The Silent Manor part 32

The Silent Manor part 32
Dayna Imrose lucky

রাত প্রায় নয়টা বাজে। শীতের হালকা কুয়াশা নেমেছে চারদিক জুড়ে।জমিদার বাড়ির আঙিনা নিস্তব্ধ।শুধু মাঝে মাঝে কোথাও থেকে হুহু করে শীতল বাতাস এসে পুরোনো জানালার কপাট নাড়া দিচ্ছে।দূরের বাঁশঝাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকার মৃদু ডাক মিলিয়ে যায় রাতের ঘন অন্ধকারে।
বাড়িটার ভিতরেও যেন এক অদ্ভুত নীরবতা।বড় দালানের উঁচু ছাদের থেকে ঝুলে থাকা তেলের প্রদীপটা দুলছে হালকা হাওয়ায়, তার হলুদ আলো নড়ে নড়ে ছায়া ফেলছে দেওয়ালে। দেওয়ালের ছবিগুলো পুরোনো জমিদারদের মুখ, কঠোর দৃষ্টি,যেন এখনো জীবিত, তাঁরা যেন এখনো চোখ রেখেছে পুরো বাড়ির ওপরে।

দরজার কাছে বসে আছে প্রহরী,গায়ে মোটা কম্বল জড়ানো, হাতে এক লণ্ঠন।মাঝে মাঝে সে কাঁপা গলায় কাশি দেয়, তারপর আবার চুপচাপ তাকিয়ে থাকে অন্ধকার উঠোনের দিকে।মহলঘরে তখন একটি জানালা খোলা। ভিতরে বসে আছেন রশীদ, ভারী শাল জড়ানো গায়ে। সামনে পিতলের হুঁকো থেকে ধোঁয়া উঠছে ধীরে ধীরে।
কুদ্দুস মহলঘরে উপস্থিত হয়। রশীদ বসে বসে ঝিমোচ্ছে। রশীদ এর বিমর্ষ রুপ দেখে কুদ্দুস জিজ্ঞেস করল “তখন চিঠিতে কি লেখা ছিল?চিঠি পড়ার পর থেকেই আপনার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রশীদ ইজি চেয়ারে দোল খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। কুদ্দুস এর প্রশ্ন যেন তাঁর কানে পৌঁছেনি।কুদ্দুস তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।পুনরায় বলল “আপনি চুপচাপ আছেন যে, চিঠিতে কি ছিল? আপনাকে কেউ গালি দেয়নি তো?
রশীদ এবার চোখ মেলে তাকাল কুদ্দুস এর দিকে।দোল খাওয়া বন্ধ করল। কুদ্দুস তাঁর চাহনি দেখে বলল “না মানে, আপনাকে সরাসরি গা’লি দেয়ার সাহস তো কারো নাই।কারো মনের ভেতরে হয়ত ক্ষোভ রয়েছে।আপনার সামনে প্রকাশ করতে পারেনি বলে চিঠিতে লিখে পাঠিয়েছে।”

রশীদ প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না।দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল।চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করল নীরব ভঙ্গিতে। কুদ্দুস ভেবেছিল রশীদ হয়ত ওর উপর রেগে যাবে। কিন্তু না, এমনটি হয়নি। রশীদ চুপচাপ মাথা নিচু করে দৃষ্টি মেঝেতে রেখে পায়চারি করছে। কুদ্দুস রশীদ এর পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে বলল “আপনি কি ভাবছেন এত? আপনার দুঃখ আমার সাথে ভাগ করতে পারেন।”
রশীদ গম্ভীর মুখে বললেন “যে চিঠি পাঠিয়েছে তাঁর বানানে ভুল ছিল।দুটো।লেখার আগে ভালো করে চর্চা করা উচিত ছিল।” বলে রশীদ স্থির হয়ে দাঁড়াল। কুদ্দুস দাঁড়িয়ে বলল “আপনি বানান দেখলেন,কি বলেছে তা দেখেন নাই?
রশীদ ভাবতে শুরু করল। মুখে একরাশ স্তব্ধতার স্রোত বয়ে গেল যেন। আবার ইজি চেয়ারে বসে পড়ল।বললেন

“আচ্ছা কালু,আমি সবথেকে বেশি কাকে ভরসা করি?
“আপনি আপনাকে ভরসা করেন‌।”
“আমার পড়ে আমি কাকে ভরসা করি?
কুদ্দুস সেকেন্ড কয়েক ভেবে জবাব দিল “আপনার বড় ছেলেকে।’
“এরপর?
“আপনার মেজো ছেলেকে।”
“আর কাকে আমি ভরসা করি বলে তোর মনে হয়?
“আপনার চার ছেলে এবং মেয়েকে।তবে আপনি আমাকেও অনেক ভরসা করেন।”
রশীদ আশ্চর্য চোখে কুদ্দুস এর দিকে তাকিয়ে বলল “তুই কি আমার একমাত্র বোনের কথা বলতে ভুলে গেছিস? নাকি তোর মনে হয়েছে আমি ওকে ভরসা করি না?”

“সত্যি বলতে আপনার বোনের কথা আমি ভুলে গেছি।” কুদ্দুস মাথা নত করল।রশীদ বলল “আচ্ছা, কাউকে বিশ্বাস বা ভরসা করলে কি সে বিপরীতে আমাদের ধ্বং’স করতে চাইবে?”
‘চাইতেই পারে।কখনো কখনো ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকে বাঘের মত ধাবা।”
“কিন্তু যাকে আমি ভরসা করি সে-ই কেন আমাকে শেষ করতে চাইবে?
“এই প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছেই আছে। খুঁজে দেখুন পেয়ে যাবেন।রাত বাড়ছে, আপনার আর কোন ফরমায়েশ থাকলে বলুন”

“না,যা তুই যা, আমি কিছুক্ষণ একা থাকি।আজ মাথাটা ধরেছে। ঘুমিয়ে যেতে হবে তাড়াতাড়ি।রাতে খাবারের জন্য সবাইকে ডেকে নিয়ে নিচে আয়।জলদি খেতে হবে।”
“ঘুমালে অর্ধেক চিন্তা দূর হয়ে যায়।ঘুমান।”
“ঘুমের ঘোরে চিন্তা দূর হয় না গর্ধুব। তখন চিন্তারা কিছু সময়ের জন্য দূরে সরে যায়।যখনি ঘুম ভাঙ্গবে তখনি চিন্তারা এসে মস্তিষ্কে জুড়ে বসবে।তোকে এসব বলে লাভ নাই।তুই বুঝবি না।”
“আমাকে বলে লাভ নাই,বুঝব না, তারপরও আমাকেই বলেন।আপনি নিচে আসুন।আমি সবাইকে ডেকে আনছি।” কুদ্দুস চলে যায়।

রশীদ ড্রয়ার থেকে সিগার বের করে টানতে শুরু করল।চিঠি কে পাঠালো?কে সাবধান করলো? নিশ্চয়ই যে চিঠি পাঠিয়েছে সে তালুকদার বংশের ক্ষতি চায় না। কিন্তু আড়ালে থেকে চিঠি কেন পাঠিয়েছে? সামনাসামনি এসে কেন বলল না!হয়ত তাঁর হাত পা বাঁধা।কোন কারণে সামনে আসতে ভয় পাচ্ছে।যার ফলে লোক চক্ষুর আড়ালে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে মূলত ইতি টেনে নাম লেখা থাকে। কিন্তু আজকের চিঠিতে কোন নাম ছিল না। কয়েকটি অক্ষর এর মাধ্যমে সতর্কতা বার্তা‌। রশীদ ভাবছে।কে দিতে পারে চিঠিটা? কিন্তু ভাবনার সমাধান মিলছে না।
লালচে বেলে পাথরের দেয়াল এর দিকে এগোলো রশীদ। তাঁর স্ত্রী ফারিনা বেগমের ছবির দিকে তাকাল। তাঁর চোখ দুটি গভীর, যেন তাতে কেউ একবার তাকালে ফেরার পথ ভুলে যায়।কখনও শান্ত, কখনও ঝড়ের মতো দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা ভাষায় বোঝানো যয় না। তার চুল ঝরে পড়ে নদীর ঢেউয়ের মতো, প্রতিটি গোছা যেন রাতের অন্ধকারের টান।বাতাস এলেই ওরা নরমভাবে দুলত, যেন সুরে বাঁধা এক নিঃশব্দ সংগীত।

ফারিনা বেগমের হাঁটার ধরণ ছিল আলাদা। যেন মাটিও তাঁর পদক্ষেপ চিনে নিত।শরীরের প্রতিটি ভঙ্গি ছিল মোলায়েম। আত্মবিশ্বাসে ভরা মন।যেন চারপাশের দৃষ্টি তাঁর জন্যই থেমে গেছে।তাঁর কণ্ঠ ছিল কোমল, অথচ তাতে অদ্ভুত এক ক্ষমতা ছিল।আদেশ দিলে যেন দাস দাসীরা কাঁপতে শুরু করত।
ফারিনা বেগম চলে গেছে আজ একুশ বছর। গত একুশ বছরে সে একটি বারের জন্যও প্রিয়তমা স্ত্রীকে ভুলেনি।আজ প্রচন্ড মনে পড়ছে তাঁকে। দুঃশ্চিন্তায় ভুগছে আজ রশীদ।ফারিনা বেগম বেঁচে থাকলে আজ তাঁকে শান্তনা দিত,হয়ত নতুন নতুন পদক্ষেপ এর জন্য উৎসাহিত করত।তিনি আজ নেই। রশীদ তাঁর অভাব টা যেন আজ বেশিই অনূভব করছে।

ফারিনা বেগমের সাথে ফারদিনার মিল পুরোপুরি।চোখ কান,নাক,তেজ,রাগ অভিমান সবকিছু। তাঁদের মা মেয়ের মুখাবয়বে এমন সাদৃশ্য যে, দূর থেকে দু’জনকে আলাদা করা দুষ্কর। রশীদ কখনো কখনো ফারদিনার মধ্যে ফারিনা কে খুঁজে পায়।ফারদিনা,ফারিনা বেগমের গর্ভে থাকা থাকা কালীন রশীদ বলেছিলেন, এবার যদি আমাদের মেয়ে হয় তবে ওঁর নাম রাখব ফারদিনা। তোমার নামের সাথে মিল রেখে।’ফারদিনা দুনিয়ার আলো দেখেছে ঠিকই কিন্তু ফারিনা বেগমের দুনিয়াটা সেদিন অন্ধকার হয়ে যায়।ফারদিনা জন্মের দিন রশীদ বসে ছিলেন অন্দরমহলে। একজন দাসী এসে খবর দিয়েছিল, আপনার মেয়ে হয়েছে।সেদিন সে অনেক খুশি হয়েছিল।ঠিক তাঁর কিছুক্ষণ পর আর একজন দাসী এসে বসেছিল আপনার স্ত্রী আর বেঁচে নেই।

রশীদ এর চোখে জল জমল।লন্ঠন এর আলোয় মুখটা যেন টালমাটাল করছে। স্তম্ভিত হয়ে চেয়ারে বসল।ছড়িটা মেঝের সাথে ঠেকিয়ে রেখেছে।আজ তাঁর মনে হচ্ছে তাঁর জীবন থেকে একটি তাঁরা হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে শক্তি। মস্তিষ্কে জমে থাকা ভালোবাসা উদ্দীপনায় হঠাৎ যেন আজ তীব্র ভাবে জেগে উঠল।
ফারদিনা নিজ ঘরে পায়চারি করছে।প্রতিবারই মেঝেতে পা ফেলাতে দমদম আওয়াজ ভেসে উঠছে। ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড রাগে ফাটছে।আজ এত চেষ্টা করেও একবার ঘরের বাইরে বের হতে পারেনি। ঝিলমিল ফারদিনার অভিব্যক্তি দেখে জিজ্ঞেস করল “রাগ মেঝেতে না দেখাইয়া তোর ভাইদের দেখান উচিত।ভুল জায়গায় রাগ দেখাইয়া লাভ নাই।”

“আহ চুপ করতো।ভাইদের উপর রাগ উঠছে অনেক। জীবন টা আমার,আমি আমার খুশি থাকার সিদ্ধান্ত নেব,তা নয়, ওঁরা আমাকে পথ দেখাবে।আর সেই পথে নাকি আমাকে চলতে হবে।”
“হবেই তো। সংস্কার এর বাইরে গেলেই বিপদ।তুই হইলি জমিদার বংশের মাইয়া তোর এসব মানতেই হইবো।”
“কেন,সিরী ফারহাদ,লায়লি মজনু,এরা কি প্রেম করেনি।প্রেম ভালোবাসা ধনী গরীব দেখে হয় না।”
“এগুলা তুই আর আমি জানি এবং মানি, তারমানে এই না যে তোর ভাইয়েরাও মানব।” ফারদিনা পায়চারি বন্ধ করে খাটের উপর বসে। ঝিলমিল বলল “তুই কি জানোছ সিরীর প্রেম অসফল ক্যান ছিল?
“কেন?” ফারদিনা গভীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করল।
ঝিলমিল ফারদিনার কাছে এগিয়ে বলল “

ফারহাদ ছিল এক সাধারণ ভাস্কর, কিন্তু অসাধারণ প্রতিভাবান।তাঁদের রাজ্যের রাজকন্যা সিরী কখনও তাকে “শিরিন” বলেও ডাকত কেউ।সে ছিল রূপে, বুদ্ধিতে, কোমলতায় অতুলনীয়া।একদিন ফারহাদ রাজপ্রাসাদের ফোয়ারা নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁকে দেখল।সেই এক দৃষ্টিতেই তার জীবন বদলে গেল।
রাজকন্যার সঙ্গে এক সাধারণ শিল্পীর প্রেম সম্ভব নয়।রাজা তাতে রুষ্ট হলেন।ফারহাদকে দূরে সরিয়ে দিতে রাজা এক কঠিন কাজ দিল
বলল

“যদি তুমি পাহাড় কেটে এর মধ্য দিয়ে নদী আনতে পারো, তবে সিরী তোমার হবে।”
ফারহাদ প্রেমে পাগল, হাতে হাতুড়ি তুলে নিল।
দিন-রাত সে পাথর কেটে চলল, রক্ত ঝরল কিন্তু থামল না।তার হাতের আঘাতে পাথর গলতে লাগল, পাহাড় কেঁপে উঠল
মানুষ বলত, “ওর প্রেমের জোরে পাহাড়ও নত হয়েছে।” এরপর যখন কাজ প্রায় শেষ, তখন রাজা ভয় পেল “যদি ফারহাদ সত্যিই সফল হয়, তবে তাঁর মেয়ে হারাবে।তাই এক ধূর্ত দূত পাঠিয়ে মিথ্যে খবর দিল।“সিরী মারা গেছে।”
ফারহাদ এমন খবর শুনে কিছু না বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসল।তারপর হাতের কুড়াল নিজ বুকে বসিয়ে দিল।রক্ত মিশে গেল সেই পাহাড়ের পাথর।

সিরী জানতে পারল, ফারহাদ তাঁর জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছে।এমন সংবাদ শুনে সে দৌড়ে গেল সেই পাহাড়ে।তাকে জড়িয়ে ধরে সেও শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল সেদিন।দু’জনের দেহ পাশাপাশি পড়ে রইল।যেন মৃত্যুও আলাদা করতে পারেনি তাঁদের। কিন্তু এই দুনিয়াতে তাঁদের প্রেম সফল হয়নি।
ফারদিনা গভীর শ্বাস ফেলে বলল “কিন্তু আমার প্রেম সফল হবে।নয় দেখবি আমিও সিরীর মত ম’রে যাব।”
“ধুর,আগেই মরার কথা বলিস ক্যান। চেষ্টা ছাড়া ব্যর্থ হইতে নাই।”
“সুফিয়ান আমাকে না পেলে সত্যিই মরে যাবে।”
“আমার তো মনে হয় সুফিয়ান তোরে ভালোই বাসে না।”
ঝিলমিল এর মুখে এরকম কথা শুনে ফারদিনা আচমকা চমকে উঠল যেন।নিবীড় কন্ঠে বলল “কি বলছিস তুই এসব?

“আমি যাই বলি,তাতো তুই বিশ্বাস করবি না।মনে হইলো তাই কইলাম। আবার আমার ধারণা ভুল হইলেও হইতে পারে।”
“তোর হঠাৎ এমনটা মনে হল কেন?
“আমি অনেক কিছুই জানি।”
“কি জানিস?
“কইতে আমার লজ্জা করে।”
“যা বলবি খোলামেলা ভাবে বল।”

“আমার অহন কইতে মনে চায় না।পড়ে কমু।” বলে ঝিলমিল ঠোঁট চেপে হাসল।যেন ও লজ্জা পাচ্ছে।
ফারদিনা বালি ঘড়ির দিকে তাকাল।সময় এখন রাত ঠিক দশটা। সুফিয়ান হয়ত এখনো ক্ষেতের মাঝে বসে আছে।ফারদিনা আন্দাজ করে জানালার পাশে গেল।জানালা খুলে দিতেই দমকা হাওয়াতে তাঁর চুল গুলো উড়ে গেল।একটা প্রজাপতি এসে ফারদিনার কাঁধে বসে।সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। কালচে রঙের প্রজাপতি।কালচে হলেও রঙটা চিকচিক করছে।ফারদিনা প্রজাপতি কে এড়িয়ে ক্ষেতের দিকে দেখল। সুফিয়ান নেই।ফারদিনা বিষন্ন মনে চারপাশ দেখল। যতদূর চোখ গেল ততদূর অবধি তাকাল। কোথাও সুফিয়ান নেই। তাঁর এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়াটা ফারদিনার কাছে অস্বাভাবিক মনে হল। কাঁধে থাকা প্রজাপতির দিকে তাকিয়ে জানালা থেকে সরে গেল।
ঝিলমিল বলল “কি হল, সুফিয়ান নাই?

“না,হয়ত আমার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে চলে গেছে।”
“আজ এত তাড়াতাড়ি ধৈর্য শেষ হইয়া গেল তাঁর? আশ্চর্য।”
“তোর কি আমার মন ভাঙ্গা ছাড়া আর কাজ নাই?
“অনেক কাজ আছে।তোর লইগাই করতে পারি না।” বলে ঝিলমিল ফারদিনার কাঁধের প্রজাপতির দিকে দেখল। হঠাৎ করে প্রজাপতিটা ডানা মেলানো বন্ধ করে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে ফারদিনার শরীর বেয়েই মেঝেতে পড়ে যায়।এক পর্যায়ে ও মা’রা যায়। ঝিলমিল এবং ফারদিনা দুজনেই অবাক হল।একে অপরের সাথে চোখ আলাপ করল। ঝিলমিল মেঝেতে বসে বলল “জানিস,কারো শরীরে বইসা যদি প্রজাপতি মা’রা যায় তাইলে তাঁর অমঙ্গল হয়।”

“কি ধরণের অমঙ্গল?
“কত ধরণেরই তো হয়।”
ফারদিনা দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করার আগে কুদ্দুস উপস্থিত হয়। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করে।বলল “ সরদার খেতে ডাকছে।চলুন।”
খাবারের টেবিলে নানান ধরণের খাবার সাজানো।
সাদা নতুন ধানের ভাতে গন্ধে ভরপুর, ধোঁয়া উঠছে।মুগ ডালের খিচুড়ি, ঘিয়ের ছোঁয়া, উপর থেকে ভাজা পেঁয়াজের কুঁচি ছড়ানো।চিংড়ি মালাইকারি পুরু নারকেল দুধে রান্না, এলাচ-দারচিনির গন্ধ।ইলিশ ভাজা,রুই মাছের কালিয়া সোনালি তেলে ঝলমল করছে।খাসির রেজালা, নরম মাংস, ঘন সাদা ঝোলে ভাসছে বাদাম-পেঁয়াজের পেস্টে।বেগুন ভর্তা ও টমেটোর চাটনি জিভে লেগে থাকা টক-মিষ্টি।একটা প্লেটে কয়েক ধরণের আচার রাখা।প্রতিটি প্লেটে সামান্য কর,সন্দেশ, রসগোল্লা, ক্ষীরমোহন।

রশীদ তালুকদার গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলেন।সাথে তার চার ছেলে।জেবুন্নেছা খাচ্ছেন না। ভাতের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে গোরাচ্ছেন।মন ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।তাঁর সাথে ফারদিনাও খাচ্ছে না।রায়ান ফারদিনার দিকে তাকিয়ে বলল “তুই খাচ্ছিস না কেন?
“আজকাল খেতেই ইচ্ছে করছে না।” ফারদিনার সত্যিই খেতে ইচ্ছে করছে না।বলল “তোমরা খাও,আমি আসছি।” বলে টেবিল থেকে উঠে যেতেই রশীদ বললেন “রাতে কখনও না খেয়ে থাকতে নেই। অল্প হলেও খেতে হয়।কত পদ রাখা, কিছু একটা খেয়ে নে।”
ফারদিনা বাধ্য মেয়ের মত শান্ত হয়ে বসল। টেবিলে রাখা সমস্ত খাবারের দিকে চোখ বুলাল। তাঁর নজর কারলো আচার।কয়েক পদের আচার।ফারদিনা আচার এর বাটিটা কাছে টেনে বলল “আচার। আজকে আচার খেতে ইচ্ছে করছিল।আমি এটাই খাব।”

জেবুন্নেছা বললেন “তুই তো কখনোই আচার খাসনা।আজ খাবি কেন?
“আজ খেতে ইচ্ছে করছে তাই খাব। আপনার সমস্যা?”
“তুই যা খুশি খা, তাঁতে আমার কি।”
ফারদিনা জেবুন্নেছার কথা এড়িয়ে আচার খেতে শুরু করল।আদিব ফারদিনার দিকে চেয়ে বলল “শুধু আচার খাসনা। সাথে অন্য কিছু খা।পড়ে শরীর খারাপ করবে।”

“অন্য কিছু খেতেই ইচ্ছে করছে না। খাবারের দিকে তাকালেই বমি আসছে।”
রায়ান খাওয়া বন্ধ করে বলল “তোর শরীর খারাপ নয়তো,হাকিম কে খবর দেব?”
“অস্থির হয়ে যেও না। সামান্য খেতে পারছি না বলে হাকিম কে খবর দিতে হবে না।”
কুদ্দুস পাশ থেকে বলল “না খেয়ে থাকলে আরো শরীর খারাপ করবে। কিছু খেয়ে নিন।”
ফারদিনা মুখে বিরক্তি ছাপ এনে বলল “উফ্ এক কথা বারবার বলতে পারব না।তোমরা খাও।আমি ঘরে যাচ্ছি।” ফারদিনা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।সাথে আচার এর বাটিটা নিল। এরপর দোতলায় তাঁর ঘরের দিকে চলে যায়।”
রায়ান রশীদ এর দিকে তাকিয়ে বলল “আব্বা,ফারদিনার শরীর বোধহয় ভালো না।আমি লোক পাঠাচ্ছি হাকিম এর কাছে। চিকিৎসা দরকার।”
রশীদ গভীর গলায় বললেন “তোরা যা ভাল মনে করিস। তোদের বোন, ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব,কর্তব্য তোদেরও আছে।”

সুফিয়ান রাতের আঁধারে চাঁদনীর আলোর সাহায্যে দিক হারা পথিক এর মত হাঁটছে। একবার তালুকদার বাড়ির দিকে তো একবার তাঁর বাড়ির দিকে যাচ্ছে।বেশ কিছুক্ষণ ধরে এভাবেই হাঁটছে।ভাবছে,এই বুঝি ফারদিনা এসে অবাক করে দিয়ে বলবে ‘আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলে?’।স্বপ্ন-স্বপ্নই রয়ে গেল।ফারদিনা আসেনি।
সুফিয়ান এর হাতে সিগার।দু আঙ্গুলের মাঝে ধরে রেখেছে ঠিকই কিন্তু ফুঁকছে না।সে এখন দাঁড়িয়ে আছে তাঁর বাড়ির সামনে।রাতের নীরবতায় বাড়ির আঙিনায় গোড়ার গাড়ি ধীরে ধীরে ঢুকল। মাটির সাথে চাকার খসখসানি,কাঠের চাকার টকটক শব্দে পুরো রাস্তা যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। হালকা কাঁপুনি ছড়াল গাড়ির কাঠের সিটে বসে থাকা সারথীর কাঁধে।দূরে ক্ষেত থেকে কাঁদা মাটির গন্ধ ভেসে আসছিল।ধীরে ধীরে গাড়িটি থেমে গেল।গাড়ি থেকে টকটক খসখসানি আর কিছু মেয়েদের ফিসফিস করে কথা বলার শব্দ।

The Silent Manor part 31

সুফিয়ান মেয়েদের আওয়াজ পেয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।গাড়ি থেকে চারজন মেয়ে নেমে সারথী কে পাওনা বুঝিয়ে দিল।সারথী চলে যায়। তাঁরা সোজা সুফিয়ান এর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। সুফিয়ান রাঙার কাছে দাঁড়ানো।মেয়ে গুলো তাঁর কাছে আসতে আসতে তাঁদের চেহারা লন্ঠন এর আলোয় পরিষ্কার ভেসে উঠল।বাইজি কন্যা,মেহের,কাশমিরা,সায়রা। সুফিয়ান তাঁদের দেখে বিড়বিড় করে বলল ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রজীম।এই শয়তান এর দল আমার বাড়িতে কেন?

The Silent Manor part 33

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here