অন্তঃদহন পর্ব ১৫

অন্তঃদহন পর্ব ১৫
DRM Shohag

আসমানী নওয়ান কি রিয়েকশন দিবেন বুঝতে পারছেন না। শিমুর মা সন্ধ্যাকে দেখেই বলেছিল, তাদের বাসায় শিমুকে পড়াতে আসে একজন। ওর সাথে সন্ধ্যার চেহারার খুব মিল। কিন্তু তিনি পাত্তা দেয়নি। একরকম মানুষ হয় না? কিন্তু সামনাসামনি দেখে তার নিজের-ই ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। দেখে তো মন হয়, সন্ধ্যা আর ছেলেটা একই মায়ের পেটের,, কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?
সন্ধ্যাকে দৌড়ে আসতে দেখেছে সৌম্য। দেখেছে তার বোন বিধ্বস্ত মুখখানা নিয়ে তার বুকে শান্তি খুঁজতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সৌম্য’র চোখজোড়া ঝাপসা হয়, শরীর কাঁপছে তার। তার বোনুকে পেয়েছে সে! কাঁপা দু’হাত তুলে সন্ধ্যার পিঠে রাখলো। ভাঙা গলায় ডাকে,

– বোনু?
সন্ধ্যা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। সৌম্য ঢোক গিলে। সন্ধ্যা নিজেকে সামলে মাথা উঁচু করে সৌম্য’র দিকে তাকায়। সৌম্য সন্ধ্যার দু’গালে হাত রেখে বলে,
– কেমন আছিস বোনু?
সন্ধ্যা ঠোঁট উল্টে দু’দিকে মাথা নেড়ে বোঝায়, – সে ভালো নেই।
এরপর হাত দিয়ে বোঝায়, – তোমায় খুব মনে পড়তো ভাইয়া।
সৌম্য তার ঝাপসা চোখজোড়া কয়েকবার পলক ঝাপটে স্বাভাবিক করে নেয়। এরপর দু’হাতে সন্ধ্যার মুখ মুছে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– এইতো চলে এসেছি আমি। এবার তোকে আমার সাথে নিয়ে যাব। প্রমিস।
সন্ধ্যা মলিন মুখে তার ভাইয়ের দিকে চেয়ে থাকে। আবার-ও হাত দিয়ে বোঝায়,
– তুমি আমার কাছে আসোনি কেন ভাইয়া?
সৌম্য ধরা গলায় বলে,
– কেউ আমাকে তোর খোঁজ দেয়নি বোনু। আমি অনেক খুঁজেছি তোকে। বাবা বলেছিল, তোকে না-কি বেঁচে দিয়েছে। আর সায়ন বলেছিল, বিয়ে হয়ে গেছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিমা না। তুই ঠিক আছিস বোনু? এখানে তোকে সবাই মা’রে তাই না?
সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে আবার-ও তার বোনের গাল মুছে দিয়ে বলে,

– কাঁদিস না বোনু। আর কেউ তোকে কিচ্ছু বলতে পারবে না।
সন্ধ্যা ডান হাত তুলে তার ভাইয়ের গাল ছুঁয়ে দেয়। ভেজা চোখে মৃদু হাসে। সৌম্য নিজে-ও বোনের হাসিতে একটুখানি হাসে।
এদিকে সন্ধ্যা আর সৌম্য’র কথোপকথনে পুরো বাড়ির লোক বিস্ময় চোখে চেয়ে আছে। আকাশ একবার সৌম্য’র দিকে তাকায়, আরেকবার পিঠ ফিরিয়ে থাকা সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সৌম্য সন্ধ্যার ভাই? সন্ধ্যা তার ভাইকে কতটা ভালোবাসে, এই আন্দাজ আকাশ একটু হলে-ও করতে পারে। বেশ কয়েকবার সে দেখেছে। সৌম্য’র বলা, ‘তোকে সবাই মা’রে’ বাক্যটি শুনে আকাশ ঢোক গিলল। তার মনে পড়ল, সন্ধ্যাকে সে প্রথমদিন থা’প্প’ড় মে’রে’ছিল। সে তো জানতো না, মেয়েটি কথা বলতে পারে না। সে ভেবেছিল, মেয়েটি ভালো নয়, এজন্যই তার কথার উত্তর-ও দিচ্ছে না, হঠাৎ হঠাৎ রা’গে কি করে নিজেই বুঝতে পারেনা সে। সন্ধ্যাকে সে নিজ জীবনে চায় না এটা সত্য, তবে সন্ধ্যাকে ভালো মেয়ে হিসেবে চেনার পর সেই প্রথম থা’প্প’ড় মা’রা’র জন্য নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী লাগে। কিন্তু স্যরি বলার স্বভাব নেই তার, এজন্য এতোদিনে বলতে পারেনি। তবে আজ সৌম্য’র কথায় আবার-ও পুরনো অপরাধবোধ জাগলো।

সৌম্য মাথা তুলে সামনে তাকালে হঠাৎ আকাশকে দেখে বিস্ময় চোখে তাকায়। আকাশ আর সৌম্য’র চোখাচোখি হয়। সৌম্য’র বিস্ময় মনে প্রশ্ন জাগে, আকাশ এখানে কেন? এটা কি আকাশের বাড়ি? তার বোন এখানে কেন? তবে কি আকাশের সাথে তার বোন……
কথাটা মাথায় আসতেই সৌম্য আগের চেয়ে-ও বিস্ময় চোখে তাকায়। আকাশ তাদের ভার্সিটিতে খুবই চেনা একটা মুখ। যাকে নিয়ে বেশিরভাগ সময়-ই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে কথা হয়। আর সেখান থেকে কানে কানে সৌম্য একবার শুনেছিল, আকাশ বিয়ে করেছে, কিন্তু বউ মানে না। সৌম্য কখনো ভার্সিটিতে গিয়ে কারো সাথে বসে গল্প করেনি। করলে হয়তো আরও কিছু জানতো। সে উপর থেকে এটুকুই জেনেছিল। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে সৌম্য পছন্দ করেনা। সৌম্য ঢোক গিলল। এরপর সন্ধ্যার হাত ধরে আকাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর বলে,

– আপনার সাথে আমার বোনুর বিয়ে হয়েছে আকাশ ভাইয়া?
আকাশ সৌম্য’র পাশে দাঁড়ানো সন্ধ্যার পানে তাকালো। সন্ধ্যার মাথা নিচু। তার ভাইয়ের কথায় সে ভীষণ অবাক হয়। আকাশকে তার ভাই কিভাবে চেনে? প্রশ্নটি মাথায় আসলে-ও সন্ধ্যা মাথা তুলল না।
সৌম্য’র মনে পড়ে তার কাছে প্রথমদিন পাঠানো ভিডিওটির কথা। যেখানে তার বোনকে কেউ সর্বশক্তি দিয়ে থা’প্প’ড় দিয়েছিল, আর তার বোন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। অসহায় হয়ে কাঁদছিল। সৌম্য’র নিঃশ্বাস ভারী হলো কথাগুলো ভেবে। আকাশের উদ্দেশ্যে আবার-ও বলে,

– কিছু বলছেন না কেন ভাইয়া?
আকাশ দৃষ্টি ঘুরিয়ে সৌম্য’র দিকে চেয়ে ছোট করে বলে,
– হুম হয়েছে।
সৌম্য সাথে সাথে প্রশ্ন করে,
– আমার বোনকে কে মে’রেছিল?
আকাশ অবাক হয়। সন্ধ্যাকে সে সেই প্রথমরাতে একটি থা’প্প’ড় মে’রে’ছিল। এরপর আর থা’প্প’ড় মা’রেনি। কিন্তু এই কথা সৌম্য কিভাবে জানলো, আকাশ বুঝলো না। তবে খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেয়,
– আমি মে’রেছিলাম।
কথাটি শুনতেই সৌম্য যেমন অবাক হয়, তেমন-ই প্রচন্ড রা’গ হয়। সন্ধ্যার হাত ছেড়ে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। আরেকটু এগিয়ে এসে আকাশের চোখে চোখ রেখে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আপনার সাহস কি করে হয় আমার বোনের গায়ে হাত তোলার?

সৌম্য’র ব্যবহার আকাশের একটু-ও ভালো লাগলো না। তার আত্মসম্মানে লাগলো। যেখানে তার সাথে দেখা হলে সৌম্যরা তাকে সালাম না দিলে এটা তাদের অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। আর আজ সৌম্য তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছে। সে অনুতপ্ত ছিল সন্ধ্যাকে একটি থা’প্প’ড় দেয়ার জন্য। কিন্তু সৌম্য’র এরকম ব্যবহারে আবার-ও হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে যায়। ডান হাতে সৌম্য’র কাঁধে ধাক্কা দিয়ে রে’গে বলে,
– সৌম্য গলা নামিয়ে কথা বলো। ভুলে যাবে না, আমি তোমার ভার্সিটির বড় ভাই।

ধাক্কা খেয়ে সৌম্য দু’পা পিছিয়ে যায়। রা’গের মাত্রা আরও বাড়লো। ভুলে যায়নি আকাশ তার ভার্সিটির বড় ভাই। সে তো তার বাবাকেই কথা শোনাতে ছাড় দিত না, তার বোনের জন্য। আর এখানে আকাশ বাইরের এক বড় ভাই। সে ছাড় দিবে, কোনো প্রশ্ন-ই আসেনা। সৌম্য এগিয়ে এসে দু’হাতে আকাশের পাঞ্জাবির কলার ধরে শক্ত কণ্ঠে বলে,
– আর আপনি ভুলে যাবেন না, আমি সন্ধ্যার বড় ভাই।
আকাশের চোখেমুখে ক্রোধ জমা হয়। সৌম্য’র শার্টের কলার ধরে শক্ত করে বলে,
– কাজটা ঠিক করলে না সৌম্য।
সৌম্য রাগান্বিত স্বরে বলে,

– ঠিক-বেঠিক আমি জানি মিস্টার আকাশ।
কথাটা বলে হঠাৎ-ই আকাশের গাল বরাবর একটা ঘু’ষি মে’রে দেয়।
আকাশের মুখ ডানদিকে হেলে যায়। রা’গে শরীর কাঁপছে তার।
বাড়ির সকলে বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। কি হচ্ছে এসব? শিমুর মাথা ঘুরছে। তার স্যার সন্ধ্যার ভাই, তারপর আবার আকাশকে মা’র’লো? শিমুর মা বাকহীন হয়ে চেয়ে আছে। আসমানী নওয়ান একবার তার ছেলের দিকে তাকায়, আরেকবার সৌম্য’র দিকে তাকায়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসেন তিনি। সন্ধ্যাকে এগোতে দেখে থেমে গেলেন তিনি।

সন্ধ্যা তার ভাইকে ঠেলে সরায় আকাশের থেকে। আকাশ সৌম্য’র দিকে তেড়ে যায়। সৌম্য’কে ঘু’ষি মা’রা’র জন্য হাত উঠালে সন্ধ্যা দ্রুত সামনের দিকে ফিরে আকাশের বুকে দু’হাতে ধাক্কা দেয়। এরপর দু’হাত জমা করে অনুরোধ করে যেন তার ভাইকে না মা’রে। আকাশ শীতল দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সৌম্য রাগান্বিত স্বরে বলে,
– বোনু তুই সর। এই লোকটা বাইরে ভালো সেজে থাকে। আর ঘরে অসহায় একটা মেয়েকে মা’র’ধ’র করে।
আকাশ ক্রোধান্বিত চোখে তাকায় সৌম্য’র দিকে। দৃষ্টি নামিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল মেয়েটি এখনো তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে-ই তার মুষ্টিবদ্ধ হাত নামিয়ে নেয়। মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার ভাইকে থামতে বলো সন্ধ্যা। আমি রে’গে যাচ্ছি। আমি ওকে ধরলে তোমার ভাইকে বাঁচাতে পারবে না।
আকাশের কথাগুলোয় না ছিল রা’গ, না ছিল ক্রোধ। যেন কাউকে বুঝিয়ে বলছে। সন্ধ্যার চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়ালো। দ্রুত উল্টো ঘুরে সৌম্য’র দিকে তাকায়। দু’হাতে সৌম্য’র গাল ধরে তার দিকে ফেরায়। ইশারায় বোঝায়,

– উনি ভালো মানুষ ভাইয়া। তুমি প্লিজ রা’গ কর না। আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো প্লিজ!
সৌম্য সন্ধ্যার প্রতিটি মনোভাব খুব নিখুঁতভাবে বুঝতে পারে। আকাশের বুঝতে ক’ষ্ট হলে-ও বুঝলো। অবাক হলো তাকে ভালো বলায়। সৌম্য আকাশের দিকে চেয়ে বলে,
– ভালো মানুষেরা কখনো মেয়েদের গায়ে হাত তোলে না, বুঝলি বোনু? আর তারা বিয়ে করে বউকে না মানার জিকির করেনা।
আকাশ সৌম্য’র দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। সৌম্য’র চোখেমুখে এখনো রা’গ। আকাশের দু’হাত নিশপিশ করছে। কিন্তু সে মা’র’ছে না কেন সৌম্যকে? সন্ধ্যা নিষেধ করল বলে? এই মেয়েটা মাত্র কয়েকদিনে তার জীবনের সমীকরণটাই যেন পাল্টে দিয়েছে। নিজের এসব হ্যাবিট নিজের বহন করতেই অসহ্য লাগছে।
সন্ধ্যা তার ভাইকে বোঝায়, সে সব বুঝিয়ে বলছে। এরপর সৌম্য’র থেকে ফোন নিয়ে লিখতে শুরু করে। প্রায় মিনিট চার কিছু লিখল। সবাই চুপ থাকলো। কেউ কিচ্ছু বলল না। সন্ধ্যার লেখা শেষ হলে সে তার ভাইয়ের সামনে ফোন ধরে। যেখানে লেখা ~

– ভাইয়া আকাশ নওয়ানকে তার মা আমার সাথে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়েছিল। তিনি বিয়ে করতে চাননি। এজন্য আমাকে মানতে পারছিলেন না। আর উনি জানতেন না, আমি কথা বলতে পারিনা। উনি আমাকে প্রশ্ন করছিল,
কথা বলতে পারি না তো। আর ভ’য় পাচ্ছিলাম বলে হঠাৎ ইশারায় দেখাতে পারছিলাম না। তাছাড়া উনি কেন যেন আমাকে লোভী ভাবতেন, সবমিলিয়ে রে’গে মে’রেছিল। এরপর আর মা’রেননি। উনি আমাকে অনেকবার সাহায্য করেছিল ভাইয়া। তুমি ওনাকে কথা শুনিয়ো না। মে’রো না।

তাছাড়া তুমি ভাবো, আমাকে যদি একটি বোবা, কালো ছেলের সাথে বিয়ে দেয়া হয় না জেনেই। তবে তার রিয়েকশন কেমন হবে? তবুও উনি আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমি অনেকবার বিপদে পড়েছি, উনি আমাকে বিপদে ফেলে চলে যাননি। তুমি আর ঝামেলা করনা ভাইয়া। আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো প্লিজ সৌম্য ভাইয়া!
লেখাগুলো পড়ে সৌম্য নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার চোখের কোণে পানি। তার বোন উদার সে জানে। কিন্তু মিথ্যা বলেনা এটা-ও জানে। আকাশের সাথে জোর করে বিয়ে দিয়েছে? আর তার বাবা-মা-ই বা কি স্বার্থে বিয়ে দিল? সৌম্য আকাশের দিকে তাকালে দেখল আকাশ ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই চেয়ে আছে। সৌম্য ঢোক গিলল। এরপর সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,

– নিয়ে যাবো বোনু। আর কখনো তোকে একা রেখে কোথাও যাবো না।
আসমানী নওয়ান পাশ থেকে প্রশ্ন করে,
– তুমি সন্ধ্যার আপন ভাই?
সৌম্য আসমানী নওয়ানকে উত্তর করে,
– জ্বি। কেন?
আসমানী নওয়ান একটু চুপ থেকে বলে,
– আমি জানি তুমি সন্ধ্যার সৎ ভাই। সন্ধ্যাকে এইখান থেইকে কোথাও নিয়ে যাইতে পারবা না।
সৌম্য শিমু আর শিমুর মাকে দেখেছে। একটু অবাক হলেও বুঝেছে এদের আত্মীয়। আর আসমানী নওয়ানকে দেখে বুঝেছে, ভদ্রমহিলা আকাশের মা হবেন। তাছাড়া আর কেউ তো নেই। অবাক হয়ে বলে,
– কেন পারবো না? আকাশ ভাইয়া তো আমার বোনকে স্ত্রী হিসেবে মানে না।
আসমানী নওয়ান বলেন,

– কারণ সন্ধ্যারে আমি তোমার নিমোক’হারাম বাপের থেইকা কিনা আনছি। ১৫ লাখ টাকা গুণে দিয়া আসছি। সেইখান থেইকা তুমি ভাগ পাওনাই বলে আবার আমার জান্নাতরে নিয়া যাইতে আসছো? এতো অ’ত্যা’চা’র কইরা-ও শান্তি হয়নাই তোমাগো?
আসমানী নওয়ান এর কথাগুলো শুনে সকলের মনে হলো এখানে মাত্র বো’ম’ব্লা’স্ট হয়েছে। আকাশ সবচেয়ে বেশি অবাক হলো। তার বিয়ের পর পর সে ১৫ লাখ টাকা উধাও দেখে তার মাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি অনেক রিয়েক্ট করে। আর এদিকে তিনি ওই টাকাগুলো দিয়ে সন্ধ্যাকে কিনে এনেছে?
সন্ধ্যা, সৌম্য দু’জনেই হতবাক হয়ে চেয়ে আছে আসমানী নওয়ানের দিকে। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার দিকে তাকালো। মেয়েটিকে তিনি জানাতে চায়নি। যতই হোক জন্মদাতা বাপ সে। সন্ধ্যা ক’ষ্ট পাবে। কিন্তু আজ আবার সেই ন’র’কে তার জান্নাতকে যেতে হবে শুনে নিজেকে সামলাতে পারলেন না। সৌম্য ঢোক গিলে বলে,
– কি বাজে কথা বলছেন? আমি এসব ব্যাপারে কিছু জানি না।

সন্ধ্যা ডানহাতে সৌম্য’র শার্ট খামচে ধরল। মাথা উঁচু করে সৌম্য’র দিকে তাকায়। চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। সৌম্য বা হাতে তার বোনকে নিজের সাথে আগলে নেয়। ডানহাত সন্ধ্যার গালে রেখে কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– বোনু বিশ্বাস কর, আমি এসব কিচ্ছু জানতাম না। আমি তোকে পা’গ’লের মতো খুঁজেছি। বাবাকে নিয়ম করে কল করতাম, একটাবার তোর খোঁজ পাবার জন্য। স্বা’র্থ’প’র বাপটা মুখ থেকে একবার-ও একটা শব্দ বের করেনি। আমি অনেক ক’ষ্ট করে তোকে খুঁজে পেয়েছি বোনু। তুই আমাকে অ’বিশ্বাস করলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো বল তো?
সন্ধ্যা হঠাৎ তার ভাইকে গায়ের জোরে ধাক্কা দেয়। সৌম্য অবাক হয়ে তাকায়। চোখজোড়া ভরে ওঠে। থেমে থেমে ডাকে,

– ব.বোনু??
সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য’র উপর তার খুব রা’গ হয়। তার ভাই কি পা’গ’ল? সন্ধ্যা তার ভাইকে অ’বিশ্বাস করবে এটাও সম্ভব? সৌম্য তার ব্যাপারে এমন চিন্তা কি করে করে যে, সন্ধ্যা তার ভাইকে ভুল বুঝবে? তার তো এটা ভেবে খারাপ লাগছে, তার নিজের বাবা তাকে কিভাবে বেঁচে দিয়েছে? সন্ধ্যা দু’হাতে চোখ মুছে ইশারায় বোঝায়,
– আমি তোমাকে অবিশ্বাস করছি, এটা তুমি কিভাবে ভাবো ভাইয়া? তুমি-ও আমায় পর ভাবো সৌম্য ভাইয়া? আমাকে একটু-ও বোঝোনা?

সন্ধ্যার কথাগুলো এবার সবাই সেভাবে বুঝলো না। আকাশ বোধয় একটু একটু বুঝলো। কিন্তু সৌম্য পুরোপুরি বুঝেছে। অসহায় চোখে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার সামনে এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে বলে,
– স্যরি বোনু! আমি টেনশনে ভুলভাল বলে ফেলেছি। তোকে ভুল বুঝিনি আমি।
সৌম্য’র কথা শুনে সবাই অবাক হয়। এইবার হয়তো সন্ধ্যার ইশারায় বোঝানো কথাগুলো বুঝেছে। এদের ভাইবোনের এমন আবেগঘন কথপোকথনে প্রত্যেকে অবাক না হয়ে পারেনা।
সন্ধ্যা ইশারায় বলে, – আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও ভাইয়া, প্লিজ!
সৌম্য সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
– অবশ্যই নিয়ে যাবো বোনু।
এরপর বিড়বিড় করল,

– এমন জা’নো’য়া’র বাপ কাউকে দিওনা আল্লাহ।
আসমানী নওয়ান ঝাপসা চোখে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। মনে প্রশ্ন জাগে, সন্ধ্যা আর এই ছেলেটা সত্যি-ই একে অপরকে এতো মোহাব্বত করে?
সৌম্য আসমানী নওয়ানের দিকে চেয়ে বলে,
– আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আপনার সব টাকা ফেরত দিয়ে তবেই আমার বোনকে নিয়ে যাবো।
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
– তুই সত্যি-ই আমাকে রেখে যেতে যাস জান্নাত?
শিমুর মা অপর পাশ থেকে বলে,

– আমাদের থেকে দূরে যাস না জান্নাত। ওরা তোকে একটু-ও শান্তি দেয় না। ওমন ন’র’কে কেন যেতে চাইছিস?
সন্ধ্যা একবার আসমানী নওয়ান এর দিকে তাকায়, আরেকবার শিমুর মায়ের দিকে তাকায়। ইশারায় বোঝায়,
– তার ভাই তাকে খুব ভালোবাসে। একটু-ও অ’ত্যা’চা’র করেনা।
সৌম্য অবাক হয় দু’জন ভদ্রমহিলার মুখে জান্নাত নাম শুনে। এই নামে তো তার মা তার বোনুকে ডাকতো। তার মায়ের সাথে কি কোনো কানেকশন আছে এনাদের? সৌম্য কিছু বলতে গিয়ে-ও এই ভাবনা চেপে রাখলো। সে কিছু জানতে চায় না। সে শুধু তার বোনুকে এখান থেকে নিয়ে তার কাছে রাখতে চায়।

আকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এদের ব্যাপার-স্যাপার অনেকটা বুঝেছে। সৌম্যকে সে অনেকবছর আগে থেকেই চেনে। সৌম্য’র কথা শুনে এটা-ও বুঝল, এদের বাবা সুবিধার নয়,, কোনোভাবে এদের দু’জনকে এদের বাবা-ই আলাদা করেছে। তার মায়ের কথাতে-ও স্পষ্ট সে সৌম্যকে চিনতো না। সে এই অনুভূতি থেকে বের হতে চায়। তাছাড়া এদের ভাই-বোনকে আলাদা রাখার কোনো মানেই হয়না, যেখানে দু’জনে দু’জনের সাথে থাকতে চায়। হঠাৎ রা’গ উঠলে-ও সেই রা’গ পড়তে আকাশের সময় লাগেনা। যেমন এখন সে রে’গে নেই। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– সৌম্য তোমার বোনকে নিয়ে যেও। তবে টাকা ফেরত দিতে হবে না।
আকাশের কথা শুনে আসমানী নওয়ান বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় ছেলের পানে। সন্ধ্যা-ও অবাক হয়। সৌম্য অপরাধীর ন্যায় তাকায়। সে বুঝল, আকাশ তার অবস্থা জেনেই পুরো ১৫ লাখ টাকা দিতে নিষেধ করল। তাদের পুরো ভার্সিটি এমন আকাশকেই চেনে। কিন্তু তখন হঠাৎ উপর থেকে একটু শুনেই রে’গে গিয়ে রুড বিহেভ করে ফেলেছে, এমনকি মে’রে’ছে-ও। তার বোনের ব্যাপারে ছাড় দিতে পারেনা সে।
সৌম্য মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলে,

– ঋণী থাকতে চাই না। আমি আপনাদের টাকা পরিশোধ করে দিব। আমাকে একদিন সময় দিন।
সৌম্য কথাটা বলে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি কালকে এসে তোকে নিয়ে যাবো বোনু, কেমন? এইটুকু সময় অপেক্ষা করতে পারবি না?
সন্ধ্যা ছলছল চোখে তাকায় তার ভাইয়ের দিকে। মাথা নেড়ে বোঝায়, – সে পারবে।
এরপর আবার-ও হাত নেড়ে বোঝায়,
– তুমি এতো টাকা কোথায় পাবে ভাইয়া?
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,

– আমার কি মা আছে? তুই-ই তো আমার মা। ছোট মা তুই আমার। সব পারি আমি আমার বোনুর জন্য। তুই সাবধানে থাকবি,, আমি কালকে এসে তোকে নিয়ে যাবো কিন্তু।
সন্ধ্যা তার ভাইয়ের বুকে মাথা রাখলো। তার ভাই কোথায় পাবে টাকা? এটা ভেবেই মাথা ঘুরছে। দু’ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। সৌম্য সন্ধ্যাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। যাওয়ার আগে শিমুর মাকে বলেছে, সে আর শিমুকে পড়াতে পারবে না। আর আকাশকে ছোট্ট করে স্যরি-ও বলেছে।
আসমানী নওয়ান কিছু বললেন না। যেখানে সন্ধ্যা যেতে চায়, সে কীভাবে বারণ করবে? আকাশ যেহেতু মানবে না সন্ধ্যাকে তবে চলে যাওয়াই ভালো।

আসমানী নওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপচাপ তার ঘরে চলে গেল। তবে তার মাথায় কিছু ঘুরছে। সন্ধ্যাদের গ্রামে আরেকবার যেতে হবে তাকে। শিমুর মা-ও মলিন মুখে নিজের ঘরে চলে যায়। শিমু ঝাপসা চোখে চেয়ে ভাইবোনের আলাপ দেখল। সৌম্য তাকে আর পড়াবে না ভেবে ভীষণ মন খারাপ হলো। কিন্তু এর চেয়ে-ও বেশি খারাপ লাগছে সৌম্য আর সন্ধ্যার কথা ভেবে। এইজন্য-ই কি সৌম্য তাকে পড়াতে এসে এতো বেশি রুড আর চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল? মায়ের পিছু সে-ও জায়গাটি প্রস্থান করে।
সন্ধ্যা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ-ও দাঁড়িয়ে আছে তার জায়গায়। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার ভাই টাকা ম্যানেজ করতে না পারলে-ও তোমাকে আটকে রাখবো না আমরা। চিন্তা কর না।
কথাটা বলে আকাশ আর দাঁড়ালো না। দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে তার ঘরের উদ্দেশ্যে।
সন্ধ্যা মলিন মুখে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। ঝাপসা চোখজোড়া সরিয়ে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়।

সৌম্য আকাশদের বাড়ি থেকে সোজা তার মেসে এসেছে। এরপর মৌলভীবাজার থাকে, সৃজার বাবা, অর্থাৎ তার মামার কাছে কল করে। কল রিসিভ হলে সৌম্য তার মামাকে সালাম দেয়। এরপর টুকটাক কথা বলে সৌম্য বলে,
– মামা আমার ১৫ লাখ টাকা লাগবে।
সৌম্য’র কথায় ভদ্রলোক থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। এরপর বলে,
– এতো টাকা কি করবে বাবা?
সৌম্য তার বাবার কুকীর্তি বলতে চাইলো। কিন্তু ফোনে বলতে ইচ্ছে হলো না। অতঃপর বলে,
– আমি আপনাকে সামনাসামনি সব বলব মামা। আপনি কি আমাকে কালকের মধ্যে টাকা টা দিতে পারবেন?
সৃজার বাবাকে চুপ দেখে সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,

– আমি আপনাকে সব টাকা পরিশোধ করে দিব মামা। আমাকে শুধু একটু সময় দিয়েন।
সৌম্য’র কথায় ভদ্রলোক হেসে ফেলল। একটু পর বলে,
– পা’গ’ল ছেলে। তোমার মায়ের ঋণ শোধ করতে পারব না কখনো আমি। তাছাড়া তোমার সাথে আমার অনেক হিসাব-নিকাশ আছে। তুমি এলে সব হবে। আর আমি তোমাকে কালকে টাকা পাঠাবো বাবা। চিন্তা কর না, তবে একটু লেট হতে পারে।
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– আচ্ছা মামা। সমস্যা নেই।
এরপর কল কেটে দেয়। পাশে রিহান বসা। সে গালে হাত দিয়ে বলে,
– আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তোর বাপ তোদের বাপ তো নয়-ই। ওটা মানুষ-ও নয়। এমন অ’মানুষের গল্প-ও কখনো শুনিনি আমি।
সৌম্য রিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। মৃদু হেসে বলে,

– তোর বাবা তোকে প্রতি মাসে টাকা পাঠায় তাই না?
রিহান মাথা নেড়ে বলে,
– হুম তা তো দেয়-ই। চাকরি তো করিনা এখনো। মাঝে মাঝে আমি না করলেও জোর করে দেয়। ভাবে আমি মিথ্যা বলে ক’ষ্ট করব হয়তো।
সৌম্য মলিন হেসে নির্জীব গলায় বলে,
– তোর বাবা তোকে সুখে রাখতে টাকা দেয়, আর আমার বাবা নিজে সুখে থাকতে আমার বোনুকে বেঁচে দেয়।
কথাটা বলে সৌম্য দু’হাতের মাঝে মুখ লুকিয়ে রেখে ভাঙা গলায় বলে,
– মা বেঁচে থাকতে, আমার বাবা-ও আমার সুখের কথা ভাবতো। আসলে যার মা নেই তার কেউ নেই। কথাটা আমি আর আমার বোনু খুব বাজেভাবে ফিল করেছি, এখনো করছি।
রিহান মলিন মুখে তাকালো। নিরব সান্ত্বনাস্বরূপ সৌম্য’র কাঁধে হাত রাখলো।

রাত তখন ১ টার কাছাকাছি।
সন্ধ্যা বিছানা এক কোণে চুপ করে বসে আছে। দু’হাঁটু ভাঁজ করে, হাটুতে গাল ঠেকিয়ে অজানায় তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে প্রাণ নেই। দু’পা সামনের দিকে সামান্য মেলে রাখা। সন্ধ্যা দৃষ্টি ঘুরিয়ে তার দু’পায়ে রাখে। আকাশের দেয়া নুপুর পরেছিল সেদিন আর খোলা হয়নি। সন্ধ্যা বেশ কিছুক্ষণ দু’হাতে নুপুর দু’টি নাড়ালো। ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি ফুটল। সময় নষ্ট না করে নুপুর দু’টি পা থেকে খুলল। এরপর বিছানা থেকে নেমে টেবিলের কাছে গিয়ে চেয়ারে বসে। একটি প্যাডে সময় নিয়ে কিছু লিখল। শেষ দু’টি শব্দের উপর ডান চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা পানি পড়ে। সন্ধ্যা ঢোক গিলে দু’আঙুলের সাহায্যে লেখাটির উপর থেকে পানির কণা ছিটকে ফেলে। এরপর কাগজটি চার ভাঁজ করে ডান হাতের মুঠোয় নেয়, আর নুপুর দু’টি বক্সের ভিতর ঢুকিয়ে বা হাতে বক্সটি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।
সবাই ঘুমিয়েছে হয়তো।

সন্ধ্যা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। পুরো বাড়ি জুড়ে মৃদু আলো ঘুরছে। যার ফলে সন্ধ্যার হাঁটতে খুব বেশি সমস্যা হলো না। একটি একটি করে সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে আকাশের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভাবলো, দরজা হয়তো লাগানো। তাই ছোট্ট চিরকুট আর নুপুরের বক্স দরজার কাছেই রেখে যাবে। কিন্তু কি যেন ভেবে বা হাত দরজায় রাখলে ঘরের দরজাটি কিছুটা আলগা হয়ে যায়। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। ঘরের ভেতরে জিরো লাইট জ্বলছে মনে হলো। সন্ধ্যা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। ভেতরে যাবে না-কি, এখানেই রেখে চলে যাবে। অবশেষে ভাবলো, ঘরে গিয়ে রেখে আসবে। এরপর দরজা ঠেলে ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে।

আকাশ বিছানার এক কোণে জড়সড় হয়ে শুয়ে আছে। মৃদু আলোয় সন্ধ্যা হালকা অস্পষ্ট আকাশকে দেখল। ভ’য়ে ভ’য়ে এগিয়ে গিয়ে আকাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। জিরো লাইটের মৃদু নীল আলোয় আকাশের শুভ্র মুখটা জ্বলজ্বল করে। আকাশের পরনে সেই সাদা পাঞ্জাবি। সন্ধ্যা মলিন হাসলো। গত কিছুদিন যাবৎ আকাশকে বেশিরভাগ সময় সাদা পাঞ্জাবিতে দেখেছে সে। প্রথম প্রথম শার্ট, প্যান্টে দেখেছিল। এরপর সাদা পাঞ্জাবি। সন্ধ্যার আকাশকে ভালো লেগেছে এই পোষাকে, সে জানেনা কেন।
সন্ধ্যা ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়ে। আকাশের মাথার কাছে বসেছে সে। আকাশের ঘুমন্ত মুখপানে চাইল সন্ধ্যা। চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করে।
একপর্যায়ে চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। আজকের রাতটাই এই বাড়িতে শেষ রাত তার। আর কখনো আকাশকে তার দেখা হবে না। কি করে দেখা হবে? এমনিতে-ও আকাশ তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যার দমবন্ধ লাগলো। সন্ধ্যার খুব বলতে ইচ্ছে করল,

– আপনাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে, জানেন? কবুল বলেছি বলে হয়তো।
আচ্ছা আপনি-ও তো আমায় কবুল বলে বিয়ে করেছেন। তবে আপনার মাঝে কবুলের প্রভাব একটুখানি-ও কেন পড়লো না?
মনে মনে কথাগুলো আওড়িয়ে সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে ওঠে।
তার হাতের নুপুরের বক্সটির দিকে তাকালো। নুপুরটি তার খুব পছন্দ হয়েছিল। নুপুর সুন্দর বলে পছন্দ হয়েছে এমন নয়, বরং নুপুর দেয়ার মানুষটি কবুল বলে বিয়ে করা স্বামী বলে ভালো লেগেছিল। খুব ইচ্ছে জেগেছিল, এই নুপুর দু’টি তার কাছে অতিযত্নে রাখতে। কিন্তু যে মানুষটা তাকে ভুল করে-ও একটুখানি চায় না, তার থেকে মুক্তি পেতে কতই না চেষ্টা যার, সে কি করে তার দেয়া জিনিস নিজের কাছে রাখবে? সন্ধ্যা নিজেকে সামলে নেয়।
বা হাতের কাছে একটি ছোট্ট বেডসাইড টেবিলের উপর হাতের চিরকুট, তার উপর নুপুরের বক্সটি রাখে।
এরপর আকাশের ঘুমন্ত মুখপানে তাকায় আবার-ও। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়। উল্টো ঘুরে যেতে নিলে বা হাতে টান পড়ায় সন্ধ্যা সাথে সাথে উল্টো ঘুরে তাকায়।
আকাশ ঘুমুঘুমু চোখে সন্ধ্যার পানে চেয়ে আছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। চোখেমুখে ভীতি। আকাশ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,

– আমার ভীষণ মাথা ব্য’থা করছে। চুলগুলো একটু টেনে দিবে?
কথাটা বলে চোখজোড়া বুজে নেয়। সন্ধ্যার হাতটি-ও আলগা করে দেয়। আকাশ তার যে হাত ধরেছিল সন্ধ্যা তার সেই হাতের দিকে তাকালো। তার কাছে আকাশের হাত অনেক গরম লেগেছে। সন্ধ্যা তার ভীতি চেপে একটু এগিয়ে গিয়ে আকাশের কপালে হাত ছোঁয়ালে ভীষণ অবাক হয়। আকাশের গায়ে অনেক জ্বর। আকাশের জড়সড় হয়ে শোয়ার কারণ বুঝল সন্ধ্যা। বেডের পাশে একটি কাঁথা নিয়ে আকাশের গায়ে জড়িয়ে দিল। আকাশ বোধয় একটু আরাম পেল। আবার-ও তার লালিত চোখজোড়া টেনে খুলে বাচ্চাদের মতো করে বলে,

অন্তঃদহন পর্ব ১৪

– চুল টেনে দিবে না?
আকাশের ব্যবহারে সন্ধ্যা অবাক হয়, তবে ডানদিকে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। আকাশ বোধয় খুশি হলো। একটু হেসে বলে,
– তুমি একদম সন্ধ্যার মতো দেখতে।

অন্তঃদহন পর্ব ১৬