অন্তঃদহন পর্ব ৩৬
DRM Shohag
শিমুর গুণগুণিয়ে গাওয়া গান সবার কানে গিয়েছে। আকাশ আর সৌম্য দু’জনেই শিমুর দিকে রে’গে তাকিয়ে আছে। শিমু আকাশ আর সৌম্য’র দিকে তাকালে, দু’জনের সাথে চোখাচোখি হতেই থতমত খেয়ে যায়। আকাশ বলে,
– কি বলছিলি?
একই সাথে সৌম্য বলে,
– কি গাইছিলে?
শিমু আমতা আমতা করে বলে,
– হঠাৎ মনে পড়ল, তাই একটু…..
আকাশ ধমকে বলে,
– এক থা’প্প’ড়ে গান ভুলিয়ে দিব তোকে।
শিমু ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। সকলে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। সন্ধ্যা আর ইরা মাথা নিচু করে মিটমিটিয়ে হাসছে। আকাশ, সৌম্য দু’জনেই ব্যাপারটা খেয়াল করে। আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
– হাসছো কেন?
একই সাথে সৌম্য ইরার দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে বলে,
– হাসছিস কেন?
সন্ধ্যা, ইরা দু’জনেই থতমত খেয়ে তাকায়। আকাশ সৌম্য’র দিকে চেয়ে বলে,
– বারবার তুমি আমার কপি করছ কেন?
সৌম্য অবাক হওয়ার ভান করে বলে,
– আপনার কপি করব, আমি? কপি করার মতো ভালো কিছু আছে আপনার মধ্যে?
সৌম্য’র কথায় এবার সন্ধ্যা শব্দহীন তবে বেশ জোরে হাসে। ফলস্বরূপ মুখের খাবার নাকে উঠে যায়। সমানে কাশতে থাকে। আকাশ সৌম্য’কে কিছু বলতে গিয়েও সন্ধ্যার অবস্থায় দ্রুত সন্ধ্যার দিকে ফিরে তাকায়। পানি এগিয়ে দেয় সন্ধ্যার দিকে। সৌম্য উঠতে গিয়েও আকাশকে পানি দিতে দেখে আর উঠল না। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– তোমাগো ঝগরার জন্য আমার জান্নাতের এমন হইলো। আর একটা কথাও কইবানা কেউ।
আকাশ সন্ধ্যাকে পানি খাইয়ে দিতে মৃদুস্বরে বলে,
– ঠিক হয়েছে?
সন্ধ্যা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝায়। সৌম্য মাথা নিচু করে খেতে শুরু করল। ইরা মিটিমিটি হেসে সৌম্য’র কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
– শিমুর গানটা সুন্দর ছিল, বল?
সৌম্য রে’গে তাকায় ইরার দিকে। ইরা মেকি হেসে বলে,
– তুই অনেক কিউট!
কথাটা আকাশ শুনতে পেয়ে ইরার দিকে তাকায়। ইরা আকাশকে তাকাতে দেখে আমতা আমতা করে বলে,
– আপনি-ও কিউট আকাশ ভাইয়া!
সৌম্য রে’গে জোরে ধমক দেয়,
– তুই কি খাবি?
সৌম্য’র ধমকে সবাই সৌম্য’র দিকে তাকায়। সৌম্য বিব্রতবোধ করল। আকাশ সৌম্য’র দিকে চেয়ে বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– এমন ষা’ড়ের মতো চেঁচালে ও খাবে কিভাবে?
সৌম্য রে’গে বলে,
– আপনাকে ওর কথা ভাবতে হবে না।
আকাশ সৌম্যকে কিছু বলল না। ইরার দিকে চেয়ে বলে,
– ইরা তুমি তো সন্ধ্যার বড় বোন। কতদিন পর দেখা হয়েছে তোমাদের। সন্ধ্যার সাথে একরাত থাকা উচিৎ তোমার। সন্ধ্যা ভীষণ খুশি হবে তাহলে।
সৌম্য কটমট দৃষ্টিতে তাকায় আকাশের দিকে। কি বে’য়া’দ’ব দেখ! তার বউকে তার থেকে আলাদা রাখার কি টেকনিক বের করেছে! আকাশ সৌম্য’র দিকে চেয়ে মনে মনে হাসলো। এরপর সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলে,
– কি বউ! মামাতো বোন প্লাস ভাবির সাথে এক রাত থাকলে খুবি হবে তো তাই না?
সন্ধ্যা সৌম্য’র দিকে তাকালে, সৌম্য নিজেকে সামলে নেয়। মৃদু হেসে বলে,
– ইরা আজ তোর সাথেই থাকবে বোনু।
সন্ধ্যা হাসলো। সৌম্য’ও হাসলো। বোনু হাসলে তার আর কি লাগে? কিন্তু বোনু হাসার জন্য তো তার বউকে চায়নি। এই আকাশ ভাইয়া কু’বুদ্ধি দিল! বিরক্ত লাগছে।
ইরা হেসে বলে,
– তাহলে আমি, সন্ধ্যা আর শিমু আজ একসাথে থাকবো।
ইরার কথায় সবাই হাসলো। এরপর সবাই টুকটাক কথা বলায় ব্যস্ত হয়। আসমানী নওয়ান খেতে বসে পড়েছে।
আকাশ সৌম্য’র দিকে চেয়ে বলে,
– বেশি ক’ষ্ট হচ্ছে?
সৌম্য বিরক্ত হয়ে বলে,
– দেখুন….
আকাশ মাঝখান থেকে বলে,
– তুমি আবার কি আমাকে দেখাতে চাও? আমি তোমার কিছু দেখতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই মিস্টার সম্মোন্ধি। এসব দেখাদেখি আমার বোন ইরার জন্য তুলে রাখো।
সৌম্য আকাশের দিকে কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– শা’লা!
আকাশ তেজ দেখিয়ে বলে,
– কি বললে? বড় ভাইকে অসম্মান করছ? তোমার সাহস তো কম না?
সৌম্য মেকি হেসে বলে,
– আপনাকে ডাকলাম। একটা মাত্র শা’লা তো, তাই এই নামে ডাকতেই বেশি ভালো লাগে আমার। বুঝেছেন শা’লা?
আকাশ কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমি তোমার সম্মোন্ধি। নট শা’লা।
সৌম্য ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– আমার সম্মোন্ধি নাম পছন্দ নয়। শা’লা বেশি পছন্দ।
আকাশ দাঁত কিড়মিড় করে তাকায়। সৌম্য মনে মনে হাসে। আকাশ হঠাৎ শব্দ করে বলে,
– সৌম্য শা’লা??
এতোক্ষণ সবাই কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় আকাশ আর সৌম্য’র কথা সেভাবে শুনতে পায়নি। এবার আকাশ জোরে বলায় সবাই শুনতে পেয়ে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ মৃদু হেসে বলে,
– শা’লা ডাকটা আসলে মধুর ডাক। বললেই পরাণ জুড়িয়ে যায়। সম্মোন্ধি নামটা কে আবিষ্কার করেছে? পুরাই ফা’ল’তু। এতো মধুর ডাক শা’লা রেখে অন্য নাম ডাকতে একদম পানসে লাগে।
এরপর সৌম্য’র প্লেটের দিকে ভাতের থালা সহ তরকারির বাটি এগিয়ে দিয়ে বলে,
– সৌম্য শা’লা তুমি খাও। পেট ভরে খাও শা’লা। আর কিছু লাগবে তোমার, শা’লা?
সৌম্য’র পাতের খাবার শেষ। মুখে খাবার আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাত চিবোচ্ছে, যেন আকাশকেই চিবোচ্ছে। আকাশ পাত্তা দিল না। তার খাওয়া শেষ। হাত ধোয়ার জন্য উঠে বেসিনের দিকে যায়।
সবাই অবাক হয়ে চেয়ে আছে। মানে এদের কি করা উচিৎ? শা’লা ডাকবে বলে সম্মোন্ধি সম্পর্ক-ই অস্বীকার করছে! কপাল চাপড়ায় সকলে।
সৌম্য উঠে গিয়ে আকাশের পিছনে দাঁড়ায়। অতঃপর বলে,
– আপনি আমার বোনুকে আরও একবছর পাবেন না।
আকাশ হাত ধুয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। সৌম্য’র দিকে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে বলে,
– তোমার বোন কালকেই আমার কাছে সুড়সুড় করে চলে আসবে। আমার চিন্তা বাদ দাও।
একটু থেমে মনে মনে হেসে বলে,
– ইরাকে ছাড়া থাকতে, তোমার বেশি ক’ষ্ট হলে আমার রুমে আসো। স্পেশাল তেল আছে। মালিশ করে দিব। যতই হোক, আমি সবার বড় ভাই হিসেবে আমার ছোট ভাই-বোনদের খুব আদর-যত্ন করি। লাগবে তেল-মালিশ?
সৌম্য কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশ পাত্তা দিল না। সৌম্যকে পাস করে তার ঘরের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বলে,
– লাগলে চলে এসো৷
সকলে আকাশের দিকে তাকায়। আসমানী নওয়ান ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কি লাগবো আব্বা?
আকাশ একটু হেসে বলে,
– তোমার ছোট ছেলে জানে মা।
সৌম্য হাত ধুয়ে তার ঘরের দিকে বড় বড় পা ফেলে যেতে যেতে রে’গে বলে,
– আমি আর এই বাসায় থাকবোই না।
সবাই একবার আকাশের দিকে তাকায়, তো একবার সৌম্য’র দিকে। আবার-ও কপাল চাপড়ায় সকলে।এদের নিয়ে আর পারা যাচ্ছে না। শিমু হেসে বলে,
– আকাশ ভাইয়া আর সৌম্য ভাইয়ার ঝগড়া তো মেয়েদের-ও হার মানাবে! সেই তো!
শিমুর কথায় সবাই হাসলো।
পেরিয়েছে সাতদিন।
দুপুরের পর পর তখন,
আকাশের বুকে মেঘ জমতে শুরু করেছে। থেকে থেকে তীব্র বেগে বাতাস বইছে। সমুদ্রের পানিগুলো বাতাসের বেগে উথাল-পাতাল হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ঘুরতে এসেছে কক্সবাজারের এই সমুদ্র-সৈকতে। মন ভরে আনন্দ করছে। কেউ কেউ অতি উল্লাসে প্রাণভরে হাসছে। সমুদ্রের পানিতে নেমে মনের আনন্দে নিজেদের সুখ কুড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু শান্তি নেই সমুদ্রেরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাইফুদ্দীন নওয়ানের মনে। তার জীবনের দু’টো প্রাণ। একজন স্ত্রী, আরেকজন তার ছেলে। দু’জনেই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ঘৃণা করে তাকে। ভুল করেও যদি কেউ তাকায়, তবে সে তার স্ত্রী আর ছেলের চোখে তার জন্য শুধুমাত্র ঘৃণা দেখতে পায়। যা তার জীবনের সব সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে। কোথাও গিয়ে শান্তি পায়না। আর নিজের বাড়িতে থাকলে তার দু’টো প্রাণের ঘৃণা ভরা চাহনী দেখে মনে হয়, সে এক জা’হা’ন্না’মে পু’ড়’ছে।
আসমানীকে সে প্রথম দেখেই ভীষণ পছন্দ করেছিল। এরপর বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বিয়ে করে এনেছিল তার কাছে। কি শান্ত মেয়ে ছিল! সবসময় চোখ নামিয়ে কথা বলত তার সাথে। এরপর সে আসমানী নওয়ানকে তার সাথে সহজ হতে শেখায়। তার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে আসমানী নওয়ান সহজ হতে হতে তাকে শাসন পর্যন্ত করেছে। সাইফুদ্দীন নওয়ান স্ত্রীর ভালোবাসায় ভরা শাসন মাথা পেতে মেনে নিত। ভীষণ শান্তি পেত সে। এরপর তাদের ঘর আলো করে আসলো আকাশ। সেদিন আসমানী তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিল,
– আমি মা হইছি, আমার তো বিশ্বাস-ই হয় না। আমার ছেলেরে আমি আকাশের মতো উদার বানামু। ওর নাম আকাশ রাখি?
সাইফুদ্দীন নওয়ান হেসেছিলেন। স্ত্রীর কপালে চুমু খেয়ে আবদার করেছিলেন,
– তবে সেই সম্মোধনে একবার আমাকে ডাকো আসমানী।
আসমানী নওয়ান স্বামীর আবদার মেনে হেসে ডেকেছিল,
– আকাশের আব্বা?
সাইফুদ্দীন নওয়ান স্ত্রী-সন্তানকে একসাথে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। এরপর আকাশ ধীরে ধীরে বড় হলো। সাইফুদ্দীন নওয়ান নিজেই আকাশকে মায়ের নেওটা বানিয়েছিলেন। আকাশ তার মাকে ভালোবাসতো, সাইফুদ্দীন নওয়ান স্ত্রী-ছেলের ভালোবাসা মুগ্ধ হয়ে দেখতেন।
আকাশ মাঝে মাঝে রে’গে তার মায়ের সাথে উঁচু গলায় কথা বললে তিনি আকাশকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতেন। ভীষণ ভালোবাসে সাইফুদ্দীন নওয়ান তার স্ত্রীকে।
কিন্তু সময় আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে তাকে? কথাগুলো ভেবে সাইফুদ্দীন নওয়ানের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
হঠাৎ পিছন থেকে একজন বলে ওঠে,
– ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট মিস্টার সাইফুদ্দীন নওয়ান।
নিজের নাম অপরিচিত কণ্ঠে তাও আবার এরকম সম্মোধনে শুনে সাইফুদ্দীন নওয়ান অবাক হয়ে উল্টো ঘুরে তাকায়। তিনজন পুলিশকে দেখে ভদ্রলোক অবাক হয়। কিছু বলার আগেই একটু দূরে আকাশকে দেখে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। গলার মাঝে কথা আটকে যায়। বুকে চিনচিন ব্য’থা করে ওঠে।
আকাশ গম্ভীর মুখাবয়বে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে কাঠিন্য। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বাবার সামনে দাঁড়ায়। বাবার চোখে চোখ রাখে। সাইফুদ্দীন নওয়ান ছেলের চোখে চোখ মেলাতে পারেন না, এই ঘৃণাভরা চোখ তার শান্তি কেড়ে নেয়। কিন্তু আজ আকাশের চোখ থেকে দৃষ্টি সরালো না। ক’ষ্ট হলেও চেয়ে রইল। এতোটা অবাক বোধয় এর আগে কখনো কখনো হয়নি। ঢোক গিলল বেশ কয়েকবার। বহুক’ষ্টে বলতে চাইলো,
– তুমি…….
মাঝখান থেকে আকাশ শ’ক্ত গলায় বলে ওঠে,
– আমিই তোমার জেলে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি বাবা। চিন্তা কর না, সবচেয়ে নিম্নমানের জেলটা-ই তোমার জন্য বরাদ্দ করেছি। এতো মানুষকে মে’রে আর কত উল্লাস করবে? আর কত মু’ক্ত বাতাসে উড়বে? এবার নিজের আসল জায়গায় যাও, যা তোমার প্রাপ্য।
সাইফুদ্দীন নওয়ান এর চোখজোড়া ভরে উঠলো। ছেলের এতো তাচ্ছিল্য ভরা কথা বুকে কাঁটার ন্যায় বিঁধলো। সে সত্যিই উল্লাস করে?
আকাশ তার বাবার জলেভরা চোখ দেখে দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। ঢোক গিলে বলে,
– দয়া করে এসব মিথ্যা জল চোখে আনবে না। অ’মানুষদের চোখের জল আজীবন মিথ্যা। তারা অভিনয়ে পারদর্শী হয়।
সাইফুদ্দীন নওয়ানের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। নিজের ছেলেকে চিনতে পারেনা, বছর ঘুরে এলো। আজ যেন একটু বেশিই অচেনা লাগছে আকাশকে। ভাঙা গলায় ডাকলো,
– আকাশ?
আকাশ শুনলো না বাবার ডাক। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সাইফুদ্দীন নওয়ানের সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। এরপর পুলিশদের উদ্দেশ্যে বলে,
– অফিসার নিয়ে যান উনাকে।
পুলিশ সাইফুদ্দীন নওয়ান এর হাতে হাতকড়া পরায়। সাইফুদ্দীন নওয়ান অবাক হয়ে ছেলের পানে চেয়ে রইল। আকাশ উল্টো ঘুরে দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি অজায়নায়।
দু’জন পুলিশ সাইফুদ্দীন নওয়ান এর দু’পাশে দাঁড়ায়। এরপর ভদ্দলোককে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। সাইফুদ্দীন নওয়ান হাঁটল, তবে একবার-ও সামনে তাকাল না। ঘাড় বাঁকিয়ে ছেলের পানে তাকিয়ে রইল, যতক্ষণ দেখা যায়। চোখের কোণ ঘেঁষে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আকাশকে ডাকতে চাইল কয়েকবার। কিন্তু শ’ক্তিতে কুলালো না।
আকাশের দৃষ্টি ধোঁয়াশা সমুদ্রের পানে। পায়ের জুতো খুলে পানির দিকে এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে হাঁটু সমান পানিতে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রায় ২০ মিনিট একদম স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দু’টো লাল। নিজেকে কেন যেন ভীষণ একা লাগছে। শূণ্য লাগছে ভীষণ।
বিদেশ থেকে ফেরার পর, সে যখন প্রথম অফিসে জয়েন করল, তার বাবা তাকে হাতে-কলমে সব শিখিয়েছে। বিভিন্ন দেশে যাওয়া লাগলে, আকাশকে খুব কম পাঠাতো। বলতো,
– আকাশ তুমি তোমার মায়ের কাছে থাক। বাইরে আমি সামলে নিব।
আকাশ মায়ের কাছে থাকতো। চারবছরের জন্য আকাশ যখন পড়ার জন্য বিদেশ যায়, যাওয়ার আগে সাইফুদ্দীন নওয়ান বলেছিলেন,
– আকাশ তুমি তোমার মায়ের কাছে থাকলে, আমি বেশি খুশি হব।
আসমানী নওয়ান আকাশের বাবাকে চুপ করিয়ে ছেলেকে পড়াতে বিদেশ পাঠিয়েছিলেন।
আকাশ সেদিন তার বাবার কান্ডে হেসেছিল। মানুষ ছেলেমেয়েকে নিজের দিকে টানে, কিন্তু তার বাবা সবসময় তাকে তার মায়ের আঁচলের তলায় থাকার জন্য ঠেলত। সে বুঝত, তার বাবা তার মাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর সে তার বাবার ছোট্ট প্রাণ। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগে,
– যারা নিরপরাধ, নিরীহ, নির্দোষ মানুষদের অ’মানুষের মতো মে’রে ফেলে। তারা কি আদোও ভালোবাসতে পারে? বাবা কি তাকে আর মাকে সত্যি ভালোবেসেছিল? না-কি অভিনয় করতে ভালো লাগতো বলে এমন করত? আকাশের মনে আছে, সে ছয়টি পোড়া লা’শের মাঝে একটি বাচ্চার কয়লা পেয়েছিল। কি জানি সে কে ছিল! আকাশ তো চেনে না। কিন্তু ওই বাচ্চাটার কি দোষ ছিল? ওই বাচ্চাটার খু’নি-ও তার বাবা।
কথাগুলো ভেবে আকাশের দম আটকে আসে। হাঁটু সমান পানিতে হাঁটু গেড়ে বসে। মৃদু বাতাস আকাশের গা ছুঁয়ে যায়। বাতাসের তোড়ে সমুদ্রের পানিতে ঢেউয়ের মাত্রা বাড়ে। পানির ঢেউ একটু পর পর আকাশের কোমরে এসে ধাক্কা খায়। তার দৃষ্টি বাতাসে দুলতে থাকা পানির দিকে। স্বচ্ছ পানিতে তার বাবার কিছুক্ষণ আগের জলেভরা চোখ দু’টো যেন ভাসলো। আকাশ ঢোক গিলল। ধীরে ধীরে চোখজোড়া ঝাপসা হতে থাকে। দু’হাতের মাঝে মুখ রেখে চোখ বুজে নেয়। অসহায় কণ্ঠে বিড়বিড় করে,
– বাবা!
আরও একদিন পেরিয়েছে।
ঘন জঙ্গল। চারিদিকে শুনশান, নিরব, নিস্তব্ধ। থেকে থেকে দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। শুকনো পাতা মাড়িয়ে দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাচ্ছে একজোড়া পা। মুখে মাস্ক, ডান হাতে পিস্তল।, বা হাতে ছুড়ি। চোখেমুখে কাঠিন্য।
পিছন পিছন বায়ান ভীতু হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে। একটু পর পর আশেপাশে তাকালে তার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু থেমে গেলে স্যার তাকেই গু’লি করে খুলি উঠিয়ে দিবে।
হঠাৎ-ই সামনে একটু আলোর দেখা পেয়ে বায়ান সামনে দৌড় দেয়। চেঁচিয়ে বলে,
– স্যার আলো পেয়েছি, আলো পেয়েছি।
আকাশ রে’গে বলে,
– আর একটা বা’জে বকলে আগে তোমরা গ’লা কা’ট’ব।
বায়ান চুপসে যায়। আকাশের পা থেমে নেই। বায়ান-ও আকাশের পাশে হাঁটছে। আরও কিছুদূর গেলে বায়ানের কানে কারো গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসে। বায়ান ঢোক গিলল। মিনমিন করে বলে,
– স্যার আপনি কি ভূত ধরার এক্সপেরিমেন্ট করতে এসেছেন?
আকাশ থেমে যায়। রে’গে তাকায় বায়ানের দিকে। একটু-আধটু অন্ধকারে আকাশের চোখদু’টো শুধু দেখা গেল। বায়ান ঢোক গিলে বলে,
– স্যার আমার মনে হচ্ছে, ভূতের এক্সপেরিমেন্ট করতে এসে আপনাকেই ভূতে ধরেছে।
কথাটা বলতেই আকাশ বা হাতের ছুড়ি বায়ানের গলায় ঠেকায়। বায়ান চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ম’রার শখ জেগেছে? এজন্য ফা’লতু কথা বন্ধ করছ না, তাইনা?
বায়ান কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– না না স্যার! আর কিছু বলব না। আমাকে ছেড়ে দিন স্যার।
আকাশ বায়নকে ছেড়ে আবার-ও হাঁটতে শুরু করে। পায়ের গতি বাড়িয়েছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় আকাশ। সাথে বায়ান-ও দাঁড়ায়। এখানে একটা ছোট্ট লাইট জ্বালানো। আলো খুবই অল্প। কিন্তু সামনে দু’টো গাছে দু’জন মানুষ বাঁধা। বায়ান জিজ্ঞেস করে,
– ওরা কারা স্যার?
আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– তোমার শ্বশুর।
বায়ান মাথা চুলকে বলে,
– আমি তো একটাও বিয়ে করলাম না। এরই মধ্যে দু’টো শ্বশুর হয়ে গেল?
আকাশ রে’গে তাকালে বায়ান চুপসে গিয়ে বলে,
– স্যরি স্যার! আপনি যখন বলেছেন তখন ওরা আমার শ্বশুর-ই হবে!
আকাশ বায়ানের কথা কানে নিল না। লোকদু’টোর হাত, পা, মুখ সব বাঁধা। শুধু চোখ খোলা। চোখেমুখে ভীতি। আকাশ ডান হাতের পি’স্ত’ল বা হাতে নিল। এরপর মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলে দেয়। লোকদু’টো আকাশের মুখ দেখে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। আকাশ ডান হাতে ছুড়ি নিয়ে, বা হাতে পি’স্ত’ল ধরে শ’ক্ত করে। কয়েকবার এপাশ-ওপাশ ঘুরে ঘুরে হাঁটে। লোকদু’টো ছটফট করে।
আকাশ হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় চারিদিকে ঘোরায় কয়েকবার। এরপর হঠাৎ-ই ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে, একটি লোকের পায়ের গিরার একটু উপরে ছুড়ি গেড়ে দেয়।
লোকটি বোধয় গগণ কাঁপানো চিৎকার দিয়েছে, কিন্তু মুখ বাঁধা থাকায় শুধু উমউম শব্দ বের হলো। বায়ান ভীত চোখে চেয়ে আছে।
আকাশ লোকটির পায়ে গেড়ে দেয়া ছুড়ি সর্বশক্তি দিয়ে ঘোরায় কয়েকবার। লোকটি গলাকাটা মুরগির ন্যায় ছটফটাতে চাইলেও পারলো না, বাঁধা থাকায়। আকাশ উঠে দাঁড়ায়। লোকটির পায়ে গেড়ে রাখা খাড়া ছুড়ির উপর আকাশ তার বাম পা রাখে। এরপর আকাশ লোকটির দিকে তাকায়। ঠাণ্ডা গলায় বলে,
– তোদের যত নৃ’শং’স’ভাবেই মা’রি না কেন, আমার মনের জ্বালা মিটবে না।
কথাটা বলে লোকটির অপর পায়ে পরপর পুরো ছয়টি গু’লি করে দেয়।
কথাগুলো বলে বায়ান ঢোক গিলল। নিয়াজ চিন্তিত মুখে বায়ানের দিকে চেয়ে আছে। বায়ানের প্রেশার হাই হয়ে গিয়েছিল। এজন্য মূলত আকাশ তার কাছে বায়ানকে এনেছে কিছুক্ষণ আগে।
নিয়াজ বুঝেছে, বায়ান কিছু দেখে ভ’য় পেয়ে এই অবস্থা হয়েছে।
আজ সন্ধ্যার পর পর আকাশ বায়ানকে নিয়ে কোথায় যেন গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে আকাশ কাহিনী ঘটিয়েছে। বায়ানের বলা এটুকু কাহিনী শুনে নিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলে,
– তোমার তো দেখছি, হার্ট খুব দুর্বল। এটুকুতেই হার্ট অ্যাটাক করতে নিচ্ছিলে?
বায়ান ঢোক গিলে বলে,
– না স্যার। এটুকু নয়। আরও আছে। আপনাকে তো আমি মাত্র ডেমো ক্লাসের কথা বললাম।
নিয়াজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তাহলে বাকিগুলোও বলো।
বায়ান ঢোক গিলে বলে,
– এসব বললে আমি সত্যিই হার্ট-অ্যাটাক করব। আর বলতে পারব না স্যার।
নিয়াজ কিছু বলল না। বায়ান হঠাৎ বলে ওঠে,
– জানেন স্যার, আপনার বন্ধু ওই লোকদু’টোর ভবিষ্যৎ কেটে ফেলেছে।
কথাটা শুনে নিয়াজ কেশে ওঠে। অতঃপর বলে,
– আকাশ আমার বন্ধু নয়।
বায়ান কিছু বলল না। এদের ভেতরকার খবর সে জানে। এতোবছর থেকে দেখছে বুঝবে না? কেউ মুখে স্বীকার করেনা।
রাত ১২ টার কাছাকাছি। আকাশ দরজা ঠেলে কেবিনের ভেতর প্রবেশ করলে নিয়াজ তাকায়। বায়ান আকাশকে দেখে ঢোক গিলল। আকাশের গায়ে পাঞ্জাবির উপর একটা পাতলা কাপড় জড়িয়েছে চাদরের মতো করে। এগিয়ে এসে বায়ানের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
– এখন কি অবস্থা তোমার?
বায়ান ঢোক গিলে। কথা বের হচ্ছে না তার। আকাশ বায়ানকে চুপ দেখে ধমকে বলে,
– কি প্রবলেম তোমার? কথা বলছ না কেন? থা’প্প’ড় খেতে চাইছ?
নিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
– বাদ দাও। ও ভ’য় পাচ্ছে। হার্ট দুর্বল। কিন্তু তুমি না-কি সেই লোকদু’টোর ভবিষ্যৎ কেটে নিয়েছ!
আকাশ হাতের ব্যাগের ভেতর থেকে সাদা পাঞ্জাবি, প্যান্ট বের করে বলে,
– হুম।
নিয়াজ অবাক হয়ে বলে,
– লোকদু’টোর ভবিষ্যৎ এভাবে কেটে নিলে?
আকাশ আবার-ও ছোট করে বলে, – হুম।
নিয়াজ আগের চেয়েও অবাক হয়ে বলে,
– কিভাবে করলে এই কাজ?
আকাশ বিরক্ত চোখে তাকায়। বা হাতে ডান হাতের পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে এগিয়ে আসে আর গম্ভীর গলায় বলে,
– এসো তোমাকে প্রাকটিক্যালি করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
নিয়াজ দ্রুত দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলে,
– এই না, দূরে থাকো।
বায়ান মুখ টিপে হাসে। আকাশ বিরক্ত হয়। পাঞ্জাবির উপর থেকে চাদর সরিয়ে নিলে র’ক্তে লাল রঞ্জিত পাঞ্জাবি উম্মুক্ত হয়। নিয়াজ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। ঢোক গিলে বলে,
– এসব কি আকাশ?
আকাশ কিছু বলে না। ওয়াশরুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর পাঞ্জাবি-প্যান্ট পাল্টে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে আকাশ। নিয়াজ থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। আকাশকে দেখে আবার-ও জিজ্ঞেস করে,
– তুমি ওই লোকদু’টোর সাথে কি করেছ?
আকাশ দু’হাতের পাঞ্জাবির হাতা খুব সুন্দর করে কনুই পর্যন্ত গোটালো। এরপর নিয়াজের দিকে চেয়ে বাঁকা হেসে বলে,
– করলাম তো অনেককিছু। কোনটা রেখে কোনটা বলব? আগামীকাল ট্রেইলার দেখতে পাবে। পরে কখনো সময় করে গল্প করা যাবে।
এটুকু বলে থামে আকাশ৷ এরপর বাইরে যেতে যেতে বলে,
– আমার কাপড়গুলো সরিয়ে ফেলো। নয়তো তুমি ফাঁসবে।
নিয়াজ অবাক হয়ে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। অতঃপর বলে,
– অকাজ তুমি করলে। আমি কেন ফাঁসবো?
আকাশ কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে স্বাভাবিক গলায় বলে,
– কারণ আমি ফাঁসাবো।
নিয়াজ বাকহারা হয়ে চেয়ে রইল। মানে একে কি করা উচিৎ? সে সাহায্য-ও করবে। আবার সেই ফাঁসবে। নিয়াজ কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে রইল আকাশের প্রস্থানের দিকে। তবে তার আকাশকে সুবিধার লাগলো না। রাজনীতির ব্যাপারে একটু-আধটু ধারণা তার আছে। কিন্তু এই আকাশকে কেমন যেন একটু বেশিই অদ্ভুদ লাগছে। বুঝতে পারছে না ঠিক।
বায়ান ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বসে আছে। খুব ভালোই বুঝল, সে আকাশের পিএ হয়ে ফেঁসে গিয়েছে। আর নিয়াজ আকাশের শ’ত্রুরূপি বন্ধু হয়ে ফেঁসেছে।
ঘড়িতে সময় ১২:৩০। আকাশ হসপিটাল থেকে ফিরেছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে শিমুর ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিল। ঘর অন্ধকার। অবাক হলো না। সন্ধ্যা এখন লাইট অফ করেই ঘুমায়। ঔষধ খেয়ে প্রায় ৯৯% রিকোভার করেছে সে। ঘরের লাইট অফ থাকলেও জিরো লাইট জ্বালানো। এজন্য ভেতরে স্পষ্ট দেখা গেল। শিমু বেডে ঘুমিয়ে থাকলেও সন্ধ্যা নেই। আকাশের ভ্রু কুঁচকে যায়। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বাথরুমের দরজা চেক করলে দেখল নেই। চিন্তিত হলো। তার সন্ধ্যামালতী কোথায় গেল? বুক টিপটিপ করছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেল। দ্রুতপায়ে বেলকনিতে গিয়ে দেখল, সন্ধ্যা উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ এক সেকেন্ড-ও সময় ন’ষ্ট না করে সন্ধ্যাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। আকাশ ধরেছে বুঝতে পেরে একটুও নড়লো না।
আকাশ সন্ধ্যার কাঁধে একটা চুমু খেয়ে বলে,
– ভ’য় পাইয়ে দিয়েছিলে সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ সন্ধ্যাকে তার দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– ঘুমাওনি কেন?
সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকায়। হাতে তার ফোন ছিল। লিখল,
– আপনি আজ সারাদিন কোথায় ছিলেন?
আকাশ লেখাটি পড়ে একটু হাসল। তার বউ তার জন্য চিন্তা করবে। ইশ! এমন একটা দিনের জন্য সে কতদিন অপেক্ষা করেছে! আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন পেয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যাকে জড়িয়ে নিয়ে মৃদুস্বরে ডাকে,
– বউ?
সন্ধ্যা চোখ বুজে নেয়। আকাশ আবার-ও বলে,
– আমি যেখানে ছিলাম তুমি সেই জায়গাটি চেনো সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যা অবাক হয়। আকাশ কোথায় ছিল, সে কিভাবে চিনবে? আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে সন্ধ্যার দু’গাল দু’হাতের আঁজলায় নেয়। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
– একটা ঘরে ছিলাম। সেই ঘরের নাম তুমি জানো।
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ঘরের আবার নাম থাকে? সে তো কখনো শোনেনি। মাথা নাড়িয়ে বোঝায়,
– সে জানেনা।
আকাশ হেসে ফেলল। সন্ধ্যা বোকাচোখে তাকায়। আকাশের আজগুবি কথা রেখে সে ফোনে টাইপ করে,
– আমি বকুল গাছতলায় যেতে চাই। আপনি যাবেন?
আকাশ অবাক হলো। সন্ধ্যা তাকে এভাবে অফার করছে? বিশ্বাস-ই হয়না তার। আকাশ মাথা নিচু করে আবার-ও একটু হাসলো।
এরপর সন্ধ্যার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে,
– তুমি ঘরের নাম জানো সন্ধ্যামালতী। একটু ভেবে উত্তর দিও। আমি অপেক্ষা করব।
আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে বকুল গাছতলায় এসেছে। চারিদিকে অন্ধকার। তবে চাঁদের আলোয় চারপাশটা জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা নিচু হয়ে শুকিয়ে যাওয়া বকুল ফুল কুড়ায়। বিকালবেলা আসলে তাজা ফুল পাওয়া যায়। সন্ধ্যার মনে ছিল না। এই রাতে বেলকনিতে এসে গাছটি দেখে অনেকগুলো মাস পর আবারও ফুল কুড়ানোর ইচ্ছে জাগলো। শুকনো ফুল, তাতে কি? ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে এই অনেক।
আকাশ দু’হাত আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সন্ধ্যার পানে। সন্ধ্যার চুলগুলো মাটি ছুঁয়েছে। মেয়েটি কি মনোযোগ সহকারে ফুল কুড়াতে ব্যস্ত। আকাশের মনে পড়ল, প্রায় একবছর আগের কথা। এক বিকেলে সন্ধ্যা এভাবেই ফুল কুড়াচ্ছিল। আর সে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল। সেদিন তাদের মাঝে কত দূরত্ব ছিল! আজ তাদের মাঝে দূরত্ব কমেছে।
আকাশ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় সন্ধ্যার পাশে। সন্ধ্যা দু’হাত ভর্তি করে বকুল ফুল কুড়িয়েছে।
আকাশ সন্ধ্যার পাশে মাটিতে বসল। সন্ধ্যা আকাশকে খেয়াল করে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ বা হাতে সন্ধ্যাকে টেনে তার কোলে বসালো। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ ডান হাতের দুই-আঙুল দিয়ে সন্ধ্যার কপালে একটা টোকা দিয়ে বলে,
– চোখ ছোট কর। দেখতে পেত্নীদের মতো লাগে।
সন্ধ্যা চোখ পাকিয়ে তাকায়। আকাশ হেসে তার বুকে ডান হাত রেখে একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
– হায় আল্লাহ! মারাত্মক ভ’য় পেলাম তো বউ!
সন্ধ্যা আকাশের ভঙিমায় না চাইতেও একটু হাসলো। সাথে সাথে আবার হাসি থামায়। নয়তো আকাশ এটা নিয়েও মজা করবে, সে জানে।
সন্ধ্যার দু’হাতের মুঠোয় থাকা ফুলগুলো আকাশ তার এক হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আকাশ সন্ধ্যার মুখের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– বকুল ফুলের গল্প আরেকদিন শোনাবো তোমায়। আজ এসব রাখো বউ।
সন্ধ্যার মনে হলো,, আকাশের কণ্ঠ কেঁপেছে। সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকালে আকাশের দৃষ্টিতে তার দৃষ্টি মিলিত হলে মেয়েটি থমকায়। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। আকাশের কোল থেকে উঠতে নিলে আকাশ দু’হাতে সন্ধ্যাকে তার সাথে শ’ক্ত করে চেপে ধরে। ডান হাত সন্ধ্যার শাড়ির ভাঁজে রাখে। সন্ধ্যা দু’হাতে আকাশের হাত চেপে ধরে। শুকনো ঢোক গিলে তাকায়।
আকাশ সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে মোহনীয় গলায় বলে,
– ১০০ হাত দূরত্ব কমিয়ে পাশে বসতে দিয়ে নিজেই তো সর্বনাশ করলে। এবার তোমার মাঝে আমায় ভাসতেই হবে সন্ধ্যামালতী।
এটুকু বলে সন্ধ্যার গলায় মুখ গুঁজে আকাশ। ডান হাতে সন্ধ্যার উম্মুক্ত পেটে আলতো করে হাত বুলায়। চোখ বুজে রেখে সন্ধ্যার গলায় নাক ঘষে অধৈর্য গলায় বলে,
– উফ! আর ওয়েট করা যাবে না। কনফার্ম বউ।
সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। আকাশ মাথা উঁচু করে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে রেখেছে। আকাশ সন্ধ্যাকে তার কোলে বা হাতের উপর হঠাৎ-ই আধশোয়া করে দেয়। সন্ধ্যা চোখ বড় বড় তাকায়। উঠতে নেয়, তার আগেই আকাশ তার মুখ এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার ঠোঁটজোড়া নিজের আয়ত্তে নিয়ে নেয়। সন্ধ্যার শরীর নেতিয়ে পড়ে। চোখ বুজে নেয়। আকাশ বা হাতের উপর ছেড়ে দেয়া সন্ধ্যার শরীর তার বুকে টেনে নেয়। সন্ধ্যাকে ছাড়েনি। ডান হাতে সন্ধ্যার কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল নামিয়ে দেয়। দু’হাতে সন্ধ্যাকে নিজের সাথে শ’ক্ত করে জড়িয়ে নেয়।
সন্ধ্যা একটুখানি ছটফটালো ছাড়া পাওয়ার জন্য। আকাশ ছাড়লো না। ওভাবে সন্ধ্যাকে নিয়ে শ’ক্ত মাটিতে শুয়ে পড়ে। আকাশের হাতের বিচরণ এলোমেলো হয়।
সন্ধ্যা আকাশের হাবভাব বুঝে ছটফট করে। এই লোক কি পা’গ’ল? কোথায় কি করে। সন্ধ্যার ছটফটানি বাড়লেও আকাশের হুশ নেই। এক পর্যায়ে সন্ধ্যা দু’হাতে আকাশকে জোরে ধাক্কা দেয়। আকাশ একটু সরে যায় সন্ধ্যার উপর থেকে। সন্ধ্যা দ্রুত উঠতে নিলে আকাশ দু’হাতে সন্ধ্যাকে শ’ক্ত করে চেপে ধরে। ধমকে ডাকে,
অন্তঃদহন পর্ব ৩৫
– সন্ধ্যামালতী?
সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। আকাশ ঢোক গিলল। সন্ধ্যার গলায় দু’টো চুমু খেয়ে নরম গলায় বলে,
– ডিস্টার্ব কর না বউ। রে’গে যাচ্ছি আমি।
