অন্তঃদহন পর্ব ২৭
DRM Shohag
অরুণ তার একটি কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিল। বায়ান এর কাছে সৌম্য-সন্ধ্যার খবর শুনে দ্রুত চলে এসেছে। আসমানী নওয়ান এর কথাগুলো-ও মন দিয়ে শুনেছে। আকাশের রিয়েকশন দেখে সে কথা আর কি বলবে, সেই তখন থেকে মুখ চেপে হাসছে। আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকায় আকাশের বলা জ’ঘ’ণ্য ফিলিংস শব্দটি তার কানে গিয়েছে। এবার না পেরে শব্দ করে হেসে দেয়। সবাই অরুণের দিকে অদ্ভুদভাবে তাকায়। অরুণ ডান হাতে পেট চেপে হাসতে হাসতে বা হাত উঁচু করে সবার উদ্দেশ্যে বলে,
– স্যরি গাইস! বাট প্লিজ আমাকে কেউ হাসতে নিষেধ কর না। আমি একটু পরেই তোমাদের সাথে শোক পালন করব।
অরুণের কথা শুনে সবাই না চাইতে-ও হেসে ফেলল। এতোক্ষণের নিস্তব্ধতার মাঝে অরুণের কথাটুকু সবার কাছে বিনোদন হিসেবে কাজ করল। অাকাশ বিরক্ত চোখে চেয়ে আছে অরুণের দিকে। সে খুব ভালোই বুঝেছে এই বে’য়া’দ’ব তার দুর্দিনে মজা লুটছে। অরুণ বহুক’ষ্টে নিজেকে সামলে আকাশের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
– বাতাস বাবু তোর কিন্তু তিনটে বোন। তিন নম্বর বোনের নাম সন্ধ্যা! নামটি কি কিউট! ওয়াও!
সাথে সাথে আকাশ উঠে দাঁড়ায়। অরুণের কলার ধরে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– আমার কোনো বোন নেই। সব বোন বয়কট। একটা আমার বউ, মানে বউ। আর দু’টো আজ থেকে আমার নানি।
কথাটা বলে অরুণের কলার ছেড়ে আকাশ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অরুণ মিটমিটিয়ে হাসছে। শেষমেশ নানি! বিড়বিড়িয়ে বলে,
– ডাক টা সেই রে!
আকাশ রে’গে তাকায়। অরুণ পাত্তা দিল না।
সকলে অরুণ আর আকাশের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। তাদের কথা কেউ শুনতে পায়নি, তাই বুঝতেও পারছে না। আকাশের এতো রা’গ লাগছে নিজের উপর! নিজেই নিজেকে সমানে থা’প’ড়া’তে পারলে মনে হয় রা’গ টা কমতো।
সৌম্য চোখ ছোট ছোট করে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে না ঠিক। একজন হাসছে, একজন রা’গ’ছে। ব্যাপার কি?
আকাশ মাথা নিচু করে দু’বার শ্বাস ফেলল। এরপর মাথা উঁচু করে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা তার দিকেই চেয়ে আছে। দু’জনের চোখে চোখ পড়ে। সন্ধ্যা এবার চোখ নামালো না। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশের চোখেমুখে রা’গ। সন্ধ্যার হয়তো বুঝল। কিন্তু রা’গের কারণ বুঝতে পারছে না।
অরুণ এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার সামনে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– হাই সন্ধ্যা! তুমি বেঁচে আছো জেনে আমি ভীষণ সারপ্রাইজড্ হয়ে গিয়েছি।
সন্ধ্যা অরুণের দিকে তাকালো। তার মনে আছে অরুণের কথা। দেখতে একদম বিদেশি। কিন্তু কথাবার্তা বাংলাদেশিদের মতো। অরুণের বাড়িয়ে রাখা হাতের দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা বিব্রতবোধ করে। দৃষ্টি ফিরিয়ে আবার-ও আকাশের দিকে তাকালে দেখল আকাশ এখন-ও সেই একইভাবে তার দিকে চেয়ে আছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। সে কি কিছু করেছে? আকাশ তার দিকে খেয়ে ফেলা চোখে চেয়ে আছে কেন?
হঠাৎ আকাশকে বড় বড় পা ফেলে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সন্ধ্যা দ্রুত এক পা পিছিয়ে যায়। কিন্তু আকাশ সন্ধ্যাকে কিছু করল না, কিছু বলল-ও না।
পিছন থেকে ডান হাতে অরুণের কলার ধরে টেনে তার পাশে এনে দাঁড় করায়। এরপর অরুণের কাঁধের উপর ডান হাত রেখে সন্ধ্যার দিকে কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– মা অরুণের একটি অপারেশন হবে, দোয়া করে দাও তো।
আকাশের কথা শুনে অরুণ চোখ বড় বড় করে তাকায়। তার অপারেশ? কি অপারেশন? তার মতো সুস্থ মানুষের কি অপারেশন করতে চায় এই আকাশ বাতাস? আসমানী নওয়ান অবাক হয়ে বলে,
– কিসের অপারেশন অরুণ?
অরুণ আকাশের দিকে রে’গে তাকায়। আকাশের দৃষ্টি সন্ধ্যার পানে। মনে হচ্ছে দু’চোখ দিয়ে সন্ধ্যাকে চিবিয়ে খাচ্ছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। সন্ধ্যার মনে হচ্ছে আকাশ নিজের দু’চোখ দিয়ে তাকেই অপারেশন করছে এখন। সন্ধ্যা চোখ নামিয়ে নিল। আকাশ এভাবে তাকাচ্ছে কেন? ভ’য় পাচ্ছে সন্ধ্যা। সামনে তাকালে সৌম্যকে দেখে সন্ধ্যার ভ’য় একটুখানি কমলো। মাথা নিচু করে আকাশ আর অরুণের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আকাশ দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে,
– বে’য়া’দ’ব মেয়ে।
একদম আকাশের পাশ দিয়ে যাওয়ায় কথাটি সন্ধ্যার কানে গিয়ে বাড়ি লাগে। মেয়েটি কেঁপে ওঠে। যেন আকাশ তাকে ধাক্কা দিয়েছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় সৌম্য’র পাশে। সৌম্য সন্ধ্যাকে দেখে তার পাশে চেয়ার টেনে নিয়ে সন্ধ্যাকে বসতে বললে সন্ধ্যা চুপ করে বসল ভাইয়ের পাশে। সৌম্য মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,
– খারাপ লাগছে বোনু?
সন্ধ্যা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। এরপর সন্ধ্যা নিচু মাথা খানিকটা উঁচু করলে আকাশের সেই দৃষ্টি দেখে মেয়েটির কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কি করেছে সে? আকাশ এভাবে তাকাচ্ছে কেন তার দিকে?
আকাশ ঘাড় বাঁকিয়ে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। একে তো বোনের ডোজটাই সামলাতে পারছে না। তার উপর সন্ধ্যার যাচ্ছেতাই অবস্থা। অর্থাৎ সন্ধ্যার গায়ে এখনো কলেজ ড্রেস। মাথায় হিজাব নেই। ওড়নার অবস্থা-ও বেহাল। যদিও ওড়না ঠিক-ই আছে। কিন্তু আকাশের কাছে ভালো লাগছে না। এতোক্ষণ এখানে কোনো ছেলে মানুষ ছিল না, সৌম্য ছাড়া। তাই আকাশ এটা ভাবেনি। কিন্তু যখন দেখল অরুণ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়েছে, ওমনি মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছে। সৌম্য, সন্ধ্যা দুইভাইবোনকে দু’টো ঠাস ঠাস করে থা’প্প’ড় মা’র’তে ইচ্ছে করল তার। এক ভাই কিপ্টা, এজন্য একটা হিজাব কিনে দিতে পারেনি, আর বোন তো দরদী হয়ে বসে আছে। ভাইয়ের টাকা খরচ হবে বলে হিজাব কিনে না।
আসমানী নওয়ান আকাশকে ঝাঁকিয়ে বলে,
– কথা কইতাছ না ক্যান?
আকাশ ঘাড় ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। ছোট করে বলে,
– পরে বলছি, দাঁড়াও।
এরপর অরুণকে ছেড়ে আকাশ সন্ধ্যা আর সৌম্য’র সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার মাথা নিচু। দু’হাতে দু’হাত কচলায়। সন্ধ্যা ভাবছে, সে কি অপরাধ করেছে। মুখে থুতু দেয়ার জন্য এরকম করছে না তো! কিন্তু ইরা আপুর রুমে যে ভালো করে কথা বললো। সন্ধ্যার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। দৃষ্টি আকাশের দু’পায়ে ব্রাউন কালার জুতোর দিকে। জুতোজোড়া সন্ধ্যার পছন্দ হয়েছে। সাদা পাঞ্জাবি-সাদা প্যান্ট এর সাথে মানিয়েছে বেশ।
হঠাৎ আকাশের গমগমে কণ্ঠ শুনতে পেয়ে সন্ধ্যার ধ্যান ভাঙে। ঝাঁকি দিয়ে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়।
সৌম্য ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আকাশ ডান হাতের নেমে আসা পাঞ্জাবির হাতা উপরদিকে তুলতে তুলতে শ’ক্ত কণ্ঠে বলে,
– কিপ্টা ভাইয়ের দরদী বোন। দু’ভাইবোনের এসব ফা’ল’তু হ্যাবিট যাস্ট দু’দিনে ছুটাবো। মাইন্ড ইট।
কথাটা বলে আর এখানে দাঁড়ালো না আকাশ। উল্টো ঘুরে অরুণের কলার ধরে টেনে হনহন করে কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়। আসমানী নওয়ান পিছু ডাকলে আকাশ বলে,
– ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে মা।
সন্ধ্যা, সৌম্য দু’জনেই বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আকাশের কথার আগা-ও বুঝলো না, মাথা-ও বুঝলো না। আগের কথাগুলো আকাশ আস্তে বললেও এই কথাটি জোরে বলেছে, যার ফলে সবাই শুনতে পেয়েছে। কেউই আকাশের কথার মানে বুঝল না, শুধু বুঝল আকাশ রে’গে আছে। শিমু সবার দিকে চেয়ে হেসে বলে ওঠে,
– আকাশ ভাইয়ার কাহিনী আমি বুঝেছি। আসলে আকাশ ভাইয়া,, সৌম্য স্যার আর সন্ধ্যাকে নিজের ছোট-ভাই বোন রূপে পেয়ে একটু শাসন করছে আর-কী! আমি একাই এতোদিন আকাশ ভাইয়ার ছোট বোন হয়ে শুধু শাসিত হয়েছি। আজকে আরও দু’জন ভাই-বোন পেয়ে আকাশ ভাইয়া কন্ট্রোল করতে না পেরে সন্ধ্যা আর সৌম্য স্যারকে শাসন করে দিয়েছে। সবাই বুঝেছ?
শিমুর কথা শুনে সবাই শব্দ করে হেসে ফেলে। শিমুর নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলার ধরনে সন্ধ্যা-ও না হেসে পারলো না। কিন্তু সৌম্য হাসলো না। বিরক্ত চোখে শিমুর দিকে চেয়ে রইল। এই মেয়ে একটু-ও বদলায়নি। যত ধরনের ফা’ল’তু কথা, এই মেয়ের কাছে পাওয়া যায়।
হাতের ফোন বেজে উঠলে সৌম্য কল রিসিভ করে। রিহান কল করেছে। সৌম্য হসপিটালে পৌঁছেই রিহানকে মার্কেটে পাঠিয়েছিল, সন্ধ্যার জন্য কিছু হিজাব কিনে আনতে। এতোক্ষণে-ও না আসায় সৌম্য রিহানকে কল করলে, রিহান কল কেটে এখন ব্যাক করেছে। সৌম্য কল রিসিভ করে রে’গে বলে,
– কয়’শ ঘণ্টা লাগিয়ে একটা হিজাব কিনবি তুই? লাগবে না আর। কিনে থাকলে নিজেই বেঁধে বসে থাক, নয়তো ওটা খেয়ে তুই তোর পেট ভরা।
বলেই কল কেটে দিল। আকাশের রা’গ রিহানের উপর ঝেড়ে দিল। ওপাশে বেচারা রিহান জ্যামে বসে হাওয়া খাওয়ার মাঝে সৌম্য’র ঝাড়ি-ও খেল।
এদিকে সৌম্য’র দিকে সবাই অদ্ভুদভাবে চেয়ে আছে। সৌম্য বিষয়টি খেয়াল করতেই বিব্রতবোধ করল। উঠে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে আসছি।
কথাটা বলে দ্রুত বেরিয়ে যায়। সৌম্য বেরিয়ে যেতেই শিমু ফিক করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে বলে,
– সন্ধ্যা তোমার ভাইয়া কাকে হিজাব খেয়ে পেট ভরাতে বলল। বেচারা যদি সৌম্য স্যারের ভক্ত হয়ে সত্যি সত্যি হিজাব কেটে খেয়ে ফেলে। তখন কি হবে?
শিমুর কথায় সন্ধ্যা একটু হাসলো। শিমুকে দেখে তার সোহার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কেউ একটু হাসলেই তার সোহার কথা মনে পড়ে যায়।
শিমুর মা শিমুর কান টেনে বলে,
– সন্ধ্যাকে নাম ধরিস কেন? ও তোর ভাবি হয়।
শিমু মুখ কুঁচকে বলে,
– আচ্ছা আচ্ছা ভাবি-ই বলব। কান ছাড়ো তো মা।
শিমুর কথায় আবার-ও সবাই হাসলো। ইরার মা, আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার দিকে তাকায়। আকাশের জন্য তাকে ভাবি ডাকতে বলছে ভেবে, সন্ধ্যার অদ্ভুদ লাগলো।
আকাশ অরুণকে টেনে নিয়াজের রুমে এনেছে। নিয়াজ রোগী দেখা শেষ করে মাত্র চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছে। এমন সময়, আকাশকে হুড়মুড়িয়ে তার রুমে ঢুকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সাথে অরুণ-ও আছে। আকাশ অরুণের কলার ধরে সরাসরি নিয়াজের সামনে দাঁড়ায়। অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,
– বা’ল। কলার ছাড় তো!
আকাশ শুনলো না। নিয়াজের উদ্দেশ্যে বলে,
– নিয়াজ! অপারেশন থিয়েটারে চলো। সব রেডি কর। ইমারজেন্সি অপারেশন করাতে হবে।
নিয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কার?
আকাশের কাটকাট জবাব,
– অরুণের।
অরুণ চেঁচিয়ে ওঠে,
– কিহহ! কিসের অপারেশন আমার। ছাড় বেদ্দপ!
নিয়াজ অবাক হলো না। এদের কারবার দেখেই বুঝেছে, নিশ্চয়ই অরুণ ভুলভাল কিছু করেছে। আর আকাশ এর শাস্তি দিতে এখানে এনেছে। তাই বলে অপারেশন করিয়ে শাস্তি! বিড়বিড় করল
– যেমন কর্ম তেমন ফল। যেমন বন্ধু বানিয়েছে, তেমন শাস্তি ভোগ করুক। তার কী! সে তো আর আকাশের বন্ধু নয়!
অতঃপর গলা ঝেড়ে বলে,
– কি অপারেশন করতে হবে?
আকাশ সাথে সাথে বলে,
– ওর ডান হাত কা’ট’তে হবে। আর চোখ দু’টো তুলে নিতে হবে।
নিয়াজ কেশে ওঠে। অরুণ চোখ বড় বড় করে তাকায়। হতভম্ব হয়ে বলে,
– ইন্না-লিল্লাহ! কেউ আমাকে বাঁচাও এই আধ-পা’গ’লের থেকে।
নিয়াজ এক ঢোক পানি খেয়ে বলে,
– আসলেই?
আকাশ রে’গে বলে,
– তো তোমার সাথে কি আমি নকলেই কথা বলছি?
নিয়াজ থতমত খেয়ে তাকায়। অরুণ আকাশের দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– এই তোর কি একটু-ও মায়া নেই? আমার মতো এতো সুদর্শন পুরুষের চোখ তুলে নিতে চাস?
আকাশ কিছু একটা ভেবে বলে,
– নিয়াজ অরুণের সুদর্শন চেহারা কু’দর্শন বানাতে হবে। এটা-ও অ্যাড কর।
অরুণ মাথায় হাত দেয়। রে’গে বলে,
– তোর প্রবলেম কি? একদম এসব উল্টাপাল্টা কাজ করার কথা ভাববি না।
আকাশ রাগান্বিত স্বরে বলে,
– তোর নজর ভালো না। এসব চোখ থাকা অন্যের বউদের জন্য রিস্ক!
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। ওহ! এইবার বুঝল। সে সন্ধ্যার সাথে কথা বলতে গিয়েছিল বলে এর পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলছে। তাই বলে তার চোখ তুলে নিবে? তার সাধের হাতটা-ও কা’টতে বলছে। কি বে’য়া’দ’ব ভাবা যায়? সে কত ইয়াম্মি ইয়াম্মি খাবার খায় এই হাত দিয়ে! তা কি কেউ কখনো ভেবেছে! অরুণের মুখটা দুঃখে ভরে গেল। অতঃপর বলে,
– ছাড় রে বাবা! তোর বউয়ের ধারের কাছে-ও যাবো না। আচ্ছা নে, তোর বউ যে বাড়ি থাকবে সে বাড়িতে-ও থাকবো না।
আকাশের কড়া দৃষ্টি দেখে মেকি হেসে বলে,
– তাও হবে না? আচ্ছা যা, তোর বউ যে শহরে থাকবে সেই শহর-ই ছেড়ে দিব।
আকাশের দৃষ্টির নড়চড় নেই। অরুণ অসহায় কণ্ঠে বলে,
– ওরে আল্লাহ! এই দেশ-ই ছেড়ে দিব যা। নিজের বাড়ি চলে যাচ্ছি আমি। তুই আর তোর বউ শান্তি করে বাংলাদেশে থাক। এবার ছাড় বাপ।
আকাশ সাথে সাথে অরুণের কলার ছেড়ে ফোনে কিছুক্ষণ টাইপ করে বলে,
– টিকিট বুক করে দিয়েছি। কাল ভোরে টিকিট। লাগেজ গুছিয়ে নে।
অরুণ চোখ বড় বড় করে তাকায়। মানে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে! এমন বে’য়া’দ’ব বন্ধু কোথায় পাওয়া যায়! আকাশ অরুণের দিকে চেয়ে বলে,
– টিকিট ক্যান্সেল করলে চোখ দু’টো দান করতে হবে। আমি দৃষ্টিশক্তিহীন ব্যক্তির সাথে কন্টাক্ট করেছি। কোনটা চুজ করবি? চোখ দু’টো দান করলে অবশ্য সাওয়াব কামাই হবে। জীবনে কম তো পা’প করলি না!
অরুণ দাঁত কিড়মিড় করে, ডান হাতে আকাশের গাল টেনে বলে,
– ওমাগো, আমাল বাতাস বাবু তো নয়, এ যেন সাক্ষাৎ ফেলেস্তা বাবু!
আকাশ বিরক্ত হয়ে অরুণের হাত ঝাড়া মে’রে সরিয়ে দেয়। নিয়াজ মুখে হাত দিয়ে হাসছে। অরুণ দ্রুতপায়ে নিয়াজের রুম থেকে বেরিয়ে যায়। যেন সে সত্যি-ই লাগেজ গোছাতে যাচ্ছে। আকাশ নিয়াজের সামনে চেয়ার টেনে বসে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– ইরা কবে সুস্থ হবে, জানো কি?
নিয়াজ বলে,
– ইরার চিকিৎসা আমাদের বড় স্যারের আন্ডারে হচ্ছে। তবে এই পেসেন্টকে এর আগে আনলে সে কখনো কোনো রেসপন্স করেনি। কোনো ইমপ্রুভমেন্ট জানা যায়নি। কিন্তু এইবার খুব সামান্য ইম্প্রুভ লক্ষ্য করেছে ডক্টর। কিছুক্ষণ আগেই আমার কথা হয়েছে উনার সাথে।
আকাশ চুপচাপ কথাগুলো শুনলো। ছোট করে বলে,
– ওকে সুস্থ কর।
এরপর নিয়াজের রুম থেকে বেরিয়ে যায় আকাশ।
রিহান মাত্র হসপিটালে প্রবেশ করেছে। হাতে একটি ব্যাগ। যেখানে সন্ধ্যার জন্য বেশ কয়েকটি হিজাবি ওড়না আছে। রিহান হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আকাশকে দেখে তার পা থেমে যায়। আকাশের শক্ত দৃষ্টি রিহানের উপর। ডান হাত একটু উঁচু করে একবার ঝাড়া দিল। যেন রিহানকে মা’রার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রিহান ঢোক গিলল। এগোনো তো দূর, আকাশের ওমন ভ’স্ম করে দেয়া দৃষ্টি দেখেই রিহানের হাঁটু কাঁপছে। বিকালের খাওয়া মারেই তার গায়ের ব্য’থা সারলো না। বেচারা আবার মা’র খাবে? যেভাবে তাকিয়ে আছে, কি করবে আল্লাহ জানে আর আকাশ জানে। একে তো আকাশ তার ভার্সিটির বড় ভাই, সাথে আবার সভাপতি! রিহান ঢোক গিলল। দ্রুত উল্টো ঘুরে পা চালায়। আর মা’র খেতে পারবে না বাবা। আকাশের হাতের মা’র খাওয়ার চেয়ে সৌম্য’র হাজারটা ধমক খাওয়া ভালো।
আকাশ পায়ের গতি বাড়ায়। চোয়াল শক্ত। এই ছেলে যে এখানে সন্ধ্যার জন্যই এসেছে, খুব ভালো করেই সে বুঝেছে। আজ যদি রিহানকে ধরতে পারে, তবে এই হসপিটালেই এর সার্জারি সে নিজ হাতে করবে। যে সার্জারিতে মানুষ জ’ঘ’ণ্য ভাবে শুধু ম’রে যায়।
হঠাৎ পিছন থেকে আসমানী নওয়ানের একটি কথায় থেমে যায় আকাশের পা।
– আব্বা জান্নাত দুপুর থেইকা কিছু খায়নাই। ওর জন্য কিছু আনো তো!
আকাশ একবার সামনে তাকালো। রিহানকে দেখল না। তাতে তার উপর বিশেষ প্রভাব পড়লো না। সন্ধ্যার না খেয়ে থাকার ব্যাপারটি তার উপর বেশি প্রভাব ফেলল। সৌম্য’কে তো আর নেয়া যাচ্ছে না। এ কি আসলেই কিপ্টা? তার বউকে এতোক্ষণ না খাইয়ে রেখেছে! বিড়বিড় করল,
– বে’য়া’দ’ব শা’লা!
এরপর উল্টো ঘুরে দ্রুত পায়ে মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটু আগে চোখেমুখে যে কাঠিন্য ভাব ছিল, তা মুহূর্তেই মুছে যায়। দু’হাতে মায়ের হাত আগলে নিয়ে আবদার করে,
– সন্ধ্যামালতীকে আমার সাথে ৩০ মিনিট থাকতে দিবে মা?
আসমানী নওয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– ও তোমারে ভ’য় পায়। ওরে স্বাভাবিক হতে একটু সময় দাও।
আকাশ অসহায় কণ্ঠে বলে,
– ওর থেকে দূরে থাকবো,
একটু থেমে মেকি হেসে বলে,
– মানে কিছু করব না। করলে-ও কি! আমার-ই তো বউ!
আসমানী নওয়ান বলেন,
– আমি তোমার মা।
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– এজন্যই তো বলছি, তোমার বউমা আর আমাকে একটু স্পেস দাও। আমি আমার বউকে না ধরতেই তোমার গায়ে ফোসকা পড়ে যায়। কিছু করব না নাও। তবুও আমার বউটাকে একটু দেখতে দাও।
আসমানী নওয়ান বলেন,
– আসার পর থেকে তো দেখতাছ-ই। ও তো বোরখা পইরা নাই।
আকাশ হতাশ হলো। রা’গ লাগছে তার। ইচ্ছে করছে সন্ধ্যাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার ঘরে বেঁধে রাখতে। এতো ধৈর্য কোন জন্মে হলো তার! ধৈর্য নেই বলেই সন্ধ্যার সাথে এতো জোর করেছে। কিন্তু তার এরকম আচরণের জন্য সবকিছু কেমন ঘেটে গিয়েছে। প্রথম থেকে সন্ধ্যাকে একটু অন্যভাবে ট্রিট করলে হয়তো এমন হতো না। আকাশ চোখ বুজল। নিজেকে শান্ত করতে চাইছে। একটু পর চোখ মেলে মৃদুস্বরে বলে,
– মা প্লিজ! সত্যি কিছু করব না। তুমি সন্ধ্যামালতীকে ১০২ নম্বর রুমে রেখে এসো। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
আসমানী নওয়ান চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– আমি তো তোমারে একটা কেবিন নিতে কইছিলাম। আরেকটা নিছ ক্যান?
আকাশের ঠাস করে বলতে ইচ্ছে করল, – আমার বউ নিয়ে থাকবো, তাই।
কিন্তু বলল না। এটা বললে তার মা সন্ধ্যাকে দিবে না। তখন তাকে আবার বসে বসে আঙুল চুষতে হবে।
বিড়বিড় করল, – কুল কুল।
এরপর কথা ঘুরিয়ে বলে,
– ও কি খেতে পছন্দ করে?
আসমানী নওয়ান উল্টো ঘুরে কেবিনের ভেতর যেতে যেতে বলে,
– গরুর মাংস দিয়ে ভাত আইনো।
আকাশ ক্যান্টিনের দিকে চলে যায়।
সৌম্য ইরার পাশে বসে আছে। মুখটা মলিন। দৃষ্টি ইরার মুখে। কবে তার ইরাবতী চোখ মেলবে? কত অপেক্ষা করতে হবে? তার যে অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করেনা। তার ভীষণ ইচ্ছে করে, তার ইরাবতী উঠে বসুক। তার দিকে তাকাক। তার সামনে অভিযোগের মেলা ছড়িয়ে দিক, অভিমানের ঝুড়ি নিয়ে বসুক। সে সব মেনে নিবে। কিন্তু এমন নির্জীব ইরাবতীকে দেখতে তার খুব ক’ষ্ট হয়। ডান হাতের মাঝে ইরার বা হাতটি ধরে রাখা। বিড়বিড় করে,
– ইরাবতী?
আসমানী নওয়ান সৌম্য’র পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সৌম্য’কে এক ধ্যানে ইরার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখছে অনেকক্ষণ থেকে। ডান হাত সৌম্য’র কাঁধে রাখলে সৌম্য দ্রুত মাথা উঁচু করে তাকায়। নিজেকে সামলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। সৌম্য’র অস্বস্তি লাগছে। সে না জেনে এনার সাথে অনেক বা’জে ব্যবহার করে ফেলেছে। সৌম্য মাথা নিচু করে অনুতপ্ত স্বরে বলে,
– আন্টি আমি স্যরি!
আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– আমি তোমার আন্টি হই আব্বা?
আব্বা ডান শুনে সৌম্য কেমন স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার মা এভাবে তাকে ডাকতো! চোখ তুলে আসমানী নওয়ান এর দিকে তাকায়। ভদ্রমহিলা সৌম্য’র গালে হাত রেখে বলে,
– আমি তোমার খালাম্মা হই। আমারে হয় খালাম্মা কইয়া ডাকবা, নয়তো আকাশের মতো শুধু মা কইয়া ডাকবা। পারবানা আব্বা?
সৌম্য ঢোক গিলল। ঠিক কত বছর আগে এভাবে মায়ের আদরমাখা একটি শব্দ শুনেছিল, তার মনে পড়ে না। সে ভীষণ আবেগী হয়ে যাচ্ছে। ঝাপসা চোখজোড়া এদিক-ওদিক করে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইলো। এরপর আসমানী নওয়ানের দিকে চেয়ে বলে,
– আমি কি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি?
আসমানী নওয়ানের চোখজোড়া ভিজে যায়। কোনো ছেলে যদি এতো অসহায় কণ্ঠে মায়ের কাছে আবদার করে, তার কেমন লাগা উচিৎ? আসমানী নওয়ান একটু হেসে বলে,
– অবশ্যই পারো আব্বা।
সৌম্য সাথে সাথে আসমানী নওয়ানকে জড়িয়ে ধরল। আসমানী নওয়ান সৌম্য’র পিঠে হাত রাখলো। তার জ্যোৎস্নার অংশ এটা। ভেবেই বুকটা শান্তিতে ছেঁয়ে গেল। সৌম্য বেশ অনেকটা সময় পর আসমানী নওয়ানকে ধরে রেখেই ভাঙা গলায় বলে,
– আপনার সাথে মায়ের গন্ধ লেগে আছে। আমি আপনাকে অবশ্যই মা ডাকবো।
সৌম্য’র কথায় আসমানী নওয়ান হেসে ফেলল।
সন্ধ্যা একটি ফাঁকা কেবিনে চুপচাপ বসে আছে। আসমানী নওয়ান তাকে এখানে বসিয়ে রেখে গিয়েছেন। আর বলে গিয়েছেন, একটু পর এখানে তার জন্য খাবার আসবে। সন্ধ্যা বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ-ই আকাশকে একটি প্যাকেট আর একটি পানির বোতল নিয়ে কেবিনের ভেতরে ঢুকতে দেখল। আকাশকে দেখে সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ উল্টো ঘুরে দরজা আটকে দেয়।
সন্ধ্যা দ্রুত বেড থেকে উঠে দাঁড়ায়। এখানে আকাশ কেন? আবার ঘরের দরজা আটকালো কেন? সন্ধ্যা ভীত চোখে তাকায়।
আকাশ হাতের প্যাকেট আর বোতল বেডসাইড টেবিলের উপর রাখলো। এরপর সন্ধ্যার সামনে এসে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। এক পা পিছিয়ে যায়। আকাশ-ও সন্ধ্যার দিকে এক পা এগোলো। সন্ধ্যা দ্রুত মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ সন্ধ্যার দিকেই চেয়ে আছে। মুখাবয়ব গম্ভীর। সন্ধ্যা শুকনো গলা ভেজায়। আকাশ তো তার উপর রে’গে ছিল। এখন কি সেই রা’গ মেটাতে এসেছে কোনোভাবে?
সন্ধ্যা নিজের ভ’য়কে তাড়াতে চাইলো। মাথা নিচু করে আকাশের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে আকাশ ডান হাতে সন্ধ্যার বা হাত টেনে তার সামনে দাঁড় করায়। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়।
আকাশ সন্ধ্যার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। তাদের মাঝে আহামরি দূরত্ব নেই। তবুও আকাশ সন্ধ্যার দিকে এগোলো। সন্ধ্যা বুঝতে পেরে পেছাতে গেলে ঠাস করে বেডের উপর পড়ে যায়। খোপা করা চুলগুলো খুলে যায়। হতভম্ব হয়ে যায় সন্ধ্যা। আকাশ তার পাঞ্জাবির খুলে রাখা বোতাম এর নিচের বোতমাটি খুলে, এরপরের বোতাম খুলতে খুলতে একটু হেসে বলে,
– আমি তোমার কে জানো?
সন্ধ্যা আকাশের পাঞ্জাবির বোতাম খোলায় ব্যস্ত হাতের দিকে তাকায়। এরপর বিস্ময় চোখে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশের হাসি দেখে সন্ধ্যা ঢোক গিলল। সন্ধ্যার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে আকাশের হাসি দীর্ঘ হয়। অতঃপর বলে,
– হাসবেন্ড হই তোমার। একদম লিগ্যাল ওয়াইফ তুমি আমার। রিয়েল রেজিস্ট্রি-পেপার যত্ন করে তুলে রাখা আছে আমার ড্রয়ারে। এরপর-ও কোন সাহসে আমার থেকে পালাতে চাও তুমি? পথ বন্ধ করার টেকনিক আমার কাছে আছে।
একটু থেমে বাঁকা হেসে বলে,
– এপ্লাই করব সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা আকাশের পাঞ্জাবির আধ-খোলা বোতামগুলোর দিকে তাকায়। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কি করবে আকাশ?
অন্তঃদহন পর্ব ২৬
তার ভাবনার মাঝেই আকাশ সন্ধ্যাকে ঝট করে টেনে দাঁড় করিয়ে শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে। সন্ধ্যা নড়াচড়া করতে চাইলে, আকাশ সন্ধ্যার গালের সাথে গাল লাগিয়ে মৃদুস্বরে আবদার করে,
– পাঁচমিনিট চুপ থাকো সন্ধ্যামালতী, প্লিজ! প্রমিস করছি, এরপর ১০ হাত স্পেস দিব তোমাকে।