অনুরাগে তুই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩

অনুরাগে তুই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩
সাদিয়া শওকত বাবলি

ঘড়ির কাঁটায় কেবল সকাল সাড়ে এগারোটা। আরফা দাঁড়িয়ে রয়েছে কলেজের অভিমুখে। আজ আর ক্লাস করবে না সে। কলেজের নিকটেই কোনো এক মাঠে রাজনৈতিক কোন দলের বিশাল সভা বসবে যেন। কলেজের অধিকাংশ ছেলেরাই সেখানে যাচ্ছে, কিছু মেয়েরাও যাচ্ছে। আরফার কোনো কালেই এসব রাজনৈতিক বিষয়াদি পছন্দ ছিল না। তাই আর সে ওদিকে না গিয়ে সোজা বাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু সেই কখন থেকে বাড়িতে ফেরার জন্য একটি রিকশা খুঁজছে সে। অথচ রিকাশার কোনো দেখা নেই। এমনি অসময়ে যখন প্রয়োজন হয় না তখন রিকশার অভাব হয় না। এ আসে, ও আসে। না বলার পরেও বারবার জিজ্ঞেস করে,

“আপা যাইবেন? আপা যাইবেন?”
অথচ আজ যখন একটি রিকশার প্রয়োজন তখন কারো দেখা নেই। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে এলো আরফার। তাকালো এদিক ওদিক। হঠাৎ তার চোখে পড়ল কায়সারকে। কিছু ছেলেদের নিয়ে তার অভিমুখের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। হয়তো সভায় যাচ্ছে। আরফা একবার ডাক দিবে ভেবেও ডাক দিল না। কি দরকার লোকটাকে বিরক্ত করার? সে হয়তো আরফার এমন অযাচিত ডাকে বিরক্ত হবে। সেই মাস ছয়েক পূর্বের ঘটনার পরে কায়সার আর এদিকটায় খুব বেশি আসে না, এলেও কলেজে ঢোকে না। হয়তো ত্রয়ী নেই বলে। আরফার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয় লোকটার। কখনো সখনো টুকটাক কথা বলে, আবার কখনো এড়িয়ে যায়। এই এড়িয়ে যাওয়াটা অবশ্য আরফাই করে। দূর থেকে কায়সারকে দেখলেই সে সরে পড়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ছয় মাস পূর্বে ঘটা সেই ঘটনার পরে আরফা নিজের ভিতরে বেশ পরিবর্তন অনুভব করে। সে নিজের ভিতরে কায়সারের জন্য আলাদা একটি টান অনুভব করে। আরফা কখনো চায়নি এমন হোক। সে কখনো কায়সারকে ভালোবাসতে চায়নি। তবুও কিভাবে কিভাবে যেন হয়ে গেছে। সেদিন ত্রয়ীর প্রতি কায়সারের এক তরফা ভালোবাসার গভীরত্ব দেখে এই অনুভূতির আভাস সে পেয়েছিল নিজ হৃদয়ে। আরফা ভেবেছিল এটা তার আবেগ। সময়ের সাথে সাথে এ আবেগ কেটে যাবে। কিন্তু তা তো কাটলোই না বরং আরও বাড়ল। আরফা জানে লোকটা অন্য কাউকে ভালোবাসে‌। আর সে ভালোবাসার গভীরত্বও সে অনুধাবন করেছে। এতকিছুর পরেও সেই লোকের জন্য নিজ হৃদয় অনুভূতি পুষে রাখা, আবার সেই অনুভূতির দাপটে তার নিকটে যাওয়া নিশ্চয়ই বাঞ্ছনীয় নয়। কায়সারও হয়তো বিষয়টা ভালো চোখে দেখবে না। আর তাছাড়া কায়সার তো তাকে আগে থেকেই তেমন পছন্দ করে না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল আরফা। চোখ ঘুরিয়ে তাকাল আশেপাশে।

নিজের দলের সাথে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কায়সারের চোখ পড়ল আরফার দিকে। আরফা তাকে দেখে কথা না বললেও সে দৌড়ে এলো মেয়েটির নিকটে‌। ওষ্ঠে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে শুধাল,
“কি কেমন আছ?”
আরফা অপ্রস্তুত হলো কিঞ্চিৎ। এরপর ইতস্তত করে জবাব দিল,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তা এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
“রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু পাচ্ছি না।”
আরফার কথা শেষ হতে না হতেই কায়সার কাকে যেন কল করল। কলেজের অভিমুখে একটি রিকশা পাঠিয়ে দিতে বলে কলটা আবার কেটে দিল প্রায় সাথে সাথেই। হাসিমুখে বলল,

“একটু অপেক্ষা করো। রিকশা আসছে।”
কায়সারের আজকের ব্যবহারে অবাক হলো আরফা। লোকটার মধ্যে হঠাৎ এত পরিবর্তন! আগে তো তাকে দেখলেও তেড়ে আসতো কায়সার। যখনই দুজনের দেখা হতো এক চোট ঝগড়া হতোই হতো। এখন কি তবে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মস্তিষ্ক ঠিক হয়ে গেছে? আরফা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল। আমতা আমতা করে বলল,
“আপনি কি সত্যিই ভালো আছেন কায়সার ভাই? নাকি….”
এই টুকু বলে থামল মেয়েটি। কায়সার ভ্রু কুঁচকে শুধাল,
“আমি ভালো থাকব না কেন? কি হয়েছে আমার?”
“না মানে ত্রয়ী….ওকে কি ভুলে গেছেন?”

“চাইলেই কি জীবনে আসা সব চরিত্রদের ভুলে থাকা যায়? আমিও তাকে ভুলিনি।”
এই টুকু বলে থামল কায়সার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের বলল,
“তবে আমি আর তাকে আগের মতো ভালোবাসি না।”
“যাকে একবার ভালোবাসা যায় তাকে কি এত সহজে আবার ভালোবাসার খাতা থেকে উপরে ফেলা যায়?”
“কে বলেছে আমি তাকে ভালোবাসার খাতা থেকে উপরে ফেলেছি। সে এখনো আছে, আমার হৃদয়ের গভীরে ঘুমিয়ে আছে। তবে তার জন্য এখন আর আমি ছটফটাই না‌। তাকে একটা নজর দেখার জন্য, তার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আর উতলা হই না।”
আরফা এবং কায়সারের কথাপকথনের মধ্যেই তাদের পাশে এসে একটি রিকশা উপস্থিত হলো। রিকশাওয়ালা স্বাভাবিক কণ্ঠেই শুধাল,

“আমাকে রিকশা নিয়া আইতে কইছিলেন, কায়সার ভাই?”
কায়সার রিকশাওয়ালার দিকে এক পলক তাকালো অতঃপর আবার আরফার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“তোমার রিকশা এসে গেছে। বাড়িতে চলে যাও তাড়াতাড়ি। একটু পর এই রাস্তা মানুষে ভরে যাবে। সামনে সভা তো।”
আরফা আর দ্বিরুক্তি করল না। এখনই এ রাস্তা ভীরে পরিপূর্ণ। একটু পর তো আরও ভীর হবে। আরফা রিকশায় উঠে বসলো। কায়সারের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দিল বাড়ির পথে‌।

মেহেরের ক্লাসও বোধ হয় আজ আর হবে না। কলেজের ছেলেমেয়েরা সব দলে দলে সভায় যোগ দিতে যাচ্ছে। মেহের কলেজ থেকে বেরিয়ে দাঁড়াল গেটের অভিমুখে। বাড়ির ড্রাইভারকে ইতোমধ্যে গাড়ি নিয়ে আসার জন্য কল করে দিয়েছে‌ সে। অল্প সময়ের মধ্যেই মনে হয় চলে আসবে ড্রাইভার। মেহের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে নজর বুলাল। হঠাৎ তার দৃষ্টি জোড়া আটকে গেল অদূরে রাস্তার দিকে। সে রাস্তারই পাশ ঘেঁষে একটি বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আলভী। হাতে তার একটি জ্বলন্ত সিগারেট আর দৃষ্টি মেহেরের দিকে। মাঝে মাঝেই আলভী এখানে আসে। মেহেরর থেকে একটু দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। অথচ কথা বলে না। মেহেরও যেচে কথা বলতে যায় না। একজন সন্তান সব মেনে নিতে পারে। কিন্তু নিজের পিতার অপমান কখনো মেনে নিতে পারে না‌। সেখানে মেহের কিভাবে মেনে নিবে?মেহেরের আলভীর সাথে কথা বলার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও ক্রোধের বশে আর বলা হয় না। দুজনের চোখে হাজারও কথা ভেসে ওঠে, একে অপরকে কাছে পাওয়ার আকুলতায় হৃদয় উত্তাল হয়। তবুও কথা হয় না দুজনের। একে অপরের প্রতি চাপা অভিমান নিয়েই বারবার কাছে গিয়েও আবার দূরে সরে আসে তারা।

ভোর চারটা। চারদিকটা গভীর আঁধারে নিমজ্জিত। আকাশের সূর্যটা এখনো উঁকি দিতে শুরু করেনি। রস্তাঘাটও ফাঁকা। তেমন একটা যানবাহনের দেখা নেই। ভোরের এই ক্ষণে তামিমের গাড়িটা সাঁই সাঁই করে ছুটছে ঢাকা-বরিশার মহাসড়ক ধরে। গাড়ি চালাচ্ছে নয়ন, আর তার পাশের সিটে বসে আছে রবি। তামিম এবং আলভী পিছনের সিটে। কিছু জরুরি কাজের তাগিদে শীর্ষ আসতে পারেনি। রবিদেরও তামিমকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই আবার ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিতে বলেছে। তারা সবাই একবার ভেবেছিল রাতের দিকেই বরিশালের উদ্দেশে রওনা দিবে। আবার কাল রাতের আগেই ঢাকায় ফিরে যাবে।

কিন্তু পরে আবার ভেবে দেখলো রাতের দিকে রওনা দিলে বরিশালে তামিমের বাড়িতে রাতের মধ্যেই কিংবা একদম ভোরে গিয়ে পৌঁছাবে। অচেনা অজানা একটি স্থান, তামিমের পরিবারের লোকদের তারা চিনে না। তামিমকেও তো খুব একটা ভালোভাবে চিনে না। সেখানে তাদের বাড়িতে রাতের আঁধারে গিয়ে হানা দেওয়াটা কেমন একটু লাগছিল তাদের। তাছাড়া তামিম তো এখন প্রায় সুস্থই। তাই ভোরের দিকেই রওনা দিয়েছে। সকাল দশটা বা এগারোটার মধ্যে তামিমের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাবে। সেখানে কোনো রকমে এক ঘন্টা কাটিয়েই আবার গাড়িতে উঠবে।
ফাঁকা রাস্তা, নিরিবিলি পরিবেশ। রবি তার পাশের জানালাটা খুলে দিল। রাতের হালকা বাতাস ছুঁয়ে দিতে শুরু করল তার শরীরকে। উৎফুল্ল হলো রবির হৃদয়। মৃদু স্বরে গান ধরল,

এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো ।।
এই টুকু গাইতেই তাকে থামিয়ে দিল আলভী। পিছন থেকে নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“কি শুরু করেছিস ভাই? রাস্তার পাশের বাড়ি গুলোতে থাকা ঘুমন্ত মানুষ গুলো তো লাফিয়ে উঠবে তোর গান শুনে। গলা না যেন ফাটা বাঁশ।”
রবি অপমানিত বোধ করল। থমথমে কণ্ঠে বলল,

“তুই কিন্তু আমাকে অপমান করছিস, আলভী।”
আলভী সাথে সাথে মুখ বাঁকিয়ে জবাব দিল,
“তোর মান আছে নাকি যে অপমান করবো?”
রবি পিছন ঘুরে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল আলভীর উপর। কটমট করে বলল,
“তোকে আমি পরে দেখে নেব। এই অপমানের বদলা তো নেবই নেব।”
“যা করার করে নিস তুই। এখন ঘুমা।”

নয়নদের গাড়িটি বরিশালের নিস্তব্ধ পল্লিবেশে ঢুকলো প্রায় সকাল দশটার দিকে। পথের শেষপ্রান্তে, তমিমের বাড়ির সামনেই এসে থামল গাড়িটি। বিশাল দোতলা অট্টালিকা, চারপাশে ঘন সবুজের আবরণ। নারিকেল, আম, কাঁঠাল, গাছের ছায়ায় যেন বাড়িটা লুকিয়ে আছে। এখানকার পরিবেশেও এক অদ্ভুত প্রশান্তি, শহরের কোলাহলও তেমন একটা নেই।

গাড়ির দরজা একে একে খুলে নামল সবাই। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি আর ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে থাকতে কোমড়, পিঠে যেন ব্যথা হয়ে গেছে তাদের। নয়ন, রবি ও আলভী গা ঝাড়া দিয়ে একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল। অতঃপর তামিমকে ধরে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বাড়ির মূল দরজার অভিমুখে। হাত উঁচিয়ে বাজালো কলিং বেলটা। প্রায় সাথে সাথেই দরজাটা খুলে গেল। একজন অল্পবয়সী তরুনী দরজা খুলেছে। হালকা পাতলা গড়নের দারুন এক কন্যা সে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা গায়ের রং। লম্বাটা মঝারি। সব মিলিয়ে এ রমনীকে সুন্দরীদের কাতারেই ফেলা যায়। রমনীটি প্রথমে কপালে ভাঁজ ফেলে দরজাটা খুললেও দরজার অভিমুখে হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে তামিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে ভাঁজ গায়েব হলো। অস্থির হয়ে শুধাল,

“কি হয়েছে ভাইয়া তোর? হাতে, কপালে ব্যান্ডেজ কেন?”
তামিম হাতে ইশারা দিল। রবি এবং আলভীর সহায়তায় ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“অস্থির হোস না, তৃপ্তি। আগে ভিতরে ঢুকি তারপর বলছি সব।”
তৃপ্তি সম্পর্কে তামিমের ছোট বোন। ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। তামিম ভিতরে গিয়ে বসলো বসার কক্ষের সোফায়। তৃপ্তি গলা উঁচিয়ে ডাকল,
“মা, চাচি কোথায় তোমরা? দেখো ভাইয়া এসেছে। ভাইয়ার কি যেন হয়েছে। হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ।”
তৃপ্তির হাঁক ডাকে অল্প সময়ের মধ্যেই অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে এলেন তামিমের মা আলেয়া বেগম এবং ছোট চাচি লুৎফা বেগম। ছেলের এমন নাজুক অবস্থা দেখেই তার উপর হামলে পড়লেন আলেয়া বেগম। দিশেহারা হয়ে শুধালেন,

“কি হয়েছে বাবা তোর? হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?”
তামিম একে একে সব খুলে বলল। সবটা শুনে আলেয়া বেগম ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আঁচলে মুখ ঢেকে বললেন,
“আমি জানতাম আমার ছেলে ভালো নেই। তার কিছু না কিছু হয়েছে। ওদের বারবার বলেছিলাম তোকে কল করতে, তোর খোঁজ খবর নিতে।”
তামিম এক হাত বাড়িয়ে মাকে আগলে নিল নিজের সাথে। অভয় দিয়ে বলল,
“আহ, মা, কাঁদছ কেন তুমি? এই দেখো আমি ঠিক আছি।”
আলেয়া বেগম কান্না থামালেন। কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
“কিসের ঠিক আছিস তুই? হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ। এখনো ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারছিস না।”
“ওটা আর অল্প কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।”
মা ছেলের কথাপকথনের মধ্যে এবার উঠে দাঁড়াল রবি। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,
“আমরা তাহলে এখন উঠি।”

আলেয়া বেগম কিছুটা লজ্জিত অনুভব করলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
“এই দেখো ছেলের শোকে আমি তোমাদের কথা ভুলেই বসেছিলাম। তোমরা মনে কিছু করো না। আসলে বয়স বেড়েছে তো, বুড়ো হয়েছি। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়।”
“আরে না, না আন্টি আমরা কি মনে করব? আপনার স্থানে আমাদের মায়েরা হলেও বোধ হয় এমন কিছুই হতো। কিন্তু আমাদের এখান যেতে হবে। অনেকটা পথ।”
“তোমরা কোথায় যাবে? এই তো এলে। তোমরা আমাদের যা উপকার করেছ। এত সহজে তোমাদের ছাড়ি কিভাবে?”

আলভী সৌজন্য সূচক হাসলো। নম্র কণ্ঠে বলল,
“আমরা শুধুমাত্র আমাদের কর্তব্য আমরা পালন করেছি। আমাদের নিকট এতটা ব্যস্ত হবেন না আন্টি। আর তাছাড়া আমাদের অফিস আছে। সেখান থেকে তেমন ছুটি নিয়ে আসিনি। আমাদের সবাইকে আজই ফিরতে হবে।”
এ পর্যায়ে মুখ খুললেন তামিমের ছোট চাচি লুৎফা বেগম,
“সে কি, আজই চলে যাবে? অফিসে কথা বলে দেখো যদি ছুটি একটু বাড়াতে পারো। তোমাদের জন্য আমাদের বাড়ির ছেলেটা বেঁচে ফিরে এলো। তোমাদের আমরা এভাবে কিভাবে যেতে দেই?”
“তা সম্ভব নয় আন্টি। আমরা আগেই এ ব্যাপারে অফিসে কথা বলেছি। অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে একটা। সেই কাজের জন্যই তো আমাদের আরেক বন্ধু শীর্ষও আসতে পারেনি। আমাদের আজই ফিরতে হবে। নয়তো অনেক বড়ো ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে।”

“কিন্তু…”
“প্রয়োজনে আমরা আবার অন্য সময়ে আপনাদের বাড়িতে এসে ঘুরে যাব। কিন্তু আজ নয়।”
আলেয়া বেগম এবং লুৎফা বেগম আর জোরাজুরি করলেন না। আলেয়া বেগম শুধু বললেন,
“আচ্ছা তোমরা যখন থাকতেই চাইছ না তখন আমরা আর জোর করব না। কিন্তু এই সময়ে বাড়ির কর্তারা কেউ বাড়িতে নেই। তারা ফিরুক তারপর না হয় যাবে।”
লুৎফা বেগমও এ কথার সাথে সায় জানিয়ে বললেন,
“হ্যা, আপাতত তোমাদের জন্য কিছু চা নাস্তার ব্যবস্থা করি।”
রবি, আলভী এবং নয়ন দ্বিরুক্তি করল না। অনেকটা পথ পেড়িয়ে এসেছে তারা। ভীষণ ক্ষুধাও লেগেছে। রবি আর আগের স্থানে বসলো না। একটু ঘুরে গিয়ে বসলো অন্য সোফায়। সাথে সাথে চ্যাঁচিয়ে উঠল তৃপ্তি,
“আমার ফেস প্যাক।”

রবিও তার নিচে কিছু একটা অনুভব করল। ছোট বাটি জাতীয় কিছু। সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল সে। সত্যি সত্যি তার পশ্চাৎদেশে একটি ছোট বাটি লেগে আছে। না দেখে ধপ করে এসে বসে পড়েছে, যার ফল এটা। রবি বাটিটা হাতে নিল। বাটিতে হলুদ রঙা আঠালো জাতীয় কি যেন। দেখতে একদম গু* এর মতো লাগছে। এটা আবার লেগে গেছে তার পশ্চাৎদেশে। দেখে মনে হচ্ছে চাপ সহ্য করতে না পেরে প্যান্ট নষ্ট করেছে সে। রবির অবস্থা দেখে হেসে উঠল সবাই। আলভী নাক ছিটকে বলল,

“ছি, ছি রবি। শেষ পর্যন্ত কিনা প্যান্ট নষ্ট করলি? বেশি চাপ থাকলে ওয়াশ রুমে যেতি। আমরা কি তোকে আটকে রেখেছিলাম?”
রবির মেজাজ তেতে গেল। ফেস প্যাক না কি, এটা রাখার স্থান কি সোফা? তাও আবার কি সব রঙের ফেস প্যাক। অচেনা, অপরিচিত এক বাড়িতে এসে কি এক বিশ্রী পরিস্থিতিতে পড়ল সে। মান ইজ্জত আর রইল না। রবি কটমট করে তাকাল তৃপ্তির দিকে। শক্ত কণ্ঠে কিছু বলবে তার পূর্বেই তেতে উঠল তৃপ্তি। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“দেখে শুনে বসবেন না? দিলেন তো আমার ফেস প্যাকটা নষ্ট করে। এই ফেস প্যাকের জন্য আজ আমি কলেজে যাইনি।”
“এটা কোনো ফেস প্যাক রাখার জায়গা?”
“রাখলেই রাখার জায়গা। আপনি দেখেশুনে বসবেন না?”
“এ বাড়িতে যে সোফার উপরেও ফেস প্যাক ফেলে রাখে তা বুঝেছে কে? বুঝলে না হয় দেখে শুনে বসতাম।”
“আপনি….”
এই টুকু বলতেই তৃপ্তিকে থামিয়ে দিলেন আলেয়া বেগম। মেয়ের দিকে একবার অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকালেন রবির দিকে। জোরপূর্বক হেসে বললেন,
“ওর কথায় কিছু মনে করো না, বাবা। আমার সাথে এসো। ফ্রেশ হয়ে নিবে।”
রবি রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল তৃপ্তির দিকে। অতঃপর কিছু না বলে হনহন করে হাঁটা ধরল আলেয়া বেগমের পিছু পিছু।

সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুরের পথে। রবি, আলভী এবং নয়ন নাস্তা শেষ করে কেবলই বেরুলো তামিমদের বাড়ি থেকে। আলেয়া বেগম, লুৎফা বেগম, তামিম অনেক অনুরোধ করেছিল তাদের আর একটু সময় থাকার জন্য। বাড়ির কর্তারা এখনো ফিরেননি। কিন্তু তারা থাকেনি। ঢাকায় আজই যখন যেতে হবে তখন আগেভাগে যাওয়াটাই ভালো।
কিছুটা দূরে আসতেই নয়ন হঠাৎ রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল। আলভী এবং রবিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“বরিশালে এলাম। আর কোনো স্মৃতি নিয়ে যাব না? আপনারা আমার একটি ছবি তুলে দিন তো।”
নয়ন নিজের মোবাইলটা বাড়িয়ে দিল। আলভী মোবাইলটা হাতে নিয়ে গোটা চারেক ছবি তুলে দিল। নয়ন সময় ব্যয় করল না। প্রায় সাথে সাথেই ছবিগুলো পোস্ট করে দিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। উপরে লিখে দিল,
“ছায়াঘেরা বরিশাল।”

অনুরাগে তুই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২

শীর্ষ অফিসের কাঁচঘেরা কক্ষে বসে অলস হাতে ফেসবুক স্ক্রল করছিল। কেবলই একটি মিটিং শেষ করে এসেছে সে। নিউজফিডে বিভিন্ন পোস্ট দেখতে দেখতে হঠাৎ তার সামনে এসে পড়ল নয়নের ছবিগুলো। অন্যান্য সময়ের মতোই ছবিগুলোকে উপরে ঠেলতে যাবে তখনই তার তার দৃষ্টি আটকে গেল একটি ছবিতে। সে ছবিতে নয়নের পিছনে একটু দূরে এক নারীকে দেখা যাচ্ছে। কেমন চেনা চেনা লাগছে সেই নারীকে। ভীষণ কাছের কারো সাথে মিল পাচ্ছে শীর্ষের হৃদয়। শীর্ষ দম আটকে ছবিটি জুম করল। ঝাপসা ফ্রেমের ভেতরেও স্পষ্ট হলো সেই নারীর মুখের রেখাগুলো। শীর্ষের বুকের ভেতর যেন ঝড় উঠল। বিস্ময়ে, আনন্দে, অবিশ্বাসে কেঁপে উঠল তার সমগ্র সত্তা। সেই পুরনো ভঙ্গি, সেই চিরচেনা মুখের আদল। এই রমণীকে কি সে এত সহজে ভুলতে পারে?

অনুরাগে তুই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৪