The Silent Manor part 35

The Silent Manor part 35
Dayna Imrose lucky

ভোর বেলার পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে চারপাশ মুখরিত হল। মহলঘরের মেঝেতে সূর্যের কড়া ঝিলিক পড়েছে।শীত প্রায়ই শেষের দিকে এখন। রায়ান এর ডাকে ফারদিনার ঘুম ভাঙ্গে। হকচকিত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।বোধহয় তাঁর আশেপাশের সবাই এই শব্দ শুনতে পাচ্ছে।তার চোখ দুটো হঠাৎ গোল হয়ে উঠল, মণি যেন প্রসারিত অন্ধকারে ডুবে গেল। পলক পড়ছিল না।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রায়ান এর দিকে।ভয়ের তীব্র ছায়া যেন চোখের গভীরে জমে উঠেছে।পাশেই রশীদ তালুকদার।সে বন্দিশালায় বন্দি নয়। মহলঘরে।রশীদ ফারদিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন “ভয় পেয়েছিস?

ফারদিনা বিস্ময়ে তাকাল রশীদ এর দিকে।এরপর রায়ান,সায়েম,আরিব,আদিব এবং কিছু দাসীরা উপস্থিত, তাঁদের দিকে তাকাল।দাসীদের হাতে খাবারের থালা।ফারদিনা সবার দিকে বেশ আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেখল। গতরাতে মাথায় আঘা’ত পেয়েছিল।মনে করতেই মাথায় হাত দিল, সবকিছু ঠিকঠাক আছে।স্বপ্ন দেখছিল ফারদিনা। কঠিন স্বপ্ন।সে খুশি হয়েছে,স্বপ্ন বলে।যা দেখেছে সবই মিথ্যে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।ফারদিনা রশীদ এর প্রশ্নের জবাব দিল “খা’রাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম।তাই ভয় পেয়েছি।”
‘তোকে নিয়ে গতকাল চিন্তায় ছিলাম। ঘরে না পেয়ে বাইরে খুঁজতে গেছিলাম। এরপর জানতে পারি তুই মহলঘরে।তোর শরীর ঠিক আছে? রায়ান বলল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমি ঠিক আছি।’
আদিব ফারদিনার পাশে বসল। “হাকিম কাজের জন্য দূরে গেছেন।দু’একদিনে ফিরে আসবে। এরপর তোর চিকিৎসা করাব। ততক্ষণ পর্যন্ত তুই ঠিক থাক,এই কামনা করি।’
ফারদিনা শরীরে জড়ানো শালটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। গতরাতে স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু এখনো তা বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর। সবকিছু কতটা স্পষ্ট ভাবে স্বপ্নের জগতে ফুটে উঠেছিল।ভাবতেই ফারদিনার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠছে। সুফিয়ান এর সাথে আজকাল বেশি একটা দেখা করবে না বলে নিশ্চিত করল। কেননা তাঁর উপর নজরদারির জন্য খাস লোক রাখা হয়েছে।সে কখন ফারদিনাকে সুফিয়ান এর সাথে দেখে ফেলে বলা যায় না।ফারদিনা আজকাল হতাশার চাদরে পুরোপুরি যেন ঢেকে যাচ্ছে। স্বপ্নের ভয়টা এখনো যায়নি।এত তাড়াতাড়ি যাবেও না। রশীদ ছড়ি হাতে উঠে দাঁড়ালো। ধীরস্থির কন্ঠে দাসীদের বলল “ফারদিনার যত্ন কর।’ এরপর ফারদিনার দিকে তাকিয়ে বলল

‘হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা সেরে নে।’
“কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।যখন খেতে ইচ্ছে করছে তখন খাব।”
আদিব ফারদিনার কপাল ছুঁয়ে বলল “শরীরে তো জ্বর নেই। তাহলে হঠাৎ তোর কি হল ?
“জানি না।”
‘যা,তুই হাত মুখে ধুয়ে আয়। আমি আজ তোকে নিজের হাতে খাইয়ে দেব।” ফারদিনা বাধ্য হল। বিছানা থেকে নেমে হাত মুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে প্রবেশ করে। রশীদ সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন “তোমরা দেখো,ওকে খাওয়াতে পারো কি না। আমাকে বের হতে হবে। দারোগার কাছে যাব।” বলে মহলঘর থেকে বেরিয়ে যান। কুদ্দুস তাঁর পেছন পেছন গেল।ফারদিনা হাত মুখ ধুয়ে আসল। বিছানায় বসে পড়ে। তিনজন দাসী কয়েক পদ খাবার হাতে এগিয়ে আসল।দুধ ও মালাই।ঘি-পরোটা আর রুটি।আলুর দম।ডিম ভাজা।সন্দেশ। সবগুলো খাবারই ফারদিনার পছন্দ। কিন্তু আজ খাবার এর দিকে তাকালেই তাঁর শরীর ঝিম মেরে উঠছে।আদিব কে বলল “ভাই,তোমরা যাও।আমি পড়ে খেয়ে নেব।”

“পড়ে না, এখুনি খেতে হবে। নিজের দিকে দেখেছিস,চোখ মুখ একদম শুকিয়ে গেছে।”
ফারদিনা বিরক্ত হল।তখন উপস্থিত হল জেবুন্নেছা।ফারদিনাকে আপ্যায়ন করে খাওয়ানো হচ্ছে,যা ওনার সহ্য হচ্ছে না।মুখ ভেংচে মনে মনে বলল ‘যত্যসব আদিখ্যেতা।’ ফারদিনা একবার রায়ান এর দিকে তাকাল।সে জানালা থেকে বাইরে দেখছে।সায়েম বসে বসে সিগার টানছে।আরিব চেয়ারে বসে ফারদিনার দিকেই দেখছে। তাকে জোড় করে খাওয়ানো চেষ্টা করা হচ্ছে। বিষয়টি তাঁর সাথে অস্বাভাবিক মনে হল।খাবারে বি’ষ আছে,বলে মনে করল। তাঁর ভাইয়েরা সত্যিটা জেনে এখন না জানার অভিনয় করছে, সে প্রমাণ ছাড়াই নিশ্চিত হল। একদিন এক অচেনা ব্যক্তি তাঁর কাছে চিঠির মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছিল -সে যার উপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করছে, সে-ই তাঁর ক্ষতির কারণ হবে। তাঁর জীবনের ইতি টানবে।’

আদিব খাবারের লোকমা তুলে ধরল।আদিব কে ফারদিনা ভরসা করে। সে-ই আজ খাবারের জন্য জোড় করছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।আদিব বলল “কি ভাবছিস,হা কর!’
ফারদিনা বলল ‘তোমরা খেয়েছো?
“না,তোকে খাইয়ে খাব।’

“তুমি আগে খাও।নয় আমি খাব না।’ আদিব বিনা দ্বিধায় এক লোকমা খাবার নিজের মুখে তুলে নিল। এরপর ফারদিনার মুখে তুলে দিল।ফারদিনা আদিব এর কন্ঠনালির দিকে তাকিয়ে আছে।খাবার চিবোচ্ছে।গিলছে না।সেও চিবোচ্ছে।আদিব যতক্ষণ না গিলবে ততক্ষণে গিলবে না।আদিব সেকেন্ড কয়েক পর গিলে ফেলল।ফারদিনা দেখল। অবশেষে সে নিশ্চিত হল খাবারে বি’ষ নেই।ফারদিনা প্রথম লোকমা খেলেও দ্বিতীয়বার এর সময় বমি ভাব চলে আসে।হঠাৎ ফারদিনার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বুকের ভেতর কেমন উথালপাথাল,বসা থেকে উঠে ছুটে গেল বাথরুমের কোণে।পরের মুহূর্তেই গলা থেকে জোরে বেরিয়ে এলো বমির শব্দ। দাসীরা এগিয়ে গেল জল হাতে।আদিব সহ সবাই বেশ আশ্চর্যজনক ভাবে তাকাল। জেবুন্নেছা কপাল আধভাজ করে দেখছে।রায়ান আরিব কে বলল “ওর শরীর অনেক খারা’প। জলদি হাকিম কে আনতে হবে।’

আদিব একজন দাসীকে বলল ‘আপাত ওর বমি কমার কোন উপায় আছে?
দাসী বলল ‘টক,টক খেলে বমি কমবে।’
‘তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, দ্রুত নিয়ে আয়।’ দাসী ছুটে যায় রান্নাঘরে।ফারদিনা আপাতত নিজেকে সামলে নিয়েছে।দাসীরা খাটে এনে বসায়। আদিব বেশ আদুরে গলায় বলল “ঠিক হয়ে যাবি।আমরা দেখছি হাকিম কবে ফিরবেন।খোঁজ করছি,অন্য হাকিমদের। এই ঘরে থাকবি, নাকি তোঁর ঘরে দিয়ে আসব?
“আমার ঘরে যাব।’

ফারদিনা নিজ ঘরে এসে শুয়ে পড়ে।সাথে তাঁর ভাইয়েরা। জেবুন্নেছা পান মুখে বসল একপাশে। ততক্ষণে ঝিলমিল ছুটে আসে ফারদিনার কাছে।ওর হাতে টক জাতীয় আচার।লেবু,তেঁতুল থেকে শুরু করে কয়েক ধরনের আচার। রান্নাঘরে রান্না করতে ছিল ঝিলমিল।একজন দাসী তখন ফারদিনার কথা বললে আঁচার নিয়ে হাজির হয়।আদিব ঝিলমিল কে বলল “আমার বোনের যত্ন নে।ওকে টক খাওয়া।বমি দিয়েছে।”
জেবুন্নেছা পিক ফেললেন পিকদানিতে। এরপর বললেন “আগেই বলেছিলাম অঘটন ঘটবে।এখন দেখেছিস তো,কে জানে কোথা থেকে কার ফসল নিজের…! বাকি কথা বলল না।তার কারণ,আদিব রাগান্বিত চোখে তাঁর দিকে তাকিয়েছে।বলল “কোথা থেকে কি অঘটন ঘটিয়েছে মানে?কি বলতে চাইছেন আপনি?
“তোরা ছেলে মানুষ,এই ধরনের লক্ষণ তোরা বুঝবি না। যা,হাকিম কে নিয়ে আয়, সে-ই বুঝিয়ে দেবে।”
“এই ধরনের লক্ষণ বুঝব না মানে? রায়ান এগিয়ে এল। আবার বলল “অসুস্থ হতেই পারে,হয়ত পেটে সমস্যা হয়েছে, খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করে না, সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরে বেরিয়েছে।তাই এমনটা হয়েছে।”
জেবুন্নেছা হেসে বলল “আমার কথা বাসি হলে মিষ্টি হবে।যত দ্রুত সম্ভব হাকিম কে নিয়ে আয়। বেশি দেরি হয়ে গেলে তোরা হয়ত নতুন মেহমান পাবি।”

সায়েম প্রচন্ড রেগে গেল। জেবুন্নেছা পেটে রেখে রেখে কথা বলছে। কিছু পরিষ্কার করে বলছে না।ফারদিনার রেগেমেগে জেবুন্নেছার দিকে তাকাল। কিছু বলল না। কিছু বললেই ঝগড়া বেঁধে যাবে।ফারদিনার এখন মোটেই ইচ্ছা করছে না ঝগড়া করতে। নিজেকে বড্ড ক্লান্ত লাগল। ঝিলমিল ফারদিনার দিকে আচার এগিয়ে দিল।সে প্রথমেই কাগজি লেবুর একটা টুকরা হাতে তুলে নিল।লেবুর গন্ধ নাকে আসতেই ফারদিনার স্নায়ুতন্ত্র যেন শীতল হল। লেবুতে আছে সাইট্রিক অ্যাসিড।এটি পেটে হজম রসের নিঃসরণ বাড়ায়, ফলে খাবার দ্রুত হজম হয় ও বমি ভাব কমে।
ফারদিনা বসে বসে কয়েক টুকরো খেল।রায়ান এবং আদিব অপেক্ষা করছে ফারদিনা কখন বলবে,এখন আমি ঠিক আছি।’অপেক্ষা করতে না পেরে রায়ানই জিজ্ঞেস করল “ এখন ঠিক আছিস? বমি ভাব কমেছে?

“হুঁ।তোমরা যাও,আমি ঠিক আছি।”
আদিব ঝিলমিল কে লক্ষ্য করে বলল “ ওর খেয়াল রাখিস!’ বলে যেতেই ফারদিনা বলল “ভাই, সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকলে শরীর আরো খারাপ লাগবে।একটু বাইরে বের হই? প্রকৃতির মাঝে বের হলে ভালো লাগবে’” ফারদিনার কন্ঠে অনুরোধ।রায়ান রাজি হল না।সায়েম রায়ান এর দিকে তাকাল।আদিব বলল “আচ্ছা, ঘুরে আয়। সাথে ঝিলমিল কে নিয়ে যা।তবে বাড়ির আশেপাশে অবধি সীমাবদ্ধ।এর থেকে দূরে যাবি না।ঠিক আছে?
ফারদিনা মাথা কাত করে বোঝাল,সে বুঝেছে।
জেবুন্নেছা রাগে জ্বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রায়ান,আদিব,সায়েম তাঁরাও বেরিয়ে যায়। ঝিলমিল ফারদিনার ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বলল “তোর সত্যিই কি হইছে বলবি তো?
“আমার সত্যিই আজকাল খেতে ইচ্ছে করছে না। শরীর ভালো লাগছে না।”
“এমন কিছু করনি তো যাতে,তোর ক্ষতি হয়?’ ফারদিনার হঠাৎ করে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন নিস্তেজ হয়ে গেল।মাথা আওড়ালো ‘না।’

সকাল আটটার দিকে ঘুম ভাঙ্গে সুফিয়ান এর।এখনো বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। সাধারণ কেউ এত দেরিতে ঘুম থেকে উঠে না।কেউ দেখলে বলবে জমিদার এর মত ঘুমাচ্ছে কাজ কর্ম ফেলে রেখে।কাজ কর্ম আছে।ফসল তুলতে হবে।বদরু, হাবলু, লাল মিয়া, সোলেমান কে যবে থেকে কাজে লাগিয়েছে,তখন থেকেই সুফিয়ান যেন একটু বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পেয়েছে।আজ ওদের পারিশ্রমিক দেয়ার দিন। পারিশ্রমিক পেয়ে নিশ্চয়ই ওঁরা খুশি হবে। কাজের পর যখনই শ্রমিক, কৃষক, পারিশ্রমিক পায় তখনই ওদের ঘাম ঝড়ার কষ্ট ভুলে যায়।

সুফিয়ান উঠছে না। গতকাল সারারাত প্রায়ই জেগে ছিল।ফারদিনা চলে যাওয়ার পর রাঙার কাছে বেশ অনেক্ষণ বসে ছিল। ঠান্ডায় হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল। র’ক্ত চলাচল প্রায়ই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এরপর ঘরে ঠুকে বিছানায় শোয়। শুয়ে শুয়ে বেশ কিছুক্ষণ বই পড়ছিল। কিন্তু বইয়ে মন বসছিল না।ফারদিনার কথা বারবার মনে পড়ছিল। তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের ঘোরে মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখেছিল।এখন মনে পড়ছে না স্বপ্নের কথা। হঠাৎ করে হয়ত মনে পড়বে।

সুফিয়ান হামি তুলে উঠে বসল।আলসে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সোলেমান এর কন্ঠ ভেসে আসে। ‘ভাই,এখনো ঘুমান নাকি?’
সুফিয়ান চাদরটা পেঁচিয়ে ঘর থেকে বাইরে আসে। সোলেমান হাতে একটা শৌচবাক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ওর বাকি তিনজন সঙ্গী ওকে বলেছে আজই যেন সুফিয়ান কে শেষ করে ফেলে।নয় ওকে ওঁরা শেষ করবে। সুফিয়ান ওর হাতে শৌচবাক্স দেখে বলল “সকাল সকাল এসব দিয়ে কি করবি?

সোলেমান কাপা কাঁপা গলায় বলল “আপনার দাঁড়ি গোঁফ বড় হয়েছে।ঠিক করা দরকার। গতকাল বলেছেন আজ করবেন,তাই..!” বলে একবার ঢোক গিলল। সুফিয়ান দু চোখের ভ্রু কুঁচকে সোলেমান কে পর্যবেক্ষণ করল। এরপর বলল “আমার দাঁড়ি গোঁফ ঠিকই আছে। তারপরও যখন তোর শৌচ করার ইচ্ছা তো কর।আয়” সুফিয়ান ঘরের ভেতরে গেল। সোলেমান বারান্দায় বসে। সুফিয়ান দাঁত মেজে নিল।কলসি থেকে জল ঠেলে ঘরের পেছনে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলল।গামছা দিয়ে মুখ মুছে ফেলল।চোখ দুটো লাল টকটকে।রাতে দেরি করে ঘুমানোর ফলে চোখমুখ ফুলে গেছে। কিন্তু এর পরেও যেন তাঁর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেল। সুফিয়ান ঘর থেকে একটা চেয়ার এনে বারান্দায় বসল। চেয়ারের হাতলে দু হাতের ভর দিয়ে সাহেব এর মত বসল। সোলেমান বলল “এভাবে বসবেন না। ব্রিটিশরা এভাবে বসে।”

“আমাদের দেশ তো পুরোপুরি ব্রিটিশদের আয়াত্তেই। তাহলে তাদের ঘৃণা করছিস কেন?
“আপনার মুখে এ কথা মানায় না। তাঁদের থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়।”
“ঠিকই বলেছিস।আমার দাদাও তাঁদের ঘৃণা করত।” মাটিতে একটা পিড়ি রাখা। সুফিয়ান সেটার উপর বসল। সোলেমান তাঁর সামনে বসে। সোলেমান প্রথমেই ক্ষুর বের করল। সুফিয়ান এর গলার কাছে নিল।সোলেমান এর হাত কাঁপছে। সুফিয়ান বলল “আগে সাবান দিতে হয়।ভুলে গেছিস?

সোলেমান ক্ষীণ চোখে সুফিয়ান এর চোখের দিকে তাকাল। সুফিয়ান বড্ড চালাক চতুর ছেলে বলে সে মেনে নিল।বলল “ভুলে গেছিলাম।’ বাক্স থেকে সাবান বের করে ফেনা তৈরি করলো। এরপর পুনরায় হাতে ক্ষুর তুলে নিল। ধারালো ক্ষুর।বদরু, হাবলু,লাল মিয়া,দূর থেকে তাঁদের উপর অনুসরণ করছে। কখন সুফিয়ান এর গলাটা কে’টে ফেলবে সোলেমান। সোলেমান ধীরে ধীরে সুফিয়ান এর দাঁড়ি কাঁটছে। কাঁটা প্রায়ই শেষ পর্যায়ে। সোলেমান এর হাত কাঁপছে। ঘুরে একবার বদরু ওঁদের দিকে তাকাল। ওঁরা ইশারায় বোঝাল গলাটা জলদি কে’টে ফেলা।
সোলেমান চোখ সরিয়ে নেয়।ওর কাঁপা হাতটা সুফিয়ান ধরে ফেলল ধাব করে।বলল “এভাবে হাত কাপলে তো আমার গলা কে’টে যাবে।”

“দুঃখিত।” সোলেমান বলল ভেজা কন্ঠে। বাদবাকি টুকু কাঁটার জন্য সোলেমান হাত বাড়াতেই সুফিয়ান এর মুখটির দিকে তাকাল।কতটা মায়াভরা চেহারা তাঁর।তেমনি অন্যদের প্রতি মায়াশিল সুফিয়ান।ওদের ভালো কাজের পর দেখিয়েছে।আর ওঁরা তাঁকে শেষ করে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। অনুতপ্ত হল সোলেমান।
সোলেমান মাটিয়ে লুটিয়ে বসে পড়ে।ক্ষুর টা ফেলে দেয়। হুঁ হুঁ শব্দে কান্না শুরু করল। সুফিয়ান ওর কান্না দেখছে। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে নীরব কন্ঠে বলল “তোরা গত দুদিন ধরে আমাকে মা’রতে চাইছিস।আমি আগেই টের পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি। নিশ্চিতও ছিলাম। দেখছিলাম তোঁরা কিভাবে আমাকে মা’রার জন্য পথ তৈরি করিস। মৃ’ত্যু আমার কতটা কাছে ছিল দ্যাখ,ক্ষুর দিয়ে আমার গলাটা কে’টে দিলেই আমি হয়ত ম’রে যেতাম। তাহলে মারলি না কেন?

সোলেমান বিনয়ের সাথে বলল “আমাদের ক্ষমা করুন।আমরা বুঝতে পারি নাই।ভালো পথ এত মূল্য বুঝি নাই।মাফ করে দেন। এরপর থেকে আর কোনদিন এরকমটা হবে না।”
সুফিয়ান একরাশ বেদনার আভা নিয়ে বলল “আমার কপালটাই এমন জানিস তো,যাকেই বিশ্বাস করি সেই আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে যায়।যার ভালো চাই, সে-ই আমার ক্ষতি করার জন্য উঠেপড়ে লাগে।”
সোলেমান দু চোখ মুছে বলল “আমি আর কোনদিন চুরি-ডাকা’টি করব না।কথা দিলাম।”
“যে একবার বিশ্বাস ভাঙ্গে তাঁকে কি দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করা যায়?
“করেই দেখুন।আর কোনদিন আপনার নির্দেশ এর বাইরে যাব না।”
সুফিয়ান অভিব্যক্তি পাল্টে বলল “দাঁড়ি বাকিটা কেটে দে।সম্পুর্ন করিসনি তো।ভালো দেখাবে না।”
সোলেমান অশ্রুসিক্ত নয়নে হেসে বলল ‘তারমানে বিশ্বাস করছেন আমায়।” বলে খুশি মনে শৌচ কাজটা সেরে ফেলে।

দূর থেকে দৃশ্যটা দেখল বদরু, হাবলু লাল মিয়া। ওঁরা একে অপরের ক্রোধ বিনিময়ে করল। লালমিয়া বলল “ওকে দিয়ে এ কাজ হবে না আগেই বলছি।এখন আর উপায় নাই। পালাতে হবে। সোলেমান নিশ্চয়ই আমাদের কথা বলে দিছে।চল, দ্রুত পালাতে হবে।আর এক মূহুর্ত থাকা যাবে না।তাঁর হাতে পড়লে শেষ।” বলে ওঁরা হাত থেকে দা’কাঁচি, কোদাল, সবকিছু ক্ষেতের মধ্যে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।অথচ ওদের কেউ ধাওয়া করছে না।করবে বলে আগেই ওঁরা পদক্ষেপ নিল।

সুফিয়ান সোলেমান কে বলল “আমি জানি তোরা আমার সাথে কাজ করতে চাইছিস না।তোদের মনে হয় তোদের আমি আটকে রেখেছি। কিন্তু না,আমি চেয়েছিলাম তোদের সৎ পথে আনতে।হালাল উপার্জন করতে। কিন্তু আমার আশা পূরণ হয়নি।” বলে সুফিয়ান ঘরের ভেতর চলে যায়। এরপর কিছু টাকা ও মুদ্রা নিয়ে বের হয়।যা ওদের পাওনার পরিমাণ এর থেকেও বেশি। সুফিয়ান সেগুলো সোলেমান এর হাতে দিয়ে বলল “আশাকরি এতে তোদের পোষাবে। তারপরও যদি কম মনে হয় তবে আবারো চাইলে চু’রি ডা’কাতি শুরু করতে পারিস।আমি নিজেকে ব্যর্থ ধরে নিলাম।” সুফিয়ান নির্বিকার ভাবে কথা গুলো বলছে।চোখে জল ছুঁই ছুঁই।কিন্তু সে ইচ্ছে করে চোখের জল আড়াল করল।বলল “আর হয়ত এমনিতেও তোদের সাথে দেখা হবে না। কিন্তু আমার আক্ষেপ থেকে যাবে, তোদের ভালো পথে আনতে পারিনি। সোলেমান বলল “আমি ভেবেছি আপনি হয়ত আমাদের ক্ষমা করে দিছেন। কিন্তু আমি আপনার সাথেই কাজ করতে চাই।’

“কথা বাড়াস না।চলে যা।আজ থেকে তোরা মুক্ত।বলে সুফিয়ান পিঠ ঘুরে তাকাল। সোলেমান হাতের টাকা গুলোর দিকে একবার, আরেকবার সুফিয়ান এর দিকে তাকিয়ে চলে যায়।_
অন্যদিকে রশীদ তালুকদার বসে আছেন আদ্যপুর থানাতে। তাঁর সামনে বসে আছেন দারোগা সাহেব। রশীদ এর পাশে বসা একজন চৌকিদার। রশীদ এর সামনে এক কাপ চা রাখা।তিনি খাচ্ছেন না।সকাল সকাল দারোগা সাহেব খবর পাঠিয়েছিল যত দ্রুত সম্ভব সে যেন থানাতে আসেন।বড্ড বিরক্তি নিয়ে এসেছে সে। তিনি নিজেকে বুদ্ধিমান লোক মনে করেন।অবশ্য গ্রামের সবাই তাই বলে স্বীকার করে।কোন বুদ্ধিমান লোক সকাল সকাল কোন কাজের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে পারেন না।যা করবে নিরিবিলি। কিন্তু আজ তাঁকে তাড়া দিয়ে ডেকেছেন।দারোগার উপর রেগে আছেন।দারোগা সাহেব নিশ্চয়ই গর্ধুব বুদ্ধিহীন। রশীদ ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলল “কি জন্য ডেকেছেন?
দারোগা সাহেব হাত দুটি টেবিল এর উপর রেখে বেশ কিছুক্ষণ ঝিমাল।মাথা নিচু। রশীদ এর প্রশ্নের জবাব যেন তিনি ভেবে চিন্তে দিবেন।
এরপর মাথা উঁচু করে বললেন “আপনার গ্রামকে কি আগের মত মনে হচ্ছে?

“এর মানে’? রশীদ বুঝতে পারল না।
“এই ধরুন আগের মত হইহুল্লোড় এর যে ব্যাপারটা, গ্রামের মানুষের কোলাহল এর বিষয়টা, রাস্তায় বের হলেই, বুড়ো,জোয়ান, বাচ্চাদের দেখাই যেত। আজকাল কিন্তু দেখা যাচ্ছে না।”
রশীদ ভেবে বলল “আমার ঘরের বাইরে কমই বের হওয়া হয়,তাই বাইরের খবর জানি না।গ্রাম শান্ত না অশান্ত তাও জানি না।”
পাশ থেকে চৌকিদার বলল “কিন্তু জমিদার বাবু, আশেপাশের খবরও রাখা উচিত। আপনি গ্রাম প্রধান।এসব আপনার দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত।”
“আমাকে জ্ঞান দেয়ার জন্য এখানে আনা হলে, আমি উঠছি। আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে।আর এত বছর ধরে আমি আমার জ্ঞান দিয়েই জমিদারি টিকিয়ে রাখছি।”

দারোগা সাহেব বললেন “আপনি বোধহয় রেগে যাচ্ছেন।ভুল বুঝছেন, কিন্তু আসল কথা শুনলে হয়তো আপনি অবাক হবেন।আমরাও যখন বিষয়টি লক্ষ্য করেছি আমরাও রীতিমতো অবাক হয়েছি।”
রশীদ ছড়ির উপর হাতের ভর রেখে বলল “যা বলতে চাচ্ছেন, সরাসরি বললেই ভালো।’
দারোগা সাহেব বিস্মিত হয়ে বলল “আমরা বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করেছি গ্রামটা হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেছে।আগের মত গ্রামবাসীদের আনাগোনা দেখছি না। এরপর আমি এবং চৌকিদার মিলে দূর দূর পর্যন্ত খোঁজ নেই। এবং জানতে পারি অধিকাংশ গ্রামবাসীরা কোথাও চলে গেছে। বিষয়টি কি রকম জানেন?বলছি শুনুন, গ্রামের শেষ সীমান্ত থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে আমাদের দিকেই অদৃশ্য ভাবে কেউ তেড়ে আসছে।আর সে গ্রামকে ধীরে ধীরে মানব শূন্য করে ফেলছে।”

রশীদ আতঙ্ক প্রকাশ করল।এরপর আবার চুপচাপ বসে রইল। চৌকিদার বলল “মানব শূন্য হওয়ার বিষয়টি আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। এরপর না জানি আমাদেরও শূন্য করে ফেলে।মনে হচ্ছে ঝড় আমাদের দিকেই আসছে।আমরাই শেষ লক্ষ্য।”
দারোগা সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এরপর পায়চারি করতে করতে বলল “আনন্দে ভরা গ্রাম হঠাৎ করেই সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে। আমার সংবিধানের জ্ঞান দিয়ে বলতে পারি,কেউ ইচ্ছা করে আমাদের গ্রামকে গ্রাম শূন্য করতে চাইছে।আর সে প্রায়ই সফল।তবে এ কাজ যেই করুক সে সাধারণ কেউ নয়, তাঁর পেছনে নিশ্চয়ই ক্ষমতাবান কেউ আছে।”

The Silent Manor part 34

রশীদ হঠাৎ করে কাঁশি দিয়ে উঠল।হাত ছেড়ে ছড়ি টা পড়ে গেল। দারোগা সাহেব একজন চাকর কে ডেকে জল চাইল।জল নিয়ে আসলে রশীদ ঠান্ডা জল টুকু পুরোপুরি খেয়ে ফেলল। তাঁর কপালে ঘাম দেখা গেল। চৌকিদার বলল “আপনি ঘামছেন কেন?

The Silent Manor part 36

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here