The Silent Manor part 9
Dayna Imrose lucky
ফারদিনা দ্বিধা নিয়ে আরও একটু এগিয়ে এল। তার সারা শরীরে তখন চাঁদের আলোর শীতল স্পর্শ। রাখাল নামটা যেন তার কাছে পরিচিত নয়, অথচ তার বাঁশির সুর বড় আপন।
”রাখাল?” ফারদিনার কণ্ঠে কিছুটা বিস্ময়।“তুমি এই রাতে এখানে বাঁশি বাজাচ্ছ কেন? আর তোমার বাঁশির সুর,এমন কেন?”
রাখাল বাঁশি নামিয়ে রাখল, কিন্তু মাথা থেকে পাগড়িটা নামাল না। তার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত মায়াবী ছাপ। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের।সে ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকাল।ফারদিনার মনে হলো, এই চোখ সে আগেও কোথাও দেখেছে, যেখানে গভীর নদীর মতো নীরবতা আর বিশাল আকাশের মতো অপার শান্তি ছিল।
”বাঁশির সুর কেন এমন, তা আমি বলতে পারব না,” সুফিয়ান শান্ত স্বরে বলল, “তবে মন যখন কথা বলতে চায়, সে শব্দ করে না, সুর খোঁজে।আমার মন হয়তো আজ আপনাকে ডাকছিল।”
ফারদিনা চমকে গেল। “তুমি আমাকে চিনলে কী করে? তুমি তো, আমার নাম জানো না।”
রাখাল মৃদু হাসল। হাসিটা চাঁদের আলোর চেয়েও কোমল।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
”আপনার নামের প্রয়োজন হয়নি। যে মেয়ে বাবার কঠোর নিয়মের মাঝে দাঁড়িয়ে গ্রামের অসহায়দের জন্য দয়া চাইতে পারে,তার চোখ আর হাঁটার ধরন আলাদা হয় এবং দেখলেই বোঝা যায়। তা ছাড়া, এই জমিদার বংশের একমাত্র সাহসী কন্যা আপনি, আর কেউ এত রাতে সাহস করে চৌহদ্দি পেরোবে না।”
ফারদিনার মুখে এবার লজ্জার আর কৌতূহলের এক মিশ্রণ। সে চারপাশে একবার দেখে নিল।বাড়ির দিকটা এখনও ঘুমন্ত, কেবল কিছু ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।
”তুমি এখানে কতদিন ধরে আসছো?”
”আসা-যাওয়া অনেক দিনের। তবে সাহস করে আজই প্রথম শিমুল গাছের কাছে এসেছি,” রাখাল বলল।”আমি এই আলিমনগর গ্রামেরই ছেলে। সবাই আমাকে রাখাল বলেই ডাকে। আপনার ভাই আদিব তালুকদার এর সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। তাঁর কাছ থেকেই আপনার গল্প শুনেছি।মানুষের প্রতি আপনার মমতা আর এই কঠিন হিসাবের বাইরে একটা নরম মন আছে আপনার। এবং তাঁর ও।”
আদিবের নাম শুনে ফারদিনা খানিকটা স্বস্তি পেল। আদিবকে সে বিশ্বাস করে।
”আদিব ভাই! তুমি তাঁর বন্ধু?”
”বন্ধু নয়, তবে তাঁর আদর্শকে আমি সম্মান করি। আদিব সাহেব সত্যিই মানুষের বিচারক হতে পারতেন,” সুফিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“তুমি কি কর? ফারদিনা জিজ্ঞেস করল।
“আমি এই গ্রামেরই এক সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে।আমিও একজন রাখাল।আপনারাই আমাদের নিয়ন্তা।”
ফারদিনা বিষণ্ণ হয়ে বলল, “তাহলে তুমি এখানে এলে কেন? যদি কেউ দেখে ফেলে, তাহলে..” রাখাল জানে সে কি বলতে চাইছে।
”কেউ দেখবে না। আমি শুধু আপনাকে একটি কথা বলার জন্য এসেছি” ।সুফিয়ানের কণ্ঠস্বর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে উঠল।”আপনারা হয়তো জমিদার বাড়ির ভেতরে সুরক্ষিত, কিন্তু বাইরে এই গ্রামের মানুষদের রাত কাটে চরম আতঙ্কে।গত বছরের বকেয়া খাজনা নিয়ে তালুকদার সাহেবের কঠোরতা আরও বেড়েছে। মানুষ জমি হারানোর ভয়ে কাঁপছে।মজিদ মিয়ার অর্ধেক মাপ হলেও সবার ভাগ্যে তা জুটবে না।”
ফারদিনা বিষণ্ণ হয়ে বলল, “আমি সকালে আব্বা-কে বলেছিলাম, কিন্তু তিনি শোনেননি। তিনি বলেন, এটা রাজত্বের রাজনীতি”
”রাজনীতি নয়, রাজকুমারী, এটা নিয়ম ভাঙার অনিয়মতা।” সুফিয়ান দৃঢ় কণ্ঠে বলল। “যেখানে মানুষের পেটে চাল নেই, সেখানে নিয়মের দোহাই দেওয়া চলে না। আমাদের একমাত্র ভরসা এখন আপনার ভাই আদিব সাহেব। তিনিই হয়তো এই নিয়মের জালটা একটু হলেও আলগা করতে পারবেন।”
ফারদিনা বুঝতে পারল, এই বাঁশির সুর শুধু প্রেম বা শান্তি নিয়ে আসেনি, এ সুর এক বিদ্রোহের নীরব আহবান।যেন রাজকন্যা আর এক প্রজার মধ্যে এখন এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হয়েছে।যে সেতুর ভিত্তি হলো দয়া আর ন্যায়
ফারদিনা মাথা নিচু করে ভাবল। তার এই রাতের দুঃসাহসিক যাত্রা শুধু এক অচেনা যুবকের সাথে দেখা করা নয়, এটা তার অন্তরের মানবিকতার প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া।
”আমি বুঝতে পারছি” ফারদিনা ফিসফিস করে বলল। “কিন্তু আমি কী করতে পারি? আমার ক্ষমতা খুবই সীমিত।”
রাখাল তার হাতে থাকা বাঁশিটা আলতো করে ছুঁয়ে দিল।
”আপনি পারেন, রাজকুমারী। আপনার সীমিত ক্ষমতাও আমাদের কাছে আকাশের চাঁদের আলোর মতো। আপনার কণ্ঠস্বর স্নেহ হয়ে যখন আদিব সাহেবের কানে পৌঁছায়, তখন তা সাহস জোগায়। আমি এই কথা বলার জন্যই এসেছিলাম।শুধু চেয়েছিলাম,এই বাড়ির কর্তাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন একবার গ্রামের নীরব কষ্টটা দেখুক।”
কথাগুলো বলে রাখাল হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সে আর এক মুহূর্তও নষ্ট করতে চাইল না, যেন তার আসার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে।
”আমাকে এবার যেতে হবে। আর কখনো এই রাতে আসবেন না, রাজকুমারী। এটা আপনার জন্য নিরাপদ নয়”
”দাঁড়াও” ফারদিনা দ্রুত বলল।”আমি.. আমি তোমার বাঁশির সুর শুনতে চাই!আর একবার সুর তোলো। আমার জন্য।”
রাখাল কিছু না বলে তার কপাল থেকে পাগড়িটা আরও একটু নিচে টেনে দিল। তারপর বাঁশিটি ঠোঁটে তুলে ধরল। এইবার সুরটা আগের চেয়েও করুণ, গভীর এবং আরও বেশি অস্থির। সুরটি যেন এক গোপন প্রতিশ্রুতি।আদিব এবং ফারদিনা, দুই ভাইবোন যেন গ্রামের মানুষের জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করে।তারই যেন ইঙ্গিত।
চাঁদের আলোয় শিমুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে সুফিয়ান যখন বাঁশি বাজাচ্ছিল, তখন ফারদিনার মনে হল ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে কেউ আসছে।ফারদিনা ভাবতে না ভাবতেই আড়াল থেকে বিদ্যুতের মতো ছিটকে এলো কালো পোশাক পরা, মুখোশধারী একদল শত্রু। তারা ফারদিনাকে লক্ষ্য করে ধারালো অস্ত্র উঁচিয়ে এগিয়ে এলো।
ফারদিনা হতচকিত হয়ে এক পা পিছিয়ে গেল। কিন্তু রাখাল এক মুহূর্তও নষ্ট করল না। তার বলিষ্ঠ হাতটি বিদ্যুদ্বেগে ফারদিনার কোমরের চারপাশে আলতো করে জড়িয়ে ধরল এবং তাকে নিজের পেছনে ঢাল হিসেবে টেনে নিল। শত্রুদের প্রথম আক্রমণটি বাতাসের গতিতে ব্যর্থ হলো।
”ভয় পাবেন না” শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল রাখাল। এই তীব্র উত্তেজনার মাঝেও তার কণ্ঠস্বরে যেন এক অদ্ভুত আশ্বাস।
এরপর শুরু হলো লড়াই। তবে এ লড়াই শুধু শত্রুকে হারাবার জন্য নয়, এ যেন তার গ্রামের মানুষকে রক্ষা করার এক কাব্যিক নৃত্য। রাখাল বাম হাতে ফারদিনাকে নিজের সাথে শক্ত করে ধরে রাখল, শত্রুর প্রতিটি আঘাত থেকে তাকে আড়াল করল। ফারদিনা রাখালের পিঠে হেলান দিয়ে ছিল, তার হৃদস্পন্দন স্পষ্ট অনুভব করছিল।যা ভয়ের চেয়েও বেশি ছিল এক অদ্ভুদ শিহরণ।
রাখাল যখনই কোনো শত্রুকে পাল্টা আঘাত করে, তখন তার শরীর ফারদিনার শরীরের সঙ্গে ঘষা খায়। প্রতিটি মোচড় যেন এক আবেশ। শত্রুদের একজনের দিকে সে যখন লাথি ছুঁড়ল, তার কোমর বেঁকে গেল।আর ঠিক সেই মুহূর্তে ফারদিনার হাত রাখালের বুকের পেশিতে আলতোভাবে ছুঁয়ে গেল। এই স্পর্শে রাখালের মনোযোগ একটুও নড়ল না, বরং এক নতুন শক্তি পেল। প্রতিপক্ষের অস্ত্র যখন তাদের দিকে ধেয়ে আসে, রাখাল তখন এমনভাবে ঘুরে যায় যাতে সে এবং ফারদিনা, দুজনেই যেন এক সুতায় বাঁধা। সে ফারদিনাকে ধরে কখনো শূন্যে লাফিয়ে ওঠে, আবার কখনো বা মাটিতে নিচু হয়ে যায়। এটি যেন মৃত্যুভয়কে জয় করা দুই মানুষের এক নিবিড় আলিঙ্গন।
এক সময় শত্রুদল পিছু হটে গেল, রাখালের অপ্রতিরোধ্য প্রতিরোধ তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। তাদের বুক এখনো উত্তেজনায় কাঁপছে।লড়াই শেষ। ফারদিনার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল রাখাল, সেখানে নেই কোনো ভয়।আছে শুধু এক গভীর মুগ্ধতা। রাখাল আলতো করে ফারদিনার গাল ছুয়ে দিল।ফারদিনা দূরে সরে বলল “কি করছো?
“গালে রক্ত ছিটে পড়েছে।মুছে দিচ্ছিলাম”
ফারদিনা মোহময় কন্ঠে বলল “ওরা কাকে আক্রমণ করতে এসেছিল?”
“আপনাকে রাজকুমারি।”
রাখাল মাথা থেকে পাগড়িটা খুলল। ধীরস্থির কন্ঠে বলল “আমার কি আছে,যে আমাকে আক্রমন করবে’ শুনুন রাজকুমারী, গরীবের শত্রু হয় না।”
ফারদিনা দেখল রাখাল কে। তাঁর লড়াই করা দেখে সে আরো মুগ্ধ হল তাঁর প্রতি। বাবরি চুল তাঁর। চুলটা খোলা। পাগড়িটা পুনরায় বেঁধে নিল। “আমি চলি রাজকুমারী”
ফারদিনা বলল “আমাকে রাজকুমারী রাজকুমারী বল না।ফারদিনা ডাকতে পারো।”
“সে অধিকার আমার নেই।”
“আজ থেকে আমি তোমাকে অধিকার দিলাম। আমার অনুরোধ, আমাকে নাম ধরে ডাকবে।”
রাখাল কিছু বলল না। তাঁর বাশিটার যত্ন নিল।
“আচ্ছা, তুমি বুঝলে কিভাবে, এত রাতে বাঁশি বাজালে আমি নিশ্চয়ই আসব? ফারদিনার যেন বিচক্ষণ প্রশ্ন।
রাখাল কোমল কন্ঠে হেসে বলল “কোন সুর একজন রাজকুমারী কে আকৃষ্ট করতে পারে,তা একজন বাঁশিওয়ালা ঠিকই জানে।”
ফারদিনা একটু বিরক্ত নিয়ে বলল “দেখো, আমাদের জমিদার বাড়িটি একসময় প্রাসাদ ছিল।কোন সময়ে ছিল,আমি তা বলতে পারব না।আমি হয়ত তখন দুনিয়াতেই ছিলাম না।আর এখন এটা জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত।আমরা জমিদার। আমার বাবা একজন জমিদার।রাজা নন। জমিদার এর মেয়েরা রাজকুমারী হয়।আমি রাজকুমারী নই”
রাখাল এবার ঢং করে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল “তাঁর মানে আপনি রাজকুমারী নন।আর এই প্রাসাদটি যেহেতু রাজাদের ছিল, এখন আর তারা নেই।সেই সুযোগে আপনারা দখল করে নিয়েছেন।” রাখাল থেমে গেল। “এটাকে বলে রাজনীতি।তাদের রাজ্য কারা দখল করে নিয়েছেন।” ফারদিনা কিচ্ছুটি বলল না।সে জানে। রাখাল যেটি বলেছে,তা বাস্তব।
রাত বাড়ছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। চাঁদের আলো এসে পড়ছে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে।সাথে মৃদু দমকা বাতাস।
ফারদিনা বাড়ির দিকে একবার তাকালো।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহারাদারদের ছায়া।
“আমি চলি।” রাখাল বলল।
“শোনো, তোমার নাম কি ?
“সুফিয়ান।”
“তোমার কথা শোনে শিক্ষিত মনে হল। পড়ালেখা করেছো?
“শুদ্ধ ভাষায় কথা বললেই শিক্ষিত হয় না। চেষ্টা করলেই হয়ে যায়।”
“এখন কোথায় যাবে?
“বাড়ি ফিরতে হবে।”
“আগামীকাল সন্ধ্যায় তুমি এখানে এসো।আমি শিমুল গাছের নিচে অপেক্ষা করব।আর আমার আগে তুমি আসলে বাঁশি বাজিও। তাহলেই বুঝব তুমি এসেছো!”
“সন্ধ্যায় গ্রামের মানুষ আনাগোনা করে।আর সন্ধ্যার পরে এখানকার মেয়েদের বাইরে বের হওয়া নিষেধ। এরপর যদি দেখে ফেলে কোন পুরুষের সাথে তবে তো শাস্তি পেতে হবে।”
ফারদিনা ভেবে বলল “তাহলে রাত বাড়লে আসবে।যখন সবাই যে যার ঘরে চলে যায়।”
“কিন্তু আমি আসব কেন?
“আমি খাজনার ব্যাপারে আব্বার সাথে কথা বলব।আদিব ভাই এর সাথে কথা বলব। ওনারা কি সিদ্ধান্ত জানায় সেটা তোমাকে জানাতে হবে না”! বলে থামতেই ফারদিনার চোখ পড়ে তাদের বাড়ির পাশের সরু পথের দিকে।কেউ অশ্ব চেপে বাড়ির দিকেই যাচ্ছে।বাড়ির সামনে এসে অশ্ব রেখে দেয়।ফারদিনা ও সুফিয়ান দৃষ্টটি দেখে সেদিকে এগোলো আড়ালে থেকে। সুফিয়ান বলল “আদিব ভাই হয়ত”
“হয়ত না, সে-ই। কিন্তু ভাইয়া এত রাতে কোথায় গিয়েছিল,আর কিসের জন্য?
“হয়ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল।” বলল সুফিয়ান।
আদিব উশখুশ হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে একজন অনুচারীকে কিছু দিল। এরপর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। ফারদিনা বলল “ভাইয়া ভয় পেয়ে আছে কেন? আব্বার জন্য নাকি অন্য কারণ’
সুফিয়ান আদিবের দিকে চেয়েই রইল।ফারদিনার পাশেই সে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ানো। দু’জনের মুখমণ্ডল পাশাপাশি।ফারদিনা কোমল দৃষ্টিতে সুফিয়ান কে দেখল। চাঁদের আলোয় সুফিয়ান এর চোখ দুটো যেন ছলছল করছে। মায়াবিও দেখাচ্ছে বটে।
সুফিয়ান আদিবের ধ্যান ছেড়ে বলল “আমার যেতে হবে।আজ চলি”
ফারদিনা বলল “আগামীকাল কিন্তু আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।”
“আমার সুযোগ হলে আসব।” বলে সুফিয়ান চলে যায়।চাঁদের আলো ধরে পথ চলতে শুরু করল সে। যেতে যেতে কুয়াশায় হারিয়ে গেল সে।ফারদিনা চেয়ে রইল। যতক্ষণ না হারিয়ে গেল তাঁর ছায়া।
রাতের নরম আঁধারে ফারদিনা ঘরে ফিরল।চাঁদের আলো জানালা বেয়ে ঘরে ঢুকছে, পর্দার ফাঁক দিয়ে বাতাস ঢেউ খেলছে। চারদিকে মশাল এর আলো ছড়িয়ে আছে। সোনালী আলোয় আবৃত্ত চারদিক।
ফারদিনার টেবিলের ওপর যেন কিছু ঝিলমিল করছে।এক টুকরো কাপড়ে মোড়ানো কাগজ।ফারদিনা কৌতূহলভরে সেটা খুলে দেখল।কিছু অক্ষর, অচেনা অথচ ভয়াবহ ভাবে স্পষ্ট—“যার ওপর ভরসা রাখছো, সে-ই তোমার সবচেয়ে বড় বিপদ।”
মুহূর্তে তার বুকের ভেতর এক ঠান্ডা শীতলতা নেমে এল।কে লিখল এই কথা?বাড়ির কেউ? নাকি অন্য কেউ?’যে অন্ধকারের ভিতর থেকেও তার নিঃশব্দ ভয়গুলো চিনে ফেলেছে?ফারদিনা চিরকুটটি রেখে দিল খাটের নিচে।
বাইরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ভেসে এল, যেন অজানা কাউকে তাড়াচ্ছে।জানালার পাশে ছায়া নড়ে উঠল একবার।ফারদিনা চমকে উঠে জানালা বন্ধ করে দিল। তখন অদৃশ্য ভাবে যেন একটি কন্ঠস্বর ভেসে এলো “যাকে তুমি নির্ভরতা ভাবো, সেই হয়তো তোমার পতনের শুরু।” ফারদিনা কম্পিত কন্ঠে ফিসফিস করে বলল “চিরকুট এর ভয়ের জন্য এরকম হচ্ছে। কিন্তু ওটা দিল কে!”
ফারদিনা শুতে যাবে। বিছানা ঠিক করল।ঠিক তখনি তাঁর ঘরের বাইরে থেকে মনে হল কেউ দৌড়ে গেল।ফারদিনা হাত থেকে বালিশ টা রেখে দিল।এরপর সতর্কে তাঁর ঘরের দরজাটা হাট করে খুলল। কিছু অনুচারী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে তৃতীয় তলার দিকে যাচ্ছে।ফারদিনার খটকা লাগলো। কৌশলে সেও অনুসরণ করল।
বাড়ির তৃতীয় তলায় সচরাচর কেউ যায় না। অর্থাৎ যেতে দেওয়া হয় না কাউকে।সবসময় অনুচারীগন পাহারা দেয়। রশীদ তালুকদার এর কড়া নির্দেশ,বাড়ির কেউ কেঁদে মরে গেলেও যেন তৃতীয় তলায় কখনো না যেতে পারে। কিন্তু আজ ফারদিনা যেতে যেতে দেখল কোন পাহারাদার নেই।
পুরানো প্রাসাদ ঘিরে বর্তমান জমিদার বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে।প্রাসাদ শব্দটি এখান থেকেও বিলিন হয়ে গেলেও প্রাসাদের ভেতরে অলিগলি পরিবর্তন হয়নি।এটি এমন একটি প্রাসাদ ছিল যার এক প্রান্ত থেকে ভেতরে প্রবেশ করলে সে রাস্তা হারিয়ে ফেলত।শত্রুদের শেষ করার জন্য প্রাসাদের ভেতরেই বিপদজনক পথ তৈরি করে রাখা হয়েছিল। শত্রুরা পথ হারিয়ে যখন ছোটাছুটি করবে তখন গরম তেলের মধ্যে পড়ে যেত।এটা একটা ফাঁদ ছিল। কিছু পথ অন্ধকার।এতটাই অন্ধকার যে এখানে শত্রুরা পৌঁছালে নিজেদের মধ্যে নিজেরা খুনাখুনি শুরু করে দিবে।এর কারণ, শত্রুদল মনে করবে প্রাসাদের কোন রক্ষীতা বোধদয় তাঁদের আক্রমণ করেছে।
ফারদিনা মুখে একটা চাদর পেঁচিয়ে তৃতীয় তলার সরু পথে এগোচ্ছে। চারদিকে পাথরের দেয়াল।তবে এই পথ অন্ধকার নয়, মশাল জ্বলছে দেয়ালে দেয়ালে।ফারদিনার ভয় ও করছে। পাথরের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে একটা গোপন ঘরের দিকে নজর পড়ল।ওখানেই সমস্ত অনুচারীগন ঘেরাও করে রেখেছে কিছু একটা।ফারদিনা কৌশলে ঘরটির পাশে গেল।
ঘরটিতে আরিব,রায়ান এবং সায়েম উপস্থিত। একজন অচেনা লোককে অনুচারীরা পাকড়াও করে ধরে রেখেছে।লোকটির চোখে মুখে আতংকের ছাপ। তাঁর মুখে কালো মুখোশ পড়া।পাশে একটা পাথরের ঢাকানার মত।রায়ান তখন অনুচারীদের আদেশ দিল “ওর মুখোশ খুলে ফেল।এরপর কুপের ঢাকনা সরিয়ে ফেল।” রায়ান এর কন্ঠে যেন গর্জন।অনুচারীগন তাই করল। প্রথমে লোকটির মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলল। এরপর কুপের ঢাকনা সরিয়ে ফেলল। কুপের মধ্যে কুমিরের মাথা দেখা গেল।ওঁরা যেন মানুষের দেহ চাইছে। প্রচন্ড খিদে।ফারদিনা ভয়ে চুপসে গেল এরকম দৃশ্য দেখে।
আরিব বলল “চাপাতি দে।আজ ও হবে কুমিরের খাবার।” বলে দাঁত বের করে হেসে উঠল।সায়েম তখন আরো খুশির সঙ্গে বলল “আদিব ভাই থাকলে নিশ্চয়ই দয়া দেখাতেন।” এরপর আবার ও হেসে উঠল। ওঁরা যেন খুব আনন্দ পাচ্ছে।
ফারদিনার চোখে দেখা এটাই যেন সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্য।যা আগে কখনো দেখেনি সে। কিন্তু অসহায় লোকটির প্রান ওরা কেন কেড়ে নিতে চাইছে?কি অন্যায় তাঁর?ফারদিনার খুব ইচ্ছে করছে অসহায় লোকটিকে বাঁচাতে। কিন্তু তা অসম্ভব।
সায়েম বলল “ভাই,আগে ওর হাত কেটে কুমির কে দাও। এরপর পা। এরপর মুন্ডু দিলেই হবে।” বলে আবার হাসল। রাতের ভয়াবহ রুপ যেন তাদের।দিনে তাঁরা রশীদ এর সামনে এমন ভাবে থাকে যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না।নাকি রশীদ ও জানেন এসব? ফারদিনার ভেতরে প্রশ্ন জমল।
রায়ান তখন হাতে একটা চাপাতি নিয়ে এগিয়ে আসল লোকটির দিকে।অনুচারী কে বলল “ওর দু হাত দুদিকে টেনে ধর। ছোট্ট ভাই আবদার করেছে,যাতে ওর হাত আগে কাটি।এটা তো মানতেই হবে।তাই না’ কথাটা শুনে সায়েম মনের সুখে হেসে উঠলো।
ফারদিনা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখল।অচেনা লোকটি ভয়ে কাতরাচ্ছে।বয়স হবে আনুমানিক পঁয়তাল্লিশ। মোটাতাজা শরীর তাঁর। ভয়ের ছাপ তাঁর দু চোখে নেমে এসেছে। কিন্তু লোকটি কিছু বলতে পারছে না।রায়ান এর কোন মায়া হল না ওর জন্য।সে চাপাতির কোপে লোকটির একটা হাত ছিনিয়ে নিল।লোকটি তখন তির্যক চিৎকার করল।যন্ত্রণায় ছটফট করতে শুরু করলো।ফারদিনা তাঁর মুখ চেপে ধরল।তাঁর চোখে ভয়,আতঙ্ক।
The Silent Manor part 8
রায়ান হাতটি নিয়ে কুমিরের দিকে ছুড়ে দিল। এরপর লোকটির অপর হাতটি কাটল।লোকটি তখন নিচে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে শুরু করলো।আরিব তখন বলল ‘ওকে আর চাপাতির আঘাত করিস না। কষ্ট হচ্ছে। তাঁর চেয়ে কুমিরের মুখে দিয়ে দে। ওঁরা খাক।তাজা মানুষ।” কথাটি শুনে সায়েম হেসে উঠল।
