The Silent Manor part 7
Dayna Imrose lucky
মীর কে চিন্তিত দেখে রাফিদ বলল “তোর কি হয়েছে,কি ভাবছিস?
“তেমন কিছু না।তুই জিজ্ঞেস করলি না কখন এলাম, মিনিট চল্লিশ হয়।’
“তোর হাতে এটা কিসের বই?আহির জিজ্ঞেস করল।
“দ্যা সাইলেন্ট ম্যানর’ বই।বাবাও বইটি পড়েছে। এখানে আসার পর শুনলাম মায়াও পড়েছে।বইটা পড়লে নাকি চিন্তায় ধরবে।ঘোর থেকে যাবে।তাই ভাবছি পড়ে দেখি।”
“দে দেখি বইটা’ আহির চাইল।মীর দিল।
দ্যা সাইলেন্ট ম্যানর’। বইটির লেখকের নাম সুফিয়ান হায়দার।বইটাতে সময়কাল লেখা আছে। অনেক আগের। “আমি এটা ফাঁকে ফাঁকে পড়ব। কাজের জন্য হয়ত সময় পাব না।তাই।” বইটা পুনরায় এগিয়ে দিল মীর এর দিকে।
মীর বলল “আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। ভালো লাগছে না কিছু। পড়ে পড়ব।”
“আমি আসছি।বাবার সাথে কিছু কাজ আছে।তোরা আড্ডা দে” বলে রাফিদ চলে যায়।
রাত বাড়ছে।মায়া ঘরে একা একা শুয়ে আছে। তৃষ্ণা আজ তাঁর সাথে নেই। তাঁর মায়ের সাথে ঘুমাবে বলে চলে গেছে।মায়া অনেকবার বলেছে তাঁর ভয় করছে।একা একা ঘরে থাকতে পারে না। বিদেশে থাকাকালীন এরকম সমস্যা ছিল না।দেশে ফেরার পর থেকেই সমস্যাটা দেখা দিয়েছে।এটা সমস্যা, অযথা ভয়, উদ্বেগ থেকে হচ্ছে কিনা সে জানে না। যেদিন গ্রামে এসেছে সেদিন রাতে জয়ন্তন এর সাথে ঘুমিয়েছিল। সেদিন রাতেই এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে। এরপর ঘুম থেকে উঠে দেখে সব মিথ্যা। অর্থাৎ স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নটার ঘোর যেন রয়ে গেছে।মায়া একবার ঘড়ির দিকে দেখল।সময় এখন রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই।ঘুম পাচ্ছে তাঁর।ভয় ও পাঁচ্ছে। ভয়ের জন্য ঘুমাতে ও পারছে না। তখনই ঘড়িতে টং করে শব্দ করে। বারোটা বেজে গেছে।মায়া ভৌতিক গল্পের বইতে পড়েছে,রাত বারোটার পড়েই ভুতেরা আসে।এটাই ওদের নির্দিষ্ট সময়।এমন সময় ঘরের আলো নিভে যায়।মায়া বিষ্ময়কর হয়ে উঠল। বাল্ব নিভে গেছে। শুধু কিছু মোমবাতি জ্বলছে।একধনের পিতলের হাঁড়ির ভেতর মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা। সোনালী আলো দিচ্ছে বেশ।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জানালা ভেদ করে এসে পড়েছে চাঁদের আলো।মায়া শোয়া থেকে উঠে বসে। চারপাশ খুবই নিস্তব্ধ।এমন মনে হচ্ছে এখনি কেউ হানা আনবে তার উপর।সে ভয়ে দোয়া পড়তে শুরু করে।পড়ে বুকে ফুক দিল। কিন্তু ভয় কমলো না। কিভাবে কমবে, মুহূর্তে বাথরুম থেকে জল পড়ার তীব্র শব্দ ভেসে আসছে।মায়ার বুকের ভেতর চিনচিন ব্যথা শুরু করল। তাঁর সাথে ধকধক শব্দ। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু গলা থেকে শব্দ বের হচ্ছে না।
সে বিছানা থেকে নামল। চাদরটা পেঁচিয়ে নেয়। এরপর বাথরুম এর দিকে হেঁটে গেল। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।জল পড়ছে। কিন্তু নিজে থেকে জল কিভাবে পড়বে? স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেল না তো!
বাথরুম এর কাছে পৌঁছে। দরজা খুলে ভেতরে গেল। আপনাআপনি জল পড়ছে।মায়া জলের কলটি বন্ধ করে দেয়। এরপর বাইরে চলে আসে।বাইরে এসে মায়ার ভয়টা আরো বেয়ে যায়।সে যখন বিছানা থেকে নামল তখন কম্বলটা বিছানায় ছিল, কিন্তু এখন ফ্লোরে পড়ে আছে।মায়া অস্ফুট আতঙ্কে জড়সড় হয়ে গেল।কম্বলটি কাঁপা হাতে ভয়ে ভয়ে তুলছে,ঠিক তখনি মায়ার মনে হল খাটের নিচে কেউ উবু হয়ে শুয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।মায়া ঘেমে গেল। প্রচন্ড ঘেমে গেল। তাঁর বুকের ধুকধুক শব্দ টা খাটের নিচ অবধি যেন চলে গেছে। কিন্তু অচেনা শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি চলে যাচ্ছে না।মায়া ঘুরে তাকাল খাটের নিচ। ভয়ংকর এক বিকৃত আকৃতির রুপ নিয়ে একটা মেয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে।মায়া তির্যক কন্ঠে চিৎকার দিয়ে দরজা খুলে বাইরে যেতে চাইলো।এমন সময় রাফিদ এর সাথে ধাক্কা লাগল তাঁর।মায়াকে বিচলিত দেখে রাফিদ জড়িয়ে ধরল তাকে।মায়া ফোপাচ্ছে। রাফিদ বারেবারে জিজ্ঞেস করল “কি হয়েছে?ভয় পেয়ে আছিস কেন?ঘরে কে?নাকি স্বপ্ন দেখেছিস?বল আমায়” একসাথে অনেক গুলো প্রশ্ন করল রাফিদ।মায়া নিজেকে কোনমতে সামলে বলল “ভাইয়া খাটের নিচে কেউ আছে”
“কি বলছিস! সত্যি”
“আমি সত্যি বলছি।এখনো ও খাটের নিচেই আছে।”
“চল ভেতরে দেখছি।” রাফিদ ঘরে প্রবেশ করে। এরপর খাটের নিচে উঁকি মেরে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।মায়া বুঝতে পারল,আহত মেয়েটি কে দেখেছে। রাফিদ ভয় পাচ্ছে।
‘ভাই তুই ওকে দেখেছিস,সরে আয়। আঘাত করবে।’
‘তুই ঠিকই বলেছিস মায়া। খাটের নিচে এ কে?তুই ওকে আগে থেকে চিনিস?
‘আমি ওকে কিভাবে চিনব?
‘ভুতটি একদম তোর মত দেখতে।’
‘কি বলছিস!”
‘সত্যি বলছি।’
“তারমানে ও আমার রুপ ধারণ করেছে।”
“একদমই তাই।তোর যা রুপ,খুব সহজেই ও নকল করে নিয়েছে।”
“ভাই’ মায়া ভয়ের চোখেই রেগে গেল। রাফিদ বসা থেকে উঠে আওয়াজ করে হেসে উঠলো।মায়া দেখল। এতক্ষণ তাঁর ভাই তার সাথে মজা করেছে। নিশ্চিত হল। রাফিদ হাঁসি থামিয়ে বলল নিল। এরপর ঘরের আলো জ্বালালো। একটা বাল্ব কেটে গেছে।যেটা জ্বলছিলো। রাফিদ আর একটা ধরাল। এরপর চেয়ারে বসে। জ্যাকেট এর পকেট থেকে সিগারেট বের করল। সিগারেট ধরিয়ে বলল “তুই আর শান্তি দিলি না।”
“আমিতো, সারাদিনেও তোকে বিরক্ত করি না!’আর এখন বলছিস শান্তি দিচ্ছি না।!”
“আমার কথা বলিনি।ভুত এর কথা বলেছি।”
“মানে?
“মানে ভুত তোর জন্য একটু রাতে শান্তি মত থাকতে পারছে না।’
“আমি সত্যিই ভুত দেখেছি। বাথরুম এর জলটা পর্যন্ত ও ছেঁড়েছে।বালতি ভরে জল নিচে পড়ছিল।”
“তো!এতে ভয় পাওয়ার কি আছে!ভুত কি তোর মত নোংরা।যে গোসল করবে না। গোসল করতে গিয়েছিল।”
“ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছিল।’
“ওর নিশ্চয়ই লজ্জা লাগছিল।’
“ভাই, আমি মোটেই মিথ্যা বলছি না।’
রাফিদ সিগারেট এর ধোঁয়া ছেড়ে বলল “মিথ্যা তো আমিও বলছি না।” মায়া থেমে গেল। রাফিদ তাঁর সাথে মজা করছে। অথচ সে ভয় পেয়েই আছে।মায়া গাম্ভীর্য মুখ করে ফেলেছে দেখে রাফিদ বলল ‘পাগলের ডাক্তার দেখাতে হবে।”
“কাকে?
“তোকে।”
“কেন?
“পাগ’লকে তো পা’গলের ডাক্তার ই ভালো করতে পারবে তাই না।!”
“আমি পা’গল”? মায়া হা হয়ে গেল।
“তা না হলে কেউ,ঘরের ভেতর ভুত দেখে।!”
“সত্যিই বলছি।’
“চোখে ঘুম ছিল।তাই ভুল দেখেছিস।’
“তাহলে জলের কল কে ছাড়লো?
“তুই দেশে আসার আগ পর্যন্ত ঘরটা বন্ধ ছিল। বাথরুম এর কলে একটু সমস্যা ছিল।সারানো হয়নি।মনেও ছিল না।তাই মাঝেমধ্যে একাই জল পড়ে।’
“তাহলে বিছানা থেকে কম্বল কিভাবে পড়ে গেল!আমিত ফেলেনি।’
“হয়ত তুই যখন নিচে নেমেছিস তখন,তোর গায়ে বেঁধে পড়ে গেছে।তুই দেখিসনি।’
মায়া নিজের মনের ভুল বলে ধরে নিল। রাফিদ এর ব্যাখ্যা গুলো যুক্তিসঙ্গত। এবং সত্য।মায়া মনে মনে স্বীকার করে। কিন্তু ভেতর থেকে ভয় যায়নি। রাফিদ সিগারেট টানা শেষ করে। শেষ খন্ডিত অংশটি বারান্দা থেকে ফেলে দেয়।
“আচ্ছা তুমি আমার ঘরে কেন আসলে এই সময়ে? মায়া হঠাৎ নীরব কন্ঠে প্রশ্ন করল।
“তুই থেকে তুমিতে চলে গেলি, হঠাৎ কি হল।?
“বলনা’
“দেখতে আসছিলাম তোকে।জ্বর কমলো কিনা”
“কমেছে।তবে পুরোপুরি না। শরীর টা এখনো গরম।’
“কই দেখি।” রাফিদ কপালে হাত দিয়ে দেখল। আসলেই গরম।
“তুই শুয়ে পড়। ঘুমিয়ে পড়লে শরীর টা ভালো লাগবে।”
মায়া এখন শুয়ে পড়লেই রাফিদ চলে যাবে। তারপর যদি ঐ ভূতটা আবার আসে!মাত্রই ভেবেছে,ভুতটুত বলে কিছু হয় না।সব মনের ভুল। কিন্তু এখন আবার মনে হচ্ছে,ভুত আছে। রাফিদ চলে গেলেই আসবে। রাফিদ কে যেভাবে হোক মায়ার আটকাতে হবে।
“ভাই একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
“আবার অনুমতি চাইছিস?
“তুমি বিয়ে কবে করবে?
“আমিত বিয়ে করব না।আর এসব ফালতু কথা বাদ দে।নে শুয়ে পড়।” রাফিদ মায়াকে শুইয়ে দিল।গায়ে কম্বল জড়িয়ে দিল। এরপর রাফিদ বিছানা থেকে উঠে যেতেই মায়া তাঁর হাতটা ধব করে ধরে ফেলল।রাফিদ থমকে দাঁড়িয়ে যায়। চোখের সামনে সে-ই ছোট্ট বেলার দৃষ্টটি ভেসে উঠে। কোথাও নির্জন পরিবেশে দু’জন খেলছিল। তখন রাফিদ তাঁর কাছ থেকে চলে আসতে চাইলে পেছন থেকে এভাবেই হাতটা সেদিন ধরে বলেছিল ‘আমাকে একা রেখে যেও না ভাইয়া।”
“আমায় একা রেখে যেও না ভাইয়া।ভয় করছে।” মায়া বলল। রাফিদ পুনরায় বিছানায় বসে। জুতা খুলে ফেলল। এরপর মোহময় কন্ঠে বলল “এইজন্য হঠাৎ তুই থেকে তুমিতে চলে গিয়েছিস।এত ভয় কিসের তোর!আমি আছিতো,আমি থাকতে তোর কখনো কিছু হবে না।” বলে রাফিদ মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।মায়া এতক্ষণ পড়ে নির্ভয়ে শুতে পারল। এখন শান্তিতে ঘুম হবে তার।মায়া রাফিদ এর ডান হাতের কনিষ্ঠা আঙুল টি খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে। রাফিদ তখন ফিসফিসিয়ে বললো “তোকে কাদদে দেখলে অন্তরটা পুড়ে যায়।আর তোকে হাসতে দেখলে দুনিয়াটাকেই সুন্দর মনে হয়।” এরপর মায়ার কপালে চুমু দিল।
অন্যদিকে রাত বাড়লেও ঘুম নেই গৌরী ও তাঁর মায়ের চোখে।বাইরে শীতের বাতাস হুহু করে বইছে, কুয়াশা যেন মাটির বুক জুড়ে সাদা চাদর বিছিয়ে রেখেছে।বাতাসে মাটির গন্ধ, আর ঠান্ডা এমন যে নিঃশ্বাসও যেন কেটে যায় মাঝপথে।
বিছানায় শুয়ে আছে রহিমা। চোখ আধখোলা, ঠোঁট ফেটে গেছে শীতে।গায়ে পুরনো একটা চাদর জড়ানো, যেটা এক সময় সাদা ছিল, এখন ধূসর আর ছেঁড়া।তার পাশে রাখা আছে একটা পুরনো লণ্ঠন, তার আলোয় ঘরটা যেন কাঁপে কাঁপে জ্বলে নিভে যায়।
গৌরী চুলার সামনে বসে আছে। চুলগুলো এলোমেলো, গায়ে পাতলা একটা শাল, ঠান্ডায় ঠোঁট বেগুনি হয়ে গেছে।
সে চুলার সামনে বসে আগুন ধরানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু ভেজা কাঠে আগুন ধরছে না, শুধু ধোঁয়া উঠছে। সারাদিন জমিদার বাড়িতে কাজের জন্য ছিল। সন্ধ্যায় ফিরে সেলাই মেশিনে বসে কিছু কাপড় কাটছিল। একজন দুইটা থ্রিপিস আর একটা ফতুয়া বানাতে দিয়ে গেছে। রান্নার সুযোগ হয়নি।
চুলার ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে জল চলে আসে, কিন্তু সে পাপড়ি দিয়ে মুছে আবার চেষ্টা করে।
“এই আগুনও আমার মতো মা,যতই জ্বলাই, জ্বলে না।” গৌরী বলল।
বিছানা থেকে রহিমা কাশতে কাশতে বলল
‘মা তুই আবার কাদদাছিস নাকি?”
গৌরী হাতের পিঠে চোখ মুছে “না মা, ধোঁয়ায় চোখে জল আসছে।”
“ধোঁয়া না রে, তোর মনের কষ্ট বের হইতেছে।তুই আমারে লইয়া আর ভাবিস না।যদি হায়াত থাকে তবে বাচুম,নয় মরুম।”
গৌরী রহিমার পাশে এসে বসে, কপালে হাত রাখে তাঁর। গরম আগুনের মতো গা জ্বলছে রহিমার।
গৌরী তখন বলল“তোমার শরীর জ্বরে পুড়তেছে মা।আমি তোমাকে ডঃ এর কাছে নেয়ার চেষ্টা করব আগামীকাল।
“টাকা কই রে? তিনদিন হলো ভাত চড়াইনি ঠিক মতো। ডাক্তার কেমনে দেখাবি?”
গৌরীর চোখে অশ্রু চকচক করে ওঠে লণ্ঠনের আলোয়।গৌরী বলল “আমি মাসিমার কাছে যাই।দিনে তো সময় পাব না। তাঁর কাছে কিছু ধান ধার চাই।আর ঘরে যা আছে মিলিয়ে বিক্রি করে তোমাকে ডাক্তার দেখাবো”
রহিমা কিছুটা রাগ করে বলল “না রে গৌরী। শীতের এই রাইতে কুয়াশার ভেতর যাস না। রাস্তা পিচ্ছিল, কেউ থাকেও না বাইরে এই সময়ে। আমি ঠিক আছি।”
গৌরী অবাধ্য কণ্ঠে বলল “তুমি ঠিক নাই মা, তুমি কি মরন চাও।”
এই কথাটা বলেই গৌরী নিজেই চমকে ওঠে। কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু শব্দটা যেন ছুরি হয়ে বাতাসে কেটে যায়। রহিমা মৃদু হাসে। “তুই এমন কথা বলিস না রে, গৌরী। মরার ভয় আমার নাই। আমি তো আগেই অর্ধেক মইরা গেছি।আমি চাই তুই একটু ভালো থাক।মরার আগে তোরে যদি একটা কিনারায় তুলে দিয়ে যাইতে পারতাম।” রহিমার কন্ঠে আক্ষেপ জড়ানো।
গৌরী চুপ করে যায়। শুধু তাঁর মায়ের হাতটা নিজের বুকের ওপর রাখে।“তুমিই আমার কিনারা। তুমি থাকলেই আমি বাঁচি মা। তুমি ছাড়া আমার কিচ্ছু নাই।আর আমি কিছু চাই ও না।
বাইরে হঠাৎ বাতাস জোরে বয়ে যায়, দরজাটা ঠাস করে বন্ধ হয়ে যায়।লণ্ঠনের আলো কাঁপে, ছায়া নড়ে দেয়ালে।দূরে কুকুরের ডাক ভেসে আসে লম্বা,করুণ।রহিমা শোয়া থেকে উঠে বসে।চৌকি থেকে নিচে নামতে চাইল। কিন্তু মাটি ঠান্ডা। তাঁর জুতো জোড়া ছিঁড়ে গেছে।
“তোমার কিছু লাগবে? গৌরী জিজ্ঞেস করল।
“তুই একটু গরম জল আইনা দে।গলাটা শুকায়ে যাইতেছে”
গৌরী চুলায় হাঁড়ি বসায়, কিন্তু আগুন ধরছে না।কাঠ ভিজে গেছে।ধোঁয়ায় পুরো ঘর ভরে যায়। গৌরী কাশতে কাশতে কপাল মুছে, তবু হাল ছাড়ে না।একটু আগুন ধরতেই সে হাঁড়িটা বসিয়ে দেয়।
জল গরম হতে থাকে, আর সে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
রহিমা চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে,“গৌরী, মনে আছে তুই ছোট থাকতিস, তোরে পিঠা খাওয়াইতাম? এই সময়ে পিঠার গন্ধে পুরা বাড়ি ভরপুর থাকত।”
গৌরী হেসে চোখ মুছে বলে, “তুমি থাকলে আবারও সেই পিঠার গন্ধ হবে মা।”
রহিমা চুপ রইল।শুধু কাশতে থাকে।
জল ফুটে গেলে গৌরী একটু তাঁর মায়ের জন্য গ্লাসে করে এনে দেয়।সাথে মুড়ি এনে তাঁর মায়ের হাতে দিল।রহিমা কম্পিত গলায় বলল “তুই খাবি না?”
“তোমার পরে খাবো মা।”
“তুই সব সময় এমন বলিস। তোর পেটেও তো আগুন জ্বলে।”
গৌরী মিথ্যা হাসার চেষ্টা করে বলল “আমার পেটের আগুন ঠান্ডা, তোমার শরীরেরটা আগে নেভাতে হবে।”
রহিমা চোখ বন্ধ করে, কণ্ঠ আরও নিচু হয়ে আসে।“তুই যদি একদিন মানুষ হইতি, আমি শান্তি পাইতাম রে। তোর সুবুদ্ধি আছে, মুখশ্রী ভালো, যদি একটু পড়াতে পারতাম।”
গৌরী বলল “আমি পড়ব না মা।পড়লে পেটে ভাত আসবে না।
রহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাইরে শীতের হাওয়া ছাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসে।লণ্ঠনের শিখা কাঁপে, যেন ভয়ে নিভে যাবে।গৌরী উঠে দরজাটা আটকায়, তারপর আবার তাঁর মায়ের পাশে এসে বসে। রহিমা তিনটা ঔষধ খেল। এরপর গৌরী বিছানা থেকে সব সরিয়ে ফেলল। ফিরে এসে তাঁর মায়ের পাশে বসে হাত ধরে বলল
“তুমি একটু ঘুমাও মা। আমি আছি।”
রহিমা দুর্বল কণ্ঠে বলল “তুই যদি না থাকো, আমি ঘুমাই কেমনে রে?”
“আমি আছিতো মা, তোমায় ছাড়ব না মা।”
রহিমা আর কিছু বলে না। শুধু নিঃশ্বাসে হালকা কাশি মিশে যায়।গৌরী তার মায়ের কপালে চুমু খায়, তারপর মাথা রেখে পাশে শোয়।
বাইরে তখন কুয়াশা ঘন হয়ে গেছে, দূরে গাছের মাথা পর্যন্ত দেখা যায় না।শীতের কামড়ে গৌরীর আঙুল অবশ, তবু সে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে আছে, যেন ছেড়ে দিলেই মাটি ফেটে তাঁর ভেতরে চলে যাবে।হঠাৎ লণ্ঠনের শিখা নিভে যায়। ঘরটা
অন্ধকার।শুধু কুয়াশার মধ্যে বাতাসের গর্জন, আর তাঁর মায়ের নিঃশ্বাসের শব্দ।
রহিমা ফিসফিসিয়ে বলল “মালকিন যদি বেতন দেয়, তাইলে আমারে এক জোড়া জুতা কিনা দিস। ঠান্ডায় মাটিতে পা রাখন যায় না।”
“এনে দিব মা।”
কিছুক্ষণ পরেই ঘরে নিস্তব্ধত।গৌরীর চোখের জল গড়িয়ে পড়ে তাঁর মায়ের আঁচলে।লণ্ঠনের নিভে যাওয়ায় ঘরে গৌরীর কান্নার শব্দ মিশে যায় শীতের বাতাসে।পুরো আমিলনগর ঘুমিয়ে আছে এখন।কিন্তু একটা মাটির ঘরে এক মেয়ে জেগে আছে’গৌরী।একটু পরপর মা’ নিঃশ্বাস নিচ্ছে কিনা দেখছে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে দেখে গৌরী স্বস্তি পায়।তার কপালে হাত রেখে,জ্বর দেখল।জ্বর কমেছে কিছুটা। গৌর অশ্রুসিক্ত নয়নে ফিসফিস করে মাথা নিচু করে বলছিল “তুমি ঘুমাও মা।আমি তোমাকে ছাড়ব না কোনদিন।”
ভোরবেলা।পূর্ব আকাশের দিগন্তরেখা তখন ম্লান নীল থেকে ধীরে ধীরে হালকা কমলায় রঙ নিচ্ছে। বাতাসে শিশিরের নরম গন্ধ, মাটির গন্ধে মিশে আছে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। দূরে পাখিরা কিচিরমিচির করে নতুন দিনের আগমন ঘোষণা দিচ্ছে। চৌধুরী নিবাসন এর দোতলার ঘরে ঘুম ভাঙল মীরের। চোখ খুলতেই জানালার ফাঁক দিয়ে আসা আলো পড়ল তার মুখে। হালকা হেসে মীর উঠে বসল।
মাথার কাছে রাখা ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা ছুঁইছুঁই।ঘরের ভিতরে হালকা ঠান্ডা বাতাসরা খেলছে পর্দায়। গা ঝাঁকিয়ে মীর উঠে দাঁড়াল। মৃদু হাই তুলে জানালার বাইরে তাকাল।দূরের তাল গাছগুলোর মাথা কুয়াশায় ঢেকে গেছে, পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিকে।
তাঁর মনে পড়ল গতরাতে মায়ার জ্বর কমেছিল কিনা দেখতে পারেনি। হঠাৎ যেন এক ধরনের চিন্তা কাজ করল তাঁর ভিতরে। নিঃশব্দে চাদরটা কাঁধে ফেলে দরজার কাছে গেল মীর। এরপর দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে একবার আহির এর হাতের দিকে দেখল।রাতে দু’জন একসাথে ছিল।এরপর চলে যায় মায়ার ঘরের দিকে।
মায়ার ঘরের দরজার সামনে এসে একটু থামল।
ভেতর থেকে খুব হালকা শ্বাসের শব্দ আসছে। দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ রাখতেই দেখল, জানালার আলো পড়েছে ঘরের এক কোণে। মায়া চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে, পাশে রাফিদ।রাফিদ আধঘুমে।হয়ত সারারাত জেগে ছিল বোনটার পাশে।মায়া রাফিদ এর আঙুল ধরে রেখেছে। যেভাবে ছোট্ট বাচ্চারা ধরে রাখে।
মীর এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে তাকিয়ে রইল।
তাঁর মুখে একরাশ কোমলতা ভেসে উঠল।
চুপিসারে নিজের মনে বলল,
“জ্বর কমে গেছে বোধহয়।ভাই যেহেতু পাশে’ভালোই।”
তারপর মৃদু হেসে দরজার ফাঁক আস্তে বন্ধ করে দিল। কোনো শব্দ না করে ঘুরে দাঁড়াল।
আজ মায়াকে আর বিরক্ত করা যাবে না।এই ভাবনা নিয়ে ধীরে ধীরে প্রাঙ্গণের দিকে হাঁটল মীর।
বাইরে তখন সকাল পুরোপুরি জেগে উঠছে।
চণ্ডীবটের নিচে এক বৃদ্ধ কাজের লোক উঠোন ঝাড়ছে। বাতাসে মৃদু ধুলো উড়ছে। উঠোনের পাশের নলকূপে একজন বালতি ভরছে, জল পড়ছে টুপটাপ শব্দ করে। পুকুরপাড়ে দাসীরা আছে। তাঁরা মূলত সমস্ত অনুচারীদের জন্য রান্নাবান্না করে।
মীরের চোখ পড়ল অশ্বশালার দিকে।সেখানে তাঁর প্রিয় অশ্ব অগ্নিল বাঁধা। কালো রঙের সেই অশ্ব যেন সূর্যের আলোয় চকচক করছে।অগ্লিন মীরকে দেখেই মৃদু হ্রেষা ছাড়ল, যেন অভিমান করে বলছে,“আজ এত দেরি কেন?”
মীর এগিয়ে গিয়ে ওর গলা স্পর্শ করল।অগ্নিল নাক ঘষল তার কাঁধে।মীর হেসে বলল,
“চল, আজ সকালে একটু ঘুরে আসা যাক, হে বন্ধু।”
কিন্তু এখনই তার অশ্বে চড়া ঠিক হবে না। মায়ার কথা মনে পড়ল আবার।তবুও অশ্বের গায়ে হাত বুলিয়ে দিল যত্ন করে।তারপর একখানা কাপড়ে অগ্নিলের চোখ-মুখ মুছে দিল, জলভর্তি বালতি থেকে একটু জল খেতে দিল।
আকাশের রঙ তখন আরও উজ্জ্বল হয়েছে।
বাড়ির ছাদে কয়েকটা পায়রা বসে আছে। দিগন্তে সূর্যের প্রথম গোলক দেখা দিচ্ছে। মীর একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখল,কুয়াশার চাদর সরছে ধীরে ধীরে, গ্রামটা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠছে নতুন দিনের সুরে।রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে।মীর গভীরভাবে শ্বাস নিল।যেন এই নিরব সকাল, এই আলো, এই কুয়াশা সবই তাকে এক অদ্ভুত শান্তি দিচ্ছে।
হঠাৎ পেছন থেকে ডাক এল
“বাবু, চা দিব?”
মীর ঘুরে দেখল বুলবুল।মীর হেসে বলল,
“না বুলবুল এখনই নয়। আগে একটু হাঁটতে যাব।”
তারপর আস্তে আস্তে পায়ে পায়ে পুকুরঘাটের দিকে রওনা দিল।জলচর পাখিরা তখন ডানা ভিজিয়ে খেলছে, পুকুরের জলে সূর্যের প্রতিফলন কাঁপছে হালকা ঢেউয়ে।
মীর থেমে দাঁড়াল।তার চোখে একরাশ নীরবতা।
বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে গেল।
দিগন্তের দিকে তাকিয়ে মীর মৃদুস্বরে বলল
“আজ দিনটা ভালো যাবে নিশ্চয়ই।”
সকালের পাখিরা তার কথার উত্তর দিল যেন সুরে সুর মিলিয়ে।আর অগ্নিল দূর থেকে একবার হ্রেষা ছেড়ে যেন জানিয়ে দিল,
“আমি আছি, মীর।”মীর হাসে।
মীর তখন দেখল বাড়ির ভেতরে একটা মেয়ে প্রবেশ করেছে। তাঁর মাথায় দীর্ঘ কাপড় টানা।মীর গৌরী কে সন্দেহ করে দ্রুত হেঁটে তাঁর কাছে আসে।গৌরী দাঁড়িয়ে যায়।মীর একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল। এরপর প্রশ্ন করল “তুমি নিশ্চয়ই গৌরী?
গৌরী নিশ্চুপ।
“আচ্ছা তোমার বাবা কিভাবে মারা গিয়েছিল?
গৌরী এবার যেন একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল।দু হাতে শক্ত করে নিজের পোশাক নিজেই মুষ্টি করে ধরল।মীর দ্বিতীয় বার কিছু বলার আগেই গৌরী বলল “আমার কাজ আছে। দেরি হলে মালকিন বকবেন।” বলে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল ঘরের ভেতরে।
রান্নাঘরে শেফালী।মাছ কাটছে। শালুক ও আছে। গৌরী গিয়ে কাজে হাত লাগাল। শালুক তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল “তোর মায়ের এখন কি অবস্থা? শরীর টা ভালো?
“আগের মতই আছে। আরেকবার ডাক্তার দেখানো উচিত।”
“তাহলে দেখা।”
“আপনি এই মাসের বেতন টা দিলেই দেখাব।”
শালুক নিশ্চুপ রইল। তাঁর হাতে চায়ের পাতিল ছিল। নিচু স্বরে গৌরী কে বলল “সবাইকে চা দিয়ে আয়।উপরে মায়া আছে, ওকেও দিস। অতিথি আছে। তাঁদের দিতে ভুলে যাস না আবার।”
গৌরী মাথা আওড়ালো ‘আচ্ছা’
গৌরী চা হাতে নিয়ে দোতলায় গেল।বাড়ির লোক, অতিথি কোন দিকের ঘরে থাকে সে জানে না।স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে এক দিকে চলে গেল।একটা ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা ছিল। গৌরী ভেতরে প্রবেশ করে। টেবিলের উপর চায়ের ট্রে রাখল।এক কাপ চা হাতে নিয়ে বিছানার দিকে ঘুরে তাকালো।আহির ঘুমাচ্ছে।চিত হয়ে।ডান হাতটা সোজা করে রাখা।গায়ে কম্বল। গৌরী চিনতে পারে।
চায়ের কাপটা সে হাত থেকে রেখে দেয়। এরপর সোজা চলে যায় রান্নাঘরে। কিছু চা পাতা বেটে নিল। কুসুম গরম জল নিল। এরপর পুনরায় আহির এর ঘরে চলে আসে।
ধীরস্থির ভাবে আহির এর হাতের পট্টি খুলে দেয়। ক্ষতস্থানটি পুনরায় পরিষ্কার করে দিল।বেটে আনা চা পাতা ক্ষতস্থানে দিল। পুনরায় পট্টি বেঁধে দিল। গৌরী মনে মনে বলল “নিশ্চয়ই বাড়ির অতিথি।খেয়াল রাখার মত বোধহয় কেউ নেই।সবাই তো ব্যস্ত।’
এক কাপ চা টেবিলে রাখল। বাকি চা ট্রেতে করে নিয়ে চলে যেতেই পেছন থেকে মলিন কন্ঠ ভেসে আসে। “গৌরী, আমার ক্ষত বিক্ষত জায়গাটি পূর্ণ করে দেয়ার জন্য শুকরিয়া।” গৌরী থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আহির সজাগ। এতক্ষণ সবকিছু টের পেয়েছে। গৌরী বুঝতে পারল না। নিজের কাছেই নিজের জন্য লজ্জিত হচ্ছে। কিন্তু এখানে লজ্জার কি আছে! একজন অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করা উত্তম কাজ।
গৌরী ঘর থেকে চলে যেতে চাইল। আহির ফের দাঁড় করিয়ে বলল “আমার হাতের পট্টি ভালো করে পেঁচানো হয়নি।খুলে যাবে।এটা ঠিক করে দিয়ে যাও।”
গৌরী দাঁতে দাঁত চেপে ঘুরে তাকাল।ট্রেটা রাখল।আহির খাটে পাশে উবু হয়ে শুয়ে আছে।হাতটা আগ বাড়িয়ে এগিয়ে দিল।গৌরী পা’ আধভাজ করে বসে হাতের পট্টি খুলে ফেলল।আহির তখন বলল “আমি এতক্ষন সজাগ ছিলাম।চোখ আধখোলা ছিল। তোমাকে আমি আগেই দেখেছি।বাধা দেয়নি।ভালোই লাগছিল তোমার যত্ন”
গৌরী চুপচাপ তাঁর কাজ করল।আহিরের কোন কথার প্রতিক্রিয়া করল না।
গৌরী উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার জন্য।আহির শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ালো। গৌরীর সামনে দাঁড়িয়ে বলল “তুমি কথা বলতে পারো না?
গৌরী পাশ কেটে যেতে চাইল।আহির হাত বাড়িয়ে বাঁধা দেয়। “জবাব না দিয়ে কোথায় যাচ্ছ? তুমি সত্যিই কথা বলতে পারো না!
কোন জবাব নেই গৌরীর।
“কথা না বলতে পারলেও একটা সুবিধা আছে। সুন্দরী মেয়েরা রঙে ঢঙে কথা বলে। কথা শুরু করলে থামে না।মশার মত ভন ভন করতেই থাকে।”
গৌরী এবার ও চুপচাপ।আহির পুনরায় বলল “থাক তোমাকে বিরক্ত করব না।তোমার কাজ কর।দরকার পড়লে আমিই তোমার সাথে কথা বলে নেব।”
গৌরী চলে যায়।আহির একা একা হাসল।
সকাল গড়িয়ে যায়। মায়া ঘুম থেকে উঠেছে বেশ কিছুক্ষণ। রাফিদ উঠিয়েছিল। শেফালী এসে গরম দুধ আর রুটি সাথে ভাজি দিয়ে গিয়েছিল। সকালের খাবার। তাঁর মনটা উদাসীন।সে জানে, পুরোপুরি সেরে উঠলেই বিয়ের আয়োজন শুরু হবে। তাঁকে একজন অচেনা অজানা ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া হবে। ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাকে এ বিয়েতে রাজি হতেই হবে।
তাঁর ঘরের দরজাটা খোলা ছিল।গৌরী অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করল।মায়া গৌরী কে দেখে বলল “তুই এখানে?
“মায়ের শরীর টা ভালো না।তাই আমাকেই আসতে হল।শুনেছি তোর শরীর ভালো না,এখন কি অবস্থা?
“ঠিক আছি!
“দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন ঘর থেকে বের হস না।চল।বাইরে থেকে ঘুরে আসবি।”
“কোথায় যাব?
“কোথায় আর, পুকুরপাড়ে।”
মায়া রাজি হল। দুজনে পুকুরপাড়ে গেল। পুকুর জলে হাঁস মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে।নীরব জল ওদের সাঁতারে ঢেউ তুলছে। সূর্যের কিরণ পড়ছে জলে।যা জল থেকে তাঁর আলো প্রতিফলিত হল গৌরীর মুখে। দৃষ্টটি দেখল আহির।
আহির, রাফিদ, মীর পুকুর পাড়ে একটা পাথরের বেঞ্চে বসে আছে। তিনজন এর হাতেই সিগারেট।গৌরী কে দেখে আহির সিগারেট ফেলে দেয়।
মায়া পুকুর এর শেষ শানে নামল। গৌরী উপরেই দাঁড়িয়ে রইল। আহির তখন মীর কে নিয়ে পুকুর ঘাটে উপস্থিত হয়। গৌরী কে শুনিয়ে শুনিয়ে সে এটা ওটা বলতে থাকল। কিন্তু মীর সেসব না শুনে মায়ার দিকে দেখছে। তখন মায়ার শরীরের অবস্থা জানার জন্য তাঁর ঘরে যেতে চাইলে থমাস তাঁর সামনে উপস্থিত হয়।মীর এর সাথে কথা আছে বলে দূরে নিয়ে যায়। অতঃপর এখন দেখছে মায়াকে। হাস্যোজ্জ্বল মুখ তাঁর।জ্বর নেই বলে ধরে নিল মীর।
আহির এটা ওটা বলতে বলতে পেছনে সরতে থাকল বেখেয়ালি ভাবে।ঘাটের উপর থেকে নিচে সিঁড়ি বেয়ে গেছে।আহির আর একটু পেছনে গেলেই পড়ে যাবে।
মীর মায়ার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আহির এর দিকে নিতেই সে পা পিছলে পড়ে যেতেই গৌরী চেঁচিয়ে হাত এগিয়ে বলল “সামলে”
মীর ধরে ফেলে আহির এর হাতটি।মায়া আতঙ্কিত হয়ে উঠল। রাফিদ দৌড়ে আসে।আহির স্তব্ধ হয়ে গেল।মীর বলল “এখনি পড়ে যেতিস।মন থাকে কই!চল এখান থেকে।” তারা তিনজন চলে যায়।
আজ শুক্রবার। জুমার দিন। যোহরের আযান এখনো পড়েনি।আযান দিতে দিতে এখনো পনেরো মিনিট এর মত বাকি। শুক্রবার বলে আহির আজ বাইরে বের হয়নি। তদন্ত করার জন্য।
চৌধুরী বাড়ির ছাদে তাঁরা আড্ডা দিচ্ছে। রাফিদ রেলিঙ ধরে প্রকৃতি দেখছে।আহির বেতের চেয়ারে বসা। তাঁর সামনে মীর।
মীর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল “জানিস রাফিদ, মোহিনী ওর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে।সেও প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। ভাবতেই অবাক লাগছে।”
রাফিদ বলল “কি বলছিস! সত্যি বলছিস নাকি?
“আমি মিথ্যে বলব কেন?ও চিঠিতে ওর উত্তর জানিয়েছে। চিঠিটা আমার কাছেই আছে।তুই দেখতে পারিস।”
আহির বলল “ভালোই হল।প্রেমে সফল হ। বিয়েটা শীঘ্রই করে নে।আমি যাতে দেখে যেতে পারি।”
তাঁদের কথোপকথন শুনে নেয় মায়া। গৌরী আর সে আসছিল ছাদে।কাপড় শুকাতে।মায়ার ভেতরটা ভেঙ্গে গেল।গৌরী মায়ার অভিব্যক্তি দেখে কিছু বুঝতে পারল। এরপর তাকে নিয়ে ছাদ থেকে চলে যায়।
আহির, রাফিদ, মীর জুমার নামাজ এর জন্য গোসল শেষে তৈরি হয়ে নেয়।আহির কালো রঙের পাঞ্জাবি পড়ল।মীর এবং রাফিদ সাদা রঙের পাঞ্জাবি পড়ে নেয়।
The Silent Manor part 6
মীর তাঁর ঘর থেকে বের হতেই দেখল ফ্লোরে কিছু একটা পড়ে আছে।একটা ভাজ করা পৃষ্ঠা।হাতে তুলে নিল পৃষ্ঠাটি।এটা সেই চিরকুট যেটি সেদিন উত্তরপাড়া থেকে আসার সময় এক অচেনা লোক দিয়েছিল।মীর চিরকুট টি ড্রয়ারে রেখে দিল। তখন মনে পড়ে চিরকুটে একটি চিত্র আঁকা ছিল।যেটা সেদিন বোঝা যায়নি।মীর ড্রয়ার খুলে চিরকুট টি খুলল। চিত্রটি দেখল।একটি পুরনো প্রাসাদ। আশ্চর্যের বিষয় হল প্রাসাদ টি ঠিক উত্তরপাড়ার সে-ই প্রাসাদটির মতন।মীর স্তম্ভিত হয়ে গেল।ঠিক তখনই মসজিদ থেকে আযান এর সুর ভেসে আসে।
