অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৪

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৪
লিজা মনি

রুয়ানা আচমকা করে ঘুমের মধ্যে চিৎকার দিয়ে হুট করে লাফিয়া উঠে। রুয়ানার চিৎকারের সাথে সাথে ইউভির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ইউভি ঘুমঘুম চোখে ডিভান থেকে বিছানার দিকে তাকায়। রুয়ানাকে চাঁদর খামছে ধরে কাঁপতে দেখে দ্রুত রুয়ানার কাছে যায়। ইউভি রুয়ানাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে মাথায় হাত দিয়ে বলে,
” কি হয়েছে জান? কি নিয়ে ভয় পেয়েছো? বাজে সপ্ন দেখেছো?
রুয়ানা রিতীমত কাঁপছে। ইউভির শার্ট শক্ত করে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে।
” আব্বু- আম্মুকে দেখেছি । ও.. ওরা আমার কাছে কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু আমি ভয়ে শুনি নি। ওদের শরীরে সাদা ড্রেস পড়া ছিলো। শুধু ঠোঁট নাড়াচ্ছিলো আমি শুনতে পারি নি।
ইউভি গভীর নিশ্বাস ফেলে রুয়ানার মাথায় হাত রাখে। এরপর মিনি টেবিল থেকে পানি এনে রুয়ানার মুখের সামনে নিয়ে বলে,

” আগে পানিটা খেয়ে শান্ত হও।
রুয়ানা সম্মতি জানিয়ে ইউভির হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে পুরোটা পানি খেয়ে নেয়। ইউভি গ্লাসটা যথাস্থানে রেখে রুয়ানাকে শান্তনা দিয়ে বলে,
” ভয়ের কিছু নেই। আমি আছি তো পাশে। এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো ।
ইউভি রুয়ানার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাই কিন্তু রুয়ানা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
” যা.. যাবেন না, য.. যাবেন না প্লিজ। আমার সাথে থাকুন ।
— আমি তো পাশেই আছি তাহলে ভয় কিসের?
— পাশে নয় আমার সাথে থাকুন।
ইউভির পুরো সত্তা কেঁপে উঠে। বড় বড় শ্বাস টেনে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” পাশে থাকলে নিজেকে সামলাতে পারব না জান। তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে।
রুয়ানা কিছু বলছে না শুধু ইউভির বুকে মুখ গুঁজে আছে। এখনও মেয়েটা অসম্ভব ভয় পেয়ে আছে। রুয়ানার কোমল স্পর্শে ইউভির নাজেহাল অবস্থা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে নিজেকে শক্ত করে নেয়। এরপর রুয়ানাকে সেই অবস্থাতে নিয়েই শুয়ে পড়ে। রুয়ানা বালিশে মাথা না রেখে ইউভির বুকে মাথা রেখে ঘুম ঘুম আওয়াজে বলে,
” যাবেন না আমাকে রেখে প্রমিস করুন? আবার ভয় পেয়ে উঠে পড়লে আপনাকে পাশে না পেলে কথা বলব না কোনোদিন।
রুয়ানার ঘুমন্ত কথাগুলো শুনে ইউভি মুচকি হাসে। এরপর তার মুখে অজস্র চুমু খেয়ে নিজের সাথে আরও ভালোভাবে মিশিয়ে বলে,

” এক সাথেই তো থাকতে চাই। কিন্তু এইটা পর্যাপ্ত সময় নয়। তোমার সান্নিধ্যে থাকলে আমি নিজের মধ্যে থাকতে পারব না। আমার দুর্বলতা তোমার ক্ষতি হবে। আমাকে সামলানোর মত ক্ষমতা এখনও তোমার হয় নি। যেদিন হবে সেদিন এক রাত ও আলাদা থাকব না প্রমিস।
রুয়ানা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আর এইদিকে ইউভি এক দৃষ্টিতে রুয়ানার বাচ্চামুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

মিরা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসে। ইউভি মিরাকে দেখে বলে,
” মিরা।
— হুম।
— ভাইয়া আর বউমনি মেবি বাহিরে গিয়েছে।
মিরা চোখ বড় বড় করে তাকায় অরিদের দিকে। অরিদ মিরার তাকানো দেখে ঠোঁট উল্টে বলে,
” কি?
— মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে আপনার? ভাইয়া যাবে ইয়ানাকে নিয়ে বাহিরে? হাসালেন। নয়টা মাস মেয়েটাকে রুম থেকে বের হতে দেয় নি। কয়েকদিন পর ডেলিভারি আর এখন ভাইয়া বাহিরে নিয়ে যাবে।
— সেটা মনে করে আমিও অবাক হয়ে ছিলাম। কিন্ত ভাইয়া আর বউমনিকে গাড়ি নিয়ে বের হতে দেখেছি। মানে ভাইয়ার কোলে ছিলো বউমনি। আমি বেলকনি থেকে দেখেছি।
মিরা তব্দা খেয়ে অরিদের দিকে তাকিয়ে আছে। অরিদ মেকি হাসি দিয়ে বলে,
” চ.. চুমু খেয়েছে সেটাও দেখেছি।
মিরা কটমট চোখে অরিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
” নির্লজ্জ , ইডিয়েট! বড় ভাইয়ের রোমান্স দেখে। আমি দেখলে মানা যেত কারন আমি ইয়ানার ফ্রেন্ড। একটা ডাক তো দিতে পারতেন যখন দেখেছেন।

— আমাকে নির্লজ্জ বললে এখন নিজেই দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করছো?
— আমি বেস্ট ফ্রেন্ড দেখার রাইট আছে।
— আচ্ছা?
— হুম।
— মিরা।
— কি?
— প্রচুর প্রেম প্রেম পাচ্ছে। কি করা দরকার বলো তো?
— ওয়াশরুমে গিয়ে বসে থাকেন।
মিরা কথাটা বলে বিছানা থেকে উঠে সামনে এগোতেই হাতে টান অনুভব করে। মিরা বিরক্তি হয়ে পিছনে তাকাতেই অরিদ বাঁকা হেসে হেঁচকা টানে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসে। মিরা নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে অরিদের দিকে কটমট চোখে তাকায়।
— ছাড়ুন আমাকে। রাত হলেই আপনার অসভ্যতামি মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
— রাত হলেই তো অসভ্যতার পর্যাপ্ত সময় কিউট পাখি।
মিরা চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে বলে,

” নষ্টামি না করে ঘুমান অরিদ।
— একটু তো নষ্টামি করবো’ই।
— আপনি ভালো হবেন কবে?
অরিদ মিরার চুলগুলো এক পাশে নিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বলে,
” প্রমিস সকাল হলে ভালো হয়ে যাব।
— সরুন তো অসভ্য লোক। অসুস্থ আমি বর্তমানে।
অরিদ আহাম্মকের মত তাকায় মিরার দিকে।
— মাঝপথে এমন বিরহ কথা না বললে পারতা।
— বলতে দিয়েছেন আমাকে? কন্ট্রোল আছে আপনার?
— অবশ্যই আছে। নাহলে এতদিনে দশ বাচ্চার বাবা হয়ে যেতাম। আমার আর রায়ান ভাইয়ার তো এক সাথে বিয়ে হয়েছে। দেখো উনি বাবা হয়ে যাচ্ছে। আর এইদকে আমি বউয়ের ধমক শুনছি। সব’ই আমার ভাগ্য।
মিরা মুচকি হেসে অরিদের দুই গালে চুমু খেয়ে বলে,

” এত ঝগড়ুটে কেনো আপনি?
— তোমার সাথে ঝগড়া করতে ভালো লাগে। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছিলাম
— কোন কথা?
অরিদ মিরার দুই গালে হাত দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে,
” মিরা ওইদিন রুমে আটকেছিলাম সেটা আমার দোষ মানছি। বাট সুইমিংপুল পুলের আলোতে তো রুমটা সামান্য আলোকিত থাকে। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার নয়। আমি যতটুকু দেখেছি তুমি ভিতু নও। তাহলে সেদিন জ্ঞান হারানোর কারন জানতে পারি? আর কিসের সপ্ন? কিসের অতীত?
— বাহহহ ! হঠাৎত আমার আগর কথা জানবার হোনচে আপনার ? এতদিনে তাইলে আপনার মগজত প্রশ্ন জাইগা বাইর অইলো!
মিরার এমন ধাঁচের কথা শুনে ইউভি থতমত খেয়ে বলে,

” কিসব ভাষা এইগুলো মিরা?
মিরা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
— আই চাঁটগার মাইয়া। মানে চিটাগাং এর মেয়ে।
অরিদ তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
” নরমাল ভাবে কথা হলো। এইসব ভাষা বুঝি না আমি।
— দ্যা গ্রেট চৌধুরি ভিলার ছোট ছেলে মি, অরিদ চৌধুরি সাধারন চট্টগ্রামের ভাষা বুঝে না। জাতি কি আপনাকে মেনে নিবে? ইংরেজি দিয়া ভদ্রতা ফলান। কিন্তু যারে বিয়া করছেন হেইর ভাষাত একটা কথা কইবার পারেন না। হেইডা লজ্জার কাম, গর্বের না!
অরিদ সহ্য করতে না পেরে ধমকে উঠে,

” যাস্ট স্টপিড মিরা! আর একটা আঞ্চলিক ভাষা বললে তোমাকে মাটির নিচে রেখে আসব।
মিরা হাসতে হাসতে ভেতরে ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু অরিদের সামনে গম্ভীরতা নিয়ে হলে,
” আপনের এই নষ্ট কতা থেইক্ক্যা অল্পেত্তো বাঁচি যামু!
অরিদ কিছুক্ষন মিরার দিকে ছোট ছোট চোখে তাকায়। এরপর এক প্রকার রাগ দেখিয়ে শুয়ে পড়ে। মিরা ভ্রুঁ নাচিয়ে অরিদের রাগান্বিত মুখটার দিকে তাকায়। এরপর ঠোঁট চেপে শব্দ করে হেসে বলে,
” শুনুন তাহলে আমার অতীত।
অরিদ কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলে,
” প্রয়োজন নেই তোমার অতীত শুনার। যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
— রাগ করেছেন? আরে আমি মজা করছিলাম একটু।
অরিদ শয়নরত অবস্থায় মিরার দিকে রাগান্বিত ভাবে তাকিয়ে বলে,
” সিরিয়াস সময়ে মজা করা একদম পছন্দ নয় মিরা। মজা করার জন্য পুরো সময় পড়ে থাকে।
মিরা হাসি দিয়ে বলে,

” হয়েছে আর রাগ করতে হবে না। উঠে বসুন আমি বলছি।
অরিদ উঠে হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে সাবধান করে দিয়ে বলে,
” খবরদার একটা আঞ্চলিক ভাষা ও মারবে না। অসহ্য লাগে শুনতে।
— বুঝেন না তাই অসহ্য লাগে। যায় হোক আমার কথা শুরু করছি।
মিরা ধীরে ধীরে অরিদকে সব কাহিনী বলতে থাকে। আতিক আর রানবীর মিলে কিভাবে চট্টগ্রামের লোকদের উত্যক্ত করত। কিভাবে তাদের ছেলেরা মেয়েদের জীবন নিয়ে উল্লাস করত? মিরার ফ্রেন্ড নেহা থেকে শুরু করে মিরার সব কাহিনী অরিদকে খুলে বলে। জনি কিভাবে নেহাকে মেরেছে? মিরাকে কিভাবে রে**প করার চেষ্টা চালিয়েছিলো। মিরা দেশ ছেড়ে কানাডায় মামার বাড়ি এসে থাকার কারন। সব এক এক করে অরিদকে বলতে থাকে।
মিরা থামে কিছুক্ষনের জন্য। অরিদ গম্ভীর হয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে আছে।মিরা দেখে অরিদের কার্নিশ লাল হয়ে গিয়েছে। মিরা শ্বাস ফেলে বলে,

” ওইদিন অন্ধকার রুমে মনে হয়েছিলো জনি আমাকে স্পর্শ করতে আসছে। আর বাজে বাজে কাহিনী চোখে ভাসছিলো। রক্তাক্ত নেহাকে অনুভব করছিলাম বার বার। নেহার আর্তনাদ , জনির বর্বরতা সব মিলিয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম প্রচন্ডভাবে।
অরিদ কাঁপা গলায় বলে,
, সেদিন জনি কি তোমাকে স্পর্শ করেছিলো মিরা?
— কেনো? স্পর্শ করে থাকলে ঘৃনা করবেন আমাকে?
অরিদ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
” থাপ্পর খাবে আমার হাতে মিরা। জনি বেঁচে থাকলে আমি ওর কলিজা টেনে নিয়ে আসতাম।
মিরা মুচকি হেসে বলে,

” আমার কাছে কখনো আসতে পারে নি। আমার নাম মিরা নয় অরিদ।
— মানে? তোমাকে তো মিরা নামেই চিনি প্রথম থেকে।
— আমার সঠিক নাম আয়াত। জনির ঘটনার পর যখন কানাডায় আসি পালিয়ে তখন মামা আমার নাম পরিবর্তন করে মিরা রেখে দেয়। যাতে জনি কোনো সন্ধান না পায়। নতুন পরিচয়, নতুন জায়গা সব মিলিত হয়ে আমি মিরা নামেই গড়ে উঠি। আয়াত নামটা চাপা পড়ে গিয়ে এখন মিরা নামেই পরিচিত।
অরিদ — মিসেস মিরা চৌধুরি
মিরা আলতো হাসে। আরেকটা কথা মনে হতেই মিরা কেঁশে বলে,
” আপনাকে আরেকটা কথা জানানোর ছিলো?
— আর কি কথা?
— আপনার মনে আছে একবার আপনারা চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন.?
অরিদ কপাল কুচকে বলে,

” হ্যা, সেটা তো অনেক বছর আগের কাহিনী। তখন আব্বুর নির্বাচনের জন্য একটা কাজে গিয়েছিলাম। বাট তুমি কিভাবে জানো? তোমাকে তো কোনোদিন বলে নি আমি।
মিরা মিটিমিটি হেসে বলে,
” কাঁদায় পড়ে চুবানি খেয়েছিলেন মনে আছে মি, অরিদ চৌধুরি? একটা মেয়ের সাথে ধ্বাক্কা খেয়ে পড়েছিলেন?
অরিদ হা করে তাকায় মিরার দিকে। মিরা অরিদের দিকে ভ্রুঁ নাচিয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে। অরিদ কপাল কুচকে বলে,
” অর্থাৎ?
— অর্থাৎ সে মেয়েটা আমি ছিলাম।
— মানেহহহ? তুমি আমাকে অজান্তে আগে থেকেই জ্বালিয়ে আসছো। তোমাকে আমি অনেক খুঁজেছি। সামনে পেলে ফেলে দেওয়ার অপরাধে থাপ্পর খেতে আমার হাতে।
— সে জন্য’ইত পালিয়েছি। আপনি ছিলেন খাদ্য মন্ত্রীর ছেলে সামনে থাকলে গর্দান যেত।
অরিদ কপাল কুচকে বলে,

” তুমি চিনেছিলে আমাকে?
— চিনেছি দেখেইতো চলে গিয়েছিলাম। বাট অন্য কেউ হলে সাহায্য করতাম।
— হ্যা অন্য পুরুষদের তো সাহায্য করবেই। অন্য লোকদের এই ভালো লাগবে।
— আরে রেগে যাচ্ছেন কেনো? তখন জানতাম না কি আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে। আর বিয়ে হওয়ার পরও ভেবেছি আমাদের ডিভোর্স হয়ে যা…
মিরা কথাটা শেষ করতে পারে নি। অরিদ মিরার ঠোঁটের উপর আঙ্গুল দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। মিরা অরিদের কাতর চোখ দুটির দিকে তাকায়। চোখের মিলন ঘটে দুজনার। অরিদ মিরার কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে হতাশ ভয়েসে বলে,
” ডিভোর্সের কথা কখনো উচ্চারন করবে না মিরা। আমার পাস্ট ছিলো ওইটা। কিন্তু বর্তমানে আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। তোমাকে হারানোর মত ভয় পৃথীবিতে আমার কাছে আর দ্বিতীয়টি নেই।
মিরা মুচকি হেসে অরিদকে জড়িয়ে ধরে। অরিদ ও আবেশের সাথে নিজের ঝগড়ুটে প্রিয়তমাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।

Lake Ontario-র প্রশান্ত জলরাশির কোল ঘেঁষে অবস্থিত Sandbanks Beach । এইটা প্রকৃতির এক অদ্ভুত কারিগরি কুশলতার ফল।যেখানে জল, বালি আর আকাশ মিলে গড়েছে এক অপরূপ ত্রিধাতব ঐক্য। বিস্তীর্ণ, সূক্ষ্মবালুকাময় উপকূলজুড়ে যে নিরবধি সোনালি আচ্ছাদন বিস্তার করেছে। তা শুধুমাত্র প্রাকৃতিক নয় প্রায় অতিপ্রাকৃত মনে হয়। বীচকে দেখলে মনে হয় সূর্য তার শেষ রশ্মি দিয়ে এই তটরেখাকে সোনায় মোড়ানো এক গালিচায় পরিণত করেছে। Barachois-ধর্মী প্রাকৃতিক ডিউন বা বালির ঢিবিগুলো, যেগুলো সময়ের সাথে সাথে বাতাস ও জলের যৌথচাপে তৈরি হয়েছে। সেইসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিদর্শন যা পৃথিবীতে বিরল এবং কানাডার অন্যতম রক্ষিত ভূ-আকৃতি।

তটরেখা এত দীর্ঘ ও উন্মুক্ত যে কোনো নির্জন প্রহরে একা হাঁটতে হাঁটতে মনে হয় এক বিশাল ধুসর-বর্ণ স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ করছে। যেখানে কেবল ঢেউয়ের কলরব আর বাতাসের শিস বাজে। এখানে জল এতটাই স্বচ্ছ। পানি কোন রঙহীন কাঁচে আকাশ প্রতিফলিত হয়ে নিজেকেই ফিরে দেখছে। তরঙ্গগুলি ক্ষুদ্র অথচ ধারাবাহিক একটি চুম্বকের মতো তটরেখায় এসে বারবার ছুঁয়ে যায় বালির সীমানা
আবার ফিরে যায় নিঃশব্দে, বিনয়ের সাথে।

বিছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সৈকত ঘেঁষা beachgrass ও cottonwood গাছগুলো সেই একান্ত দর্শক। যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জলের ওঠানামা ও মানুষের পদচিহ্ন পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। আর দূরের আকাশের রঙ বদল, ক্লাউডফর্মেশনের অলঙ্ঘ্য মহড়া সূর্যাস্তের আগে এক ক্ষণিক চিত্রনাট্য হয়ে উঠে। সন্ধ্যায় সূর্য যখন হ্রদের জলে নিজেকে ডুবিয়ে দেয় তখন চারদিক সোনালি, কমলা ও লালাভ আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। সৈকতের বালি এক মুহূর্তের জন্য আগুনের চেয়ে কম উজ্জ্বল নয়। আর সেই বালির উপর যদি কোনো মানব – মানবী দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে যেন সৌন্দর্য আরও কয়েক গুন বৃদ্ধি পায়। মাফিয়া বস অন্ধকারে ঢেকে থাকা তাঁরা গুলির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইয়ানা তার বাহুতে আবদ্ধ হয়ে আছে। সে ও সেই দিকে দৃষ্টি রাখে। ইয়ানা সেদিকে তাকিয়ে মোহিত হয়ে বলে,
” তাঁরা গুলো খুব সুন্দর তাই না মি, চৌধুরি?

— হুম।
ইয়ানা ভোঁতা মুখে অগ্নির দিকে তাকায়। ইয়ানাকে এমনভাবে তাকাতে দেখে অগ্নি ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,
” এত সুন্দর পরিবেশে এসেও মুখটা এমন করে রেখেছো কেনো? তুমি নিজেই তো বললে জায়গাটা খুব সুন্দর।
— যখন আমি বলেছি তাঁরাগুলো খুব সুন্দর তখন আপনি যাস্ট হুম বললেন কেনো? বউয়ের প্রসংশা আসে না মুখ দিয়ে।
— কি প্রসংশা করব শুনি?
ইয়ানা লাজুক হাসি দিয়ে বলে,
” বলতে পারতেন তাঁরা গুলো ঠিক তোমার মত সুন্দর।
— কিন্তু আমি তো এইটা বলব না।
ইয়ানা ফুঁসে উঠে,
” তার মানে আমি সুন্দর নয়?
অগ্নি গম্ভীর হেসে ইয়ানাকে নিজের সামনে দাড় করায়। এরপর ইয়ানার উচু পেটের উপর নিজের আর ইয়ানার হাত রাখে। ইয়ানাকে তাঁরার দিকে তাকাতে বলে। অগ্নির কথা অনুযায়ী ইয়ানা তাকায় সেদিকে। অগ্নি সবসময়কার মত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,

” তাঁরার কি হাত – মুখ – চোখ আছে যে তোমার সাথে তুলনা করব?
ইয়ানা বোকা বনে যায় অগ্নির বাস্তবাদী কথা শুনে। এইটা তো যাস্ট ভালোবেসে সৌন্দর্যের মিলন ঘটায় তুলনা করে। তাই বলে চাঁদের মধ্যেও নাক- মুখ খুঁজতে যাবে এই সাইকো লোক!
— তুমি তাঁরা হয়ত নও কিন্তু আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী রমনী তুমি। তোমার সৌন্দর্যের কাছে তাঁরার ঝলকানি কিছুই নয়। তাঁরাদের সৌন্দর্য বর্ননা করা যায় , অনুভব করা যায় কিন্তু তোমার সৌন্দর্য অনুভব তো দুরের থাক আমাকে স্তব্দ করে দেয়। মহা দেশে যে সৌন্দর্যের কোনো বর্ননা হয় না ঠিক তেমন সুন্দর তুমি। আমার দেখা সবচেয়ে ভালো মেয়ে তুমি। আমার অশান্ত হৃদয়ের প্রশান্তি তুমি। আমার অর্ধাঙ্গীনি, আমার সম্রাজ্ঞী, আমার বাচ্চাদের মা তুমি। সর্বশেষে অগ্নি চৌধুরির বেঁচে থাকার এক মাত্র অবলম্বন তুমি বউ।

অগ্নির প্রতিটা কথা ইয়ানাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে তুলে।কে বলেছে ইতিহাসে মাফিয়ারা খারাপ থাকে? কে বলেছিলো তারা নিষ্ঠুর প্রজাতির হয়? এই”ত আমার সামনে মাফিয়া বস অগ্নি চৌধুরি দাঁড়িয়ে আছে। যে নিজের স্ত্রীর সৌন্দর্য এমনভাবে দিয়েছেন যার কোনো সারমর্ম হয় না। ভিলেনরা ভালোবাসতে জানে যদি তাদের ভালোবাসা কেউ গ্রহন করে। ইয়ানা নিজেকে সামলাতে না পেরে অগ্নির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অগ্নি মুচকি হেসে নিজের সাথে আগলে নেয়।
— আমাদের এত বছরের সংসারে এই প্রথম আপনি আমার বর্ননা দিয়েছেন অগ্নি চৌধুরি। ভালোবাসি কথাটা কবে বলবেন ? সেটাও বলে দিন না।
অগ্নি — উহুম ভালোবাসি না আমি তোমাকে।
ইয়ানা অগ্নির বুক থেকে মাথা তুলে রেগ তাকায়। এরপর নিজের পেটে ইশারা করে বলে,

” এখানে দুটি আছে। ভালো না বাসলে কিভাবে আসলো শুনি?
অগ্নি ইয়ানার পেটে এক পলক তাকিয়ে ইয়ানার রাগান্বিত মুখটার দিকে তাকায়। এরপর ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
” বউ যখন আমার বাচ্চা আসাটাই স্বাভাবিক।
ইয়ানা ছোট – ছোট চোখ করে তাকিয়ে অগ্নির কথা বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝতে সে ব্যার্থ হয়। সে বর্তমানে এই পরিবেশটা উপভোগ করতে চায়। তাই সব রাগ উপেক্ষা করে বলে,
” চলুন বালিতে হাটা- হাটি করি। নিজের জুতোজোড়া খুলে ফেলুন দ্রুত।
অগ্নি নাক কুচকে বলে,
” অসম্ভব! খালি পায়ে আমি হাটতে পারি না।
— আমি বলছি না খুলার কথা। ইয়াজ আর আনায়া বলছে পাপার জুতাগুলো যাতে খুলে দেই।
অগ্নি ইয়ানার ঠোঁট উল্টে কথাগুলো শুনে শব্দ করে হেসে উঠে। ইয়ানা এক দৃষ্টিতে অগ্নির দিকে তাকিয়ে থাকে। অগ্নি হাসি থামিয়ে বলে,

” আমার বাচ্চারা বলল অথচ আমি শুনতে পেলাম না হুম।
— আপনার প্রানবন্ত হাসি কি সুন্দর অগ্নি চৌধুরি। একটু হাসলে কি এমন ক্ষতি হয়।
ইয়ানার কথা কানে প্রবেশ করতেই অগ্নি গম্ভীর হয়ে আসে। ইয়ানা কথাটা আনমনে বলে ফেলেছিলো। অগ্নির দিকে তাকাতেই দেখে অগ্নি নিজের পায়ের সুজগুলোর ফিতা খুলছে।
— আমি বলেছি তখন অসম্ভব। আর যখন বাচ্চারা বলেছে তখন মাফিয়া বস এক চুটকিতে অসম্ভব কাজ সম্ভব করে ফেলছে।
অগ্নি জুতা খুলে বসা থেকে দাঁড়িয়ে ইয়ানার মুখে ফুঁ দিয়ে বলে,

” তিন জনের মনের আশা পুরন করেছি। বাচ্চার মা নিজেকে প্রশ্ন করুক কার কথা শুনে জুতা খুলেছি।
— প্রশ্ন করতে হবে না জানি আমি।
অগ্নি বালিতে পা রেখে পুনরায় আবার তুলে নেয়। বিরক্তি নিয়ে বলে,
” অভ্যস্ত নয় আমি ইয়ানা। হাঁটব কিভাবে আমি?
— সবসময় আমি আপনার হাত ধরে হাঁটি আজ নাহয় আমার হাত ধরে হাঁটতে থাকুন।
অগ্নি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকায়। অগ্নিকে চারপাশে তাকাতে দেখে ইয়ানা বলে,
” কি হলো চলুন আমার সাথে।
অগ্নি গম্ভীর হয়ে বলে,

” হুম চলো।
অগ্নি ইয়ানার হাতের উপর হাত রেখে বালির উপর পা দেয়। প্রথমে অস্বস্তি লাগলে ও খোলা আকাশের নিচে ইয়ানার পাশা – পাশি হাটতে থাকে। ইয়ানা হেসে অগ্নির দিকে তাকায়। দুজনের দৃষ্টি বিনিময় করে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।
নির্জন সমুদ্রতটে রাতের নিস্তব্ধতা যেন এক অলিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।নীরব, অথচ গভীরভাবে সংবেদনশীল। চাঁদের আলো ক্ষীণভাবে বালুর ওপর পড়ছে আর তার প্রতিফলনে দু’টি ছায়া। একজন মাফিয়া বস আর তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তারা পাশা-পাশি হাঁটছে যেন এক অদ্ভুত নিঃশব্দতা ভেদ করে জীবনের গভীরতম সত্যের মুখোমুখি হচ্ছে তারা। বাতাসে লবণাক্ততার গন্ধ, দূরে ঢেউয়ের ঘূর্ণি, আর সেই প্রাকৃতিক সঙ্গীতের মাঝে তাদের হাঁটার ধ্বনি সমস্ত কিছু মিলে এক অন্তর্নিহিত নাটকীয়তা সৃষ্টি করছে। অগ্নির কড়া মুখাবয়বেও এক ধরনের কোমলতা স্পষ্ট।

ইয়ানার প্রতি এক অপার্থিব স্নেহ ছড়িয়ে আছে তার দৃষ্টিতে। এই মুহূর্তে তিনি কেবল অপরাধজগতের এক নির্মম চরিত্র নন তিনি একজন আগামীর পিতা, তিনি একজন স্বামী। হুট করে চারদিকে গুলির শব্দে ইয়ানা ভয়ে অগ্নিকে ঝাঁপটে ধরে। অগ্নি ইয়ানাকে নিজের বাহুডরে আগলে নিয়ে নিজের গার্ডদের বার্তা পাঠিয়ে দেয়। সে অনেক আগে থেকেই বুঝতে পারছে তাদের কেউ ফলো করছে। তাই জুতার ফিতা খুলার অযুহাতে গার্ডদের বার্তা পাঠিয়ে দেয় । অগ্নি প্যেন্টের পিছন থেকে একটা বন্ধুক হাতে তুলে নেয়। ইয়ানাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে সামনে তাকায়। দুইটা গাড়ি এসে একদম তাদের সামনে দাঁড়ায়। অগ্নি কপাল কুচকে গাড়ির দিকে তাকায়। গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে দুই জন ব্যক্তি। তাদের দেখে অগ্নির কপালের ভাঁজ প্রসারিত হয়। দুইজন ব্যক্তি বুক টান টান করে পৈশাচিক হাসি দিয়ে সামনে দাঁড়ায়। একজন হাসি দিয়ে বলে,

” আমার ছেলে জনিকে মেরে , আমার প্রতিনিয়ত হুমকিস্বরুপ মেসেজ দিয়ে ভয় দেখানো। আমাদেরকে বোকা বানাতে তো আপনি একদম পাক্কা মাফিয়া বস অগ্নি চৌধুরি।
— আমাদের ব্যাংক খালি করে ছন্নছাড়া ও বানিয়ে দিতে আপনি একদম মহানায়েক অগ্নি চৌধুরি।
অগ্নি বাঁকা হাসে । এরপর এক হাত দিয়ে ইয়ানাকে নিজের পিছনে দাঁড় করিয়ে আড়াল করে গম্ভীর আওয়াজে বলে,
” ছন্নছাড়া আর করতে পারলাম কোথায়? মাত্র তো ব্যাংক খালি করেছি তদের কলিজা এখনও টেনে নিয়ে আসা বাকি।
রানবীর — বেইমান মা****! ছোট থেকে বড় করেছি আমরা তকে। আমাদের দৌলতে আজ তর সিংহাসন। আর তুই আমাদের পিঠে ছুরি মারলি?
অগ্নি উচ্চস্বরে হেসে উঠে। চারপাশে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলে,

” গলা নিচে ব্লাডি বিচ! আমি থেকেছি তাই তরা রেখেছিস। আর আমি থেকেছি তদের দেউলিয়া করতে। তদের মারার আগে সব কাহিনী বলব চাপ নিস না। কেনো তরা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু।
আতিক বন্ধুক নিয়ে তেঁরে যায় অগ্নির দিকে।
— শু***য়রের বাচ্চা তকে আজ খুন করব। ভাইয়ের মত করে বড় করেছি।
— নিজের স্বার্থে। ভেবেছিলে আমি যদি সিংহাসন পায় তাহকে তরা নিজে দখল করবি। কিন্তু বলতে পারলি না ভয়ে। আমাকে অনেকবার মারার ওত নকশা করেছিস আতিক?
রানবীর অগ্নির পিছনে উকি দিয়ে বলে,
” তাহলে রক্তের স্রোত আজ একজনের হবে না এক সাথে দুইজনের হবে। তুই বাপ হবি মিষ্টি খাওয়ালি না অগ্নি? তর বউটা কিন্তু ভীষন সুন্দর।
রানবীরের কুদৃষ্টি অনুভব করতে পেরে অগ্নি রাগে হুংকার দিয়ে উঠে,

” খবরদার কুত্তার বাচ্চা। তর নোংরা দৃষ্টি আমার স্ত্রীর উপর দিবি না। চোখ তুলে নিয়ে আসব।
আচমকা আরেকটা গুলির আওয়াজে সবাই স্তব্দ হয়ে যায়। ইয়ানা চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠে। গুলিটা একদম অগ্নির বুকে এসে লাগত কিন্তু অগ্নি তার আগেই সরে যায়। অগ্নিকে অক্ষত দেখে যেন ইয়ানার জীবন ফিরে আসে।
অগ্নি ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে,
” তুমি আমার গাড়িতে গিয়ে বসো ইয়ানা। ওই যে আরিফকে দেখতে পাচ্ছো সে থাকবে তোমার পাশে। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আসছি। কোনো ভয় পাবে না ওকে।
ইয়ানা অগ্নির শার্ট চেপে ধরে বলে,

” যাব না আমি আপনাকে এখানে রেখে। ওরা আপনার ক্ষতি করে দিবে। আপনি একা আর তারা অনেক জন। মরলে এক সাথে মরব। তবুও আপনাকে একা রেখে যাব না।
ইয়ানার জেদ দেখে অগ্নি রেগে ধমক দিয়ে বলে,
” তোমাকে আমি যেতে বলেছি ইয়ানা। নাহলে এই সমুদ্রে আমি তোমাকে চুবিয়ে মারব ইডিয়েট। হাজার জন গার্ডের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা অগ্নি চৌধুরির আছে কিন্তু তোমাকে সাথে নিয়ে একজনের সাথে লড়াই করার ক্ষমতাও নেই।
ইয়ানা কেঁদে উঠে। অগ্নি সামান্য নমনীয়তা দেখিয়ে বলে,
” আমার কথাটা একটু শুনে ফেল জান। বাড়ি গিয়ে হাজার জেদ দেখাস কিছু বলব না। এখন প্লিজ আরিফের সাথে চলে যা। গার্ডগুলো সব আমার। আতিক, রানবীর কিছু করতে পারবে না।
অগ্নি ইয়ানাকে আড়াল করে আরিফের কাছে পাঠিয়ে দেয়। রানবীর আর আতিক গাড়ি থেকে কিছু কাগজ পত্র বের করে পুনরায় অগ্নির সামনে আসে। অগ্নিকে একা রহস্যময় হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের কপাল কুচকে আসে।

— তর বউ কোথায়?
— কলিজার ভেতরে ডুকিয়ে দিয়েছি যাতে শকুনের দৃষ্টি না পড়ে।
অগ্নি কথাটা বলেই চোখ- মুখ শক্ত করে ফেলে। দুই ঠোঁট দিয়ে গার্ডদের উদ্দেশ্যে শিষ্ দেয়। শিষ্ বাজানোর সাথে সাথে চোখের পলকে পুরো বীচ রক্তাক্ত হয়ে পড়ে। আতিকদের সব গার্ড রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
অগ্নি লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
” কি ভেবেছিস ডিটার্জেন্ট খেয়ে মাফিয়া বস হয়েছি। তর বলা প্রত্যেকটা কথাও কেউ রেকর্ড করে ফেলছে। অগ্নি চৌধুরি কোনো জায়গায় পা রাখলে সেখানে সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে রাখে। তরা যদি চলে থাকি ঢালে ঢালে আমি চলি পাতায় পাতায়। একা বউকে নিয়ে বের হওয়ার প্রশ্নেই আসে না। নিজের চারদিকে তাকিয়ে দেখ আতিক আর রানবীর।
আতিক আর রানবীর চারদিকে তাকায়। তাদের চারদিকে বন্ধুক তাক করে রেখেছে শত শত গার্ড। তারা ভয়ে জমে উঠে। কিন্তু পর মুহূর্তে পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,
” আমাদের মেরে ফেললেও তর বউ – বাচ্চাকে বাঁচাতে পারবি তো অগ্নি? আমাদের মারতে মারতে তর সন্তান আর বউ ফিনিশ।
অগ্নি বন্ধুক নিচে নামিয়ে নেয়। কাঁপা গলায় বলে,

” ক.. কি করেছিস তরা মাদার্ফাকারের বাচ্চা? আমার স্ত্রীর উপর সামান্য আঘাত লাগলে ও জ্বালিয়ে দিব তদের। আই ক্যান ইন-ডিউর এভ্রি-থিং, বাট আই ক্যা-নট টল-অরেট ইভেন আ সিঙ্গল ব্লো টু মাই ওয়াইফ।
আতিক পৈশাচিক ভাবে হেসে উঠে। অগ্নির চোখ দুটি জ্বলে উঠে। জেগে উঠে সেই ভয়ানক অগ্নি চৌধুরি। যার কাছে রক্ত এক অমুল্য সম্পদ। লোকের দেহকে ছিন্ন- বিচ্ছন্ন করে পৈশাচিক তৃপ্তি মেটায়। অগ্নির চোখের কার্নিশগুলো লাল আকার ধারন করে। নিজের বোধ শক্তি হারিয়ে আতিক আর রানবীরের বুকে একটা বুলেট ছুড়ে মারে। এরপর পায়ে হাতে অনেকগুলো গুলি বসিয়ে দেয়। অগ্নির আচমকা আক্রমনে তারা সাথে সাথে বসে যায়। তারা তো ভেবেছে অগ্নি দুর্বল হয়ে যাবে আর সেটার ওই সুযোগ নিবে তারা। অগ্নি দাঁত পিষে গার্ডের উদ্দেশ্যে গর্জন করে উঠে,
” এই দুই শুয়রের বাচ্চাকে টর্চার সেলের সবচেয়ে ভয়ানক কক্ষে নিয়ে যাও। তারা মৃত্যুর জন্য ছটফট করবে কিন্তু উপর ওয়ালা ছাড়া কেউ জান নিতে পারবে না। সবচেয়ে নরকময় যন্ত্রনা দিব এদের।

অগ্নি কথাটা বলে সোজা চলে যায় ইয়ানার উদ্দেশ্যে। নিজের গাড়ির কাছে গিয়ে স্তব্দ হয়ে যায়। আরিফ রক্তাক্ত হয়ে গাড়ির এক পাশে পড়ে আছে। হাত দিয়ে বার বার গাড়ির ভিতরে ইশারা করছে। আচমকা ইয়ানার চিৎকার কানে বাজতেই অগ্নি নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলে। আরিফের রক্তাক্ত শরীর ভিতরে মুচর দিয়ে উঠে। ইয়ানার পর পর চিৎকার অগ্নির কানে বাজতেই থাকে। অগ্নি উন্মাদের মত আরিফের কাছে যেতেই আরিফ রক্তাক্ত ঠোঁট নিয়ে বলে,

” ভ.. ভাই ভিতরে ভাবি। বাঁচাও দ্রুত।
অগ্নি উঠে যায় গাড়ির কাছে। ইয়ানা ব্যাক সিটে এক পাশে আছে। আর অন্য পাশে ঝর্না আর রায়হান ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। ইয়ানা পেটে হাত দিয়ে চোখ- মুখ বন্ধ করে রেখেছে। অগ্নি দাঁত খিঁচে রায়হানের শার্টের কলার খামচে ধরে গাড়ি থেকে বের করে নিয়ে আসে। রায়হান তাকানোর আগেই অগ্নি একটা ছুঁরি দিয়ে রায়হানের মুখের উপর কুঁ**পাতে থাকে। চোখ গলে যায়, ঠোঁট, নাক সব জায়গায় আঘাতে ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রায়হানের আর্তনাদ যেন বর্তমানে পৈশাচিক শান্তি। অগ্নি জনির বুকের মাঝখানে একাধারে ছুঁরিঘাত করে চিৎকার করে উঠে,

” কুত্তার বাচ্চা তর সাহস কি করে হলো ওদেরকে আঘাত করার? শালা মাদার্ফাকার তদের বাপ- বেটার জীবন নরকে বানিয়ে ছাড়ব আমি। যে ভাইয়ের শরীরে আমি কোনোদিন আঘাত করে নি তাকে তুই রক্তাক্ত করেছিস? যে স্ত্রীকে সামান্য থাপ্পর দিলে নিজে দ্বীগুন আঘাতের কষ্ট সহ্য করি তুই তাকে আঘাত করেছিস হ্যা? শু*** বাচ্চা!
অগ্নির পাগলাটে পর পর ছুঁড়ির আঘাতে রায়হান চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারায়। অগ্নি থামে কারন তাদের একবারে জানে মারবে না তিলে তিলে মারবে। তারা ভেবেছিলো অগ্নি আর ইয়ানা একা বের হয়েছে তাই এ্যাঁটাক করেছে। কিন্ত অগ্নির লোকায়িত গার্ডদের সম্পর্কে ধারনা ছিলো না তাদের। অগ্নি রায়হানের রক্তাক্ত শরীরের উপর থুঁ- থুঁ দিয়ে উঠে। গার্ডাদের উদেশ্যে বলে,

” ইমার্জেন্সি আরিফকে নিয়ে হসপিটালে এডমিড করাও। আমার ভাইয়ায়ের যাতে কিছু না হয়। আমার জন্য সে রক্তাক্ত হয়েছে প্লিজ আমার ভাইয়ের যাতে কিছু না হয়।
গার্ডরা অগ্নির কথামত রক্তাক্ত আরিফকে কাঁধে তুলে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। অগ্নির গাড়ির দরজা খুলতেই ঝর্নাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে রেগে যায় আরও। অগ্নি ঝর্নার গলায় চেপে ধরবে তার আগেই ইয়ানা বলে,
” ওকে কিছু করবেন না। ঝর্নার কারনে আজ আমি বেঁচে আছি। রায়হান আমাকে আঘাত করতে আসলে ঝর্না সেই আঘাতের সম্মুখীন হয়।

অগ্নি অবাক হয় ইয়ানার কথা শুনে। ইয়ানা হাঁপাচ্ছে। ব্যাথায় পেট ছিঁড়ে যাচ্ছে। তার পরও দাঁত চেপে সহ্য করে অগ্নির দিকে তাকিয়ে আছে। ঝর্না নিভু নিভু চোখে অগ্নির দিকে তাকায়। অগ্নির গাল স্পর্শ করতে চায় কিন্তু পারে না। ঝর্না হাসি দিয়ে বলে,

” জীবনে অনেক পাপ করেছি অগ্নি। ইয়ানাকে শেষ করতে রায়হানের সাথে অনেক চুক্তি করেছি। আশা করি তুমি সব জেনে গিয়েছো বা আগে থেকেই জানো। আমি তোমার – ইয়ানার বিচ্ছেদ চেয়েছিলাম কিন্তু খুন নয়। আমি খারাপ কিন্তু আমার ভালোবাসা খারাপ ছিলো না। যখন ছোট ছিলাম তখন মাম্মি গল্প বলত আহান চৌধুরি নামক একজন ছেলে আছে সাজিদ চৌধুরির। তার সাথে একদিন আমাকে বিয়ে দিবে। ছোট থেকে তাকেই মন – প্রান দিয়ে রেখেছে। বড় হয়ে যখন তোমার মুখো- মুখি হয়েছি ভালোবেসে ফেললাম। শিশু মনে গড়ে উঠে আবেগ যেন ফুটন্ত হয়ে উঠেছিলো। কিন্তু যেদিন তোমার বিয়ের খবর শুনেছি এরপর থেকে বরবাদ হতে শুরু করি। সব নেশা করেছি ভুলে যেতে কিন্তু পারছিলাম না। ইয়ানাকে দেখে রাগ হত। ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলাম আমার ভালোবাসা। সেজন্য রায়হানের সাথে হাত মিলিয়েছি। পরে জানতে পারলাম রায়হান তোমার বড় শত্রু। সে তোমাকে মারতে চায় আমাকে ঢাল বানিয়েছে। বোকা বানাচ্ছিলো। তোমাকে যে মারবে তাকে কিভাবে সহ্য করব বলো। ভালোবাসি তো তোমাকে খুব। এতদিন লাপাত্তা ছিলাম ভুলে থাকার জন্য। কানাডায় ফিরে রায়হানের পিছু নেয়। এরপর এখানে বীচে চলে আসি। তোমার সন্তানের ক্ষতি আমি হতে দেয় নি অগ্নি। উহুম ইয়ানাকে বাঁচায় নি কিন্তু। ইয়ানা যদি একা হত তাহলে কোনকদিন ও বাঁচাতাম না। কিন্ত ওর পেটে তোমার সন্তান ছিলো। নিজে সন্তানকে হারিয়ে তুমি তো মরে যাবে।

যাকে ভালোবাসি তার নিরব চিৎকার কিভাবে সহ্য করব বলো।
ঝর্না থেমে আবার ও কান্না করে উঠে,
” এক পাক্ষিক ভালোবাসা মৃত্যুর থেকে ও ভয়ানক। যা তোমার হৃদয়কে ক্ষনে ক্ষনে রক্তাক্ত করে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলবে। আমি ও হেরে গেছি সেই ভালোবাসার কাছে। কিন্তু হেরে গিয়ে ও শান্তি অনুভব করছি তার অস্তিত্বকে রক্ষা করে একটা ভালো কাজ তো করেছি। আমাকে ক্ষমা করেছো তো অগ্নি?
অগ্নি ঠোঁট ভিজিয়ে গম্ভীরতা টেনে বলে,
” তোমাকে হসপিটালে নিতে হবে ঝর্না।
ঝর্না মলিন হেসে বলে,

” এতক্ষনে শরীর থেকে সব ব্লাড মেবি বের হয়ে গিয়েছে। বাঁচব না আমি আর অগ্নি। শুধু মিষ্টি সুরে একটা কথা বলবে? প্লিজ অগ্নি একটু শুনতে চাই।
— ঝর্না কেনো পাগলামো করছো। ক্ষমা করে দিয়েছে আমি তোমাকে। হয়ত কখনো কাউকে ক্ষমা করার রেকর্ড আমার নেই কিন্তু তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
ঝর্না অগ্নির হাতে স্পর্শ করে বলে,
” জন্ম জন্মান্তর বলতে কিছু নেই নাহলে এক জন্মে অন্তত তোমার ভয়ংকার ভালোবাসার সঙ্গী হতাম। পরকালে যাতে তোমার সাথে আমার দৃষ্টি বিনিময় হয় অগ্নি।
অগ্নি সব কিছু বাদ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে পড়ে। যে কোনো মুল্যেই এখন হসলিটালে পৌঁছাতে হবে। অগ্নি গাড়ি স্ট্রাট দিবে এমন সময় ইয়ানার চিৎকারে স্তব্দ হয়ে যায়।

— ঝর্না আপু চোখ খুলো প্লিজ। তুমি এইভাবে চলে যেতে পারো না। তুমি ভালো হবার সুযোগ পাবে। আমার সাথে থাকবে তুমি আমার বোন হয়ে। প্লিজ চলে যেও না।
অগ্নি নিস্তেজ কন্ঠে বলে,
” ঝর্নার শ্বাস কি বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইয়ানা?
ইয়ানা ডুকরে কেঁদে উঠে,
” কথা বলছে না। চোখ বন্ধ করে ফেলেছে।
অগ্নি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
” তুমি ঠিক আছো?
অগ্নির বলা বাক্যটা হয়ত ইয়ানা শুনতে পায় নি। নিজের পেটে ধরে ছটফটিয়ে উঠে।
— আয়াহহহহহহ!

আচমকা ইয়ানার চিৎকারে অগ্নি পাগলের মত ছুটে যায় তার কাছে। দরজা খুলে ইয়ানার দিকে তাকাতেই আৎকে উঠে। ইয়ানার পুরো কাপড় ব্লাডে লাল হয়ে গিয়েছে। অগ্নির শ্বাস আটকে রাখে।
— ত… তুমি আঘাত পেয়েছিলে?
ইয়ানা মুখ খিঁচে বলে,,
” হ্যা। রায়হান আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলো।

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৩

অগ্নি অস্থির হয়ে উঠে। তারা হসপিটাল থেকে অনেক দুরে। এখান থেকে হসপিটালে পৌঁছানোর আগেই ইয়ানার ডেলিভারি করাতে হবে নাহলে সে কোনো আঘটন ঘটে যাবে। অগ্নি চুল খমচে ধরে। ইয়ানার পর পর চিৎকার করে উঠছে। অগ্নি সহ্য করতে পারছে না এই শব্দগুলো। হৃদয়ে রক্তক্ষরন হচ্ছে ভীষনভাবে সে ইয়ানাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। ইয়ানক্র যন্ত্রণাকাতর শরীর তাকে কাঁপিয়ে তুলছে। প্রসববেদনার প্রথম ঢেউ যেন তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে উদ্যত। মুহূর্তেই তার মস্তিষ্কে বজ্রাঘাত হলো। যে শহরের প্রতিটি গলির মালিকানা নিয়ন্ত্রণ করে। তার হুংকারে কেঁপে উঠে পুরো শহর। আজ সে মাফিয়া বস বার বার কেঁপে উঠছে। তার চোখে যন্ত্রণা। ইয়ানার আর্তনাদ ছিলো তার কাছে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কর্কশ আর অবর্ণনীয় শব্দ।

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৪ (২)