The Silent Manor part 38

The Silent Manor part 38
Dayna Imrose lucky

আরিব দ্বিমত পোষণ করল।বলল “কুদ্দুস এ বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। তাছাড়া, আব্বা ওকে ভীষণ ভালোবাসেন।আপন ভাবেন। আব্বা, কুদ্দুস ব্যতীত কারো সেবা নেননা।তাই,আমি তোঁদের সাথে সহমত পোষণ করতে পারলাম না।আর এটা আমি হতেও দেব না।”
রায়ান বলল “আমারও মন সায় দিচ্ছে না।সায়েম তুই,ওই একচোখা ঝন্টু কে বলে অন্য কারো খোঁজ করতে বলিস। যাঁরা আমাদের থেকে দূর দূরে থাকে।”

“কিন্তু, পরিস্থিতি যদি এমন হয়,যে দূরের কাউকে পাচ্ছি না, আমাদের আশেপাশের কাউকেই বেঁছে নিতে হবে তখন?
“এমনটি যখন হবে তখন ভেবে দেখব।এই নিয়ে আর কথা বাড়াতে চাই না। আপাতত ঝন্টু কে কাউকে খুঁজে আনতে বল।”
সায়েম কর্কশ শব্দে বলল “ভাই, গদাধর পন্ডিত এর কথা মনে আছে,ঘোর বিপদ আসতে চলেছে।তাই আমাদের কিন্তু পূর্বের নিয়ম মেনেই চলতে হবে।কোন ভুল করলে চলবে না।”
“আহ্ বললাম তো,এই নিয়ে পড়ে কথা বলব।আর আমার সব মনে আছে।” বলল রায়ান।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজ অষ্টম দিনে পড়েছে সুফিয়ান ফিরেনি। সুফিয়ান না থাকায় পুরো আলিমনগরটা যেন থ’হয়ে আছে বলে ফারদিনার মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে গ্রামটি মানবশূন্য হয়ে যাচ্ছে।সেটি থেকে এক ধরণের নিস্তব্ধা। সুফিয়ান না থাকায় তাঁর মনে হচ্ছে পুরো গ্রাম নয়,দুনিয়াটাই নিস্তব্ধ। গতকাল আদিব অনেক বার জানতে চেয়েছে ফারদিনা কাউকে ভালোবাসে কিনা?ফারদিনা তখন সাহস করে বলেই দিয়েছে -আমি সুফিয়ান কে ভালোবাসি”
ফারদিনা ভেবেছে সুফিয়ান এর কথা শুনে আদিব উত্তেজিত হয়ে রেগে যাবে। তাঁর উপর প্রচন্ড চেঁচামেচি করবে। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি।আদিব ফারদিনার মুখে এমনটি শোনার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছিল। এরপর ফারদিনা জিজ্ঞেস করেছিল, ভাইয়া চুপ করে কেন আছো? আমি কি ভুল কাউকে আমার জীবনের জন্য বেঁছে নিয়েছি?”

আদিব স্বাভাবিক ভাবে হেসে বলেছিল “তোর পছন্দ কখনো ভুল হতে পারে না।আমি সুফিয়ান এবং আব্বার সাথে কথা বলব।” ফারদিনা আনন্দে আত্মহারা হয়ে আদিব কে জড়িয়ে ধরেছিল।
ফারদিনা হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে সুফিয়ান এর কথা। তাঁর পাশে ঝিলমিল। তাঁরা যাচ্ছে সুফিয়ান এর বাড়ি। যদি কোনভাবে জানা যায় সুফিয়ান কোথায় গেছে? তাহলে ফারদিনাও সেখানে যাবে। গতকাল রাতে তাঁরা দুজন মিলে নিশ্চিত করেছে।আজ রশীদ কে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়েছে ফারদিনা।কথায় আছে মন থেকে চাইলে আর চেষ্টা করলে সব সম্ভব।আজ ফারদিনা ঘর থেকে বের হতে পেরে এটাই ভাবছে।সে পেরেছে ঘর থেকে বের হতে, অতএব কেউ চাইলেই যা কিছু করতে পারে। কিন্তু তা সবসময় সফল হয় না বলেও স্বীকার করছে।
সরু পথের দুধারে ধানের ক্ষেত।ধান পেকে হলদে ভাব এসেছে।ধান ক্ষেতের মধ্যে কাকতাড়ুয়া।ফারদিনা কাকতাড়ুয়ার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসল। হঠাৎ তাঁর ঠোঁটের ফাঁকে হাঁসি আসার রহস্য বুঝতে পারল না। ভেতরে জমা একরাশ কষ্ট।আর ব্যথা। গতকাল সাতদিন পেরিয়ে আজ আটদিন সুফিয়ান কে সে দেখছে না। কোথায় যেতে পারে তা নিয়ে দিনরাত ভাবছে!কোন বিপদ হল কিনা ভাবছে।

যেতে যেতে দেখল দূর থেকে এক লোক ফারদিনার দিকেই কালো চাদরের আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে।ফারদিনা সরাসরি না তাকিয়ে আড়াআড়ি ভাবে দেখল। হ্যাঁ,সে নিশ্চিত তাঁকেই দেখছে।ফারদিনা হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝিলমিল কে বলল “দেখ,ওই লোকটা আমাদের দিকেই দেখছে।’
ঝিলমিল ফারদিনার ইশারা অনুযায়ী তাকাল।এক বৃদ্ধা লোক আতঙ্ক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ফারদিনার দিকেই। ঝিলমিল লোকটিকে ভালো করে দেখে বলল “উনি তো মজিদ মিয়া।”
“মজিদ মিয়াটা আবার কে?
“উনি সে-ই যার খাজনা বরাবরই বকেয়া থাহে। ওনার মাথায় সমস্যা আছে।লোকে কয়।তুই চল,তোর কাজ সার।সরদার দেরি হইলে বকবেন।”

ফারদিনা ঝিলমিল এর কথা অনুযায়ী মজিদ মিয়ার বিষয় অগ্রাহ্য করে সুফিয়ান এর বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে যায়।
বাড়ি ফাঁকা। উঠোনে কিছু খড় পড়ে আছে।রাঙার খাদ্য। সুফিয়ান এর ঘরটি তালাবদ্ধ।ফারদিনা বলল “চল তালা ভেঙ্গে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করি।যদি কিছু পাই!”
“কারো অনুমতি ছাড়া তাঁর ঘরে যাওন উচিত না।আর সেইখানে তুই তালা ভাইঙ্গা ঠুকবি। না বাপু,আমি পারুম না।”
“নাটক কম কর মুচমুচি।যা বলছি তাই কর,যা ভারী কিছু একটা নিয়ে আয়।”
ঝিলমিল বাধ্য হল।কোমরে হাত দিয়ে ফারদিনার দিকে তাকাল।সে ঠোঁট,চোখ এক করে বোঝাল,যা বলেছি দয়া করে কর।’

ঝিলমিল চারপাশে ভারী কিছু খোঁজার দৃষ্টিতে তাকালে একটা ইটের খন্ড পেল।সেটি দিয়ে তালার উপর আঘাত করতে লাগল। কিন্তু তালা খুলছে না। ঝিলমিল কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর ফারদিনা নিল ইটের খন্ডটি।সে তালা ভাঙতে শুরু করতেই পেছন থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে আসল। “ঘরে ঠুকে লাভ নাই। সুফিয়ান এর কোন জিনিস ঘরে নাই।সে আর ফিরব না।” বলে রহস্যময় এক হাঁসি দিল।হাঁসির শব্দে ফারদিনা বিরক্ত হয়ে পেছন ঘুরে তাকাল।লোকটি মজিদ মিয়া। “আপনি কিভাবে জানলেন?
“আমি সব জানি।সে আর ফিরব না।”
ফারদিনার হাত থেকে ইটের খন্ডটি পড়ে গিয়ে মৃদু আওয়াজ তুলল। হঠাৎ যেন তাঁর শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেল। ঝিলমিল বলল “আমি তোরে আগেই কইছিলাম, সুফিয়ান আর ফিরব না।হইলো তো অহন।আর তাঁর অপেক্ষায় থাইকা লাভ নাই”

ফারদিনা মজিদ মিয়ার সম্মুখীন হল। নির্বিকার কন্ঠে বলল “আপনি জানেন, সুফিয়ান কোথায় গেছে?
‘জানি কিন্তু কমু না।’ বলে আবার হাসল মজিদ মিয়া।
ফারদিনা অনুরোধ মূলক কন্ঠে বলল “দয়া করে বলুন,আমি জানতে চাই সে কোথায়? যদি সে আমার সাথে প্রতারণা করেই থাকে তবে,তাঁর কাছে আমি জানতে চাইব,আমাকে মিথ্যা আশা দেয়ার কারণ কি ছিল?আমি তাঁকে একটাবার জিজ্ঞেস করতে চাই।
বলুন দয়া করে”
ফারদিনার ভেজা কন্ঠে মজিদ মিয়ার মন শীতল হল।সে ফিসফিসিয়ে বলল “আমি বলমু, কিন্তু আমার কথা কাউরে কইতে পারবা না’

“আচ্ছা, কাউকে বলব না।”
“সুফিয়ান গেছে তাঁর গ্রাম সিন্ধুতলিতে।”
“কোন পথ থেকে আমরা যেতে পারি?
“নদী পথে যাওন যায়,নদী পথ ছাড়াও যাওন যায়।” বলে মজিদ মিয়া চলে যায়।পাগ’লের মত আচরণ করছিল সে।
ফারদিনা ঝিলমিল কে বলল “চল,আজকেই আমরা সিন্ধুতলি গ্রামে যাব। সুফিয়ান আসলে কি কাজে এখানে এসেছে,আমাকেই কেন মিথ্যা বলেছে,এর শেষ দেখতেই হবে।”
ঝিলমিল রাজি হল না।বলল “আমরা দুইজন মেয়ে হইয়া এত দূরের পথে কেমনে যামু?বিপদ হইতে পারে।”
“কিছু হবে না।তুই যদি সত্যিই আমাকে বন্ধু ভেবে থাকিস তবে আজ, এবং এক্ষুনি চল”
ঝিলমিল ভাবছে। কঠিন ভাবনা।ওর চাহনি বলে দিচ্ছে,ও মোটেই যেতে রাজি নয়। কিন্তু ফারদিনার জন্য যেতেই হবে।বলল “আচ্ছা চল, কিন্তু শুধু আমরা দুইজন না।সাথে আজমাত রে লইয়া লই।তোঁর ভাইয়েরা কোন ঝামেলা করলে সব দোষ ওর ঘাড়ে চাপামু।,”

“যা করার তাড়াতাড়ি চল।”
দুপুরের রোদ এখন একটু নরম হয়ে এসেছে। আকাশজুড়ে হালকা ছায়া,মেঘ নয়, যেন সোনালি ধুলোর মতো উষ্ণ আলো। নদীর ঘাটে নৌকাটা আগে থেকেই বাঁধা ছিল।একটিই নৌকা। কাঠের শরীরে যুগের ছাপ, তবুও শক্তপোক্ত। ফারদিনা সবার আগে এসে পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকাল। অথই জলের বুক জুড়ে ক্ষীণ ঢেউ, দূরে দু’টি শাপলা ভাসছে।নীরব,স্থির। মনে হলো এ জল যেন সব জানে,সুফিয়ান কোথায় আছে, কোন বাতাসে তার নাম ভেসে এসেছে।
আজমাত উঠল কিছুটা তাড়াহুড়ো করে, হাতে ছোট্ট ব্যাগ।“চলো, সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না” তার গলায় উদ্বেগ স্পষ্ট।

ঝিলমিল পিছন থেকে নৌকায় উঠতে উঠতে বলল, “সিন্ধুতলি গ্রামে নদীর ওইপার দিয়া গেলে পথ ছোট, কিন্তু জলের স্রোত আইজ একটু বেশি। সাবধানে যাও মাঝি ।”
নৌকাওয়ালা রামুটে হাঁসি হেঁসে দাঁড়িয়ে ছিল। “ভয় পাইয়েন না। এই নদীর পথ আমার হাতের তালুর মতো চিনি।”
তার কথায় আশ্বাস পেলেও ফারদিনার বুকের ভয় কমল না। মনে হচ্ছিল নদীর প্রতিটি ঢেউ যেন তাকে আরেকটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে,সুফিয়ান সত্যিই ওদিকে আছে তো?

নৌকা ছাড়তেই কাঠের গা-ঘেঁষে জলের শব্দ উঠল চরর চরর করে। প্রথমে ধীরে ধীরে চলল নৌকা।তারপর বাতাসের তালে গতি বাড়ল। নদীর দুই ধারের দৃশ্য চোখের সামনে পাল্টাতে লাগল।কচু ক্ষেতের মাথায় ঝুলে থাকা সাদা বক, দূরে নিস্তরঙ্গ বাঁশঝাড়, কোথাও মাঝেমধ্যে ধোঁয়া উঠছে কোনো মাটির চুলা থেকে।পথটুকু কত সাধারণ, অথচ আজ যেন অচেনা, অদ্ভুত ভারী লাগছে ফারদিনার কাছে।
ফারদিনা চোখ বুজে অনুভব করল নদীর ঢেউ,জল, কাদামাটি আর দূরের গাছের ভেজা সুবাস। মনে পড়ল সুফিয়ানের পাশে বসা দিনগুলো, তার হাঁসি।আবার নদীর মতোই বয়ে এল এক চাপা আতঙ্ক।এতদিনে সে ফিরল না কেন?ফারদিনার চোখে জল।
ঝিলমিল আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখল।

“কিছু হইবে না ফারদিনা। সিন্ধুতলির মানুষ ভালো। শুনছিলাম। যদি ওইখানেই থাকে, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই দেখছে। তাঁর খোঁজ পামু।”
আজমাতও বলল, “আমরা তাকে খুঁজে পাব।”
ঝিলমিল বলল “গ্রামটা অনেক টা দূরে।আজ এমনিতেও ফেরা হইবে বইলা মনে হয় না। না, জানি সরদার আমগো না পাইয়া কি করে!”
নৌকা তখন নদীর মাঝ বরাবর পৌঁছে গেছে। স্রোত আরও চঞ্চল, ঢেউ একটু বড়। নৌকাওয়ালা দাঁ পেতে দিক সামলাচ্ছে। আকাশে জোড়া চিল ঘুরছে, তাদের ডানার ছায়া কখনো জলের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। দূরে পশ্চিম দিগন্তে আলোর রং বদলাতে শুরু করেছে।হলুদ থেকে সোনালি, তারপর কমলা। কুয়াশা নেমে যাবে।
যাত্রাপথে সবাই চুপচাপ। শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ আর দাঁ’–এর তাল ঠোকাঠুকি। তবুও নৌকার নীরবতা যেন এক ধরনের প্রতিজ্ঞার মতো।যা-ই হোক, যা-ই সামনে অপেক্ষা করে থাকুক, আজ তারা থামবে না।ফারদিনা থামবে না,অন্যরা যা করুক।

দীর্ঘ সময়ের পর তাঁরা সিন্ধুতলি গ্রামের সন্ধ্যান পেল যেন।দূর থেকে সিন্ধুতলি গ্রামের প্রথম চারা-গাছের রেখা যখন দিগন্তে ফুটে উঠল, ফারদিনার বুকটা হঠাৎ ধুকধুক করে উঠল। অজানা গ্রামের দিকে ভেসে যাওয়া এই পথ।হয়তো ঠিক এই নদী পথই তাকে সুফিয়ানের কাছে নিয়ে যাবে।
নৌকা এগিয়ে চলল, স্রোতের বুক চিরে।আশা আর শঙ্কা দুটোকে সঙ্গী করে।ফারদিনা মাঝিকে জিজ্ঞেস করল “মাঝি ওই তো একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে!ওটাই বুঝি সিন্ধুতলি?
“হুঁ,তবে আমাদের ঘুইরা যাইতে হইবো। আরো কিছুক্ষণ সময় লাগব। কিন্তু আপনারা এই গ্রামে ক্যান আইছেন,এই গ্রামে তো কেউ আহে না?”
ফারদিনা কোন জবাব দিল না।সে নিজেই সিন্ধুতলি গ্রাম সম্পর্কে কিছু জানে না। শুধু অজানা এক বার্তার জন্য অচেনা পথ পাড়ি দেয়া।

অতঃপর তাঁরা পৌঁছে যায় সিন্ধুতলি গ্রামে।ফারদিনা নৌকা থেকে আগে আগে নামল। নামতে গিয়ে শাড়ির আঁচলটা নৌকার দাড় এর সাথে বেঁধে গেল।ফারদিনা দাঁড়িয়ে যায়।আজমাত আঁচলটা বাঁধা থেকে সরিয়ে দিল। এরপর সে নামল। ঝিলমিল বলল “কোথাও যাওয়ার আগে পেছন থেইকে বাঁধা পড়লে অমঙ্গল হয়।” আজমাত বলল “তোমরা এসব কোথায় পাও,আমি এসবে বিশ্বাস করি না।” বলে মাঝিকে ওনার পাওনা বুঝিয়ে দিল।
তাঁরা হাঁটা শুরু করল।এই পথ সবুজ শ্যামল এর পথ নয়।মনে হচ্ছে মরুভূমির দেশ। চারদিকে উঁচু উঁচু ইট রঙের পাহাড়। সবুজের কোন দেখা নেই।পথে শুধু বালি।বালিতে অশ্বের পায়ের ছাপ। একাধিক অশ্বের পায়ের ছাপ।বেশ কিছু দূরে ঢাল দেখা যাচ্ছে।ঢাল পেরিয়ে গেলে সবুজের দেখা মিলবে বলে তাঁরা ধারণা করল।
সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে ধরণীতে।ফারদিনার পা ব্যথা হয়ে গেল।তবুও থামছে না। অন্যদিকে সে তাঁর গ্রাম ছেড়ে দূর গ্রামে চলে এসেছে, সুফিয়ান কে খুঁজতে, জানতে পারলে তাঁর ভাইয়েরা হয়ত তাঁকে এলোপা’থাড়ি ছু’রির আঘাতে মেরে ফেলবে।সে নিশ্চিত। কিন্তু তাঁর এই মুহূর্তে উদ্দেশ্য একটাই সুফিয়ান কে খুঁজে বের করা।

কিছু দূরে গিয়ে চোখে পড়ল লন্ঠন এর আলো। মশাল এর আলো। কুঁড়েঘর থেকে শুরু করে অনেক ঘর।ঘর গুলো ছাড়িয়ে একটা জমিদার বাড়ি।দূর থেকে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে বাড়িটিতে কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে। গ্রামবাসীরা কাউকে দেখার জন্য ভীর করে রেখেছে। সেরকম কিছু শব্দ ভেসে আসছে ‘শুনছি অনেক রুপসী। একটাবার দেখতে পারি কিনা দেখি।’ আশপাশের ভীর থেকে শব্দ গুলো ভেসে আসছে।আজমাত বলল “চলো,আমরাও দেখার চেষ্টা করি।”
এরপর তাঁরা ভীর অতিক্রম করে জমিদার বাড়ির মূল ফটকের সামনে একটু জায়গা পেয়েছে উঁকি মেরে দেখার জন্য।ফারদিনা দু’জন অনুচারীর ফাঁক দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বাড়িটির জমজমাট আয়োজন এর ভিড়ে একজন উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুদর্শন যুবক বেরিয়ে এল।

যুবকটি চোখে পড়ার মতো তাঁর রাজকীয় সাজ নিয়ে উপস্থিত হল সবার সামনে। পরনে তাঁর পান্না-সবুজ রঙের মুলবেরি সিল্কের লম্বা আঙ্গরখা, যার গলা ও কিনার জুড়ে সোনালি জরি আর সূক্ষ্ম কারুকাজ ঝলমল করছে। আঙ্গরখার নিচে পরা দুধসাদা সিল্কের চুড়িদার পায়ের সাথে নিখুঁতভাবে মিশে গিয়ে তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডান কাঁধে রয়েছে একই রঙের দোপাট্টা, যার সোনালি বর্ডার আলোয় পড়ে চিকচিক করে উঠেছে। মাথায় বাঁধা গেরুয়া পাগড়ির সামনে ছোট্ট রত্নখচিত পিন,লাল পাথরের সেই ঝিলিক তাঁর সৌরভ ছড়ানো উপস্থিতিকে আরও রাজকীয় করে তুলল।গলায় মুক্তো ও পান্নার মিশ্রণে তৈরি ভারী রাজমালা, হাতে সোনার খোদাই করা বালা আর আঙুলে বড় সবুজ পাথরের আংটি তাঁর আভিজাত্যেরই পরিচয় দিচ্ছে যেন। পায়ে নাগরা জুতো, যার সোনালি নকশা উৎসবের আলোয় ঝিকমিক করছে। পুরো সাজে সে যেন জমিদারি ঐশ্বর্যের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।এত এত ভিড়েও যাঁকে একবার দেখলে দ্বিতীয়বার আর কেউ চোখ ফেরাতে চাইছে না।

ফারদিনা যুবকটির মুখটি পরিষ্কার ভাবে দেখার আগেই একজন অনুচারী এসে তাঁর ফাঁকা জায়গাটা দখল করে নিল।
একজনের ধাক্কায় ফারদিনা সরে গেল এক পাশে। আজমাত তাঁকে হাত ধরে আগের জায়গায় নিয়ে আসল। এরপর কোনভাবে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করতেই যুবকটিকে দেখতে পেল। তাঁদের সামনে রাজকীয় ভাবে উপস্থিত সুফিয়ান।

সুফিয়ান ধীর পায়ে সামনে আসার পর তাঁর সামনে দাসীদের ভীর থেকে বেরিয়ে এল এক সুন্দরী নারী।যার সৌন্দর্যে যেন গোটা বাড়িটি ঝলমলিয়ে উঠছে। তাঁর আচরণে প্রকাশ পায় সেও একজন জমিদার কন্যা।সুফিয়ান তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে সেও তাঁর হাতে হাত রেখে বলল “এতদিন পর তোমার আসার সময় হল বুঝি।”
পাশ থেকে একজন বলল “ হয়ত তাঁর উদ্দেশ্য সফল।”
সুফিয়ান রাখাল নয়। একজন জমিদার।সত্যটা চোখের সামনে উদঘাটিত হওয়ার ঠিক সেই মুহূর্তে ফারদিনার শরীরটা থমকে যায়।তার দুটি চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠল,যেন অচেনা কাউকে প্রথমবার দেখছে। চোখের মণি কেঁপে ওঠে দপদপ করে।দৃষ্টিটা ধীরে ধীরে নিস্পন্দ আর কঠিন হয়ে গেল।

চোঁখের পলকের ফাঁকে জমে ওঠা আর্দ্রতা প্রথমে বাষ্পের মতো, পরে চিকচিক জলের দাগে পরিণত হল। সে চোখ সরাতে চাইল। কিন্তু পারছে না।চাহনি যেন আটকে যাচ্ছে অবিশ্বাসের গিঁটে।
ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠছে,যেন কিছু বলতে চাইছে,কিন্তু শব্দ বের হচ্ছে না। ঠোঁটের কোণে এক অদ্ভুত শক্ত হয়ে থাকা দাগ,যেখানে রাগ, ব্যথা আর হতভম্বতা একসঙ্গে মিলেমিশে জমাট বাঁধছে
ফারদিনার বুকটা ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে।শ্বাস ভারী হয়ে আসছে। মনে হয় যেন বুকের ভেতরটা কেউ মুঠি করে চেপে ধরেছে। হৃদযন্ত্রের প্রতিটি ধকধক স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে সে। একটা ধাক্কা, তারপর আরও এক ধাক্কা।সবটাই তীব্র আঘাতের মতো লাগছে।

দুটো হাত অজান্তেই মুঠো হয়ে যায়, পাতলা আঙুলগুলো কাঁপতে থাকে ক্ষুদ্র কম্পনে। খেয়াল করলে দেখা যাবে তার কাঁধ সামান্য ঝুঁকে গেছে,যেন ভিতরকার আঘাতটাকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে।
ফারদিনা আর চোখের জল জোড় করে আটকে রাখতে পারল না।জল বেয়ে গাল ভিজে গলায় নেমে গেছে।মনের ভেতরে তখন গভীর এক ঝড়।বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা,নিজেকে বোকা ভাবার তীব্র লজ্জা,আর হঠাৎ দূরত্ব তৈরি হওয়ার হিমশীতল শূন্যতা।তার মুখে কোনো চিৎকার নেই, রাগের উচ্ছ্বাসও নেই।
কিন্তু চোখের নীরব কষ্টটাই সবচেয়ে ভয়ংকর।

সেই চোখে আছে এমন এক মলিন ব্যথা, যা শুধু ভুলে যাওয়া নয়, সুফিয়ান এর প্রতি গভীর বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার ব্যথা। সুফিয়ান তাকে ঠকিয়েছে। তাঁকে একদম ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে।
ঝিলমিল এবং আজমাত নিজেদের মধ্যে চোখের আলাপে আতঙ্ক প্রকাশ করে কথা বলল। তাঁরাও রিতিমত নির্বাক হয়ে গেল। ঝিলমিল ফারদিনাকে নিয়ে ভীর থেকে বেরিয়ে নীরব শূন্য স্থানে চলে গেল। সেখানে শুধু বালু।বালুর উপর ফারদিনা বসে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।তাঁর কান্নার শব্দ আজ প্রকৃতি শুনছে।সুফিয়ান শুনছে না। ঝিলমিল শান্তনা দিয়ে বলল “আগেই কইছিলাম তারে বিশ্বাস করিস না।আজ বুঝলি তো।যা হওয়ার হইছে।অহন কান্দিস না।চল ফিরা যাই।”

The Silent Manor part 37

ফারদিনা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। কিছু বলছে না।আজমাত ফারদিনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল “আমিও সুফিয়ান এর আসল রুপ দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখানে কি হচ্ছে কিছুই আমরা জানি না। দাঁড়াও,আমি একজনকে জিজ্ঞেস করছি।” বলে দাঁড়াল।কাকে জিজ্ঞেস করবে ভেবে আশেপাশে তাকাতেই একজন বৃদ্ধা মহিলাকে পেল। এদিকেই আসছে।আজমাত তাঁকে জিজ্ঞেস করছে “আচ্ছা,চাচী, এখানে কিসের উৎসব হচ্ছে? আজমাত ভুলে উৎসব বলে ফেলল অনুষ্ঠানকে।
বৃদ্ধা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল ‘উৎসব না উৎসব না,বিয়া হইতেছে।বিয়ার অনুষ্ঠান।’

The Silent Manor part 39

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here