অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২২

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২২
ইরিন নাজ

কেক কাঁটা, খাওয়াদাওয়া শেষে বড়রা সবাই নিজেদের রুমে ফিরেছে। আজ সবাই আদ্রিশদের বাড়িতেই থাকবে। অনামিকা বেগম এবং মাহমুদ সাহেব ফিরতে চাইলেও ফিরতে দেয় নি আদ্রিশ। এক প্রকার বাধ্য হয়েই থেকে যেতে হয়েছে উনাদের। দ্বীপ, মিথি এবং রিয়াও আজ এ বাড়িতে থাকবে। ওদের বাবা-মায়ের কাছ থেকেও অনুমতি নিয়ে এসেছে আদ্রিশ।
রাত যথেষ্ট হয়েছে। বড়রা সবাই রুমে চলে গেলেও বাকিরা সবাই চলে এসেছে ছাদে। তারা প্ল্যান করেছে বেশ রাত পর্যন্ত আড্ডা দিবে আজ, গল্পসল্প করবে। পরিকল্পনামাফিক গোল হয়ে বসেছে সবাই। আদ্রিশদের বাড়ির ছাদের এক সাইডের একটি অংশে ছাদ বানানো আছে, অর্থাৎ চারপাশ খোলা হলেও উপরে ছাদ দেয়া আছে। তাই এখানে বসে অনায়াসে বৃষ্টি উপভোগ করা সম্ভব। সেখানেই আজ বসেছে সবাই। এখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শীতল হাওয়া বইছে। পরিবেশ টা দারুণ। সবাই এই দারুণ পরিবেশ উপভোগ করতে করতে নানান গল্প করছে। গল্পের এক পর্যায়ে আদ্রিশ-আয়ানা এবং আহিল-মীরার বিয়ের কথা উঠে আসলো। হুট করে আয়ানা বেশ সিরিয়াস কণ্ঠে আহিল কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

— ভাইয়া, একটা প্রশ্ন করি?
আদ্রিশ তাকিয়েই ছিলো আয়ানার দিকে। হুট করে আয়ানা কে এতো সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়লো তার। বাকি সবাই ও কথা বলা থামিয়ে আয়ানা এবং আহিলের দিকে মনোযোগ দিলো। আহিল সামান্য হেসে বললো,
— অবশ্যই। অনুমতি নেয়ার কি আছে?
আয়ানা এক পলক আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে ফের আহিলের দিকে তাকাল এবং বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— ভাইয়া, আপনার আর আপুর বিয়ের দিন আম্মু কেনো হুট করে আমার আর উনার বিয়ের শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন? কেনো এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন যে আমার সাথে উনার বিয়ে না হলে আপুর ও আপনার সাথে বিয়ে হবে না? আমাকে তো আম্মু তখন চিনতেন ও না। আর আম্মু কে আমি এতদিনে যতটুকু চিনেছি, উনি এমন ব্ল্যাকমেইল করার মতো মানুষ নন। যদি করেন ও, নিশ্চয়ই কোনো কারণে করবেন। তবে সেই কারণ টা কি? সেই কারণ টা আমি আজও জানতে পারি নি। এমনকি উনিও জানেন না যে সেদিন আম্মু কেনো এমন করেছিলেন! আম্মু উনাকে এতটুকুই বলেছেন যে মেয়ে পছন্দ হয়েছে তাই এমনটা করেছেন। কিন্তু আমার কেনো যেনো মনে হয় অন্য কোনো ব্যাপার ছিলো এবং আপনি সেই ব্যাপারে সবকিছু জানেন। জেনে থাকলে প্লিজ বলুন, ভাইয়া।
আয়ানার প্রশ্নে সকলেই কৌতূহলী হলো। আহিল তার পাশে বসা মীরার দিকে তাকাতেই মীরা চোখের ইশারায় যেনো কিছু একটা বুঝালো। আহিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

— আমার আর মীরার যে লাভ ম্যারেজ, সেই ব্যাপারে জানো হয়তো। আই ডোন্ট নো অ্যাকচুয়ালি। তো যাই হোক, সেখান থেকেই বলি। আমি, মীরা একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট। মীরা আমার জুনিয়র। একটা প্রোগ্রামে আমাদের প্রথমবার দেখা হয়েছিল। সেখান থেকেই পরিচয় এবং পরবর্তীতে প্রেম। এরপর আমার পড়াশোনা শেষ হলো, কোম্পানিতে জয়েন করলাম। তাই পরিবারের সবাইকে মীরার ব্যাপারে জানালাম। কেউই অমত করে নি। তারা বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে প্রস্তুত। কিন্তু বাঁধা দিলো মীরা। কারণ ও তোমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিলো। ওর আমার সাথে বিয়ে হয়ে গেলে ও তো ভালো থাকবে, কিন্তু তোমার কি হবে! ও জানতো যে ফুপি তোমাকে একদম ই পছন্দ করে না, তোমার সাথে কিছু ভালো হোক সেটাও চায় না। সে সুযোগ পেলে আব্বু কে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে তোমাকে যার তার হাতে তুলে দিবে। এমনিতেই ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট সহ্য করে বড় হয়েছো তুমি।

ও কোনোমতেই চাচ্ছিলো না তোমার বাকি জীবনটাও কষ্টে কাটুক। তাই ও আমাকে আরেকটু অপেক্ষা করতে বলে যাতে তোমার একটা ব্যবস্থা করতে পারে। আমি তোমার সম্পর্কে সবটাই জানতাম। ও আমাকে সবসময়ই তোমার কথা বলতো। তাই ওর চিন্তা আমি বুঝতে পারছিলাম। তারপর আর কি! অপেক্ষা করতে লাগলাম। এরমাঝেই ওর জন্য দুটো বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। দুটো ছেলেই ভালো ছিলো। কিন্তু ও তো আমি ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না। তাই ও প্ল্যান করে যে ওর জন্য আনা কোনো পাত্রর সাথে তোমার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে। পাত্রদের সাথে একান্তে কথা বলার সুযোগ হলে ও জানিয়ে দিতো যে ও একজন কে পছন্দ করে এবং তারা চাইলে তোমাকে বিয়ে করতে পারে। তুমি যেহেতু কোনো অংশে কম নও তাই পাত্ররাও রাজী হয়েছিল। কিন্তু মীরার প্ল্যান যেনো উল্টো কাজ করতে শুরু করে। ফুপি, আব্বুকে পাত্রদের প্রস্তাবে রাজী হতে দেয়া তো দূর, আরও এই সুযোগে বুঝিয়ে দেয় যে তোমার জন্যই মীরার বিয়ে হচ্ছে না। তোমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পাত্ররা মীরা কে বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না, তোমাকে বিয়ে করতে চাইছে।

ফলে তুমি আব্বুর চক্ষুশূল এ পরিণত হও। আব্বু এবং ফুপি তোমার সাথে আরও খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করে। মীরা মন খারাপ করে আমাকে এসব বিষয়ে জানাতো। মাঝে মাঝে কাঁদতোও, তোমার সাথে উনারা এতো খারাপ ব্যবহার করছে তাই। তোমার সাথে কখনো সামনাসামনি দেখা না হলেও তোমাকে পিকে দেখেছিলাম। তোমাকে আমি নিজের ছোট বোন ই মনে করতাম। তোমার উপর এত অন্যায়, অত্যাচার আমিও মানতে পারছিলাম না। তাই শেষমেষ সিদ্ধান্ত নেই যে আমিই কোনো একটা ব্যবস্থা করবো। এদিকে বাসা থেকেও সবাই তাড়া দিচ্ছিলো। কেনো এখনো প্রস্তাব পাঠাতে দিচ্ছি না সেই বিষয়ে জানতে চাচ্ছিলো। তাই আমি তাদের সবটা জানিয়ে দেই। তোমার সম্পর্কে জেনে বড় মা হুট করেই বলে বসেন যে উনি তোমাকে আদ্রিশ ভাইয়ার বউ করবেন। আমরা সবাই ভীষণ চমকে গিয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু কারোর ই আপত্তি ছিলো না।

মীরা কে যখন এই কথা জানাই সে যে কি খুশি হয়েছিল! পরবর্তীতে আমি মীরার কাছ থেকে তোমার একটা পিক নিয়ে সবাইকে দেখাই। সবারই তোমাকে ভীষণ পছন্দ হয়। কিন্তু আদ্রিশ ভাইয়া জানতো না তার পিছে পিছে এসব চলছে। আসলে ভাইয়ার বিয়ের প্রতি কোনো ইন্টারেস্টে ছিলো না তখন। তাকে বিয়ের কথা বলা হলেই সে এড়িয়ে যেতো। তোমার সাথে বিয়ের কথা বললেও হয়তো এড়িয়ে যেতো। আবার ভাইয়ার জন্য তোমাকে চাইলে ফুপিও কোনো না কোনো ঝামেলা করতো। তাই আমরা সবাই মিলে প্ল্যান করি আগে আমার আর মীরার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। তারপর বিয়ের দিন বেঁকে বসবো। শর্ত দিবো তোমার সাথে ভাইয়ার বিয়ে না দিলে মীরার আর আমার বিয়ে ক্যানসেল। তখন মীরার সম্মানের কথা চিন্তা করে হলেও আব্বু ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে দিতে বাধ্য হবে। আর ফুপিও সেই সময়ে কিছু করতে পারবে না। হলোও ঠিক তাই।

শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসতেই আব্বু রাজী হয়ে গেলো। বড় মা ও ভাইয়া কে রাজী করিয়ে ফেললো। ভাইয়া, বড় মা এর মন এবং কথার মান রাখতে শেষ মুহূর্তে এক প্রকার বাধ্য হয়েই সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা তোমাকে বিয়ে করলো। এতটুকু বিশ্বাস আমাদের ভাইয়ার উপর ছিলো যে আর যাই হোক, সে তোমাকে কখনো হার্ট করবে না। তবে মনের মাঝে কিছুটা ভয় ও ছিলো যে ভাইয়া তোমাকে মানবে কিনা, ভালোবাসবে কিনা, আমরা তোমার আর ভাইয়ার লাইফ নষ্ট করে দিলাম কিনা! এই সবকিছু তোমরা দুজন বাদে আমরা সবাই জানি। ভাইয়া কে আমরা শুরুতেই তোমার সম্পর্কে সবটা জানিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বড় মা নিষেধ করেছিলো। সে চায় নি ভাইয়া তোমার অতীত জেনে তোমার উপর দয়া বা করুণা দেখাক। সে চাইছিলো আগে তোমরা একে অপরকে কমপ্লিটলি মেনে নাও, তোমাদের মধ্যে একটা শক্তপোক্ত বন্ডিং হোক, তোমাদের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক টা তৈরি হোক। তারপর তুমি নিজেই নিজের সম্পর্কে ভাইয়া কে সবটা জানাবে। এইতো, এটাই ছিলো তোমাদের অজানা ঘটনা। যা আজ জানিয়ে দিলাম।

স্তব্ধ হয়ে পুরোটা সময় আহিলের কথা শুনলো সবাই। আহিল থামতেই ছলছল চোখে পাশে বসা মীরার পানে চাইলো আয়ানা। মিনিট দুই যেতেই মীরা কে জাপটে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে। এই অশ্রু কষ্টের নয়, বরং কৃতজ্ঞতার এবং আনন্দের। মীরার জন্য আজ সে এত সুখে আছে, ভালো আছে। সে সবসময় ভাবতো মীরা তাকে পছন্দ করে না, ভালোবাসে না। অথচ এই মীরাই তার জন্য আড়ালে এতকিছু করেছে, কিন্তু কখনো বুঝতে দেয় নি।
আয়ানা কে এভাবে কাঁদতে দেখে মীরার ও চোখে জল চলে আসলো। সে আয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
— পাগলী মেয়ে, কাঁদছিস কেনো এভাবে?
আয়ানা ফুঁপাতে ফুঁপাতে ভগ্ন স্বরে বললো,

— আমি ভীষণ ভাগ্যবতী আপু। কারণ আমি তোমার মতো একটা বড় বোন পেয়েছি। এমন একটা বড় বোন আমার আছে যে সবসময় আমার ভালোর কথা চিন্তা করে। যার জন্য আমি আজ এতো ভালো আছি।
মীরা, বুকে থাকা আয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলো। চোখের পানি মুছিয়ে দুই গালে হাত রেখে আদুরে কণ্ঠে বললো,

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২১

— আমার একটামাত্র আদুরে বাচ্চা বোন তুই। তোকে নিয়ে চিন্তা করবো না তো কাকে নিয়ে করবো, হুম!
আয়ানা কান্নার মাঝে হেসে ফেললো। পুনরায় মীরা কে জড়িয়ে ধরলো সে। মীরাও শক্ত করে আয়ানা কে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রাখলো। ওদের মধ্যকার বন্ডিং দেখে মুগ্ধ হলো সবাই। খুশি হলো আয়ানার প্রতি মীরার দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা সম্পর্কে জেনে।

অতঃপর প্রেমের আগমন সিজন ২ পর্ব ২৩