অন্তঃদহন পর্ব ২৪
DRM Shohag
আকাশ সন্ধ্যার চোখের কোণে জমায়িত পানির কণা দেখল। তার মনে হচ্ছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। হঠাৎ-ই সন্ধ্যার হাত ধরে টেনে এনে সন্ধ্যাকে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। দু’হাতের বন্ধনীর মাঝে সর্বশক্তি দিয়ে সন্ধ্যাকে ধরে রাখে। সন্ধ্যা স্তব্ধ হয়ে যায়। মুখ ঠেকেছে আকাশের বুকে। চোখজোড়া ভেদ করে নোনাপানি বেরিয়ে, এর স্থান হয় আকাশের সাদা পাঞ্জাবিতে।
আকাশ ঢোক গিলল। তার বুক কাঁপছে। চোখ বন্ধ। থেমে থেমে আওড়ায়,
– সন্ধ্যামালতী!
সন্ধ্যা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। একটু আগেও তো এই মানুষটাকে মনে করে কত কাঁদলো সে। হঠাৎ কোথা থেকে চলে এলো আকাশ?
আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে দু’হাতের আঁজলায় সন্ধ্যার মুখ নিয়ে বিষন্ন কণ্ঠে বলে,
– কোথায় ছিলে তুমি? তুমি তুমি….
এটুকু বলে থেমে যায় আকাশ। কথা বলতে পারছে না সে। ঢোক গিলে বলে,
– তুমি পু’ড়ে যাও নি সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশের ব্যবহার তার হজম হচ্ছে না। তার দু’গালে আকাশের দু’হাত। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ কি বিয়ে করেনি? তার আকাশকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশ হয়তো বিয়ে করে নিয়েছে। প্রশ্নটি আগেও মাথায় আসতো, আর আজ আকাশকে সামনে থেকে দেখে কথাটা মাথায় বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। আকাশের চুল, দাঁড়ি কি সুন্দর গোছানো। মনে হচ্ছে আকাশ আগের চেয়ে সুন্দর হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। তাকে কি ডিভোর্স দিয়ে দিবে আকাশ। কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যার চোখেমুখে ভীতি হানা দেয়।
ওদিকে সন্ধ্যার ফ্রেন্ড লামিয়া সহ সকলে বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সব তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আকাশের কথা তারা শুনতে পাচ্ছে না। কিন্তু তাদের বান্ধবী আর সভাপতির মাঝে এসব কি হচ্ছে? লামিয়া এগিয়ে এসে ডাকে,
– এই সন্ধ্যা?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লামিয়ার ডাকে সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। দ্রুত আকাশের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। আকাশ ভ্রু কুঁচকে আবার-ও সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে আসলে সন্ধ্যা আকাশকে দু’হাতে ধাক্কা দেয়। কান্নামাখা চোখে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ সন্ধ্যার ব্যবহারে অবাক হয়। সন্ধ্যা জুতো পরলো না। তার ব্যাগ তুলে এই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে আকাশ চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই মেয়ে কোথায় লুকিয়ে ছিল? আবার তাকে দেখে পালিয়ে যাচ্ছে। আকাশ দ্রুত সন্ধ্যার হাত টেনে তার সামনে দাঁড় করিয়ে অবাক হয়ে বলে,
– তুমি আবার আমার থেকে পালাচ্ছ? তোমার সাহস তো কম না!
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। তার হাত আকাশের হাতের মুঠো থেকে ছাড়াতে চায়। সে তার ভাইয়ের কাছে যাবে। সন্ধ্যার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। আকাশ সন্ধ্যার হাবভাব দেখছে। আজব তো! মেয়েটি তাকে দূরে ঠেলছে কেন? আকাশ ডান হাতে সন্ধ্যার হাত শক্ত করে ধরে রেখে বা হাত সন্ধ্যার গালে রেখে বলে,
– সন্ধ্যামালতী কি হয়েছে তোমার?
সন্ধ্যা অবাক হয়। নামটি কেমন অদ্ভুদ ঠেকল। সাথে আকাশের ব্যবহার-ও। পাশ থেকে লামিয়া বলে,
– স্যার আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ওর নাম সন্ধ্যা। সন্ধ্যামালতী নয়।
আকাশ বিরক্ত চোখে তাকায় লামিয়ার দিকে। সন্ধ্যার হাত মোচড়ামুচড়িতে আকাশ বিরক্ত হয়ে ধমকে বলে,
– কি প্রবলেম তোমার? পালাতে চাইছ কেন আমার থেকে? ক্লোরোফর্ম চিনো? একদম অজ্ঞান করে কি’ড’ন্যা’প করে নিয়ে যাব। যেমন বে’য়া’দ’ব ছিলে তেমন-ই আছো।
আকাশের কথা শুনে সন্ধ্যাসহ সকলে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। সন্ধ্যা ভ’য় পায়। এতোক্ষণ ডিভোর্স সাথে আকাশ বিয়ে করেছে কি-না সেসব মিলিয়ে আকাশের থেকে পালাতে চাইছিল। আর এখন তাকে গু’ন্ডাদের মতো অজ্ঞান করে কি’ড’ন্যা’প করতে চাইছে। সন্ধ্যা ভীত হয়ে কাঁপা হাত মোচড়ায় আকাশের থেকে তার হাত ছাড়াতে। আকাশকে ভ’য় পাচ্ছে সে।
লামিয়া দেখছে সন্ধ্যা আকাশের থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে। আর এই আকাশ তো আচ্ছা ব’জ্জা’ত। লামিয়ারা সবাই জানে আকাশ বিবাহিত।
লামিয়া বিড়বিড় করে,
– সন্ধ্যা ঠিক-ই বলেছিল, এর স্বভাব ন’ষ্ট। ঘরে বউ রেখে আমার বান্ধবীর পিছে লেগেছে।
অতঃপর লামিয়া তার ভ’য় দূরে রেখে আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,
– আপনি তো বিবাহিত স্যার। আপনার বউ এর নাম হয়তো সন্ধ্যামালতী। আমার বান্ধবীর সাথে গুলিয়ে ফেলছেন কেন? ওকে ছাড়ুন।
লামিয়ার কথাটা শুনে সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। তার মানে আকাশ বিয়ে করে নিয়েছে? লামিয়া তো চিনে ফেলল। সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যা আগের চেয়ে শক্তি প্রয়োগ করে আকাশের থেকে নিজের হাত ছাড়াতে চায়। বাচ্চাদের মতো তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আকাশ বিবাহিত কথাটা মানতেই পারছে না মেয়েটি।
আকাশ শক্ত হাতে সন্ধ্যার হাত চেপে ধরে লামিয়ার দিকে রে’গে তাকায়। যেন আজ লামিয়াকে এই দৃষ্টি দিয়েই মে’রে ফেলবে। লামিয়া ঢোক গিলল। ভ’য় সে পাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে তার বান্ধবীকে বাঁচাবে না? সন্ধ্যা আকাশের থেকে নিজের হাত ছাড়াতে না পেরে একটু ঝুঁকে আকাশের হাতের কব্জির উপর জোরেসোরে কা’ম’ড় বসায়। আকাশ লামিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকায় বুঝতেই পারেনি। হঠাৎ ব্য’থা পেয়ে সন্ধ্যার হাত ছেড়ে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে,
– আহ!
সন্ধ্যা ছাড়া পেয়ে লামিয়ার হাত থেকে তার ফোন টেনে নিয়ে, দু’হাতে ব্যাগ চেপে খালি পায়েই দৌড় দেয়। আকাশ দ্রুত পিছু ফিরে সন্ধ্যাকে ধরতে গিয়েও পারলো না। সন্ধ্যা দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছে রুম থেকে। আকাশের চোখেমুখে যেমন বিস্ময়, তেমনি রা’গ। লামিয়ার দিকে চেয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– তোমার ব্যবস্থা পরে করছি। রা’বি’শ কোথাকার!
কথাটা বলে বড় বড় পা ফেলে আকাশ বেরিয়ে যায় রুম থেকে। লামিয়া সহ বাকি সবাই ভীত চোখে চেয়ে রইল। একটি মেয়ে লামিয়াকে ঝাঁকিয়ে বলে,
– কিছু বুঝলি?
লামিয়া বেঞ্চের উপর থেকে তার ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
– বুঝিনি কিছু। সন্ধ্যা কই গেল আগে সেটা দেখি।
সন্ধ্যা যখন রুম থেকে বেরিয়েছে, তখন-ই ছুটির ঘণ্টা পড়ে। ক্লাসরুম থেকে সকল ছাত্রছাত্রীরা বেরিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা স্টুডেন্টদের মাঝে মিশে গিয়েছে। শরীর কাঁপছে তার। কাঁপা হাতে সৌম্য’র নাম্বারে মেসেজ করে,
– সৌম্য ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসো। আমার ভ’য় লাগছে।
সন্ধ্যা একটু সাইডে গিয়ে গাছের আড়ালে দাঁড়ায়। ফোনের দিকে চেয়ে তার ভাইয়ের উত্তরের অপেক্ষা করে। সে সৌম্যকে মেসেজ করলে তাকে কখনো অপেক্ষা করতে হয় না। সৌম্য সাথে সাথে তার বোনকে রিপ্লে দেয়। কিন্তু আজ সন্ধ্যা তার ভাইয়ের নাম্বার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে হাসফাস করে। তার ভাইয়া কোথায়? সন্ধ্যার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আকাশ বিয়ে করে নিয়েছে ভাবতেই দমবন্ধ লাগছে। আবার তাকে তুলে নিয়ে যেতে চায়। জোর করে ডিভোর্স করিয়ে নিবে এইজন্য? সন্ধ্যা নিজেই ডিভোর্স দিয়ে দিবে আকাশকে। এমন বিবাহিত লোকের বউ হয়ে থাকার একটু-ও ইচ্ছে নেই তার।
আবার-ও ফোন চেক করলে দেখল সৌম্য কোনো রিপ্লে-ই দেয়নি। গাছের আড়াল থেকে একটু মাথা বের করে আশেপাশে তাকালে দেখল মাঠের মাঝে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে, তবে মুখে মাস্ক। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। সত্যি সত্যি তাকে অজ্ঞান করে নিয়ে গেলে তার কি হবে? তার ভাইয়া তাকে কই খুঁজবে? সন্ধ্যা ভীত চোখে তাকায়। ভাবলো বাইরে গিয়ে দেখুক, তার ভাইয়া এসেছে কিনা! সন্ধ্যা ব্যাগ সামনে রেখে নিজেকে আড়াল করে দৌড়ে কলেজ গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।
এদিকে আকাশ দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা হাতের কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সন্ধ্যাকে খুঁজছে। চোখের পলকে মেয়েটি কোথায় চলে গেল? সন্ধ্যার বেঁচে থাকার ব্যাপারে তার মাথায় হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে এসব ভাবনা আপাতত সরিয়ে রেখে তার দৃষ্টি সন্ধ্যাকে খুঁজতে ব্যস্ত। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে৷ সন্ধ্যা তার থেকে পালালো কেন? তবে এতোদিন-ও কি ইচ্ছা করেই তার থেকে দূরে ছিল? কেন? আকাশ ঢোক গিলল। চোখদু’টো লাল হতে শুরু করেছে। আবার কোথায় হারালো তার সন্ধ্যামালতী?
আকাশ এদিক-ওদিক ব্যস্ত পায়ে হেঁটে হেঁটে সন্ধ্যাকে খুঁজতে থাকে। এতো স্টুডেন্ট এর মাঝে কিভাবে খুঁজবে? আদো-ও এখানে আছে? কলেজ গেইট থেকে বেরিয়ে যায়নি তো? আরও বেশ কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে খুঁজল। এতোক্ষণে মাঠ আগের চেয়ে অনেকটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আকাশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পুরো মাঠ জুড়ে। কোথাও নেই সন্ধ্যা।
শিমু আকাশকে মাঠে দেখে দৌড়ে এসে বলে,
– আকাশ ভাইয়া চলো।
আকাশ শিমুর উদ্দেশ্যে বলে,
– গাড়িতে গিয়ে বোস। আমি আসছি।
শিমু ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আকাশের কণ্ঠ টা কেমন যেন একটু অন্যরকম লাগলো। চোখদু’টো-ও লাল। কৌতূহলী চোখে চেয়ে বলে
– কি হয়েছে ভাইয়া?
আকাশ ছোট করে ‘কিছু না’ বলে মাঠের কোণার দিকে সাইড করে রাখা গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। স্কুল মাঠে সন্ধ্যা নেই এটা সে বুঝে গেছে। শিমু-ও আকাশের পিছু পিছু গিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে বসে পড়ে। আকাশ গাড়ি ঘোরালে দারোয়ান কলেজ গেইটের বড় গেইট খুলে দেয়। আকাশ কলেজের ভেতর থেকে গাড়ি বের করে রাস্তার একপাশে গাড়ি সাইড করে গাড়ি থেকে বের হয়।
দৃষ্টি চারপাশে ঘুরছে এখনো। পকেট থেকে ফোন বের করে বায়ানের নাম্বারে কল করে। কল রিসিভ হলে আকাশ গম্ভীর স্বরে বলে,
– শিমুর কলেজের সামনে আসো। গাড়ি ড্রাইভ করতে হবে।
কথাটা বলেই কল কেটে দেয়। চোখজোড়া বুজে ভারী নিঃশ্বাস ফেলে। তার সন্ধ্যা বেঁচে আছে, কথাটা ভাবতেই মনে হলো, তার জীবন সার্থক। সে বেঁচে থেকে সার্থক।
মরুভূমিতে পথ হারিয়ে ফেলা পথিক যেমন একফোঁটা পানির সন্ধান পেয়ে জীবন ফিরে পাবার আশায়, তার খুশির অন্ত থাকে না। আকাশের তেমনি অনুভূতি হলো। প্রাণহীন এক দেহে হঠাৎ প্রাণ ফিরে পেয়ে আকাশ কেমন যেন সতেজ হয়ে উঠল। বিড়বিড় করল,
– তুমি বেঁচে আছো সন্ধ্যামালতী? আমি জানিনা তুমি কেন আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছ! তবে তুমি বেঁচে আছো মানে আমার দৃষ্টির বাইরে আর এক সেকেন্ড-ও থাকতে পারবে না।
আকাশ কথাগুলো বলে চোখ মেলে তাকায়৷ এরপর কলেজ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। দৃষ্টি অনবরত এদিক-ওদিক ঘুরছে।
সন্ধ্যা কলেজ থেকে বেরিয়ে তাদের বাসার দিকে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। তার ভাইয়া এখনো কেন আসেনি? তাকে মেসেজ এর রিপ্লে-ও দেয়নি। সন্ধ্যার কান্না পায়। খালি পা, হাঁটুর নিচ পর্যন্ত চুলগুলো এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করছে, দু’হাতে ব্যাগ চেপে সন্ধ্যা দুরুদুরু বুক নিয়ে হাঁটছে। সন্ধ্যার কোনোদিকে খেয়াল নেই। ভাইয়াকে পেলেই হবে তার। হঠাৎ-ই সামনে রিহানকে দেখে সন্ধ্যা ধাক্কা খেতে গিয়ে-ও দাঁড়িয়ে যায়।
রিহান অবাক হয়ে সন্ধ্যাকে দেখছে। সন্ধ্যার খালি পা, আর খোলা মাথা দেখে রিহান কি বলবে বুঝতে পারছে না। সৌম্য তাকে বলেছে সন্ধ্যাকে নিয়ে হসপিটাল যেতে। তার বেরতে বেরতে একটু লেট হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার এই অবস্থা কেন? সবচেয়ে বড় কথা, সে সৌম্যদের বাড়িতে অনেক গিয়েছে। সন্ধ্যার মাথায় সবসময় কাপড় থাকতো, সন্ধ্যা কখনো মাথা উঁচু করে তাকিয়েছে কি-না রিহানের মনে পড়ে না। সে সন্ধ্যাকে কখনো দেখতেই পায়নি ভালো করে। অথচ আজ এতো খোলামেলাভাবে সন্ধ্যাকে দেখে কেমন হা করে চেয়ে আছে। আপনাআপনি মন বলে ওঠে,
– মেয়েটি কি সুন্দর!
রিহানের দৃষ্টি দেখে এতোক্ষণে সন্ধ্যার নিজের অবস্থা কথা মনে পড়ে। অস্বস্তি ঘিরে ধরে তাকে। রিহানের দৃষ্টিকে সে অন্যকোনো নাম দিল না। প্রায় একবছর হলো ভাইয়ের পাশে দেখে আসছে, ভাইয়ের মতোই দেখে আসছে। তাকে হঠাৎ অন্যভাবে দেখে যে কেউ এভাবে তাকাবে। সন্ধ্যা কি করবে বুঝলো না। তার হিজাব যে খুঁজে পায়নি। তারপর ভ’য় পেয়ে দিকবিদিকশুন্য হয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আশেপাশে ভীতি দৃষ্টি বুলিয়ে রিহানের দিকে তাকায় সন্ধ্যা। ডাকতে তো পারছে না। অস্বস্তি নিয়ে রিহানের হাত ধরে ঝাঁকায়। রিহান সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নিজেকে সামলে বলে,
– তোমার এই অবস্থা কেন সন্ধ্যা? জুতো, হিজাব কিছুই তো নেই।
সন্ধ্যা ফোনে লিখে কিছু বলতে চাইলো। কিন্তু কি বলবে।
রিহান আবার-ও বলে,
– তোমার ভাইয়ার কাজ আছে। তোমাকে নেওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে। এসো।
সন্ধ্যা পিছনে তাকিয়ে দেখল আকাশ এদিক-ওদিক তাকিয়ে এদিকেই আসছে। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় তাকায়। ডান হাতে ব্যাগ ধরে বা হাতে রিহানের হাত ধরে টেনে সামনের দিকে যায়। রিহান বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সে মনে হয় কারেন্ট শক খেয়েছে। জীবনে তো রিলেশনে জড়ায়নি। সৌম্য আর ইরার কাহিনী দেখেই বেচারা অর্ধেক ছ্যাঁকা খেয়ে বসে ছিল। কোনো মেয়ের দিকে তাকাবে কি!
কিন্তু আজ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বন্ধুর বোনের স্পর্শ পেয়ে তার বুকটা কেমন যেন করে উঠল। সাথে দৃষ্টিতে মুগ্ধতা কাজ করে সন্ধ্যা এতো বড় বড় চুল দেখে। সন্ধ্যা রিহানের হাত ধরে টেনে এগিয়ে যাচ্ছে। সে রিহানের থেকে দু’পা সামনে। রিহান ঢোক গিলল।
আকাশের নজরে পড়েছে সন্ধ্যাকে। কিন্তু তার দৃষ্টি ছেলেটির হাত ধরে রাখা সন্ধ্যার হাতের দিকে। এতোক্ষণ ক’ষ্ট পাচ্ছিল, আর এখন এই দৃশ্য চক্ষুগোচর হতেই রা’গে ফেটে পড়ছে যেন। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে চেয়ে আছে দু’জনের হাতের দিকে।
এই ছেলের জন্য তার সন্ধ্যামালতী তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? এমন হলে দু’টোকেই খু’ন করে ফেলবে সে। সন্ধ্যা অন্যকারো পাশে থাকার চেয়ে ম’রে গিয়ে ক’ব’রে শুয়ে থাকা-ই ভালো। সে ওই ক’ষ্ট সহ্য করে নিবে। কিন্তু তার সন্ধ্যার পাশে অন্যকাউকে এক সেকেন্ড এর জন্য সে সহ্য করবে না।
আকাশ বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায় সন্ধ্যাদের দিকে। কোনো কথা ছাড়াই সন্ধ্যার হাত ঝাড়া মে’রে সরিয়ে দেয় রিহানের থেকে। এরপর রিহানের কলার ধরে তার দিকে ফেরায়। সন্ধ্যা পিছু ফিরে আকাশকে দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায়৷ আকাশ রিহানকে দেখে বিস্ময় চোখে তাকায়। সন্ধ্যাদের পু’ড়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার আগে রিহানের সাথে আকাশের মাঝে মাঝে দেখা হলেই সে সৌম্য আর সন্ধ্যার কথা জিজ্ঞেস করত। রিহান বরাবর-ই বলত সে জানেনা। অথচ আজ সন্ধ্যার হাত ধরে হাঁটছে। এটা দেখে মাথায় আরও র’ক্ত উঠে গিয়েছে। এর মানে কি সন্ধ্যার এই ছেলের সাথে কিছু আগে থেকেই ছিল? কথাটা ভাবতেই রা’গের সাথে সাথে চোখেমুখে অসহায়ত্ব ভিড় করল। সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা ভীত সাথে ভেজা চোখে তার দিকে চেয়ে আছে।
আকাশ চোখ বুজল। সেকেন্ড না পেরোতেই রিহানকে রাস্তায় চিৎপটাং করে শুইয়ে দু’পাশে দু’পা রেখে সমানে ছেলেটিকে সমানে ঘুষি মা’র’তে থাকে। প্রচন্ড জোরে কয়েকটা ঘু’ষি খেয়ে মুহূর্তেই রিহানের নাকমুখ দিয়ে র’ক্ত বের হতে শুরু করে। আকাশের ভাবটা এমন যেন সে আজ একে মে’রে তবেই দম নিবে।
সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আকাশের মুখে মাস্ক নেই। ইতিমধ্যে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়ে গিয়েছে। আকাশকে দেখে কেউ এগোচ্ছে না। অনেকেই ভিডিও করছে। আকাশের কোনোদিকে খেয়াল নেই।
সন্ধ্যা আকাশকে ঠেকাতে চায়। নিচু হয়ে আকাশকে আটকাতে গিয়ে আকাশের দু’টো আঘাত পেয়ে মেয়েটির দমবন্ধ হওয়ার মতো ব্য’থা পায়। আকাশ সন্ধ্যাকে খেয়াল করতেই ছেলেটিকে ছেড়ে সন্ধ্যার হাত ধরে সে সহ সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে যায়। এরপর ডানহাতে সন্ধ্যার গাল চেপে চিৎকার করে বলে,
– এটা কে বল? কার সাথে ঘুরছিস বল? বল এটা কে? নয়তো আগে তোকে মা’র’ব এরপর ওকে। কি হলো বল?
সন্ধ্যা দু’হাতে আকাশের হাত ছাড়াতে চায়। মুখখানি ব্য’থায় জর্জরিত হয়। হঠাৎ-ই সন্ধ্যা দু’হাত আকাশে বুকে রেখে আকাশকে গায়ের জোরে ধাক্কা দেয়। আকাশ এক পা পিছিয়ে যায়। রে’গে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে সন্ধ্যা আকাশের ডানগালে জোরেসোরে একটি থা’প্প’ড় মে’রে দেয়।
আকাশ বিস্ময় চোখে তাকায় সন্ধ্যার দিকে।
বিস্ময় সাথে সাথে চোখেমুখে ক্রোধ জমা হয়। এই ছেলের জন্য তার সন্ধ্যামালতী তাকে থা’প্প’ড় মারলো? হ’জ’ম হলো না ঠিক। রা’গে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তাকায় সন্ধ্যার দিকে।
সন্ধ্যা ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে ইশারায় বোঝায়
– আমার থেকে দূরে থাকবেন। আমি আপনাকে একদম চাইনা।
একটু বোঝাতে গিয়ে মেয়েটির দু’চোখের পাতা ভেদ করে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে।
সন্ধ্যার কথা বুঝতে পেরে আকাশের চোখেমুখে আগের চেয়েও ক্রোধ জমা হয়। ওই ছেলের জন্য তার সন্ধ্যামালতী তাকে চাইছে না? ইচ্ছে তো করল সন্ধ্যাকে এক আছাড় মা’র’তে। কিন্তু তা না করে দু’পা এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যাকে টেনে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। সন্ধ্যার মনে হলো তার হাড়গোড় সব ভেঙে যাবে। নড়তে চাইলেও একচুল পরিমাণ-ও নড়তে পারলো না। আকাশ বা হাতে সন্ধ্যাকে দু’হাতসহ শক্ত করে ধরে রেখে ডান হাতে সন্ধ্যার গাল চেপে ধরে। সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– তুই আমাকে তো চাইবি-ই, তোর বাপ, ভাইসহ চোদ্দগুষ্টি আমাকে তোর পাশে চাইবে। তার আগে তোর মনে যেই জা’নো’য়া’র আছে। ওটাকে ধুয়েমুছে ছাফ করব।
সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে আকাশের কথাগুলো শুনে। চোখ বুজে ফুঁপিয়ে ওঠে। উত্তপ্ত স্থানে ঠান্ডা পানি পড়লে যেমন মূহুর্তেই স্থানটি শীতল হয়ে যায়, সন্ধ্যার বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি আকাশের রা’গ সেভাবেই নিভিয়ে দেয়। আকাশ সন্ধ্যার গাল ছেড়ে দেয়। ঢোক গিলে মৃদুস্বরে বলে,
– স্যরি!
সন্ধ্যা চোখ মেলে তাকায়। কান্নার ফলে দু’চোখ লাল হয়ে আছে। আকাশ দু’হাতের আঁজলায় সন্ধ্যার মুখটা নিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– সন্ধ্যামালতী তুমি অন্যকাউকে নিয়ে কেন ভাবছ? তোমার মনে অন্যকেউ নেই, একবার বলো? তুমি আমাকে ভালোবাসো। বলো সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তাকে এই নামে কেন ডাকছে আকাশ? তার নাম তো এটা নয়! হঠাৎ-ই আকাশকে দু’হাতে ধাক্কা দেয়। আকাশ দু’পা পিছিয়ে যায়। রে’গে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। এগিয়ে এসে সন্ধ্যাকে ধরতে গিয়ে চুপ করে দাঁড়ালো। সন্ধ্যা ফোনে কিছু লিখছে। সন্ধ্যা কিছুক্ষণ পর আকাশের দিকে ফোন তাক করে ধরে। আকাশ মনে মনে আওড়ায় লেখাগুলো,
– আমার মনে কেউ নেই, বুঝেছেন? আপনি তো বিবাহিত। আরেকটা বিয়ে করে নিয়েছেন। দ্বিতীয় বউকে রেখে আবার আমার কাছে আসতে চাইছেন কেন? আপনি আপনার বউয়ের কাছে যান। দু’টো বউ নিয়ে সংসার করতে চাইলে সেই ইচ্ছের কথা ভুলে যান। আমি সতীন নিয়ে সংসার করব না। এবার আমি আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিব।
লাস্ট লাইনটা পড়ে আকাশের রা’গ হলেও আগের লেখাগুলো পড়ে আকাশ অদ্ভুদ দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সে আবার কবে বিয়ে করল? কিসব ফা’ল’তু কথা বলছে মেয়েটা। আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। চোখজোড়ায় জলকণা চিকচিক করছে। আকাশ কিছু বলতে গিয়ে-ও শব্দ করে হেসে ফেলল।
প্রথমত সন্ধ্যার বলা ‘আমার মনে কেউ নেই’ কথাটায় স্বস্তি পেয়েছে।
আর দ্বিতীয়ত সন্ধ্যার বলা ‘আমি সতীন নিয়ে সংসার করব না’ লাইনটায় সে না হেসে পারলো না।
রিহান বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে ছিল। তার মাথা ঘুরছিল এতো মার খেয়ে। সময় নিয়ে নিজেকে সামলে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে লেগে থাকা র’ক্ত মুছে নেয়। সে বুঝতে পারছে না এই সভাপতি আকাশ নওয়ান তাকে এভাবে মা’র’লো কেন? যতটুকু বুঝলো সন্ধ্যার সাথে কোনো কানেকশন আছে। তার মনে আছে, সৌম্য আর সন্ধ্যা এখান থেকে যাওয়ার পর পর আকাশ তার কাছে সৌম্যদের খোঁজ নিতে আসতো। কিন্তু সে তো জানতো না।
সন্ধ্যা ঘাড় বাঁকিয়ে রিহানের দিকে তাকায়। রিহান সন্ধ্যার দিকেই তাকিয়ে ছিল। দু’জনের চোখাচোখি হয়। সন্ধ্যার খারাপ লাগলো, তার ভাইয়ের বন্ধু তার জন্য কত মা’র খেয়েছে।
আকাশ ব্যাপারটা খেয়াল করতেই তার মে’জা’জ খা’রা’প হয়। বা হাতে সন্ধ্যার মাথার পিছন বরাবর হাত রেখে সন্ধ্যার কপাল তার বুকে চেপে ধরে। সন্ধ্যার কপালসহ মুখ আকাশের বুকে এসে ঠেকেছে।
সন্ধ্যা দু’হাতে আকাশকে ঠেলে সরাতে চাইলো। কিন্তু আকাশের শ’ক্তির সাথে পারলো না। না পেরে দু’হাত উঁচু করে আকাশের গলা খামচে দেয়। আকাশ বিরক্ত হয়। কিন্তু কিছু বলল না। রিহানের দিকে রে’গে তাকিয়ে আছে। রিহান ঢোক গিলল। সন্ধ্যার সাথে লোকটি জোরজবরদস্তি করছে দেখে রিহানের রা’গ হলো। অতঃপর এগিয়ে এসে বলে,
– আপনি সন্ধ্যার সাথে এরকম করছেন কেন? ওকে ছাড়ুন। ও তো আপনাকে….
বাকিটুকু বলার আগেই আকাশ ডান হাতে রিহানের গলা চেপে ধরে। হিসহিসিয়ে বলে,
– ওর নাম উচ্চারণ করলে মে’রে পুতে ফেলব তোকে।
কথাটা বলে রিহানকে ধাক্কা দেয়। রিহান গলা ধরে কাশতে লাগলো। আকাশ আশেপাশে তাকালো। কলেজ ছুটির পর জায়গাটি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। লোকজন তেমন নেই। কয়েকজন লোক ভিডি-ও করছিল। আকাশ সকলের উদ্দেশ্যে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– একটা ভিডিও লিক হলে সবাইকে বিশেষ আপ্যায়ণ করা হবে।
আকাশের কথাটি শুনে সকলে তাদের ফোন নামিয়ে নিয়েছে। ভ’য় পেয়ে ভিডিও ডিলিট-ও করল। এসব মানুষের সাথে জড়িয়ে নিজেদের জীবন বিপদে ফেলার কী দরকার!
সন্ধ্যার অতিরক্তি নড়াচড়ায় আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে দেয়। সন্ধ্যা দাঁত কিড়মিড় করল। আকাশকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আকাশ সন্ধ্যাকে ঝট করে কোলে তুলে নেয়। সন্ধ্যা ছটফটায়। আকাশকে কিল-ঘুষি, খামচি কতকিছু দিল। আকাশ বড় বড় পা ফেলে তার গাড়ির পিছনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– বায়ান দরজা খোলো।
শিমু আর বায়ান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এতোক্ষণ তা’মা’শা দেখছিল। আকাশের আদেশ পেয়ে বায়ান দ্রুত গাড়ির দরজা খুলে দিলে আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে গাড়ির পিছনে বসল। শিমু দ্রুত ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে উঠে বসে। সে কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। আকাশ ভাইয়া এই সন্ধ্যাকে কোথা থেকে পেয়েছে, সেটাই মাথায় ঢুকছে না। যাকে গত ৫ মাস যাবৎ মৃ’ত জেনে আসলো, আজ হঠাৎ তাকে জীবিত দেখে কেমন রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারছেনা। পাশ থেকে বায়ান শিমুকে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,
– এই মেয়ে কে?
শিমু ছোট করে বলে,
– আকাশ ভাইয়ার বউ।
বায়ান পুরোটা শুনতে পায় না। শুধু শুনলো বউ। বায়ান মাথা চুলকায়। আকাশের বউ তো মা’রা গিয়েছে। তাহলে তাদের আকাশ স্যার এটা কার বউকে তুলে আনলো? কৌতূহল দমাতে না পেরে পিছু ফিরে জিজ্ঞেস করে,
– স্যার আপনি কার বউকে তুলে আনলেন?
আকাশ গাড়ির পিছনের সিটে বসে আছে। কোলে সন্ধ্যা মোচড়ামুচড়ি করছে। আকাশ দু’হাতে শক্ত করে সন্ধ্যাকে চেপে ধরে বায়ানের দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
– বউ আমার, গাড়ি আমার, পিএ আমার। এবার গাড়ি চালাও। নয়তো সব আমার ভেবে যেখানে সেখানে ভুলভাল কিছু করে ফেলতে পারি।
লাস্ট কথাটা সন্ধ্যার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল। সন্ধ্যা চোখ ফিরিয়ে নেয়। আকাশ মৃদু হাসলো।
বায়ান গাড়ি স্টার্ট দেয়। শিমু বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– আকাশ ভাইয়া সন্ধ্যাকে কোথায় পেলে?
আকাশ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– তোর ভাবি।
– হ্যাঁ ওই হলো। ভাবিকে কোথায় পেলে?
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– কলেজে।
একটু থেমে মনে মনে হেসে বলে,
– শিমু আমার ছোট বউ কে কল করে বল, আমার বড় বউকে খুঁজে পেয়েছি। বড় বউয়ের জন্য রান্না বসাতে বল।
সন্ধ্যার আকাশকে খু’ন করতে ইচ্ছে করল। একটু নড়তে-ও পারছে না। শিমু অবাক হয়ে বলে,
– তুমি আরেকটা বিয়ে কবে করেছ? আমি তো জানি না।
আকাশ আড়চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমিও জানতাম না। আজকেই জানলাম। একটা ছোটোখাটো সাংবাদিক এর থেকে খবরটা পেলাম।
সন্ধ্যা দাঁত কিড়মিড় করল। আকাশ যে তাকে উপহাস করে বলছে, সে বুঝেছে।
শিমু বোকা চোখে তাকালো। কিছু বললো না। সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল মেয়েটি নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। আকাশ এমনভাবে ধরেছে, সন্ধ্যা নিঃশ্বাস নিতে পারছে কি-না সন্দেহ! রিহানকে মা’রের সিন মনে পড়লে শিমু ঢোক গিলে চুপ করে বসে থাকলো।
ইরার মা আর ইহাব কিছুক্ষণ আগেই হসপিটালে এসে পৌঁছেছে। ইরার মামা আসেনি। ভদ্রলোক বাড়িতেই আছেন। আরামপ্রিয় মানুষ তিনি। বোন আর ছেলেকে পাঠিয়ে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন।
সৌম্য আইসিইউ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। এতোক্ষণে-ও রিহান তার বোনুকে নিয়ে আসছে না বলে টেনশন হচ্ছে। রিহানকে কল করার জন্য পকেট থেকে ফোন বের করলে নোটিফিকেশনে সন্ধ্যার মেসেজটি সবার আগে চোখে পড়ল।
– ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসো। আমার ভ’য় লাগছে।
সৌম্য ভ’য় পায়। কি হয়েছে তার বোনুর? এই মেসেজ তো অনেকক্ষণ আগের। সে ইরার পাশে ছিল, কখন নোটিফিকেশন এসেছে বুঝতে পারেনি। রিহানকে কল করতে নিলে রিহানের ডাকে সৌম্য দ্রুত মাথা তোলে। সামনে শুধু রিহানকে দেখে আশেপাশে তাকায়। সন্ধ্যাকে না দেখতে পেয়ে সৌম্য দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে রিহানের কলার ধরে বলে,
– আমার বোনু কোথায় রিহান? তোকে বলেছি আমার বোনুকে আনতে? ওকে আনিস নি কেন? ও ভ’য় পাচ্ছে।
রিহান চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– আকাশ ভাইয়ার সাথে সন্ধ্যার কিসের সম্পর্ক? আকাশ ভাইয়া সন্ধ্যাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।
সৌম্য বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– মানে?
– যা বললাম তাই।
সৌম্য চোখ বুজল। ওই আকাশসহ তার পুরো ফ্যামিলিকে তার খু’ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ইরার মায়ের বলা কথা অনুযায়ী সৌম্য ভাবে, আকাশের পুরো পরিবার প্ল্যান করে তাদের পু’ড়ি’য়ে মা’র’তে চেয়েছিল। কতগুলো প্রিয় মানুষ হারিয়েছে তারা দু’ভাইবোন। কি করে ভুলবে তাদের? আজ যদি তার বোনুর কিছু হয়, সে নিজ হাতে ওই আকাশের পুরো পরিবারকে কু’র’বা’নি করবে।
সৌম্য গম্ভীর গলায় বলে,
– বাইকের চাবি দে।
রিহান পকেট থেকে তার বাইকের চাবি বের করে দিলে সৌম্য বড় বড় পা ফেলে হসপিটালের করিডর থেকে বেরিয়ে যায়। পিছন পিছন রিহান এগিয়ে গিয়ে বলে,
– হেলমেট নিয়ে যা।
সৌম্য দু’হাতে বাইকের সামনে রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– লাগবে না।
রা’গে তার শরীর কাঁপছে। সাথে তার বোনুর জন্য ভ’য়-ও লাগছে। ঠিক আছে তো তার বোনু?
ভাবনা নিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চোখের পলকে জায়গাটি প্রস্থান করে।
বায়ান গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে দিলে আকাশ সন্ধ্যার ব্যাগ সিটের উপর রেখে সন্ধ্যাকে কোলে নিয়েই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা একটুখানি ছাড়া পেয়ে আবার-ও ছটফটায়। দু’হাতে আকাশের গলা গায়ের জোরে খামচে ধরে। আকাশ দাঁতে দাঁত চেপে দ্রুতপায়ে তার বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খোলা ছিল বিধায় আকাশ বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে।
ঘরে গিয়ে সন্ধ্যাকে তার বিছানায় বসিয়ে ঘরের দরজা আটকে দেয়। সন্ধ্যা ছাড়া পেয়ে দ্রুত বিছানার উপর থেকে নেমে এগিয়ে আসে দরজার দিকে। আকাশ দরজা আটকে পিছু ফিরলে সন্ধ্যাকে এগিয়ে আসতে দেখে আকাশ সন্ধ্যাকে ঠেলে ঠাস করে বিছানার উপর ফেলে দেয়। রে’গে বলে,
– প্রবলেম টা কি তোমার? দু’মিনিট চুপ করে থাকতে পারছো না?
সন্ধ্যা বিছানার উপর থেকে উঠে দু’হাতে আকাশকে ধাক্কা দিয়ে দরজার দিকে যেতে নিলে আকাশ সন্ধ্যাকে বিছানার উপর বসিয়ে, সে-ও সন্ধ্যার পাশে বসে বা হাতে শক্ত করে সন্ধ্যাকে চেপে ধরে রে’গে বলে,
– এতো শক্তি, জেদ কোথা থেকে আমদানি করেছ হ্যাঁ? একঘণ্টা-ও হয়নি। মাথাটা পুরে ন’ষ্ট করে দিলে!
সন্ধ্যা আকাশকে ঠেলে সরাতে চাইল। সে তার ভাইয়ের কাছে যাবে। আকাশকে তার অসুস্থ মানব লাগছে।
আকাশ না পেরে চরম বিরক্ত হয়ে আশেপাশে কিছু খুঁজল। বিছানার উপর তার কয়েকটা সাদা পাঞ্জাবি ওগোছালো পেয়ে ডান হাতে বাড়িয়ে টেনে নেয়। এরপর একটি পাঞ্জাবি দিয়ে সন্ধ্যার দু’পা বাঁধলে। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। রে’গে আকাশের গাল খামচে ধরে। আকাশ চোখমুখ কুঁচকে নেয়। এই বউয়ের হাতে মার খেতে খেতেই মনে হচ্ছে আজ তাকে শহীদ হতে হবে!
আকাশ সন্ধ্যার দু’হাত পিছনে একসাথে করে আরেকটি পাঞ্জাবি দিয়ে বেঁধে দেয়। এরপর উঠে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা নড়াচড়া করতে চায়, কিন্তু পারে না। আকাশের দিকে রে’গে তাকায়। আকাশ মৃদু হেসে বলে,
– তোমাকে এভাবেই মানাচ্ছে। পাঁচমিনিট শান্ত হয়ে থাকো। আমি শাওয়ার নিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করে এসে তোমার সাথে বোঝাপড়া করছি।
কথাটা বলে আকাশ ওয়াশরুমে চলে যায়। সন্ধ্যা ভ’স্ম করে দেয়া চোখে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। কত বড় খা’রা’প লোক! তাকে বেঁধে রেখে গেল! সন্ধ্যার কান্না পাচ্ছে। তার সৌম্য ভাইয়া নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে অনেক টেনশন করছে।
সন্ধ্যা মোচড়ামুচড়ি করে হাত-পায়ের বাঁধন খুলতে চায়। অনেকটা সময় নিয়ে চেষ্টা করতে করতে একপর্যায়ে হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসলে সন্ধ্যা দু’হাত বাঁধন থেকে উম্মুক্ত করে, দু’হাতে পায়ের বাঁধন খুলে ফেলে।
এরপর দ্রুত বেড থেকে নেমে দু’পা এগোতেই আকাশ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যার লম্বা চুলের একগোছা পিছন থেকে টেনে ধরে। সন্ধ্যা ব্য’থা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে নেয়। বা হাত মাথার পিছনে দেয়।
আকাশ চুল ধরে জোরে টান দিয়ে সন্ধ্যাকে ঘুরিয়ে তার বুকে এনে ফেলল। ব্য’থায় সন্ধ্যার চোখের কোণে পানি জমেছে। আকাশ রে’গে ধমকে বলে,
– কি প্রবলেম তোমার? সেই তখন থেকে শুধু পালাই পালাই করছ। মা’র খাবে?
সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে ওঠে। আকাশ অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। ডান হাত সন্ধ্যার গালে রেখে নরম গলায় বলে,
– কি হয়েছে তোমার? দু’মিনিট শান্ত হও। আমি তোমার সব কথা শুনব সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যা ভেজা চোখে আকাশের দিকে তাকায়। তখন-ই নিচ থেকে সৌম্য’র গলা ভেসে আসে। সন্ধ্যা ভাইয়ের গলা পেয়ে আবার-ও আকাশের থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফটায়। আকাশ সৌম্য’র ডাক শুনল। সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলে,
– বুঝেছি, তোমার ভাই তোমাকে লুকিয়ে রেখেছিল। কোথাও যাবে না তুমি। তোমার ভাইয়ের সাথে আসল বোঝাপড়া করে আসছি।
কথাটা বলে সন্ধ্যাকে ছেড়ে দিলে সন্ধ্যা রা’গে কাঁপতে কাঁপতে দু’হাতে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে আকাশের বুকে, পেটে খামচে ধরে। আকাশ চোখমুখ কুঁচকে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। দ্রুত সন্ধ্যার দু’হাত ধরে উল্টেপাল্টে বলে,
– তোমার ভাই তোমায় খাইয়ে আর নখ বড় করে পুরো রা’ক্ষ’সী বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, দেখছি।
একটু থেমে বলে,
– তোমার ভাইয়ের সাথে বোঝাপড়া করে এসে তোমাকে মানুষ বানাচ্ছি, ওয়েট।
কথাটা বলে সন্ধ্যাকে ছেড়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়। সন্ধ্যা দরজায় থা’প্প’ড় দেয়। আকাশ এরকম করছে কেন তার সাথে? তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
আকাশ বাইরে থেকে দরজা লক করে দিয়ে এগিয়ে যায়। পরনে একটি সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। উদাম শরীর। গাল, গলা, বুক, পেট সব জ্বলছে আকাশের। খামচে পুরো যা তা করে দিয়েছে। তবে কিছু একটা ভেবে বাঁকা হাসলো।
এরপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– কি হয়েছে? তোমার বোনু ভালো আছে।
এরপর আসমানী নওয়ানের দিকে চেয়ে বলে,
– মা আমার শা’লাকে সুন্দর করে আপ্যায়ণ কর। রান্না বসিয়েছ?
সৌম্য আকাশকে দেখে রে’গে তাকায়৷
আসমানী নওয়ান বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শিমু তাকে গিয়ে বলল, আকাশ কোথা থেকে যেন সন্ধ্যাকে ধরে এনেছে। সে তো বিশ্বাস-ই করছিল না। এর মধ্যে সৌম্য দরজায় কড়া নাড়লে আসমানী নওয়ান সৌম্যকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। যাদের এতোদিন মৃ’ত জেনে আসলো৷ হুট করে সামনে আসায় কেমন রিয়েকশন দিবে, সেটাই বুঝতে পারছেন না তিনি।
সৌম্য আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আমি এখানে খেতে আসিনি। আমার বোনু কোথায়? ওর সাথে কি করেছেন আপনি?
আকাশ দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে একটু হেসে বলে,
– তুমি আমার বউকে এতোমাস তার স্বামীর আদর থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিলে। সেটাই পূরণ করছিলাম। তুমি এসে ডিস্টার্ব করলে।
অন্তঃদহন পর্ব ২৩
আকাশের কথায় সৌম্য বিব্রতবোধ করে। তার দৃষ্টি আকাশের গালে, গলায়, বডিতে আটকায়। আকাশ ধবধবে ফর্সা হওয়ায় প্রতিটি নখের আঁচড় জ্বলজ্বল করছে। সৌম্য আকাশের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালে দেখল আকাশ তার দিকে চেয়ে বাঁকা হাসছে।