The Silent Manor part 39
Dayna Imrose lucky
দূর থেকে দেখেই ফারদিনার শরীরটা যেন হড়কে উঠেছিল। ঝিলমিল ফারদিনাকে ধরে উঠাল। তাঁরা রওনা করেছে ফেরার পথে।ফারদিনা হাঁটতে পারছে না।হাঁটার গতি থেমে গেল মুহূর্তে।চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠল, তারপর ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হল ব্যথায়। তার দৃষ্টি কাঁপতে লাগল, যেন চোখের ভেতরই কোথাও ভেঙে যাচ্ছে কিছু।ঠোঁট দুটো কাঁপছে।বলতে চায় কিছু,বলতে পারছে না। বুকের ভেতরটা ধুকধুক করে উঠছে অস্বস্তিতে।সেই শব্দ যেন কানে-কানে বাজছে “এটা কি সত্যি?” বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সুফিয়ান এর কথা গুলো “বোকা মেয়ে, তোমাকে দুঃখ দেয়ার কথা কখনো ভাবতে পারিনা, তোমার সাথে প্রতারণা করার কথা কখনো ভাবতে পারিনা।কাজে যাচ্ছি। দু’দিন পর ফিরে আসব। তোমার জন্য বিয়ের বেনারশি আনতে যাচ্ছি।বিয়ের জন্য তৈরি থেকো। ফিরে এসেই তোমাকে বিয়ে করব।”
গলার কাছে কেমন যেন একটা শক্ত গিঁট। শ্বাস আটকে আসছে, বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে।মনের গভীর থেকে ধীরে ধীরে উঠছে এক ধরণের অসহায় ব্যথা।একই সাথে শূন্যতা, অবিশ্বাস আর অপমানের মিশ্র অচেনা অনুভূতি। ঝিলমিল তাঁকে বিশ্বাস এর খোটা দিচ্ছে।এটা যেন তাঁর প্রাপ্য।
তার মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।চোখের কোণে জল জমে উঠেছে, কিন্তু পড়ছে না এখন।হাত দুটো শীতল হয়ে গেছে, আঙুল শক্ত হয়ে আছে।মনে হচ্ছে, শরীরটা যেন নিজের ভারই নিতে পারছে না। হাঁটার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দৃষ্টি স্থির। কিছুক্ষণ আগের সামনের দৃশ্যটা ভেসে আছে চোখের সামনে, অথচ বিশ্বাস করতে এখনো কষ্ট হচ্ছে।চোখে জমে থাকা ব্যথা এত গভীর যে, মনে হয় কেউ যদি তখন তাকে স্পর্শ করে, সে ভেঙে খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে।ভেতরে হাজারটা শব্দ চিৎকার করছে।কিন্তু বাইরে নীরবতা।এই নীরবতাই ফারদিনার সবচেয়ে বড় ব্যথা।
ফারদিনা শুধু দাঁড়িয়ে থাকল নদীর তীরে। নৌকার অপেক্ষায়। নৌকা দেখা যাচ্ছে। তীরেই আসছে।চোখ লালচে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, বুকের ভেতরটা সংকুচিত। মনে হয় কেউ তার হৃদয়ের মাঝখানটা আগলে ধরে টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে।
ফারদিনার তির্যক আওয়াজে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।চোখ দুটো এত পরিমাণ লাল মনে হচ্ছে র’ক্ত ছিটকে পড়বে এখুনি বুঝি।নৌকা এসেছে।আজমাত আগে আগে উঠে দাঁড়ালো। এরপর উঠল ঝিলমিল।ফারদিনার দিকে হাঁত বাড়িয়ে দিল ঝিলমিল।ফারদিনা ঘুরে একবার সিন্ধুতলি গ্রামের এর দিকে শেষ বারের মত তাকাল। আজকে সুফিয়ান কে শেষ বারের মত দেখেছে।আর হয়ত কোনদিন দেখা পাবে না তাঁর।এটাই স্বাভাবিক।
নৌকার মাঝি দাড় টানা শুরু করল।হালকা ঢেউয়ে নৌকা দুলে দুলে চলে যাচ্ছে।ফারদিনা অপলকে চেয়ে রইল গ্রামটির দিকে।বা হাতের উল্টো দিক থেকে চোখের জল মুছল।মুছে লাভ হল না। পুনরায় গাল ভিজে গেল।
রাত শেষ প্রহরের দিকে আলিমনগর পৌঁছে যায় তাঁরা।আজ ফারদিনা ভয় পেল না।ঘরের বাইরে বের হয়েছে বলে আব্বা,ভাইয়েরা, তাঁকে মেরে ফেলবে, বকাবকি করবে,নয়ত বন্দিশালায় বন্দি করে রাখবে,রাখুক।আজ তাঁর কাছে সুফিয়ান এর থেকে পাওয়া কষ্টটাই সবচেয়ে তীব্র মনে হচ্ছে।ফারদিনার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ। চাঁদের আলো ধরে তালুকদার বাড়ির মূল ফটকে এসে দাঁড়ায়।ডান দিকে সুফিয়ান এর বাড়িটি। ঘুরে সেদিকে একবার তাকাল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।তবু মনে পড়ে তাঁর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো।যা তাঁর শিরায় উপশিরায় গেঁথে আছে। কখনো সে স্মৃতি ভুলতে পারবে বলে সে নিশ্চিত হতে পারল না।চোখ সরিয়ে একবার মাটির দিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলল।
মজিদ মিয়া একটা গাছের আড়ালে বসে ছিল যেন ফারদিনার অপেক্ষায়।ফারদিনাকে দেখেই তাঁর কাছে আসে।হাতে তাঁর একটি লন্ঠন।ফারদিনা সুফিয়ান এর খোঁজ পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করল।ফারদিনা সিন্ধুতলি গ্রামের সমস্ত ঘটনা মজিদ মিয়াকে বলল। মজিদ মিয়া বলল “আমি জানতাম, সুফিয়ান সুবিধার না।
ফারদিনা কিছু বলল না।দ্বিতীয়বার সুফিয়ান এর বাড়িটির দিকে তাকিয়ে দৌড়ে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। তাঁর ছুটে যাওয়ার ধরণ দেখে আশেপাশের অনুচারীগন তাকিয়ে ছিল।
ফারদিনা সোজা চলে যায় তাঁর ঘরে। জেবুন্নেছা দেখেছে ফারদিনাকে। কিন্তু সে আপাতত বিষয়টি এড়িয়ে গেল। তিনি প্রতি রাতের শেষ প্রহরের দিকে হাঁটতে বের হন।আজ বের হতেই ফারদিনার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে বিস্মিত হলেও কিছু বলল না।চলে যায় তাঁর গন্তব্যে।
ফারদিনা নিজের ঘরের দরজাটা ধব করে বন্ধ করে দিল।দেয়াল ঘেঁষে ধীরে ধীরে বসে পড়ে।দু হাঁটু ভাঁজ করে মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠল। তাঁর কান্নার শব্দ গুলো দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নিজের কান্না যেন নিজেই শুনছে। বিরক্ত লাগছে।খুব বিরক্ত হচ্ছে।
গত আটদিন ধরে সুফিয়ান এর সাথে তাঁর দেখা নেই কথা নেই।অথচ সেই মানুষটিই বলেছিল ‘তুমি বিরক্ত না করলে বিরক্ত হই। বিরক্ত করলে বিরক্ত হই না। তোমার বিনা বিরতিতে বলা প্রতিটি কথাই আমি মনোযোগ দিয়ে শুনি। আমার ভালো লাগে। শান্তি পাই।’
একদিন ফারদিনার দেখা না পেয়ে সুফিয়ান সারারাত অপেক্ষা করেছিল বাড়ির কিণারায়। এরপর ঘরে আলো দেখে প্রাচীর টপকে অবধি দেখেছিল ফারদিনাকে।আজমাত বাড়িতে আছে বলে তাঁর কত চিন্তা হত।আর আজ কতদিন পাড় হয়ে গেল তাঁর কথা হয়ত ভুলেই গেছে সুফিয়ান। সুফিয়ান এর গতকাল এর রুপ তাই বলে দিয়েছে।সে ফারদিনাকে ছেড়ে আনন্দে আছে। উল্লাসে মেতে আছে। এদিকে ফারদিনা যেন ঠুকরে ঠুকরে মরছে।
ফারদিনার ঘরের দরজা ধাক্কানোর শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই ঝিলমিল নয়ত আজমাত।ফারদিনার ইচ্ছে করছে না কারো সাথে কথা বলতে।একা থাকতে চাইছে। ওঁরা হয়ত তাঁকে বোঝাতে এসেছে। ঝিলমিল হয়ত কথায় কথায় কটু কথা শোনাবো ফারদিনাকে। কাঁটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটা দিবে।ফারদিনা এমনটা শুনতে পারবে না।যতই দরজা ধাক্কাক সে খুলবে না। এরপর হয়ত খুব বেশি দরকার পড়লে দরজা ভেঙ্গে ফেলবে। তাতেও ফারদিনার আপত্তি নেই।
ফারদিনা বেঁচে থেকেও যেন মৃ’ত্যুর স্বাদ পাচ্ছে। আত্মহ’ত্যা করার মত সাহস তৈরি করার চেষ্টা করছে।সাহস হচ্ছে আবার কোন কারণে থেমে যাচ্ছে।নিথর দেহ নিয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে ফারদিনা। শুধু নিঃশ্বাস নিচ্ছে।কিন্তু মনে হচ্ছে ভেতরের সত্তাটা আজ মৃ’ত।
বাঁশির সুর ভেসে আসছে। পশ্চিম দিক থেকে। হঠাৎ ফারদিনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শরীরের শক্তিও যেন ফিরে এসেছে। শোয়া থেকে উঠে বারান্দায় গেল।সুরের দিক অনুসরণ করে তাকাল। হঠাৎ সুর বন্ধ হয়ে গেল।সে ভুল শুনছে। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।ফারদিনা আবার কেঁদে উঠল।
কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে।নাকটা লাল হয়ে গেছে। চুলগুলো উস্কো খুস্কো হয়ে গেছে। সুফিয়ান এর ভাবনা গুলো মাথা থেকে বের করতে চাইছে,পারছে না। রাতভোর তাঁর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মস্তিস্কের নিউরনের মাঝে ভেসে ভেসে উঠছে।সুফিয়ান এর বাঁশির সুর তাঁর কানের কাছে ভাসছে।একদিন রাতে সে আর সুফিয়ান দূরে সমুদ্র পাড়ে গিয়েছিল,সেদিন রাতে সুফিয়ান এর সাথে একসাথে কতটা সময় কাটিয়েছে। সুফিয়ান নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিল। সেদিন রাত এর পরবর্তী মুহুর্ত গুলো আর ভাবতে পারল না ফারদিনা….।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ফারদিনা খানিকটা বিরক্ত হল। নিজেকে না সামলেই দরজাটা খুলে দিল। ঝিলমিল এসেছে। ঝিলমিল ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ওকে দেখে ফারদিনার কষ্টটা যেন আরো বেড়ে গেল। ঝিলমিল ফারদিনাকে শান্ত হয়ে বসতে বলল।ফারদিনা যেন ঝিলমিল এর নিয়ন্ত্রণে এসে, ওর কথা মত বিছানায় বসল। ঝিলমিল বলল ‘আর কাঁদিস না।তোরে কাঁদতে দেখতে আমার ভালো লাগে না রে।”
ঝিলমিল ব্যাকুল কন্ঠে নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বলল “নিজের প্রিয় মানুষটিকে অন্যর সাথে দেখার সৌভাগ্য কখনো কারো না হোক।_”
আজ সোমবার। সুফিয়ান আলিমনগর ফিরেছে ঠিক দশটি দিন পর। তাঁর ঘরের অবস্থা চৌচির হয়ে আছে।ফিরে এসে প্রথমে রাঙার খাবার এর ব্যবস্থা করেছে।রাঙা ঘাস খাচ্ছে। সুফিয়ান আরো কিছু ঘাস এনে রাঙাকে দিতে দিতে বলছে ‘দুদিন এর কথা বলে দশদিন পর ফিরেছি।মনে হয় আমার উপর ছোটখাটো সুনামি আঘা’ত হানবে।” রাঙা হ্রেষাধ্বনি তুলল। সুফিয়ান ঘেমে গেছে। সকাল সকাল ফিরে সে অনেক কাজ করেছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কোমরটা ঠিক করল।মাথা থেকে গামছাটা খুলে ফেলল। শরীর থেকে এখন কাদার গন্ধ আসছে। গোসলে যাবে। তাঁর আগে একবার ক্ষেতের দিকে গেল।ধান তোলার সময় উপযুক্ত হয়েছে।
সুফিয়ান কাঁধের উপর গামছাটা হাতে নিয়ে,ঘাড় ঘুরিয়ে তালুকদার বাড়ির দিকে দেখল। এরপর একবার ক্ষেতের দিকে তাকাল। সোলেমান,বদরু, হাবলু, লাল মিয়া ক্ষেতে কাজ করছে। সুফিয়ান চোখ সরিয়ে নিল। ওঁরা পালিয়ে গেছে।আর আসবে না।হয়ত আবার চুরি ডাকা’তি শুরু করেছে।হয়ত না, নিশ্চয়ই এতদিনে অনেক চু’রি ডাকা’তি করে অন্যর হক ছিনিয়ে নিয়েছে। সুফিয়ান ভুল দেখছে। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ভেবে ঘরের দিকে যেতেই পেছন থেকে লাল মিয়ার কন্ঠস্বর ভেসে আসল। “ভাই,রাগ করে আছেন বুঝি” বলে ওঁরা চারজন দৌড়ে সুফিয়ান এর কাছে আসে। তাঁর পায়ে পড়ে যায়।সোলেমান বলল “ভুল করছিলাম সেদিন, আমাদের ক্ষমা করুন। এতদিন আপনার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছি। আপনাকে পাই নাই।শুনেছি কোথাও গেছেন।এ ক’দিনে আমরা ক্ষেতেই কাজ করছি।কোন চুরি ডা’কাতি করি নাই।” সুফিয়ান এর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে না। বাস্তবেই ওঁরা আসছে। সুফিয়ান ওঁদের ধরে উঠাল। মুখে মৃদু হাঁসি এনে বলল “তোরা সত্যিই পরিবর্তন হয়ে গেছিস?
“হুঁ,আর অন্যায় কাজ করব না।কথা দিলাম।” বলল বদরু।
সুফিয়ান বলল “তাহলে আমি হেরে গিয়েও জিতে গেলাম।আজ সত্যিই খুব আনন্দ হচ্ছে।”
সোলেমান প্রসঙ্গ পাল্টে বলল “আপনার হবু বউয়ের খবর কি? আপনি চলে যাওয়ার পর তাঁকে আর দেখি নাই।”
লাল মিয়া বলল “একদিন দেখছিলাম। তিনদিন আগে,তারপর আর দেখি নাই।” সুফিয়ান এর মুখের রং হঠাৎ পাল্টে গেল।মাথা নিচু করে বলল “তোঁরা কাজে লেগে পড়। ততক্ষণে আমি তালুকদার বাড়ি থেকে আসছি।”
দিঘীর জলে রোদের কড়া ঝিলিক পড়েছে। জলের উপর রোদের ঝিলিক পড়ে তাঁর প্রতিফলন সুফিয়ান এর মুখে পড়ল। সুফিয়ান একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জলে নেমে পড়ল।গভীর জলে ডুব দিয়ে নিজেকে যেন ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলল।
গোসল শেষে উঠে ঘাটে আসল। গামছা দিয়ে শরীর মুছে ফেলল।তখন মনে হল কেউ লাল রঙের শাড়ি পরে তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান ফারদিনাকে ভেবে ঘুরে তাকাল।কেউই নেই তাঁর পাশে।ভুল দেখছে। বারবার হ্যালুসিনেশন হওয়ার বিষয়টি সুফিয়ান কে ভাবাচ্ছে। তাঁর বুকের ভেতর কেমন এক চাপা ব্যথা শুরু হয়েছে।যে ব্যথার কারণ সে নিজেও জানে না। আপাতত জানার চেষ্টা করছে না। তাঁর লক্ষ্য তালুকদার বাড়ি যাওয়া।
সুফিয়ান কালো রঙের পাঞ্জাবি বের করল। সাথে সাদা রঙের পাজামা। ঠান্ডা জলে গোসল করার পর হঠাৎ যেন শীত শীত অনুভব হচ্ছে তাঁর।কালো রঙের শাল বের করল। পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি ব্যবহার করল।কখনো সুগন্ধি ব্যবহার করা হয় না,আজ করছে।ফারদিনা তাঁকে বলছিল গোলাপ দিয়ে প্রেম নিবেদন করতে হবে।আজ করবে ভেবেছে। নিশ্চয়ই ফারদিনা রাগে আক্রোশে ফুঁসছে। সুফিয়ান ফারদিনার কথা ভেবে ঘর থেকে বের হল।গোলাপ গাছের দিকে এগিয়ে গেল।গোলাপ ফুটেছে।একটা গোলাপ ছিঁড়ে পাঞ্জাবির পকেটে রাখল।
তালুকদার বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলেই সামনে পড়ল মজিদ মিয়া। সুফিয়ান এর সামনে পথ রোধ করে দাঁড়াল। সুফিয়ান জিজ্ঞেস করল “চাঁচা, আপনাকে অনেকদিন পর দেখলাম। কোথায় ছিলেন?
মজিদ অদ্ভুত আচরণ করে বলল “তালুকদার বাড়ির দিকে যাইও না। তুমি বিবাহিত।বউ আছে। তাহলে তালুকদার বাড়ির মাইয়ার পেছনে পইরা আছো কেন?ওর জীবনডা নষ্ট কইরো না।”
সুফিয়ান আশ্চর্যজনক চোখে বলল “চাঁচা এসব আপনি কি বলছেন, আপনার মাথায় সমস্যা আছে অনেকেই বলতো,আমি বিশ্বাস করতাম না।এখন দেখছি সত্যিই সমস্যা আছে।সরুন সামনে থেকে।” বলে সুফিয়ান তাঁর পাশে কেটে চলে যায় তালুকদার বাড়ির উদ্দেশ্যে।
দূর থেকে সোলেমান,বদরু, হাবলু, লাল মিয়া সুফিয়ান কে দেখল। ওঁরা নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে বলল ‘সুফিয়ান ভাইর, সৌন্দর্য বুঝায় আরো বেড়ে গেছে।কি সুন্দর রাজপুত্রের মত লাগছে।” বলল লাল মিয়া।
মজিদ মিয়া ওঁদের দিকে তাকিয়ে বলল “রাজপুত্রের মত দেখালেই রাজপুত্র হয় না।” বলে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। ওঁরা কেউ তাঁর কথার পাত্তা না দিয়ে বলল “আস্ত একটা পাগ’ল। নিজের মেয়ের মৃত্যু’র শোক কাটিয়ে উঠতে না পেরে এখন ভালো মানুষকেও পাগ’ল বানাতে চাচ্ছে।” বলল সোলেমান।
সুফিয়ান তালুকদার বাড়ির মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।আজ থেকে দশ দিন আগের মত বাড়িটি আর আনন্দ উল্লাসের মত মেতে নেই। দাসীরা ছুটে ছুটে কাজ করছে না। খামার থেকে গরুর ঘন্টার টুংটাং শব্দ আসছে না।মনে হচ্ছে ওরাও কোন কারণে নীরব হয়ে গেছে।অনুচারীদের মধ্যে সে-ই তেজ ভাবটা আর নেই। সত্যিই কি নেই, নাকি সুফিয়ান এর ভাবনা।ভুল ভাবনা? সুফিয়ান কিছু বুঝতে পারল না।বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
ঘরের ভেতরে প্রথম পা রাখতেই একটা কালো বিড়াল সুফিয়ান এর দু পায়ের মাঝ দিয়ে চলে গেল। হঠাৎ বিড়ালের আগমনে সুফিয়ান কিঞ্চিত চমকে উঠল।চোখ পড়ল বৈঠকখানায়। রশীদ তালুকদার বসে আছেন।ওনার অভিব্যক্তি বেশ হতাশায় নিমজ্জিত।
সুফিয়ান তাঁকে সালাম দিল। রশীদ সালামের জবাব দিল সেকেন্ড কয়েক পর। এরপর ইশারায় সুফিয়ান কে বসতে বলল। সুফিয়ান বসে। তাৎক্ষণিক উপস্থিত হয় আদিব। কুদ্দুস হাতে একটা জলের পাত্র নিয়ে রান্নাঘর এর দিকেই যাচ্ছিল। হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও। রশীদ সুফিয়ান কে বলল তুই হঠাৎ এখানে?আজ কিসের জন্য এসেছিস?
দোতলার ঘরপাশের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আরিব,রায়ান, এবং সায়েম। সুফিয়ান কোন দ্বিধা না করেই বলল “চাঁচা আমি ফারদিনাকে ভালোবাসি।ফারদিনাও আমাকে ভালোবাসে।আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।”
রশীদ শুধু বসেই রইল নির্বাক হয়ে। কুদ্দুস অপলকে সুফিয়ান কে,কতক্ষণ রশীদ, কতক্ষণ আদিব এর দিকে দেখছে।আদিব ধীর পায়ে হেঁটে রশীদ এর পেছনে দাঁড়াল।
রশীদ বলল “তোর আর ফারদিনার মধ্যে প্রেম চলে তা আমি আগেই একটু একটু টের পেয়েছিলাম।তবে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে আদিব আমাকে তোর আর ফারদিনার ব্যাপারে সবটা বলে। বিয়ের প্রস্তাব তো বলতে গেলে তুই আগেই দিয়েছিস,আজ তো বিয়ের জন্যই এসেছিস তাই না?” অর্থ ছাড়া যুক্তিহীন মনে হল রশীদ এর কথা।আদিব যেহেতু সবটা জেনে গেছে এর মানে ফারদিনা সবটা বলে দিয়েছে। সুফিয়ান ফিরে এসে ফারদিনাকে বিয়ে করবে বলেছে। সেটাও হয়ত জেনে গেছেন তাঁরা,হয়ত তাই বলেছে আজ বিয়ে করতেই এসেছে। সুফিয়ান তাই ধরে নিল।নিজেই নিজের ভাবনার সমাধান দিল।
সুফিয়ান ছোট্ট করে বলল “হুঁ সেটাই।’
রায়ান দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলল “কিন্তু তুই আসতে দেরি করে ফেলেছিস সুফিয়ান।” সুফিয়ান এর হৃদয় হঠাৎ ধকধক ধকধক করে উঠল।সে যেদিন সিন্ধুতলি গ্রামের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল,সেদিন বিদায় বেলা ফারদিনা একবার বলেছিল,ফিরে এসে আমার লা’শ না দেখো।” সুফিয়ান খা’রাপ কিছু ভাবতে চাইল না। চোখ তুলে আদিব এর দিকে দেখল। রশীদ ছড়ি হাতে উঠে দাঁড়ালেন।সে নিস্তেজ শরীরে তাঁর ঘরের দিকে চলে যান। সুফিয়ান বলল “আমি দেরি করে ফেলেছি মানে?আদিব কে জিজ্ঞেস করল।
“ফারদিনা আজমাত কে বিয়ে করে ঠিক গতকাল এই সময়ের দিকে কিরগিজস্তান এর উদ্দেশ্যে চলে গেছে।”
‘ফারদিনা আজমাত কে বিয়ে করে চলে গেছে।ফারদিনা অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলেছে।’ একাধিক শব্দ যেন সুফিয়ান এর আশেপাশে ঘুরঘুর শুরু করল।সে যেন নিজের শরীরের ভরটাই হারিয়ে ফেলছে।চোখ দু’টো শূন্যে উঠে গেল।সে অবাক হয়ে থেকে, ভেঙে পড়ার মাঝামাঝি এক অচেনা স্থিরতার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে যেন। চোখের কোণে জল জমছে, কিন্তু পড়ছে না।ঠিক যেন চোখের ভেতরে আটকে থাকা এক ঝড় বাইরে বেরোতে পারছে না।
ঠোঁট দুটো কাঁপছে তাঁর। হাঁটু দুটো কাঁপুনি দিয়ে উঠতে চাইছে সুফিয়ান সামলে নিচ্ছে।চাইলেও যেন বলতে পারছে না কিছু।বুকের ওপর অদৃশ্য পাথর চেপে আছে, নিশ্বাস নিতে ব্যথা লাগছে।গলার হাড়ের কাছে ধকধক স্পন্দন।প্রতিটি স্পন্দন তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে ফারদিনার কথা।
সুফিয়ান নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে বলল “তোরা মিথ্যা বলছিস,ও হঠাৎ করে এমনটা করতে পারে না।ফারদিনা আমাকে ভালোবেসেছিল। সত্যিকারের ভালবাসা।প্রতারক নয় ও।”
আদিব বলল “তুই বিশ্বাস না করলে সত্যটা মিথ্যা হয়ে যাবে না।”
“আমি ওর ঘরে একটাবার যেতে চাই।”
আদিব বলল “যেতে পারিস,তবে ঘর ফাঁকা।’
রায়ান বলল “শুধু শুধু নিজের কষ্ট বাড়াস না।ওর স্মৃতি থেকে দূরে থাক।”
সুফিয়ান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।সবার দিকে একবার তাকাল। নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘর থেকে বের হতেই বেখেয়ালি ভাবে দরজার সাথে ধাক্কা লাগল। এরপর একা একা বিড়বিড় করে কিছু বলল যা,নিজের কাছেই অস্পষ্ট।
তালুকদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। দিগ্বিদিক হারিয়ে পথে হাঁটা শুরু করল। নিজের বাড়ির দিকে রওনা করেছিল কিন্তু ভুলে সে চৌরঙ্গী হাটের দিকে চলে যাচ্ছে।কোন দিকে যাচ্ছে খেয়াল নেই সুফিয়ান এর।যেতে যেতে ফারদিনার কথাগুলো ভেসে উঠছে বারবার কানের কাছে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে গোলাপ টা বের করল। গোলাপ এর দিকে তাকাতেই তাঁর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। অনর্গল জল গড়িয়ে পড়ছেই।ফারদিনা কে সে তাঁর মায়ের পরের স্থানটা দিয়েছিল। বিশ্বাস করেছিল। আজ তাঁর বিশ্বাস এর জায়গাটা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে গেছে। নিজেকে নিজের আ’ঘাত করতে ইচ্ছে করছে। শরীরের আঘা’ত এর থেকে মনের আঘা’ত হয় অসহনীয়।যার ফলে মানুষ হয় নিজের মৃ’ত্যু নিজে ডেকে আনে,নয়ত ধীরে ধীরে মরে। সুফিয়ান ধীর ধীরে না, একবারেই ম’রতে চাইছে।
গোলাপ ফুলটা ছিঁড়ে ফেলল।ছেঁড়া পাপড়ি গুলো উড়ে মাটিতে পড়ল।একটা পাপড়ি এসে সুফিয়ান এর বুকের সাথে লাগল। সুফিয়ান সেটাকে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে আবার ফেলে দিল সবটুকু রাগ পাপড়িটার উপর দেখিয়ে।
সুফিয়ান যেতে যেতে চৌরঙ্গী হাটের কাছাকাছি চলে গেছে। কিন্তু সে এখন পর্যন্ত জানে না কোন পথে সে হাঁটছে!একটা ঘোড়ার গাড়ি তাঁর পেছন থেকে টকটক শব্দে তেরে আসছে।সুফিয়ান পথের মাঝখান দিয়ে হাঁটছে।সারথী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে ‘ও ভাই পথের মাঝে দিয়ে সরেন,পাগ’ল নাকি,পথের মাঝখানে হাঁটে।’
সুফিয়ান এর হবে হুঁশ ফিরল।পা’গল কথাটা তাঁর গায়ে লাগল। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া না করে পাশে সরে গেল।
চৌরঙ্গী হাট বাজারে সুফিয়ান পৌঁছে যায়। বাজার থেকে একাধিক মানুষের কলরব শব্দ ভেসে আসছে। সুফিয়ান দাঁড়িয়ে পড়ল। চারদিকে তাকাল।বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্যমনস্ক হয়ে বাজারে চলে এসেছে।
আমদানিকৃত সিগারেট এর দোকান দেখা গেল। সুফিয়ান কিছু সিগারেট কিনল।একটা ধরিয়ে টানতে শুরু করল। দোকানের এক পাশে বসল।দোকানি সুফিয়ান কে দেখছে। উদাসীন লাগছে তাঁকে। সিগারেটে দু এক টান দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। নতুন করে আবার একটা ধরাচ্ছে।দোকানি খুশি হল। আমদানিকৃত সিগারেট এর অনেক মূল্য। এগুলো ইউরোপ থেকে আসে। জমিদার, এবং এক কথায় টাকাওয়ালা ছাড়া এই সিগারেট কেউ কিনতে পারে না। নতুন দোকান দেয়ার পর সুফিয়ান তাঁর প্রথম কাষ্টমার।
সুফিয়ান সিগারেট টেনেই যাচ্ছে।বেশ কিছুদিন ধরে ধুমপান থেকে সুফিয়ান দূরেই ছিল।বাজে নেশা বলে ছেড়েই দিয়েছিল।আজ আবার হাতে তুলে নিল সিগারেট। একজন লোক এসে সুফিয়ান এর পাশে বসল।বয়স তাঁর আন্দাজ করা যায় চল্লিশের কাছাকাছি।সে সুফিয়ান এর অভিব্যক্তি দেখে বলল “ভাই,কোন সমস্যা?
সুফিয়ান চুপচাপ।সে শুনেইনি তাঁর প্রশ্ন।লোকটি আবার বলল “ভাই, মানসিক ভাবে অসুস্থ মনে হইতাছে। কিছু হইছে? বন্ধু ভাইবা কইতে পারেন’
সুফিয়ান সিগারেট টা ফেলে আরেক টা ধরিয়ে বলল “একজনকে ভালোবেসে ঠকে গেছি ভাই।’
লোকটি নিঃশব্দে হাসল।
“মাইয়া মানুষ এমনি ভাই। কিন্তু, আপনার কাহিনী কি,সে প্রতারণা করলো ক্যান,আপনারে দেইখাতো ভালো ঘরের পোলা মনে হইতেছে!আমি এই গ্রামে নতুন তো,তাই সবাইরে ঠিকঠাক মত চিনি না।আপনারে হয়ত সবারই চেনার কথা,দেখে তো….!” বাকি কথা বলল না লোকটি।
সুফিয়ান অল্প সময়ের মধ্যে সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনা লোকটিকে খুলে বলল। লোকটি শুনে বলল ‘বেইমান বেইমান। কষ্ট পাইয়েন না। ভাগ্যে থাকলে দেখা হইবো আবার।’
সুফিয়ান বলল “বেইমান মানুষটার প্রতিটি মূহুর্ত সুন্দর হোক, কিন্তু তাঁর সাথে আমার দেখা না হোক।”
লোকটি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল “আচ্ছা ভাই, আপনি বললেন গতকাল জমিদার এর মাইয়া বিদেশি পোলার লগে কিরগিজ চইলা গেছে, কিন্তু গত এক সপ্তাহ ধইরা জাহাজ চলাচল বন্ধ। বিদেশ পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব।আমিও বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতাছি। সরকার আপাতত বিদেশে যাওয়ার জন্য জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখছে।দূর দেশে পাড়ি দেওনের লইগা সমুদ্র পথ ছাড়া তো আর কোন পথ নাই।”
সুফিয়ান এর দৃষ্টি হঠাৎ করে স্থির হল।ভ্রু কুঁচকে লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল “আপনি কি নিশ্চিত?
“আমি গত কয়দিন ধইরা এসব নিয়াই ঘাঁটাঘাঁটি করতেছি।আর আমি ভুল কমু।’
সুফিয়ান কঠিন ভাবনায় তলিয়ে বলল ‘চলুন”
“কোথায় যাইবেন?
“বোম্বের অ্যাপোলো ঘাটে।যেখান থেকেই বিদেশগামী স্টিমার ছাড়ে।”
আলিমনগর গ্রাম থেকে সুফিয়ান ও লোকটি শহরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।ট্রেনে যেতে তাঁদের ঘন্টা দুয়েক এর মত সময় লাগল। তাঁরা শহরে পৌঁছে চলে যায় বোম্বের অ্যাপোলো ঘাটে। সুফিয়ান একজন নাবিক কে দেখতে পেল। তাঁকে গিয়ে বেশ হতাশ ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল “গতকাল কি কোন জাহাজ কিরগিজস্তান এর উদ্দেশ্যে গিয়েছে?
নাবিক প্রথমে সুফিয়ান কে দেখল। এরপর বলল “না,গত এক সপ্তাহ জাহাজ চলাচল বন্ধ। দেখছেন না,সব জাহাজ ঘাটে।”
সুফিয়ান থমকে গেল।পাশ থেকে তাঁর সাথে আসা লোকটি বলল “ভাই আমার কথা অহন বিশ্বাস করলেন তো। কিন্তু আমার প্রশ্ন হইলো,তাইলে জমিদার এর কন্যা কোথায়?
সুফিয়ান জাহাজ ঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সূর্য এখুনি ওর সমস্ত তাপশক্তি গিলে চলে যাবে আঁধারে। যেভাবে ফারদিনা তাঁকে ফেলে লুকিয়ে গেছে।_
আলিমনগর এর রাতটা আজ নিস্তব্ধ। অস্বাভাবিক শান্ত। কোথাও,পাখি, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, শেয়ালের ডাক,কিছুই ভেসে আসছে না। সুফিয়ান শহর আলিমনগর ফিরেছে মধ্যরাতের দিকে।ফিরেই তালুকদার বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরছে।ক’জন অনুচারী কে ফারদিনার কথা জিজ্ঞেস করেছে। ওঁরা কেউ ফারদিনার খোঁজ দিতে পারেনি। সুফিয়ান কৌশলে একজন অনুচারীর সাহায্য বাড়িটির ছাদে গিয়েছিল।ফারদিনার গোলাপ গাছটার খোঁজে।গাছটা মরে গেছে। অযত্নে অবহেলায়। সুফিয়ান এর তখন বুকটা কেঁপে উঠেছিল।ফারদিনা বলেছিল ‘যেদিন আমার গোলাপ গাছটা ঝড়ে যাবে,সেদিন ভাববে আমিও মরে গেছি।’
ফারদিনার কিছু হতে পারে না বলে সুফিয়ান নিজেকে সামাল দিচ্ছে।বাড়ির পেছনের দিকে এসেছে,আজ ফারদিনার ঘরে আলো জ্বলছে না। সবকিছু কেমন নীরব।যে নীরবতা আগে কখনো ছিল না তালুকদার বাড়ি জুড়ে।
সুফিয়ান তাঁর বাড়ি ফিরে আসে।রাঙা হ্রেষাধ্বনি তুলছে বারবার।ওর দিকে ঘুরেও তাকাল না সুফিয়ান। সোজা ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। সোলেমান তাঁকে সে-ই সকাল থেকেই অনুসরণ করছিল। সুফিয়ান শহরে গেছে ভেবে সোলেমান চিন্তা করছিল। কিসের জন্য গিয়েছে জিজ্ঞেস করবে করবে করে কখন থেকে পিছু পিছু ঘুরছে।এখনও সুযোগ হয়নি।সুযোগ করার জন্য সুফিয়ান এর ঘরে প্রবেশ করল।
সুফিয়ান টেবিলের সামনে বসে আছে।দু হাত দিয়ে মাথার চুল গুলো টেনে শক্ত করে ধরে রেখেছে। সোলেমান গা ঘেঁষে পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। সুফিয়ান হাতের সাহায্যে চোঁখের জল মুছল। এরপর হাতে নিব কলম তুলে নিল।গত ক’দিন এর ঘটনা নতুন একটি পৃষ্ঠায় লিখছে। আজকে সারাদিন উদ্ভ্রান্ত পথিক এর মত ফারদিনাকে খুঁজেছে।পায়নি।ফারদিনার লাগানো গোলাপ গাছটি অযত্নে মরে গেছে। সুফিয়ান এর খুব কষ্ট হচ্ছে। পুরুষেরা কাঁদে না।লোকে বলে। আজ সুফিয়ান ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তাঁর কান্নার আওয়াজ সোলেমান এর কানে গেল। সোলেমান শহরের বিষয়টি পাল্টে বলল “আপনি আপনার জীবনের কাহিনী খাতা কলমে লিখছেন।আজ সারাদিন আপনি পাগ’লের মত ছুটছেন।হয়ত আপনার হবু বউয়ের জন্য।” থেমে সোলেমান আবার বলল ‘তালুকদার বাড়ি হঠাৎ করেই যেন সর্বশান্ত হয়ে গেছে।এক কথায় নীরব জমিদার বাড়ি।’ এতটুকু বলে আবার থামল। সুফিয়ান লেখা থামাল না। সোলেমান আবার বলল “আপনি জীবনের গল্পের নাম কি?
সুফিয়ান এবার বলল “আমার জীবনের আলাদা কাহিনী নেই।সবটা জুড়েই ছিল ফারদিনা। আমার জীবনের সাথে তাঁকে জড়িয়ে চেয়েছিলাম, ফারদিনা আর আমার প্রেমের উপাখ্যান তৈরি করতে। কিন্তু হঠাৎ করেই ফারদিনা হারিয়ে গেল।’
সোলেমান বলল “তবুও আপনার জীবনের গল্পের একটা নাম দিন। যদি কোনদিন আপনার লেখাগুলো সাড়া বিশ্বের মানুষের হাতে যায়, সে-ই ভেবে।”
সুফিয়ান হেসে বলল ‘লেখাটা শুধু আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক।’
সোলেমান হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল ‘আপনি সত্যিই কৃষক তো?” থেমে ভয়ে ভয়ে আবার বলল “আমি আর একটা জানতে পেরেছি, মজিদ মিয়ার কাছ থেকে ফারদিনা আপনার ঠিকানা নিয়ে আপনার খোঁজে আপনার গ্রামে গেছিল। সেখানে নাকি আপনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থায় ফারদিনা দেখেছে।হয়ত সে-ই শোকে…” সোলেমান ঢোক গিলল।ও যেন কিছু জানার মত ভান ধরল।অথচ ও কিছুই জানেনা। শুধু এতটুকুই জানে, সুফিয়ান আজ সারাদিন খুঁজেও ফারদিনার কোন হদিশ পায়নি।
সুফিয়ান সোলেমান এর প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।হাতে কলম তুলে লিখল,’সত্যটা না জেনেই আমার জীবন থেকে চলে গেলে?’
এরপর যে পৃষ্ঠা থেকে লেখাগুলো শুরু করেছিল সেখানে গেল। উপরের একটি অংশে কাঁপা হাতে লিখল দ্য সাইলেন্ট ম্যানর’।
এরপর করুন কন্ঠে একবার বলল “আমি বোধহয় ফারদিনাকে হারিয়ে ফেললাম। এবার হয়ত তোরাও আমায় হারিয়ে ফেলবি।_
ভোরের আলো ফুটেছে।তখন ফজরের আযানের সাথে সাথেই মীর এর বইটি পড়া শেষ হয়। তাঁর চোখে জল।আহির এবং রাফিদ দুজনের চোখই জল।আহির স্তব্ধ হয়ে গেল। শ্বাস ফেলে বলল “সুফিয়ান হয়ত ফারদিনাদের বাড়িটি ঘিরেই তাঁর বাস্তব ঘটনার নাম দিয়েছে দ্য সাইলেন্ট ম্যানর’। হইহুল্লোড়ে ভরা তালুকদার বাড়িটি হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গিয়েছিল।সেখান থেকেই শেষ হয় দ্য সাইলেন্ট ম্যানর’ এর কাহিনী। কিন্তু আমি যেন নিজেকে সামলাতে পারছি না।
The Silent Manor part 38
মীর বলল “কান্না পাচ্ছে অনেক।ফারদিনা বিদেশ যায়নি, রশীদ তালুকদার নির্বিকার কন্ঠে সুফিয়ান কে মেনে নিয়েছিল, হঠাৎ ফারদিনা নি’খোঁজ,আর শেষমেষ তাঁর গোলাপ গাছটা মরেই গেল।’
রাফিদ বলল ‘আর শেষমেষ অপূর্ণ থাকল, দ্য সাইলেন্ট ম্যানর’ বইটি।__
