অন্তঃদহন পর্ব ১৪
DRM Shohag
সৌম্য নিজেকে সামলে নেয়। দু’হাতের মাঝে তার মুখ রেখে কয়েকবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঝাপসা চোখজোড়া কয়েকবার ডলে স্বাভাবিক করে নেয়। এরপর ইরার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। ইরা মাথা নিচু করে ফোঁপাচ্ছে। সৌম্য মৃদুস্বরে ডাকে,
– ইরাবতী?
ইরার দমবন্ধ লাগলো। এই ডাক ডেকে সৌম্য তাকে ভুলে যেতে বলে। সে কি করে পারবে? সৌম্য’র ইচ্ছে করল তার ইরাবতীকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত রাখতে। কিন্তু সে ইচ্ছে যে বামুন হয়ে চাঁদ ধরার মতো। জড়িয়ে ধরতে না পারলেও দু’হাতে ইরার মুখ আগলে নেয় সৌম্য। ইরার মুখ উঁচু করে ইরার কান্নারত মুখপানে অসহায় চোখে তাকালো। ইরার বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে অনবরত নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। সৌম্য দু’হাতে ইরার দু’গাল মুছে দিয়ে ঢোক গিলে বলে,
– ইরাবতী কান্না থামা।
ইরা শুনলো না সৌম্য’র কথা। সৌম্য মলিন গলায় বলে,
– ইরাবতী কাঁদলে আমার ভীষণ বুক ব্য’থা করে।
ইরা আরও ফুঁপিয়ে ওঠে। সৌম্য আবার-ও অসহায় কণ্ঠে বলে,
– কান্না থামাবি না ইরাবতী?
ইরা চোখ মেলে তাকায় সৌম্য’র দিকে। দু’গাল নোনতা জলে ভেজা। সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– অনেক ভালোবাসিস আমাকে?
ইরা ভাঙা গলায় বলে,
– অনেক ভালোবাসি।
– আমার একটা কথা রাখবি?
ইরা চুপ থাকলো। সৌম্য আবার-ও বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– রাখবি?
ইরা সৌম্য’র কথার পিঠে বলে,
– তবে তুই আমাকে ভালোবাসবি সৌম্য?
সৌম্য মলিন হেসে বলে,
– বাসবো।
ইরা অবাক হয়ে বলে,
– কি কথা রাখতে হবে?
– আগে বল রাখবি।
– রাখবো।
সৌম্য চোখ বুজল। গলায় কিছু বিঁধলে যেমন কথা বের হয়না, সৌম্য’র তেমন কথা বেরতে চায়না। দু’বার ঢোক গিলল ছেলেটা। ইরার গাল থেকে হাত সরায়নি এখনো। ইরা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সৌম্য দু’বার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মেলে। ইরার দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলে,
– এবার তুই বিয়ে করে নে ইরাবতী। তোর বিয়ের বয়স অনেক আগে পেরিয়েছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমি তো তোকে গ্রহণ করতে পারব না ইরাবতী। তবে কেন তোর এই অপেক্ষা?
এটুকু বলে থামলো সৌম্য। আটকে রাখা শ্বাস ফেলে। এরপর বলে,
– আমি চাই তোর খুব সুন্দর একটা সংসার হোক। সেই ঘরে একটি ছোট্ট ইরাবতী আসুক, সেই ছোট্ট ইরাবতী যেন রাজকন্যার মতো বড় হয়।
আমার সাথে তোকে জড়িয়ে নিলে ছোট্ট ইরাবতী রাজকন্যা তো দূর, রাজ্যের দাসী-ও হতে পারবে না।
ইরা স্তব্ধ চোখে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ ফেটে দু’ফোঁটা পানি টুপ করে গড়িয়ে পড়লো। সৌম্য ইরার গাল ছেড়ে মাথা নিচু করে নিল। ইরা থেমে থেমে বলে,
– তুই যে বললি, আমাকে ভালোবাসবি?
সৌম্য কিছু বলল না। ইরা আবার-ও বলে,
– আমি অন্যকাউকে বিয়ে করে নিব, আর তুই?
সৌম্য ভারী গলায় বলে,
– আমি-ও বিয়ে করে নিব।
ইরা সৌম্য’র দিকে চেয়ে রইল। মেয়েটির চোখজোড়া আবার-ও ভিজল। কিন্তু তা আর গড়িয়ে পড়লো না। ইরা বোধয় দিল না। নির্জীব চোখে চেয়ে রইল সৌম্য’র পানে। প্রায় ১০ মিনিট এর মতো সৌম্য মাথা নিচু করে থাকলো, আর ইরা স্তব্ধ চোখে সৌম্য’র পানে চেয়ে রইল। এরপর সৌম্য মাথা উঁচু করে তাকায়।
ইরার পোষাকের দিকে নজর করল। পরনে একটি থ্রি-পিস। গলায় ওড়না ঝুলানো। সৌম্য অবাক হলো। ইরার থ্রি-পিস আছে কি-না সৌম্য’র সন্দেহ। অনেক আগে ইরাকে জিজ্ঞেস করেছিল, – ইরা তুই মেয়ে, মেয়েদের পোষাক পরিস না কেন?
উত্তরে ইরা বলেছিল, – ওর শাড়ি, থ্রি-পিস এসব পরলে দমবন্ধ লাগে।
সৌম্য ইরাকে কিছু বলতে গিয়ে-ও আর বলেনি। নিজেকে গুটিয়ে নিত। ইরা তো তার নয়। হয়তো ইরার এরকম কারোর সাথে বিয়ে হবে, যে ইরাকে এসব পোষাক-ই পরতে বলবে। আজ হঠাৎ ইরার গায়ে থ্রি-পিস দেখে সৌম্য অবাক হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইরার গলায় ঝুলানো ওড়নাটা পিছন থেকে নিয়ে মাথায় টেনে দেয়। ইরা মলিন মুখে সৌম্য’র দিকে চেয়ে আছে।
সৌম্য ইরার মাথায় ওড়না টেনে হাত সরিয়ে নেয়। এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– লাস্ট একটা চাওয়া, এইভাবে চলাফেরা করার চেষ্টা করিস, যদি পারিস। ভালো লাগে দেখতে।
কথাটা বলে সৌম্য উঠে দাঁড়ালো। ঝাপসা চোখজোড়া নিয়ে বারবার এদিক-ওদিক করে আর পলক ঝাপটায়। এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে ইরার বাবাকে কল করে এই জায়গাটি আসতে বলে দেয়। এরপর ইরাকে ধরে দাঁড় করায়। কিন্তু সৌম্য ইরার দিকে আর তাকালো না। আর ইরা সৌম্য’র দিক থেকে দৃষ্টি সরালো না।
প্রায় বিশ মিনিট পর ইশতিয়াক আহমেদ সৌম্য’র বলা জায়গাটিতে আসে। সৌম্য ইরার বাবাকে দেখে বলে,
– আপনার মেয়েকে নিয়ে যান।
ইশতিয়াক আহমেদ ইরাকে এখানে দেখে অবাক হয়। সাথে রে’গে-ও যায়। ইরার উদ্দেশ্যে শক্ত বাণী ছুঁড়ে দেয়,
– এসো। তোমার পা কাটবো আজ।
ইরা তার বাবার কথা শুনলো। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– আমার ঘরের চাবিটা?
ইরা মাথা নিচু করে রাস্তা থেকে তার ছোট্ট ব্যাগ কুড়িয়ে নেয়। ব্যাগের ভেতর থেকে চাবি বের করে সৌম্য’র দিকে বাড়িয়ে দিলে সৌম্য মাথা নিচু করেই চাবিটা নিল ইরার হাত থেকে। ইশতিয়াক আহমেদ ইরার হাত শক্ত করে ধরে উল্টো দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ইরার তার বাবার সাথে পা মেলায়। তবে মাথা পিছন দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে, দৃষ্টি সৌম্য’র পানে।
ইশতিয়াক আহমেদ দাঁড় করিয়ে রাখা গাড়ির পাশে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। ইরা ডানদিকে ঘাড় বাঁকিয়ে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে। ইশতিয়াক আহমেদ মেয়ের কান্ডে প্রচন্ড রাগান্বিত। ধমকে বলে,
– গাড়িতে ওঠো।
ইরা এবারেও তার বাবাকে কিছু বললো না। সৌম্য’র দিকে দৃষ্টি রেখে আওয়াজ করে বলে,
– ২৫ বছরের মেয়ে হয়ে ১৫ বছরের মেয়ের মতো পা’গ’লা’মি করে তোকে অনেক বিরক্ত করেছি। পারলে ক্ষমা করিস সৌম্য। ভালো থাকিস।
কথাটা বলে সৌম্য’র চোখে দৃষ্টি রেখে মলিন হাসলো ইরা। এতোক্ষণের বহু’ক’ষ্টে জমানো অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। ইরা আর সময় নষ্ট না করে গাড়িতে উঠে বসে। ইশতিয়াক আহমেদ গাড়ির দরজা লাগিয় ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
সৌম্য ঝাপসা চোখে চেয়ে রইল ইরাদের গাড়ির দিকে। গাড়িটি ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। এতোক্ষণ তার ইরাবতীর কান্না যতটা না তাকে পোড়াচ্ছিল, ইরার শেষ কথাটা সাথে ওই হাসিটুকু যেন সৌম্য’র হৃদয় পুড়িয়ে ছাই করে দিতে উদ্যত হলো।
সৌম্য প্রায় ৪০ মিনিটের মতো স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শরীরে যেন কোনো শক্তি পাচ্ছে না। কয়েক পা পিছিয়ে আসলে একটি গাছ হাতের কাছে পেয়ে বা হাতে গাছটি আঁকড়ে ধরে। মাথা নিচু করে কয়েকবার ঢোক গিলল। চোখ বুজে কম্পিত কণ্ঠে বিড়বিড় করে,
– ইরাবতী এবার তবে সত্যিই ভুলে যাবে আমায়!
একটু পর আবার-ও একই স্বরে বিড়বিড় করে,
– সৌম্য কখনো তার ইরাবতীকে ছাড়া অন্যকোনো নারীর কথা কল্পনা-ও করেনা, ভবিষ্যৎে-ও করবে না। কিন্তু তুই আজ আমার মন কেন পড়লি না ইরাবতী?
সৌম্য আরও দশ মিনিট এর মতো গাছে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এরপর উল্টো ঘুরে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে থাকে। প্রায় বিশ মিনিট হাঁটলে মেইন রোডে গিয়ে ওঠে। রোডের ধার দিয়ে হাঁটতে থাকে। কিছুকক্ষণ পর সৌম্য রাস্তার ধারে বসল। দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরল। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে পারলে হয়তো বুকের জ্বলুনি টা একটু কমতো! কিন্তু কাঁদতে পারে না তো!
রিহান এদিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। টিউশনে গিয়েছিল হয়তো। রাস্তার পাশে সৌম্যকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– সৌম্য? কি হয়েছে তোর? এখানে এভাবে বসে আছিস যে?
রিহানের কণ্ঠে সৌম্য মাথা তুলে তাকায়। সৌম্য’র চোখজোড়া অসম্ভব লাল। রিহান অবাক হয়, নিচু হয়ে বলে,
– এই কি হয়েছে তোর?
সৌম্য বোবা চোখে চেয়ে রইল রিহানের দিকে। রিহান বোধয় বুঝল। মনে পড়লো সৌম্য ইরার থেকে চাবি নিতে বেরিয়েছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উল্টো ঘুরে একটি রিক্সা দাঁড় করায়। এরপর সৌম্যকে টেনে রিক্সায় উঠিয়ে সে-ও সৌম্য’র পাশে উঠে বসে। রিক্সা চলতে শুরু করে। সৌম্য নির্জীব চোখজোড়া আকাশপানে নিবদ্ধ করে রেখেছে। রিহান বলে,
– এতোবার ফিরিয়ে না দিয়ে মেনে নিতি নাহয়, আর কত ক’ষ্ট দিবি নিজেকে?
সৌম্য একটু হেসে প্রাণহীন স্বরে বলে,
– আল্লাহ আমাকে না পাওয়ার স্বাদ গ্রহণ করার ভাগ্য নিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছে, পেয়ে গেলে তো ভাগ্যের সাথে মিলবে না।
রিহান কিছু বলল না।
সৌম্য’র মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়লো। মায়ের কোলে মাথা রাখা তার খুব বদঅভ্যেস ছিল। মা তাকে এই বদঅভ্যেস করে দিয়ে এক রাতের আঁধারে চিরিদিনের জন্য হারিয়ে গেল। আজ-ও তার মাথা ব্য’থা করছে। তার জন্য কোথাও সুখ লেখা নেই। মা থাকলে, মাথায় একবার হাত বুলালে একটুখানি আরাম পেত বোধয়! বোনু থাকলে-ও চুল টেনে দিত! কিন্তু তার তো কেউ নেই। সৌম্য আকাশপানে চেয়ে ঝাপসা চোখে বিড়বিড় করল,
– মা একবার আসবে!
ইরা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। গাড়ির জানালা খোলা। মৃদু হাওয়ায় ওড়নার ফাঁকে চুলগুলো উড়ছে। ইরার কানে দু’টো বাক্য বারবার প্রতিধ্বনি হচ্ছে,
– এবার তুই বিয়ে করে নে ইরাবতী,, আমি-ও বিয়ে করে নিব।
সৌম্য এতোদিন শুধু তাকে বিয়ে করে নিতে বলত, আর আজ সে নিজেও অন্য মেয়েকে বিয়ে করে নিতে চাইলো। তার সৌম্য অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। এটা ভাবতেই ইরার নিঃশ্বাস নিতে ক’ষ্ট হয়। ভালোবাসা বুঝি এমন-ই হয়?
বাবার ডাকে ইরা চোখ মেলে তাকায়। গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে ইশতিয়াক আহমেদ। ইরা ডান হাতে চোখের কোণে লেগে থাকা পানির কণা মুছে নিল। এরপর গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতর যায়। দরজা খোলা ছিল, ইরার মা ইরাকে এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখে এগিয়ে এসে বলে,
– কোথায় গিয়েছিলি মা?
ইরা মায়ের দিকে একবার তাকায়। এরপর উল্টো ঘুরে তার বাবার দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– মা’র’তে চাইলে মে’রে নাও বাবা। পরে যদি সুযোগ না পাও!
ইশতিয়াক আহমেদ ইরাকে ধমকানোর জন্য মুখ খোলার আগেই মেয়ের এমন বাক্য তাকে স্তম্ভিত করে দেয়। ইরা তার বাবাকে চুপ দেখে মৃদু হেসে বলে,
– মুড আসছে না? প্রবলেম নেই। মুড আসলে ডাক দিও। চলে আসবো।
কথাটা বলে ইরা তার ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। কোনোদিকে তাকালো না সে, সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। হাতের ছোট্ট ব্যাগ, ফোন সব ছুঁড়ে ফেলে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। ঝপঝপ করে অতিবৃষ্টির ন্যায় পানি ইরাকে ভিজিয়ে দিতে থাকে। ইরা বোধয় বহু’ক’ষ্টে এতোক্ষণ কান্না আটকে রেখেছিল। হঠাৎ-ই দু’হাতে মাথার চুলগুলো সর্বশক্তি দিয়ে টেনে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এক পর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে। হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো কণ্ঠে বলে,
– আমি ম’রে যেতে চাই, প্লিজ! আমি আমার সৌম্য’র পাশে অন্যকাউকে কি করে দেখব? আমি পারবো না। পারবো না।
আরও কতকিছু যে বিড়বিড় করে বলে আর কাঁদে তার ইয়ত্তা নেই।
পরদিন,
ঘড়ির কাটায় তখন বিকাল ৫ টা।
সকাল এসে দাঁড়িয়েছে আকাশদের বাড়ির সামনে। সে গ্রাম থেকে শহরে এসেছে গত পরশুদিন। আকাশের অফিসে জয়েন করেছে গতকাল। আজ বায়ান এর থেকে আকাশের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে এখানে এসে পড়েছে। বায়ান তার বয়ফ্রেন্ড। ছেলেটা খুব সাদাসিধে। যা বোঝায়, সেটাই বোঝে।
সকাল মেইন গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান তাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। সকাল অনেক অনুরোধ করে, অনেক বলে কয়ে ভেতরে ঢুকতে পেরেছে। একেবারে মিথ্যা-ও তো বলেনি। সন্ধ্যা তার বোন, সে হিসেবে ও এই বাড়ির আত্মীয় অবশ্যই।
কলিংবেল এর আওয়াজ পেয়ে আসমানী নওয়ান এসে দরজা খুলে দেয়। সামনে এক অপরিচিত মেয়েকে দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সকাল সালাম দেয় আসমানী নওয়ানকে। ভদ্রমহিলা সালাম এর উত্তর দেন। সকালের মুখে মাস্ক পরা। সে মৃদুস্বরে বলে,
– আন্টি আমার ওয়াশরুমে যেতে হবে। একটু হেল্প করবেন প্লিজ!
আসমানী নওয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তোমার নাম কি?
সকাল বলে,
– হাসিনা। প্লিজ আন্টি, আমার খুব আর্জেন্ট।
আসমানী নওয়ান আর কিছু বললেন না। মেয়েটির হয়তো বিপদে পড়েই এসেছে। তাই তিনি সকালকে ভেতরে আসতে দিলেন। সকাল ভেতরে গিয়ে মনে মনে বিশ্বজয় করা হাসি হাসে।
তখন-ই সন্ধ্যা তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সকাল সন্ধ্যাকে দেখেই দাঁড়িয়ে যায়। সন্ধ্যা নিজে-ও সকালের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। যদিও মুখে মাস্ক পরা। কিন্তু তার কাছে চেনা চেনা লাগলো।
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলে,
– সন্ধ্যা ওই মেয়েটারে বা’থ’রু’ম দেইখা দে তো মা।
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। আসমানী নওয়ান সকালের উদ্দেশ্যে বলে,
– ওর সাথে যাও।
তিনি মূলত হালকা খাবার যেমন চা, বিস্কুট খেতে দিবেন সকালকে। একজন এসেছে। যতই না চিনুক, খালি মুখে গেলে তার খারাপ লাগবে।
সকাল সন্ধ্যার পাশে হেঁটে সন্ধ্যার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। সন্ধ্যা বার বার ঘাড় বাঁকিয়ে সকালের দিকে তাকাচ্ছে। সকাল মনে মনে হাসছে। ঘরে গিয়ে সন্ধ্যা ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে সকালকে দেখিয়ে দিতে চায়, তার আগেই সকাল শক্ত হাতে সন্ধ্যার হাত টেনে ধরে। সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে তাকায়।
সকাল তার মুখ থেকে মাস্ক নামিয়ে নিয়েছে। সকালকে দেখে সন্ধ্যার মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে যায়। সকাল হেসে বলে,
– কি রে কেমন আছিস?
সন্ধ্যার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। নিজের বলতে কাউকেই তো পাশে পায়নি। সেই যে বিয়ের পর এখানে চলে আসলো, তার ভাইটা-ও আর আসেনা, বাবাকেও দেখেনা, সৎ মা, তার দু’টো সৎ ভাইবোন কাউকেই দেখেনা। যতই এরা তার সাথে খারাপ করুক,, সে তো ছোট থেকে এদের সাথেই বড় হয়েছে। মায়া কাজ করে। সন্ধ্যা সকালকে জড়িয়ে ধরে।
সাথে সাথেই সকাল সন্ধ্যাকে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দেয়। সন্ধ্যা দু’পা পিছিয়ে যায়। সকাল রে’গে বলে,
– তোর এসব চিপকাচিপকি যায় না কেন? অ’স’হ্য’ক’র একটা।
সকালের ব্যবহারে সন্ধ্যা অবাক হয়না। সকাল এরমক-ই করে তার সাথে। এতোদিন পর নিজের একটা মানুষকে দেখে সন্ধ্যা খুব আবেগি হয়ে পড়েছে। না চাইতেও চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যা আবারও সকালের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে ইশারায় বোঝায়,
– তার সৌম্য ভাইয়া কোথায়?
সকাল বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– তোর এসব হাত পা নাচানাচি করে আমার সাথে কথা বলবি না। বি’র’ক্তি’ক’র! মুখ দিয়ে কথা বলতে পারলে বলবি। নয়তো জোকারের মতো হাত পা নাচাবি না।
সন্ধ্যা অসহায় চোখে তাকালো। আবার-ও চোখজোড়া ভরে উঠল। সে তো কথা বলতে পারে না। কি করবে? সময় ন’ষ্ট করল না সন্ধ্যা। দ্রুত টেবিলের উপর গিয়ে একটি কাগজে কিছু লিখে সকালের সামনে নিয়ে এসে মেলে ধরে। সকাল চোখ বুলায়, যেখানে লেখা,
– সকাল আপু আমার সৌম্য ভাইয়া কোথায় একটু বলবে? সৌম্য ভাইয়াকে আমার এখানে একবার আসতে বলবে? প্লিজ!
সকাল এবারে-ও বিরক্তি কণ্ঠে উত্তর দেয়,
– তোর ভাই আমাদের বাড়ি আর যায় না। ম’র’ছেই না-কি আল্লাহ জানে!
সকালের কথায় সন্ধ্যা বিস্ময় চোখে তাকায়। হাত থেকে কাগজটি পরে যায়। বুকটা কেঁপে উঠলো। চোখ থেকে টুপটুপ করে নোনাপানি গড়িয়ে পরতে লাগলো। তার ভাইয়ের কিছু হলে সে কি করে বাঁচবে? সকাল আপু তাকে নিয়েই নাহয় বলুক, তার ভাইকে নিয়ে এভাবে না বললে খুব কি ক্ষ’তি হয়?
কথাগুলো ভেবে ডান হাতে চোখ মুছল। এরপর দু’হাত জমা করে সকালের সামনে অনুরোধ করে বোঝায়, – প্লিজ বলো, আমার সৌম্য ভাইয়া কোথায়?
এটুকু বোঝাতে গিয়ে আবার-ও চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে।
হঠাৎ আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে ডাকতে ডাকতে এদিকে আসছে দেখে সন্ধ্যা দ্রুত দু’হাত নামিয়ে নেয়। দু’হাতে মুখ মুছে মাথা নিচু করে নেয়।
আসমানী নওয়ান দরজায় দাঁড়িয়ে সকালের উদ্দেশ্য বলে,
– হইছে তোমার?
সকাল সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে বলে,
– জ্বি আন্টি। এই মেয়েটির সাথে কথা বলছিলাম। ভীষণ মিষ্টি মেয়ে!
আসমানী নওয়ান মৃদু হাসলো। তার জান্নাত মিষ্টি হবে না তো কে হবে? সকাল মেয়েটিকে তার ভালোই লাগলো, মিশুক মনে হলো। এটুকু সময়ে-ই কি সুন্দর করে কথা বলছে! তিনি উল্টো ঘুরে যেতে যেতে বলে,
– আইচ্ছা কথা কইয়া আইসো তাইলে। সন্ধ্যা মেয়েটারে সাথে নিয়া আয় মা।
আসমানী নওয়ান যেতেই সকালের চোখেমুখে বিরক্তি ভর করে। সন্ধ্যা কিছু বোঝার আগেই সকাল সন্ধ্যার হাত টেনে একটি আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায় সন্ধ্যাকে। সন্ধ্যার পাশে সে দাঁড়ায়। এরপর আয়নায় তাকিয়ে বলে,
– শুনলাম তোর সাথে না-কি ওই আকাশ নওয়ানকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে তোর শ্বাশুড়ি-মা। আকাশ নওয়ান রাজি তো হয়নি, উল্টে তোর জন্য ডিভোর্স পেপার বানাতে দিয়েছে। অবশ্য দিবে না কেন? আয়নায় নিজেকে দেখ, গায়ের রঙটা কেমন চাপা দেখেছিস? তোর চেয়ে আকাশ নওয়ান কত সেড ফর্সা কল্পনা করতে পারবি তুই? আবার কথা-ও বলতে পারিস না। বোবা একটা। তো আকাশ তোকে ডিভোর্স দিবে না তো কাকে দিবে?
আকাশ ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিল, তোকে পেপারটা এনে দিয়ে সাইন করাতো, কিন্তু তার এক বান্ধবী সেটা ছিঁড়ে ফেলেছে। বুঝলি তো? আবার-ও ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দিয়েছে। তা ডিভোর্স হয়ে গেলে কোথায় যাবি ভেবেছিস কিছু? তোর ভাই তো লাপাত্তা!
কথাগুলো টানা বলে সকাল থামলো। সন্ধ্যা আয়নায় সৃষ্ট সকালের প্রতিবিম্বের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখ দু’টো ভরে উঠেছে, যেন টোকা দিলেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।
সকাল কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে,
– তোকে একটা খবর দিই। আমি আকাশ নওয়ান এর পিএ। এটার মানে কি জানিস? আকাশ নওয়ানের সাথে ২৪ ঘণ্টা থাকবো। এরপর কি হতে পারে বুঝতে পারলি তো! আমি কিন্তু আকাশের চেয়ে আরও ফর্সা, আবার কথা-ও বলতে পারি। বোবা নই তোর মতো। তোর ডিভোর্স টা হলে-ই চুটকি মে’রে আকাশ নওয়ান এর বউ হয়ে যাবো আমি। তুই কই যাবি, সেই চিন্তা কর তাহলে, কেমন?
কথাগুলো বলে সকাল ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আসমানী নওয়ান সকালকে বেরিয়ে যেতে দেখে বলে,
– কই যাইতাছ? নাস্তা কইরা যাও।
সকাল যেতে যেতে বলে,
– আন্টি গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ পরে গিয়েছে, আজ আসছি।
কথাটা বলে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
সন্ধ্যা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পা তোলার শক্তি পাচ্ছে না মনে হলো। দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর করে নোনা পানি গড়িয়ে পড়ে। সকালের বলা প্রতিটি কথা কানে বাজছে এখনো। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। ধীর পায়ে বেলকনির দিকে এগিয়ে যায়। শরীরটা কেমন কাঁপছে মনে হলো। একটু একটু করে পা ফেলে বেলকনির গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়ায়। তার ঘরের বেলকনি থেকে একদম সামনে থেকে সামান্য ডানদিকে মেইন গেট। গেটের ওপাশে স্পষ্ট দেখল আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। আকাশের পরনে সাদা পাঞ্জাবি, সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। গত বেশকয়েকদিন যাবৎ আকাশকে এই পোষাক পরতে দেখছে সন্ধ্যা।
হঠাৎ-ই আকাশের সামনে সকাল দাঁড়ায়। সন্ধ্যা মলিন মুখে চেয়ে রইল। মাথাটা গ্রিলের সাথে ঠেকিয়ে আকাশ আর সকালের দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশ আর সকালকে পাশাপাশি খুব সুন্দর মানিয়েছে। কথাটা মিথ্যা নয়। সত্যি-ই তাদের মানিয়েছে। দু’জনের গায়ের রঙ টা কত উজ্জ্বল। সন্ধ্যা একবার তার হাতের দিকে তাকালো। সে শ্যামা মেয়ে। আকাশ কেন তাকে পছন্দ করবে? ছেলেরা সবসময় তাদের চেয়ে-ও সুন্দর আর ফর্সা মেয়ে চায়, কিন্তু সন্ধ্যা তার উল্টো। কথা-ও বলতে পারে না সে। সে তো বোবা। কোনো সুস্থ মানুষ তাকে জীবনে ঠাই দিবে না, এটা সন্ধ্যা জানে। আসমানী নওয়ানকে কত নিষেধ করত প্রথম প্রথম,, কিন্তু সে বলতো তার ছেলে মানবে।
সন্ধ্যা নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বোকা উপাধি দিল। তার মতো বোবা, অসুন্দর মেয়েকে কেউ মেনে নিবে, এই কথাটা সন্ধ্যা কিভাবে ভাবলো!
এটা ভেবেই সন্ধ্যা নিজের উপর বিদ্রুপ হাসলো।
আকাশ তাকে ডিভোর্স দিতে চায়, এটা শুধু কানে শুনতো। এখানে থাকতে থাকতে কখনো কখনো ভুল করে সে ভেবে ফেলেছে আকাশ-ই তার ভবিতব্য। কত বোকা সে!
আকাশ তার মতো মেয়েকে চায়না বলে ডিভোর্স পেপারে সাইন পর্যন্ত করেছে,, আরেকজন ছিঁড়ে ফেলেছে বলে আবার-ও ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দিয়েছে। কত বিতৃষ্ণা তার প্রতি! সন্ধ্যার চোখের বাঁধ থামে না। আকাশ তাকে ডিভোর্স দিবে এ তো নতুন নয়, তবুও ক’ষ্ট কেন হয় এই কথাটা ভাবলে? এটা বোধয় কবুল বলে বিয়ের টান!
সন্ধ্যা রাস্তায় তাকালে দেখল আকাশ আর সকাল এখনো দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যার চোখ থেকে পানির বন্যা বয়। চোখেমুখে কত মায়া, অসহায়ত্ব, ব্য’থা ফুটে উঠেছে, তা কেউ দেখতে পায় না।
সন্ধ্যা গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে রেখে ওভাবেই চোখ বুজল। বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে অনবরত নোনাপানি গড়িয়ে পড়ে। তার ভাই কি আর আসবে না? কোথায় সৌম্য ভাইয়া? সন্ধ্যার খুব মন পুড়লো ভাইয়ের জন্য। তার ভাইটা ঠিক আছে তো!
কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে উঠলো।
আকাশ এতোক্ষণ কলে কথা বলছিল। ইম্পর্ট্যান্ট কল ছিল। সকালকে দেখে দাঁড়াতে বলেছিল। এখন কল কেটে সকালের দিকে তাকায়। মেয়েটি তার পিএর আবার পিএ। তার বাড়ির কাছে কি করছে সেটাই ভাবছে। অতঃপর বলে,
– তুমি এখানে কি করছ?
সকাল মৃদুস্বরে বলে,
– স্যার আমার এইদিকে কাজ ছিল। তাই এসেছিলাম।
আকাশের ফোন আবার-ও বেজে উঠলে সকালকে হাতের ইশারায় যেতে বলে আবার-ও এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলায় ব্যস্ত হয়। রাজনীতির ব্যাপার। সারাদিন বাইরে কাটিয়ে এসে-ও শান্তি নেই। তবে এটাই তার স্বপ্ন। ভীষণ ভালোলাগা কাজ করে এই সাইট টায়।
রিহান মেস থেকে বেরিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছে টিউশনে যাবে বলে। সৌম্য’কে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে দেখে রিহান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সৌম্য রিহানের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বলতে চায়, কিন্তু আওয়াজ বের হচ্ছে না, গলা ধরে আসছে। রিহান সৌম্য’র কাঁধে হাত রেখে বলে,
– ঠিক আছিস?
সৌম্য’র চোখজোড়া ঝাপসা হয়। হঠাৎ-ই রিহানকে সাপ্টে ধরে ভাঙা গলায় বলে,
– বোনুর খোঁজ পেয়েছি রিহান।
কথাটা শুনে রিহান যেমন অবাক হলো, তেমনি খুশি। সৌম্য’র পিঠে দু’বার চাপড় মে’রে বলে,
– আলহামদুলিল্লাহ।
সৌম্য রিহানকে ছেড়ে দু’হাতে চোখ ডলে স্বাভাবিক করে নেয়। রিহান বলে,
– আমি যাবো তোর সাথে?
সৌম্য গলা ঝেড়ে বলে,
– প্রয়োজন হলে ফোন করব। আপাতত তুই টিউশনে যা। আমি এদিকে যাচ্ছি। এখান থেকে বেশি দূর নয়।
কথাটা বলে সৌম্য একটি রিক্সা নেয় তার গন্তব্যে পৌঁছাতে।
আকাশ কলে কথা বলা শেষ করে গাড়ি গ্যারেজে রেখে বাড়িতে কলিংবেল চাপলে শিমু এসে দরজা খুলে দেয়। আকাশ ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলে,
– ঘরে এক গ্লাস শরবত সহ এক প্লেট ভাত দিয়ে যা এক্ষুনি।
শিমু দরজা আটকালো। আকাশ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নিলে আসমানী নওয়ান কঠোর স্বরে বলে,
– আকাশ দাঁড়াও।
মায়ের কণ্ঠে আকাশের পা থেমে যায়। কণ্ঠস্বরে বুঝতে পারলো তার মা রে’গে আছে। আকাশ চিন্তিত হয়। রা’গ হওয়ার মতো সে কি কিছু করেছে?
সে গতকাল বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে অফিসে গিয়েছিল। এরপর অফিস থেকে আনিকার বাড়িতে গিয়ে ছিল। সকালে সেখান থেকে আবার কাজে ছুটেছে। আজ বাড়ি ফিরল। এজন্য রে’গে আছে না-কি! ভাবনা রেখে আকাশ তার মায়ের সামনে গিয়ে বলে,
– কি হয়েছে মা?
আসমানী নওয়ান গলা উঁচু করে সন্ধ্যাকে ডাকে। দু’বার ডাকতেই সন্ধ্যা তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সামনে তাকালে আকাশের সাথে চোখাচোখি হয়।সন্ধ্যা সাথে সাথে মাথা নিচু করে নেয়। আকাশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সন্ধ্যার চোখদুটো তার কাছে অস্বাভাবিক লাল লাগলো। যদি-ও তার নিজের চোখ দু’টো-ও লাল। গতকাল সারারাত ঘুম হয়নি তার।
মায়ের কথায় আকাশের ধ্যান ভাঙে।
– তুমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করছিলা?
আকাশের ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়। আসমানী নওয়ান উত্তরের অপেক্ষায় আকাশের পানে চেয়ে আছে। গতকাল আকাশ বাড়ি না ফেরায় আকাশের বাবা আনিকাকে কল করেছিল। আনিকা বলেছিল, আকাশ তার বাড়ি। এরপর আনিকা আসমানী নওয়ান এর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন। আর তখন আনিকা আসমানী নওয়ানকে আকাশের সেই ডিভোর্স পেপারের ব্যাপারে সবকিছু বলেন। আকাশকে চুপ দেখে আসমানী নওয়ান শক্ত কণ্ঠে বলে,
– কি হইলো? কথা কইতাছ না কেন? তুমি সন্ধ্যার জন্য ডিভোর্স পেপার বানায়ে তাতে সাইন করছিলা?
আকাশ বিরক্ত হয়। সাথে মায়ের অহেতুক এমন ব্যবহার, এসব প্রশ্নে রে’গে যায়। গতকাল এই মেয়েটার জন্য সে বাড়িতেই আসলো না। আনিকার বাড়ি গিয়ে ভাবলো ওখানে শান্তি পাবে, অথচ সে সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। মাথা ব্য’থা করছে, চোখের বারোটা বেজে আছে। দু’দিনেই এই মেয়ে তাকে পা’গ’ল বানিয়ে দিয়েছে। সে কোথাও গিয়ে শান্তি পাচ্ছে। রা’গ টা সবার আগে সন্ধ্যার উপর হচ্ছে। রা’গে জিদ্দে চিৎকার করে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ ডিভোর্স দিতে চাই। এতো জেরা করছ কেন আমাকে? আমি তো প্রথমদিন-ই বলে দিয়েছি, আমি ওই বে’য়া’দ’ব মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে দিব।
আকাশের চিৎকারে সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। মাথা নিচু তার। লালিত চোখজোড়া থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
আসমানী নওয়ান রে’গে আকাশের ডান গালে ক’ষিয়ে একটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ হলো যেন। আকাশ আগের চেয়েও জোরে চিৎকার করে বলে,
– তুমি ওই মেয়েটার জন্য বারবার আমার গায়ে কেন হাত তোলো হ্যাঁ?
কথাটা বলে উল্টো ঘুরে হাতের কাছে একটা ফুলদানি পেয়ে ছুঁড়ে মা’রে। ফুলদানিটি সন্ধ্যার পাশ ঘেঁষে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সন্ধ্যা মাথা তুলল না, নড়লো না। মাথা নিচু নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। আজ কেন যেন তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।
শিমু দৌড়ে সন্ধ্যার পাশে এসে দাঁড়ায়। শিমুর মা তার বোনকে আগলে নেয়। আসমানী নওয়ান ঝাপসা চোখে ছেলের পানে চেয়ে আছে।
আকাশ চোখ বুজে রেখে জোরেজোরে শ্বাস ফেলছে। আসমানী নওয়ান নিরবে তার ঘরে গেলেন, কয়েক সেকেন্ডের মাঝে-ই আবার বাইরে বেরিয়ে এলেন তার ফোন হাতে। এরপর কাউকে কল করে ফোন লাউডে দেয়। কয়েক সেকেন্ডেই কল রিসিভ হয়। আসমানী নওয়ান সালাম দিয়ে বলেন,
– ভাইজান ডিভোর্স পেপার কবে দিতে পারবেন যেন বলছিলেন?
ওপাশ থেকে উত্তর আসে,
– ১৫ দিন পর।
আসমানী নওয়ান বলেন,
– আচ্ছা ভাইজান। পারলে আরেকটু দ্রুত দেয়ার চেষ্টা করবেন।
আসমানী নওয়ান আর ফোনের ওপাশের ব্যক্তির কথোপকথনে প্রত্যেকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় ভদ্রমহিলার দিকে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয় আকাশ। সে বাকহারা হয়ে তার মায়ের দিকে চেয়ে আছে। সন্ধ্যা এবার-ও মাথা তোলেনি। মেয়েটি আজ যে পরিমাণ কেঁদেছে, এতো কান্না যে কবে কেঁদেছে তার মনে পড়েনা। চোখদু’টো ব্য’থা করছে। তবুও চোখের বাঁধ থামলো না মেয়েটির।
আসমানী নওয়ান কল কেটে দেয়। গতকাল আনিকার কাছে সব শোনার পর সাথে সাথে তিনি নিজেই আকাশের বাবার পরিচিত লোকের সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করতে বলেন।
ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের উদ্দেশ্যে বলেন,
– আমার জান্নাত ফেলনা নয়। তোমার ডিভোর্সের ব্যবস্থা আমি নিজেই কইরা দিলাম।
কথাটা বলে আসমানী নওয়ান তার ঝাপসা চোখজোড়া ডান হাতে মুছে নেয়। আকাশ ঢোক গিলল। সামনে দাঁড়ানো সন্ধ্যার দিকে একবার তাকালো। যার মাথা নিচু, সন্ধ্যাকে দেখতে পায় না আকাশ। বেশ কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যার দিকে দৃষ্টি রেখেই মৃদুস্বরে বলে,
– আমাকে বোঝার জন্য থ্যাংকস্ মা। অনেক বড় উপকার করলে। এবার আমি এই য’ন্ত্র’ণা থেকে মুক্তি পাবো।
সন্ধ্যা কান্নার তোড়ে কেঁপে ওঠে। ডান হাতে পরনের শাড়ি খামচে ধরে।
হঠাৎ-ই বাড়ির কলিংবেল বেজে উঠলে আসমানী নওয়ান নিজেকে সামলে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সৌম্য আসমানী নওয়ানকে দেখে মৃদুস্বরে সালাম দেয়। আসমানী নওয়ানের চোখেমুখে কিছুটা বিস্ময়, সেভাবেই সালাম এর উত্তর নিলেন।
সৌম্য সাথে সাথে বলে,
– খালাম্মা এই বাড়িতে কি সন্ধ্যা নামের কেউ আছে?
সৌম্য’র কথায় আসমানী নওয়ানের চোখে আগের চেয়ে হাজারগুণ বিস্ময় ভর করে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– তুমি সন্ধ্যার কে বাবা?
সৌম্য আসমানী নওয়ানের চোখের দিকে তাকালে অবাক হয়। ভদ্রমহিলার দু’চোখ ভর্তি পানি। যা একটু আগে-ও ছিল না। মনে হচ্ছে তাকে দেখে কাঁদছে। সৌম্য এসব রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– জ্বি! আমি সন্ধ্যার বড় ভাই।
অন্তঃদহন পর্ব ১৩
কথাটা শুনতেই আসমানী নওয়ানের মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে ওঠে। সৌম্য’র লাস্ট কথাটা বেশ জোরে ছিল। প্রত্যেকেই সৌম্য’র কথাটি শুনতে পেয়ে দরজার দিকে তাকায়। সকলের চোখেমুখে বিস্ময়।
সন্ধ্যা তার ভাইয়ের গলা একটু একটু পেয়ে ধীরে ধীরে অনেকটা এগিয়ে এসেছিল,, লাস্ট কথাটা জোরে বলায়, সাথে সন্ধ্যা সামনে তাকিয়ে সৌম্য’কে দেখে বিস্ময় চোখে তাকায়। কোনোদিকে না তাকিয়ে এক দৌড় দেয়, আকাশের সাথে ধাক্কা খেয়ে মেয়েটি পড়তে গিয়ে-ও নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে দৌড় দিয়ে তার সৌম্য ভাইয়ার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সৌম্য’র শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। সন্ধ্যা দু’হাতে সৌম্য’কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে।
