অন্তঃদহন পর্ব ৩১
DRM Shohag
সন্ধ্যার চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। তার মুখ আকাশের বুকে ঠেকেছে। আকাশের শরীর উদাম থাকায় সে বুঝল, সন্ধ্যা কাঁদছে। আকাশ দ্রুত সন্ধ্যাকে ছেড়ে দেয়। দু’পা পেছায়। অপরাধীর ন্যায় বলে,
– স্যরি! আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে চাইনি। বাট…..
থেমে গেল আকাশ। সন্ধ্যা ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশ নিজের উপর বিরক্ত হলো। একটু দূরত্ব রেখেও তো কথাটা বলা যেত। কথাটা ভাবলেও বেখেয়ালে আবার-ও এগিয়ে আসে। তার দ্বারা এসব দূরত্ব রাখা হবেনা। ডান হাত বাড়িয়ে সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– স্যরি! প্লিজ কান্না অফ কর। আমি তো তোমার সাথে জোর করছি না, তাহলে কেন কাঁদছ?
সন্ধ্যা মলিন মুখে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। সে আকাশকে কি করে বোঝাবে, মানুষ শুধু দুঃখে নয়, সুখেও কাঁদে! তার শুভ্র-পাঞ্জাবিওয়ালা তাকে এতো নিখুঁতভাবে চায় বলে সে কাঁদছে! মানুষটা তাকে ভালোবাসে বলে সে কাঁদছে! আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– ওই দেখ শিমু নাক ডেকে ঘুমায়। তুমি ঘুমাওনি কেন?
এরপর আফসোসের সুরে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– মনে হচ্ছে, তুমি আমার বউয়ের চোখের নিচে কালো দাগ লাগানোর জন্য মিশনে নামতে চাইছ! তাইনা?
সন্ধ্যা বোকাচোখে তাকায়। আকাশ চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছে সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার মন পড়তে চাইলো বোধয়। কিন্তু পারলো না। এসব রেখে নরম স্বরে আবদার করে,
– ছাদে যাবে?
সন্ধ্যা অবাক হয়। আকাশ আবার-ও বলে,
– একটু পর তো ফজরের আজান দিবে। একেবারে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ো। তাই বলছিলাম। যাবে?
কথাটা বলে আকাশ সন্ধ্যার উত্তরের অপেক্ষা করে। সন্ধ্যা উশখুশ করে। দু’হাত জমা করে রেখেছে। কি বলবে বুঝতে পারেনা। আকাশ সন্ধ্যাকে চুপ দেখে মন খারাপ করে বলে,
– আচ্ছা ঠিকাছে যেতে হবে না। ঘুমাও তাহলে।
সন্ধ্যা দ্রুত মাথা তুলে তাকায়। ভেবেছে আকাশ চলে যাচ্ছে। কিন্তু আকাশকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সন্ধ্যা চোখ নামিয়ে নেয়। আকাশ জানতে চাইছে, সে কি চায়! এটুকুতে সন্ধ্যার ভীষণ ভালো লাগলো।
আকাশ সন্ধ্যাকে ঘুমাতে বলেও যায় না। বউ থেকে দূরে যাওয়া যায় না-কি! তাছাড়া প্রসঙ্গ যদি তার সন্ধ্যামালতী হয়, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। আবার-ও অসহায় কণ্ঠে আবদার করে,
– সন্ধ্যামালতী যাবে?
সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে,
– শুধু কথা বলব।
সন্ধ্যা অবাক এর উপর অবাক হয়। সন্ধ্যাকে চুপ দেখে আকাশ অধৈর্য হয়। কিন্তু নিজেকে দমালো। কারণ মাথা ঠাণ্ডা না রাখলে সব উলটপালট হয়ে যায়। ডান হাত সন্ধ্যার গালে রেখে নরম কণ্ঠে বলে,
– যাবে না?
সন্ধ্যার বুক টিপটিপ করছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ডানদিকে সামান্য মাথা কাত করে সম্মতি দেয়, সে যাবে। আকাশের মুখে হাসি ফুটল। সন্ধ্যার গাল থেকে হাত সরিয়ে সন্ধ্যার পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– চলো।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। ধীরপয়ে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। আকাশ সন্ধ্যার পিছু পিছু যায়। রুম থেকে বেরিয়ে আকাশ বা হাতে ঘরের লাইট অফ করে দেয়, শিমু ঘুমিয়েছে এজন্য। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় সন্ধ্যা ভ’য় পায়। সাথে সাথে তার পা থেমে যায়। দ্রুত উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। আকাশ না থামায় সন্ধ্যার সাথে একটু ধাক্কা খায়। আকাশের মনে পড়ে, সন্ধ্যা অন্ধকার ভ’য় পায়। দ্রুত বাইরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা টলমল চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। আকাশ ঢোক গিলল। অনুতপ্ত স্বরে বলে,
– স্যরি!
একটু থেমে বলে,
– সন্ধ্যামালতী ফুল কখনো অপবিত্র হয় না।
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। একটা প্রশান্তির শ্বাস ফেলে উল্টো ঘুরে সামনে এগোয়। আকাশ সন্ধ্যার পিছু পিছু যায়।
আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে ছাদে এসেছে। আসার সময় ধীরে ধীরে অনেকগুলো লাইট জ্বালিয়েছে ছাদের সিঁড়ি পর্যন্ত। সবশেষে ছাদের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। এরপর এগিয়ে যায় ছাদে পাতা একটি দোলনার কাছে। অনেক আগে থেকেই এই দোলনা ছাদে আছে বসার জন্য। দোলনাটি সাদা রঙের।
আকাশ ডান পা ভাঁজ করে দোলনায় বাঁকা হয়ে বসে। ডান হাত একটু উঁচু করে রাখে। সন্ধ্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
– বসো।
সন্ধ্যা অস্বস্তি নিয়ে দোলনার অপর পাশে বসে। দোলনাটি বেশ বড়সড় হওয়ায় মাঝখানে কিছুটা জায়গা থাকলো। আকাশ কিছু বলল না। মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে তোমার কি প্ল্যান?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে সন্ধ্যা অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকায়। সৌম্য ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে তো কখনো ভাবা হয়নি। কিভাবে ভাববে সে? তাদের কি তেমন জীবন ছিল? তাছাড়া সে তো জানতো, তার ভাইয়া ইরা আপুকে কত ভালোবাসতো!
আকাশ পকেট হাতিয়ে ফোন খুঁজলে ফোন পায় না। হতাশ হয়ে বলে,
– ফোন আনতে ভুলে গিয়েছি। তুমি ইশারা কর। আমি বুঝতে পারব।
কথাটা বলে আকাশ একটু এগিয়ে আসে সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,
– ইশারায় বোঝালে দূর থেকে বুঝতে পারিনা। তাই একটু…..তোমাকে টাচ করব না, পাক্কা!
সন্ধ্যা অদ্ভুদভাবে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ ঢোক গিলল। আবার চলে যাবে না তো! ভেবেই অসহায় মুখ করল। সন্ধ্যার ধ্যান ঘোরাতে দ্রুত বলে,
– একদম সাদামাটাভাবে বিয়ে করতে কি কি প্রয়োজন পড়ে সন্ধ্যামালতী? মানে ছেলে-মেয়ে কি পরলে অন্তত তাদের বর-বউ লাগবে?
কথাটা শুনে সন্ধ্যা অবাক হয়। প্রশ্নাত্মক চোখে তাকায়। কার বিয়ে? তাও আবার এতো সাদামাটাভাবে?
আকাশ এই টপিক-ও রাখে। অতঃপর বলে,
– আজ ইরাকে রিলিজ দিবে। তুমি কি আমার সাথে ওকে আনতে যাবে?
সন্ধ্যা সাথে সাথে মাথা নেড়ে বোঝালো, সে যেতে চায়। আকাশ সন্তুষ্ট চিত্তে হাসলো।
বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা সোজা হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। আকাশের নিরবতায় সন্ধ্যার চোখে ঘুম ধরা দেয়। তাকাতেই পারছে না ঠিক করে। মনে হচ্ছে উঠতেও পারবে না। ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে, অথচ তার এক কানিও ঘুম হয়নি। যার ফলে বেশি প্রবলেম হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে যেতে নেয়।
আকাশ সন্ধ্যার দিকেই চেয়ে ছিল, সে বুঝতে পেরে দ্রুত সন্ধ্যাকে দু’হাতে আগলে নেয়। সন্ধ্যা একদম ঘুমিয়ে গিয়েছে। মাথা পিছনদিকে হেলে গিয়েছে। আকাশ ঘুমন্ত সন্ধ্যার মুখপানে চেয়ে রইল। ছাদে জ্বলতে থাকা সাদা আলো সন্ধ্যার মুখে এসে পড়েছে। এই মুখে এতো মায়া কেন? আকাশ ভেবে পায় না। শুকনো ঢোক গিলল সে।
সন্ধ্যাকে একটু উঁচু করে তার কোলে বসিয়ে দেয়। সন্ধ্যা একটু নড়ে উঠল, কিন্তু ঘুম ভাঙল না। আকাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
বা হাত উঠিয়ে সন্ধ্যার কানের পিঠে রাখে। চার আঙুল চুলের ভাঁজে রেখে বুড়ো আঙুল সন্ধ্যার গালে আলতো করে রাখে। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে সন্ধ্যার গালে একটা চুমু খায়। নিজেকে না দমিয়ে সন্ধ্যার অপর গালে চুমু খায়, ধীরে ধীরে সারামুখে ছোট ছোট বেহিসাব চুমু আঁকে।
চোখের কোণে জলকণা জমতে শুরু করেছে ছেলেটার। তার বিশ্বাস হয় না, তার সন্ধ্যামালতী তার বুকে। সে মেয়েটিকে ভেবে ভেবে, তার ব্যক্তিত্ব হারিয়েছে। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শিখেছে। তার মন অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। কখন কি করে, নিজেই বোঝেনা। সে ভালোবাসা শব্দটার সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকে অসহায়ত্ব শব্দটিকে চিনেছে। বাঁচার ইচ্ছে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়েছে।
যেদিন দেখেছে, তার সন্ধ্যামালতী বেঁচে আছে,, সেদিন নতুন করে আবার-ও বাঁচার ইচ্ছে জেগেছে। কিন্তু যখন মনে হলো, তার সন্ধ্যামালতী তাকে চাইছে না,, এই বুকে কতশত ব্য’থার উৎপত্তি হলো, তার সহ্যের সীমা পেরোলো। প্রতিবার যখন তার সন্ধ্যামালতী তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত, ততবার সে বাজেভাবে ভেঙে যেত, সাপের বি’ষের চেয়েও ভ’য়া’নক বি’ষ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ত। কিন্তু তার সন্ধ্যামালতী একবার খোঁজ নিতে চাইলো না। শুধু অভিমান করেই থাকলো।
কথাগুলো ভেবে আকাশের ডান চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। সন্ধ্যার কপালে একটা চুমু খায়। এরপর সন্ধ্যার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে,
– আমার সন্ধ্যামালতী তুমি। কেন লুকিয়ে ছিলে সন্ধ্যামালতী? একবার আমার সামনে আসলে আমি তোমার সব অভিমান ভেঙে দিতাম। অনেক শা’স্তি দিয়েছ আমায়।
একটু হেসে মৃদুস্বরে বলে,
– একটু-আধটু বে’য়া’দ’বি আছে তোমার মধ্যে। একবার ভালোবাসতে দাও, সব ভুলিয়ে দিব।
কথাগুলো বলে আকাশ মাথা উঁচু করে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। আকাশের মনে হলো, সন্ধ্যার দু’চোখ অল্প অল্প খোলা। এই মেয়ে জেগে গিয়েছে না-কি! কথাটা ভেবে আকাশ ঢোক গিলল। অসহায় কণ্ঠে বিড়বিড় করল,
– আল্লাহ বাঁচাও!
সন্ধ্যার চোখ দু’টো লাল। জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভেজায়। এরপর হঠাৎ চোখ দু’টো একেবারে বুজে ফেলে। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে। আকাশ তীক্ষ্ণ চোখে সন্ধ্যাকে দেখছে। কি হলো ব্যাপারটা? জেগেছিল কি-না বুঝল না। কিন্তু এখন যে গভীর ঘুমে তা বুঝল। আকাশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সন্ধ্যার ভেজা ঠোঁটজোড়ার দিকে চোখ পড়লে আকাশ শুকনো ঢোক গিলল। নিজেকে অনেক ভুলভাল বুঝিয়ে দমাতে চাইলো। কিন্তু হতাশ হচ্ছে বারবার। নিজেকে না দমিয়ে সন্ধ্যার ভেজা ঠোঁটজোড়ায় ছোট ছোট দু’টো চুমু আঁকে।
এরপর সন্ধ্যার মাথা তার বুকে চেপে চোখ বুজে নেয়। এখন শান্তি লাগছে। বিড়বিড় করে,
– স্যরি বউ!
একটু হেসে বলে,
– বেশি ভালোবাসলে অনুমতি লাগেনা।
ঘড়িতে তখন সকাল ৯ টা। সন্ধ্যা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। পাশ ফিরে তাকালে দেখল শিমু তার পাশেই বসে ফোনে মগ্ন। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে উঠে বসে। নিজের ঘর দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয়। মনে পড়ল, সে তো ছাদের গিয়েছিল। আকাশ কি কি যেন বলছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। সে ঘরে আসলো কিভাবে? সন্ধ্যা ভাবুক হয়। কিছু শব্দ কানের কাছে বাজে, ‘সন্ধ্যামালতী, অভিমান, শা’স্তি।’
সন্ধ্যা মাথায় চাপ প্রয়োগ করল, কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছে না।
শিমু সন্ধ্যাকে খেয়াল করতেই এগিয়ে এসে বলে,
– ভাবি তুমি উঠেছ? দ্রুত রেডি হয়ে নাও। তুমি না-কি সৌম্য স্যার আর ইরা আপুকে আনতে যাবা?
সন্ধ্যা শিমুর দিকে তাকালো। আবার-ও ভাবুক হয়। তার ঝাপসা কিছু মনে পড়ছে, আবার যেন মনে পড়ছে না। শিমু সন্ধ্যার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। আকাশ যখন সন্ধ্যাকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল, তখন শিমু জেগে গিয়েছিল। অবাক হয়েছিল সে। আকাশ বেরিয়ে যেতে যেতে তাকে বলেছিল,
– হা বন্ধ কর। ওটা আমার বউ। আমার বউকে আমি কোলে নিয়েছি। আর ও ঘুম থেকে উঠলে ওকে রেডি হতে বলবি। ইরাকে আনতে যাব। তুই যেতে চাইলে রেডি হয়ে থাকিস।
শিমু কথাটা ভেবে হাসলো। সন্ধ্যাকে ঝাঁকিয়ে বলে,
– ভাবি তুমি রাতে কোথায় গিয়েছিলে?
সন্ধ্যা তার ফোন নিয়ে খুব সরল মনে টাইপ করে,
– তোমার ভাইয়ার সাথে ছাদে গিয়েছিলাম। কিন্তু ঘরে আসলাম কিভাবে?
শিমু জহুরি চোখে চেয়ে বলে,
– তুমি নিজের ইচ্ছায় গিয়েছিলে ভাবি? না-কি ভাইয়া তোমাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল?
কথাটা শুনে সন্ধ্যা বিব্রতবোধ করে। কিছু টাইপ করেনা। সে তো নিজের ইচ্ছেতেই গিয়েছিল। কিন্তু বলতে কেমন যেন লাগছে। শিমু মিটিমিটি হাসলো। ভাবছে, তার গতকাল সন্ধ্যাকে বলা কথাগুলো কাজে দিয়েছে হয়তো। সে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। আকাশ ভাইয়াকে তার বড় ভাইয়ের পাশাপাশি বাবা-ও লাগে। সে ছোট থেকে দেখেছে আকাশ ভাইয়া তার সব আবদার রাখতো। তাকে কত ভালোবাসতো! বড় ভাই, বাবার অভাব আকাশ ভাইয়া-ই পূরণ করেছে। সেই মানুষটা ক’ষ্ট পেলে শিমুর খুব খারাপ লাগতো। এমনিতেও তার মনটা খুব নরম।
এখন এদের মধ্যে একটু-আধটু ঠিক দেখে শিমুর শান্তি লাগছে।
সন্ধ্যা হাতের ফোন রেখে ওয়াশরুমে চলে গেল। কাজা নামাজ পড়তে হবে, তাই আর সময় ন’ষ্ট করল না। আজ অনেক দেরি হয়ে গেল।
আকাশ শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। ঘড়িতে সময় তখন ৯:৩০। আকাশ প্যান্ট পরে কাভার্ড হাতিয়ে পাঞ্জাবি খোঁজে। একটা পাঞ্জাবি-ও নেই দেখে আকাশ অবাক হয়। গলা চড়িয়ে তার মাকে ডাকে বেশ কয়েকবার।
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার ঘরে সন্ধ্যাকে দেখল। মেয়েটি আজ অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে, এজন্য একটু পর পর দেখতে এসেছিল। এখন সন্ধ্যাকে উঠতে দেখে সন্ধ্যাকে খাওয়ার জন্য নিচে যেতে বলে, সে নিচে যাচ্ছিল। ছেলের ডাকে আকাশের ঘরে এসে বলে,
– কি হইছে আকাশ? ডাকতাছ ক্যান?
আকাশ এগিয়ে এসে বলে,
– মা আমার সব পাঞ্জাবি কোথায় হাওয়া হয়ে গেল?
আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলেন,
– সব ধুইতে দিছি কাজের মাইয়ার কাছে।
আকাশ চেঁচিয়ে ওঠে,
– কিহহহ?
আসমানী নওয়ান অবাক হয়ে বলে,
– কি হইছে? কালকে তো শার্ট পইরা হসপিটাল গেলা। আজকের দিনটা শার্ট পর। বিকালেই সব শুকাইয়া যাইবো।
আকাশ অসহায় কণ্ঠে বলে,
– উফ মা! তুমি আসলেই আমার আর আমার বউয়ের মাঝের শত্রু।
– মানে? কি কইতাছ?
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– আমার পাঞ্জাবি আমাকে এনে দাও। এসব শার্ট পরতে পারব না আমি।
আসমানী নওয়ান অসহায় চোখে তাকায়। সে তো বুঝতে পারেনি আকাশ এমন করবে। ভাবলো সব একসাথেই ধুয়ে দিক। ওয়াশিংমেশিন টার কি যেন হয়েছে। তার সারাতেও মনে নেই। এইকয়দিন যা ঘটলো, এসবের মধ্যে তার খেয়াল নেই।
ওয়াশিংমেশিন ভালো থাকলে কাপড় ভেতর থেকে অর্ধেক শুকিয়ে বের হতো। এরপর একটু রোদে দিলেই হতো।
আকাশ হতাশ হলো। উপায় না পেয়ে কাভার্ড থেকে একটি সাদা শার্ট বের করে পরতে পরতে বলে,
– তোমাদের কাউকে যেতে হবে না মা। আমি আর সন্ধ্যামালতী যাবো ইরাদের আনতে।
আসমানী নওয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– জান্নাত তোমার সাথে একা যাইব না।
আকাশ মৃদু হেসে বলে,
– যাবে।
– তুমি মিথ্যা কইতাছ? আবার জোর করবা ওর সাথে?
আকাশ শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,
– সত্যি বলছি। ও নিজেই যেতে চেয়েছে। তুমি ওকে দ্রুত খাইয়ে দাও। আর আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমার জান্নাতকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।
আসমানী নওয়ান অবাক হলেন আকাশের কথায়। ছেলেটার মনটা কেমন ফুরফুরে লাগছে। ব্যাপার কি? আকাশকে আর কিছু বললেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার ঘরে আসলে সন্ধ্যাকে ওয়াশরুমে দেখে তিনি নিচে চলে যায়। ভাবলো সন্ধ্যা নিচে খেতে গেলে জিজ্ঞাসা করবে।
সন্ধ্যা কাজা নামাজ পরে পরিপাটি হয়ে নিচে যেতে নিলে শিমু সন্ধ্যার হাত টেনে ধরে বলে,
– একবারে রেডি হয়ে যাও ভাবি। হসপিটাল যাবানা?
সন্ধ্যা সম্মতি দিল। ভাবলো শিমু ঠিকই বলেছে। তাহলে আবার উপরে আসতে হবেনা। এগিয়ে গিয়ে এই ঘরের কাভার্ড থেকে তার একটি জামা বের করে। শিমু কিছু একটা ভেবে সন্ধ্যার হাত থেকে জামাটি নিয়ে রেখে দেয়। এরপর বলে,
– ভাবি তুমি দুই মিনিট দাঁড়াও। আমি তোমার জন্য একটা জিনিস আনছি।
কথাটা বলে শিমু এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। যেমন ঝড়ের গতিতে গিয়েছিল, তেমনি ঝড়ের গতিতে চলে আসে। শিমুর হাতে শাড়ি দেখে সন্ধ্যা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। শিমু হেসে বলে,
– এই শাড়িতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগবে।
সন্ধ্যা শিমুকে বোঝালো, সে শাড়ি পরতে চায় না। শিমু মন খারাপ করে বলে,
– আমি এটা তোমার জন্য কিনেছিলাম। তুমি না পরলে অনেক কষ্ট পাবো।
সন্ধ্যার খারাপ লাগলো। আর কিছু বললো না। শিমু হাসলো। সে শাড়িটা এমনিই কিনেছিল। একদম নতুন আছে। এভাবে কাজে লেগে যাবে বোঝেনি। সবচেয়ে বড় কথা আকাশ ভাইয়া সাদা’র ফ্যান। শাড়িটি-ও সাদা কালার। আর উপরে খুব সুন্দর কাজ করা। আকাশ ভাইয়া খুশিই হবে। সময় নিয়ে সন্ধ্যাকে শাড়িটি পরিয়ে দেয় শিমু। সন্ধ্যা শিমুকে রেডি হতে বললে, শিমু বলে, সে যাবে না।
কথাটা বলে শিমু হাসলো। সবাই গেলে সে যেত। কিন্তু আকাশ ভাইয়া আর সন্ধ্যার সাথে সে যাবে না। এদের তো উল্টে স্পেস দিতে হবে।
সন্ধ্যা নিচে নেমে সকালের খাবার খেয়ে নেয়। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে দেখে শুধু হাসলেন। শিমু তাকে সব বলেছে। তিনি খুশি-ই হলেন। শিমু মাইয়া টা এক কাজের কাজ করেছে।
আকাশ সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে নিচে খেয়াল করলে তার পা থেমে যায়। সন্ধ্যা খাবার খেয়ে মাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে। পরনে খুব সুন্দর কাজ করা একটি সাদা শাড়ি, সাথে ম্যাচিং করে একটি হিজাব বাঁধা। চোখে লাগার মতো সুন্দর লাগছে। আকাশ ঢোক গিলল।
শিমু আকাশকে দেখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,
– আকাশ ভাইয়া সব ক্রেডিট কিন্তু আমার।
আকাশ অবাক হয়ে শিমুর দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
– আসলেই?
শিমু ভাব নিয়ে বলে,
– বিশ্বাস না হলে তোমার বউকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
আকাশ মৃদু হেসে বলে,
– কি লাগবে তোর?
শিমু দাঁত কেলিয়ে বলে,
– কিছুই লাগবে না। তুমি এবার থেকে মেয়েদের মতো কান্না অফ কর।
আকাশ শিমুর মাথায় গাট্টা মেরে নিচে নামতে নামতে বলে,
– সাথে তোর বিয়ের ব্যবস্থা-ও করছি। বেশি পেকেছিস।
শিমু মুখ ফোলালো। এই ভাই জাতটাই ভালো না। কোথায় একটা ধন্যবাদ দিবে, তা না, তাকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করছে।
আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে পাশে দাঁড় করায়। সামনে আকাশ দাঁড়ানো। ভদ্রমহিলা সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– জান্নাত দেখ তো মা, আমার ছেলেরে শার্ট পইরা সুন্দর লাগে না?
আসমানী নওয়ানের কথা শুনে সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের পরনে সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট। শার্টের হাতা খুব সুন্দর করে কনুই পর্যন্ত গুটানো। বা হাতে চেইন ঘড়ি। সন্ধ্যার তো আকাশকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ লাগে। আর তার চোখে সাদা রঙটা আকাশের জন্য বেশি ভালো লাগে। কিন্তু এটা বলবে কিভাবে? ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে চুপ দেখে আবার-ও বলেন,
– সাদা পাঞ্জাবি ছাড়া ওয় কিছু পরতে চায় না। শার্ট পরলে কি সুন্দর লাগে! ওরে একটু বুঝাস তো জান্নাত!
সন্ধ্যা অবাক হয়। এটা আবার কি ধরনের কথা? ছেলেরা শার্ট পরতে চায় না, এটা প্রথম শুনলো।
আসমানী নওয়ান ঘরের দিকে যেতে যেতে বলে,
– আকাশ সাবধানে নিয়া যাইও জান্নাতরে।
ইরা ঘুমে থাকতেই সৌম্য একজন নার্সকে ইরার কাছে রেখে ইরার জন্য একটি থ্রি পিস কিনে এনেছে। সাথে সকালের খাবার। অফিসে কল করে আরও দু’দিন ছুটি নিয়েছে। ছুটি দিতে চাইছিল না। কিন্তু সৌম্য ইরাবতীকে এভাবে রেখে যেতে পারবে না। বেশ কসরত করেই ছুটি আদায় করতে হয়েছে।
ইরার ঘুম ভাঙলে ইরাকে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে সৌম্য তাকে সকালের খাবার খাইয়ে দেয়। এরপর তার কিনে আনা জামাটি ইরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– একটু পর রিলিজ দিয়ে দিবে। জামা একা চেঞ্জ করতে পারবি? না-কি নার্সকে ডাকব?
ইরা মাথা নেড়ে বলে,
– পারবো।
এরপর ধীরে ধীরে বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। সৌম্য’র হাত থেকে জামা নেয়। জামাটি উল্টেপাল্টে বুঝল, দামি জামা। ইরা অবাক হয়ে বলে,
– এই জামার অনেক দাম। তুই এতো টাকা কোথায় পেয়েছিস সৌম্য?
সৌম্য তাকাল ইরার দিকে। ইরাকে এখনো কিছু বলেনি। এজন্য ইরার রিয়েকশনে অবাক হলো না। ইরা এবার সৌম্য’র দিকে খেয়াল করল।
সৌম্য’র পরনে একটি কালো প্যান্ট, সাথে কালো শার্ট, পায়ে জুতো। সবই কেমন দামি দামি। ইরা আগের চেয়েও অবাক হয়ে বলে,
– তোর নতুন শার্ট, নতুন প্যান্ট, নতুন জুতো-ও কিনেছিস?
সৌম্য অস্বস্তিতে পড়ে যায়। নিজেকে সামলে বলে,
– চাকরি পেয়েছি ইরাবতী।
ইরার চোখ মার্বেলের ন্যায় বড় বড় হয়ে যায়। বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– একদিনের মধ্যে কোথায় চাকরি পেলি? আবার প্রথমদিন-ই কে টাকা দিল?
সৌম্য সময়ের ব্যবধান টুকু বলতে গিয়ে বারবার আটকে যাচ্ছে। সে কিভাবে বলবে, মাঝখানে একদিন, দুইদিন নয়,, পুরো এগারোটা মাস চলে গিয়েছে। তার ইরাবতী মৃ’ত্যু’র সাথে লড়াই করেছে। তাছাড়া ইরা তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে কি বলবে। এখন কিছুতেই এটা বলা যাবে না। সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– ইরাবতী আমি তোকে পরে সব বুঝিয়ে বলব। তুই রেডি হয়ে নে। বাসায় তোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।
ইরা আর কিছু বললো না। ভাবনা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
আকাশের কল পেয়ে সৌম্য রিসিভ করে। আকাশ তাকে রিসিপশনের ওখানে যেতে বললে সৌম্য কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।
সৌম্য আকাশের পাশে সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হয়। সন্ধ্যাকে একটু অন্যরকম লাগছে। এটাও তার চোখে পড়ে। সন্ধ্যা তার ভাইকে দেখে কয়েক পা এগিয়ে আসে। সৌম্য দেখল তার বোনের মুখ মলিন নয়। বরং না হাসলেও হাস্যজ্জ্বল। ভালো লাগলো তার। শান্তি পায় তার বোনুকে ভালো থাকতে দেখলে। জিজ্ঞেস করে,
– বোনু সকালে খেয়েছিস?
সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বোঝায় সে খেয়েছে। সৌম্যকে পাল্টা জিজ্ঞেস করে, খেয়েছে কি-না! সৌম্য উত্তর দেয়, সে-ও খেয়েছে।
আকাশ চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে আছে। এই সৌম্য তো তার বউকে ভাই এর ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো ভালোবাসা শেখায়নি। তার বউ সারাটা পথ চুপচাপ আসলো। তাকে একটাবার জিজ্ঞেস করল না, খেয়েছে কি-না! অথচ ভাইকে দেখে সব ভালোবাসা বেরিয়ে আসছে। আকাশ হতাশ! কবে তার বউ তাকে একটু ভালোবাসবে?
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– আমার ছোট মাকে সুন্দর লাগছে।
ভাইয়ের থেকে প্রশংসা পেয়ে সন্ধ্যার মন আরও ভালো হলো। স্বভাবসুলভ সৌম্যকে জড়িয়ে ধরে। আকাশ একবার সৌম্য’র দিকে তাকায়, আরেকবার সন্ধ্যার দিকে। স্বামীকে ভুলে গিয়ে ভাইকে ভালোবাসছে। ভাইটাও বোনকে বোঝায় না, স্বামীকে একটু ভালোবাসতে হয়। তার কপালটাই খারাপ! বউ-ও ভালোবাসেনা, বউয়ের ভাইটা-ও যাচ্ছেতাই।
সৌম্য এগিয়ে এসে বলে,
– কিছু বলবেন আকাশ ভাইয়া?
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– স্লিপ টা দাও।
– কেন?
আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– বিল মিটিয়ে দিব তাই।
– আপনি কেন দিবেন? আমি….
আকাশ মাঝ থেকেই বলে ওঠে,
– কারণ আমি ইরার বড় ভাই।
একটু থেমে বলে,
– আর তোমার-ও।
কথাটায় কি ছিল কে জানে। সৌম্য নিঃশব্দে পকেট থেকে স্লিপটি বের করে দিল। আকাশ রিসিপশনের লোকের সাথে টুকটাক কথা বলে। সৌম্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। তার মাথার উপর আল্লাহ ছাড়া কেউ আছে এটা ভাবা তো কল্পনার বাইরে ছিল। কিন্তু আজ মনে হয়, তার মাথার উপর-ও কেউ আছে। সন্ধ্যার বড় ভাইয়ের মতো তার-ও বড় ভাই আছে একটা। সৌম্য মাথা নিচু করে একটু হাসলো।
ইরা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সৌম্য’র পাশে আকাশ আর সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হয়। আকাশ তাদের ভার্সিটির বড় ভাইয়ের পাশাপাশি আরেকভাবে
তার চেনা চেনা লাগলো, কিন্তু চিনতে পারলো না। তবে সন্ধ্যাকে দেখেই চিনেছে। অবাক হয়ে বলে,
– আরে এটা সন্ধ্যা না?
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– হুম।
ইরা মৃদু হেসে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
– ও তো ফোনের ভেতরের চেয়ে, সামনে থেকে দেখতে অনেক বেশি সুন্দর!
ইরা এখন মোটামুটি ভালোই সুস্থ। সন্ধ্যাকে দেখে আরও মন ভালো হলো। সন্ধ্যার সামনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার গালে হাত রেখে বলে,
– অবশেষে তোমার এই কিপ্টে ভাই তোমাকে শহরে এনেছে। আমি অনেক বলতাম, কিন্তু সৌম্য তোমাকে আনেনি। সে যাক, আমি অনেক খুশি হয়েছি।
সন্ধ্যা একটু হাসলো। ইরা তাকে ফোনের ভেতরেই কত আদর করত। সন্ধ্যার নিজের-ও ইরাকে দেখার ইচ্ছে হত। কিন্তু চাইলেই তো সব পাওয়া যায় না। সন্ধ্যার পাশে আকাশকে দেখে ইরা একটু বিব্রতবোধ করল। সৌম্য, সাথে সন্ধ্যাকে পেয়ে ইরা অনেকটা চঞ্চল হয়েছে। তাই স্বভাবসুলভ জিজ্ঞেস করে,
– আপনি কে ভাই? ভালো মানুষ নয় সেটা বুঝেছি। কারণ আমি আপনাকে খারাপ কোথাও দেখেছি। কিন্তু মনে পড়ছে না।
ইরার কথা শুনে সন্ধ্যা, সৌম্য দু’জনেই চোখ বড় বড় তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ কেশে ওঠে। সে আবার কবে খারাপ কাজ করল? এই বোন মনে হচ্ছে তার সংসার হওয়ার আগেই ভেঙে দিবে। সৌম্য অবাক হয়ে বলে,
– কি বলছিস ইরাবতী?
ইরা একটু ভেবে বলে,
– ও হ্যাঁঁ মনে পড়েছে। এই লোকটা আমায় বিয়ে করতে এসেছিল সৌম্য। বাবার সাথে কানেকশন ছিল। বাবা কেমন মানুষ জানিস-ই তো। বাবার সাথে নিশ্চয়ই ভালো মানুষের কানেকশন থাকবে না?
আকাশ কিছু বলতে নেয়, তার আগেই সৌম্য বলে,
– সেসব এর পিছনে কাহিনী আছে ইরাবতী। তোকে পরে বলব। আর আকাশ ভাইয়া তোর ফুফাতো ভাই ইরাবতী।
ইরা কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। বিড়বিড় করে,
– ফুফাতো ভাই?
সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– তুই যে তোর বাবার বাড়ির আত্মীয়দের জন্য আফসোস করতি। তাদের মধ্যে একজন আকাশ ভাইয়া।
ইরা ঢোক গিলল। সৌম্যকে ভালোবাসার আগে তার বাবার সাথে তার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। বাবা তার কাছে অনেক গল্প করত, তার তিন বোনের। যাদের নাম,, আসমানী, তারা, জ্যোৎস্না।
তবে তার বাবা সবচেয়ে বেশি বলত ছোট বোন জ্যোৎস্নার কথা। ইরা যখন তাদের খোঁজ চাইত, তখন তার বাবা এড়িয়ে যেত। কতদিন জিজ্ঞেস করেছে। বাবা কখনো বলেনি। তার মা-ও বলেনি। ইরা আকাশের দিকে চেয়ে বলে,
– আপনি কি জ্যোৎস্না ফুপির ছেলে?
ইরার মুখে নিজের মায়ের নাম শুনে সন্ধ্যা অবাক হয়। আকাশ-ও অবাক হয়। তবে সৌম্য অবাক হয়না। ইরার সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল। আর ইরা যেটুকু জানতো, সবই তাকে এসে বলত। সৌম্য অবাক হয়নি। অবাক হওয়ার কথাও না। এক নামে এই পৃথিবীতে কত মানুষ থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা যে এভাবে ঘুরে যাবে কখনো কল্পনাও করেনি।
আকাশ মনে মনে হেসে বলে,
– আমি তোমার আসমানী ফুপির ছেলে,, সম্পর্কে তোমার বড় ভাই। আর তোমার জ্যোৎস্না ফুপির ছেলে সৌম্য,, যে তোমার ছোট ভাই।
কথাটা শুনে সৌম্য কেশে ওঠে। আকাশের দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– একদম ফা’ল’তু কথা বলবেন না। তাছাড়া আমার বোনুও তো আপনার ছোট বোন।
এবার আকাশ রা’গ’লো। রে’গে বলে,
– আমি আমার সন্ধ্যামালতীকে বোন মানিনা।
একই সময়ে আকাশের সাথে সাথে সৌম্য’ও বলে,
– আমি আমার ইরাবতীকে বোন মানিনা।
দু’জনের কথা একসাথে রিপিট হওয়ায় দু’জনেই থতমত খেয়ে তাকায়। ইরা আর সন্ধ্যা একবার আকাশের দিকে তাকায় আরেকবার সৌম্য’র দিকে। এদের অবস্থা দেখে সন্ধ্যা মুখে হাত দিয়ে হেসে ফেলল। ইরার হাসি আসলেও হাসতে পারলো না। তার অবাকের রেশ-ই কাটলো না। আকাশকে মানতে পারলেও সৌম্য আর সন্ধ্যার ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছে না।
সৌম্য ইরার দিকে চেয়ে মে’জা’জ দেখিয়ে বলে,
– হজম কর। আমিও অবাক হয়েছিলাম। আর হজম করলেও আমাকেই বিয়ে করতে হবে। এসব ভাই-টাই ভুলে যা।
ইরা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তুই রে’গে যাচ্ছিস কেন? আমি কি একটু অবাক-ও হতে পারবো না?
সৌম্য কিছু বলল না। তাকে ইরার ডিরেক্ট ভাই বানিয়ে দেয়ায় মে’জা’জ খারাপ লাগছে। সৌম্য বিড়বিড় করল,
– পুরাই জ’ঘ’ণ্য অনুভূতি!
কথাটা আকাশের কানে গিয়েছে। সৌম্য’র কথার পিঠে বলে,
– একদম!
সৌম্য আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ-ও সৌম্য’র দিকে চেয়ে। দু’জনেই দু’জনের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে রইল।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ইরা সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– সৌম্য, আমার রিক্সায় যেতে ইচ্ছে করছে। যাবি?
সৌম্য ইরার কথা শুনে ইরার দিকে তাকালো। ইরা মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে। সৌম্য মৃদু হেসে বলে,
– আচ্ছা।
আকাশ তার গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে, পাশে সন্ধ্যা। সৌম্য ইরার হাত ধরে এগিয়ে এসে আকাশের সামনে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,
– আকাশ ভাইয়া, ইরাবতী রিক্সায় যেতে চায়।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– আচ্ছা নিয়ে যাও।
সৌম্য ডান হাত বাড়িয়ে বলে,
– ভাড়া দিন।
আকাশ অবাক হয়। পাশে দাঁড়ানো সন্ধ্যা-ও অবাক হয়। তার ভাইয়া তো এমন নয়।
সৌম্য’র হাত ধরে দাঁড়ানো ইরা-ও সবচেয়ে বেশি অবাক হয়। সে সৌম্যকে খুব ভালো করে চেনে। সৌম্য না খেয়ে থাকলেও কখনো কাউকে বলে না। আর আজ সে আকাশের কাছে হাত পেতে টাকা চাইছে। তাও আবার রিক্সা ভাড়া!
আকাশ বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– তোমার কাছে টাকা নেই?
সৌম্য উত্তর করে,
– বড় ভাইয়ের টাকা নেই। বড় ভাইয়ের টাকায় যেতে ইচ্ছে করছে।
কথাটা শুনে আকাশ শব্দ করে হেসে ফেলল। রিসিপশনে তার বলা কথাটার প্রয়োগ করছে সৌম্য, আকাশ বুঝল। সৌম্য-ও মৃদু হাসলো। সন্ধ্যা আপ্লূত হয়ে তার ভাইয়া আর আকাশকে দেখল। তার ভীষণ ভালো লাগলো এই ছোট্ট ঘটনাটুকু।
আকাশ প্যান্টের পিছন পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে একশ টাকার তিনটে চকচকে নোট সৌম্য’র দিকে বাড়িয়ে নেয়। সৌম্য সত্যি-ই নিল। এরপর ইরার হাত ধরে উল্টো ঘুরে এগিয়ে যায় রিক্সার দিকে। ইরার মুখে হাসি লেপ্টে। এমন সৌম্যকে সে চিনলেও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আজ দেখল। সৌম্য একটি রিক্সা ঠিক করে ইরাকে উঠতে বললে, ইরা রিক্সায় উঠে বসে। পাশে সৌম্য উঠে বসে। দু’সেকেন্ড যেতেই সৌম্য বলে,
– ইরাবতী তোর মায়ের বাড়ির আত্মীয়দের বলিস, তোর আজ বিয়ে।
কথাটা শুনে ইরা সাথে সাথে সৌম্য’র দিকে তাকায়। অবাক হয়ে বলে,
– আজ?
সৌম্য ছোট করে বলে,
– হুম।
ইরা পাত্তা না দিয়ে বলে,
– পা’গ’ল না-কি তুই? বিয়ে মানুষের জীবনে একবার-ই হয়। আর এটা অনেক প্ল্যান করতে হয়। ঢাকাইয়া বিয়েগুলো দেখিস না কিভাবে হয়? আমিও ওভাবে বিয়ে করতে চাই। জানিস না, পছন্দের মানুষদের সাথে বিয়ে হলে মেয়েরা কতকিছু করে?
সৌম্য বিরক্ত হয়ে বলে,
– সব বিয়ের পর করিস।
ইরা হতাশ হয়ে বলে,
– ধ্যাত! বিয়ের পর কিছু হয় না। তুই একটু অপেক্ষা কর। আমি সব প্ল্যান করব বাড়ি গিয়ে।
সৌম্য গম্ভীর গলায় বলে,
– বিয়ে আজকেই হবে।
– না। অন্তত দুই সপ্তাহ টাইম লাগবে।
সৌম্য রে’গে তাকায়। ইরা মিনমিন করে বলে,
– একটাই তো বিয়ে করব। আমার সব ফ্রেন্ডদের এভাবেই বিয়ে হয়েছিল।
সৌম্য শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ইরার কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– তোর জ্ঞান ফেরার পর দুই বেলা ওয়েট করব এটাই বেশি। আর ওয়েট করতে পারবো না। ওয়েদার ভালো। ইরাবতীকে আজকেই লাগবে আমার। মানে আজকেই।
কথাটা বলে ইরার গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে সোজা হয়ে বসে। ইরা চোখ নামিয়ে ঢোক গিলল। জমে গিয়েছে সে। সৌম্য আড়চোখে ইরাকে দেখে একটু হাসলো।
আকাশ গাড়ি গ্যারেজে রাখে। এরপর গাড়ি থেকে নেমে সন্ধ্যার পাশের দরজা খুলে দেয়। সন্ধ্যা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। আকাশ সন্ধ্যার হাত ধরে উল্টোদিকে যায় দ্রুতপায়ে। সন্ধ্যা অবাক হয়। আকাশের হাত ধরে আটকাতে চাইছে। কিন্তু পারছেনা। আকাশ সন্ধ্যাকে বাগানে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ ঘেমে গিয়েছে। গাড়িতে এসি ছিল। তাছাড়া আজকে আবহাওয়া ঠাণ্ডা। আকাশ মেঘলা। তবে আকাশের এই অবস্থা কেন?
আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে ঢোক গিলল। প্রথমে তো শিমুর উপর খুশি হয়েছিল তার সন্ধ্যামালতীকে শাড়ি পরিয়ে দেয়ায়। এখন বুঝতে পারছে কতবড় কেলেঙ্কারি করে দিয়েছে তার ব’জ্জা’ত বোন। বউকে সামনে রেখে কন্ট্রোল করা যায়? একটু জড়িয়ে ধরতে-ও পারেনা। আকাশ এদিক-ওদিক তাকিয়ে হাসফাস করে। বা হাতে শার্টের দু’টো বোতাম খুলে দেয়।
সন্ধ্যা চিন্তিত মুখে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। তার আকাশকে অসুস্থ লাগছে। ফোনে কিছু টাইপ করে,
– আপনার কি হয়েছে?
এরপর ফোনটি আকাশের দিকে ধরলে আকাশ লেখাটি সন্ধ্যার দিকে তাকায়। তার বউ যে বুঝেছে তার কিছু হয়েছে, এটাই অনেক লাগলো। কিন্তু কি হয়েছে এটা কিভাবে বলবে?
সন্ধ্যা আকাশকে চুপ দেখে হতাশ হলো। আসমানী নওয়ানের কথাটি মনে পড়লে আবার-ও কিছু টাইপ করে আকাশের দিকে ফোন বাড়িয়ে দেয়। আকাশ এবার-ও সন্ধ্যার হাত থেকেই লেখাটি পড়ল।
– আপনি সবসময় সাদা পাঞ্জাবি পরেন কেন?
এরপর চোখ তুলে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল, সন্ধ্যা তার দিকে উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে। আকাশ মৃদু হেসে বলে,
– কে যেন বলেছিল, আমাকে সাদা পাঞ্জাবিতে সুন্দর লাগে। আমি তার ইচ্ছে পূরণে বিন্দুমাত্র কৃপণতা করিনা।
সন্ধ্যার চোখেমুখে বিস্ময়। কথাটা তো সে বলেছিল। আকাশ এটাও মনে রেখেছে? আর এজন্যই আকাশ শুধু সাদা পাঞ্জাবি পরে? সন্ধ্যা বাকহারা হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইল।
আকাশ হঠাৎ-ই দু’পা এগিয়ে এসে বা হাতে সন্ধ্যার কোমর জড়িয়ে তার সাথে চেপে ধরে। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। নড়াচড়া করার আগেই আকাশ নরম স্বরে বলে,
– প্লিজ এভাবে থাকো একটু। আমার অসুস্থ লাগছে।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। নড়লো না। আকাশ সন্ধ্যার গালে ডান হাত রাখে। সন্ধ্যার শুকনো মুখের দিকে চেয়ে ঢোক গিলল। মৃদুস্বরে আবদার করে,
– একটু হাসবে?
সন্ধ্যা অবাক হয়। আকাশ আবার-ও বলে,
– হাসো সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যা অসহায় চোখে তাকালো। এভাবে হাসা যায় না-কি! সন্ধ্যা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁটজোড়া ভেজায়। আকাশের দৃষ্টি আটকালো সেথায়। মনে হচ্ছে, বউটা তাকে আরও উষ্কে দিচ্ছে।
সন্ধ্যা আকাশের দৃষ্টি দেখে থমকায়। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে।
আকাশ ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে সন্ধ্যার ঠোঁটের নিচে আলতো হাত চালায়। দৃষ্টি সন্ধ্যার ঠোঁটজোড়ায়। মুখটা একটু এগিয়ে এনে বলে,
– হাসো বউ।
সন্ধ্যার শরীর শিরশির করে ওঠে। আকাশ ঢোক গিলল। মৃদুস্বরে বলে,
– নাহ থাক। এখন হাসতে হবে না।
কথাটা বলে আকাশ সন্ধ্যার চোখের দিকে তাকায়। সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আকাশ ভীতি ঢোক গিলে বলে,
– আমার ভীষণ অসুস্থ লাগছে। তুমি সুস্থ করে দাও সন্ধ্যামালতী!
এরপর আরেকটু এগিয়ে নেয় তার মুখ। অনুতপ্ত স্বরে বলে,
– স্যরি বউ!
অন্তঃদহন পর্ব ৩০
কথাটি বলে সাথে সাথে চোখ বুজে, সন্ধ্যার ঠোঁটজোড়া তার ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে। সন্ধ্যা স্তব্ধ হয়ে যায়। হাতে থাকা ফোন ঠাস করে শক্ত মাটিতে পড়ে যায়। আকাশ সন্ধ্যার দু’হাত তার ঘাড়ের উপর তুলে দেয়। এরপর তার দু’হাতে সন্ধ্যার কোমর শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বহুদিনের অপেক্ষায় রাখা অমৃত পান করতে ভীষণ-ই ব্যস্ত সে।
