The Silent Manor part 40
Dayna Imrose lucky
সকাল দশটার দিকেও আজ পুরো বাড়িটা শান্ত।একটু ধীরগতি। চারদিকের আলো এখন পুরোপুরি উজ্জ্বল।সূর্যের কোমল আলো উঠোনে হালকা সোনালি ছায়া ফেলেছে। বাড়ির লম্বা বারান্দা জুড়ে শিউলি গাছের পাতায় হালকা বাতাস দুলে দুলে নরম শব্দ তুলছে।
দালানের দেয়ালে সকাল বেলার রোদ পড়ে একধরনের উষ্ণতা তৈরি করে। উঠোনে দু–একজন কাজের লোক ঝাঁটা দিচ্ছে, রান্নাঘর এর দিক থেকে হালকা ধোঁয়া আর ভাজাভুজির গন্ধ ভেসে আসছে। পেছনের দিকে গোয়ালঘরে গরুর ঘণ্টি মাঝে মাঝে টুনটুন করে বাজে।
আহির এর ঘরের বারান্দা থেকে পুকুর পাড়টা দেখা যায়।পুকুর এর জলটা এখনো শান্ত। হাঁসের সাঁতারে হালকা ঢেউ উঠছে।বাড়ির পরিবেশে কোনো হৈচৈ নেই। একধরনের ভোর-সকালের স্থিরতা।
স্থিরতা ঘিরে আহির।নিবীড় চোখে দূর আকাশে চেয়ে আছে। তাঁর চোঁখের সামনে শুধু ফারদিনা আর সুফিয়ান এর কথাগুলো, একসাথে তাঁদের কাটানো মুহূর্তগুলো যেন তাঁর সামনে স্পষ্ট ভাবে ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সুফিয়ান এর শেষ কথাগুলো তাঁর কানের কাছে বিদ্ধ হয়ে আছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বিচ্ছে’দ কখনোই সুন্দর হয় না। বিচ্ছেদ যদি হয় ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে,দু’জন দু’জনের থেকে চিরদিনের জন্য দূরে সরে যাওয়া,তবে সে-ই বিষা’ক্ত আঘা’ত যেন মৃ’ত্যুর মতই কঠিন। ভালোবাসা সুন্দর, কিন্তু কখনো কখনো এর শেষ পরিণতি ভয়াবহ হয় ভেবে আহির যেন স্তব্ধ হয়ে গেল পুরোপুরি।
ভোরবেলা বইটি পড়া শেষে রাফিদ,মীর বিছানায় শুয়ে শুয়ে সুফিয়ান এবং ফারদিনার বিষয়ে আলোচনা করতে করতে দু’জন ঘুমিয়ে যায়। সারারাত জেগে ছিল বলেই এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।আহির বারান্দা থেকে ঘরের ভেতরে চলে আসল। পায়চারি করতে করতে ভাবছে এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে?কার কাছে যাবে?কে তাঁদের শেষ পরিণতির ঘটনা বলতে পারবে? কোনটিকে আগে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ, মিলনের অস্বাভাবিক মৃ’ত্যু ? নাকি, সুফিয়ান এবং ফারদিনার সাথে কি ঘটেছিল তা উদ্ঘাটন করা? তাঁরা বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলে কোথায় আছে?তবে সে নিশ্চিত বেঁচে নেই তাঁরা।তবে আল্লাহর ইচ্ছাতে দীর্ঘায়ু পেয়ে থাকলে হয়ত বেঁচে আছে।আহির যেন অতিরিক্ত আশা করে ফেলল।
আহির এর মাথায় একাধিক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।স্থির হতে হবে। শান্ত মস্তিষ্কে ভাবতে হবে।আজ দিঘীর পাড়ে গতকাল এর অচেনা অশ্বধারী লোকটি অপেক্ষা করবে।উনি নিশ্চয়ই কিছু জানেন! নয়তো, সুফিয়ান এবং ফারদিনার শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁদের খুঁজে বের করতে লোকটি আপ্রাণ চেষ্টা করছে।হয়ত তিনি নিজেও অনেক ভাবে খুঁজেছেন তাঁদের। পায়নি।আহির একজন গোয়েন্দা বলে অনেক আশা নিয়ে এসেছে তাঁর কাছে।আহির তাঁর আশা ভঙ্গ করবে না।
বুলবুল আসে আহির এর ঘরে। দরজা খোলা ছিল।বলল “আপনাদের নিচে নাস্তা খেতে ডাকছেন মালকিন। তাড়াতাড়ি আসুন।” বলে চলে গেল।আহির কোন কিছু বলল না।মীর ও রাফিদ কে ডাকল।উঠছে না। এভাবে ডাকলে হবে না।আহির জলের জগ থেকে হাতে জল নিয়ে তাঁদের দিকে ছিটিয়ে মারল।মীর নড়েচড়ে শোয়।রাফিদ এপাশ-ওপাশ করল।আহির পুনরায় ডাকল।বলল “গতকাল এর অচেনা লোকটি, যিনি আমাকে বইটি পড়তে বলেছেন সে দিঘীর পাড়ে অপেক্ষা করবে।চল, ওনার সাথে দেখা করে আসি।”
মীর ঘুমঘুম চোখে উঠে বসল। এরপর রাফিদ কে টেনে টেনে তুলল।রাফিদ হাই তুলে বলল “জানিস,আমি ঘুমের ঘোরে তাঁদের স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে তাঁদের পূর্ণতা মিলেছে।”
রাফিদ রসিকতা করছে বলে মীর বলল “মজা করছিস,আর আমি তাঁদের নিয়ে চিন্তিত।কি হয়েছিল জানার আমার বেশ আগ্রহ।”
আহির তাড়া দিয়ে বলল “গতকাল আমরা না খেয়েই ছিলাম।খিদে পেয়েছে।চল, দ্রুত খাওয়া দাওয়া সেরে ওনার সাথে দেখা করে আসি।” আহির এর সাথে মীর ও রাফিদ একমত পোষণ করল।
খাবার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য। রাফিদ,মীর আগে আগে সিঁড়ি বেয়ে নেমে টেবিলে গিয়ে বসল।আহির কালো রঙের শার্ট এর হাতা ভাঁজ করতে করতে নিচে নামছে। গৌরী চোখ তুলে একবার তাঁর দিকে তাকাল। দ্বিতীয়বার চোখ সরিয়ে সবাইকে খাবার পরিবেশন করতে শুরু করল।আহির চেয়ারে বসল। টেবিলের এক প্রান্তে আমজাদ, অপরপ্রান্তে আহির। আমজাদ খাবার মুখে তুলতে তুলতে বললেন “তা গোয়েন্দা বাবু, তদন্ত কতদূর?” আমজাদ কে কিছুটা উৎফুল্ল মনে হল।আহির জবাবে বলল “প্রায়ই সত্যর কাছাকাছি।খু’নিকে শীঘ্রই শনাক্ত করে ফেলব।মিলন হ’ত্যার সঠিক বিচার হবে। আমার হাত থেকে আজ অবধি কোন সত্য লুকিয়ে থাকতে পারেনি।আজও পারবে না।”
আমজাদ বললেন “তোমার যতদিন খুশি এখানে থেকে তদ’ন্ত করো।কারণ, আমার একমাত্র কন্যা মায়ার বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের আয়োজন কাল পরশুর মধ্যে শুরু করব। গ্রাম, শহরের অনেক চেনা পরিচিতি মানুষদের নিমন্ত্রণ করতে হবে। অনেক কাজ। তুমি থাকলে আরো সুবিধা হবে।”
আহির মসৃণ হেসে বলল “আশাকরি আমার কাজ শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। এরপর মায়ার বিয়েতে জমিয়ে আনন্দ করব।” বলা শেষে মায়ার দিকে ঘুরে তাকাল।মায়া কিছু বলল না। চুপচাপ খাচ্ছে।মীর কিছুক্ষণ চেষ্টা করছে মায়াকে তাঁর দিকে তাকানোর জন্য। কিন্তু মায়া কারো কোন কথার প্রতিক্রিয়া করল না।কারো দিকে তাকাচ্ছেও না।
মীর খেতে খেতে চিন্তা করছে, কিভাবে মায়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। গতকাল সারারাত বসে তাঁরা দ্য সাইলেন্ট ম্যানর’ বইটি পড়েছে,মায়ার পছন্দের বই।মায়া বলেছিল মীর কে বইটি পড়তে।বইটি পড়েছেন আরো একজন। থমাস শন।মীর থমাসের দিকে তাকিয়ে বলল “বাবা, তুমি আমাকে একটা বইয়ের কথা বলেছিলে না,দ্য সাইলেন্ট ম্যানর!বইটি আমরা পড়েছি গতরাতে।”
“কেমন ছিল অসম্পূর্ণ বইটি? থমাস খাবার হাতে প্রশ্ন করলেন।
মীর থমকে বলল “বইটি পড়ে রিতিমত আমরা নির্বাক।মাথার মধ্যে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, সুফিয়ান অর্থাৎ বইটির লেখকের সেদিন এর পর কি হয়েছিল?ফারদিনাই বা কোথায়?”
“আমিও জানার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যর্থ হই।” মায়া শীতল চোখে মীরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর বলা বইটি নিয়ে কথাগুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আহির থমাস শন এর প্রশ্ন টেনে বলল “আঙ্কেল,এটা বাস্তব ঘটনা,এর শেষ পরিণতি কী হতে পারে, আন্দাজ করতে পারছি না।তবে এই ঘটনা কেউ না কেউ নিশ্চয়ই জানে।আমি এই সত্য বের করব, সুফিয়ান এবং ফারদিনার অমর প্রেম কাহিনী জানতেই হবে।” আহির এর চোখে তেজ আর কন্ঠে যেন হিমশীতলতা।শালুক মীর, এবং আহির এর দিকে তাকিয়ে বললেন “আর যাই কর,সত্য উদঘাটন করতে গিয়ে নিজেদের আবার ক্ষতি করিস না।”
মায়া এতক্ষণ পড়ে মুখ খুলল।দ্য সাইলেন্ট ম্যানর বইটির অসম্পূর্ণ কাহিনী তাঁরা খুঁজে বের করব।সে খুশি মনে আহির কে লক্ষ্য করে বলল “আপনি বইটির সম্পর্কে জানতে পারলে আমাকে নিশ্চয়ই জানাবেন।”
মীর বলল “হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই জানাব, বিয়ের কনে তুমি,আর বিয়ের কনেদের কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখতে হয় না।” মায়া চোখ ছোট করে ক্রোধে জ্বলে মীরের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।মীর বিড়বিড় করে বলল “মেয়ের তেজ না যেন আগুন।”
আমজাদ বইটির বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা একদম পছন্দ করছেন না। তিনি অসম্ভব কঠোর চোখে আহির এরপর মীর এবং মায়ার দিকে তাকালেন। বললেন ‘তোমরা একটা সামান্য গল্প নিয়ে মাতামাতি করছো।”
আহির বলল “এটা গল্প নয়, বাস্তব।”
সকালের নাস্তার পর্ব শেষ হয়। আমজাদ, এবং থমাস শন কারখানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান। সাথে আছে আমজাদ এর ম্যানেজার আবুল। আজকাল কারখানার দায়িত্বে আমজাদ সময় দেয়ার চেষ্টা করেন।থমাস এর সাথে সে-ই সুবাদে অন্তত আলাদা সময়ও কাটানো যায়।থমাস আজকাল বেশ তাড়া দিচ্ছে মায়ার বিয়ে নিয়ে আমজাদ কে। বারবার বলছে মায়ার বিয়ের কাজটা দ্রুত সেরে ফেলতে।যত দ্রুত মায়ার বিয়ের কাজ শেষ হবে,সে তত দ্রুত থাইল্যান্ডে ফিরে যেতে পারবে।
আহির আগে আগে তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে উঠোনে পায়চারি করতে করতে সিগারেট ধরাল। অশ্বশালার দিকে তাকাতেই চোখ পড়ল পুকুর পাড়ে।সেখানে গৌরী এবং মায়া হাঁসাহাঁসি করছে।আহির সিগারেটটা ফেলে দিল। একবার ঘরের দিকে তাকাল।রাফিদ,মীর এখনো বের হয়নি।
সে পুকুর পাড়ে গেল।মায়া ঘাটের উপর বসে আছে। গৌরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে। মুখে একরাশ হাঁসি। তাঁর পরনে মেরুন রঙের সুতি কাপড়ের থ্রিপিস।চুল গুলো বেনুনি করা।আহির যেন আজ প্রথমবার গৌরির সৌন্দর্য উপলব্ধি করছে। চোখে পড়ছে।নিশ্ছিদ্র নীরবতার ভেতর দিয়ে যেন হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া এক অপরূপা সুন্দরী নারী।তাঁকে প্রথম যেদিন আহির দেখেছিল প্রথমেই তাঁর চোখ থমকে গিয়েছিল।তার গায়ের রঙ যেন ভোরের শিশিরে ভেজা চাঁদের উজ্জ্বল আলোর মতন।চুলগুলো কোমর ছুঁয়ে নেমে এসেছে, কালো রেশমের মতো মসৃণ, হালকা বাতাসে দুলে উঠলেই মনে হয় দিনের আকাশের সূর্যের কিরণ নড়ে উঠেছে।চোখ দু’টি বড়, গভীর,যেন স্থির পুকুরে জমে থাকা রহস্য।তার দৃষ্টিতে আছে এক অদ্ভুত টান।নরম, শান্ত।আবার কোথাও একটু অপ্রকাশ্য বিষাদ লুকিয়ে আছে যেন।চোখের পাপড়িগুলো লম্বা ও মোটা, পাখার মতো দোল খাচ্ছে।নাকটি ছোটখাটো, তীক্ষ্ণ, ভীষণ মানানসই তাঁর মুখাবয়বের সঙ্গে। থুতনির আঁকার কিছুটা সরু।মুখের গড়ন যেন শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা,পরিপাটি, আকর্ষণীয়, একটুও বাড়তি নয়।
আহির আকৃষ্ট হল গৌরীর সৌন্দর্যে।গৌরির দিকে পা বাড়াতেই মীর এর কন্ঠ ভেসে আসল।সে ডাকছে।আহির আর সামনের দিকে পা বাড়াল না। ঘুরে মীর এবং রাফিদ কে নিয়ে দিঘীর পাড়ের দিকে তিনজন অশ্ব নিয়ে বেরিয়ে যায়।গৌরী মায়ার আড়ালে একবার দূর থেকে আহির এর দিকে দেখল। না চাইতেও ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো হাঁসি চলে আসে।
দিঘীর পাড়ে বড় বড় গাছ ব্যতীত কিছুই দেখা যাচ্ছে না।দিঘীর পাড়ে গাছ, দিঘীর জল ব্যতীত আর কিইবা দেখা যাবে? দিঘীর ঘাটের অবস্থা ভাঙ্গচুর।দীর্ঘদিন ধরে দিঘীর পাড়ের যত্ন কেউ নেয় না।বোধহয় কারো দরকার হয় না। চারদিকটা কেমন ছন্নছাড়া।মীর বলল “আমি ওদিন রাতে, মোহিনীর চিঠি নিতে এখানেই এসেছিলাম।” বলে অশ্ব থেকে নামল।আহির অশ্ব থেকে নেমে অচেনা অশ্বধারী লোকটি কে খুঁজল।
দিঘীর পুব তাকাল আহির।অচেনা সেই বয়স্ক অশ্বধারী লোকটি দাঁড়িয়ে আছে।পরনের পোশাকটা খুবই সাদামাটা, তবু চোখে পড়ার মতো। ধুলো মাখা মলিন মাটি-রঙা কুর্তা, হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে। তাঁর উপর শীতের মোটা পোশাক।বহু পথ পাড়ি দেওয়ার ক্লান্তি তার ভাঁজে লেগে আছে। পায়ে পুরনো চামড়ার স্যান্ডেল, হাঁটুর কাছে ওঠা ধুলো স্পষ্ট।কোমরে বাঁধা ক্ষয়ে যাওয়া কাপড়ের বেল্ট, তাতে ছোট একটি থলে ঝুলছে। সব মিলিয়ে তাঁর পুরো পোশাকই বলে দিচ্ছে,এই মানুষটা বহু দিন ধরে রাস্তায়,অশ্বের পিঠে, পথের সঙ্গী হয়ে আছে।
দিন বলে স্পষ্ট দেখা গেল তাকে।তবে মুখটি দেখা গেল না।আহির চেষ্টাও করল না। তাঁর দিকে তাঁরা তিনজন এগিয়ে গেল।লোকটির চোখ দুটো বেশ বিবর্ণ দেখাল।নীরব স্থির চোখে দূর প্রান্তে তাকিয়ে আছে। সেদিকে শুধু খোলা মাঠ।আহির লোকটির পাশে দাঁড়িয়ে বলল “আপনার কথা মত,দ্য সাইলেন্ট ম্যানর বইটি শেষ করেছি।”
লোকটি গম্ভীর মুখে বললেন “পড়ে কি বুঝতে পারলে?
আহির বইটির বিস্তারিত, এবং নিজের মনের ভাবনা গুলো প্রকাশ করল। এরপর বলল “এখন বলুন আমাকে কি করতে হবে?
‘তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে তাঁরা কোথায়, জানতে হবে তাঁদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি? নিশ্চয়ই কেউ না কেউ জানে।আর তাঁরা আলিমনগরই কেউ হবে।”
“হুঁ, আলিমনগর এর বসবাসকারী মানুষের মধ্যেই কেউ না কেউ জেনে থাকবেন। কিন্তু, আপনিই তো সেসব সম্পর্কে জানতে পারতেন।”
“আমি চেষ্টা অনেক করেছি। পারিনি।কেউ জেনে থাকলেও আমাকে বলতে চাইছে না।আমি অন্যর থেকে কথা বের করার কৌশলও জানি না। তুমি গোয়েন্দা, তুমি নিশ্চয়ই এসব জানবে। তোমাকে দিয়ে আমি আশাবাদী।”
মীর ও রাফিদ লোকটির কথা বলার ভঙ্গিমা দেখল। অদ্ভুত মনে হল।মনে হচ্ছে তাঁর ভেতরে রাগ এবং ক্রোধের বসবাস।আহির মীর ও রাফিদ কে দেখিয়ে লোকটিকে বলল “এরা হচ্ছে মীর এবং রাফিদ আমার বন্ধু।” প্রথমে মীর এর দিকে দেখাল। লোকটি মীর কে ক্ষীণ চোখে দেখল।মীর এর গলার রত্নখচিত পেনডেন্ট লকেট এর দিকে তাকাল। এরপর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল “তুমি নিশ্চয়ই জমিদার বংশের একমাত্র সন্তান?” মীর না বলতে চাইল।রাফিদ মীর কে থামিয়ে বলল “হ্যাঁ,ঠিক বলেছেন,ওই হচ্ছে আমজাদ চৌধুরীর এর একমাত্র সন্তান।মীর চৌধুরী।”
লোকটি দৃষ্টি মাটির দিকে করল। পরবর্তীতে খোলা প্রকৃতির মাঝে তাকাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল “সুখে থাকো। সবসময় তোমরা ভালো থাকো। ভালো থাকার চেষ্টা করো।আর যত দ্রুত সম্ভব সুফিয়ান এবং ফারদিনার খোঁজ কর।”
“আপনি এখন কোথায় যাবেন?” জিজ্ঞেস করল আহির।
“আমি এক অজানা পথিক এর মত ঘুরে ঘুরে বেড়াই। নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা আমার নেই।অশ্ব আমার সঙ্গী।রাত হলে কোন এক গাছের নিচে দু’জনে ঘুমিয়ে যাই। গভীর ঘুমে কেটে যায় রাতের ঘোর অন্ধকার। এরপর সকাল। আবার পথে পথে ঘুরতে থাকি।”
আহির বেশ সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে বলল “আপনি আমাদের সাথে থাকতে পারেন। যতদিন না,দ্য সাইলেন্ট ম্যানর বইটির অসম্পূর্ণ কাহিনী সম্পর্কে জানতে পারছি।”
লোকটি আপত্তিস্বরে বলল “না।এ হয় না।অন্যর ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকা উচিত না।তুমি বলেছো আমি আনন্দিত।”
রাফিদ আহির এর রেশ টেনে বলল “হ্যাঁ,ও ঠিকই বলেছে, আপনি আমাদের সাথে থাকে চলুন। আমাদেরও ভালো লাগবে।কেননা,এখন আমাদের লক্ষ্য সুফিয়ান এবং ফারদিনার সম্পর্কে জানা।আপনি আমাদের সাথে থাকলে সুবিধা হবে।”
লোকটি নির্বিকার চোখে মীর এর দিকে তাকাল। এরপর ভেবে বলল “আচ্ছা,তোমরা যখন এত করে বলছো,তবে তাই হোক।”
থেমে আবার বলল “এখন তোমরা কোথায় যাবে?
“আমি আমার কাজ শুরু করব। সুফিয়ান,ফারদিনা, এবং মিলন হ’ত্যার রহস্য উন্মোচন করব।” আহির বলল।মিলন হ’ত্যার কথা শুনে লোকটা কোন প্রতিক্রিয়া করল না।মীর বলল “তুই একা না।তোর সাথে আমরাও আছি।”
“তাহলে দেরি কিসের!বেরিয়ে পড়ো তোমরা।আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। দিঘীর পাড়ে বসে থাকব।নীরব দিঘী।” বলে হেঁটে ঘাটের দিকে গেল।ঘাটটা ভাঙ্গা।এক অংশে বসার মত জায়গাটুকু আছে।লোকটি নিস্তেজ শরীরে সেখানে বসে।
আহির,মীর এবং রাফিদ বেরিয়ে পড়ে তাঁদের গন্তব্যে। অচেনা অজানা গন্তব্যে। কোথায় গেলে সুফিয়ান এবং ফারদিনার হদিশ মিলবে তাঁরা জানে না।কারা তাঁদের হদিশ দিতে পারবে তাও যে অজানা।মীর ধীরগতিতে অশ্বে চেপে সামনে এগোচ্ছে।তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল সে-ই পরিত্যক্ত প্রাসাদ।পশ্চিমের শেষ প্রান্তের সে-ই ঘটনা তাঁর মনে হঠাৎ জানান দিল।রাফিদ এবং সে আলিমনগর এর শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল।দূর থেকে পরিত্যক্ত প্রাসাদ কে পরিত্যক্ত অবস্থায় নয়, বরং জীবিত মনে হয়েছিল।মীর অন্যমনস্ক।
একই সঙ্গে রাফিদও অন্যমনস্ক হয়ে ভাবছে কিছু।সে কিছু ভাবতে ভাবতে নিঃশব্দে হাসল। বিষয়টি লক্ষ্য করল আহির।বলল “তোরা এত চুপচাপ কেন?কি ভাবছিস?
“আমার ভেতরে শুধু ফারদিনা আর সুফিয়ান এর আ’র্তনাদ ভাসছে। যতক্ষণ না তাঁদের সম্পর্কে জানছি ততক্ষন শান্তি পাব না।” বলল মীর।
রাফিদ বলল “অপূর্ণ ভালোবাসা কষ্টের। প্রার্থনা একটাই, দুনিয়াতে কারো ভালোবাসা যেন অপূর্ণ না থাকে। কেননা, পুনর্জন্ম আর হবে না।”
আহির হতাশ ভঙ্গিতে ভাবলেশহীন ভাবে বলল “পূর্ণতার ছোঁয়া পেতে পেতে হঠাৎ যদি বি’চ্ছেদ এর যন্ত্রণা পেতে হয়,প্রিয় মানুষটিকে যদি হারিয়ে ফেলতে হয়,তবে যেন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই মরে যায়।’
তাঁরা তিনজন বাজারে পৌঁছে যায়। বাজারে লোকদের বেশ আনাগোনা দেখা যাচ্ছে।আহির বাজারের ভেতরে ঘুরেঘুরে বেশ কিছুক্ষণ,কিছু লোকদের সাথে কথা বলল।সেধে সেধে দ্য সাইলেন্ট ম্যানর বইটির ঘটনার খন্ডাংশ বলে এটা ওটা জিজ্ঞেস করেছিল।কেউ কিছু জানে না বলে স্বীকার করল।আহির যেন অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে।যত দ্রুত সম্ভব জানতে হবে বইটি অসম্পূর্ণ কেন রেখেছে? অচেনা সে-ই লোকটির জন্য নয়,সারা বিশ্বের মানুষের জানা।দ্য সাইলেন্ট ম্যানর বইটি হাজার হাজার মানুষ পড়েছে।সবার মধ্যেই এখন পর্যন্ত একটাই প্রশ্ন, রাখাল বাঁশিওয়ালার আসল পরিচয় কি?কি লুকিয়েছিল সে? তাঁর আলিমনগর থাকার পেছনে আসল রহস্য কি ছিল?ফারদিনা হঠাৎ করে গা’য়েব হওয়ার পেছনে কারণ কি? আলিমনগর মানবশূন্য হওয়ার পেছনে কে ছিল?
আহির চেতনা কমাতে সিগারেট ধরাল।কিন্তু টানল না।কি যেন কি ভেবে ফেলে দিল। এরপর বাজারের কো’লাহল ছেড়ে দূরে গেল।একটা ঢালের উপর দাঁড়িয়ে আছে।ঢালের অপরপ্রান্তে নদী।নদীর ধার ঘেঁষেই বাজার।
আহির একটি পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছে। নদীর ঢেউয়ের শব্দ শুনছে। ঢেউয়ের সাথে সাথে যেন সুফিয়ান এর শেষ কথাগুলো ভেসে আসছে।মীর ও রাফিদ বাজারের ভেতর থেকে আহির এর নিকট আসল।আজ কাউকে পেল না, যে অসম্পূর্ণ বইটির লেখক এর সন্ধান দিবে।কি হয়েছিল সেদিন সবটা জানাবে।
মীর বলল “কাউকে তো পেলাম না,যে আমাদের সাহায্য করবে। তালুকদার বংশের শেষ পরিণতি বলবে।”
“তোমরা রশীদ তালুকদার এর বংশের সম্বন্ধে জানতে চাও ক্যান?” তাৎক্ষণিক তাঁদের পেছন থেকে এক বৃদ্ধ লোকের কন্ঠস্বর ভেসে আসল। তাঁরা ঘুরে তাকাল। বৃদ্ধা লোকটির বয়স আনুমানিক আশি বছর এর বেশি।জীর্ণশীর্ণ শরীর। চামড়া একদম তুলতুলে।লাঠির উপর তাঁর হাতের ভর।বয়স হলেও যেন হাড় মজবুত।যার ফলে এখনো কিছুটা ঝুঁকে হলেও দাঁড়িয়ে আছে।
আহির মীর এবং রাফিদ লোকটির কাছে এগিয়ে এল।আহির বলল “আপনি কি করে জানলেন আমরা তাঁদের খোঁজ করছি?
The Silent Manor part 39
“তোমরা এক লোকরে জিগাইছো,আমি ওই দোকানেই বইসা আছিলাম তহন।”
“আপনি বলতে পারবেন রশীদ তালুকদার এর সম্পর্কে? তাঁর বংশের সবার সম্পর্কে? তাঁর মেয়ে এবং তাঁর হবু স্বামী সুফিয়ান হায়দার এর সম্পর্কে?”
আহির বিনা বাধায় এক সাথে অনেক গুলো প্রশ্ন করে ফেলেছে।
লোকটি আহির এর প্রশ্নে বিস্ফারিত চোখে তাকাল মাটিতে।উনি কেঁদে উঠলেন।শরীরে কাঁপুনি সৃষ্টি হল।মীর লোকটিকে ধরে একটা পাথরের উপরে বসিয়ে দিল।লোকটি সময় নিল জবাব দিতে।আহির অধৈর্য হয়ে আবার বলল “কি জানেন তাঁদের সম্বন্ধে? কি হয়েছিল সুফিয়ান হায়দার এর?
লোকটি কাঁপতে কাঁপতে বলল “ওই ঘটনা আমি আর মনে করতে চাই না।” বলে লোকটি হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো।
