”
মীর মায়ার দিকে ঝুঁকে বলল “তুমি নিশ্চয়ই ভুল কিছু ধারণা করছো।আমি যা বলেছি তাই সত্য। আমার ডিকশনারিতে মিথ্যা বলতে কোন শব্দ নেই।”
“তাহলে রাফিদ দাদা’ আপনার সাথে কি করছিলো?
মীর এবার ঠোঁট চুলকিয়ে বেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ রইল। এরপর জবাব দিল “ও তো রাতে আমার সাথে ই ছিল।আর ও তখন ছুরিটি দেখে এটাই বলছিলো, ‘এটা বিছানায় কেন,গলা কেটে যাবে। তুমি নিশ্চয়ই এটা জানালা থেকে দেখেছো”
মায়া মীর এর দিকে ঘুরে বলল “আপনি কিভাবে জানলেন?
“তুমি ছোট্ট বেলা থেকেই দুষ্টু।বয়স কম হয়নি, কিন্তু এখনো পাগলামো যায়নি তোমার।”
মায়া মলিন হেসে উঠল।মীর মায়ার হাঁসি দেখে বলল “আর কাউকে সন্দেহ কর না। তোমার আশেপাশে কেউ তোমার শত্রু নয় মায়া।”
মায়া অপ্রীতিকর ভাবে বলল “কিন্তু মীর, আপনি জানেন আমার কেমন যেন সবাইকে অদ্ভুত মনে হয়।কখনো মনে হয় এরা সবাই আমার ক্ষতি চায়। যাদের দেখছি তাঁরা কেউ আমার আপন নয়।”
“অসুখ।”
“মানে? মায়া ভ্রুকুঞ্চিত করল।
“মানে এটা তোমার একটা অসুখ। দীর্ঘ সময় ধরে তুমি পরিবার এর থেকে দূরে ছিলে, পরিবার এর আদর সোহাগ কেমন হয় সেটা হয়ত তুমি ঠিকঠাক ভাবে কখনো উপলব্ধি করনি। হঠাৎ করে সবাইকে একসাথে পেয়ে তোমার এমন অনুভূতি হচ্ছে”
মায়া দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল।মীর এর রেশ টেনে বলল “আপনি ঠিকই বলেছেন।”
“এখন ঠিক বলছো। কিছুক্ষণ পর আমার পেছনেই তুমি পড়বে।”
নিরব সময় কাটে পুকুর পাড়ে কিছুক্ষণ। সূর্যের আলো পুকুর এর জলে পড়ে তাঁর প্রতিফলন পড়ল মায়ার মুখে।মীর তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি কি বই পড়তে ভালোবাসো?
“আমি গল্প পছন্দ করি। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন?
“তোমার ঘরে তোমার অনুমতি ছাড়াই গিয়েছিলাম। তখন অনেক বই দেখতে পাই।”
মায়া মীর এর দিকে ঘুরে তাঁর হাতের উপর হাত রেখে বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল “আচ্ছা আপনি ‘দ্যা সাইলেন্ট ম্যানর’ বইটি পড়েছেন?
মীর মায়ার হাতের স্পর্শ পেয়ে সেদিকে তাকাল।মায়া বুঝতে পেরে হাত সরিয়ে ফেলল।
“দুঃখিত”
“আমি বই পড়তে পছন্দ করি না।পাঠ্য বই তো বাবার ভয়ে পড়তাম।আর গল্প!” মীর থামে।
“এটি একটি অসম্পূর্ণ বই। আমার অনেক পছন্দের। কিন্তু লেখক বইটি কেন অসম্পূর্ণ রেখেছে!আর লেখকই বা কোথায় হারিয়ে গেছে, জানি না। জানেন ওনার খোঁজ পর্যন্ত করেছিলাম। কিন্তু পাইনি।”
মায়ার মুখটি হঠাৎ করে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।মীর দেখে বলল “তুমি কি বইটি নিয়ে চিন্তিত?
মায়া নিরুত্তর।মীর হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে বলল “আচ্ছা বইটি আমাকে দিও,আমিও পড়ে দেখব।”
“সত্যি তো?”মায়ার মুখে উজ্জ্বল হাঁসি।
“বললাম না আমি মিথ্যে বলি না।”
“কিন্তু আপনি তো গল্প পছন্দ করেন না!”
“তোমার জন্য একটা বই পড়াই যায়” বলে মীর পুকুর পাড় থেকে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।মায়া মীরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
এতক্ষণ তৃষ্ণা মায়া এবং মীর কে অনুকরণ করছিল। তৃষ্ণা মায়ার কাছে উপস্থিত হয়।কাছে ঘেষে বলল “তুই মীর এর সাথে এত কি বলছিস?ও কিন্তু তোর খালাতো ভাই। মানে আমাদের বড় ভাইয়ের মত।প্রেমে-টেমে পড়ে যাস না। বিদেশি ছেলে, না জানি কত প্রেমিক আছে।”
মায়া বলল “তোর কি আমার পেছনে লাগা ছাড়া কাজ নেই।আমি তাকে কেন ভালোবাসতে যাব।” বলে পুকুর পাড় ছেড়ে চলে যায় ঘরের উদ্দেশ্যে।
টেলিফোন এ রিং বেজে উঠলে কলটি রিসিভ করে জয়ন্তন বেগম।তিনি হ্যালো বলার পর অপরপ্রান্ত থেকে আমজাদ এর কন্ঠ ভেসে আসে। “মা’কেমন আছো তোমরা সকলে?
“আমরা ভালোই আছি।তোর খবর নাই বাজান,তুই কই,কবে বাড়ি ফিরবি? বড্ড উতালা হল জয়ন্তন।
“মা’ আমাদের ফিরতে আরো দু’দিন দেরি হবে।এটা বলতেই কল দিয়েছি।” এরপর কলটি কেটে যায়। জয়ন্তন পুনরায় কল দিলে, কলটি ওপাশ থেকে কেটে দেয় আমজাদ।জয়ন্তন খুব হতাশ হল।এক পুত্র কে হারিয়েছে আজ বাইশ বছর। আমজাদ এবং এহসান ছিল তাঁর চোখের মনি। দুইভাই যেন দুই ভাইয়ের রক্ষা কবজ ছিল। এরপর হঠাৎ একদিন শোনা যায় এহসান চৌধুরী আর বেঁচে নেই। জয়ন্তন খুব ভেঙ্গে পড়েছিল সেদিন। তারপর থেকে আমজাদ কোথাও গেলে সে বড্ড উদাসীন হয়ে যায়।
শালুক আসে জয়ন্তন এর কাছে। তাঁকে ভরসা সূচক হাতে স্পর্শ করে বলল “মা চলুন বসবেন।”
তারা সোফায় বসে।শালুক জয়ন্তন কে লক্ষ্য করে বলল “মা’ আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলে ঠিক সময়মতো ফিরে আসবে। তাঁর কিছুই হবে না।”
অন্যদিকে শহরের একটি বেসরকারি কৃষি ইনস্টিটিউট অফিসে বসে আছে থমাস শন এবং আমজাদ। আমজাদ কলটি তখন জয়ন্তন এর মুখের উপর কেটে দিয়েছে। বিষয়টি লক্ষ্য করেছে থমাস।থমাস আমজাদ কে প্রশ্ন করল “তুমি তোমার মায়ের মুখের উপর কলটি কেটে দিয়েছো, এটা কিন্তু ঠিক হয়নি।”
“এখনই হয়ত বিদেশ থেকে কল আসবে।তাই কলটি কেটে দিয়েছি।”
থমাস বেশ গভীর শ্বাস ছেড়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে বলল “তুমি খুবই ভাগ্যবান। তোমার মায়ের কল আসে। আফসোস,আজ বহুবছর আমার মায়ের কোন কল আসে না।”
বলে থমাস বসা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘তোমার মায়ের কল আসে। তুমি ভাগ্যবান। আফসোস আমার মায়ের কল আসে না আজ বহুবছর’ বাক্যটি আমজাদ এর আশেপাশে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমজাদ তখন তাঁর বাড়ির নম্বরে দ্বিতীয় বার সংযোগ করার চেষ্টা করল।
দ্বিতীয় বার টেলিফোন বেজে ওঠায় জয়ন্তন বেশ হকচকিয়ে গেল।শালুক বলল “আপনার ছেলেই হয়ত কল’ চলুন কলটি ধরুন।” জয়ন্তন কলটি রিসিভ করে।ওপাশ থেকে আমজাদ এর মলিন কন্ঠ ভেসে আসে। একটি মধুর ডাক ‘মা’ !এইতো, এখানেই একজন গর্ভধারিনী’জননির সুখ।
জয়ন্তন জবাব দিল “বাপজান, কিছু হইছে তোর!ঠিক আছো বাবা?
“আমি ঠিক আছি মা।” আমজাদ নিশ্চুপ হয়ে গেল। জয়ন্তন ও চুপচাপ। আমজাদ হঠাৎ করে বলল “মা’ আমি কিন্তু তোমায় সে-ই ছোট্ট বেলার মতই ভালোবাসি।” কথাটি শুনে জয়ন্তন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। দৃষ্টটি দেখল শালুক। তাঁর ঠোঁটের ফাঁকে হাঁসি।বলা হয় শাশুড়ির সাথে তাঁর ছেলের সুসম্পর্ক বউয়ের নাকি সহ্য হয় না। কিন্তু শালুক যেন তাঁর উল্টে। তিনি সবসময় চান জয়ন্তন যেন মৃ’ত্যুর শেষ সময় অবধি হাসিখুশি থাকেন।
জয়ন্তন জবাব দিল “কাজ শেষ কইরা জলদি বাড়ি চইলা আইসো বাপজান।”
অপরপ্রান্ত থেকে আমজাদ বলল “দোয়া রাইখো মা।’ জয়ন্তন কল কেটে দেন।
এতক্ষণ ঘটে যাওয়া ঘটনাটি দেখল মীর দোতলা থেকে। দোতলার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়েছিল সে। জয়ন্তন তাঁর ঘরে চলে গেল।মীর তখন উপর থেকে নীচে আসে। বৈঠকখানায় শালুক বসে আছে।এসে মীর খুব নতজানু হয়ে তাঁর কোলে মাথা রেখে শোয়।শালুক একটু নির্বিকার প্রশ্ন করল “মীর, শরীর খারাপ তোর! কিছু হয়েছে বাপ তোর!”
“ছোট মা,একটু শুতে দাও। ভালো লাগছে না। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।”
শালুক মীর এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল “আমি কি তোর মা নই মীর।’ থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলল “গর্ভধারিনী মায়ের মত দুনিয়াতে কেউ হয় না আমি জানি। গর্ভধারিনী মায়ের স্পর্শেও সন্তান সুস্থ হয়ে ওঠে। মায়ের গায়ের গন্ধ মন সতেজ করে তোলে। কিন্তু সে মা থাকতে ক’জন মূল্য বুঝে? হারিয়ে গেলে তখন খুঁজে।”
মীর বলল “আমার মাঝেমধ্যে খুব কষ্ট হয় ছোট মা। মায়ের শূন্যতা আমাকে বিষিয়ে তোলে। ইচ্ছে করে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাই।”
“ও কথা বলতে নেই বাপ।আমি আছিতো। আমি আমার সবটুকু দিয়ে তোকে আগলে রেখেছি, ভবিষ্যতে ও রাখব।”
মীর কোল ছেড়ে উঠে চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
দিন ফুরিয়ে বিকেলের আগমন ঘটল ধরণীতে।সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। সোনালি আলো গাঢ় সবুজ পাহাড়ের গায়ে ঝরে পড়ছে, ঠিক যেন কেউ আগুনের ছিটা ছুঁড়ে দিয়েছে বনজুড়ে। পাহাড়ের নিচে বিস্তৃত এক উপত্যকা।যেখানে কুয়াশা ভেসে বেড়ায় নরম চাদরের মতো। মাঝখানে নীরব এক নদ, তার জলে ভাসে সূর্যের শেষ রশ্মি। চারপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর দূরে কোথাও অচেনা পাখির ডানার শব্দ।
উপত্যকার প্রান্তে আছে এক পুরনো কাঠের সেতু, যেটা পার হলেই দেখা যায়।একটা অদ্ভুত শান্ত গ্রাম। ঘরগুলো কাঠ আর পাথরের তৈরি, ছাদের ধারে শুকনো ফুল ঝুলছে। গ্রামের মাঝখানে একটা বিশাল বটগাছ, তার নিচে পাথরের আসন, যেখানে নাকি বহু বছর আগে কেউ হারিয়ে গিয়েছিল।
হ্রদের ওপারে দেখা যায় একটি প্রাসাদ।দূর থেকে যেন ধোঁয়ার মতো ভাসমান। জানালাগুলো সব বন্ধ, তবু মনে হয় কেউ একফাঁকে তাকিয়ে আছে। বাতাসে ভেসে আসে হালকা চন্দন আর পুরনো বইয়ের গন্ধ।
রাফিদ এবং মীর এমন একটি জায়গায় উপস্থিত হতে পেরে ভীষণ আনন্দিত। আমজাদ চৌধুরী বাড়ির বাহিরে থাকায় তাঁরা বেশ স্বাধীন ভাবে ঘুরতে পারছে। ছোট্ট গ্রামটির কোন বাসিন্দারা বেঁচে নেই।যদিও কেউ বেঁচে থাকে, তবে তাঁরা আর এখানে থাকে না। প্রতিটি ঘরই তালাবদ্ধ। গ্রামটির শেষে একটি নদ।নদ এর ওপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে পাহাড়। পাহাড়টিতে পৌঁছাতে নদটি পাড় হতে হবে।মীর দেখল নদটি।জল গুলো বেশ নীলাকার।এখানের বাতাসে যেন মন মাতানো সুভাষ পাওয়া যায়।মীর রাফিদ কে লক্ষ্য করে বলল “ওদিকে একটা প্রাসাদ এর মত দেখা যাচ্ছে।ওটা কি?”
রাফিদ বলে “ওটা সম্ভবত কোন রাজাদের নগর ছিল। সময়ের সাথে সাথে আজ পরিত্যক্ত।আজ শুধু শেওলা এবং জলের আয়ত্তে প্রাসাদটি।”
“কত বছর হয় এটি পরিত্যক্ত?”
রাফিদ বলল “আমি ঠিক বলতে পারব না।”
মীর খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো প্রাসাদটির দিকে।নদ এর অপরপ্রান্তে। সূর্য নিজ গন্তব্যে ঢেলে পরাতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না কুয়াশার জন্য। প্রাসাদটি দেখে মনে হচ্ছে এখনো জীবন্ত। ওখানকার প্রতিটি মানুষ জীবন্ত। তাঁরা যেন এপারে তাকিয়ে আছে সাহায্যের জন্য।মীর এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো। রাফিদ মীর কে ডাকল।মীর শুনেনি।সে অন্য ধ্যানে মগ্ন। এরপর রাফিদ মীর এর শরীরে স্পর্শ করে ডাকল।মীর হুশে ফিরে।
মীর রাফিদ কে জিজ্ঞেস করে “আচ্ছা, প্রাসাদটি হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়ার কারণ?
“এটার আবার কারণ কি! সময়ের নিয়ম ই এটা।আজ যদি আমরা দুনিয়া থেকে চলে যাই এরপর আমাদের জমিদার বাড়িটিও এরকম পরিত্যক্ত হয়ে যাবে।নদ এর জলে ডুবে যাবে। এরপর ডুবুরিরা আমাদের রাখা স্বর্ণমুদ্রা উত্তোলন করবে।” বলে রাফিদ নিঃশব্দে হাসলো।
মীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষ কেন এভাবে হারিয়ে যায়!কত রাজ্য প্রাচুর্য অর্জন করে,সবাই কত আনন্দ নিয়ে বসবাস করে, এরপর হঠাৎ করেই সবকিছু ধুলোয়মাখা হয়ে পড়ে থাকে।সবাই মাটির সাথে মিশে যায়। থাকে শুধু তাদের স্মৃতি।মীর ঘুরে পুনরায় একবার প্রাসাদটির দিকে দেখে। ততক্ষণে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই সময়ের আগমন ঘটে।
রাফিদ বলল “কাঠের সেতুটি পাড় হতে রিস্ক হবে।আসার সময় তো এসেছি, জানি না এখন যেতে পারব কি না। তাড়াতাড়ি চল।ওপারে আমাদের অশ্ব আছে।”
মীর বলল “চিন্তা করিস না।যেতে পারব।চল।” বলে ছোট্ট গ্রামটির চূড়া থেকে যেতে যেতে বারবার পেছন ঘুরে দেখল মীর।নীরব প্রাসাদটি যেন তাঁকে ডাকছে। কিন্তু নীরবেই।যার কোন শব্দ নেই।
তাঁরা কাঠের সেতুটির কাছে উপস্থিত হয়। সেতুটির নিচ থেকে বয়ে যাচ্ছে জলরাশি।প্রখর জলের স্রোত। তাঁর মধ্যে থেকে বড় বড় পাথর দেখা যাচ্ছে। রাফিদ বলল “মীর, হঠাৎ জলের স্রোত বেড়ে গেছে।যদি সেতুটি ভেঙ্গে নিচে পড়ে যাই, মৃত্যু নিশ্চিত।”
“ভুলভাল না বকে চল। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। অশ্বের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।আমি আবার অশ্বের কান্না সহ্য করতে পারি না।”
পুরানো কাঠের সেতুটি থেকে কড় কড় শব্দ ভেসে আসছে। বাতাসের সাথে সাথে কিছুটা দুলছেও।মীর আগে আগে পা বাড়িয়ে যেতে শুরু করল।রাফিদ পেছনে। ধীরস্থির ভাবে মাঝবরাবর সেতুটির পৌঁছালে রাফিদের পেছন একটা কাঠ ভেঙে যায়।রাফিদ এবং মীর পেছন ঘুরল।রাফিদ কিছুটা ভয় পেল। কিন্তু মীর ভরসা দিয়ে বলল “কিছু হবে না।ভয় পাস না। চলে আয়।”
পুনরায় দুজনে হাঁটা শুরু করে।রাফিদ তখন পেছন থেকে বলল “আমি যদি নিচে পড়ে যাই তাহলে কি হবে বুঝতে পারছিস?
“হ্যাঁ বুঝতে পারছি।”
“কি বুঝেছিস বল?”
“এই, তোকে দেখার আগেই তোর হবু বউ বিধবা হয়ে যাবে” বলে চাপা স্বরে হাসে মীর।
রাফিদ বলল “মজা করছিস, আমার কিন্তু সত্যিই ভয় হচ্ছে।”
“ভয় না পেয়ে চলে আয়।” বলে মীর প্রাই সেতুর শেষ সীমানায় পৌঁছে যায়।
মীর অপরপ্রান্তে পৌঁছে যায়। রাফিদ প্রায়ই সেতুটির শেষ সীমানায় পৌঁছে যায়।সেতুর শেষ কাঠ পাড় হয়ে যেতেই দড়ি ছিঁড়ে রাফিদ নিচে পড়ে যায়।রাফিদ তীর্যক আওয়াজ করল।মীর হতভম্ব হয়ে যায়।রাফিদ তখন সেতুর ছেঁড়া দড়িটা ধরে ফেলে।
মীর বিষ্ময়কর হয়ে উঠল। হঠাৎ যে মুহূর্তে রাফিদ কাঠ ভেঙ্গে পড়ল তখন তাঁর, পৃথিবীটা যেন উল্টো হয়ে গেল। বাতাস হঠাৎ তীক্ষ্ণ ছুরির মতো কানে বিঁধতে লাগল। শরীরের ভারহীনতা যেন কেউ নিচ থেকে টেনে নিচ্ছে রাফিদ কে। অথচ তাঁর উপরে ওঠার চেষ্টা।
এক সেকেন্ডেই মনে হলো ‘শেষ। সব শেষ।
মাথার ভেতর অসংখ্য চিন্তা বিদ্যুৎবেগে ছুটল মীর এর। রাফিদ একবার আতঙ্ক নিয়ে নিচে দেখল। জলরাশি যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর অপেক্ষায় আছে।রাফিদ ভয়ে চুপসে গেল।পরিবার, মুখগুলো, অসমাপ্ত কাজ,সব যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো।চোখের সামনে আকাশ, গাছ, পাথর সব ঘুরছে। বাতাসে শরীরের আঘাতের ধাক্কা, বুকের ভেতর হাহাকার, আর গলার কাছে চিৎকার আটকে থাকা একটি শব্দ।
মীর উপর থেকে হাঁটু মাটিতে রেখে রাফিদ এর দিকে ঝুঁকে বলল “ভয় পাস না।দড়িটা ধরে রাখ।ঠিক তখনই রাফিদের ধরে থাকা দড়িটি থেকে ছিঁড়ে পড়ার শব্দ এলো।মীর তখন দড়িটি উপর থেকে ধরে নিজের হাতে পেঁচিয়ে নেয়। কিন্তু তাঁর পক্ষে নিচ থেকে রাফিদ কে টেনে উঠানো সম্ভব নয়।দড়িটিও ছিঁড়ে যেতে পারে।মীর কি করবে বুঝতে পারল না। সন্ধ্যা নেমে আসছে। চারদিকে কোন জনমানব নেই। ঝুঁলে থাকা রাফিদ চেঁচিয়ে বলল “মীর আমায় টেনে উঠা।” মীর আপ্রাণ চেষ্টা করল। কিন্তু পারছে না।দড়িটিও ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম।
মীর এর অশ্ব তখন পেছন থেকে হ্রেষাধ্বনি তুলল।মীর তখন পেছন ঘুরে।দেখল রাফিদ এবং তাঁর অশ্ব দাঁড়িয়ে আছে।মীর একবার রাফিদ এর দিকে দেখল। এরপর তাঁর অশ্বের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল “অগ্লিন, দড়িটা ছুড়ে দে আমার দিকে।” অশ্ব অগ্লিন মীর এর বাক্য বুঝতে না পারলেও, বিপদের আশঙ্কার কন্ঠস্বর যেন বুঝতে পারল।অগ্লিন শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে পিঠ থেকে দড়ি ফেলে মীর এর দিকে ছুড়ে ফেলে।মীর দড়িটা রাফিদ এর দিকে ফেলে বলল “ওটা ধর।আমি টেনে তুলছি।” রাফিদ ধরল। এরপর মীর এবং অগ্লিন মিলে কোনভাবে রাফিদ কে টেনে তুলে।
রাফিদ উপরে এসে মাটিতে লুটিয়ে শুয়ে পড়ে।মীর ও জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলল।বেশ কিছুক্ষণ পর রাফিদ এবং মীর এর ক্লান্ত দূর হয়।
রাফিদ শোয়া থেকে উঠে বসে।মীর তাঁর দিকে দেখল। রাফিদ ও মীর এর দিকে তাকায়। এরপর দুজন অট্টহাসিতে তলিয়ে পড়ল। হাঁসি থামিয়ে মীর বলে “অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল।”
“হ্যাঁ,আর একটু হলে আমি জলের স্রোতে না জানি কোথায় গিয়ে পৌছাতাম।”
মীর তখন কন্ঠ খাদে নামিয়ে মোহময় কন্ঠে বলল “আমি থাকতে তোর কিছুই হতে দিতাম না।”
রাফিদ মীর এর দিকে ঘুরে তাকালো। চক্ষু শীতল। “আমরা তো ভাই,এর বেশি আজ আর একটা এই সম্পর্কের নাম দেয়া যাক”? রাফিদ এর প্রস্তাব।
“বন্ধু’তাই তো।আজ থেকে আমরাও বন্ধুত্বে পরিচয় নিলাম।” মীর মৃদু হাসল।
সন্ধ্যার আপছা আলো ধরে মীর এবং রাফিদ চৌধুরী নিবাসন এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অশ্ব কে তাঁরা ধীর স্থির গতিতে নিয়ন্ত্রণ করছে।খোলা মাঠ ধরে তাঁরা এগোচ্ছে। চারপাশ সুনসান। তাঁদের থেকে কিছুদূরে ডান এবং বা দিকে সারি সারি মৃ’ত গাছ। রাফিদ চারপাশ দেখে বলল “তাড়াতাড়ি চল। অন্ধকার নেমে আসছে।” রাফিদ কথাটি শেষ করতে না করতেই একটা তীর ফলক এসে তাঁদের সামনে মাটিতে বিদ্ধ হয়। তারা বেশ আশ্চর্য হল। অশ্ব দাঁড়িয়ে যায়। কোথা থেকে তীরটা আসলো দেখার জন্য তাঁরা চারদিকে তাকাল।
The Silent Manor part 2
তখন দেখতে পায় দূরে মৃত গাছ গুলোর স্থান থেকে একজন তীরটা ছুড়েছে। ব্যাক্তিটি অশ্বের-পৃষ্ঠায় বসা।মুখ পাগড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকা। দূরে থাকায় স্পষ্ট ভাবে তাকে চিহ্নিত করা গেল না।মীর নিচে নেমে দেখল তীরের সাথে একটি চিরকুট।মীর চিরকুট টি খুলল।তাতে লেখা “চোখের সামনে প্রিয় মানুষ এর মৃত দেড়টি দেখার মত সৌভাগ্য কারো না হোক।’চাইলে সত্যটা তোমরা উন্মোচন করতে পারবে।” ব্যস। এরপর ছোট করে একটি দৃশ্য আঁকা।যা এখন বোঝা যাচ্ছে না।
রাফিদ জিজ্ঞেস করল “চিরকুটে কি লেখা?…
