অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৫

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৫
লিজা মনি

সময়ের প্রবাহ অনির্বচনীয়। এটি কোনোদিন কারো জন্য অপেক্ষা করে না। জগতের যাবতীয় সৃষ্টি, বিনাশ এবং পুনঃসৃজন এই সময়ের অমোঘ নিয়মের অধীন। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংযোগসূত্র হিসেবে সময় এক মহাজাগতিক ধারক ও বাহক রূপে বিবেচিত। মানুষ যতই প্রগতি লাভ করুক না কেন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে সে ইতিহাসের পাতায় বিস্মৃত হয়। সময়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে ব্যক্তি যেমন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তেমনি জাতিও চরম অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয়। অতএব, সময়ের অপচয় নয় বরং যথোপযুক্ত ব্যবহারে মনোনিবেশ করাই হিতকর। সময় এগিয়ে চলে তার আপন গতিতে নির্দয়, নিরবধি, অপরিবর্তনীয় নিয়মে। সময় নিজ গতিতে এক মাস কেটে যায়।

ইয়ানা এখন পুরোপুরিভাবে সুস্থ। মেয়েটার মাথায় সামান্য আঘাত লেগেছে তাই এক সপ্তাহ চিকিৎসার মধ্যে ছিলো। এখন সম্পূর্নভাবে সুস্থ। আরিফকে পনেরো দিনের মাথায় বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। আরিফ নিজের বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু অগ্নি যেতে দেয় নি। এখন আরিফ অগ্নির বাসভবনে থাকছে। সে সম্পূর্নভাবে এখনও সুস্থ নয়। অতিরিক্ত ব্লাড যাওয়ার ফলে শরীরের দুর্বলতা এখনও কাটে নি। সবাই নিজের পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সুমুর ও ডেলিভারির সময় চলে আসছে ধীরে ধীরে। তার শরীরের কন্ডিশন ও বেশি ভালো না। ইয়ানার অবস্থা দেখে রায়ান ও প্রচুর দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সর্বক্ষন নিজের চোখে চোখে রাখছে। অরিদ আগে মিরার কাছে এসে পাগলামো করত একটা বাচ্চার জন্য।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু ইয়ানাকে দেখার পর তার পাগলামি ও কমে গিয়েছে। তারও বাচ্চার প্রয়োজন নেই। যেভাবে আছে সেভাবেই তারা দুজন ঠিক আছে। যদি মিরার তার চেয়ে ও বেশি কিছু হয়ে যায়! তখন কি করবে সে?
এখন সকাল আটটা। দিবাকরের প্রাবল্যে আলোকিত ভূপ্রকৃতি আপন বৈভবে উদ্ভাসিত। সর্বত্র পরিলক্ষিত হয় এক অপার প্রশান্তি ও ঐন্দ্রিক কল্যাণের সুষম সমাহার। নিসর্গের লীলাবিলাসে উদিত সূর্য যেন প্রভাতবেলার ধ্যানমগ্ন ঋষির ন্যায়। দিগন্তরেখায় স্থিত একাগ্র দৃষ্টিতে সমগ্র চরাচরকে আশীর্বাদ করতে ব্যতিব্যস্ত। আলসেমি অপসারিত হওয়ায় প্রকৃতির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেন সচল ও সজীব। গগনে বিহাররত পাখিকুলের সম্মিলিত কলতান শ্রবণেন্দ্রিয়কে মোহিত করে তোলে। মননশীল মানবসমাজ ধীরে ধীরে কর্মযাত্রায় প্রবৃত্ত হচ্ছে । গৃহকোণে প্রজ্বলিত ধূপের সুবাস, স্তবপাঠের ধ্বনি, এবং স্নিগ্ধ আলোয় মগ্ন মুখাবয়ব প্রত্যেকটি হৃদয়কে এক অভ্যন্তরীণ জাগরণে উদ্বুদ্ধ করে।

শিশিরসিক্ত তৃণরাজি প্রভাতসূর্যের কিরণে যেন হিরন্ময় দীপ্তি ধারণ করে মহিমামণ্ডিত হয়েছে এই পবিত্র প্রভাত মুহূর্ত যা মোহমুক্ত চিত্তের অন্বেষায় আত্মনিবেদন করবার শ্রেষ্ঠতম কাল।প্রকৃতি ও মানবের সহাবস্থানে অনন্ত সত্য ও সৌন্দর্যের সন্ধান দান করে। সেই মনোমুগ্ধকর সকালে বেডের মধ্যে শুয়ে আছে অগ্নি চৌধুরির তিন প্রান। বাচ্চা দুইটা ঠোঁট উল্টে শুয়ে আছে। পাশে বাচ্চাদের মা হাত – পা ছড়িয়ে- ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে। অগ্নি জিম করে রুমে ডুকে এত সুন্দর একটা দৃশ্য দেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। এরপর বিছানার কাছে গিয়ে বাচ্চাগুলোর কপালে চুমু খায়। বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ইয়ানার মলিন মুখটার দিকে তাকায়। গলায়, ঠোঁট সব খানে তার দেওয়া চিহৃগুলো জ্বলজ্বল করছে। অগ্নি সেই স্পর্শগুলোর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। অগ্নি কিছুক্ষন ইয়ানার দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

প্রায় পনেরো মিনিট পর শাওয়ার শেষ করে বের হয়। সবাই আগের মত’ই ঘুমিয়ে আছে। অগ্নি সেদিকে তাকিয়ে জানালার কাছে গিয়ে পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়। জানালার কাউচ ভেদ করে সূর্যের আলো রুমে প্রবেশ করতেই ইয়ানা কপাল কুচকে ফেলে। এর মধ্যেই মেয়েটা কান্নার শব্দের মত গুন গুন করে উঠে। মেয়ের গুন গুন শুনে অগ্নি দ্রুত মেয়ের কাছে আসে। সে পৌছানোর আগেই মেয়েটা উচ্চস্বরে কান্না করে উঠে। বুকের উপরে রাখা টাওয়েলটা ফেলে দেয়। মেয়ের কান্নার আওয়াজ কানে যেতেই ইয়ানা পিটপিট করে চোখ তুলে তাকায়। অগ্নি খুব যত্নসহকারে কোলে তোলে নেয়। ছেলেটাও ইতিমধ্যে উঠে পড়ে। তবে সে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে। ইয়ানা ঘুম ঘুম চোখে নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে উঠতে যাবে এমন সময় ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠে। চোখ- মুখ খিঁচে আবার আগের ন্যায় শুয়ে পড়ে। পুরো শরীরে প্রচন্ডরকম ব্যাথা। ইয়ানাকে আর্তনাদ করতে দেখে অগ্নি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
” বেশি ব্যাথা করছে জান? পেইন কিলার খাইয়ে দিয়েছি একটু পর কমে যাবে।
ইয়ানা কটমট করে তাকায় অগ্নির দিকে।

— সারারাত মনে থাকে না ঘুম থেকে উঠে ব্যাথা পাব, নাকি পাব না?
– কোম্পানি পরিচালনা করা আমার দায়িত্ব।
– আমি আপনার জন্য কোম্পানি?
অগ্নি নিচের ঠোঁট কামড়ে ছেলে – মেয়ের দিকে ইশারা করে বলে,
” এইগুলো আমার প্রোডাক্ট।
– অসভ্য!
– সেটা আমি সর্বকালেই ছিলাম।
— মাফিয়া বিয়ে করে আমার জীবন শেষ। লাস্ট কবে রাতে শান্তিতে ঘুমিয়েছি সে সময়টা’ই ভুলে গিয়েছি।
অগ্নি মেয়েটাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। বাবার কোলে গিয়ে শান্ত হয়ে ঘাপটে মেরে আছে। অগ্নি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে ইয়ানার দিকে তাকিয়ে বলে,

” প্রতিজ্ঞা রক্ষা করছি আমি। বাচ্চারা যখন গর্ভে ছিলো তখন আমাকে যেভাবে জ্বালিয়ে মেরেছো সবগুলো আগে পুষিয়ে নেয়। বলেছিলাম আমাকে সিডিউস করো না। এরা দুনিয়ায় আসলে এক রাতও তুমি শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না। সময় তো মাত্র কয়েকদিন হলো। নয় মাস জ্বালিয়েছো আমায়।
ইয়ানা হতাস হয়ে তাকায় অগ্নির দিকে। সে তো মজা করে ভিবিন্ন ড্রেস পড়ে অগ্নির সামনে যেত। সে জানত ওই সময় অগ্নি কিছু করবে না। কারন অগ্নি চৌধুরি কখনো সাধারনভাবে স্পর্শ করতে পারে না। উনার স্পর্শে বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আর সেটা তো উনি কখনো করবে না। ইয়ানা তো সেই সুযোগটাই নিয়েছিলো একটু জ্বালানোর জন্য। তাকে ও কম জ্বালিয়েছে নাকি? প্রতিবার অজ্ঞান করে ফেলে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে এখন সে নিজে’ই প্রতিশোধের গুটি হয়ে গিয়েছে। ইয়ানাকে বসে থাকতে দেখে অগ্নি চিন্তিত হয়ে বলে।,

” উঠতে পারবে নাকি সাহায্য করব? চিন্তা করো না প্রতিদিনের মত আজও ব্যাথা কমে যাবে সময় হলেই।
অগ্নির কথায় ইয়ানা কোনো উত্তর দেয় না। সকাল অনেক হয়েছে বাচ্চাদের নিশ্চয় ক্ষিধে পেয়েছে। ইয়ানা নাক – মুখ কুচকে হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে ছেলেকে কোলে তোলে নেয়। মায়ের স্পর্শ পেয়ে ছেলেটা আর ও নিশ্চুপ হয়ে যায়। নাক – মুখ দিয়ে নিজের কাঙ্খিত জিনিসটি খুঁজার জন্য ছটফট করে উঠে। ইয়ানা নিজেকে ঢেকে সঠিকভাবে বাবুকে ফিডিং করাতে থাকে। ছেলেটা শান্ত হয়ে যায়। ইয়ানা অগ্নির উদ্দেশ্যে বলে,
” আনায়া ঘুমিয়ে গিয়েছে মি চৌধুরি?
— উহুম।
— একটু আগে তো কান্না করলো। না ঘুমালে এখন এত শান্ত কেনো তাহলে?
— পাপার কোলে আছে তাই।
— নিজের শরীরে কিছু জড়িয়ে নিন।
— কেনো? বস্ত্রহীনভাবে নতুন দেখছো আমাকে?
– আমার জন্য বলছি না। বাচ্চাদের জন্য বলছি আমি। পুরো শরীরে আফ্রিকার জঙ্গল বানিয়ে রেখেছেন । হুট করে তাকালেই ভয় পেয়ে যাবে ওরা।

— তারা আসাদ হোসেনের মেয়ে ইয়ানা নয়। যে সামান্য ট্যাটু দেখে ভয় পেয়ে যাবে। ওদের শরীরে প্রবাহিত সব কিছুই অগ্নি চৌধুরির। আমার ডিএনএ এতটাও দুর্বল নয়।
ইয়ানা দাঁত কটমট করে অগ্নির দিকে তাকায়। তাকে কি কোনোভাবে অপমান করলো? হ্যা সে প্রথম প্রথম এইগুলো দেখে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু সময়ের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
— শুধু আপনার নয় আমার ডিএনএ ও আছে।
– সে সব আমি হিসেবে রাখি না।
ইয়ানা ফুঁসে উঠে,

” কেনো রাখবেন না? অবশ্যই রাখবেন। বকা খেয়েও বাচ্চা কনসিভ করেছি আমি। সুরক্ষার কথা ভেবে আপনার কথা অনুযায়ী নয় মাস নিজেকে রুম বন্ধী রেখেছি। নয় মাস পেটে রেখেছি আমি। মরন যন্ত্রনা সহ্য করে পৃথিবী আনলাম আমি। আর আজ আমাকে হিসবে রাখছেন না?
— তোমার এত কষ্টের কাহিনী হিসেবে আমার সামান্য জিনিস ওই যথেষ্ট। আমি রাখতে দিয়েছি বলে রাখতে পেরেছো। আমি না থাকলে কোথায় পেত তাদের হুম?
ইয়ানা কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। সত্যি’ত কোথায় পেত সে? তাই বলে এইভাবে আপমান করবে?
অগ্নির কথা শুনে ইয়ানা সামান্য মুখ ভেঙচি কেটে বলে,
” কেউ একজন বলেছিলো আমার বাচ্চার প্রয়োজন নেই ইয়ানা। আমার সম্রাজ্যে তুই থাকলে আর কারোর প্রয়োজন নেই। সেই কথার নমুনা বিগত এক মাস ধরে দেখে আসছি।
ইয়ানার ভেঙচি দেখে অগ্নি সামান্য হেসে বলে,

” আমার পৃথিবী জুড়ে আছে তারা দুজন।
– আর আমি?
অগ্নি ইয়ানার উৎসুক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হেসে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
” আগে ছিলে এখন আর নেই। তোমার জায়গা তারা দুজন নিয়ে নিয়েছে।
অগ্নির উত্তর শুনে ইয়ানার হাসিমুখটা চুপসে যায়। দৃষ্টি নত করে ফেলে সাথে সাথে। এইভাবে বলতে পারলো উনি? আমি উনার পৃথিবীতে নেই? সব ইন্টারেস্ট উঠে গিয়েছে। অসভ্য পুরুষ! আর আসিস আমার কাছে। তখন বুঝাব ইয়ানা কি জিনিস।
অগ্নি ইয়ানার চুপসে যাওয়া মুখটার দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকায়। স্বভাব – সুলভ ঠোঁট কামড়ে হেসে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উচ্চ আওয়াজে ফোন বেজে উঠে। অগ্নি কপাল কুচকে বেড টেবিল থেকে ফোন রিসিভ করতেই মুখ গম্ভীর হয়ে উঠে।

— হুম আসছি আমি এখন’ই।
অগ্নি কথাটা বলে ইয়ানার দিকে এগিয়ে যায়। ইয়ানা ততক্ষনে ইয়াজকে শুইয়ে দিয়েছে। অগ্নি আনায়াকে ইয়ানার কোলে দিতে দিতে বলে,
” আমি মেইডকে ডেকে দিচ্ছি। একটু পর তারা খাবার নিয়ে আসবে। তুমি খেয়ে নিও ওরা বাবুদের সামলাবে।
ইয়ানা কিছু বলে না। ইয়ানাকে চুপ থাকতে দেখে অগ্নি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ট্রায়াল রুমে চলে যায়। কিছুক্ষন পর পরিপাটি হয়ে, প্রয়োজনীয় প্রসাধনী ব্যবহার করে দুই ছেলে- মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যায়। অগ্নি চলে যেতেই ইয়ানা নিজের চোখের পানি মুছে। চোখে পানি টলমল করছে। বাচ্চাদের চুমু খেয়ে গেলো অথচ তাকে খেয়ে গেলো না! অভিমানে বুক ভারি হয়ে উঠে। মেয়েকে জড়িয়ে দিয়ে হেডবোর্ডে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

” টর্চার সেল “অন্ধকারে নিমজ্জিত। সেই সেলের গুপ্ত কক্ষে রিয়েছে এক নরক কক্ষ। যার চার- পাশে আগুনের হিট দেওয়া হয়। এতটাই গরম যে শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। শীতল পাথরে নির্মিত সেলটির প্রত্যেকটি প্রাচীর যেন বেদনার শব্দে অনুরণিত। এই সেলে আলো কখনো প্রবেশ করে না কেবল যন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস প্রতিধ্বনিত হয়। নরক কক্ষে ছিল নিছক কারাগার নয় বরং ছিল এক মহারণ্য। যেখানে মানবমস্তিষ্ক ভেঙে পড়ত চেতনার দিগন্ত হারিয়ে যেত।

দরজাটি ছিল শক্ত জংধরা, ভারী, কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করা লোহার গ্রিল দিয়ে বন্ধ। ভেতরে প্রবেশ করলেই তীক্ষ্ণ একধরনের দুর্গন্ধে নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়। সেই গন্ধ ছিল ঘাম, রক্ত, এবং পচনশীল মানবমাংসের এক বিষাক্ত মিশ্রণ। পচনশীল মাংসের দুর্গন্ধে যে কারোর বমি চলে আসবে। দরজার সামনে পচা শুয়র রাখা হয়েছে। মাছি ভঁনভঁন করছে শুয়রটার উপর।
প্রাচীরজুড়ে ছিল শৃঙ্খল ধাতব, ধারালো, এবং গভীর অমানবিকতার প্রতিচ্ছবি। এখানে অগ্নির সব চেয়ে বড় শত্রুরা যন্ত্রনা ভোগ করে থাকে। বন্দিরা দিনের পর দিন বাধ্যতামূলকভাবে এই শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে থাকত।দেহ থেকে ছাল তুলে নেওয়া হতো ধাপে ধাপে যেন বেদনাকে প্রসারিত করে তোলা এক অভিনব শিল্পকলা।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে এক বিশাল ভীতিপ্রদ ‘মেশিন’ চালু হতো যার আওয়াজেই আত্মা কেঁপে উঠত। এই যন্ত্রের সাহায্যে গেঁথে দেওয়া হতো নখের নিচে সূক্ষ্ম লোহার কাঁটা অথবা চোখের পাতার নিচে ফুটিয়ে দেওয়া হতো উত্তপ্ত তেল। বন্দিদের কানে ঢোকানো হতো গরম মোম। যাতে চিরতরে শ্রবণশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায় কিন্তু যন্ত্রণার আর্তনাদ যেন আত্মার গভীরে গেঁথে থাকে।
এই সেলে নরককক্ষের পাশেই ছিল “নীরবতার কক্ষ” একটি ঘর যেখানে শব্দ প্রবেশ করে না। এই নিস্তব্ধতা ছিল এক নির্মম শাস্তি।কারণ নিজস্ব চিন্তার প্রতিধ্বনিত রূপ, অপরাধবোধ ও পাগলামির মাঝখানে বন্দিকে ফেলে দিত এক মানসিক ধ্বংসযজ্ঞে।
রাত নামলেই শুরু হতো মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন। দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ফিসফিস শব্দ আর আকস্মিক চিৎকার। লোকের আর্তনাদ যেন ঘুমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করত। আলো নিভে যাওয়ার পর বন্দিরা তাদের পাশেই অনুভব করত অদৃশ্য অস্তিত্ব যা চোখে দেখা যায় না। কিন্তু ঘাড়ের ওপরে নিশ্বাস ফেলত ঠিকই।

এখানে সময় ছিল নিষিদ্ধ ধারণা। ঘড়ি, দিনরাত্রির চিহ্ন সবকিছু ছিলো এক বিলাসিতা। সেই নরকে বহু বছর ধরে কাউকে রাখা হয় না। কিন্তু বিগত এক।মাস ধরে রাখা হচ্ছে অগ্নি চৌধুরির সবচেয়ে বড় শত্রুদের। আতিক, রানবীর আর রায়হান বিগত এক মাস ধরে মরন যন্ত্রনা সহ্য করছে। তাদের কানে ফুটন্ত মোম গলানো হয়েছে। শরীরে অসংখ্য নরকীয় চিহ্ন। শরীর রক্তে লাল হয়ে গেলে লাল ফুটন্ত গরম পানি দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করা হয়েছে। ঝলসে গিয়েছে পুরো শরীর। এমন পচা গন্ধে যেন সকলের নাড়ী – ভুড়ি পচে গিয়েছে। কারোর চোখ নেই, কারোর হাত আবার কারোর পা! বর্তমানে।তারা কোনো মানুষ নয় যেন অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে কোনো বিকৃত মানুমানুষে পরিনত হয়েছে। তিন জনেই বিবস্ত্র হয়ে আছে। এক বিন্দু কাপড় নেই কারোর শরীরে। হাত – পা শিকল দিয়ে টান- টান করে বেঁধে রাখা হয়েছে। আতিক হাঁপাচ্ছে। সামান্য পানির জন্য দেওয়ানা হয়ে উঠেছে। অস্ফু্র্তভাবে পানি, পানি শব্দ করছে। ঠিক সে সময় চোখের সামনে পানির গ্লাস দেখে হাসি দিয়ে উঠে। অনেকদিনের তৃষ্ণার্ত কাকের মত ঝাপিয়ে পরে গ্লাসের উপর। মুখে দিতেই চিৎকার করে উঠে। জিহ্বা বের করে অস্থির হয়ে উঠে। যেন পুরো জিহ্বা জ্বলে যাচ্ছে।

— ফুটন্ত গরম পানি ছিলো এইটা।
গম্ভীর আর শান্ত কন্ঠস্বর শুনে আতিক রক্তাক্ত নিভু নিভু চোখে তাকায় সেদিকে। সামনে তাকাতেই আরও ভয় পেয়ে উঠে। তাদের সামনে রায়ান, ইউভি আর অগ্নি দাডিয়ে আছে। সবার মুখেই মাস্ক পড়া। মাস্ক পড়া তিন জনকে চিনতে আতিক, রানবীরের মোটেও অসুবিধা হয় নি। আতিক কান্না করে দিয়ে বলে,
” প্লিজ বের করো আমাদের। এই যন্ত্রনা আর সহ্য করতে পারছি না।
অগ্নি সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠে।
ইউভি- আমার বাবা – মায়ের মৃত্যুর বদলা নিয়ে নেয় আগে।
রায়ান – আমার বাবার বুকে গুলি চালানোর প্রতিশোধ তো এখনও বাকি কলিজার পাখিরা।
অগ্নি হাতে একটা ছুঁরি নেয়। এরপর ছুঁরিটা একটা স্টিলের উপর শব্দ করে রেখে বলে।,
” আমার কাকিয়ার সম্রমহানী, আমার কাকার হত্যা, আমাকে পাচার করে দিনের পর পর দিন নরক যন্ত্রনা সহ্য করানোর প্রতিশোধ তো এখনও বাকি আতিক আর রানবীর।
আতিক আর রানবীর দুইজন অবাক হয়ে তাকায়। তাদের বাবা, কাকাদের কবে খুন করেছে? আর অগ্নিকেই বা কবে পাচার করলো তারা?

— ভুল হচ্ছে কোথাও। আমরা এমন কিছুই করি নি। কে তোমাদের বাবা- মা? আমি কাউকে চিনি না।
অগ্নি রাগে চেঁচিয়ে উঠে। হাতে থাকা ছুঁরিটা তাদের দিকে ফিক্কা মারে। ছুঁরিটা গিয়ে একদম রানবীরের হাতে লাগে। অগ্নির চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে,
” কিছু না জেনে ছটফট কর এইটাও তদের জন্য একটা শাস্থি। যেদিন তদের প্রানে মারব সেদিন সব কিছুর ব্যখ্যা দিব। এখন আপাযত নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে থাক কাদের কথা বলছি?
রায়হান কথা বলতে পারছে না। তার জিহ্বা কেটে নেওয়া হয়েছে। কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু সে বিফল।
অগ্নি সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে পৈশাচিক হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায়। অগ্নির সাথে রায়ান আর ইউভি ও বেরিয়ে পরে। আবার ও লেগে যায় ধাতব দরজাটা। অন্ধকার হয়ে পড়ে পুরো রুম। আতিক, রানবীর শুধু ভাবছে অগ্নির বলা প্রতিটা কথা।

রাত প্রায় নয়টার কাছা- কাছি। ইয়ানা ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে মাত্র শুয়ে দিয়েছে । আর মেয়েকে নিয়ে এদিক- সেদিক হাটা হাটা করছে। মেয়েটা প্রচুর ছটফট টাইপের। ইয়ানা হাটছে আর ভিবিন্ন কিছু বলছে। কিন্তু মেয়ে সেই একইভাবে তাকিয়ে আছে। চোখে কোনো রকম ঘুম নেই। ইয়ানা হতাশ এই মেয়েকে নিয়ে। ইয়ানা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেয়। কয়জন সন্তানের ভাগ্য হয় নিজের বাবার হাতে পৃথিবীতে আসার। কয়জন স্ত্রী ভাগ্য হয় নিজের স্বামীর হাতে সব কিছু হওয়া। নিঃশ্বন্দেহে ইয়ানা অনেক ভাগ্যবতী। কিন্তু উনি কিভাবে করেছে? উনার তো এই নিয়ে কোনো ধারনা ছিলো না। কিভাবে পারলো বাচ্চা প্রসব করাতে? ইয়ানা চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু সকালে অগ্নির বলা উত্তরটার কথা মনে পড়তেই মনটা আবার ও বিষিয়ে উঠে। ইয়ানার ভাবনার মধ্যেই দরজা খুলার শব্দে সেদিকে তাকায়। অগ্নিকে দেখতে পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ইয়ানার দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়াটা অগ্নির চোখ এড়িয়ে যায় না। ইয়ানার অভিমানের কারন বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসে। এরপর নিজেকে ভালোভাবে ফ্রেশ করে বিছানার কাছে যায়। অগ্নি মেয়েকে কোলে নিতেই ইয়ানা এক পাশে শুয়ে পড়ে। অগ্নি সামান্য কপাল কুচকে বলে,

” মেয়েকে খাইয়েছো?
ইয়ানা নিশ্চুপভাবে শুধু মাথা নাড়ায়। অগ্নি আনায়াকে নিয়ে কিছুক্ষন নড়াচড়া করতেই মেয়েটা ঘুমিয়ে যায়।
অগ্নি মেয়েকে শুয়ে দিয়ে বলে,
” বাচ্চার মাম্মা ও কি ঘুমিয়ে গিয়েছে?
ইয়ানা নিশ্চুপ ভাবে পড়ে আছে। এমনভাবে আছে যেন কতশত দিন ধরে সে ঘুমের রাজ্যে আছে। ইয়ানার কোনো রেসপন্স না পেয়ে অগ্নি ইয়ানাকে হেচকা টানে কোলে তোলে নেয়। হঠাৎ কোলে উঠাতে ইয়ানা ভড়কে যায়। ইয়ানা চেঁচিয়ে উঠে,
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ছাড়ুন আমাকে।
ইয়ানাকে চেঁচাতে দেখে অগ্নি সামান্য ধমক দিয়ে বলে,
” স্টপ ! বাচ্চারা উঠে যাবে।
ইয়ানা ছটফটিয়ে বলে,

” আমি ও চাইছি উঠানোর জন্য। কেনো এসেছেন আমার কাছে? আমার স্থান তো আপনার পৃথিবীতে নেই। তাহলে কেনো কাছে টানবেন? ছাড়ুন আমাকে বলছি।
অগ্নি ইয়ানাকে ডিভানে শুইয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে ইয়ানার গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে বলে,
” একটু শান্ত হয়ে থাক জান। বেশি কিছু করব না যাস্ট চুমু খাব। ছটফট করলে গড প্রমিস পুরো রাতও ছাড় পাবি না। কান্না, আর্তনাদ, ছটফট যা ইচ্ছে হোক আমাকে থামাতে পারবে না।
অগ্নির এমন অস্থির কন্ঠ শুনে ইয়ানা অবাক হয়ে বলে,
” আপনি ঠিক আছে মি, চৌধুরি?
অগ্নি ইয়ানার কানের কাছে ঠোঁটের স্পর্শ করে বলে,
” হুম। তবে মানসিক শান্তির প্রয়োজন। অতীতের কাহিনী মনে পড়ছে খুব।
অগ্নি কথাটা খুব স্লো ভয়েসে বলে। ফলে ইয়ানার কান অব্দি পৌঁছায় না।

অগ্নি আলতোভাবে ইয়ানার ঠোঁট নিজের ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে নেয়। ইয়ানা কেঁপে উঠে। পিছন থেকে অগ্নির চুল খামচে ধরে। তবে আজ অগ্নির স্পর্শে কোনো অস্থিরতা বা রক্তাক্ত ছিলো না। একদম নরমভাবে , ধীরে ধীরে আয়ত্তে নিচ্ছে । হঠাৎ করে কান্নার আওয়াজে ইয়ানা ছটফট করে উঠে। অগ্নির বুকে সামান্য ধাক্কা দিতেই সে মাথা তুলে তাকায় পিছনে। মেয়েকে হাত – পা ছড়িয়ে কান্না করতে দেখে ইয়ানার দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে। ইয়ানা মুচকি হাসি দিয়ে ডিভান থেকে উঠে পরে।
অগ্নি ডিভানে বসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে ,
“জনগন শত্রুতা করবে কখন? নিজের মেয়ে’ই বাপের রোমান্সে পানি ঢেলে দিয়েছে। আরেকটু কি ঘুমানো যেত না।
ইয়ানা অগ্নির কথায় সামান্য হেসে বলে,

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৪ (২)

” এদের কারনে যদি আপনার কাছ থেকে একটু মুক্তি পায়। আপনি কাছে আসবেন আর তারা কান্না করে হঠবে। উফফ মাফিয়া বসের এমন অবস্থা কি কানাডাবাসী মেনে নিবে?
ইয়ানার ঠাট্টা শুনে অগ্নি ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,
” সব সেক্রিফাইস করতে পারব। বাট তোমার কাছে আসা সেক্রিফাইস করা পসিবল নয়। প্রয়োজনে বাচ্চাদের রুই আর মিরার কাছে দিয়ে আসব। তবু’ও রাতে আমি আমার বউ চাই।
— অসভ্য লোক একটু তো সভ্য হন।
— সেটা কোনো কালেই সম্ভব না।
ইয়ানা কটমট চোখে তাকায়। অগ্নি সামান্য হেসে ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে।

অনুভবে তুমি সিজন ২ পর্ব ৬৬