অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৫০
লিজা মনি
রাতের আঁধার ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে দিগন্ত রেখা ছুঁয়ে। প্রকৃতি নিজ হাতে আঁকা এক নিঃশব্দ ক্যানভাস যেখানে রং নেই, শব্দ নেই, শুধু আছে এক রূপালী আবেশ। আকাশের বুকজুড়ে ধূসর নীল মেঘেরা চুপচাপ ভেসে বেড়ায়। তাদের গায়ে লেগে থাকে একটুকরো হালকা রৌদ্রের সোনালি ধুলো। রাতের তুষার গলে গলে আলো হয়ে উঠছে। এই আলো রুক্ষ নয়, দৃষ্টিনন্দন নয়, বরং কোমল, ধীর আর সংযত। যেমন হয় একজন স্নেহময় মায়ের চোখ।
আলোর সেই প্রথম ছোঁয়ায় ভিজে ওঠে ঘাসের ডগাগুলো। শিশির কণারা রূপার বিন্দু হয়ে জমে আছে প্রতিটি পাতা ও প্রতিটি শস্যদানে। হঠাৎ করে এক হাওয়া বয়ে যায় মাঠজুড়ে আর সেই কণাগুলো কাঁপে অথবা ছলকে পড়ে যায় মাটিতে।ঠিক যেমন কোন বালিকার চোখে জমে থাকা স্বপ্ন আচমকা কারো কথা শুনে কেঁপে উঠে।
পাখিরা একে একে ডানা মেলে উড়ছে আকাশের দিকে। তাদের গলায় আজ আর কোলাহল নেই বরং একধরনের ধ্যানমগ্নতা। তারা সকালকে স্বাগত জানায় তাদের গানের মাধ্যমে। কখনো কাকের কর্কশ ডাক কখনো শালিকের সুরেলা স্বর।সব মিলিয়ে এক অভাবনীয় গানের মঞ্চ যেন এই ভোরের প্রকৃতি। পাখিদের সেই আহ্বানে মানুষ ঘুম ভাঙে।
জানালার কপাট খোলে ভেতরে আলো ঢুকে পড়ে ধীরে ধীরে।যেমন পুরোনো দিনের কোনো চিঠির খামে ঢুকে পড়ে আজকের নতুন দিনের বাতাস।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঘুমের মায়া এখনো পুরোপুরি কাটেনি ইয়ানার চোখ থেকে। আধা-ভেজা চোখে সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। শরীরের বাঁ পাশে টানটান একটা ব্যথা অনুভব হতেই মুখটা কুঁচকে যায়। ঠোঁট দুটো সরু হয়ে উঠে নাক ফুলে ওঠে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস। এমন ব্যথা তো এখন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।এত বড় খাম্বা যদি সারারাত এইভাবে আষ্টে- পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রাখে তাহলে শরীরে হালকা ব্যাথা করাটাই স্বাভাবিক।
মেঝেতে মার্বেলের ঠাণ্ডা ছোঁয়া তার ত্বকে লাগতেই শরীরে ঝাঁকুনি লাগে। টি- শার্টটা বাতাসে একটু নড়ে ওঠে। চুলগুলো এলোমেলোভাবে গলায় ঝুলে।মুখে এখনো ঘুমের ছাপ স্পষ্ট।
এমন সময় ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে সে চমকে সেদিকে তাকায়।
সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। মুখ থেকে অস্ফুর্তভাবে বেরিয়ে যায়,
‘” নির্লজ্জ”
এই ছোট শব্দটা অগ্নির কর্নপাত হতেই কপালের ভাঁজ প্রখর হয়। ঠোঁট চেপে গম্ভীর হাসে। নিজের দিকে তাকিয়ে এর মানে বুঝতে পারে। কোমরে টাওয়েল পেচিয়ে রাখা। ইয়ানা ধীর পায়ে জানালার কাউচের উপর থেকে পর্দা সরিয়ে দেয়। পিছন ফিরতে যাবে এমন সময় কারোর শক্তপোক্ত উন্মুক শরীরে ধাক্কা খায়। ইয়ানার ঠোঁট আপনা- আপনি বুকের উপর স্পর্শ করে যায়। চোখ বড় বড় হয়ে যায় তার। নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে সামান্য পিছিয়ে যায়। অগ্নি ইয়ানার বাহু ধরে হেচকা টানে নিজের কাছাকাছি এনে দাড় করায়। ঠিক ততটুকু কাছে যতটুকু তারা তাদের নিশ্বাস উপলব্দি করতে পারছে। ইয়ানার গলা শুকিয়ে আছে। ইয়ানা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বলে,,,
” কি.. কি হয়েছে? এইভাবে কাছে টেনেছেন কেনো?
অগ্নির ঠোঁটে বাঁকা হাসি,
” নির্লজ্জ কেনো বলেছিলে আমাকে?
ইয়ানা চট করে অগ্নির দিকে তাকায়। এম প্রশ্নে রীতিমত থমথমে খেয়ে যায়। নির্লজ্জ বলাতে এমন মাতলামো করছে তাহলে? ইয়ানা নিজেকে শক্ত করে বলে,
” কেনো কোনো সন্দেহ আছে? প্রমান হিসেবে এখনও অর্ধনগ্ন হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
ইয়ানার কথা শেষ হতেই অগ্নি ইয়ানার টি- শার্ট ভেদ করে উন্মুক্ত মেদহীন কোমর আকড়ে ধরে। ইয়ানা কেঁপে উঠে। এই স্পর্শ সবসময় এক নতুন রুপ নেয়। অগ্নির দৃষ্টি ধাঁরালো যেটা ইয়ানার কাঁপা ঠোঁটের উপর রাখা। নিজের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে ইয়ানার ঠোঁটে স্লাইড করতে করতে স্লো কন্ঠে বলে,,,,
” এমন কি জিনিস আছে যা আমি অগ্নি চৌধুরি উন্মুক্ত করতে অক্ষম হয়েছি। পাহাড়ের উপরে সে মাটির ঘর, সেখানে খড়ের স্তুপের উপর বয়ে চলা ঘূর্নিঝড়। সেদিন তো সব উন্মুক্ত করেছিলাম। তাহলে প্রতিবার নতুন করে এমন লজ্জা ডাউনলোড কোথায় থেকে দাও ? চলো নতুন করে আবার সব উন্মুক্ত করি।
ইয়ানা চোখ বড় বড় করে তাকায়। কেমন নির্লজ্জ উনি। অগ্নি ইয়ানার সাথে আরও ঘনিষ্ট হয়। ইয়ানা কিছুটা ছটফট করে বলে,,,,
” কি শুরু করেছেন? ছাড়ুন আমাকে।
অগ্নি — তোমার লজ্জা হরন করব আবার নতুনভাবে।
ইয়ানা আচমকা অগ্নির টাওয়েলের গিটের মধ্যে চেপে ধরে। অগ্নি কপাল ভাঁজ করে সেদিকে তাকায়। এরপর দৃষ্টি সরিয়ে একই ভঙ্গিতে ইয়ানার মুখের দিকে তাকায়। ইয়ানা ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,,
‘ আমাকে যদি এখন না ছাড়েন তাহলে ট্রাস্ট মি এই টাওয়েল খুলে ফেলব।
অগ্নির বাঁকা হাসি,,,
” এত তাড়া কিসের তোমার। ধীরে ধীরে তো আমি ওই সব করতাম। দেন ইফ ইউ ওয়ান্ট টু টেইক ইট অফ নাও গো অ্যাহেড অ্যান্ড টেইক ইট অফ। ইউ আনকাভার মাইন, অ্যান্ড আই’ল আনকাভার ইয়োর্স। ফা*ক মি ইয়ানা।
ইয়ানা অগ্নির মুখে চেপে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,,
” ইয়া খোদা উনাকে একটু লজ্জা দান করো। নাহলে আমার কান বন্ধ করে দাও। এত অশ্লিল…
বাক্যটা শেষ করতে পারে নি। ফুল আওয়াজে মোবাইল বেজে উঠে। অগ্নি বিরক্তি নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সেদিকে তাকায়। ইয়ানা সরে আসতে নিবে এমন সময় আহহ করে আর্তনাদ করে উঠে। অগ্নি অধৈর্য হয়ে তাকায়। তার চেইনের সাথে ইয়ানার চুল পেচিয়ে গিয়েছে। ইয়ানা ঠোঁট উল্টে সেদিকে তাকায়। অগ্নি হালকা স্পর্শ ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইয়ানা সামান্য ব্যাথাতুর গলায় বলে,,,
” ধীরে ধীরে করুন ব্যাথা পাচ্ছি।
অগ্নি — একটু সহ্য করো জান । ধীরে করার চেষ্টা ওই করছি। আর একটু সহ্য করে নাও।
ইয়ানা নাক – মুখ খিঁচে রাখে। অগ্নি আলতো হাতে চেইন থেকে চুল ছাড়িয়ে নেয়। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো একটা চুল ও ছিড়ে নি। ইয়ানা হাসি দিয়ে বলে,,,
” বাহহ একটা চুল ও ছিড়ে যায় নি।
অগ্নি বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,,,
” এই প্রতিটা চুলের কোণায় মাদকতা আছে। যার সংস্পর্শে আসলে আমি হারিয়ে যায় বার বার। সেই চুল ছিঁড়ে ফেলি কিভাবে?
ইয়ানা মুচকি হাসে। অগ্নি হাতে মোবাইলটা নিয়ে গম্ভীর হয়ে পড়ে। চোখে – মুখে এক অদৃশ্য রহস্য এসে জমা হয়। কিছুক্ষন ঠোঁট চেপে রেখে কপাল ঘেষে কিছু একটা ভাবে।
ইয়ানা সামনে এগিয়ে এসে বলে,,
” ফোন রিসিভ করছেন না কেনো? কে ফোন দিয়েছে?
অগ্নি ইয়ানার দিকে এক পলক তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে গম্ভীর আওয়াজে বলে,,
” হুম রায়ান বল।
অপরপাশ থেকে,,,
” ভাইয়া আমি সুমু। প্লিজ একটু ইয়ানার কাছে ফোনটা দিন না।
অগ্নির রগ গুলো ভেসে উঠে। গম্ভীর দৃষ্টি রেখে ইয়ানার কাছে ফোন এগিয়ে নেই। ইয়ানা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে,,,
” কে?”
অগ্নির ভারী আওয়াজ —
” সুমাইয়া।
ইয়ানা কপাল কুচকে ফেলে। তার তো ফোন আছেই তাহলে আবার উনার মোবাইলে ফোন দিয়েছে কেনো? হুট করে ইয়ানার মনে পড়ে যায় মোবাইলে চার্জ নেই। একদম অফ হয়ে আছে।
ইয়ানা মোবাইলটা হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই অবাক হয়ে যায়। সুমুর গলার আওয়াজ অস্বাভাবিক। মনে হচ্ছে কান্না করেছে। ইয়ানা মেকি হাসি দিয়ে বলে,,
” কি হয়েছে সুমু? তর কন্ঠস্বর এমন লাগছে কেনো?
সুমুর স্বাভাবিক কন্ঠস্বর,,,
” একটু সিটি হসপিটালে আসবি? তকে আঙ্কেল দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
” সিটি হসপিটালে কেনো? কি হয়েছে আব্বুর।
সুমু থমথমে খেয়ে যায়। কি বলবে সে?
সুমু– কিছু হয় নি তুই শুধু একটুর জন্য আয়।
ইয়ানার কন্ঠে চাপা আর্তনাদ —
” আমি তকে জিজ্ঞাসা করছি সুমু, কি হয়েছে আব্বুর। যা প্রশ্ন করেছি ঠিক তার উত্তর দে।
সুমু ঘাবরে গিয়ে বলে,,
” ক.. কাল সকালে আঙ্কেল আর্ট আ্যটাক করেছিলো। সিসিউতে ছিলো পুরো রাত। এখন জ্ঞান ফিরেছে। তকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে।
ইয়ানা থমকে যায়। স্তব্দ হয়ে যায় সে । ধপ করে বসে যায় বিছানার উপর। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম। চোখে বিন্দু বিন্দু পানির কণা দেখা যায়। অবাকতার রেশ এখনও কাটে নি। কাল সকালে হসপিটালে নিয়েছে আর সেই সংবাদ আজ সকালে জানাচ্ছে। ফুঁপিয়ে কঁদে উঠে। কান্না ভেজা কাঁপা স্বরে বলে,,,
” এমনটা আমার সাথে কেনো করলি তরা। একবার জানালে কি এমন ক্ষতি হত। আজ আমার আব্বুর যদি কিছু হয়ে যেত তখন আমার কি হত! সারাজীবন আত্ন গ্লানিতে ধুকে ধুকে মরতাম।। এইটা ভেবে যে শেষ সময়ে আমি আব্বুর পাশে থাকতে পারি নি। আর কেউ না জানুক তরা তো জানিস আমার আব্বুর আমার জন্য কি? ঠিক কতটা ভালোবাসি আমি সেই মানুষটাকে।
সুমু — জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভাইয়া বারন করছে। এখন জানালে তুই কান্না- কাটি করবি। ভাইয়ার কথাটা ভেবে আমরা কেউ জানাই নি। আর আঙ্কেল এখন সম্পূর্ন সুস্থ। তকে দেখতে চাচ্ছে।
ইয়ানা ফোন কেটে দেয়। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার কারোর সাথে। এতটা পর করে দিয়েছে তাকে।।তার জন্মদাতা পিতা হসপিটালের বেডে কাতরাচ্ছে অথচ তাকে জানা নো হয় নি! কান্না – কাটি করব তাই বলে? কেনো আগে কি ছিলাম না? তখন যদি মেনে নিতে পারে তাহলে এখন সমস্যা কোথায় ছিলো?
ইয়ানা চোখের পানি মুছে অগ্নির দিকে তাকায়। যে এই মুহূর্তে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে একটা একটা করে। ইয়ানা বিছানা থেকে উঠে অগ্নির সামনে দাঁড়ায়। নিজের সামনে ইয়ানাকে দেখে কপাল কুচকে তাকায়। ইয়ানার ঠোঁট কাঁপছে। আকস্মিক অগ্নিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। অগ্নি রাগে হত মুষ্টি করে নেয়। রাগ হলেও শান্ত আর গম্ভীর আওয়াজে বলে,,,,
” তোমার চোখের পানি অন্য কারোর জন্য ঝরবে না ইয়ানা। আমি সেটা কখনো মানতে পারি না। আমি তোমাকে আদর করতে করতে অনেকবার বুঝিয়েছি। তুমি কাঁদবে! তবে সেই কান্না শুধু আমাকে ঘিরে হবে। আমার ভালোবাসার আঘাত সহ্য করতে না পেরে কাঁদবে। যদি কখনো এই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় তখন কাঁদবে। আমাকে ছাড়া শূন্যতায় বদ্ধঘরে চিৎকার করে নিশ্বব্দে ভেঙ্গে পড়বে । অন্যকে ঘিরে এই চোখের পানি বয়ে চলে নিষিদ্ধ।
ইয়ানা চাপা আর্তনাদ করে উঠে। অগ্নির বুকে মুখ গুঁজে বলে,,,
” কতটা পাষাণ আপনি অগ্নি চৌধুরি। কান্না পরের আর্তনাদ দেখলেও চলে আসে। আর সেখানে আমার জন্মদাতা বাবা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে ফিরেছে। তার জন্য কাঁদবো না বলছেন? এতটা পাষান কেনো আপনি ? আপনজনের বিষাক্ত হাহাকার আপনার হৃদকে কেনো ছুঁতে পারে না? প্লিজ বর্বর হবেন না। আমাকে একবার আব্বুকে এখার সুযোগ করে দিন।
অগ্নির শক্ত গলা,,,
” কান্না থামাও নাহলে ইহজনমে ও নিয়ে ও যাব না।
ইয়ানা থেমে যায়। বুক থেকে মাথা তুলে অগ্নির দিকে তাকায়। অগ্নি ইয়ানার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,,,
” ফ্রেশ হয়ে নাও। তবে শর্ত!
ইয়ানা — কি?
অগ্নির ভারী স্বর,,,
” দুনিয়া কিয়ামত হয়ে যাক কিন্তু তুমি সেখানে থাকবে না। তোমার বাবা যদি থেকে যেতে বলে তাহলে থাকবে না। যদি এই প্রমিস রাখতে পারো তাহলেই এক মাত্র তোমাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হব।
ইয়ানা কিছু একটা ভেবে হুট করে বলে।,,,
” যা আপনি বলবেন।
অগ্নি রহস্যময় হাসি দেয়। এই হাসিতে লুকিয়ে আছে অনেক কিছু। ইয়ানা ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে যায়। মাথায় আসাদ হোসেনের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো চিন্তা নেই। শুধু একবার এখানে পৌঁছাতে পারলেই হবে। এরপর সব কিছু জাহান্নাম হয়ে যাক কিছু যায় আসে না।
মাত্র দশ মিনিটে ইয়ানা নিজেকে পরিপাটি করে নিচে নামে। এরপর দ্রুত গাড়ির কাছে চলে যায়। ইয়ানা গেলে অগ্নি এক হাতে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। ইয়ানা দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে।
অগ্নি গম্ভীর হয়ে গাড়ি স্ট্রাট দেয়। ইয়ানার বুকের ভিতরে এক ঘূর্নিঝর চলছে। অগ্নির ভয়ে কান্না ও করতে পারছে না।।যদি মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দেয়। এই লোককে নিয়ে বিশ্বাসের “ব” ও নেই।
ওয়েটিং রুমে হল্লা পার্টি , রায়ান ইউভি সবাই অপেক্ষা করছে। আসাদ হোসেনের কাছে বর্তমানে শুধু একজনকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই সেলিনা হোসেন তার পাশে বসে আছে। আসাদ হোসেন বিরবির করে শুধু ইয়ানার নাম মুখে তুলছে।
পুরো দিনের ক্লান্তি আর রাতে নির্ঘুম থাকার কারনে রুয়ানা ফজরের আজানের পর সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ইউভি এসে দেখতে পায় আরুর কাঁধে মাথা রেখে রুয়ানা ঘুমিয়ে আছে। ইউভি ইশারা দিয়ে আরুকে উঠতে বলে। আরু নিশ্বঃব্দে উঠে যায়। ইউভি আরুর জায়গায় বসে শব্দহীনভাবে রুয়ানার মাথাটা নিজের কাঁধের উপর রাখে। রুয়ানার স্পর্শ যেন শরীরের প্রতিটা লোমকূপ জানান দিচ্ছে এই মেয়েটা একদিন তর ব্যক্তিগত রমনী হবে।। এই পিচ্চি মেয়েটাও একদিন তকে শাষন করবে বউ হিসেবে। ইউভি হালকা হাসে। রুয়ানার মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো ইয়ানা হালকা স্পর্শে সরিয়ে দেয়। পুরো দিনের ধকলে মেয়েটা কেমন নেতিয়ে গিয়েছে। কিছু খায় নি এখন পর্যন্ত। রুয়ানা কিছু খায় নি ভাবতেই মাথায় টনক নড়ে। পুরো একটা দিন – রাত গিয়েছে অথচ মেয়েটা অভুক্ত। সামান্য পাউরুটি খেয়ে এতক্ষন থাকা যায় নাকি? ভালো হয়েছে ইয়ানাকে জানানো হয় নি। নাহলে মেয়েটাও ভেঙ্গে পড়ত। আর অগ্নির রাগের শিকার হত। যা করে আল্লাহ ভালোর জন্য করে।
ইউভি সামনের দিকে তাকিয়ে রুহানকে ডাক দিয়ে বলে,,,
” রুহান কিছু খাবার নিয়ে আসো।
রুহান — কার জন্য ভাইয়া?
ইউভি — রুয়ানা মনে হচ্ছে এখনও কিছু খাইনি। এমন অভুক্ত থাকলে শরীর খারাপ করবে।
সুমু– খাওয়াতে চেয়েছিলাম বাট শুধু বলছে আব্বুর জ্ঞান না ফিরা পর্যন্ত খাব না। জ্ঞান তো ফিরেছে কিন্তু ঘুমিয়ে গেছে তাই আর ডাকি নি।
ইউভি গম্ভীর আওয়াজে বলে,,,,
” সমস্যা নেই। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
সুমু কপাল কুচকে ইউভির দিকে তাকায়। সে এতক্ষন খেয়াল করে নি রুই যে ইউভির কোলে মাথা রেখে শুইয়ে আছে। ও তো ভেবেছে এখনও আরুর কাঁধে মাথা রাখা। সুমু আরুর দিকে তাকায়। আরু সুমুর দিকে তাকিয়ে ইউভি আর রুয়ানার দিকে ইশারা করে।
সুমু কিছুটা সন্দেহ নিয়ে রায়ানের কানে হিসহিসিয়ে বলে,,,
” কি ব্যাপার বলোন তো? ইউভি ভাইয়া হুট করে রুইয়ের জন্য এত ডেম্পারেট হয়ে উঠেছে। কেমন সন্দেহের গন্ধ পাচ্ছি ।
রুয়ান — ভালোবাসার মানুষকে আগলে রাখাটাই স্বাভাবিক।
সুমুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। ভালোবাসা! তাও আবার রুই আর ইউভি ভাইয়ার! ওরে আল্লাহ বলে কি এইসব? সুমু টাল সামলাতে না পেরে উচ্চস্বরে বলে উঠে,,,,
” কিহহহহ!
সুমুর চিৎকারে রায়ান ঘাবরে গিয়ে তার হাত চেপে ধরে। হল্লা – পার্টি, ইউভি তাদের দিকে তাকায়। রায়ান সবার দিকে কৃত্রিম হাসি দিয়ে সুমুর হাত চেপে ধরে বাহিরে নিয়ে আসে। জায়গাটায় মানুষ নেই একদম নিরিবিলি বললেই চলে। সুমু রায়ানের উদ্দেশ্যে বলে,,,,
” এখানে নিয়ে আসলেন কেনো আপনি? আর একটু আগে কি বললেন এইটা? ভালোবাসা! তাও আবার ইউভি আর আমাদের রুইয়ের!
রায়ান কোমরে এক হাত রেখে সুমুর দিকে তাকিয়ে বিরক্তির রেশ টনে বলে,,,
” একটু ধীর আওয়াজে কথা বলবেন প্লিজ। আপনার এমন উচ্চস্বরে কথা বলার কারনে পুরো হসপিটালের লোকজন চলে আসবে।
সুমু– একটু বেশি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তাই অজান্তেই এইভাবে বলে ফেলেছি। আগে কাহিনী বলুন।
রায়ান তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,,,
” ইউভি রুইকে ভালোবাসে। আর এইটা কোনো সাধারন ভালোবাসা না। পাগলের মত ভালোবাসে ইউভি রুয়ানাকে। ইয়ানার বিয়ের পর কোনোভাবে রুয়ানাকে দেখেছিলো। আর সেই থেকে ধীরে ধীরে রুয়ানার প্রতি তিব্রভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে।
সুমু রায়ানের দিকে তাকিয়ে হাস্কি সুরে বলে,,,
” এইটা আপনি আমাকে কি শুনালেন রায়ান? এই সত্যি জানার পর আমি কি বলব ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। রুই এখন ও ছোট। ভালোবাসা, সংসার, স্বামী- স্ত্রী মানে কি? সে সম্পর্কের ওর কোনো জ্ঞান নেই। হ্যা হয়ত এই বয়সে অনেক মেয়েরা এইসবে জেনে বসে আছে কিন্ত আমাদের রুই এখনও বাচ্চা রয়ে গিয়েছে। বাহিরের জগত নিয়ে কোনো ধারনা নেই ওর মধ্যে। পারবে ইউভি ভাইয়া এমন একটা বাচ্চা মেয়েকে সামলাতে?
রায়ান সুমুর কাঁধে হাত রেখে হাসি দিয়ে বলে,,,
” ভালোবাসা আর মোহ দুইটা আলাদা জিনিস। ইউভি রুয়ানাকে কামনা নয় ভালোবাসে। ইউভি অনেকটাই অগ্নির মত গম্ভীর। কথা বলে খুব কম। ধৈর্য ও প্রচুর। ওর জায়গায় আমি হলে এতদিনে মরে যেতাম। তোমাকে পছন্দ করেছি কোনো কিছু না ভেবে অল্প সময়ে বউ বানিয়ে নিয়ে এসেছি। অপেক্ষা করার মত এতটা ধৈর্য আমার নেই। আর ভালোবাসার মানুষের সব কিছু একজন পুরুষ সহ্য করতে পারে যেমন আমি সহ্য করছি।
সুমু কপাল কুচকে জিজ্ঞাসা করে,,,,
” আপনি কি সহ্য করছেন? কি করলাম আমি?
রায়ানের বিষাধময় কন্ঠ,,,
” এই যে বিয়ের এত দিন পরও ভার্জিন রয়ে গেলাম। বাচ্চার বাবা হব চল্লিশ বছর বয়সে। তখন স্কুলের অভিভাবকরা আমাকে বাবা না বানিয়ে দাদা বানিয়ে দিবে।
রায়ানের কথায় সুমুর কান গরম হয়ে উঠে। লজ্জা পেলেও হাসি সামলাতে পারে নি। রায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,,,
” একটু তো ধৈর্য ধরুন।
রায়ান — আর কত?
সুমু মুচকি হাসি দিয়ে বলে,,
” একটু।
রায়ান কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইয়ানার কন্ঠস্বর কানের মাঝে স্পর্শ করে যায়। রায়ান আর সুমু ওয়েটিং রুমে চলে যায়।
রুয়ানাকে খাওয়ানোর জন্য ইউভি ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। ঠিক সেই মুহূর্তেই ইয়ানার আগমন। রুয়ানা ইয়ানাকে দেখতে পেয়েই ইয়ানার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রুই কান্না করতে করতে বলে,,,
” আপু রাতে আব্বুর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।
ইয়ানার চোখে পানি গড়িয়ে পড়ে। মনকে শক্ত করে রুয়ানার মাথায় চুমু খেয়ে বলে,,
” শুক্রিয়া আব্বু এখন পুরো – পুরি সুস্থ। আমাকে জানাস নি কেনো? যদি আব্বুর কিছু হয়ে যেত কোনোদিন তদের ক্ষমতা করতাম না রুই। হঠাৎ করে আব্বু আ্যটাক হওয়ার কারন?
— কারন তোমার আব্বু আমার সম্পর্কে সব জেনে গিয়েছে। তার ধারনা তার মেয়েকে নিজ হাতে কোনো নরকে ঢেলে দিয়েছে। আর সেই ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে বুক চাপা আর্তনাদে নেতিয়ে পড়ে।
সেই চিরচনা গম্ভীর স্বর শুনে ইয়ানা দুই পিছিয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস টানে। যে ভয়টা সে এতদিন পেয়ে এসেছে আজ সেটাই হলো। কি হবে এখন? কি হবে শেষ গন্তব্য? কাকে সামলাব আমি? কার কথা মানব? একদিকে স্বামী অন্যদিকে বাবা! ইয়ানা মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে যায়। ইয়ানা শান্ত সুরে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,,,
” কে জানিয়েছে এইসব আব্বুকে ?
অগ্নির ঠান্ডা নিচু স্বর,,,
” সেটা জানলে নিশ্চয় এখানে থাকতাম না। আমার স্থান আর পদচারন হত এতক্ষন সেই টর্চার সেলে।
আকাশ, রুহান, সুমু আর আরু উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। কারোর মাথায় কিছু ডুকছে না। কিসের পরিচয়, কিসের টর্চার সেল।
আরু সকল নিরবতা ভেঙ্গে প্রশ্ন করে,,,
” কিসের পরিচয় আর কিসের টর্চার সেল?
ইয়ানা আরুর দিকে তাকিয়ে বলে,,,
” আমাকে খারাপভাবে নিস না আরু। এতকিছু তদের থেকে গোপন রাখার কারনে? জীবনে তদের থেকে কোনো জিনিস গোপন রাখি নি। কিন্তু আজ জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যটা ওই জানাতে পারি নি। বলতে পারিস জানানোর সাহস হয়ে উঠে নি। ধৈর্য ধর আর অপেক্ষা কর সব জানতে পারবি।
সুমু — আশা রাখব এমন কিছু নয় যেটাতে ভয় কাজ করবে।
ইয়ানা মলিন হাসে। কিছুক্ষনের মধ্যে কেবিনের ভিতরে ডুকার জন্য সবাইকে অনুমতি দেয়। ইউভি, রায়ান আর অগ্নি ওয়েটিং রুমে গম্ভীর হয়ে বসে। বাকি সবাই আসাদ হোসেনের কাছে চলে যায়। রুয়ানা কেবিনে ডুকে আসদ হোসেনকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
” কেমন লাগছে তোমার আব্বু?
আসাদ হোসেন মেয়ের মাথায় ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,,,
” ভালো আছি মামুনি। এইভাবে কান্না করলে হবে। তুমি তো আমার স্ট্রং মেয়ে।
রুয়ানা মুচকি হাসে। ইয়ানা এগিয়ে যায়। আসাদ হসেনের পাশে বসে হাতে চুমু খেয়ে বলে,,,
” কষ্ট অনুভব হচ্ছে না তো আব্বু?
আসাদ হোসেন ইয়ানার মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দেয়। ইয়ানা হাতে ধরে বলে,,,
” তুমি কান্না কেনো করছো আব্বু?
আসাদ হোসেন অসহায় গলায় বলে,,,,
” আমাকে ক্ষমা করে দে মা। বাবা হয়ে তকে এমন একজনের হাতে তুলে দিয়েছি যে মানুষ ওই নয়। তকে নরকে পাঠিয়ে দিলাম। এই বাবাকে কখনো ক্ষমা করিস না।
ইয়ানা মুচকি হেসে বলে,,,,
” তুমি তো ছোট বেলায় শিখিয়েছিলো আব্বু। জম্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটা জিনিস আল্লাহর হাতে। উনি সব কিছু নির্ধারন করে। ভাগ্যকে এড়িয়ে চলে নিজেকে কেনো দোষ দিচ্ছো?
আসাদ হোসেন — তকে টর্চার করে নিতো? ওই জানোয়ারটা তকে ক্ষতি করে নি তো মা। থাকতে হবে না এই নরকে। যেভাবে তকে ঢেলে দিয়েছি সেভাবেই তকে সেখান থেকে তুলে আনব। তর বাবা মরে নি, এখনও বেঁচে আছে। আমি সুস্থ হলেই ডিভোর্সের কাজ শুরু করে দিব। এমন হিংস্র লোকের সাথে সংসার অসম্ভব।
কেবিনের ভিতরে প্রত্যেকটা মানুষ অবাক হয়ে তাকায়।ইয়ানার বুকটা ধক করে উঠে। এই ভয়টা ওই সে পেয়েছে এতদিন। ডিভোর্স! ইয়ানা ভয়ে একবার দরজার দিকে তাকায়। মনের ভিতরে এক তীব্র ভয় জাগ্রত হয়। একবার যদি অগ্নির কানে এই কথাটা যেতে পারে তাহলে সে আমার বাবাকে ছাড়বে না। তার বুকে ছুঁরি চালাতে ও এবার দ্বিধাবোধ করবে না। ইয়ানা শান্তির নিশ্বাস ফেলে। না এখানে অগ্নির কোনো অস্তিত্ব নেই। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ইয়ানা আসাদ হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
” আমি একদম নরকে নেই আব্বু। উনি আমাতে আসক্ত । উনি উন্মাদ আব্বু। উনার সামনে ডিভোর্সের কথা পুনরায় উচ্চারন করো না। এইসব শুনলে কানাডার সেই মাফিয়া হতে ও দুই বার ভাববে না। তোমাকে আঘাত করলে আমি ভেঙ্গে যাব। আমি সুখে – শান্তিতে আছি। উনি বড্ড একা। আমাকে ছাড়া পাগল হয়ে পড়বে।
আসাদ হোসেন — জীবন একদিন বা এক বছরের নয়। জীবনটা অনেক বছরের। এমন একটা জঘন্য কীটের সাথে কিভাবে থাকবি তুই? তর পরিবেশ আর অগ্নি চৌধুরির পরিবেশ আলাদা। মাত্র জীবন শুরু এখনও কিছু শুরু হয় নি। যে ছেলেটা নারীদের সম্মান করে না। নারী পাচারের সাথে যুক্ত সে নিজের স্ত্রীকে কিভাবে সামলে রাখবে। যে ছেলেটা ছোট ছোট বাচ্চা পাচার চক্রের সাথে যুক্ত সে কিভাবে নিজের সন্তানের হেফাজত দিবে বল আমায়? অন্যন্য বিষাক্ত কাজের উল্লেখ না করলাম। ইয়াবা, ড্রাগ, মাদক পাচার, শক্তিশালী অস্ত্র পাচার, বিকৃত খুন সর্বশেষে এমন কোনো জিনিস নেই যার সাথে সে যুক্ত নয়। এমন একজন গ্যাংস্টারের হাতে আমার মেয়েটাকে কিভাবে তুলে দেয়। বাবা হিসেবে মেয়েকে নিজ হাতে কুরবানি দেওয়া হবে।
কেবিনে হঠাৎ নিস্তব্দতার বিস্ফোরন ঘটে। প্রত্যেকজনের মাথায় যেন পাহাড় ধ্বসে পড়ে। আরু, সুমু, আকাশ রুহান একে অপরের দিকে তাকায়।মুখের অভিব্যক্তি এমন মনে হয় বুকের মাঝে কেউ বারুদের স্তুপ ফেলে দিয়েছে। কি বলছে এইসব? মাফিয়া! গ্যাংস্টার! শব্দগুলো কেউ আতাসে ছুঁরে মারলো কেউ।
ইয়ানার নিঃশ্বাস আটকে আসে। ইয়ানা ভাবুক হয়ে উঠে। মাথায় ঘুরছে নারী পাচার আর শিশু পাচার চক্রের কথা।একটি মেয়ে তারই মত কোমল আর নিষ্পাপ মুখ।একটি শিশু ফুটফুটে, মায়ের কোলে ঘুমিয়ে থাকার কথা। আর তারা কেউই জানে না কোন অন্ধকার গহ্বরে নিয়ে যাওয়া হবে তাদের জীবনকে। ইয়ানা হঠাৎ জড়সড় হয়ে পড়ে। বুকের ভিতরটায় দারুণ এক ধাক্কা লাগে। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠে। কথাগুলো মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে অস্ফুট স্বরে।কিন্তু তাতে ছিল অটুট বিশ্বাসের কাঠিন্য। ইয়ানার কাঁপা গলায় বিরোধ,,
” না আব্বু উনি নারী পাচার – শিশু পাচারের সাথে যুক্ত নয়। তোমার ভুল হয়েছে। উনি এইসব করে না।
আসাদ হোসেন মেয়ের সরল মুখটার দিকে তাকায়। কতটা নরম আর সরল ওর মেয়ে। আর সে জীবন কাটাবে এমন একজন নরপশুর সাথে। আসাদ হোসেনের চাপা কন্ঠ,,,,
” অগ্নি চৌধুরি পুরো মাফিয়া প্যালেসের বস। মাফিয়া আন্ডারগ্রাউন্ড ওর হাতের ইশারাতে চলে। ওর অনুমতিতে সব পাপ চক্র হয়। অগ্নি চৌধুরি কোনো কাজ ওই সরাসরি করে না। মাফিয়া সম্রাজ্যে হাজার হাজার লোক আছে করার জন্য।।তাদের প্রয়োজন শুধু ইশারা। আর অগ্নি চৌধুরি সেই ইশারা ওই দিয়ে থাকেন। প্রতিটি মাফিয়া ভিবিন্ন চক্রের সাথে যুক্ত। আর সেসব মাফিয়াদের হিংস্র সিংহাসনে বসে আছেন অগ্নি চৌধুরি। এখন তুই ভেবে নে অগ্নি চৌধুরি পাচারে যুক্ত নাকি যুক্ত না।
মুহূর্তে যেন ইয়ানার চারপাশটা ঘুরে যায়।
প্রিয় মানুষের নামটা কানে বাজে কিন্তু এইবার ভালোবাসার শব্দে নয় বরং একেকটা বাক্যে যেন বিষ ঢেলে দিচ্ছে হৃদয়ে। আপনি তো আমাকে বলেছিলেন এইসবে আপনি যুক্ত নয় তাহলে আজ আমি এইসব কি শুনছি?ইয়ানা মূর্তির মত স্তব্দ হয়ে পড়ে। কোনো শব্দ নয়, কোনো বাক্য নয় একদম শান্ত পাথরের রুপ নেয়। মনে হচ্ছে সে ছাড়া তার পাশে কেউ নেই।
ডাক্তার কেবিনে এসে এত মানুষ দেখে সতর্ক দিয়ে বলে,,,
” এত মানুষে রোগীর সমস্যার কারন হবে। আর ঘন ঘন কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। রোগীকে একদিন বেড রেস্ট দিন। প্রায় ত্রিশ মিনিট আপনাদের কথা বলার অনুমতি দিয়েছি। এখন সবাই বাহিরে যান আর রোগীকে কিছুক্ষন ঘুমাতে দিন।
ইয়ানা উঠে দাঁড়ায়। আসাদ হোসেনের হাতে চুমু খেয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলে,,,
” চিন্তা করো না আব্বু। আমি আসাদ হোসেনের মেয়ে। ঠিক তার মত শক্ত। সবকিছু মোকাবেলা করার ক্ষমতা আছে। আমি চাই শুধু তোমাদের দোয়ার হাত। তুমি আর আম্মু দোয়া করো যাতে তোমাদের মেয়ে সব কিছুতে মানিয়ে নিতে পারে। সেই লোকটাকে তোমার মেয়ে পাগলের মত ভালোবাসে।।তাকে ছাড়া এক মুহূর্ত ও সে থাকতে পারে না।আসছি আব্বু আবারও কোনো একদিন দেখা হবে। পুনরায় দেখা হলে যাতে তোমার মুখে হাসি দেখতে পাই।
এরপর রুয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে।,,,
” রুই আব্বু- আম্মুর খেয়াল রাখবি সবসময়। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে।
ইয়ানা হল্লা পার্টি সবার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। সবার চোখে পানি চিকচিক করছে। এত বড় সত্যি সামলাতে পারছে না।
কেবিন থেকে এক এক করে সবাই বেরিয়ে যায়। আসাদ হোসেন মেয়ের সাহসিকতার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে। কিন্তু বাবার মন কিছুতেই মানতে পারছে না। বুকটা হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। তিনি আটকাতে পারতেন ইয়ানাকে কিন্তু কেনো জানি মস্তিষ্ক আটকাতে মানা করছে।
অগ্নির কালো মার্সিডিজ গাড়িটা শাঁ শাঁ করে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশেই ইয়ানা চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে শুইয়ে আছে। মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। অগ্নি আড়চোখে কয়েকবার তাকায় সেদিকে কিন্তু কিছু বলে না। একসময় গাড়িটা এসে ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থামতে ইয়ানা চোখ মেলে তাকায়। গন্তব্যে এসে পড়েছে ভাবতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। অগ্নির পিছু পিছু যায়। দরজা ফিঙ্গার টাচ করে খুলতেই ইয়ানা বিনা শব্দে উপর চলে যায়। রুমে ডুকে বিছানার উপর বসে চাঁদর শক্ত করে চেপে ধরে। অগ্নি রুমে ডুকে গম্ভীর আওয়াজে বলে,,,
” চলে আসলে যে?
ইয়ানার মাথা নিচু করে রাখা। স্তব্দ হয়ে বসে আছে। অগ্নি আর নিজের রাগ সামলাতে পারে না। অনেকক্ষন ধরে ফলো করছে ইয়ানা তাকে এড়িয়ে চলছে। অগ্নি রেগে ইয়ানার দিকে ঝুকে বাহু চেপে ধমকে বলে,,
” আমার কথা কানে যাচ্ছে না? এমন ত্যারামি করার মানে কি? রাগ অনিয়ন্ত্রন হলে কন্ট্রোল করতে পারবে? ডাফার!
ইয়ানা মাথা তুলে অগ্নির দিকে তাকায়। ইয়ানার চোখ লাল হয়ে আছে। চোখের সাদা অংশে যেন রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। ইয়ানার মলিস হাসি,,,,
” কথা দিয়েছিলাম আপনাকে তাই চলে আসলাম। কেনো খুশি হন নি?
অগ্নি ইয়ানার পুরো মুখে চোখ বুলায়। এমন অস্বাভিক দেখে কপাল কুচকে আসে। ইয়ানা সামান্য হেসে উঠে শব্দ করে। নিশ্বাস নিয়ে বলে,,,
” কতটা বোকা আমি তাই না? এত কিছুর পরও আমি আপনাকে অন্ধের মত বিশ্বাস করি। দোষ আপনার নয় সব দোষ আমার। কেনো ভালোবাসতে গেলাম আর কেনো ওই বা এখন আফসোস করি।
এরপর অগ্নির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,,
” একটা প্রশ্ন করি প্লিজ? একবার ও কি আপনার বুক চিৎকার করে কেঁদে উঠে নি। যখন আপনি মেয়ে পাচারের আদেশ নামাই সাইন করেছেন। একবার ও কি বুকটা ধুক করে উঠে নি যখন বাচ্চাগুলোকে বিক্রির খাতায় স্বাক্ষর দিয়েছন? বাচ্চাগুলোকে কি এক নজর ইচ্ছা জাগে নি কখনো? কাকে বিক্রি করার অনুমতি দিচ্ছেন। মনে হয় নি আমার ও একদিন এমন একটা সন্তান হবে। অন্যের সন্তান ছিনিয়ে নেওয়ার আদেশ কিভাবে দেয়? আপনার অন্য সব বাদ দিলাম।সব মেনেই আপনার সাথে পুনরায় ঘর বাঁধার সপ্ন দেখেছি। কিন্তু আজ আমাকে কেনো এমন সত্যের মুখে দাড়া করালেন অগ্নি চৌধুরি? যদি কলিজা ছিঁরে দেখাতে পারতাম আমার ভিতরে বয়ে চলা তান্ডব তাহলে হয়ত সেই তান্ডবে আপনি এ ভষ্ম হয়ে যেতেন। আছে কি কোনো উত্তর?
অগ্নি ইয়ানার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে গম্ভীরতার ছাপ স্পষ্ট। অগ্নি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে থেকেই ভারী গলায় বলে।,,,,
” আমি সেই জগতের সিংহাসন দখলধারী। সেখানে কোনো ভালো কাজের অংশ নেই। যদি পাও তাহলে পাবে শুধু ছলনা আর বঞ্চনা। পৃথিবীর এমন কোনো নিষিদ্ধ জিনিস নেই যেটা সেখানে হয় না। একেক জন একেক কাজে যুক্ত। আর আমি সেটা পরিচালনা করি। আমার থেকে অনুমতি পত্র নিতে হয়। আমি এক অন্ধকারের সিংহাসনে বসে আলোর বর্তা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। নারী – শিশু পাচার হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি তোমাকে আগে ও বলছি সরাসরি যুক্ত নয় কিন্তু অনুমতি দেয়। আমাকে সাধু পুরুষ ভাবাটা বোকামি। পর নারীর সংস্পর্শ ছাড়া আমি সকল নিষিদ্ধ কাজ করেছি। আর সেটা বলতে আমার কোনো আফসোস নেই।
ইয়ানা নিশ্বাস টানে বড় বড়। বুকের ভিতরে খন্ড- বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে। ইয়ানার মুখে তাচ্ছিল্য হাসি। শান্ত সুরে বলে,,,
” যদি কখনো আপনি সন্তানের বাবা হন তাহলে আল্লাহ যাতে আপনাকে কখনো মেয়ে দান না করে। আপনার যাতে সন্তান না হয় সেই অভিশাপ আমি দিব না অগ্নি চৌধুরি। আপনার সন্তান না হলে আমাকে নিস্বঃন্তান হয়ে বাঁচতে হবে। কিন্তু দোয়া করি যাতে মেয়ে না হয়। যে অন্য মায়ের বুক খালি করার অনুমতি দিতে পারে সে ঘরে মেয়ে জন্ম নেওয়াটাও নিষিদ্ধ।
অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৪৯
দেখবেন অগ্নি চৌধুরি একদিন আপনার জীবনে এমন কেউ আসবে যে হাজারটা মেয়ের আর্তনাদ দ্বিগুন ফিরিয়ে দিবে। সেদিন আপনি ও কাঁদবেন ঠিক যেভাবে হারিয়ে যাওয়া সন্তানের বাবারা কাঁদে।
অগ্নি শান্ত হয়ে গিয়ে ইয়ানার পাশে বসে। চোখ – দুটি বন্ধ করে নেয়। বড় বড় শ্বাস টেনে আওড়ায়,,,
” সেই সুযোগটাই আসবে না। আমি জীবনে তিন জন নারীকে জায়গা দিয়েছি। আমার মা, বোন আর বউ। আমি ও দোয়া করি চতূর্থ কেউ যাতে না আসে।