অন্তঃদহন পর্ব ৩৯
DRM Shohag
আকাশ গ্যারেজে গাড়ি রেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। অপর পাশের দরজা খুলে দিলে সন্ধ্যা বেরিয়ে আসে। তখন-ই সৌম্য এসে সেখানে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার উদ্দেশ্যে বলে,
– বোনু তুই ভিতরে যা। আকাশ ভাইয়ার সাথে আমার কথা আছে।
সন্ধ্যা আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ সৌম্য’র দিকে চেয়ে আছে। সন্ধ্যা মাথা নেড়ে বাড়ির দিকে গেল। আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কি বলবে?
সৌম্য বলে,
– আপনি কি তখন আমাকে মিথ্যা বলেছিলেন?
আকাশ মুখ গম্ভীর করে বলে,
– আমি মিথ্যা বলিনা।
সৌম্য’র কপালে চিন্তার ভাঁজ। কিছু বলার আগেই আকাশ শ’ক্ত গলায় বলে,
– আজকের নিউজে দেখানো লোকদু’টো আমার বউয়ের পিছনে লেগেছিল। তাছাড়া ওরা এর আগে বেহিসাব রে’প করেছে। ওদের কাজ-ই ওটা ছিল। যার হাত কেটেছি, সে ভালো মানুষ হলে রাস্তায় মেয়েদের ব্যাড টাচ করত না।
আকাশ কথাগুলো ভীষণ সিরিয়াসভাবে বলল। সৌম্য বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আকাশ মোটেও মজা করছে না, সৌম্য বুঝল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। উপর থেকে দেখতে কি ইনোসেন্ট লাগে। এখন-ও লাগছে। আর ভেতরে কি! আকাশ দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রেখে সৌম্য’র দিকে চেয়ে বাঁকা হেসে বলে,
– ইন ফউচার তোমাকে আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বানাবো। তোমার সম্মতি লাগবে না। বড় ভাইয়ের সম্মতি আছে। এতেই চলবে।
সৌম্য অদ্ভুদ চোখে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। একটু চুপ থেকে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– আপনি কি সত্যিই অগণিত…….
আকাশ মাঝখান থেকে বলে,
– যা ভাবছ তাই।
কথাটা বলে সৌম্য’র দিকে চেয়ে সূক্ষ্ম হাসলো আকাশ। এরপর বলে,
– তুমি আবার তোমার বোনের মতো দয়ার সাগর না-কি! হলে হতেই পারো। কিন্তু আমি নই।
লাস্ট কথাটা শ’ক্ত করে বলে। সৌম্য বলতে চাইল, সে দয়ার সাগর নয়। কিন্তু কিছু বলল না। সে আকাশের মতো খু’ন করার সাহস না রাখলেও, আকাশের করা কাজ তার উপর বিশেষ প্রভাব ফেলল না।
আকাশ পকেট থেকে সিগারেট বের করে দুই ঠোঁটের ফাঁকে রাখে। লাইটার দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে লাইটার প্যান্টের পকেটে রাখে। সৌম্য অবাক কণ্ঠে বলে,
– আপনি সিগারেট খান?
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– চোখের পাওয়ার কমলে ডাক্তার দেখাও।
সৌম্য বিরক্ত হলো। উপর উপর এতো ভালো সেজে থাকে। ভেতরে বাজে স্বভাব দিয়ে ভরা। আকাশ চুপচাপ সিগারেট এর অর্ধেক শেষ করে। এর মধ্যে সৌম্য কয়েকবার কেশেছে। আকাশ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– মেয়ে মানুষের মতো কাশছ কেন?
সৌম্য কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– কারণ আমি আপনার মতো অ’স’ভ্য নই।
আকাশ শেষবার সিগারেট এর ধোঁয়া উড়িয়ে তার আধখাওয়া সিগারেট সৌম্য’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– পকেটে একটাই ছিল। এটা দিয়ে চালিয়ে নাও।
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– সিগারেট খাই না আমি।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– এতো ভদ্র?
সৌম্য কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। মৃদু হেসে বলে,
– জন্ম থেকে নিম্নবিত্তদের মতো-ই বেঁচেছি। সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছা কখনো জাগেনি। কারণ সেই টাকা জমিয়ে আমি আমার বোনুকে কখনো খাবার কিনে দিতাম, নয়তো কখনো জামা কিনে দিতাম।
আকাশ সিগারেট টি ঠোঁটেের ভাঁজে রাখতে গিয়ে-ও থেমে যায় সৌম্য’র কথা শুনে। বেশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে,
– আমার চোখে ভাইবোনের সেরা জুটি আমার বউ সন্ধ্যা আর আমার ভাই সৌম্য।
আকাশের কথা শুনে সৌম্য’র মুখে হাসি ফোটে। মনে মনে হেসে বলে,
– তার মানে আপনি মানেন, আমি আপনার ভাই। ঠিক যেমন আমার বোনু আপনার বোন।
কথাটা শুনতেই আকাশ সৌম্য’র দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকায়। তার কী সুন্দর অনুভূতির একদম রফাদফা করে দিল। সৌম্য বলে,
– আমি এই বাসায় থাকব না।
কথাটা শুনতেই আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কেন?
– এমনি।
আকাশ রে’গে বলে,
– বুঝলাম না। তোমার প্রবলেম কি?
সৌম্য চুপ থাকলো। এটা তো তার বাবার বাড়ি নয়। আকাশের বাবার বাড়ি। সৌম্য’র ভীষণ আনইজি লাগে। এই চিন্তাটা তার আকাশের বাবা এইখানে আসার পর থেকে হচ্ছে। এইখানে থাকা তার সম্মানে লাগছে। আকাশ বা হাতে সৌম্য’র কলার ধরে তার দিকে ফিরিয়ে রে’গে বলে,
– বড় ভাই আমি তোমার। ফাতরামি করব না তোমার সাথে। তোমার আত্মসম্মান তোমার পায়ের তলায় রেখে চুপচাপ ঘরে যাও। বেশি সম্মানে লাগলে বাড়ির অর্ধেক তোমার নামে লিখে দিচ্ছি।
আকাশের কথায় সৌম্য অবাক হয়। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলে,
– আমি আপনার বাবার বাড়ি থাকতে পারবো না। ক্ষমা করবেন। আপনি ফিউচারে নিজের টাকায় বাড়ি করলে নাহয় আমি নিজ দায়িত্বে বড় ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ভাগ বসাবো।
সৌম্য’র কথায় আকাশের দৃষ্টি শীতল হয়। সৌম্য’র কলার ছেড়ে দেয়। ডান হাতের বাকি সিগারেট মুখে দেয়। চোখেমুখে বিরক্তি। সৌম্য গলা ঝেড়ে বলে,
– আপনার মা আপনার কথা শোনে। আপনি একবার উনাকে বুঝিয়ে বলবেন?
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,
– পারবো না।
কথাটা বলে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে নিলে সৌম্য পিছু ফিরে বলে,
– বোনু সিগারেট খাওয়া ছেলেদের সহ্য করতে পারেনা।
আকাশের পা থেমে যায়। হাতে সিগারেট এর ছোট্ট অংশটুকুর দিকে একবার তাকায়। এরপর হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
– আচ্ছা।
কি যেন ভেবে একটু হাসল।
আকাশের ছোট্ট কাজটুকু সৌম্য’র ভালো লাগলো। সে একটাসময় ভাবতো, তার বোনুকে ডিভোর্সি ট্যাগ নিয়ে ঘুরতে হবে। পরবর্তীতে বিয়ে হলেও সে ডিভোর্সি মেয়েকে নিবে কি-না! তার বোনু আবার কথা বলতে পারেনা। এতো খুঁত নিয়ে কেউ কিভাবে মানবে তার বোনকে। সময় সবকিছু বদলে দেয়। হয় সুখ দিয়ে নয়তো দুঃখ দিয়ে।
এসব ভাবনার ইতি ঘটালো। তার বোনুকে রেখে যেতে হবে ভাবলেই খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবে? এখানে থাকতে পারবে না সে।
সৌম্য আসমানী নওয়ানকে অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করিয়েছে, সে এইখানে থাকবেনা। যদিও আসমানী নওয়ান এখনো পুরোপুরি রাজি নয়। সৌম্য কে অনেক বোঝালো। সৌম্য উল্টে আসমানী নওয়ানকে বোঝায়। শেষমেশ হতাশ হয়েছে।
আকাশ সৌম্য’র উদ্দেশ্যে বলে,
– গাড়িত গিয়ে বসো। রেখে আসছি।
সৌম্য সাথে সাথে বলে,
– রিক্সায় যাবো।
আকাশের প্রচন্ড রা’গ লাগছে। ইচ্ছে ঠাস করে একটা থা’প্প’ড় লাগাতে। ডান হাতের পাঞ্জাবির হাত উপরে তুলতে তুলতে তার মায়ের উদ্দেশ্যে রে’গে বলে,
– মা তোমার ছোট ছেলেকে কিছু বলো। নয়তো আমি এখন একে চড়ানো শুরু করলে থামবো না বলে দিলাম।
আকাশের কথা শুনে সৌম্য বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– আমি রিক্সায় গেলে আপনার কি প্রবলেম?
আকাশ রে’গে বলে,
– আমার অনেক প্রবলেম।
সৌম্য থমথমে কণ্ঠে বলে,
– আমি যেভাবে অভ্যস্ত, এর বাইরে যেতে পারবো না।
আকাশ বিরক্ত হলো। তবে কিছু বলল না।
আসমানী নওয়ান ইরার গালে হাত দিয়ে বলে,
– সাবধানে থাকবি মা। ছেলেরা সব ঘাড়ত্যাড়া হয়। কেউ আমার কথা শোনেনা। তুই কিন্তু প্রতিদিন আমার সাথে দেখা করতে আসবি।
ইরা মাথা নেড়ে বোঝায় আসবে। সৌম্য বুঝেছে আসমানী নওয়ান কথাটা তাকেই বলেছে। কিছু বলল না। আকাশ বিরক্তি চোখে চেয়ে আছে।
সৌম্য এগিয়ে এসে সন্ধ্যার গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– আমি তোকে প্রতিদিন দেখে যাবো বোনু।
সন্ধ্যা দু’হাতে তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে। গত একবছর সন্ধ্যা তার ভাইকে ছাড়া একদিন-ও থাকেনি। এখন কিভাবে থাকবে? সন্ধ্যার চোখের কোণে পানি জমেছে। সৌম্য সন্ধ্যার মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলে,
– আজকে আমার সাথে ওই বাড়ি যাবি বোনু?
সন্ধ্যা মাথা তুলে ভাইয়ের দিকে তাকায়। এখন একটু ভালো লাগছে। সম্মতি দেয়, সে যাবে। তখন-ই
আকাশের দিকে চোখ পড়লে সন্ধ্যা ঢোক গিলল।
আকাশ আগেই বুঝেছে, এই ভাই-পা’গ’ল মেয়ে ভাইয়ের লেজ ধরবে। ধরলো-ও। রা’গ হলো। কিন্তু সে কিছু বলল না। বড় বড় পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। দোতলায় উঠে হাতের কাছে একটা ফুলদানি পেয়ে সামনে ছুঁড়ে মা’রে। ফুলদানিটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়। আকাশ কোনোদিকে তাকালো না। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে তার রুমে গিয়ে ধারাম করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
নিচে থেকে সবাই কেঁপে ওঠে। আসমানী নওয়ান চুপচাপ দেখলেন ছেলের কান্ড। সৌম্য ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। সে কি তার বোনকে একেবারে নিয়ে যেতে চেয়েছে? আজব পাবলিক!
এদিকে সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ তার উপর রে’গে গিয়েছে বুঝল।
সৌম্য সন্ধ্যার মাথায় হাত রেখে বলে,
– আমি আকাশ ভাইয়াকে বুঝিয়ে বলব বোনু। তুই রেডি হয়ে আয়।
আকাশ রা’গ করেছে বলে সন্ধ্যার খারাপ লাগছে। এইতো কিছুক্ষণ আগেও তার সাথে কি সুন্দর করে কথা বলল। সন্ধ্যা মাথা নিচু করে বোঝায়,
– সে যাবেনা।
সৌম্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে তো চাইলেও সন্ধ্যাকে আর জোর করতে পারবে না। সেই অধিকার তো তার নেই। সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু হেসে বলে,
– আমি কালকেই আসব বোনু। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবি। আর আকাশ ভাইয়া কিছু বললে আমাকে মেসেজ পাঠাবি। আমি সাথে সাথে তোকে এখান থেকে নিয়ে যাবো।
সন্ধ্যা ভাইয়ের কথায় একটু হাসলো। সৌম্য সন্ধ্যাকে আরেকবার জড়িয়ে ধরে। এরপর সৌম্য আসমানী নওয়ানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আসমানী নওয়ান মুখ ফিরিয়ে নেয়। সৌম্য’র উপর রে’গে আছেন তিনি। সৌম্য একটু হাসলো। নিজে থেকেই আসমানী নওয়ানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আপনাকে আমি প্রতিদিন দেখতে আসব মা।
সৌম্য’র মুখে মা ডাক শুনে আসমানী নওয়ান অবাক হলেন। সৌম্য আজকেই প্রথম ডাকল তাকে মা বলে। ভদ্রমহিলার চোখজোড়া ভিজে যায়। সৌম্য’র পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
– না আসলে তোমার বাড়ি যাইয়া বেতের বারি দিমু। বুঝছো আব্বা?
সৌম্য হাসলো।
সৌম্য চলে গেলে সন্ধ্যা দোতলায় এসে আকাশের ঘরের সামনে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজার পানে বেশ অনেকক্ষণ চেয়ে থাকে। হাত বাড়িয়ে দরজা ঠেললে বুঝল, ভেতর থেকে দরজা আটকানো। সন্ধ্যা দরজা ধাক্কালো। কিন্তু দরজা খোলেনা। অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কালো সন্ধ্যা।
প্রায় ১০ মিনিটের মাথায় আকাশ দরজা খুলে দেয়। সন্ধ্যা আকাশকে দেখে ইশারায় কিছু বোঝাতে গেলে আকাশ সন্ধ্যার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যা বিস্মিত হয়। দ্রুত উল্টো ঘুরে তাকালে দেখল আকাশ নিচে নামছে। সন্ধ্যা দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায়। আকাশের পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। নিচে নেমে আকাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আকাশ এবারে-ও সন্ধ্যাকে না দেখার ভান করে সন্ধ্যাকে পাস করে বাইরের দিকে যায়।
আসমানী নওয়ান ছেলের কান্ড দেখে বলেন,
– আকাশ জান্নাতের সাথে এরকম করতাছ ক্যান?
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,
– কাউকে লাগবেনা আমার। তোমার জান্নাতকে রেডি হতে বলো। আমি অফিসে গিয়ে বায়ানকে পাঠাচ্ছি। বায়ান তোমার জান্নাতকে তোমার জান্নাতের ভাইয়ের কাছে রেখে আসবে।
আকাশ কথাগুলো বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা টলমল দৃষ্টিতে আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আসমানী নওয়ানের সামনে গিয়ে বোঝায়,
– খালাম্মা তোমার ছেলেকে বলো, আমি কোথাও যাবো না।
আসমানী নওয়ান হাসলেন ছেলে, ছেলের বউয়ের কান্ডে। সন্ধ্যার থুতনিতে হাত রেখে বলে,
– আচ্ছা বলব। তুই কাঁদছিস কেন? এইটুকুতে কেউ কাঁদে? পা’গ’লি মেয়ে। আকাশ বাড়ি ফিরেই তোর সাথে আবার কথা বলবে।
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নিল। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার হাত ধরে তার ঘরে যায়।
সৌম্য, ইরা দু’জন পাশাপাশি রিক্সায় বসা। সৌম্য খেয়াল করেছে, কার্জন হলে ইরার সাথে রা’গ করার পর থেকে ইরা কেমন মনমরা হয়ে আছে। সৌম্য মৃদুস্বরে ডাকে,
– ইরাবতী?
ইরা সাথে সাথে সৌম্য’র দিকে তাকায়। সৌম্য তাকিয়ে রইল ইরার দিকে। ইরাবতী তার ডাকে সবসময় চিলের মতো সাড়া দেয়। সে সত্যিই বুঝে পায় না, ইরাবতী তাকে কেন এতো ভালোবাসে! সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– এখন-ও অভিমান করে আছিস?
ইরা মাথা নিচু করে বলে,
– নাহ!
ইরার নজরে পরিচিত জায়গা পড়ে। মাথা তুলে সৌম্য’র দিকে চেয়ে বলে,
– একবার তোকে বিরক্ত করি সৌম্য?
সৌম্য তাকিয়ে রইল ইরার দিকে। তার ভীষণ খারাপ লাগছে। তার ইরাবতী এখন-ও কষ্ট পাচ্ছে। ইরা
কথাটা বললেও সৌম্য’র উত্তরের অপেক্ষা করল না। রিক্সাওয়ালাকে বলে,
– মামা এইখানে সাইড করেন।
রিক্সাওয়ালা রিক্সা সাইড করলে ইরা রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ায়। সৌম্য কিছু জিজ্ঞেস করল না। রিক্সা থেকে নেমে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। তখন-ই পাশ দিয়ে রিহানকে যেতে দেখে সৌম্য রিহানকে ডাক দেয়।
– রিহান?
রিহান উল্টো ঘুরে তাকালো। এগিয়ে আসলো না। মৃদুস্বরে বলে,
– কিছু বলবি?
সৌম্য নিজেই এগিয়ে গিয়ে বলে,
– এইখানে কোনো কাজ ছিল? আর বাসা চেঞ্জ করলি, একবার জানালি-ও না।
রিহান কৌতুক সুরে বলে,
– তোকে কেন জানাতে যাব? তুই কে?
সৌম্য রিহানের কথায় অবাক হলো। মৃদুস্বরে বলে,
– এভাবে বলছিস কেন? আমরা তো একসাথে…..
রিহান মাঝখান থেকে বলে,
– একসাথে ছিলাম। মুখে মুখে আবার ভাই-ও বানিয়েছিলি। বাদ দে, সুখে আছিস। সুখে থাক। আমি বাঁচলেও কি! ম’রলেও কি!
এটুকু বলে একটু থামে রিহান। এরপর আবার-ও বলে,
– আমার থেকে দূরে থাকলে খুশি হব। আশা করি আমার ইচ্ছের মূল্য দিবি। ভালো থাকিস।
কথাটা বলে রিহান এখানে আর দাঁড়ালো না। দ্রুতপায়ে হেঁটে চলে যায়। সৌম্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রিহান গত এক সপ্তাহের বেশি হলো তার সাথে ঠিক করে কথা বলেনা। অফিসে প্রতিবার তাকে এড়িয়ে যায়। তারা এক বাসার আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতো। রিহান বাসা চেঞ্জ করেছে, কোথায় বাসা নিয়েছে কিছুই জানায়নি তাকে। আজ সরাসরি দূরে থাকতে বলে গেল। সৌম্য’র খুব খারাপ লাগলো। কি করেছে সে? রিহান তো এমন নয়।
উল্টো ঘুরে তাকালে ইরাকে না দেখে সৌম্য’র বুক ধ্বক করে ওঠে। দ্রুতপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এলোমেলো পায়ে হাঁটে। রাস্তাটা ফাঁকা। কোথায় গেল তার ইরাবতী? সৌম্য ঢোক গিলে কিছুটা আওয়াজ তুলে ডাকে,
– ইরাবতী?
বুকটা কাঁপছে। কি হলো তার ইরাবতীর। এইতো এখানেই ছিল।
সৌম্য কিছুদূর গিয়ে দেখল ইরা রাস্তার পাশে বসে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সৌম্য ইরার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে। মৃদুস্বরে ডাকে,
– ইরাবতী?
সৌম্য’র কণ্ঠ পেয়ে ইরা মাথা তুলে তাকায়। এটুকু সময়ে কেঁদেকেটে মুখের যা তা অবস্থা করেছে। সৌম্য ঢোক গিলে বলে,
– কাঁদছিস কেন ইরাবতী?
ইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ভাঙা গলায় বলে,
– তোর বন্ধুকে দেখে দৌড়ে তার দিকে চলে গেলি। একটাবার পিছনে তাকালি না। আমাকে পিছন থেকে কেউ টেনে নিয়ে গেলেও টের পেতিনা। তুই এমন কেন সৌম্য? এখন তো আমি তোর বউ। আমার হাতটা ধরলে কি হত রে? আমি কি তোর কাছে সারাজীবন অফশনাল-ই থেকে যাবো সৌম্য?
সৌম্য বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। ইরার কথাগুলো একদম বুকে গিয়ে লাগলো। সে কি সত্যিই তার ইরাবতীকে অপশনাল হিসেবে রেখেছে? ঢোক গিলল ছেলেটা।
ইরার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আঙুল দিয়ে সামনে ইশারা করে বলে,
– তোর মনে আছে সৌম্য, একবছর আগে ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে তোর পা ধরে কেঁদে বলেছিলাম, আমরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। তোকে বলেছিলাম, আমায় একটু ভালোবাসতে। তুই ফিরিয়ে দিয়েছিলি। তোর ডায়রিটা পু’ড়ি’য়ে দিয়েছিলি। আমার কোনো কথাই শুনতি না তুই।
এটুকু বলে ইরা থামে। গলা বেঁধে আসছে। সৌম্য
নির্জীব চোখে ইরার ক্রন্দনরত মুখের দিকে চেয়ে আছে। ইরা হঠাৎ-ই দু’হাতে সৌম্য’র কলার ধরে সৌম্য’র দিকে তাকিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
– সেদিন অবহেলা করতি। আমি একা একা কাঁদতাম। কিন্তু এখন বিয়ে করে-ও কেন আমাকে অবহেলা করিস সৌম্য? তুই সারাদিন অফিস করিস। বাড়ি ফিরে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকিস। সবসময় কাজ নিয়ে পড়ে থাকিস। কেন এমন করিস? আমি তো তোর থেকে শুধু ভালোবাসা চাই সৌম্য।
আমি সবসময় ভাবতাম, একটা গ্রামে একটা টিনের বাড়িতে আমরা দু’জন খুব সাধারণভাবে থাকব। পারলে একবেলা না খেয়ে থাকব, যখন ইচ্ছে হবে তোর বুকে মাথা রাখব। দু’জন মিলে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসব। সাধারণ জীবন নিয়ে আরও কতশত স্বপ্ন বুনতাম আমি।
আমি কখনো ভাবিনি আমার সৌম্য চাকরি করে অনেক টাকা কামাবে। তারপর আমি উঁচু উঁচু বিল্ডিং-এ রাণীর মতো থাকবো।
তবে তুই কেন আমায় সময় না দিয়ে টাকার পিছনে সময় দিচ্ছিস সৌম্য?
কথাগুলো বলতে বলতে ইরা সৌম্য’র বুকে কপাল ঠেকিয়ে ফোঁপায়। একটু থেমে আবার-ও বলে,
– আমায় একটু-ও অবহেলা করিস না সৌম্য। বিশ্বাস কর, আমার খুব ক’ষ্ট হয়। বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। আমি আমার সৌম্য’র অবহেলা নিতে পারিনা রে। আমি শুধু আমার সৌম্য’র ভালোবাসা চাই। আর কিচ্ছু চাইনা। আমায় অনেক ভালোবাসবি সৌম্য? সব বাদ দিয়ে শুধু আমায় ভালোবাস না সৌম্য!
কথাগুলো বলতে বলতে ইরা কাঁদতে থাকে। সৌম্য স্তব্ধ হয়ে রইল। চোখের কোণ ঘেঁষে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি ইরার মাথার উপর পড়ে। চোখ বুজে নেয়। কাঁপা বা হাত তুলে ক্রন্দনরত ইরার মাথায় রেখে বিড়বিড় করে,
– আমি এবার থেকে শুধু আমার ইরাবতীকে ভালোবাসবো।
ইরা শুনলো না সৌম্য’র কথা। মেয়েটি সৌম্য’র বুকে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে কতশত আহাজারি করল।
সন্ধ্যা আসমানী নওয়ানের পাশে শুয়ে আছে। ঘড়ির কাটা ১২ টার ঘর ছাড়িয়েছে। সন্ধ্যার চোখে ঘুম নেই। মেয়েটা বারবার এপাশ-ওপাশ করছে। আসমানী নওয়ান তাকে জোর করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে, নয়তো মেয়েটা খেতেও পারতো না। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। আকাশ তার উপর রা’গ করে বেরিয়ে গেল। আর ফিরছে না তো। সকালে তাকে জড়িয়ে ধরল। সন্ধ্যার পর তাকে ঘুরতে নিয়ে গিয়ে কত সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত তাকে উপহার দিল। একটু সময়ে ব্যবধানে আকাশ তার জন্য বাড়িতেই ফিরছে না। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যার চোখের কোণ ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়ে। শোয়া থেকে উঠে বসে। বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে আকাশের নাম্বারে মেসেজ করল,
– আপনি কোথায়?
মেসেজটি লিখে প্রায় পাঁচমিনিট অপেক্ষা করে আবার-ও মেসেজ দেয়,
– আপনি কখন বাড়ি ফিরবেন?
আবার-ও পাঁচ মিনিট পর মেসেজ দেয়,
– আপনি কি খেয়েছেন?
এরপর প্রায় ১০ মিনিট অপেক্ষা করে। কোনো রিপ্লে না পেয়ে সন্ধ্যার চোখ ভিজে যায়। বোকা মেয়ে ভাবে, আকাশ কি তার সাথে আর কথা বলবে না? ভাবনা থেকে সন্ধ্যা আবার-ও মেসেজ করে,
– আপনি কি আমার সাথে আর কথা বলবেন না?
রিপ্লে নেই। সন্ধ্যা এবার দু’হাতে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে চোখ ভেজায়। তার মনে হচ্ছে সে আকাশের সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো স্বপ্ন দেখেছে। আর এখন স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে বলে আকাশ আর তার সাথে কথা বলে না।
সন্ধ্যা কিছুক্ষণ কেঁদে ফোন চেক করলে দেখল আকাশ রিপ্লে দেয়নি। আবার-ও মেসেজ করে,
– আমি সৌম্য ভাইয়ার বাসায় যাবো না।
প্রায় ১০ মিনিট পর আবার-ও মেসেজ করে,
– শুনছেন? বাড়ি আসুন।
সন্ধ্যা মেসেজটি সেন্ড করে হাতে ফোন নিয়ে ফোনের দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ বসে আকাশের রিপ্লের অপেক্ষা করল। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা শুয়ে পড়ল। হাতের মুঠোয় ফোন। আকাশের রিপ্লে না পেয়ে মেয়েটি আবার-ও কাঁদে।
আকাশের মেসেজের রিপ্লের অপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে সন্ধ্যা ঘুমিয়ে যায়।
আকাশ বাড়ি ফিরে রাত ১:৩০ এ। অফিসের কাজ করতে করতে বেচারা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। বাড়ির মেইন দরজা খুলে ভেতরে আসে। দোতলায় উঠতে গিয়ে, গতিপথ ঘুরিয়ে মায়ের ঘরে আসলো। বিছানায় নজর করলে সন্ধ্যাকে দেখে মুখে হাসি ফুটল। গতকাল সন্ধ্যা তার সাথে ঘুমিয়েছিল। আজ আর একা একা ঘুমোতে ভালো লাগবে না। তাছাড়া সন্ধ্যা এখন তার সাথে অনেক সহজ হয়েছে। না বলে নিয়ে গেলেও কিছু বলবে না।
অতঃপর আকাশ এগিয়ে এসে সন্ধ্যার মাথার কাছে মেঝেতে হাঁটুমুড়ে বসে। ডিম লাইটের আলোয় সন্ধ্যার ঘুমন্ত মুখখানা কি সুন্দর লাগলো। আকাশ সন্ধ্যার মুখপানে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে বিড়বিড় করে,
– পুরো মায়ার খনি তুমি!
কথাটা বলে আকাশ সন্ধ্যার সারামুখে টুপটুপ করে চারটে চুমু আঁকল। এরপর সময় ন’ষ্ট না করে সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নিয়ে মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আকাশ তার ঘরে এসে সন্ধ্যাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। এরপর পরনের পাঞ্জাবি খুলে রাখে। পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলের উপর রেখে ওয়াশরুমে চলে যায়।
মিনিট ১০ পর আকাশ শাওয়ার নিয়ে বের হয় ওয়াশরুম থেকে। টেবিলের উপর থেকে ফোন নিয়ে ফোন অন করলে পর পর কয়েকটি মেসেজ আসে। আকাশ মেসেজ কয়েকটি চেক করে,
– আপনি কোথায়?
– আপনি কখন বাড়ি ফিরবেন?
– আপনি কি খেয়েছেন?
– আপনি কি আমার সাথে আর কথা বলবেন না?
– আমি সৌম্য ভাইয়ার বাসায় যাবো না।
– শুনছেন? বাড়ি আসুন।
সন্ধ্যার নাম্বার থেকে পুরো ছয়টি মেসেজ দেখে আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। ফোন সাইলেন্ট ছিল। কাজের ব্যস্ততায় ফোন চেক-ও করা হয়নি। আকাশ কি রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারেনা। ইশ! বউটা তাকে এতোগুলো মেসেজ দিয়েছে জানলে সে তো উড়ে উড়ে চলে আসতো। ভীষণ আফসোস হলো এই ভেবে, কেন আগে ফোন চেক করল না সে।
আকাশ হাতের ফোন রেখে সন্ধ্যার পাশে এসে বসল। ডান হাত সন্ধ্যার মাথায় রেখে অপলক চেয়ে থাকে সন্ধ্যার দিকে। আবেগী স্বরে বলে,
– সন্ধ্যামালতী? তোমার এতো ভালোবাসা আমি কোথায় রাখি বউ?
আকাশ প্রায় ২০ মিনিট স্ট্যাচু হয়ে বসে পলকহীন চেয়ে দেখল সন্ধ্যাকে। একটুখানি ঝুঁকে সন্ধ্যার কপালে একটা চুমু এঁকে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
ঘরের কোণায় রাখা আলমারির কাছে গিয়ে, আলমারির ভেতর থেকে একটি গিটারের কেস বের করে। এরপর কেসের ভেতর থেকে একটি কালো গিটার বের করে।
গিটার, গান এসব আকাশের আহামরি পছন্দের নয়। ভার্সিটি লাইফে শখ করে গিটার কিনেছিল। এরপর টুকটাক বাজাতো। গিটার ভালো বাজাতে পারতো সে। কিন্তু তার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগতো না তেমন। এজন্য গিটারটি তুলে রেখেছিল। কিন্তু আজ কেন যেন ভীষণ ইচ্ছে করল গিটারের সুর তুলে কিছু গাইতে। কারণ টা অবশ্যই তার সন্ধ্যামালতী।
কোথায় যেন শুনেছিল মানুষ প্রেমে পড়লে কবি হয়ে যায়। তার আপাতত ভীষণরকমভাবে গায়ক হতে ইচ্ছে করছে।
আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। এরপর গিটার নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। বেলকনির রেলিঙের উপর বসে আকাশ। গিটারে টুংটাং সুর তুলতে শুরু করে। অনেক আগে বাজিয়েছিল, মাঝে প্রায় বছর ধরে গিটারে হাত দেয়নি। বিধায় প্রথমে একটু সমস্যা হলো। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই খুব সুন্দর করে একটা সুর তোলে।
এদিকে টুংটাং শব্দে সন্ধ্যার ঘুম ভেঙে যায়। সন্ধ্যা ঘুমঘুম চোখে আশেপাশে তাকালো। ডিম লাইটের আলোয় ঘরটি ঠিক করে চিনতে পারলো না। তবে টুংটাং শব্দ কানে লাগছে ভীষণ। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে উঠে বসল। দু’হাতে চোখ ডলে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝল এটা আকাশের ঘর। সন্ধ্যার মনে পড়ল, সে আসমানী নওয়ানের ঘরে ছিল। তাহলে আকাশের ঘরে আসলো কি করে? ভাবনার মাঝে টুংটাং শব্দ আগের চেয়েও তীব্র হলে সন্ধ্যা বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। শব্দের উৎস খুঁজে খুঁজে বেলকনির দিকে গেল।
সন্ধ্যা বেলকনির দরজায় এসে দাঁড়ালে চোখে পড়ে,
আকাশ বেলকনির রেলিঙের উপর উঠে উল্টোদিক ফিরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। চাঁদের আলোয় পিঠ ফিরিয়ে রাখা আকাশকে কি সুন্দর লাগছে!
আকাশ এখনো গিটারের টুংটাং সুর তুলছে। হঠাৎ-ই গাইতে শুরু করে,
তুমি গল্প ছিলে আমার উপন্যাসে
তুমি কবিতার মতো এই দিনের শেষে
তুমি অল্প করে কিছু স্বপ্ন দিলে
আমি প্রেমিক রব শত জনম ধরে,
দেখি তোমায় দেখি আমি এক পলকে
রোজ প্রেমে হারাই দেখতে দেখতে
দেখি তোমায় দেখি দুটি নয়ন ভরে
ভালোবাসি মেয়ে, এই আমি তোমাকে।
এটুকু গেয়ে হঠাৎ-ই আকাশ থেমে যায়। বা হাতে গিটার ধরে রেখে ডান হাতে ভর দিয়ে রেলিং থেকে এক লাফে নেমে সন্ধ্যার সামনে এসে দাঁড়ায়।
আকাশের হঠাৎ সামনে আসায় সন্ধ্যা একটু ভ’য় পায়। তবে চোখেমুখে বেশি বিস্ময়।
আকাশ গিটার বা হাতে ধরে রেখেছে। ডান হাত প্যান্টের পকেট গুঁজে সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
লুকিয়ে গান শোনা বারণ,
সন্ধ্যামালতী আমাকে-
পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেনি,
এটাই তার কারণ।
কথাটা বলে আকাশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। আজ বোধয় জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলো একদম সন্ধ্যার মুখে এসে পড়েছে। আকাশের দৃষ্টি জুড়ে মুগ্ধতার ছড়াছড়ি। সন্ধ্যাকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় আকাশ। কিছু একটা ভেবে মনে মনে হেসে উল্টো ঘুরে দু’পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলে,
– আজ অফিসে অনেক কাজ ছিল, তাই বায়ানকে পাঠাতে পারিনি। আগামীকাল সকালে আমি নিজেই তোমাকে তোমার ভাইয়ের কাছে রেখে আসবো। এখন ঘুমাও।
কথাটা বলার সাথে সাথে সন্ধ্যা ঝড়ের বেগে এসে আকাশকে পিছন থেকে দু’হাতে জাপ্টে ধরে। আকাশের পিঠে মুখ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে মেয়েটা।
অন্তঃদহন পর্ব ৩৮
সন্ধ্যার এহেন কাজে আকাশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। সন্ধ্যা কাঁদছে বুঝতে পেরে আকাশ হাতের গিটার ছুড়ে ফেলে দ্রুত উল্টো ঘুরে সন্ধ্যার দু’গাল তার দু’হাতের মাঝে নিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– সন্ধ্যামালতী কাঁদছ কেন? আমার সোনা বউ কাঁদে না। আমার কলিজা তুমি। আমার কলিজা ছাড়া আমি থাকতে পারিনা তো! কাঁদে না বউ। স্যরি সোনা বউ!
কথাগুলো বলতে বলতে সন্ধ্যার সারামুখে অসংখ্য চুমু আঁকে।