অনুরাগে তুই পর্ব ৫৮
সাদিয়া শওকত বাবলি
“তোর গ্রাম, ছোটবেলা থেকে ওখানেই বড়ো হয়েছিস তুই। গ্রামের সকলকে নিশ্চয়ই তোর চেনা। তুই নির্ঘাত আগে থেকেই সব পরিকল্পনা করে রেখেছিলি। রাতের আঁধারে ভাইয়াকে বাইরে বেরুতে দেখে তুইও তার পিছু পিছু বেরিয়েছিলি। গ্রামের লোকদের আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলি যাতে হঠাৎ এসে তোদের একসাথে ধরে। আর তারপর বিয়ে। কি বুদ্ধিরে তোর! অবশ্য গ্রাম্য মেয়েরা হয়েই এমন। কূটকৌশল এ পারদর্শী।”
থামলো রিমা। মায়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে শুধাল,
“এতকিছুর পর তুমি কি এই বিয়ে মানবে, মা?”
এমন একটি হঠাৎ বিয়ে। তার উপর এই বিয়ের জন্য গ্রামে তাদের মান সম্মানে অনেকটাই আঁচ পড়েছে। কোনো পিতা মাতাই হয়তো নিজের ছেলে বা মেয়ের এমন বিয়ে মানতে পারতেন না। ফাহমিদা বেগমও পারলেন না। তিনি শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন না,
“না।”
“গিয়ে দেখো শীর্ষ ভাই ও মনে মনে এই বিয়ে মানতে পারছে না। তাই তো এতদিন কিছু বলেনি। এখন দেখছে বিয়ে হয়ে গেছে, এ মেয়েকে না পারছে ছুঁড়ে ফেলতে আর না পারছে গিলতে। তাই তোমাদের কাছে এসে বিয়ের কথা বলেছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফাহমিদা বেগম যে এমন কথা ভাবেননি তেমন নয়, তিনিও মনে মনে এই কথাটা ভেবেছেন। ত্রয়ীরা গ্রামে গিয়েছিল সেই কবে অর্থাৎ শীর্ষ এবং ত্রয়ীর অনেকদিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। অথচ এতদিন শীর্ষ এই বিষয়ে একটা কথাও বলেনি তাদের নিকট। ত্রয়ীর প্রতি শীর্ষের আলাদা টান, দুজনের মধ্যে ভাব, এমনকি দুজনকে একসাথে বসে দু দন্ড কথাও বলত দেখেননি তিনি। এর মানে শীর্ষের এই বিয়েতে মত ছিল না। গ্রামের লোকদের চাপে পড়ে ত্রয়ীকে বিয়ে করতে হয়েছে তার। আর বিয়েটা যেহেতু হয়ে গেছে তাই শীর্ষ তাদের নিকট এসে এখন আবার বিয়ের কথা বলছে। ফাহমিদা বেগমের আকাশ পাতাল চিন্তা ভাবনার মধ্যেই আবারও রিমার কণ্ঠ ভেসে এলো,
“মা আমি বলছি কি, এমন একটা কা’লসা’প’কে এ বাড়িতে রাখার আর কোনো মানেই হয় না। তুমি বরং ওকে বাড়ি থেকে বের করে দাও।”
রিমার কথায় ফাহমিদা বেগম অবাক হলেন বেশ। এমনি ত্রয়ীর উপরে তার যতই রাগ-ক্ষোভ থাকুক না কেন, মেয়েটাকে কখনো বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার কথা ভাবেননি তিনি। ত্রয়ীও আঁতকে উঠল রিমার কথায়। এরা কি এখন সত্যিই তাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিবে? মা মেয়ে যা শুরু করেছে তাতে বের করেও দিতে পারে। সে যা বলে তারই উলটোটা বের করে এই মা মেয়ে। যেন সব দোষ শুধু তারই। সেই সবকিছু রটিয়েছে, ঘটিয়েছে। কিন্তু এ বাড়ি থেকে তাকে বের করে দিলে সে কোথায় যাবে? তার যে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। যদি তাই থাকতো তবে এদের এত অপমান সহ্য করে নিশ্চয়ই এখানে থাকতো না। ত্রয়ী ভীত রমনী, আরও ভীত হলো। তার কান্না পেল ভীষণ। কোনো রকমে কান্না আটকে কিছু বলবে তার পূর্বেই ফাহমিদা বেগম বললেন,
“কিসব বলছিস? ওকে বাড়ি থেকে বের করবো কেন?”
“বাড়ি থেকে বের করবে না তো তোমার আরও ক্ষতি করার জন্য ওকে এ বাড়িতে রেখে দিবে? ইতোমধ্যে তোমার ছেলেকে ফাঁ’সি’য়ে বিয়ে করে নিয়েছে ও। এখন শুধু তোমার সংসারটাকে কব্জায় নিয়ে আমাকে, তোমাকে, সবাইকে এ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়াই বাঁকি আছে।”
ত্রয়ী জানতো রিমা তাকে অপছন্দ করে। তাই বলে যে মেয়েটা নিজ মনে তার জন্য এত বি’ষ, এত নেতিবাচক চিন্তা চেতনা পুষে রেখেছে তা বুঝতে পারেনি। ত্রয়ী ফুঁপিয়ে উঠল। ধরা গলায় বলল,
“আমাকে দয়া করে এ বাড়ি থেকে বের করে দিবেন না। আমার যে কেউ নেই। আপনারাও যদি আমাকে বের করে দিন তাহলে আমি কোথায় যাব?”
“আমার ভাইকে ফাঁসানোর আগে এ কথা মনে ছিল না তোর? আমার ভাইকে গ্রামে নিয়ে, ফাঁ’সি’য়ে তার গলায় ঝুলে পড়েছিস। তারপরেও আশা রাখছিস তোকে আমরা এ বাড়িতে রেখে দেব?”
“আপনারা ভুল বুঝছেন আমাকে? আপনারা যেমনটা ভাবছেন তার কিছুই আমি করিনি। আমি শীর্ষ ভাইকে ফাঁ’সা’ই’নি। শীর্ষ ভাই আসুক। তাকে জিজ্ঞেস করিয়েন। তাহলেই সব পেয়ে যাবেন।”
“শীর্ষ ভাইকে আবার কি জিজ্ঞেস করবো? আমাদের কি তোর ব’ল’দ মনে হয়? আমরা ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? তুই যে শীর্ষ ভাইকে ফাঁ’সি’য়ে বিয়ে করেছিস তা তোর কথাতেই স্পষ্ট। নয়তো রাতের আঁধারে শীর্ষ ভাই বাইরে বেরুনোর পরপরই তুই কেন বের হবি।”
“বহুদিন পর চিরচেনা গ্রামে গিয়ে আবার পরের দিনই চলে আসবো ভেবে খারাপ লাগছিল, ঘুম আসছিল না। তাই নিজের বেড়ে ওঠা, শৈশব কাটানো প্রিয় ঘরটা দেখতে বেরিয়েছিলাম।”
“রাতের আঁধারে বেরিয়েছিলি তুই ঘর দেখতে? এটা তুই বললি আর আাদেরও বিশ্বাস করে নিতে হবে?”
এই টুকু বলে রিমা থামলো। শক্ত কণ্ঠে তার মা-কে বলল,
“এই মেয়েটাকে আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছে না, মা। একে তো আমার ভাইকে ফাঁ’সি’য়ে এত বড়ো একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। এখন আবার একের পর এক মিথ্যা কথা বলছে। ওকে তুমি এখনই এ বাড়ি থেকে বের করে দাও।”
ফাহমিদা বেগম সায় জানাতে পারলেন না মেয়ের কথায়। ইতস্তত করে তিনি বললেন,
“তোর বাবা, ভাই কেউ বাড়িতে নেই। এই মুহূর্তে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়াটা বোধহয় উচিত হবে না।”
“বাবা, ভাই বাড়িতে এলে তারা তোমাকে ওকে বাড়ি থেকে বের করতে দিবে? বাবাকে তো আগেই হাত করে নিয়েছে ও। আর ভাইকে একবার ফাঁসিয়ে ঘাড়ের উপরে জেঁকে বসেছে। এখন বাড়িতে এলে দেখবে বিভিন্ন কলাকৌশল খাটিয়ে আবারও কোনো না কোনোভাবে ফাঁসিয়ে দিয়েছে।”
“কিন্তু ওকে বের করে দিলে ও যাবে কোথায়?”
রিমা কণ্ঠ খাদে নামালো। মাকে বুঝানোর উদ্দেশ্যে বলল,
“কেন, গ্রামে পাঠিয়ে দিবে। গ্রামে গিয়ে কিছুদিন থাকুক ও। তার মধ্যে শীর্ষ ভাইয়ার জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখো। ও এ বাড়িতে থাকা অবস্থায় ভাইয়ার জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখলে কিংবা তাকে বিয়ে দিতে চাইলে ও ঝামেলা করতে পারে। তারপর এদিকে সব ঠিকঠাক হলে না হয় ওকে আবার নিয়ে আসবে। তবে একটা কথা বলে রাখি, পরের বার ওকে আর এ বাড়িতে আনবে না। কলেজ হোস্টেলে দিয়ে দিবে।”
ফাহমিদা বেগমের পছন্দ হলো রিমার প্রস্তাবটা। তবুও তিনি কিছুটা সংশয় নিয়ে বললেন,
“তোর বাবা বা শীর্ষ যদি কিছু বলে?”
“শীর্ষ ভাই মনে হয় না কিছু বলবে। শীর্ষ ভাই তো এমনিই এ মেয়েকে পছন্দ করে না। চাপে পড়ে বিয়ে করেছে। সে যদি জানতে পারে তুমি এই মেয়েকে তার ঘাড় থেকে নামানোর জন্য সরিয়ে দিয়েছো তাহলে আরও খুশি হবে। তবে বাবা কিছু বললেও বলতে পারে। তাকে তুমি সামলে নেওয়ার চেষ্টা করবে। পারবে না সামলে নিতে? তোমার ছেলের ভবিষ্যতের জন্য, তাকে একটি অ’প’য়া মেয়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তোমাকে এই টুকু করতেই হবে, মা।”
ফাহমিদা বেগম কিছুটা সময় নিয়ে ভাবলেন। অতঃপর পা চালিয়ে গেলেন নিজ কক্ষে। তবে খুব বেশি সময় নিলেন না তিনি। মিনিট কয়েক পরেই হাতে কিছু টাকা নিয়ে এসে দাঁড়ালেন ত্রয়ীর মুখোমুখি। হাতের টাকা গুলো মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“এখানে পাঁচ হাজার টাকা আছে। এই টাকা নিয়ে তুমি গ্রামে চলে যাও। তবে সাবধান সেখানে গিয়ে আমার ছেলে বা স্বামীর সাথে কোনো ধরণের যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না তুমি। আরও টাকার প্রয়োজন হলে আমাকে কল করবে।”
ত্রয়ী টাকা গুলো নিল না। সে বেশ ভালোভাবেই বুঝলো এরা মা, মেয়ে মিলে তাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ারই পাঁয়তারা করছে। কিন্তু শীর্ষকে না জানিয়ে সে কোথায় যাবে? গ্রামেও বা একা কিভাবে যাবে? সে তো নিজ গ্রামেই তেমন কখনো একা চলাফেরা করেনি। সেখানে এত দূরের পথ কিভাবে যাবে? আর তাছাড়া তার বিয়ে হয়ে গেছে। বাঙালি নারীদের জীবনে বিয়ে একটাই। সেই স্বামী, সংসার রেখে এদের কথায় চলে যাওয়াটা কি ঠিক? তবে কি ত্রয়ীর সব স্বপ্ন এখানেই ভেঙে যাবে? তার একজন ভালোবাসার মানুষ, সুন্দর ভরপুর একটি সংসার কখনোই হবে না? সারাটা জীবন তার দুঃখে দুঃখেই যাবে? ত্রয়ী ডুকরে কেঁদে উঠল। অনুরোধের সুরে বলল,
“আপনারা দয়া করে আমাকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিবেন না।”
“এত কিছুর পরও তোমাকে এ বাড়ি বের করে দেব না তো কি করবো?”
ত্রয়ীর হৃদয় ভেঙে এলো। দ্রুত সে পায়ে পড়ে গেল ফাহমিদা বেগমের। দুই হাতে ভদ্র মহিলার পা জড়িয়ে বলল,
“আপনি আমাকে বলেছিলেন আপনাকে যেন আমি নিজের মা মনে করি। কোনো মা কি পারে তার মেয়েকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিতে? আমাকে দয়া করে একটু সময় দিন। আমি প্রমাণ করে দেব যে আমি কিছুই করিনি, শীর্ষ ভাইয়াকে ফাঁ’সি’য়ে আমি বিয়ে করিনি। তবুও দয়া করে আমাকে এভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিবেন না।”
ফাহমিদা বেগমের মন তবুও গললো না। ঝাড়া দিয়ে তিনি নিজের পা দুটো ছাড়িয়ে নিলেন ত্রয়ীর বাঁধন থেকে। শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“বের করে দিচ্ছি বলতে তোমাকে পুরোপুরিভাবে তো আর নিঃস্ব করে দিচ্ছি না। টাকা দিচ্ছি, গ্রামে যেতে বলেছি। রাতের আঁধারে টাকা পয়সাহীন ভাবে তো আর পথে ছেড়ে দিচ্ছি ন তাই না?”
কথাটা বলে ফাহমিদা বেগম তাকালেন রিমার দিকে। আদেশের সুরে বললেন,
“ওর ঘর থেকে ওর জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে আন। তারপর স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়ে আয়।”
মায়ের আদেশ আসতে দেরি তবে রিমার ত্রয়ীর ঘরের দিকে ছুট লাগাতে দেরি হলো না। পন্না এবং নুড়ি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ফাহমিদা বেগম এবং রিমার কান্ডকীর্তি। ত্রয়ীর জন্য তাদের খারাপ লাগছে ভীষণ। তবে এই দুই নারীর মুখের উপরে কিছু বলার সাহস হচ্ছিল না তাদের এতক্ষণ। পান্না ছোট, আর নুড়ির কিছু বলা মানেই নিজের চাকরি হারানো। কত কষ্ট করে সে এই চাকরিটা জুটিয়েছে। এটা চলে গেলে দুই বেলা দুই মুঠো খাবার পাওয়াই দায় হয়ে পড়বে তার জন্য। তবে এ পর্যায়ে এসে পান্না আর নিজের মুখ বন্ধ করে রাখতে পারলো না। ইতস্তত করে বলল,
“ভাইয়ার সাথে একবার কথা বলে সিদ্ধান্ত নিলে হতো না?”
ফাহমিদা বেগম সাথে সাথে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন পন্নার দিকে। শাসনের সুরে বললেন,
“ছোট ছোটর মতো থাকো। তোমাকে এখানে কেউ কথা বলতে বলেনি।”
পন্না চুপ হয়ে গেল। ততক্ষণে রিমাও ত্রয়ীর ব্যাগ গুছিয়ে এসে দাঁড়াল বসার কক্ষে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হয়ে গেছে মা। ওর ব্যাগ নিয়ে এসেছি।”
ত্রয়ী এখনো নিচে মেঝেতে বসা। আঁখি দ্বয় অশ্রু কণায় পরিপূর্ণ, হৃদয় ভারী। তবুও নিজের স্বামী, সংসার বাঁচাতে একবার শেষ চেষ্টা করতে চাইলো সে। আবারও দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো ফাহমিদা বেগমের পা জোড়া। কান্না বিজরিত কণ্ঠে বলল,
“আন্টি অন্তত শীর্ষ ভাইয়াকে আসতে দিন। তার সাথে কথা বলুন। তিনি যদি একটা বারের জন্যও আমাকে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলে তবে আমি সাথে সাথে বেরিয়ে যাব।”
ফাহমিদা বেগম নিজের কথায় অটল। তিনি ফের সরে গেলেন দূরে। রিমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ওকে নিয়ে যা।”
রিমা এগিয়ে এলো ত্রয়ীর দিকে। মেয়েটার হাত টেনে দাঁড় করালো। টেনে দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
“চল, এ বার দেখি তুমি কিভাবে এ বাড়িতে থাকিস।”
ত্রয়ী রিমার হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইল। অশ্রু সিক্ত কণ্ঠে বলল,
“জ্ঞানত আমি আপনার সাথে কখনো খারাপ কিছু করিনি আপু। তারপরেও আপনি কেন আমার সাথে এমন করছেন? দয়া করে আমাকে বের করে দিবেন না। অন্তত শীর্ষ ভাইয়ার বাড়িতে আসা পর্যন্ত আমাকে থাকতে দিন।”
রিমা শুনলো না কোনো কথা। ত্রয়ীর হাত টেনে এনে বসলো বাড়ির গাড়িতে। গাড়ি চালককে তাড়া দিয়ে বলল,
“চাচা, তাড়াতাড়ি স্টেশনে চলুন।”
কিছুটা সময় গড়াতেই স্টেশনে এসে পৌঁছাল ত্রয়ী এবং রিমা। গাড়িতে ওঠার প্রথম দিকে সে কান্নাকাটি কিংবা অনুনয় বিনয় করলেও এখন চুপ হয়ে গেছে। চোখের পানি অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। দেহে যেন হানা দিয়েছে পাথরের ভার। দৃষ্টিও নিষ্প্রাণ। রিমার তাড়ায় কাঠের পুতুলের ন্যায় গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়াল সে। তবে মুখ ফুটে আর বলল না কিছুই। রিমা একটু সময় নিয়ে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কেটে আনলো। অতঃপর মেয়েটিকে নিয়ে উঠলো বাসে। খুঁজে খুঁজে তাকে বসিয়ে দিলো নির্ধারিত সিটে। অতঃপর টিকেটটা ত্রয়ীর হাতে দিয়ে বেরিয়ে এলো বাসের বাইরে। তবে বেরিয়ে আসার আগে বলে এলো,
“গ্রামে পৌঁছে মায়ের নাম্বারে কল করিস।”
ত্রয়ী তাকালো তার হাতে থাকা কাগজের টিকেটটার দিকে। জীবন কত নিষ্ঠুর তাই না? সবকিছু হারিয়ে একজন মানুষের দয়ার উপরে নির্ভর করে সে এসে উঠেছিল এই শহরে। তারপর তার বিয়ে হলো, একজনকে ভালোবাসলো, একটি সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখলো অথচ তার কিছুই হলো না। তীব্র লাঞ্ছনা, অপমান মাথায় নিয়ে আজ আবার ছেড়ে যেতে হচ্ছে এই শহরকে। আসলে ত্রয়ীর কপালটাই খারাপ। কেউ একজন বোধ হয় বলেছিল,
“নারীদের সুন্দর চেহারার চেয়ে সুন্দর ভাগ্য হওয়াটা জরুরি।”
ত্রয়ীর চেহারাটা তো সুন্দর হয়েছে কিন্তু ভাগ্যটা সুন্দর হয়নি। তবে ত্রয়ী এবারে ভেবে নিয়েছে আর সে কোনো অপমান সহ্য করবে না, নিজের আত্মসম্মানের সাথে কোনো সমঝোতা করবে না। অনেক হয়েছে। সেও তো একটা মানুষ। আর কত সহ্য করবে সে? প্রয়োজনে এই ব্যস্ত শহরের কোনো যানবাহনের নিচে অথবা কোনো বিশালদেহী নদীর বুকে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দিবে তবুও নিজের আত্মসম্মানের সাথে আর কোনো সমঝোতা করবে না সে। আর রইল ভালোবাসা! এই পৃথিবীতে ভালোবাসা বলতে কিছু নেই। সবই মায়া, মোহ। ত্রয়ীর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে শীর্ষ তাকে কখনো ভালোই বাসেনি। যদি ভালোবাসতো তবে তাদের বিয়ের বিষয়টা লুকিয়ে রাখতো না। আরও ঢাক ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাতো যে ত্রয়ী তার স্ত্রী। তাকে এই সমাজে যোগ্য সম্মান দিতো। আর তাহলে আজ এতকিছু হতোই না। তাকে এতটা অপমান সহ্য করতে হতো না। সব কিছু গুছিয়ে, বাবা মা সবাইকে রাজি করিয়ে আবার নাকি তাকে বিয়ে করবে। অভিনয়, সব অভিনয়।
অনুরাগে তুই পর্ব ৫৭
ত্রয়ী আর কখনো ঐ বাড়িতে ফিরে যাবে না, গ্রামেও যাবে না। মেয়েটা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।
নিজের হাতে ধরে রাখা টিকেটটা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে উড়িয়ে দিলো অভিমুখে। অতঃপর ব্যাগ ঘেটে মোবাইলটা বের করে শেষবারের মতো শীর্ষকে একটি মেসেজ করল,
“আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে অবশেষে আমি হারিয়ে গেলাম। আমাদের আর কখনো দেখা না হোক, একে অপরের সান্নিধ্যে আর আসা না হোক।”