The Silent Manor part 8

The Silent Manor part 8
Dayna Imrose lucky

জুমার নামাজ শেষে সবাই সরু পথ ধরে বাড়ি ফিরছে। রাফিদ, মীর ও আহির।সবাই এক পোশাকে।পাঞ্জাবি।সকলের মাথায় সাদা টুপি।কিন্তু আহির এর মাথায় একটা রুমাল বাঁধা।সাদা রঙের রুমাল।আহির কে এরকম সাজে দেখে মায়া তখন বলেছিল “আপনাকেও খুব সুদর্শন দেখাচ্ছে।একদম আমার রাফিদ ভাইয়ার মত।’ আহির প্রতিক্রিয়ায় শুধু মায়ার মাথায় হাত রেখে বলেছিল ‘দুষ্টু মেয়ে একটা। তুমিও কিন্তু ভারী মিষ্টি। একদম আমার ছোট্ট বোনের মত।’মায়া হেসেছিল।
মীর পথে আসতে আসতে বলল “আজ শুক্রবার। দোয়া কবুলের দিন।যাই, মায়ের কবরটি জিয়ারত করে আসি।”
রাফিদ এবং আহির তাঁর রেশ টেনে বলল আমরাও যাব।’ বলে তিনজন জমিদারদের পারিবারিক কবরস্থান এর দিকে হাঁটল।

কবরস্থান এর ভেতরে জুতা খুলে তিনজনই প্রবেশ করে।মীর সহ সকলে কবর জিয়ারত করে।মীর এর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল।এটাই কি প্রাকৃতির নিয়ম! মানুষ তাঁর স্মৃতি রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবে!কেন দুনিয়ার সময়টা আর একটু দীর্ঘ হয়না? প্রশ্নটা যেন মীর এর মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
জিয়ারত শেষে তাঁরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথের দুইধারে ধানক্ষেত।ধানের ঝিরিঝিরি শব্দ ভেসে আসছে। কিছু ধান পেকে হলদে ভাব হয়ে গেছে। কিছু পাখিরা দল বেঁধে উড়ছে।পাড়ার ছেলেরা দৌড়ে দৌড়ে খেলা করছে।আহির এবং মীর এর কাছে প্রতিটি দৃশ্যই যেন মুগ্ধকর মনে হল।মীর বলল “ইচ্ছে করছে সারাটা জীবন এখানেই থেকে যাই
রাফিদ মীর এর রেশ টেনে বলল “তোকে এখানে থাকতে তো কেউ বারণ করেনি, থেকে যা।” মীর হেসে জবাব দিল “ইদানিং মনে হচ্ছে সময়টা ঘনিয়ে এসেছে।আমিলনগর নয়, দুনিয়া থেকেই চলে যেতে পারি।” বলে মৃদু হাসে। কিন্তু রাফিদের কাছে বাক্যটি ভালো লাগেনি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আহির মীর এর দিকে তাকিয়ে বলল “আমরা বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্ব এর পথচলা সবে শুরু হয়েছে। একসাথে আমরা অনেক পথ চলব। অনেক ইচ্ছা আছে।আর তুই এসব বলছিস?” মীর বলল “তোদের দেখছি রসিকতা করেও কোন কথা বলা যাবে না।”
কথা বলতে বলতে তাঁরা বাড়িতে পৌঁছে যায় আমজাদ চৌধুরী বেশ উদ্ভ্রান্ত হয়ে বসে আছে বৈঠকখানায়। তাঁর সাথে থমাস শন। রাফিদ ও আহির এসেও তাদের সাথে যোগাদান দিল।আহির যেন একটু সময় পেল। আমজাদ কে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার। আমজাদ ও ক’দিন ধরে মিলন এর বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত।আহির ও রাফিদ তাদের সাথে আলাপ আলোচনার মশগুল হল। কিন্তু মীর সেখান থেকে চলে যায়।সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে উঠতেই সামনে পড়ে মায়া।মায়া আজ শাড়ি পড়েছে। আকাশী রঙের শাড়ি। সাথে চুলগুলো খোলা রেখেছে। কপালে ছোট্ট একটা টিপ।মুখশ্রী বেশ উজ্জ্বল দেখালো।মীর চোখ তুলে তাকায় মায়ার দিকে। দুজনে মুখোমুখি।মীর মলিন কন্ঠের সাথে রসিকতা টেনে বলল

“রুপসীর রুপ যে মাশাআল্লাহ’দেখলেই বলতে ইচ্ছে করে সুবাহানাল্লাহ।”
“মশকরা করছেন?
“আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে কেউ মশকরা করে? পাপ হয়”
“আপনি তো, মেয়েদের মন নিয়ে রং তামাশা করেন।তাতে পাপ হয় না।?
“মোটেই না।আমি কখনো একাধিক মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করেনি। সত্যি কথা বলতে আমার জীবনে আমি পাঁচজন নারীর সাথে কথা বলেছি।”
মায়া শান্ত স্বরে বলল “হিসেব আছে দেখছি”
“বরাবরই আমি হিসেবে পাকা।’
“তা পাঁচজন নারীর মধ্যে তাঁরা কারা?
মীর বলল “একজন আমার মা, একজন ছোট্ট মা, একজন দাদী,আর একজন তুমি!”
মায়া ভ্রুকুঞ্চিত করল। “চারজন হল। পাঁচ নম্বর কে?

মীর বেশ উৎফুল্ল হল। এরপর নিমিষেই আবার নীরব হয়ে বলল “আছে একজন।’তবে তাঁর নাম এখনি বলা যাবে না।সময় হলে ঠিক জানতে পারবে।” মায়া মনে মনে নিশ্চিত হল। পাঁচ নম্বর মেয়েটি নিশ্চয়ই মোহিনী। কিন্তু শব্দে প্রকাশ করল না।তার ভেতরটা কিঞ্চিত কেঁপে উঠল। নিজের প্রিয় মানুষটির মুখে তাঁর প্রিয় মানুষ এর কথা শোনা যেন ছুরির মত হৃদয় গাথে।
মায়াকে চুপচাপ দেখে মীর বলল “কি হল,চুপ করে আছো কেন?
মায়া এবার ক্ষিপ্ত হয়ে বলল “সে কৈফিয়ত আপনাকে দিতে হবে!সরুন সামনে থেকে!”
মীর বলল “সামনে থেকে সরব কেন?পাশেই তো জায়গা আছে। ওখান থেকে থেকে যাও।দেখো আবার পড়ে যেও না কিন্তু, তাহলে ধরার জন্য তোমার স্বামী কিন্তু এখনো আসেনি।”
মায়া রাগে গজগজ করতে করতে বলল “আমি পড়ে গেলে সামলে নিতে পারব”

“পারবে না রুপসী।” মীর কথা শেষে থামতেই মায়া পাশ কেটে যেতে চাইল। তখনি পা পিছলে মায়া পড়ে যেতেই মীর ধরে ফেলে।মায়া বিমোহিত হয়ে উঠল।মীর মায়াকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে মোহময় কন্ঠে বলল “বললাম না, নিজেকে সামলে নিতে পারবে না।” মায়া দৃষ্টি এলোমেলো করে বৈঠকখানার দিকে দেখল।সবাই যে যার মত কথা বলছে। তাঁদের দিকে কেউ ঘুরেও তাকায়নি।মায়া ভেবেছিল সবাই হয়ত তাকে আর মীর কে বিব্রতকর অবস্থায় দেখেছে। কিন্তু কেউ দেখেনি।এটাও কি সম্ভব?কারো নজর এদিকে আসল না’নাকি তাঁরা দেখেও না দেখার ভান করছে?মায়ার মনে হল, তাঁরা অদৃশ্য একটা দেয়ালের মাঝে। যেখানে তাকে কেউ বিব্রতকর অবস্থায় দেখে না। অথচ তাঁর ধারণা সবাই দেখে। কিন্তু কোন এক কারনে সবাই চুপ থাকে।এর কোন ব্যাখ্যা সে পেল না।
আহির তার হাতের পট্টি খুলে ফেলেছে। যন্ত্রণা নেই এখন আর। তাঁকে বের হতে হবে সত্যর সন্ধ্যানে। মিলন কে কারা হ’ত্যা করেছে এর সত্যটা তাকে বের করতে হবে। সন্দেহের চোখে প্রথমেই আমজাদ। এবং তাঁর বাড়ির সকলে। রাফিদ কেও সন্দেহ করছে আহির। তবে এখন পর্যন্ত উপযুক্ত কোন তথ্য সে পায়নি।

বিকেলের দিকে সে অশ্ব নিয়ে আলিমনগর এর আনাচে কানাচে চলে যায়। সবকিছু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে দেখছে। সংবিধানের ভাষায় বহু বিখ্যাত একটা উক্তি আছে ‘অপরাধী যতই চালাক হোক না কেন, অপরাধ শেষে প্রমাণ সে রেখেই যায়’! সে-ই প্রমাণ এর খোঁজেই যেন আহির।
শীতের সময় দিনের গতিটা যেন ক্ষুদ্রতম হয়।এই সকাল শুরু হল তো, এই শেষ। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে।আহির ফেডোরার আড়াল থেকে পশ্চিমে দেখল। সূর্য বিদায় নিচ্ছে। আকাশের আড়ালে লুকিয়ে যাচ্ছে যেমন সত্য লুকিয়ে যায় মিথ্যার আড়ালে। অশ্বের লাগাম টেনে জমিদারের তাতশাশা এর দিকে গেল।সবাই বাড়িতে চলে যাচ্ছে। ছুটি হয়েছে মাত্র ই।আহির পুনরায় অশ্বের লাগাম টানল। অশ্ব ছুটছে অজানা পথে। তখন আহিরের সামনে একটি গাড়ি এসে থামে।তারই গাড়ি।গাড়ি থেকে নেমে আসে তাঁর সহকারী অরুন।

‘স্যার, আমি একটা তাজা খবর নিয়ে এসেছি।’
-কি খবর শুনি?
‘মিলন এর লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া হয়েছিল তো। রিপোর্ট এসেছে।
-কি এসেছে রিপোর্টে?
‘আমরা যখন ওর লাশ পাই তখন ওর মুখটাই থেঁতলে ছিল। ভালো ভাবে দেখতে পারিনি। রিপোর্টে এসেছে ওর চোখ দুটো উঠিয়ে ফেলা হয়েছে’
_কি বলছো? আহির স্তব্ধ।কেসটি আরো জটিল হয়ে গেল।
‘হ্যাঁ স্যার।
আহির আর কিছু বলল না। গভীর রাত,একটা মেয়ের চিৎকার, বন্ধ গুদামঘর, পরদিন সকালে একজন ছেলের নিথর দেহ পাওয়া যায়।আহির এর আগেও অনেক কেস সমাধান করেছে। মার্ডার কেস। তবে মিলন এর মার্ডারটি বেশ আশ্চর্যজনক।চোখ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। অরুণ বলল ‘স্যার,মিলন এর চোখ সাথেই ছিল।’

-এই বললে সাথে ছিল না, এখন বলছো সাথে ছিল!
-‘স্যার আমি বলতে চাইছি,চোখ তুলে নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু,যেদিন ওর লাশ পাওয়া যায়,লাশের পাশেই পড়ে ছিল। গ্রামের দারোগা তাই বলেছে।’
অরুণ চলে যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।আহির একটা টং দোকানে বসে চা চাইল দোকানির কাছে। ততক্ষণে সে একটা নোটবুক বের করল। কিছু লিখল।যেন হিসেব মেলাচ্ছে।আহির এর তখন মনে হল তাঁকে কেউ অনুসরণ করছে। ঘুরে তাকাল চারপাশে।হেলে পড়া সূর্যের দিক ঘুরে একজন দাঁড়িয়ে আছে।বেশ কিছুটা দূরে। তাঁর দৃষ্টি আহির এর দিকে।বেশ মোটাতাজা একজন লোক। সাথে একটি অশ্ব।আহির বিষ্ময়কর হয়ে গেল। নিশ্চয়ই ইনি সাধারণ কেউ নন, গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে অশ্ব থাকাটা অসম্ভব। এবং নেই।তবে ইনি কে?
আহির চায়ে চুমুক দিল। নোটবুক পকেটে রাখল। চা অর্ধেক পান করল। বাকিটা ফেলে দেয়।দোকানির পাওনা পরিশোধ করল। এরপর সেখান থেকে বের হয়। অনুসরণ করা লোকটি তাঁর অশ্বে চেপে বসল। সাথে তীলফলক।আহির কে লক্ষ্য করে একটা তীর ছুঁড়ে। তীরটা এসে মাটিতে বিদ্ধ হয়।আহির তীরটার কাছে গেল।তীরটির সাথে একটা চিরকুট।সে খুলে দেখল।তাতে লেখা ‘নিশিরপুর কবরস্থানে আসো। আমাকে অনুসরণ করে সোজা চলে আসো।’

লোকটির দিকে ঘুরে তাকালো।লোকটি গায়েব।আহির হকচকিয়ে গেল। এরপর সে তড়িঘড়ি করে অশ্ব পৃষ্ঠায় চেপে বসে।তাঁর সামনের দিকের পথে যেতে থাকে। নিশ্চয়ই লোকটি এই পথে গেছে।
অজানা পথ। চারপাশে শুধু গাছপালা। বাড়িঘর ও নেই। সুনসান।বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আহির থামল। তাঁর সামনে একটা কবরস্থান। নির্জন নিহারিকা জায়গাটা।এতটাই নিস্তব্ধ যে নিজের হৃদয় এর ধুকধুক শব্দ নিজের কানে এসে বিঁধছে।আহির চোখ তুলে তাকায় চারদিকে। কোথাও লোকটির ছায়া নেই।সে অশ্ব থেকে নেমে হেটে সামনে গেল। চারদিকে কবর। কবরগুলো লতাপাতায় পেঁচিয়ে গেছে।সামনে যেতেই আহির এর সামনে পড়ল সেই অচেনা লোকটি। মাথায় পাগড়ি।তবে মুখ খোলা। শ্যামবর্ণ এর গায়ের রং। বৃদ্ধা হবে লোকটিতবে বয়স আন্দাজ করা গেল না। লোকটার হাতে একটা মশাল

আহির জিজ্ঞেস করল “আপনি কে,আর এখানে কেন আমাকে আসতে বলেছেন?
লোকটি নিরুত্তর।আহির বিরক্ত স্বরে আবার জিজ্ঞেস করল “কি হল,জবাব দিচ্ছেন না কেন?
লোকটি তখন গম্ভীর মুখে বলল ‘এসো আমার সাথে।’ বলে একটি কবর এর দিকে গেল। দাঁড়াল কবরটির নিকট।
আহির বিমোহিত হয়ে বলল “কার কবর?
‘রশীদ তালুকদার এর।”
“কে উনি?আর আমাকেই বা এসব বলছেন কেন?
লোকটি বলল “এখানে রশীদ তালুকদার এর কবর। এবং ওনার বংশের অনেক এরই কবর।”

“তো?
“আমার প্রশ্ন হল , তাঁর কন্যা ফারদিনা কোথায়? তাঁর হবু স্বামী কোথায়? তাঁদের খোঁজ আজও কেন পাওয়া যায়নি?
আহির অবাক হল। “সেসব আমি কি করে জানব?
“তুমি জানো না।।তবে তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে।’
আহির এবার বিরক্ত হল। “অদ্ভুত। এদের সম্পর্কে তো আমি কিছুই জানি না। খোঁজ কিভাবে করব!?”
“এদের সম্পর্কে জানতে হলে তোমাকে দ্যা সাইলেন্ট ম্যানর’ বইটি পড়তে হবে।ঐ বইটিতে সব আছে।দেরি কর না যাও।বইটা পড়।আর এদের খুঁজে বের কর।”
আহির কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল “বইটি তো অনেক আগের। তখনকার কেউ তো বেঁচে নেই।”
“সেটা আমিও জানি।কেউ বেঁচে নেই।বেঁচে না থাক,লাশ তো থাকবে। আমার ওই লাশ ই চাই।”
“আপনি তা দিয়ে কি করবেন?
“সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আগামীকাল দেব। আগামীকাল দিঘীর পাড়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।আর আজ রাতের মধ্যে বইটা পড়।”

বলে লোকটি আহির এর হাতে মশাল টি ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়।
আহির ঘন্টা দুয়েক পর জমিদার বাড়িতে পৌঁছে যায়। ঠান্ডা জলে হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় বসে পড়ে। পাশেই একটা টেবিলের উপর দ্যা সাইলেন্ট ম্যানর’ বইটি রাখা।আহির এর দৃষ্টি গেল সেদিকে।বইটি হাতে নিল। তাঁর ঘরের দরজা খোলা ছিল।মীর ও রাফিদ উপস্থিত হল তাঁর ঘরে।তারাও চেয়ার টেনে বসে।
মীর বলল “তুই বইটি পড়বি নাকি?
আহির নিচু স্বরে বলল “পড়ে দেখি।কি আছে এতে”
“শব্দ করে পড়।আমরাও শুনি।” বলল রাফিদ।
আহির বইটির প্রথম পাতা উল্টিয়ে দেখল।প্রথম পৃষ্ঠা ফাঁকা। উৎসর্গ বলতে কিছুই নেই।এরপর দ্বিতীয় পৃষ্ঠা উল্টালো। সেখান থেকেই লেখা শুরু।আহির পড়তে শুরু করল।

১৮৭০ সাল।আকাশ এখনও পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। কুয়াশার আস্ত চাদরে ঢাকা ছিল আমিলনগর গ্রামের দিগন্ত। পুব দিকের গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো উঁকি দিচ্ছে। গ্রামের মানুষজন জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখা যায় এক বিশাল জমিদার বাড়ি।এরশাদ তালুকদার এর পূর্ব পুরুষদের গড়া বাড়িটি।
দোতলার বড় বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে আছেন জমিদার রশীদ তালুকদার। মাথায় সাদা পাগড়ি, পরনে হালকা ক্রিম রঙের ধুতি,পাঞ্জাবি, হাতে রূপার ছড়ি। বয়স এখন পঞ্চান্ন, কিন্তু চেহারায় বয়সের ক্লান্তি নয়, বরং রাজকীয় গাম্ভীর্য। তাঁর চোখে এক ধরনের হিসেবি দৃষ্টি,যেন প্রতিটি জিনিসের দাম জানেন, এমনকি মানুষেরও।
উঠোনে ব্যস্ততা তখন চরমে। দাসীরা গামছা হাতে জল টানছে, রাঁধুনী গরম দুধ বসাচ্ছে, আর একপাশে গৃহপরিচারক নাসির কাজের ফরমাশ নিচ্ছে।
তালুকদারের চার ছেলে।রায়ান তালুকদার, বড় ছেলে। কঠিন স্বভাবের, বাবার মতোই গম্ভীর। তাঁর কণ্ঠে আদেশ থাকে, কিন্তু সেই আদেশে যুক্তি থাকে না।থাকে কর্তৃত্ব।মেজো ছেলে আরিব তালুকদার। হিসেবি মন, কিন্তু মনটা নরম। জমির খাতা-খতিয়ান হাতে নিয়ে বসে থাকে প্রায়ই।আদিব তালুকদার, সেজো ছেলে, আগুনের মতো। নিজের কথা বলতে গিয়ে কখনো থেমে থাকে না। গ্রামীণ মানুষের পাশে থাকতে চায়, বাবার চোখে যেটা বড় অপরাধ।সায়েম তালুকদার, ছোট ছেলে, সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে। মিষ্টি হাসি, চঞ্চল স্বভাব। বড় ভাইদের ছায়ায় থেকেও নিজের দুনিয়া সাজাতে জানে।

আর তাঁদের একমাত্র বোন, ফারদিনা।এই বাড়ির রোশনাই। লালচে গোলাপী জামদানি পরে সে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।গত সপ্তাহখানেক হয় একুশ বছরে পা ফেলেছে। পুবের আলো পড়েছে তাঁর মুখে, মনে হয় যেন সকালের সূর্যটা তারই জন্য ওঠে প্রতিদিন।
এই সকালটা অন্য দিনের মতো নয়। বাড়ির ভেতর একটা অস্থিরতা ঘুরছে। খবর এসেছে।আজ রাজস্ব পরিদর্শক আসবে জমিদারির খাজনা দেখতে। গত বছর খরায় ফসল নষ্ট হয়েছে, অনেক গ্রামবাসী খাজনা দিতে পারেনি। এই নিয়ে তালুকদারের মন ভারী।
তালুকদার নিচে নামে।রায়ান নিচে এসে বাবাকে সালাম করল।
রশীদ বললেন,

“আজ খবর নিয়ো সবার, কে কতটুকু বকেয়া রেখেছে।”
আরিব মাথা নাড়ল, কিন্তু আদিব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর নিচু গলায় বলল,
“আব্বা, গ্রামবাসীরা তো এ বছর খুব কষ্টে আছে। অনেকের ঘরে চাল নেই। একটু সময় দিলে ক্ষতি হবে না।”
রশীদ মুখ তুলে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টি যেন তলোয়ার।
“রাজত্বে দয়া দেখালে রাজ্য টেকে না, আদিব। যারা খাজনা দিতে পারে না, তারা জমি রাখবে কেন?”
আদিব আর কিছু বলল না। সে জানত বাবার সামনে কথা বাড়ানো মানে অগ্নিতে ঘি ঢালা। তবুও ভিতরে ভিতরে কিছু একটা জ্বলে উঠছিল তার মধ্যে।

সেই সময় ফারদিনা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল। চোখে কৌতূহল আর মায়া। সে বলল,
“আব্বা, ওরা তো মানুষ, খাজনা দিতে না পারলে একটু ক্ষমা করতে পারেন না?”
রশীদ মেয়ের দিকে তাকালেন একটু কোমল চোখে, তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
“ জমিদারি শুধু রাজত্ব না, দায়িত্বও। রাজস্ব না দিলে আমার নিজেরই শাস্তি হবে। এই রাজনীতি তুই বুঝবি না।”
ফারদিনা চুপ করে গেল। তবুও তার চোখে একটা প্রশ্ন রয়ে গেল।মানুষের প্রতি দয়া কি তবে অপরাধ?
উঠোনে সায়েম ছোট ভাইদের সঙ্গে হাসতে হাসতে এল।সায়েম আদিব কে লক্ষ্য করে বলল “আদিব ভাই, তুমি আবার খাজনা নিয়ে ভাবছ! তুমি এসব না ভাবলে গ্রামের বিচারক হয়ে যেতে এতদিনে!”
সবাই হেসে উঠল, কিন্তু আদিবের মুখে হাসি ফুটল না।
দূর থেকে শিঙা বাজল।দরবার বসার সংকেত। দাসরা ছুটে এসে মঞ্চ সাজাতে লাগল। চেয়ার, টেবিল, পিড়ি, আর পাশে একপাশে জলভরা কলস।
দরবার বসলো পুরোনো আমগাছের তলায়। গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধা এসে দাঁড়াল, হাতে টাকাপয়সা আর চালের বস্তা। তাদের মুখে ভয়, চোখে আশা।
প্রথমে এল বুড়ো মজিদ মিয়া, পা কাঁপছে, হাতে দু’মণ চাল।

—“সাহেব, এইটুকুই পারলাম আনতে। আর কিছু বাকি নাই ঘরে।”
রশীদ ছড়ি ঠুকে বললেন,
—“চাল কম। নিয়মে চলতে হবে।” তাঁর যেন বরাবরই কড়া হিসেব।
আদিব এগিয়ে এল।
—“আব্বা, মজিদ মিয়া একা থাকে, ওর পুত্র মারা গেছে গত বছর। বাকি চালটা মাফ করে দিন।”
সবাই চুপ। বাতাস ভারী হয়ে গেল।
রশীদ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন,
—“ঠিক আছে, ওর এই বছরের খাজনা অর্ধেক মাফ।”
মজিদ চোখে জল নিয়ে বলল,
—“আল্লাহ আপনাকে সুখে রাখুক,তালুকদার সাহেব।”
আদিবের মুখে হালকা হাসি ফুটল। ফারদিনা বারান্দা থেকে দেখছিল দৃশ্যটা। তার চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি।
দরবার শেষে, বিকেলের দিকে সূর্য ডুবে যাচ্ছিল।বাড়ির ছায়া লম্বা হচ্ছিল মাঠে। ফারদিনা বাগানে বসে ফুল তুলছিল। বাতাসে গন্ধ ছড়াচ্ছে শিউলি ফুলের।
আদিব এসে পাশে দাঁড়াল।

—“তুই আবার ফুল তুলছিস?”
—“হুম,” ফারদিনা মৃদু হাসল, “ফুলে মন ভালো হয়। সকাল থেকে সবাই এত কড়া কড়া কথা বলছে, একটু শান্তি দরকার।”
আদিব বলল,
—“আমাদের এই বাড়িতে শান্তি নেই ফারদিনা, আছে শুধু হিসাব।”
ফারদিনা তাকাল ভাইয়ের দিকে, তারপর চুপচাপ ফুলের ঝুড়ি হাতে চলে গেল ভেতরে।
বাড়ির পুবের বারান্দা গুলোতে তখন হালকা আলো জ্বলছে। দূরে পুকুরের জলে প্রতিফলিত হচ্ছে বাড়ির ছায়া। বাতাসে একটা মৃদু সুর ভেসে আসছে।পুকুরঘাটে কেউ ভাটিয়ালি গাইছে, “মাঝি নাও ছাইড়া দে, রে… সময় তো আর নাই।”

রশীদ তালুকদার দোতলার জানালা থেকে নিচে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর মুখে এক ছায়াময় ভাব। তিনি জানেন,তার রাজত্ব এখনো টিকে আছে, কিন্তু মানুষের মন থেকে তিনি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন।
রাত নামছে, কুয়াশা নামছে বাড়ির ছাদে। আর সেই কুয়াশার ভেতর দিয়ে তালুকদার বাড়ি যেন এক রহস্যে ঢাকা।যেখানে রাজত্ব আছে, আছে ক্ষমতা, কিন্তু ভালোবাসা যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে কোথায় যেন।
ফারদিনা আয়নার সামনে বসে সাজ করছে।

সে আজ পরেছে হালকা গোলাপি রেশমের শাড়ি। পাড়ে সূক্ষ্ম সোনালি বর্ডার, যা চাঁদের আলোয় কোমলভাবে ঝলমল করছে। কাঁধে লেগেছে হালকা সাদা চাদর, যার ওপর সূক্ষ্ম ফুলের কাজ চোখে পড়ছে। হাতে সোনার ছোট কড়া, কানের দুলও ছোট, কিন্তু মাধুর্যে ভরা। পায়ে হালকা নীলাম, আর চুল খোলা।প্রকৃতির বাতাসে নরমভাবে দুলছে। সেই পোশাকই ফারদিনাকে মাঠের চাঁদের আলোয় আরও রহস্যময় ও সুন্দর দেখাচ্ছে।
আলিমনগরের রাতটা আজ রুপালি।চাঁদ যেন গাছের ডালে বসে, মাঠজুড়ে দুধে ভেজা আলো ঢালছে। দূরের নদী নিঃশব্দ, কেবল কোথাও কোথাও ব্যাঙের ডাক, আর তার মাঝখানে,একটা অচেনা বাঁশির সুর।
সেই সুরে এমন কিছু ছিল যা ফারদিনার বুকের গভীরে নাড়া দিল।জমিদার বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে সে অনেকক্ষণ শুনে রইল। মনে হচ্ছিল, বাঁশিটা যেন কারো নাম ধরে বাজছে।তারই নাম।
কে বাজাচ্ছে?

কোথা থেকে আসছে এই সুর? তাঁর মনে অনেক প্রশ্ন জমল।
সে জানে না। শুধু জানে, এই সুর তাকে ডাকছে।
চোখে এক চমক নিয়ে ফারদিনা আলতো করে দরজা খুলল।বাড়ির পেছনের দরজা।চাঁদের আলোয় পা টিপে টিপে নামল সিঁড়ি বেয়ে। বাতাসে বেলফুলের গন্ধ, পাখিরা ঘুমিয়ে আছে, আকাশে তারার ঢল।
বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে মাঠে এল সে। দূরে দেখা গেল,এক যুবক শিমুল গাছের নিচে বসে আছে।হাতে বাঁশি। মাথায় পাগড়ি।মুখে আলো পড়ছে না, শুধু চাঁদের আলোয় ভেসে উঠছে এক রহস্যময় ছায়া।
ফারদিনা গিয়ে থেমে গেল। হৃদস্পন্দন যেন বাঁশির সুরের সাথে তাল মেলাচ্ছে।
সে আস্তে বলল।

The Silent Manor part 7

“কে তুমি?”
বাঁশিওয়ালা তখনও কিছু বলল না।শুধু বাঁশি ঠোঁটে তুলে আরেক দফা সুর তুলল।সেই সুরে ছিল এমন এক শান্তি, এমন এক ডাক, যা ফারদিনাকে আকৃষ্ট করল।
ফারদিনা করুন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল “কে তুমি?
যুবকটি বলল ‘আমি রাখাল

The Silent Manor part 9

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here