The Silent Manor part 5
Dayna Imrose lucky
খু’নের কথাটি শুনে আমজাদ বিস্মিত হয়ে গেল। দৃষ্টি এদিক সেদিক করল। তখন তাঁর ম্যানেজার উপস্থিত হয়।সে আমজাদ এর গা ঘেঁষে বলল “ঘটনাটি আমি আগেই জানতে পেরেছি। কিন্তু আপনি গ্রামের বাইরে থাকায় জানাইনি।”
আমজাদ আহির কে লক্ষ্য সম্মানের সাথে বলল “আপনি ভেতরে চলুন।”
আহির সহ সকলে ভেতরে গেল। রাফিদ এবং মীর দুজনে ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওঁরা নিজেদের মধ্যে চোখে চোখে কথা বলল। বিষয়টি আহির লক্ষ্য করে। এরপর রাফিদ এবং মীর দু’জনেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।
গত তিনদিন আগে ডিটেকটিভ আহির মির্জার কাছে সংবাদ পৌঁছে, আলিমনগর একটি অনাকাঙ্ক্ষিত খু’ন হয়েছে।সে তখন থেকেই হকচকিত হয়ে আছে। এরপর মনস্থির করে সে আলিমনগর যাবে।আলিমনগর এসে পৌঁছেছে সেই সকালে।সকাল থেকে এখন পর্যন্ত শুধু একে ওকে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তখন এক বয়স্ক লোক সংবাদ দেয়,যে খু’ন হয়েছে তিনি আমজাদ চৌধুরী এর একটি কারখানায় কাজ করে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আলিমনগর তাঁতের শাড়ি তৈরি করা একটি কারখানা আছে। সেখানে প্রায়ই একশো জন শ্রমিক কাজ করেন।মহিলারা আছে বেশ ক’জন। যাদের দায়িত্ব নেয়ার মত কেউ নেই, না বাপ, না স্বামী, না ছেলে সন্তান।সে সূত্র ধরে আহির মির্জা তদন্ত করার জন্য জমিদার বাড়িতে উপস্থিত হয়।
বৈঠকখানায় বসে আছে পুরুষেরা। আমজাদ,থমাস, আমজাদ এর ম্যানেজার আবুল কালাম। তাঁর সাথে মীর এবং রাফিদ।সোফার অপরপ্রান্তে আহির মির্জা।পেছনে তাঁর সহকারী দাঁড়ানো।
বুলবুল এসে চা রাখলো মাঝের টেবিলে। আহির তখন মাথা থেকে ফেডোরা খুলে ফেলল। এরপর শান্ত মস্তিষ্কে আমজাদ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলল “মি.চৌধুরী, শ্রমিক মিলন আপনার কারখানায় কতদিন যাবত কাজ করছিলো?”
“এই প্রায়ই ছ’বছর।”
“ছ’ বছরে আপনি তাঁকে কখনো দেখেছেন তাকে কারো সাথে ঝগড়াঝাঁটি করতে, অথবা তার কোন শত্রুতা আছে কিনা কারো?” পায়ের উপর পা তুলে বসে আহির।
আমজাদ ভেবে জবাব দিল “আমার জানামতে নেই।আর ও তো খুব ভালো মানুষ ছিল। তাছাড়া,আমিত ব্যবসার কাজে থাইল্যান্ডে ছিলাম দীর্ঘ বছর।”
“তাহলে আপনার কারখানা কে সামলাতো?”
আমজাদ ঘুরে রাফিদ এর দিকে দেখল। ‘আমার ছেলে এবং ম্যানেজার।বাকি দেখভাল এর জন্য অনুচারীগন আছে।” এরপর আমজাদ নাকের এবং কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে।
আহির কয়েক সেকেন্ড নিরব রইল। এরপর টেবিল থেকে চা’টা হাতে তুলে নিল।চায়ে চুমুক দিয়ে বলল “কোন প্রশ্নের জবাবে যখন কেউ মিথ্যা বলে তখন তাঁর নাকে ঘাম জমে।”
“কি বলতে চাইছেন আপনি?’ রাফিদ উৎকণ্ঠিত হল।
আমজাদ হাতের ইশারা করে চুপ করতে বলল রাফিদ কে।আহির চায়ের কাপ টেবিলে রেখে দেয়। “তুমি নিশ্চয়ই রাফিদ।যুবক বয়স।তাজা র’ক্ত। আমার আর তোমার বয়স একই হয়ে থাকবে।”
রাফিদ কিছু বলল না। আহির পুনরায় জিজ্ঞেস করল “বোনকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসো?” বিচক্ষণ প্রশ্ন আহির এর।
রাফিদ একবার মীর এর দিকে দেখে বলল “বোনকে তাঁর ভাই ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, আমার বোন আছে সেটা আপনি কিভাবে জানলেন?”
আহির এবার হেসে উঠলো স্বশব্দে। তাঁর হাঁসি দেখে সবাই স্তম্ভিত হল। জয়ন্তন দোতলার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সে শুনছে তাদের কথোপকথন। তাঁর পাশে ঠিক কয়েক হাত দূরে মায়াও রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে মায়া।সেও শুনছে ডিটেকটিভ আহির এর সাথে সবার কথোপকথন। জয়ন্তন ঘুরে মায়ার দিকে দেখল।মায়াও তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ মিলাল।
আহির হাঁসি থামায়। “হাসলেন কেন?” মীর প্রশ্ন করল।
“আমি এখানে এসেছি তদন্ত করার জন্য। কিন্তু তাঁর মানে এই নয় যে আমি কিছু জানি না। আপনাদের সমস্ত তথ্য আমার কাছে আছে।”
থেমে গেল আহির। ততক্ষণে সকলে একে অপরের সাথে চাওয়াচাওয়ি করল।আহির আবার বলল “পূর্ব জমিদার বংশের অনেক ঘটনা শুনেছি।তা থেকে বুঝতে পারলাম, জমিদার বংশের অনেক সংস্কার। সংস্কার এর বাইরে গেলে এর পরিনতি ভালো হয় না।যাকগে,সেসব দিয়ে আমি কি করব।’আচ্ছা’ রাফিদ, তোমার কি মনে হয়,কে বা কারা শ্রমিক মিলন কে হ’ত্যা করেছে?
রাফিদ কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে জবাব দিল “তা আমি কিভাবে জানব।আর কারা এরকম করতে পারে আমার তা ধারণার বাইরে।বলা মুশকিল।”
আহির একটু হেঁয়ালিপূর্ণ ভাবে বলল “মুশকিল, প্রশ্ন, দূর এবং জবাব মেলাতেই তো আমি এসেছি।”
আমজাদ কিছু ভেবে বলল “আপনার তদন্ত করতে কতদিন সময় লাগবে?”
“যতদিন না সত্যটা উন্মোচন করতে না পারবো” সোজাসাপ্টা জবাব যেন আহির এর।
আমজাদ বলল “যতদিন না আপনার তদন্ত উদ্ঘাটন না হয়, ততদিন পর্যন্ত আপনি এখানে থাকবেন।”
আমজাদ থেমে বুলবুল কে লক্ষ্য করে বলল “বুলবুল, ওনাদের জিনিসপত্র গুলো অতিথিঘরে দিয়ে আয়।” এরপর আহির এর দিকে তাকিয়ে বলল “আর কিছু জানার আছে?
“এই মুহূর্তে বিশ্রাম দরকার।যদি মস্তিষ্কে বেশি চাপ পড়ে তবে ধারণ ক্ষমতা লোপ পাবে। আমার সময়মতো যখন তখন জিজ্ঞেস করে নেব,যা জানার বাকি।এখন যাই।” বলে উঠে দোতলার দিকে যেতেই থমকে দাঁড়ায়। ঘুরে তাকাল মীর এর দিকে। তাঁকে জিজ্ঞেস করল “তুমি কে?
“আমি মীর জাফান শন। এখানে বেড়াতে এসেছি।”
আহির চলে যায় অতিথি ঘরে। সাথে তার সহকারী।মীর কে প্রশ্ন করার বিষয়টি থমাস এর ভাল লাগেনি।সে কোনভাবেই চান না, তাঁর ছেলে বিনা কারণে হয়’রানির শিকার হোক।থমাস আমজাদ কে ভরসা দিয়ে বলল “চিন্তা করিস না এসব নিয়ে। খু’নটা কে বা কারা করল তা তদন্ত করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।”
“তুমি তো জানো থমাস,আমি আমার শ্রমিকদের ভালোবাসি।ওর প্রাণটা চলে গেল। তাঁর উপর আমার কারখানা। না জানি দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে।”
“এরকম কিছুই হবে না। সাহস রাখো।আহির খুব বুদ্ধিমান।সে ঠিকই সব রহস্য উন্মোচন করবে।”
“তাই যেন হয়।’’
দিন ফুরিয়ে একটা সুন্দর বিকেলের আগমন ঘটল।আকাশে তখন হালকা কমলা রঙের আভা, যেন সূর্য বিদায়ের আগে পৃথিবীকে শেষবার ছুঁয়ে দিতে চায়। চারদিক জুড়ে মৃদু হাওয়া, পাতার মর্মর শব্দে মন ভরে যায়। দূরে কোনো নাম না-জানা পাখি ডাকছে টানা সুরে, যেন দিনের শেষে সে-ও ঘরে ফিরছে।
দূর দূরে গাছের নিচে শিশুরা হাসি-চিৎকারে দৌড়ঝাঁপ করছে, মাঠের ধারে কয়েকজন কৃষক ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। কারও হাতে চায়ের কাপ, কারও চোখে তৃপ্তি। পুকুরের জলে সূর্যের শেষ আলো ঝলমল করছে,জলটা যেন সোনায় মিশে গেছে।বাতাসে এক ধরনের শান্তি, মাটির গন্ধে এক অদ্ভুত প্রশান্তি।সব মিলিয়ে বিকেলটা এমন যে, মনে হয় পৃথিবী যেন একটু থেমে গেছে।শুধু নিঃশব্দে বলছে,
“আজকের দিনটা সত্যিই সুন্দর।”কিন্তু মায়ার ফের বলতে ইচ্ছে করছে, না’দিনটা সুন্দর নয় বরং, নিজেকে বিষিয়ে তোলার মত একটি দিন।মায়া বাড়ির বাগানে বসে আছে। সকালে হঠাৎ তার বিয়ের আলোচনা করেছে সকলে।সবার অভিব্যক্তি দেখে তখন বোঝা গিয়েছিল সবাই রাজি।আর মীর যেন একটু বেশিই খুশি। কিন্তু সে এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। তাঁর থেকেও বড় বিষয় সে মীর কে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু এটা কাউকে বলতেও পারছে না।মীর বোধদয় তাকে ভালোবাসে না।সেটাও মায়া বুঝতে পারছে।সে বড্ড বিষন্ন হল।
একটা মৃদু বাতাস আসে।তার চুল উড়িয়ে দিলো। দূর থেকে পায়ের শব্দ এল, হয়তো তৃষ্ণা আসছে ডাকতে। কিন্তু মায়া উঠল না। বাগানের নিস্তব্ধতার ভেতর সে নিজের সঙ্গে কথা বলছিল, নিজের ভবিষ্যতের সঙ্গে এক অদৃশ্য লড়াই করছিল।
মায়ার পাশের চেয়ারে এসে বসে মীর।মীর এর পরনে পাঞ্জাবি। সাদা পাঞ্জাবি তে মীর কে খুব সুদর্শন দেখায়,এটা বলেছে শালুক। তাঁর উপর একটা শাল পেচিয়ে রেখেছে। দিনের শেষ প্রহরে শৈত্য প্রবাহ ধীরে ধীরে বেড়ে যায়।মায়া মিষ্টি রঙের একটা থ্রিপিস পড়েছে।গলায় পেঁচানো ওড়না।সুতি কাপড় এর থ্রিপিস।কোন শীতের পোশাক নেই পরনে।মীর তখন নিজের গায়ের শালটা খুলে মায়ার পেছন থেকে জড়িয়ে দেয়।মায়া আকস্মিক অবাক হল। এতক্ষণ তাঁর পাশে মীর ছিল,সে খেয়াল করেনি।
মায়া মুখ ফিরিয়ে নিল।মীর আবিষ্ট কন্ঠে বলল “বিয়ের কণে রাগ করে আছে দেখছি। বিয়ের কণেকে সবসময় হাসিখুশি থাকতে হয়।’
“আমার বিয়ে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।”
“তা কি করে হয়, আমার তোমার বিয়ে নিয়ে অনেক সখ আছে। গ্রামের বিয়ে কখনো স্বচোক্ষে দেখেনি। কিন্তু এখন আমি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ার বিয়ে দেখব। অনেক আনন্দ হবে।কি বলো তুমি?
মায়া মীর এর দিকে তাকিয়ে বলল “সত্যিই খুব আনন্দ হবে?”
মীর মায়ার চোখের দিকে তাকায়। তাঁর চোখে জল।মীর কিঞ্চিত অবাক হয়ে বলল “তুমি কাঁদছো কেন! তুমি কি বিয়েতে রাজি না,আর আমরা তো তোমার বিয়ে এখনই দিচ্ছি না।তোমার পছন্দের কেউ থাকলে বলতে পারো।বলো আছে কি?”
মীর এর এরুপ প্রশ্নে মায়া নিশ্চিত হল।মীর এর মনে তাঁর কোন স্থান নেই। তৃষ্ণা ঠিকই বলেছে, বিদেশি ছেলে,ফিরে আবার বিদেশেই চলে যাবে।হয়ত এর মনেও কোন না কোন বিদেশিনীর বসবাস।
মায়া দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। বলল “অবশ্যই আমি বিয়েতে খুশি।বাবা যে ছেলে পছন্দ করবে,আমি তাঁকেই বিয়ে করব।” বলে বাগান থেকে ঘরের ভেতরে চলে যায়।মীর মায়ার যাওয়ার পানে দেখে বলল “মেয়েদের আর কিছু থাক বা থাক,রাগ থাকবেই।আর এদের রাগের কখনো কখনো ব্যাখা ও হয় না।ব্যাখা থাকলেও বলতে চায় না। অদ্ভুত।”
‘খুবই অদ্ভুত।’ মীর এর কাছে উপস্থিত হয় আহির।মীর তাকালো আহির এর দিকে।আহির গাঢ় খয়েরী রঙের শার্ট পড়া।সাথে এ্যাশ রঙের প্যান্ট।সে পুনরায় পায়চারি করতে করতে বলল “দুনিয়াটা বড়ই বিচিত্রময়।আমরা মানুষ কে চিনতে পারি না, কখনো তাকে চিনেও না চেনার ভান করি, কখনো প্রিয় মানুষটি চোখের সামনে আমাদের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করে, কিন্তু আমরা তাকে মূল্যায়ন করি না।আর যখন সে মানুষ টা আমাদের থেকে অনেক দূরে চলে যায়, তখন আমরা আর্ত চিৎকার করি। কিন্তু মানুষ টি আর ফিরে আসে না।’
মীর দাঁড়িয়ে বলল “এসব আমাকে শোনাচ্ছেন কেন?
“তুই’আমাকে তুই বলে সম্বোধন কর,আমরা তো পাশাপাশি বয়সের।”
মীর মসৃণ হেসে বলল “হঠাৎ করে তুই টা আসবে না। তবে কোন এক পরিস্থিতিতে চলে আসবে তুই ডাকটি।”
“আমি সে-ই পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছি।” বলে হাসে আহির।
মীর ও আহির দু’জন বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে সরু পথ ধরে হাঁটতে লাগল।মীর একটি সিগারেট ধরাল।
“সিগারেট খেলে ক্ষতি হয়।” আহির বলল।
মীর সিগারেট ফুঁকে বলল “ক্ষতি হবে জেনেও জীবনে ঝুঁকি নেই আমরা।হয় সখের জন্য,নয় সুখের জন্য।”
আহির গভীর শ্বাস ফেলে বলল “শেষমেষ সখ ও পূর্ন হয় না, সুখের ও দেখা মিলে না। কিন্তু হৃদয় দিব্যি পু’ড়ে যায়!”
“প্রতিদিন সিগারেট খাও?”
“না’ মাঝেমধ্যে।’ মীর সিগারেট ফেলে দেয়।আহির এর দিকে তাকিয়ে নীরব বিভ্রান্তি নিয়ে বলল “আপনি সত্যিই ডিটেকটিভ তো’
আহির ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে “তুমি সত্যিকারের ডিটেকটিভ নওতো’ মীর হেসে উঠলো।সাথে আহির ও।আহির থেমে বলে “তুমি যেভাবে জিজ্ঞেস করলে আমার এটাই মনে হল।
শালুক নিজ ঘরে বসে আছেন। আমজাদ ইজি চেয়ারে বসে আছে। বিষন্নতার ছোঁয়া তাঁর মুখে। শালুক তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।মাথার কাপড় টেনে বেশ নতজানু হয়ে বলল “আপনার কারখানায় অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে একজন খু’ন হয়েছে।এটি নিয়ে আপনি চিন্তিত আমি বুঝতে পারছি।’ এতটুকু বলে থামে শালুক। আমজাদ নিরুত্তর। শালুক আমজাদ এর সম্মুখীন হয়ে পুনরায় বলল “শুনেছি,সকালে মা’ মায়ার বিয়ের কথা বলছিল’ আপনি এখনই ওর বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?
“হ্যাঁ’ চারদিকে যা হচ্ছে, তাঁতে বিয়েটা এখনই সেরে ফেলা ভালো।ও বরাবরই চঞ্চল।সু’পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে দূরে পাঠিয়ে দিলে একটু শান্তি পাব এই ভেবে যে,কোন হয়’রানি আতঙ্ক ওকে আর ছুঁতে পারবে না।”
শালুক বলল “কিন্তু বাড়িতে যে গোয়েন্দা আছে!’
“গোয়েন্দা’ গোয়েন্দার কাজ করবে। এমন সময় একজন গোয়েন্দা বাড়িতে থাকা খুবই ভালো।আর মিলন এর খু’নের রহস্যটাও বের হবে।”
“আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়,ওকে কে মারতে পারে!আর কি কারণে?
“বুঝতে পারছি না।ওতো শান্তশিষ্ট ছিল। তবে এরকম কে করল জানি না।হবে হয়ত কোন কারণ, কারণ ছাড়া তো কিছু হয় না।”
শালুক নিশ্চুপ থেকে বলল“আমি যাই, সন্ধ্যা হয়েছে। অতিথিদের জন্য কিছু তৈরি করতে হবে।”
বলে যেতেই আমজাদ সুরেলা কণ্ঠে ডাকল শালুক কে “গিন্নি,একখান কথা শুইনা যাও।”
শালুক হঠাৎ থ’হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। লজ্জায় পড়ল যেন সে। আমজাদ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।শালুকের দিকে এগিয়ে তাঁকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল।
“কি করছেন আপনি?এই বয়সে এসেও আপনার রসিকতা যায় নি।”
আমজাদ মৃদু হাসল। “শোনো গিন্নি, নিজের স্ত্রীর সাথে এরকম নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়, যদি একটু ভাব করা যায়,তবে এটা কিন্তু সুন্নত এর কাতারে পড়বে।প্রথমত। দ্বিতীয়ত, নিজের স্ত্রীকে বুকে টেনে নিলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।ফলে রক্তসঞ্চালন বেড়ে যায়।মন সতেজ থাকে।আসো দেখি’বুকে আসো” শালুক আমজাদ কে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল “আপনার বয়স হয়েছে সংখ্যায়,মনের বয়স এখনো ত্রিশ।আমি যাই কাজ আছে।” বলে শালুক ঘরের বাইরে বের হয়। আমজাদ তখন বলল “গিন্নি দূরে ঠেলে দিলে, তুমি জানো না তোমায় কতটা ভালবাসি, তুমি যদি আমার হৃদয় টা চাইতে,আমি বিনা দ্বিধায় দিয়ে দিতাম।টাকার বিনিময়ে নয়, শুধু একটু ভালোবাসার বিনিময়ে।” শালুক মুখে কাপড় দিয়ে চাপা স্বরে হেসে চলে যায়।
অন্যদিকে আমজাদ হাসলো। আমজাদ বরাবরই জ্ঞানী একজন মানুষ। তিনি কখনোই চাঁন না, তাঁর জন্য কেউ কষ্ট পাক, চিন্তা করুক।কেউ না কেউ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। তাঁর সাথে একটু ভালো ভাবে, হেঁসে খেলে কথা বলবে,এটা অনেকেই চায়। তারমধ্যে একটু বেশি চায় যেন নিজের স্ত্রী। একজন বিবাহিত নারী যদি নিজের স্বামীর কাছে অভাব অনুভব করে, তবে গোটা দুনিয়াটাই তাঁর কাছে শূন্য মনে হবে। একজন বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।সবাই পায় না। কখনো কেউ পেয়েও হারিয়ে ফেলে। তখন আমজাদ এর গোমড়া মুখ দেখে রিতিমত শালুক ও চুপসে যায়।যা বুঝতে পারে আমজাদ। তাঁর ভালো লাগেনি শালুক এর গোমড়া মুখ।তাই সে নিজের স্ত্রীর’নিজের সন্তান এর জননীর মুখে একটু হাঁসি ফোটানোর চেষ্টা করল।কোন স্বামী যদি ঘুম থেকে উঠে নিজের স্ত্রীর কপালে চুমু খেয়ে বলে ‘আজকে সারাদিনটা আমার ভালো কাটবে।কেননা,ঘুম থেকে উঠেই যে সর্বপ্রথম তোমার মুখ দেখেছি’! বিশ্বাস করুন,এতে স্বামীর দিনটা ভালো যাক বা না যাক, কিন্তু একজন স্ত্রীর সারাটা দিন ভালো কাটে।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। আহির এবং মীর হাঁটতে হাঁটতে অনেক টা দূরে চলে যায়। একটা টং দোকানের সামনে দু’জন বসে। কিছু লোক চা খাচ্ছে।মীর দু কাপ চা চাইলো।দোকানি চা বানিয়ে দেয়।দু কাপ রং চা।আহির চায়ে চুমুক দিল।মীর বলল “আপনি বিয়ে করেছেন?
“না’
“কেন?
“ভালোবাসিনি কখনো কাউকে”
“তাহলে, পারিবারিক ভাবে বিয়েটা করে নেন। বিয়ে না করলে তো জীবনটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।এত টাকা পয়সা খ্যাতি দিয়ে কি হবে”
আহির হাসে। তাঁর হাসিতে লুকিয়ে রহস্য। “মনের মত মেয়ে পেলে ভেবে দেখব।”
“এই গ্রামে অনেক মেয়ে আছে’কাউকে পছন্দ হলে বলবেন’আমি ঘটক পাঠাবো।” বলা শেষে দুজনেই হাসে।
চা শেষ করল।মীর দোকানি কে টাকা পরিশোধ করল। এরপর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়।মীর তাড়া দিল “দ্রুত যেতে হবে।একটা বাহন হলে ভালো হত’ বলে আশেপাশে তাকাল মীর।
“কোথায় যাবে?
“আমি আর রাফিদ একটু বের হব। দরকারি কাজে। আপনাকে পড়ে বলব।”
এরপর একটি ঘোড়ারগাড়ি চোখে পড়ে। জমিদার বাড়ির রাস্তার দিকেই যাচ্ছে।মীর দাড় করিয়ে দেয়।
সারথী বলল “সাহেব, একজন মাইয়া মানুষ আছে। ওর মধ্যে আপনাদের নিলে ওর অসুবিধে হইতে পারে।”
মীর জানে, এখানে মেয়েদের অনেক মূল্যায়ন করা হয়। মেয়েটির অসম্মান হলে তাঁর দায় আমজাদ চৌধুরীকেই নিতে হবে।মীর সারথী কে যেতে বলতে চাইলো। কিন্তু আহির আটকে বলল “তাঁরা আছে,যেতে হবে।ওর কোন অসুবিধে হবে না।” বলে মীর এর হাত ধরে ঘোড়ারগাড়িতে উঠে বসে।
সারথী তাঁর পথে চলতে থাকে।আহির ভেতরে বসা।মীর সামনের দিকে।একটি হারিকেন জ্বলছে।আহির দৃষ্টি সংযত রাখলো কিছুক্ষণ। এরপর হঠাৎ করেই তার সামনে বসা মেয়েটির দিকে দৃষ্টি পড়ে। হারিকেনের আলোয় সোনালী নাক এবং ঠোঁট দেখা যাচ্ছে ওর।মাথায় ওড়না টেনে দেয়া মেয়েটির।নাক অবধি ঝুলছে ওড়নার খন্ড।হাতে ঔষধ জাতীয় কিছু। এখানকার সাধারণ মেয়েরা এভাবেই চলাফেরা করে। মেয়েটি সংকুচিত হয়ে হাত পা এক করে রাখল।তা দেখে আহির বলল “ভয় পাবেন না। আপনার কোন ক্ষতি আমরা করব না।”
জমিদার বাড়ির সামনে পৌঁছে যায় তাঁরা।মীর এবং আহির নেমে দাঁড়ায়। আহির সারথীর কে পাওয়া বুঝিয়ে দেয়।সেই সাথে জিজ্ঞেস করল “মেয়েটি কে কোথায় নামাবে?
“সামনের দুইডা মোড়ের পরেই”
“আচ্ছা, সাবধানে নিয়ে যেও।ওর পাওনাও কিন্তু তোমাকে দিয়েছি।মেয়ে মানুষ,ওর সাথে আবার কোন কথা বল না।”
সারথী চলে যায়।আহির দেখল মেয়েটি মাথা উঁচু করে ওড়নার আড়াল থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’
মীর এর ঘরটা হাট করে খোলা। মায়া একবার এসে উঁকি দিয়ে দেখেছে।মীর নেই। তখনই দেখে মীর আসছে তাঁর ঘরের দিকে। মায়া সরে যায়।মীর তাঁর ঘরে প্রবেশ করে দরজা টা লাগিয়ে দেয়।মায়া জানালার ফাঁক দিয়ে দেখল মীর কিছু লিখছে।বেশ মনোযোগ দিয়ে।লেখাটা শেষ করে নিজেই একবার পড়ল।সাথে একরাশ নিঃশব্দ হাঁসি। নিশ্চয়ই চিরকুট।মায়ার কাছে তখন শেফালী উপস্থিত হয়।মায়া ইশারায় শেফালী কে চুপ থাকতে বলে।
মীর চিরকুট টি পাঞ্জাবীর পকেটে রাখল।এরপর ঘর থেকে বের হয়ে রাফিদ এর ঘরের দিকে হাঁটতে লাগল।মায়া ও শেফালী আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। এরপর দুজনে কৌশলে মীর কে অনুসরণ করে।মীর রাফিদ এর ঘরে চলে গেল। রাফিদ ঘরে বসে কিছু কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিলো।মীর তাঁর ঘরে প্রবেশ করে। দরজা পুরোপুরি লাগায়নি।হাট করে খোলা।মায়া সাহস করে রাফিদ এর ঘরে ঠুকতে পারল না। কিন্তু মীর কি লিখেছে এটা যে তাঁর জানতে হবে। কিন্তু কিভাবে!মায়ার মাথায় তখন চট করে বুদ্ধি চলে আসল। শেফালী’ শেফালী কে মায়া বলল “তুই দাদার ঘরে যা।তুই ঘর মোছার কথা বলে ঘর মুছতে শুরু করবি।আর তাঁরা কি বলে শুনবি”
শেফালী বলল “যদি দাদায় বুঝতে পাইরা আমারে কিছু কয়’
“বললে শুনবি।’ বলে মায়া শেফালী কে ধাক্কা দিয়ে রাফিদ এর ঘরে পাঠিয়ে দেয়। রাফিদ এবং মীর এর মাঝে হঠাৎ শেফালী উপস্থিত হওয়ায়, তাঁরা কিছুটা স্তম্ভিত হয়।রাফিদ কিছু বলার আগেই শেফালী হাঁসতে হাঁসতে বলল ‘দাদাবাবু, ছোট্ট মালকিন কইছে, আপনার ঘরে নাকি ময়লা পড়ছে,তাই আমারে মুছতে পাঠাইছে।’ বলা শেষে নিচে বসে নিজের ওড়না দিয়ে ঘর মোছা শুরু করে। রাফিদ কিছু বলতে চাইলে মীর বাঁধা দিয়ে বলল ‘বারান্দায় চল’
রাফিদ কে নিয়ে মীর বলল ‘আমি মোহিনীর জন্য একটা চিঠি লিখেছি।চল দিয়ে আসি।’
কিন্তু রাফিদ নাকোচ করল।মীর তখন বেশ জোড়া জুড়ি করল রাফিদ কে। এরপর রাফিদ মোহিনীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে রাজি হয়। ব্যর্থ শেফালী। তাঁরা কথা বলার জন্য বারান্দায় গেলে শেফালী ঠিক করে কিছু শুনতে পায়নি কি বলেছে তাঁরা। শুধু দেখেছে মীর রাফিদ কে জোড়া জুড়ি করেছে। এরপর রাফিদ ও মীর ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
শেফালী মায়ার কাছে উপস্থিত হয়।মায়া বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল “কি বলেছে তারা?
‘আমি যাওয়াতে ওনারা বারান্দায় গেছে কথা কইতে’আমি ঠিকমতো কিছুই শুনিনাই। তবে এইডা বুঝতে পারছি,ঐ মীরবাবু রাফিদ দাদাবাবু যে অনেক জোড়া জুড়ি করছে।’
মায়া এমন কথা শুনে বলল ‘চল আজ ওদের পিছু নেব।দেখব ওরা কোথায় যায়’
“কিন্তু,বাড়ির কেউ যদি টের পায়!’
“কেউ কিছু বুঝতে পারবে না চল।’
ঘরের বাইরে গাড়ি রাখা।আজ আর অশ্ব নিয়ে তাঁরা বের হয়নি।গাড়ি নিয়ে বের হয়।মীর ড্রাইভিং সিটে। রাফিদ পাশে। তাঁরা বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে চলে যায়। তাঁদের পিছু নেয় মায়া ও শেফালী। তাঁরা অশ্ব নিয়ে বের হয়। শেফালী প্রথমবার অশ্বের পিঠে চেপেছে।খুব ভয় পায় সে। কিন্তু মায়া খুব জোর করলো। এরপর তাঁরাও চলে যায় বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে। বিষয়টি লক্ষ্য করে আহির মির্জা।বাড়ির সামনে বসা ছিল সে। সিগারেট টানছিল।যত দ্রুত সম্ভব মিলন এর কেসটি সমাধান করতে হবে। এরপর শহরে ফিরতে হবে তাঁর। কিন্তু কেসটি তাঁর কাছে একটু জটিল মনে হল। অন্যান্য কেস এর তুলনায়।মিলন এর হ’ত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ঘিরে এখন পর্যন্ত সে জমিদার বাড়ির লোকদের ই সন্দেহ করছে। কিন্তু কতটুকু তাঁর সন্দেহ সঠিক তা যে জানতে হবে।
সিগারেট ফেলে দেয়। এরপর তাঁর গাড়ি নিয়ে বের হয় রাফিদ এবং মীর কে অনুসরণ করার জন্য। তখন মীর বলেছে একটা দরকারি কাজ আছে। কিন্তু কি! জিজ্ঞেস করলে উত্তর মিলেনি।আহির এর সন্দেহ হয়।
আব্দুল মোতালেব হোসেন আজ বাড়িতে নেই। শহরে গেছেন কাজের জন্য। যাওয়ার আগে বারবার মোহিনী কে বলে গেছেন ‘যতদিন আমি না ফিরবো ততদিন ঘরের বাইরে বের হবে না। কুঠুরি পর্যন্ত যাবে না।’এখন ঘরে শুধু মোহিনীর মা। মোহিনী কথা শোনেনি তাঁর বাবার। তাঁর কাছে মেয়েরা নাচ শিখতে এসেছে।সে তালে তাল মিলিয়ে ওদের নাচ শেখাচ্ছে। চারপাশে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা।সেই আলো ধরেই ওরা নাচচে।
।ঘুঙুর এর শব্দ ভেসে আসছে মীর এর কানে। ছোট্ট কুঠুরির পাশে কিছু ফল ও ফুলের গাছ। আব্দুল মোতালেব নিজের হাতে বাগানটি করেছে। তিনি সবসময় বলতেন, বৃক্ষের মত আপন কেহ হয় না।বৃক্ষ আমাদের ফল দেয়,ছায়া দেয়, অক্সিজেন দেয়।’ বাগানের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে মীর ও রাফিদ। রাফিদ এখনো বারবার বলছে চিঠিটা ওকে দিস না। কিন্তু মীর শুনছে না।সে উক্ত সময়ের অপেক্ষা করছে। কখন দিবে।
তাঁদের থেকে কয়েক হাত দূরে মায়া ও শেফালী।আহির ও তাদের লক্ষ্য করছে।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর কুঠুরির মেয়েদের নাচ শেষ হয়।মীর তখন কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা কুঠুরির ভেতরে প্রবেশ করে। মোহিনী হাঁটু ভাঁজ করে বসে পা থেকে ঘুঙুর খুলছিল। তখনই তাঁর তাঁর সামনে একজোড়া পা উপস্থিত হয়। বাদামি রঙের চামড়ার স্লিপার জুতো পায়ে। মোহিনী কিছুটা আকস্মিক হকচকিয়ে গেল। এরপর ধীরে ধীরে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।মীর কে দেখে।
অন্যদিকে রাফিদ চারপাশ দেখছিল।কেউ দেখে ফেলল বলে। যদি এরকম ঘটনা কেউ জেনে যায় তবে নির্ঘাত বড় ধরনের ঝামেলা হবে। জমিদার বাড়ির ছেলেদের দুর্নাম হবে।বেশ উশখুশ হল রাফিদ। তাঁর সাথে পেছনে মায়া পাতার আড়াল থেকে মীর কে লক্ষ্য করছে।
মোহিনী ভয়ে ভয়ে বলল “আপনি কে’আর এই রাতে আমাদের কুঠুরিতে কেন! গ্রামের কেউ দেখে ফেললে মহা বিপদে পড়তে হবে।চলে যান।”
মীর বলল “থাকতে আসিনি।চলে যেতেই এসেছি। শুধু তোমাকে একটা জিনিস দিতে এসেছি।”
বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে চিঠিটা মোহিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “আমি জবাবের অপেক্ষা করব। তুমি ভেবে চিন্তে তোমার মতামত জানিও।আজ রাতটাই তোমার সময়। যদি তোমার উত্তর সহনীয় হয়,তবে আগামীকাল সন্ধ্যায় দিঘির পাড়ে এসো।”
মোহিনী একবার ঢোক গিলল। সতর্কতার সাথে এদিক ওদিক তাকাল। এরপর চিঠিটা হাত থেকে নিল।মীর মৃদু হেসে চলে যায়। তখন মোহিনীর থেকে নাচ শিখতে আসা একজন মেয়ে বলল ‘তোমার রাজ কপাল, জমিদার বাড়ির ছেলের বউ হবে।এই সুযোগ হাত ছাড়া কইরো না।”
পরদিন সকাল বেলা চারদিক জুড়ে নিস্তব্ধতা, কুয়াশা আর এক অদ্ভুত শীতল হাওয়া।আমিলনগর’এই গ্রামের নামের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে কোনো পুরনো রহস্যের ছায়া।আহির এর ধারণা।কয়েকদিন আগেই এখানে ঘটেছিল এক অমানবিক হ’ত্যাকাণ্ড।মৃ’ত ব্যক্তির নাম মিলন।নম্র, শান্ত স্বভাবের মানুষ, গ্রামে কেউ তার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলেনি কখনো। তাহলে মারলো কে?আহির বিমোহিত।
কিন্তু পাঁচদিন আগে সকালে মিলনের নিথর দেহ পাওয়া যায় কারখানার পেছনের গুদামে।চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তুলোর গুঁড়া, ভাঙা টেবিল, আর রক্তের ছোপে ঢাকা মেঝে যেন চিৎকার করে কিছু বলতে চাইছিল।
কারখানার ম্যানেজার আমজাদ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ। আবুল কালাম।সে পুলিশকে জানিয়ে প্রথমেই নিজের নির্দোষিতা দাবি করেন।
“আমি কিছুই জানি না, ডিটেকটিভ সাহেব,”শান্ত কণ্ঠে বলেছিল সে।“ও ছেলেটা সবার প্রিয় ছিল, আমারও।” আবুল কালাম প্রথমদিনই আহির মির্জার সাথে কথা বলে।
আমজাদ চৌধুরী শুধু শান্ত থেকে জবাব দিয়েছিল গতকাল।কিন্তু ডিটেকটিভ আহির মির্জা জানে
যখন কেউ অতিরিক্ত শান্তভাবে কথা বলে, তখন তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে কিছু না কিছু।
আজ সকালেই আহির মির্জা বেরিয়েছেন গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে।পশ্চিমপাড়া, মিলনের ঘর, চায়ের দোকান সবখানে যাচ্ছেন সে।প্রত্যেকের চোখে তিনি খুঁজছেন ভয়, দ্বিধা, কিংবা সত্যের ঝিলিক।
আহির তার গাড়ি নিয়ে কাপড়ের কারখানার কাছে একটা চায়ের দোকানে উপস্থিত হয়।গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে তাকাল। সাথে তাঁর সহকারী। চায়ের দোকানে এসে চা চাইলো।দোকানি এক বৃদ্ধ।চা বানিয়ে দিল দোকানি।আহির হাতে নিল। এরপর দোকানি কে জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা চাঁচা’ জমিদার এর কাপড়ের কারখানায় শ্রমিক মিলন যে খু’ন হল,এই ব্যাপারে আপনি কিছু বলতে পারবেন?”
দোকানদার ধীরে বলল
“বাবু, মিলন ভালো মানুষ ছিল, কিন্তু শেষ ক’দিন ও কই যাইত, কেডা জানে! চুপচাপ ছিল যেন কাইণ্ডা কিছু ভাবত।আর কইতো চাচা যদি মইরা টইরা যাই তবে দাবি রাইখো না। আগেই যেন মৃ’ত্যুর সংবাদ পাইছিল।’ দোকানি দুঃখ প্রকাশ করে।
আহির মির্জা চুপ করে থাকল।তার চোখ স্থির, দূরে কোথাও যেন তিনি একটা সূত্র দেখতে পাচ্ছেন।সম্ভবত এই গ্রামের নিস্তব্ধতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে সেই উত্তর।কে বা কারা চেয়েছিল মিলনের খু’ন!কি কারন হতে পারে?ও আগেই কেন মৃ’ত্যুর কথা বলেছে?”
আহির এর ভাবনা ভাঙ্গানোর জন্য তাঁর সহকারী বলল “স্যার, গতকাল রাতে আপনি মীর রাফিদ কে সন্দেহ করে তাদের পিছু নিয়েছিলেন। কিছু পেয়েছিলেন?
আহির চায়ের কাপ রেখে বলল ‘মেয়েলি কেস।ওসব নিয়ে ভাবার সময় নেই।’
আজ সূর্য ওঠেনি। কুয়াশায় ঘেরা চারপাশ। গতকাল রাতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিল যেন মীর। চিঠি সঠিক জায়গায় পৌঁছানোর কাজ। রাতে সময়মতো ঘুমাতে পারেনি।এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রাফিদ সকাল সকাল উঠে আমজাদ এবং থমাসের সাথে মিলনদের বাড়ি গিয়েছে।মীর কে ডেকেছিল,যায়নি। তখন তাঁকে ডাকতে হাজির হয় বুলবুল। বুলবুল পরপর কয়েকবার ডাকার পর মীর এর ঘুম ভাঙ্গে ‘জালাচ্ছিস কেন’যা এখান থেকে।’
“আপনে পড়ে ঘুমান। ওদিকে অঘটন ঘটে গেছে।” বলতেই মীর লাফিয়ে উঠে বসল। “কি হয়েছে?
তখন বুলবুল হেসে হেসে মীর এর পা টেপা শুরু করে। এবং বলল “এটা না বললে তো আপনি ঘুম থেকে উঠতেন না।’
“তুই আমার পেছনে কেন পড়ে আছিস” মীর হামি তুলল।
“আমি আপনার পেছন পড়ে নাই তো।আমায় মালকিন বলছে সবার খেয়াল রাখতে।তাই খেয়াল রাখছি।”
“আরে মদন, খেয়াল রাখতে বলছে কাউকে লুকিয়ে লুকিয়ে অনুসরণ করতে বলেনি।” বুলবুল মুখটা অন্ধকার করে ফেললো।ও মীর কে অনুসরণ করেছে, লুকিয়ে কথা শুনেছে তা মীর জেনে গেল কিভাবে?
মীর একটা সিগারেট ধরিয়ে ফুঁকে। “আচ্ছা,তোর মায়া আপামনি কি ঘুম থেকে উঠেছে?
“সংবাদ টা দিমু তাঁর আগে আমার একটা জিনিস চাই।”
“কি চাই তোর আবার?
“টাকা।”
“তুই টাকা দিয়ে কি করবি?
“মানুষের কতই তো সখ থাকে, আমার সখ,আমি শহরে ঘুরতে যামু,তাই টাকা জমাই।’
মীর মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে বলল “টাকা দরকার বললেই হয়।’
বুলবুল টাকা হাতে পেয়ে বলল “গতকাল রাত থেকে মায়া আপামনির শরীরে জ্বর।”
মীর তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল “কি,কি বলছিস? আমায় আগে বলবি না।”
“কেন আগে বললে আপনি জ্বর বুঝি আসতে দিতেন না?’
বুলবুল এর বোকার মত কথা শুনে মীর বিড়বিড় করে বলল “গাধা একটা’ বলে দ্রুতই মায়ার ঘরের দিকে ছুটে যায় মীর।
মায়া সহ্যশয়ী।গায়ে কম্বল জড়ানো। শেফালী পাশে বসে আছে।শালুক এবং জয়ন্তন পাশেই বসা।শালুক তাঁর মাথায় জ্বর কমানোর জন্য ঠান্ডা পট্টি দিচ্ছে।পাশের টেবিলে গরম দুধ রাখা।মীর ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।মীর কে দেখে শেফালী বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। জয়ন্তন ভ্রু কুঞ্ছিত করে তাকাল। শালুক মীর কে দেখে বলল “দেখ, হঠাৎ করে মেয়েটা জ্বর বাধিয়েছে।পইপই করে বলেছি ঠান্ডায় বাহিরে ঘোরাঘুরি করবি না।কে শোনে কার কথা।’
“ওকে কিছু খাইয়েছো’ মীর বলল।
“সে-ই কখন দুধ এনে রেখেছি।বলে ইচ্ছে করে না খেতে।”
মীর তাৎক্ষণিক কিছু ভেবে বলল “ছোট্ট মা,দাদী, তোমাদের ডাকছে নিচে। একজন লোক এসেছে।”
শালুক বলল “শেফালী তুই দেখ, ওকে খাওয়াতে পারিস কিনা। চলুন মা,দেখি কে এসেছে।”বলে শালুক ঘর থেকে চলে যায়। কিন্তু জয়ন্তন গেল না।সে ঘরের বাইরে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইল।
মীর মায়ার পাশে ঘেঁষে বসে।মায়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।মীর বলল “উঠে বসো।’
“আমি উঠতে পারব না। শরীর ব্যথা।’
তখন মীর শেফালী কে লক্ষ্য করে বলল ‘এই ওকে উঠিয়ে বসা।’
“আপনার কথা আমি শুনতে বাধ্য নাকি?” মায়ার প্রশ্ন।
“কথা কম বল।” পুনরায় শেফালী কে বলল “তোকে কি বলেছি,কানে যায়নি?
The Silent Manor part 4
শেফালী তখন মায়াকে উঠিয়ে বসায়। এরপর মীর দুধের গ্লাস টা মায়ার দিকে এগিয়ে দিল।মায়া নাকোচ করল।মীর শান্ত ভাবে খেতে বলল। মায়া এবারো মুখ ঘুরিয়ে নেয়।কেন মীর এর কথা শুনবে? গতকাল মীর মাস্টার এর মেয়েকে প্রেমপত্র দিয়েছে।যা মায়া স্বচোক্ষে দেখেছে। এরপর আর মীর এর সাথে তাঁর কথা বলার ইচ্ছে নেই।
মায়া দুধ খেতে চাইলো না বলে মীর জোড় করে খাইয়ে দিল। শেফালী তখন বলল “এইভাবে চাইপা ধইরেন না, অসুস্থ আপায়”
“চুপ ছকরি।’
জয়ন্তন ঘরের বাইরে থেকে এতক্ষণ সমস্ত কিছু দেখল। এরপর সে স্থান ত্যাগ করে।
