অন্তঃদহন পর্ব ১২

অন্তঃদহন পর্ব ১২
DRM Shohag

অরুণ মেঝেতে শুয়ে কয়েকবার কেশে ওঠে। অরুণের কাশির শব্দ পেয়ে আকাশ একবার পিছু ফিরে তাকালো। সন্ধ্যা আকাশের হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নেয়। আকাশ কিছু বলল না। উঠে গিয়ে ঘরের দরজা আটকে দিল। এরপর এগিয়ে এসে সন্ধ্যা কে কোলে তুলে বেডে বসিয়ে দিল। সন্ধ্যা একটু কেঁপে ওঠে, তবে চুপ থাকলো। আকাশ একটি চেয়ার এগিয়ে আনলো অরুণের সামনে। এরপর বেশ শক্তি খাঁটিয়ে দু’হাতে অরুণকে তুলে চেয়ারে বসালো। অরুণ চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়েছে।
আকাশ আশেপাশে ফাস্টএইড বক্স খুঁজল। ঘরের কর্ণার টেবিলের কাছে পেয়ে-ও গেল। এগিয়ে গিয়ে ফাস্টএইড বক্স টি নিয়ে সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়ে কিছু ব্যান্ডেজ সহ মলম সন্ধ্যার সামনে রেখে বলে,

– পা ব্যান্ডেজ করে নাও। ফাস্ট। অরুণকর অবস্থা খারাপ। তুমি ব্যান্ডেজ করতে পারবে না?
সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকালো। আকাশের মুখে মলিনতার ছাপ। আকাশ সন্ধ্যাকে চুপ দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,
– পারবে?
সন্ধ্যা ডানদিকে মাথা কাত করে হ্যাঁ বোঝায়।
আকাশ অরুণের সামনে বরাবর একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসে। বা পায়ের উরুর উপর ফাস্টএইড বক্স রেখে অরুণের ক্ষতস্থানগুলো তুলোর সাহায্যে মুছে দিতে থাকে। সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। লোকটি তার বন্ধুকে কিভাবে মা’র’লো, আবার সে নিজেই তাকে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। সন্ধ্যা একা একা যেটুকু পারলো সেটুকু-ই ব্যান্ডেজ করে নিল তার পা। কাঁচের কোণা দিয়ে পায়ের সাইড দিকে কেটে গভীর ক্ষ’ত হয়েছে।
দরজায় করাঘাতে সন্ধ্যা ঘাড় ঘোরায়। আকাশের হাত থেমে যায়। আনিকা হাঁপানো কণ্ঠে বলে,
– আকাশ দরজা খোল।
সন্ধ্যা বেড থেকে নামতে নেয়ার আগেই আকাশ আওয়াজ করে ঠান্ডা গলায় বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আনিকা তোরা যা। আমার অরুণের সাথে কথা আছে।
আকাশের শান্ত গলায় আনিকা শান্ত হলো। রাব্বির দিকে তাকালে দেখল রাব্বি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আনিকা রাব্বির হাত ধরে বলে,
– চলো।
রাব্বি অবাক হয়ে বলে,
– যাবে মানে? আকাশ অরুণকে মা’র’ছে বললে যে।
আনিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– হুট করে র’গে যায় ও। একটু পর-ই ঠান্ডা হয়ে যায়। এখন ও নিজেই অরুণের ব্যান্ডেজ করছে হয়তো। ও এরকম-ই। তুমি এসো।
রাব্বি আর কিছু বলল না। আনিকার সাথে জায়গাটি প্রস্থান করে।
আকাশ নিরবে অরুণের মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে যেখানে যেখানে কেটেছে সেখানে বেশ কয়েকটা ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়। ডান হাত মাথায় দিয়ে অরুণের মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

– মাথা ব্য’থা আছে?
অরুণ ছোট করে,
– হুম।
– দুপুরে খেয়েছিস?
অরুণ ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর, – হুম।
আকাশ ফাস্টএইড বক্স উল্টেপাল্টে টাফনিল খুঁজে না পেয়ে বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– বা’লের বক্স রেখে কি লাভ? কাজের সময় কিছুই পাওয়া যায় না।
বলে হাতের ফাস্টএইড বক্স ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও বক্সের এক কোণায় একটি টাফনিল দেখে আকাশ হাতে নেয় ওষুধ টি। এরপর চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে টি-টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে অরুণের সামনে ধরে বলে,

– খেয়ে নে।
অরুণের দুর্বল শরীর টা একটু নড়ে ওঠে। চোখজোড়া খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশ তার দিকে চেয়ে আছে। অরুণ আকাশের হাত থেকে ওষুধ আর পানি নিয়ে ওষুধ খেয়ে নেয়। আকাশ অরুণের থেকে গ্লাস নিয়ে টেবিলের উপর রেখে আসে। এরপর আবার-ও অরুণের সামনে চেয়ারে বসে। অরুণ চেয়ারে দু’হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজে রেখেছে। আকাশ চেয়ারে হেলান দেয়। বা পায়ের উপর ডান পা রেখে ডান হাত ভাঁজ করে কপালে দু’আঙুল ঘষে। বাম পা নাড়ায়, দৃষ্টি অরুণের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
– কবে থেকে চিনিস অনামিকাকে?
অরুণ যেমন ছিল সেভাবেই উত্তর করল,

– একবছর।
– আনিকার বোন জানতিস না?
– জানতাম না। কিছুক্ষণ আগে জেনেছি।
– অনামিকার ফিলিংস নিয়ে এতোবাজে কেন খেললি?
অরুণ চোখ মেলে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মলিন গলায় বলে,
– ওর ফিলিংস নিয়ে খেলিনি আমি। ওকে অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিলাম, ও থাকেনি আমার কাছে।
আকাশ শক্ত কণ্ঠে বলে,
– মেয়েদের মাঝে ডুবে থাকিস। এরকম ক্যারেক্টারলেস ছেলের কাছে কোনো ভদ্র মেয়ে থাকে না।
অরুণের মুখ মলিন হলো। আকাশ রাগান্বিত স্বরে বলে,
– ওর নু’ড পিকগুলো সব ডিলিট কর। এক্ষুনি।
অরুণ ঢোক গিলে। থেমে থেমে বলে,
– পারবো না, স্যরি!
কথাটা শুনতেই আকাশ অরুণের চেয়ারের হাতলে ডান পা রাখে। এরপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– অরুণ আমি ঠান্ডা আছি। প্লিজ আর রা’গা’স না। চুপচাপ অনামিকার সব পিক ডিলিট করবি।
অরুণ দুর্বল কণ্ঠে বলে,

– ওর পিক ডিলিট করলে ও বিয়ে করে নিবে। ওকে অন্যকেউ ছুঁয়ে দিবে। আমি এটা মানতে পারিনা ইয়ার!
আকাশ শান্ত চোখে তাকালো। অরুণের কথায় সে হাসফাস করল। সন্ধ্যার প্রতি সেইম ফিলিংস টা সে তার মাঝে লক্ষ্য করেছে। ব্যাপারটায় মারাত্মক বিরক্ত হলো আকাশ। মৃদুস্বরে বলে,
– এরকমটা তোর কেন মনে হয়?
অরুণ হেসে বলে,

– কেন যেন ওকে বউ বউ লাগতো। অন্যদের সাথে স্বভাবগত টাইম পাস করতাম। কিন্তু অনামিকার প্রতি ডিফরেন্ট ফিলিংস্। কিন্তু মেয়েটা আমাকে বুঝল না। পিক ভাইরাল করার ভ’য় দেখাতাম। সেই ভ’য়ে আমার সাথে একটু একটু কথা বলতো। কিন্তু আগের মতো ভালো করে কথা বলেনি কখনো। ওর যে বিয়ে আমাকে জানায়নি পর্যন্ত। এখানে এসে ওকে দেখে চিনতে পারলাম। এরপর আবার-ও ব্ল্যাকমেইল করলাম, ও বিয়ে ভেঙে দিল।
আনিকার বোনের বিয়েতে আসতে চায়নি, না আসলে তো অনামিকার বিয়ে হয়ে যেত! এসে ভালো করেছি।
আকাশ সব শুনলো। বউ বউ! সন্ধ্যা তার বউ বলে তার এই ফিলিংস্? কথাটা ভাবনায় আসতেই আকাশ কিছু হিসাব কষল মনে হলো। আপাতত এই বিষয় চেপে রেখে রে’গে বলে,
– তোর ল’জ্জা করে না, আনিকার বোনকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে?
– ভালোবাসি ওকে।
কথাটা শুনে আকাশ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। মে’জা’জ বি’গ’ড়ে যায়। এপাশ-ওপাশ হাঁটল কয়েকপা। অতঃপর থেমে বলে,

– এই ভালোবাসা শব্দটা আসলে কি বোঝা আমাকে? আমি এসবের ব্যাপারে জানিনা। বাট, এটলিস্ট এইটুকু বুঝি, কেউ মেয়েদের মধ্যে ডুবে থেকে কাউকে ভালোবাসতে পারে না।
একটু থেমে আবার-ও আকাশ বলে,
– চুপচাপ অনামিকার সব পিক ডিলিট কর।
অরুণ চোখ বুজে মৃদুস্বরে বলে,
– ওর বিয়ে অন্য কারো সাথে হবে না। ফিউচারে ওই আমার বউ হবে। তাই এসব ডিলিট করার প্রয়োজন নেই।
আকাশ রে’গে বলে,
– এতো মা’র খেয়ে-ও তোর শিক্ষা হয়নি?
অরুণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রে’গে বলে,
– না হয়নি। আর আমি বিয়ে করতে চাই আর তুই তো তোর বউকে ডিভোর্স দিবি। আমার ব্য’থা কেমনে বুঝবি?
আকাশ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

– হ্যাঁ আমি আমার বউকে না ছুঁয়েই ডিভোর্স দিব। তোর মতো খেয়ে ছেড়ে দিব না-কি!
এ পর্যায়ে অরুণ চুপ হয়ে গেল। আকাশ উল্টো ঘুরে আবার-ও অরুণের দিকে তাকাতে গিয়েও তাকালো না। সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হয়। অরুণের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে সন্ধ্যার কথা ভুলেই গিয়েছিল।
সন্ধ্যা চুপচাপ অরুণ আর আকাশের কথা শুনছিলো। অরুণের কথায় যতটা অবাক হয়েছিল আকাশের লাস্ট কথায় তার চেয়ে-ও কয়েশ গুণ অবাক হয়ে চেয়ে আছে।
আকাশ কিছু বলতে গিয়ে-ও থেমে গেল। সন্ধ্যার পায়ের দিকে নজর করলে দেখল পায়ে ব্যান্ডেজ করেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে খুলে যাবে এক্ষুনি। আকাশ এগিয়ে গিয়ে ডান পা বেডের উপর রেখে সামান্য ঝুঁকে সন্ধ্যার পা টেনে নিয়ে রে’গে বলে,

– কিছুই তো পারো না। পারো টা কি তাহলে?
বলতে বলতে সন্ধ্যার পায়ের আলগা হয়ে থাকা ব্যান্ডেজ ভালোভাবে লাগিয়ে দেয়। সন্ধ্যা চুপচাপ আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশ তার কাজ করে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
সন্ধ্যার বিস্ময় মুখপানে চেয়ে আকাশ ভ্রু কোঁচকালো। বউ শব্দটা মাথায় বাজলো। যেটাতে আকাশের বিরক্তির মাত্রা বাড়লো। সন্ধ্যার দিকে চেয়ে শক্ত করে বলে,
– প্রিপেয়ার ফর ডিভোর্স পেপার।
কথাটায় কি ছিল কে জানে। সন্ধ্যার সারা শরীর কেঁপে উঠল। আকাশ কথাটা বলে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য দরজা খোলে, তখন-ই অনামিকা ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে আসে। দরজা খোলা পেয়ে হুড়মুড় করে ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়। আকাশ দ্রুত কয়েক পা দূরে সরে দাঁড়ায়।
অনামিকা অরুণের দিকে তেড়ে গিয়ে অরুণের ডান গালে ক’ষি’য়ে দু’টো থা’প্প’ড় মা’রে। অরুণ সহ সকলে হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। অনামিকা দু’হাতে অরুণের শার্টের কলার ধরে কান্নামাখা গলায় বলে,

– খুশি হয়েছিস তুই আমার জীবন জা’হা’ন্না’ম বানিয়ে? বল খুশি হয়েছিস? চরিত্র’হীন, ল’ম্প’ট কথা বলছিস না কেন?
অরুণের চোখেমুখে অসহায়ত্ব। অনামিকার ফর্সা দু’গাল টকটকলে লাল। অরুণ ঢোক গিলে বলে,
– তোমাকে কে মে’রে’ছে?
আনিকা দ্রুত এগিয়ে এসে অনামিকাকে টেনে সরিয়ে আনে। অরুণের দিকে ভস্ম করে দেয়া চোখে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– এ আমার বোনের জন্য দরদ দেখায় কেন? আকাশ ওকে নিয়ে যা এখান থেকে।
অরুণ এগিয়ে এসে বলতে চায় কিছু। আকাশ দ্রুত অরুণকে টেনে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে থাকে। অরুণ আকাশকে বাঁধা দিল না। অনামিকার কান্নারত মুখপানে দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যায় আর ভারী গলায় বলে,

– অনামিকা আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, প্লিজ রাজি হয়ে যাও।
অনামিকা তেড়ে যেতে নিলে আনিকা তার বোনকে টেনে ধরে। অনামিকা চিৎকার করে বলে,
– আমি বি’ষ খেয়ে ম’রে যাবো, তবুও তোর মতো চরিত্রহী’নকে বিয়ে করব না।
অরুণের মুখে অসহায়ত্বের ছাপ ফুটে ওঠে। আকাশ অরুণের কলার ধরে টেনে বের করে নিয়ে যায়।
অনামিকা কান্নায় ভেঙে পড়ে। আনিকা দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে অনামিকাকে তার বেডে বসায়।
বরযাত্রী রা চলে গিয়েছে। আনিকার বাবা মা ঘরে দরজা আটকে বসে আছেন। মানসম্মান হারিয়ে সকলে যেন দিশেহারা।
ঘণ্টাখানেক আগে অনামিকাকে পা’গ’লের মতো কাঁদতে দেখে আনিকা ঘাবড়ে গিয়েছিল। প্রথমে ভেবেছিল বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে হয়তো কাঁদছে। কিন্তু এভাবে কে কাঁদে? আনিকা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অনামিকা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

– সে বরকে তার রিলেশনের কথা বলে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে।
আনিকা অবাক হয়। অনামিকার রিলেশন ছিল? অনামিকা কাঁদতে কাঁদতে শুরু থেকে তার বোনের কাছে সব বলে।
অরুণের সাথে তার ফেসবুকে পরিচয় গত একবছর আগে। সে জানতো না অরুণ আনিকার ফ্রেন্ড। একদম বিদেশি মানুষের মুখে খাঁটি বাংলা ভাষা শুনে অনামিকার ভীষণ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল। অরুণের ব্যাপারে টুকটাক জানে, কথা বলতে বলতে একসময় তাদের মাঝে একটি রিলেশন হয়। এরপর অরুণের চাওয়া বে’ড়ে যায়। অনামিকার কাছে আবদার করে, তার উইথআউট ড্রেসে পিক লাগবে। অনামিকা বুঝত, অরুণদের বিদেশি কালচারে এসব খুব নরমাল, হয়তো রুম ডেট করা-ও খুব নরমাল অরুণের কাছে। কিন্তু সে তো বাঙালি। সে সাথে সাথে স্বায় দিতে পারেনি। এরপর অনামিকা অরুণের সাথে প্রায় দু’দিন যোগাযোগ অফ রেখেছিল। কিন্তু অনামিকা থাকতে পারেনি। আবেগের বয়স ছিল। অরুণকে ভালোবাসার প্রমাণ দিতে গিয়ে নিজের নু’ড পিক অরুণকে সেন্ড করে।
কয়েকমাস পর হঠাৎ জানতে পারে অরুণের মেয়েদের সাথে প্রচুর মেলামেশা। অনামিকা জিজ্ঞেস করলে, অরুণের সহজ উত্তর ছিল, – তুমি রিয়েল, বাকিরা টাইম পাস।

অনামিকার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছিল। সবকিছু এতো দিশেহারা লাগছিল। এরপর অনামিকা যখন অরুণকে ছেড়ে দিতে চায়, তখন শুরু হয় অরুণের ব্ল্যাকমেইল।
সব কথা শুনে আনিকা অনামিকার গালে দু’টো থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়।
কথাগুলো ভেবে আনিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনামিকার মাথা তার কাঁধে রাখলো। ঝাপসা চোখজোড়া বা হাতে মুছে নিল। মানুষটা অন্যকেউ হলে হয়তো এতো খারাপ লাগতো না, যতটা খারাপ লাগছে মানুষটা তার বন্ধু অরুণ হওয়ায়।
সন্ধ্যা মলিন মুখে অনামিকার মুখপানে চেয়ে রইল।৷ ভীষণ খারাপ লাগছে তার। সে বেড থেকে নেমে আনিকার কঁধে হাত রাখলে আনিকা সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যা ইশারায় বোঝায়,

– আল্লাহর উপর ভরসা রাখো, দেখবে সব ঠিক হবে।
এরপর অনামিকার দিকে আঙুল তাক করে বোঝায়,
– আপুকে কিছু বলো না। ভুল থেকে মানুষ শিখে।
সন্ধ্যার বোঝানোর ধরণ খুব সুন্দর ছিল। আনিকা বুঝল সন্ধ্যার ভাষা। মৃদু হেসে বলে,
– তুমি তো ভীষণ লক্ষী মেয়ে সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা দু’হাত দিয়ে বোঝায়,
– তোমরা দু’বোন আরও বেশি লক্ষী, আর মিষ্টি।
সন্ধ্যার বাচ্চামি কথায় আনিকা একটু হাসলো। অনামিকা ঝাপসা চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। নাক টেনে বলে,
– এটা কে আপু?
আনিকা মৃদুস্বরে বলে,

– আকাশের বউ সন্ধ্যা। ওর কথা-ই তোকে বলেছিলাম।
অনামিকা সন্ধ্যার দিকে তাকালো। সন্ধ্যা মলিন মুখে তার দিকে চেয়ে আছে। এসব ঘটনা না হলে হয়তো সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরত। সে জানে সন্ধ্যা কথা বলতে পারে না। কিন্তু এখন কিচ্ছু ভালো লাগলো না।
আনিকা বলে,
– সন্ধ্যা বাইরে তোমার জন্য আন্টি অপেক্ষা করছে।
সন্ধ্যা ইশারায় বিদায় জানিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
কিছুক্ষণ আগেও যে বাড়িতে বিয়ের আমেজে ঘেরা ছিল, এখন তা নিস্তব্ধতায় ঘিরে গিয়েছে। সন্ধ্যা আশপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখে। কিছুদূর এগিয়ে গেলে আসমানী নওয়ান ও তার বোন সহ শিমুকে চোখে পড়ে। ভদ্রমহিলা সন্ধ্যাকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,

– তোর পায়ে কি হয়েছে?
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বোঝায় তেমন কিছু না। এরপর তারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে। আকাশ ড্রাইভিং সিটে, পাশের সিটে অরুণ। আর পিছনে বসেছে সন্ধ্যারা চারজন।
সন্ধ্যা একটু পর পর আকাশের দিকে তাকায়। তার মাথায় বারবার ঘুরছে আকাশের বলা ডিভোর্সের কথাটি। সন্ধ্যা গাড়ির সামনের আয়নায় দৃষ্টি দিলে আকাশের চোখদু’টো দেখতে পায়৷ সন্ধ্যা মলিন মুখে তাকিয়ে রইল।
আকাশ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে। গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ আয়নার চোখ পড়লে সন্ধ্যার সাথে চোখাচোখি হয়। সন্ধ্যা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয়। আকাশের ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়। বা হাতে আয়না ডানদিকে অনেকটা ঘুরিয়ে দিল। সন্ধ্যার নজর এড়ায় না তা। মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে যায়। আকাশের বলা কথাটি তার মনে প্রভাব ফেললেও নতুন লাগছে না। কারণ সে বিয়ের দিন থেকেই শুনেছে তাকে ডিভোর্স দেয়া হবে। তবু-ও মন খারাপ হয়ে যায়।

আকাশ বাসার সামনে গাড়ি সাইড করে। সন্ধ্যা সহ সকলে গাড়ি থেকে নেমে যায়। আকাশ-ও বেরিয়ে আসে। অরুণ ভেতরে-ই বসে থাকলো। সন্ধ্যা হাঁটতে হাঁটতে পিছু ফিরে আকাশের দিকে দু’বার তাকালো। আকাশ উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে মলিন মুখে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।
ধরণীতে সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। অরুণ গাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়েছে। যদি-ও আকাশের মা’র খেয়ে বেচারার অবস্থা একটু খারাপ। তবে আগের চেয়ে ভালো লাগছে। ভার্সিটিতে থাকাকালীন আকাশের হাতে কত ছেলে মা’র খেয়েছে! অনেক রেকর্ড আছে।
আকাশ কিছুদূর গিয়ে দোকান থেকে দু’টো স্প্রিট কিনে আনে। এরপর গাড়ির সামনে বনেটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে। একটি স্প্রিট বনেট এর উপর রেখে আরেকটি বোতলের মুখ খুলে ছুঁড়ে ফেলে। এরপর ঢকঢক করে অর্ধেকটা স্প্রিট খেয়ে অরুণের দিকে চেয়ে বলে,

– তোর ফোন দে।
অরুণ আকাশের কথামতো ভদ্রভাবে ফোন দিয়ে দিল আকাশ হাতে। আকাশ কোনো কথা ছাড়া-ই অরুণের ফোন গায়ের জোরে ছুঁড়ে মা’র’লো। ফোনের অস্তিত্ব নেই। অরুণ হেসে বলে,
– লাভ নাই। আমার সংগ্রহে আছে ওর সব পিক।
আকাশ অরুণের কলার ধরে রে’গে বলে,
– তুই একটা অ’মানুষ। ওর পিকগুলো ডিলিট কর অরুণ। এক কথা বারবার বলতে ভালো লাগছে না আমার।
কথাটা বলে অরুণের কলার ছেড়ে দেয়। বোতল উপুড় করে আরেকবার স্প্রিট ঢালে মুখে। এরপর ভ্রু কুঁচকে বলে,
– শুনেছি, ভালোবাসলে না-কি অপর পাশের মানুষের ক্ষ’তি করা যায় না। যদিও এসব সিনেমার ডায়লগে-ই মানায়। রিয়েলিটিতে তোর মতো-ই কেস হয়। এই যেমন তুই দিব্যি অনামিকার পিক ভাইরাল করার ধান্দায় আছিস।
অরুণ হেসে বলে,

– ওসব সিনেমায় মানায় না, রিয়েলিটিতে-ও হয়৷
আকাশ অরুণের কথায় বিদ্রুপ হাসলো। এক ঢোকে বাকি স্প্রিটটুকু খেয়ে বোতল ছুঁড়ে ফেলে। চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– তুই বলতে চাইছিস তুই অনামিকার পিক ভাইরাল করবি না?
অরুণ মলিন গলায় বলে,
– কখনোই না। ওকে ধরে রাখার জন্য শুধু ভ’য় দেখাই।
আকাশ রে’গে বলে,

– তুই কি পা’গ’ল? ও বলেছে, ও বি’ষ খাবে তবুও তোকে বিয়ে করবে না। চুপচাপ ওর পিকগুলো ডিলিট করে আনিকার বোনকে রেহাই দে। নয়তো তোর অ’ত্যা’চা’রে ওই মেয়ে সত্যি সত্যি বি’ষ খাবে। তখন খাঁটিয়া ধরতে চলে আসিস।
অরুণ ঢোক গিলল। বুকটা কাঁপলো যেন। পকেট থেকে মেমোরি বের করে। আকাশ থাবা নেয়ার মতো করে মেমোরি কার্ড টি অরুণের হাত থেকে নিয়ে মেমোরি ভেঙে ফেলে। অরুণ চোখ বড় বড় করে তাকায়। এখানেই তো সব ছিল। এবার কি অনামিকার বিয়ে হয়ে যাবে? কথাটা মনে আসতেই অরুণের দম আটকে আসলো। অসহায় কণ্ঠে বলে,
– এটা কি করলি তুই?
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,

– এসব মেয়েদের থেকে দূরে সরে আয়। আমার সাথে আন্দোলনে যোগ দে।
আকাশের কথা শুনে অরুণ অবাক হয়। আকাশ আরেকটি স্প্রিটের বোতলের মুখ খুলে স্প্রিট খায় ঢকঢক করে। অরুণ বলে,
– মানে? আন্টিকে মা’র’বি না-কি?
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– লাথি খাবি। মাকে জানাবো না। তাছাড়া মনে হচ্ছে মেয়ে ঘটিত ব্যাপারে জড়িয়ে যাচ্ছি। বিরক্ত লাগছে। এদিকে আসলে মেয়েঘটিত ব্যাপারগুলো থেকে দূরে থাকা যায়। তাছাড়া রাজনীতি তো একেবারে ছেড়ে দিইনি। একটু একটু কানেক্ট ছিলাম। এবার পুরোপুরি মন দিব।

অরুণ চুপ থাকলো। ভার্সিটি লাইফে আকাশ রাজনীতির সাথে বেশ ভালোই যুক্ত ছিল। আসমানী নওয়ান নিয়ম করে অশান্তি করত এসব নিয়ে। আকাশের সাথে রা’গ করে না খেয়ে থাকতো। কখনো কখনো কাঁদতো। ছেলেকে তিনি কিছুতেই এ পথে পা বাড়াতে দিবেন না। আকাশ মায়ের বাধ্যগত সন্তান সাথে মাকে ভীষণ ভালোবাসে। কি করার, মায়ের জন্য তার শখকে দূরে ঠেলে ব্যবসায় মন দিল। এখন আবার-ও সেই পুরনো ইচ্ছা জেগে উঠেছে।
অরুণ মৃদুস্বরে বলে,
– তুই মেয়েটাকে আসলেই ডিভোর্স দিয়ে দিবি?
আকাশ দ্বিতীয় বোতলের সবটুকু স্প্রিট খেয়ে বোতল ছুঁড়ে ফেলে। পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে কল করে। রিসিভ হলে বলে,
– আঙ্কেল প্লিজ যত দ্রুত সম্ভব ডিভোর্স পেপারের ব্যবস্থা করে দিন।
ওপাশ থেকে উত্তর শুনে আকাশ বোধয় সন্তুষ্ট হলো। বলে, – থ্যাঙ্কিউ আঙ্কেল।
এরপর কল কেটে গাড়ির বনেট এর উপর থেকে নেমে বাড়ির ভেতর যেতে যেতে বলে,
– তুই ঠিক বলেছিলি, কাউকে বউ ভাবলে তার প্রতি আলাদা ফিলিংস কাজ করে। আই গেস, সন্ধ্যাকে ডিভোর্স দিলে এই ফিলিংস থেকে মুক্তি পাবো। যত দ্রুত ডিভোর্স হবে তত-ই ভালো হবে।

সেদিনের পর দু’দিন পেরিয়েছে।
আকাশ রাব্বিকে বলেছিলে আনিকাকে নিয়ে তাদের বাড়ি আসতে। মূলত অরুণের সাথে ব্যাপারটা মিটমাট করাতে। কিন্তু আনিকা অরুণকে দেখে শুধু তেড়ে যাচ্ছে। কথা-ই বলতে দিচ্ছে না। আকাশ তখন থেকে আনিকাকে বোঝাতে চাইছে। কিন্তু সে শুনছে না। আকাশ না পেরে চিৎকার করে ডেকে ওঠে,
– আনিকাআআআ?
সকলে থমথমে মুখে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ রাগান্বিত স্বরে বলে,
– প্রবলেম কি তোর? ওর কথা না শোন, আমার কথা শোন।
আনিকা রে’গে বলে,

– তোর চরিত্র’হীন বন্ধুর হয়ে একটা সাফাই গাইবি না বলে দিলাম।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– আরে আমি কখন সাফাই গাইলাম। বললাম তো, মেমোরি ভেঙে ফেলেছি।
– তোকে-ও বিশ্বাস করিনা আমি। ওর সাথে থেকে থেকে নিশ্চয়ই তোর চরিত্রে-ও দাগ পড়েছে, এজন্য ওর হয়ে সাফাই গাইছিস।
আকাশ খেয়ে ফেলা দৃষ্টিতে তাকায় আনিকার দিকে। রাব্বি আনিকাকে টেনে সোফায় বসিয়ে বলে,
– আনিকা শান্ত হও। কি বলছ এসব?
– এই বের হ আমার বাড়ি থেকে। যা বের হ।
আসমানী নওয়ান আকাশের চিৎকার শুনে ড্রয়িং রুমে এসেছিলেন। আকাশের কথা শুনে এগিয়ে এসে বলেন,
– আকাশ কি কইতাছ তুমি?
আনিকা রে’গে বলে,

– তুই তো ডেকে আনলি, এখন বের করে দিতে চাইছিস কোন আক্কেলে?
– কারণ এই বাড়িতে কোনো ডা’ই’নির জায়গা নেই। যা বের হ।
– যাবো না। এক মাস থাকবো এইখানে। কি করবি কর যা।
আকাশ কটমট দৃষ্টিতে তাকায় আনিকার দিকে। রাব্বি আর অরুণ হেসে ফেলল এদের কথা শুনে। যদিও অরুণের মুখ মলিন। কিন্তু তাদের তিনবন্ধুর কথার কাটাকাটি হলে অপর পাশের জন না হেসে পারেনা। আসমানী নওয়ান কপাল চাপড়ালেন এদের ভিত্তিহীন কথায়।

রাত তখন ১২ টার কাছাকাছি। আনিকা রাব্বি তাদের বাড়িতেই আছে। আকাশ ছাদে দাঁড়িয়ে আনিকাকে কল করে।
– ছাদে আয়।
আনিকা বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– কেন? পারবো না। ঘুম পেয়েছে আমার।
বলেই খট করে কল কেটে দেয়। আকাশ বিরক্ত হয়ে রাব্বির ফোনে কল করে।
– রাব্বি তোমার বউকে নিয়ে ছাদে আসো। না আসতে চাইলে টেনে নিয়ে আসো। আর্জেন্ট। সাথে একটা পেন আনবে।
রাব্বি সম্মতি দিয়ে কল কেটে দেয়। মিনিট দশেক পর রাব্বি আনিকাকে নিয়ে ছাদে এসে দেখল আকাশ ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। আনিকা ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে এসে বলে,
– এই কি বলবি বল? এতো রাতে মানুষকে ডিস্টার্ব করা ছাড়া তোর কাজ নাই?
আকাশ রাব্বির দিকে চেয়ে বলে,

– এই ডায়নিকে ডিভোর্স দাও না কেন? বউ মানেই প্যারা। কোন দুঃখে বিয়ে করলে? এতো না করলাম, তাও শুনলে না!
আকাশের কথায় রাব্বি একটু হাসলো।
আনিকা কোমরে দু’হাত রেখে দাঁত কটমট করে বলে,
– নিজের বউকে ডিভোর্স দিবি বলে আরেকজনকে-ও কানপড়া দিতে ল’জ্জা করে না তোর?
আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– সন্ধ্যাকে কেমন লাগে তোর? লোভী টাইপ? সেই মেয়েদের মতো?
আনিকা একটু চুপ থেকে বোঝানোর স্বরে বলে,
– তুই দু’জনের জন্য সবাইকে এক কাতারে ফেলিস কেন বুঝলাম না। আমি, শিমু তোর মা, খালা আমরা কি সেরকম? তাহলে তুই সন্ধ্যা মেয়েটাকে এসব ব্লেম দিস কোন লজিকে?
আকাশ ছাদের রেলিঙের উপর এক লাফে উঠে বসল। এরপর বলে,

– ফার্স্ট দিন হুট করে রে’গে বলে ফেলেছি। এরপর আর খারাপ মেয়ে লাগেনি। আমার মা দরদী মানুষ। সেসব থাক।
রেলিঙের উপর থেকে নেমে রাব্বির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
– পেন এনেছ?
রাব্বি আকাশের দিকে কলম এগিয়ে দিলে আকাশ কলমটি নেয়। পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে ডান পা রেলিঙের উপর রাখে। এরপর উরুর উপর কাগজটি রেখে ডান হাতে কলম ধরে। বা হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনের ফ্লাশ জ্বালায়। এরপর দুই সেকেন্ডে কাগজে সাইন করে।
আনিকা এগিয়ে এসে কাগজটির দিকে দৃষ্টি দিলে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের দিকে। অতঃপর বলে,
– মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলি?
আকাশ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,

– দিয়ে দিলাম। বিয়েটা আমার সাথে ঠিক যায় না। মেয়েদের পিছনে টাইম পাস করার মতো ফা’ল’তু কাজ করার চেয়ে সমাজসেবা করা ভালো।
আনিকা কি বলবে বুঝল না। সে ভেবেছিল আকাশ মুখে বললেও ছেড়ে দিবে না। বিয়েটা তো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার আকাশকে আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। ভাবলো আকাশের মায়ের সাথে এটা নিয়ে কথা বলবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে নিচে নামতে এগিয়ে যায়।
আকাশ রাব্বির দিকে চেয়ে বলে,
– রাব্বি তোমার ভোট লাগবে। ব্যবসায়িক কোনো কাজ থাকলেও আগামী শুক্রবার ছুটি রাখো।
রাব্বি হেসে বলে,
– অবশ্যই।
আনিকা আকাশ আর রাব্বির কথা শুনে দ্রুত এগিয়ে এসে বলে,

– তুই আবার রাজনীতিতে ঝুঁকছিস আকাশ? আমি এক্ষুনি আন্টিকে গিয়ে বলছি।
আকাশ দ্রুত আনিকার দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– মা কে বললে তোর খবর আছে। তুই তোর সংসারে গিয়ে কু’ট’না’মি কর। আমাকে আমার সংসার করতে দে।
আনিকা অবাক হয়ে বলে,
– তুই তো সন্ধ্যাকে ডিভোর্স দিলি। সংসার করবি কার সাথে?
আকাশ ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– রাজনীতি-ই আমার সংসার। তোরা মেয়েরা এর মর্ম কি বুঝবি! আমাকে সমাজসেবা করতে দে।
আনিকা হেয়ালি করে বলে,
– ওরে আমার সমাজসেবক রে! সেই তো দিনশেষে চৌকির তলায় তেলের খনি পাওয়া যাবে। রাজনীতিবিদ রা সমাজসেবক হয় না, ওরা সমাজশোষক হয়।
আকাশ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

– রাব্বি একে নিয়ে যাও। নয়তো ছাদ থেকে ধাক্কা ম’রে ফেলে দিব বলে দিলাম।
আনিকা আকাশের হাত থেকে কাগজ টান মে’রে নিয়ে দৌড় দেয়। আকাশ হতভম্ব হয়ে যায়। আনিকার পিছে কয়েক পা দৌড়ে গিয়ে থেমে যায়। রাব্বির কাছে এসে বলে,
– রাব্বি পেপারটা নিয়ে আমাকে দিও। ওটা ছিঁড়ে ফেললে ওর একটা চুল-ও রাখবে না।
রাব্বি হেসে বলে,
– তোমদের তিন বন্ধুর চক্করে মাঝে মাঝে আমাকে পা’গ’ল লাগে।
আকাশ কিছু বলল না। তার চোখেমুখে বিরক্তি। কত ক’ষ্ট করে এতো দ্রুত ডিভোর্স পেপার সংগ্রহ করেছিল, আর এই শা’লা রাব্বির বউ এসে বাম হাত ঢুকিয়ে দিল।

পরদিন,
আকাশ আর অরুণ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। আকাশের পরনে সিম্পল সাদা পাঞ্জাবি, সাথে সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। ডান হাতে সিলভার কালার চেইন এর ঘড়ি। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছল। আকাশ মূলত এসেছে পার্টি অফিসের পরিচিত কিছু মুখদের সাথে দেখা করতে। ঢাকা ভার্সিটির কিছু জুনিয়ররা অরুণ আর আকাশকে একটু পর পর কেউ না কেউ সালাম দেয়। অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,
– বাড়ি গেলাম আমি। তুই এখন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি?
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– তুই-ও ঘোর। মেয়েদের ভূত নেমে যাবে মাথা থেকে। তাছাড়া আমি সভাপতি হয়ে গেলে আর ক’ষ্ট নেই। ডিস্টার্ব করিস না আমার কাজে।
সামনে সাধারণ সম্পাদক সহ আরও কিছু সদস্যদের গাড়ি থেকে নামতে দেখে আকাশ এগিয়ে যায়। তারা আকাশকে চিনতে পেরে আকাশের সাথে হাত মেলায়। মৃদুহেসে বলে,

– তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে আমার। ভেতরে এসো।
আকাশ ছোট করে বলে,
– জ্বি আঙ্কেল চলুন।
– মন দিয়ে কাজ কর। খুব তাড়াতাড়ি সফল হবে।
এছাড়া-ও আর-ও অনেক কথা বলতে থাকে।
আকাশ মাথা নিচু করে তার বাবার বয়সী লোকের কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে।

আকাশ গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে। অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,
– তুই কি বাড়ি যাবি? সন্ধ্যা হতে চলল। সেই সকালে বেরিয়েছি।
আকাশ তাকায় অরুণের দিকে। ছোটোখাটো এক আন্দোলন করে ফেলেছে সে। এতোদিন পর এসে রোদে রোদে ঘুরে মাথা এমনি-ই গরম হয়ে আছে তার মধ্যে এ আরেকটা। বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– মেয়েদের মতো এতো প্যানপ্যান না করলে হয়না তোর?
কথাটা বলে আকাশ আধখাওয়া সিগারেট ছুঁড়ে ফেলল। শূণ্যে ধৌঁয়া ছুঁড়ে গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলে,
– সভাপতি হওয়ার পর তোকে একটা বিয়ে দিব। চিন্তা করিস না।
অরুণ চকচকে চোখে চেয়ে বলে,

– সত্যি?
আকাশ গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বা পা রেখে, গাড়ির দরজায় ডান হাত রেখে ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে,
– অনামিকাকে নয়। তুই মেয়ে’বাজ ছেলে। তোর জন্য থাকবে ছেলে’বাজ মেয়ে।
কথাটা বলে গাড়িতে উঠে বসে। অরুণ অসহায় মুখ করে আকাশের পাশের সিটে উঠে বসলে আকাশ গাড়ি স্টার্ট দেয়। আকাশের কিছু একটা মনে পড়তেই হঠাৎ গাড়ির স্পিড একদম হাই করে ফেলে। অরুণ চোখ বড় বড় করে তাকায়। সে সিল্টবেল্ট লাগায় নি। একবার এদিকে ধাক্কা খায়, আরেকবার ওদিকে। কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– আরে আস্তে চালা। মা’র’বি না-কি!
আকাশ সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়ির গতি কমালো না, বরং আরও বাড়ানো গেলে বোধয় বাড়াতো। এক ঘটার পথ ৪০ মিনিটে এসে আকাশ তার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছে। হতদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে বের হয়। অরুণ-ও বের হয়। আকাশ বাড়ির দিকে একপ্রকার দৌড় দেয়, পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে অরুণের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলে,

– গাড়ি গ্যারেজে রাখিস।
অরুণ কিছু বলতে গিয়ে-ও থেমে গেল। এর দিন এখন থেকে এভাবেই যাবে বোঝা শেষ।
আকাশ তাদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে সমানে কলিংবেল চাপে। নিঃশ্বাস নেয় না। ঘাম ছুটছে তার। কিছুক্ষণের মাঝেই বাড়ির এক কাজের লোক দরজা খুলে দিলে আকাশ বাড়ির ভেতরে দৌড় দেয়। ভদ্রমহিলা অবাক হলো। আকাশ কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা ড্রয়িংরুমে যায়। যা ভাবছিল সেটাই।
আসমানী নওয়ান, তার খালা, শিমু, সন্ধ্যা সবাই বসে আছে। সামনে এলিডি টিভি চলছে, যেখানে খবরের চ্যানেল চলছে। একটার পর একটা নিউস স্ক্রিনে ভেসে উঠছে। কি একটু রাস্তায় বের হলো, এখন এটা নিউজে দেখাবে, আর আসমানী নওয়ান দেখলে তো খেল্লা ফতে!
আকাশের দৃষ্টি তার মায়ের দিকে ছিল শুধু। বিড়বিড় করল, – সাড়ে সর্বনাশ!
সময় নষ্ট না করে হতদন্ত হয়ে ড্রয়িং রুমে ভেতরে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে একটি খেলার চ্যানেলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আকাশের এমন কান্ডে সকলে অবাক হয়ে তাকায়।
আকাশ ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। রিমোটটি পাশে রেখে টিভির দিকে মনোযোগ দেয়। আসমানী নওয়ান একবার টিভির দিকে তাকায়, আরেকবার ছেলের দিকে। অবাক হয়ে বলে,

– চ্যানেল বদলাইলা ক্যান?
আকাশ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলে,
– ইম্পর্ট্যান্ট খেলা হচ্ছে। ডিস্টার্ব কর না মা।
আসমানী নওয়ান আগের চেয়ে-ও বিস্ময় চোখে তাকিয়ে বলে,
– তুমি খেলা দেহ কবে থেকে?
আকাশ দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে বলে,
– আজকে থেকে।
শিমু চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। যেখানে খেলা হয়, আকাশ সেখান থেকে উঠে যায়। আজ না-কি ইম্পর্ট্যান্ট খেলা দেখছে।

অন্তঃদহন পর্ব ১১

সন্ধ্যা টিভির চ্যানেলে তাকালে দেখল এটা অনেক আগের খেলা। তাদের বাড়িতে ছোট একটি টিভি ছিল। সৌম্য মাঝেমাঝে খেলা দেখত, সন্ধ্যা একটু একটু বোঝে এসব। সন্ধ্যা সন্দেহী চোখে আকাশের দিকে তাকায়। লোকটি মিথ্যা বলছে, সন্ধ্যা বোধয় ধরতে পারলো।
আকাশ সকলের এরকম জহুরী চোখ তার উপর নিবদ্ধ দেখে বিব্রতবোধ করে। কিছু একটা ভেবে বলে,
– মা বিরিয়ানি রান্না কর তো! আজ বিরিয়ানি খাবো।
আসমানী নওয়ান এবার উঠে এসে আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে বলে,
– মশকরা কর আমার লগে? তুমি বিরিয়ানি খাও?
মায়ের কথায় আকাশ থতমত খেয়ে তাকায়। টেনশনে ভুলভাল বলে ফেলেছে। বিরিয়ানি তো তার শত্রু।

অন্তঃদহন পর্ব ১৩