অন্তঃদহন পর্ব ৪২

অন্তঃদহন পর্ব ৪২
DRM Shohag

আসমানী নওয়ান আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,
– আকাশ মাইয়াটারে এমনে মা’র’লা ক্যান?
বায়ান, সন্ধ্যা, ইরা সবাই অবাক হয়ে চেয়ে আছে আকাশের দিকে। আকাশের শ’ক্ত দৃষ্টি সকালের দিকে। তবে কিছু বলল না। পকেট থেকে ফোন বের করে একটি ভিডিও অন করে ফোনে লাউড দেয়। যেখানে একটু পর পর সকালের বলা কিছু কথা ভেসে আসে,
‘তোর এসব চিপকাচিপকি যায় না কেন? অ’স’হ্য’ক’র একটা।
তোর এসব হাত পা নাচানাচি করে আমার সাথে কথা বলবি না। বি’র’ক্তি’ক’র! মুখ দিয়ে কথা বলতে পারলে বলবি। নয়তো জোকারের মতো হাত পা নাচাবি না।

শুনলাম তোর সাথে না-কি ওই আকাশ নওয়ানকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে তোর শ্বাশুড়ি-মা। আকাশ নওয়ান রাজি তো হয়নি, উল্টে তোর জন্য ডিভোর্স পেপার বানাতে দিয়েছে। অবশ্য দিবে না কেন? আয়নায় নিজেকে দেখ, গায়ের রঙটা কেমন চাপা দেখেছিস? তোর চেয়ে আকাশ নওয়ান কত সেড ফর্সা কল্পনা করতে পারবি তুই? আবার কথা-ও বলতে পারিস না। বোবা একটা। তো আকাশ তোকে ডিভোর্স দিবে না তো কাকে দিবে?
আকাশ ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিল, তোকে পেপারটা এনে দিয়ে সাইন করাতো, কিন্তু তার এক বান্ধবী সেটা ছিঁড়ে ফেলেছে। বুঝলি তো? আবার-ও ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দিয়েছে। তা ডিভোর্স হয়ে গেলে কোথায় যাবি ভেবেছিস কিছু? তোর ভাই তো লাপাত্তা!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তোকে একটা খবর দিই। আমি আকাশ নওয়ান এর পিএ। এটার মানে কি জানিস? আকাশ নওয়ানের সাথে ২৪ ঘণ্টা থাকবো। এরপর কি হতে পারে বুঝতে পারলি তো! আমি কিন্তু আকাশের চেয়ে আরও ফর্সা, আবার কথা-ও বলতে পারি। বোবা নই তোর মতো। তোর ডিভোর্স টা হলে-ই চুটকি মে’রে আকাশ নওয়ান এর বউ হয়ে যাবো আমি। তুই কই যাবি, সেই চিন্তা কর তাহলে, কেমন?’

সবগুলো কথা শেষে ভিডিওটি অফ হয়ে যায়। প্রত্যেকে বিস্ময় চোখে তাকায়। সন্ধ্যার চোখ থেকে নোনাপানি গড়িয়ে পড়ে। তার মনে আছে, সেদিন সে সকালের কাছে তার সৌম্য ভাইয়ার খোঁজ চেয়েছিল, অথচ সকাল তার সৌম্য ভাইয়ার ম’রা’র কথা কত সহজেই বলে দিয়েছিল। কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যার চোখ বেয়ে আবার-ও জল গড়ায়। সকালের হাত ছেড়ে দেয়।

সবচেয়ে বেশি অবাক হয় বায়ান। এটা যে সকালের কণ্ঠ তার চেয়ে ভালো আর কে চিনবে? গত একবছর যাবৎ কতশত বার সকালের সাথে তার কথা হয়েছে। অথচ আজ এসব কি শুনছে! বায়ানের মাথা ঘুরে উঠল। সকালের ধরে রাখা হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শরীরে শ’ক্তি পাচ্ছে না ছেলেটা। সকালের বলা আকাশের বউ হওয়ার কথাটা একদম বুকে গিয়ে লেগেছে। সকালের সাথে তার সম্পর্ক নড়বড়ে নয় বরং ভীষণ স্ট্রং।
সৌম্য সকালের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সকাল তার বোনুকে এভাবে কথা বলেছিল? তার বোনের কণ্ঠস্বর কেড়ে নিয়ে তার বোনকেই বলেছে, তার বোন না-কি জোকারের মতো হাত-পা নাড়ায়? সৌম্য দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সকালের দিকে চেয়ে রইল।

ইরা সৌম্য’র পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভীষণ অবাক লাগল সকাল মেয়েটাকে দেখে। মেয়েটি দেখতে কত সুন্দর! অথচ তাদের বোন সন্ধ্যাকে কত ক’ষ্ট দিয়েছে। ইরার নিজেরই ইচ্ছে করল, সকালকে চাপকে সোজা করে দিতে। এখানে বড় কেউ না থাকলে সে সত্যিই আজ সকালকে মা’র’তে মা’র’তে আধমরা করে ফেলত। ইরা বা হাতে সৌম্য’র ডান হাত ধরে বলে,
– এই সকাল বিকাল আমার থেকে অনেক ছোট। সন্ধ্যা আর তুই ওই মেয়েকে কিছু না বললে, আমি কিন্তু ওকে মারাত্মক মা’র’বো সৌম্য।
সৌম্য কিছু বলল না।
আসমানী নওয়ান সকালের দিকে চেয়ে আকাশের উদ্দেশ্যে রে’গে বলে,

– এইডাই সেই মাইয়া? যে আমার জান্নাতের কণ্ঠস্বর কাইরা নিছে? তাইলে ওর কণ্ঠস্বর এহনো রাখছ ক্যান?
আসমানী নওয়ানের কথা শুনে সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায় তার খালার দিকে। আসমানী নওয়ান যেমন নরম, তেমনি কঠোর। গত দিনগুলোতে সে খুব ভালো করে চিনেছে আসমানী নওয়ানকে। সত্যই সকালের গলার স্বর ন’ষ্ট করবে না তো? কথাটা ভাবতেই ঢোক গিলল সন্ধ্যা।
বায়ান একবার সকালের দিকে তাকায়, আরেকবার সন্ধ্যার দিকে। আর কি কিছু শোনা বাকি আছে তার? সকাল এরকম একটা কাজ করতে পারে, তার তো বিশ্বাসই হয় না। অবিশ্বাস-ই বা কেন করবে? ওই ভয়েসগুলো তো মিথ্যা নয়। আকাশের কণ্ঠে তার ধ্যান ভাঙে। আকাশ আদেশের সুরে বলে,

– বায়ান, আমার অফিসরুমের ড্রয়ারে সালফিউরিক এসিডের একটি শিশি আছে। ওটা আমার লাগবে। এক্ষুনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দাও। ফাস্ট।
আকাশের কথা শুনে প্রত্যেকে আগের চেয়েও বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। তবে আসমানী নওয়ান স্বাভাবিক।
বায়ান ঢোক গিলল। চোখেমুখে ভীতি ছেলেটার। সকাল তখন থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আকাশের শেষ কথাটা শুনে দু’হাতে সন্ধ্যার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি না বুঝে এরকম করেছি।
কথাটা আকাশ শুনতেই নিচু হয়ে সকালের হাত ধরে টেনে দাঁড় করায়৷ সকাল পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। আকাশ ডান হাতে সকালের চুলের মুঠি ধরে রাগান্বিত স্বরে বলে,

– জানি এসিড খেলে কেমন লাগে, সেদিন বুঝিস নি! আজ আমি তোকে এসিডের স্বাদ বোঝাবো। ওয়েট!
বায়ান এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখের কোণে জলকণা চিকচিক করছে। প্রিয় মানুষকে এভাবে অপমানিত হতে দেখে কেউ কি ঠিক থাকতে থাকতে পারে? সে-ও পারছে না। কিন্তু সকালের কাজগুলো ভাবলে তার নিজের-ই রা’গ লাগছে। সেখানে আকাশ স্যার তার বউকে কত ভালোবাসে! সকাল সেই মেয়েটার সাথে কত বাজে ব্যবহার করেছে! বায়ান মলিন মুখে সকালের দিকে চেয়ে রইল।

সন্ধ্যা দ্রুত এগিয়ে এসে আকাশের হাত সকালের চুল থেকে ছাড়াতে চায়। আকাশ বিরক্ত হয়। ফোন পকেটে রেখে বা হাতে সন্ধ্যা টেনে তার পাশে এনে দাঁড় করিয়ে সন্ধ্যার দু’হাতসহ সন্ধ্যাকে তার সাথে শ’ক্ত করে চেপে ধরে।
সকাল কান্নামাখা চোখে সন্ধ্যার দিকে চেয়ে আছে। সন্ধ্যা ভেজা চোখে সকালের দিকে চেয়ে আছে। তার খুব খারাপ লাগছে। সকাল তার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, ওতেই মেয়েটা গলে গিয়েছে। আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে শ’ক্ত কণ্ঠে বলে,
– পৃথিবীতে আরও অনেক অসহায় মানুষ আছে। তোমার এসব দয়ার ভান্ডার তাদের জন্য তুলে রাখ সন্ধ্যামালতী। কোনো অ’মানুষের জন্য ব্যয় করে এতো সুন্দর গুণ অপাত্রে ঢালবে না। নিষেধ করে দিলাম।
সন্ধ্যা আকাশের কথা শুনে ঢোক গিলল। আকাশ কথাটা বলে সকালের চুলের মুঠি আরও শ’ক্ত করে ধরে সকালের দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– সন্ধ্যামালতীকে ছাড়তে আমি যেমন ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিলাম। তেমনি সন্ধ্যামালতীকে আমার সাথে বাঁধতে আমিই ডিভোর্স পেপার ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। কান খুলে শুনে রাখ, সন্ধ্যামালতী পাতিলের মতো কালো হলেও, আকাশ নওয়ানের পাশে শুধু এবং শুধুমাত্র আমার সন্ধ্যামালতীকেই মানায়। নো ওয়ান এল্স।
লাস্ট কথাটা চিৎকার করে বলে। আর সাথে সকালের ডান গালে আবার-ও ক’ষি’য়ে আরেকটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। সকাল উল্টে পড়তে নিলে বায়ান দৌড়ে এসে সকালকে আঁকড়ে ধরে। সকাল দু’হাতে বায়ানকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে। মাথা উঁচু করে বায়ানের দিকে তাকালে দু’জনের চোখাচোখি হয়। বায়ানের চোখ দু’টো লাল। সকাল কাঁদতে কাঁদতে জড়ানো কণ্ঠে ডাকে,

– বায়ান?
বায়ান ঢোক গিলল। নিজেকে এতো অসহায় লাগেনি কখনো।
আকাশ বায়ানের দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– বায়ান আমি তোমাকে কি বলেছি, শুনতে পাওনি? চিন্তা নেই,, তোমার গার্লফ্রেন্ডকে এসিড খাওয়ানোর পর চিকিৎসা করানো হবে। ম’রে গেলে হায়াত শেষ। বেঁচে থাকলে হায়াত বেশ! ঢাকা ব্যাক কর।
কথাটা বলে আকাশ সন্ধ্যাকে ছেড়ে আবার-ও সকালের দিকে তেড়ে যেতে নিলে সন্ধ্যা দ্রুত আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাতে আকাশকে ঠেলে। আকাশ রে’গে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা কান্নামাখা চোখে তাকায়। দু’হাত জমা করে বোঝায়,

– ওকে আর কিছু বলবেন না প্লিজ!
আকাশ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– একটু আগে কি বললাম, ভুলে গিয়েছ? তুমি ঘরে যাও সন্ধ্যামালতী। নয়তো তোমার লেগে যাবে।
কথাটা বলে আকাশ তার সামনে থেকে সন্ধ্যাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। এরপর আবার-ও এগিয়ে যেতে নিলে সন্ধ্যা আকাশের সামনে এসে দু’হাতে আকাশকে সাপ্টে ধরে। আকাশ বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলে,
– সন্ধ্যামালতী ছাড়ো আমায়।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশকে ছেড়ে দু’হাতে চোখ মুছে আকাশের হাত ধরে টানে ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আকাশ সৌম্য’র দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– সৌম্য তোমার বোনকে সরাও। নয়তো ও এখন আমার হাতে মা’র খাবে বলে দিলাম।
সৌম্য নিশ্চুপ। তার দৃষ্টি অনেকটা দূরে দাঁড়ানো তার বাবার দিকে। সৌম্য’র দৃষ্টিজোড়া ঝাপসা। নিজেকে কি যে দুর্বল লাগে! কাদের শা’স্তি দিবে সে? যারা তার আপনজন? এসবদিন আসার আগে বোধয় ম’রে যাওয়া ভালো ছিল! দৃষ্টি ঘুরিয়ে তার বোনের দিকে তাকালো। এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার হাত ধরে মৃদুস্বরে বলে,

– বোনু ঘরে যা।
সন্ধ্যা ছলছল দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকায়। আকাশ সন্ধ্যার হাত থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নেয়। সাথে সাথে সন্ধ্যা সৌম্য’র হাত থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার-ও আকশের সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাতে আকাশের পেটের দিকের টি-শার্ট টেনে ধরে। মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ আবার-ও বিরক্ত হয়। মে’জা’জ খারাপ হচ্ছে তার। সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে কড়া ধমক দেয়,
– কি প্রবলেম তোমার?
সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। আকাশ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। এই বউটা সারাদিন কেঁদে কেঁদে তাকে গলিয়ে ফেলে। হঠাৎ-ই সন্ধ্যাকে কোলে তুলে নেয়। সন্ধ্যা হকচকিয়ে ওঠে। আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর যেতে যেতে বলে,
– বায়ান, আমি বাড়ির ভেতর থেকে এসে যেন শুনি, তুমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছ।

বায়ান সকালকে ছেড়ে সকালের পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সকাল মাথা নিচু করে ফোঁপাচ্ছে।
সৌম্য এগিয়ে এসে সকালের সামনে দাঁড়ায়। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদুস্বরে বলে,
– আমি ছোট থেকে ভাবতাম আমার দু’টো বোন। তুই আমার বোনুকে অনেক জ্বালিয়েছিস। আমি বাড়ি থাকতে দেখেছি। ঢাকা যাওয়ার পর-ও জ্বালিয়েছিস। দেখতে না পেলেও বুঝতাম। কিন্তু আমি বাড়ি আসলে বোনু আমার কাছে তোর নামে কখনো বিচার দেয়নি। আমি ভাবতাম, আমাদের মা আলাদা হলেও বাবা তো একটাই। হয়তো তোর মনে আমাদের জন্য সামান্য হলেও মায়া আছে। অথচ তুই যে তোর মায়েরই আরেকটি নি’কৃ’ষ্ট রূপ, সেটা বুঝতে পারিনি।
কথাগুলো বলে থামে সৌম্য। ঢোক গিলে বলে,

– অনেকগুলো বছর হয়ে গেল বোনু আর কথা বলে না। তুই আর তোর মা আমার বোনুর গলার স্বর কে’ড়ে নিয়ে ঠিক কতটা শান্তি পেয়েছিস বলবি সকাল?
সৌম্য’র কথায় ইরার চোখজোড়া ভিজে উঠল। বায়ান অবাক হয়ে সৌম্য’র দিকে চেয়ে আছে। আসমানী নওয়ান মলিন মুখে সৌম্য’র দিকে চেয়ে আছে।
সকাল মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– সৌম্য ভাইয়া বিশ্বাস কর, আমি একটুও বুঝতে পারিনি। আমাকে……
বাকিটুকু বলার আগেই সৌম্য রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আর একটাও কথা বলবি না। কাউকে শা’স্তি দেয়ার শিক্ষা মা আমাদের দেয়নি। তাই তোদের কোনো শা’স্তি আমি দিব না। তবে বোনুর মত ক্ষমা-ও আমি করব না। আকাশ ভাইয়াকে আমি বাঁধা-ও দিব না। এবার এখান থেকে যা। আমাদের ধারের কাছেও আর আসবিনা।

সকাল দু’হাতের মাঝে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
সৌম্য কথাগুলো বলে উল্টো ঘুরে যেতে গিয়েও থেমে গেল তার বাবাকে আরও অনেকটা কাছে দেখে।
আসমানী নওয়ান বাড়ির ভেতরে যেতে গিয়েও থেমে যায় সৌম্য’র বাবাকে দেখতে পেয়ে। মুহূর্তেই চোখেমুখে ক্রোধ জমা হয়। এই জা’নো’য়া’র’কে সে ছাড়বে না। ভদ্রমহিলা সৌম্য’র বাবার দিকে দু’পা এগিয়ে আসে। এরপর দাঁড়িয়ে গিয়ে ডান পা উঁচু করে পায়ের চটি খুলে ডান হাতে নেয়। দৃষ্টি সৌম্য’র বাবার পানে রেখে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যায়।
সৌম্য’র দৃষ্টি পড়ে আসমানী নওয়ানের উপর। আসমানী নওয়ানের পায়ের চটি হাতে, এটা খেয়াল করেছে সে। আসমানী নওয়ানের মনোভাব বুঝতে পেরে সৌম্য বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে দ্রুত তার বাবার সামনে দাঁড়ায়।
গ্রাম হওয়ায় অনেক মানুষ এসে জড়ো হয়েছে তাদের উঠানের সামনে। সকলের সামনে নিজের বাবাকে এভাবে অপমানিত হওয়ার ব্যাপারটি সৌম্য কেন যেন মানতে পারলো না।
আসমানী নওয়ান সামনে সৌম্য’কে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। বিরক্ত চোখে চেয়ে বলে,

– সামনে থেইকা সরে দাঁড়াও সৌম্য।
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– উনাকে কিছু বলবেন না। উনি আমার বাবা।
আসমানী নওয়ান শ’ক্ত গলায় বলে,
– আর তোমার কু’লা’ঙ্গা’র বাপ, যারে ওয় প্রথমে বিয়া করছিল, সে আমার বোন।
সৌম্য মাথা নিচু করে ঢোক গিলল। পিছন থেকে সৌম্য’র বাবা অনুতপ্ত স্বরে বলে,
– আপা আমারে মাফ করে দিয়েন।
সৌম্য’র বাবার কথায় আসমানী নওয়ান একটু হাসলো। এরপর চোখমুখ শ’ক্ত করে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– আমি মাফ করমু? আমারে তোর জ্যোৎস্না মনে হয়?
একটু থেমে বলে,

– আচ্ছা যা তোরে আমি মাফ করতাছি। আমার বোনের প্রাণ ফিরায় দে। যা আমার বোনরে আন। যদি আনতে পারোস তাইলে মাফ করতাছি। মানুষ মা’ই’রা আইসা মাফ চাইতে ল’জ্জা লাগে না তোদের?
সৌম্য’র বাবা মাথা নিচু করে রইল। সৌম্য আসমানী নওয়ানের দিকে চেয়ে বলে,
– উনি আমার মাকে মা’রে’ন নি।
আসমানী নওয়ান সৌম্য’র কথায় রে’গে যায়। বা হাতে সৌম্য’র কলার ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– তোমার মায়েরে তোমার কু’লা’ঙ্গা’র বাপ-ই মা’র’ছে। জ্যোৎস্না আমাগো সবার কলিজা আছিল। তোমার বাপের জন্য সে পরিবার হারাইছে। বিনিময়ে তোমার বাপ কি দিছিল আমার বোনরে? জীবন্ত লা’শ বানায় দিছিল। সাতদিনের মাথায় আমার বোন ঘুমের ঘোরে কি খুশিতে ম’র’ছে? না-কি তোমার এই বাপ আমার বোনটারে তিলে তিলে মা’র’ছে! জানোনা তুমি?
কথাগুলো বলে থামে আসমানী নওয়ান। কথা বেঁধে আসছে। ঢোক গিলে ধরা গলায় বলে,

– আমি জ্যোৎস্নারে কোনোদিন সামান্য রান্নার জন্য রান্নাঘরে পাঠাইনাই। আমার সেই বোনডা এই গ্রামে আইসা কত ক’ষ্ট করছে। বিনিময়ে তোমার বাপ আমার বোনডারে একটু ভালোবাসা দিতে পারেনাই সৌম্য। মা’ই’রা ফালাইছে আমার বোনরে।
কথাগুলো বলতে গিয়ে আসমানী নওয়ানের চোখ ভরে ওঠে। মাথা নিচু করে নেয়। সৌম্য’র চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জলকণা। তার মায়ের ক’ষ্ট তার চেয়ে বেশি আর কেউ দেখেনি। কিন্তু বাবাকে মা’র’লে কি তার মা আসবে?
আসমানী নওয়ান হাতের চটি ছুড়ে ফেলে বলে,

– আমারে থামাইয়া কি করবা। উপরে একজন আছে। সে একদিন ঠিকই বিচার করব।
কথাটা বলে আসমানী নওয়ান ডানদিকে কয়েকপা হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায়। চোখ বেয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল।
পাশ থেকে একজন মহিলা অবাক হয়ে বলে,
– জ্যোৎস্না আপা তোমার বোন আছিল আসমানী আপা?
কারো কণ্ঠ পেয়ে আসমানী নওয়ান দ্রুত শাড়ির আঁচল দিয়ে ভেজা চোখজোড়া মুছল। এরপর একটু হেসে বলে,
– হুম। আমার ছোট বোন। খুব আদরের আছিল।
ভদ্রমহিলা মলিন গলায় বলে,

– জ্যোৎস্না আপা তার ভাইবোনের কথা বলে সবসময় অনেক কানতো জানো। আর সৌম্য’র বাপ আরেকটা বিয়ে করছে জানা পর আরও অনেক কানতো। আমি অনেক কইছিলাম যে তোমার বাপের বাড়িতে জানাও। কিন্তু জ্যোৎস্না আপা কইত, আমার বাপের বাড়ির সবাই সৌম্য’র বাপের খোঁজ পাইলে ওরে বাঁচতে দিবেনা। জ্যোৎস্না আপা সৌম্য’র বাপরে মেলা ভালোবাসতো। কিন্তু বেচারি সৌম্য’র বাপের জন্য-ই ম’রে গেল।
আসমানী নওয়ান বহুক’ষ্টে কান্না গিলে নিল। অতঃপর মহিলাটিকে যাচ্ছি বলে দ্রুতপায়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।

সৌম্য সময় নিয়ে নিজেকে সামলালো। এরপর উল্টো ঘুরে তার বাবার উদ্দেশ্যে বলে,
– এখান থেকে যাও। তোমার দু’জন ছেলে মেয়ে আছে, তাদের নিয়ে ভালো থাকো। আমার আর বোনুর সামনে আর কখনো এসো না।
এটুকু বলে সৌম্য থামে। মাথা উঁচু করে তার বাবার ঝাপসা চোখজোড়া দেখে সৌম্য বিদ্রুপ হাসল। অতঃপর বলে,
– ভাগ্যিস আল্লাহ আমাকে আর বোনুকে তোমার মতো অ’মানুষ না বানিয়ে মায়ের মতো ভালো মানুষ বানিয়েছে। নয়তো তোমার মতো বাবাদের বাঁচিয়ে রেখে বাকি বাবাদের দু’র্নাম হতে দিতাম না।
কথাটা বলে সৌম্য উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে ভাঙা গলায় বলে,

– আমার আর বোনুর বাবা, মা কেউ বেঁচে নেই। তাই দয়া করে আমার বাবার রূপ নিয়ে আমাদের সামনে এসে আমাদের ভোলানোর চেষ্টা কর না। আমি শা’স্তি দিতে অপারগ হলেও ক্ষমা করিনা।
কথাটা বলে সৌম্য আর এক সেকেন্ড-ও এখানে দাঁড়ালো না। ইরার হাত শ’ক্ত করে ধরে দ্রুতপায়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
সৌম্য’র বাবার ঝাপসা চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে। সে সত্যিই বাবা হিসেবে খুব খারাপ করেছে। তার ক্ষমা হয় না। সৌম্য’র মায়ের মুখটা-ও আজ খুব করে চোখের সামনে ভাসল। সন্ধ্যাকে দূর থেকে একবার দেখেছিল। আর দেখল না। লোকটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

বায়ান এতোক্ষণ ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখল। সকালের বাবাকে সে চেনে। লোকটিকে তার কেমন যেন মেরুদন্ডহীন মনে হয়। তবে সে সকালের ফ্যামিলি নিয়ে কখনো কথা বলেনি। আজ-ও সকালের বাবার দিকে এগোলো না। নিজেকে শ’ক্ত করল। এরপর তার পাশে দাঁড়িয়ে ফোঁপানো সকালের হাত শ’ক্ত করে ধরে সকালদের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। সকাল ঢোক গিলল। ডান হাতে বায়নের হাত ধরে কান্নামাখা গলায় বলে,
– বায়ান আমার কথাটা শোনো। বায়ান বিশ্বাস কর, আমি এসব আমার মায়ের কথায় করতাম। বায়ান?
বায়ান সকালের কথা কানে নিল না। দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে। সকাল বায়ানের পায়ের সাথে পা মেলাতে পারেনা। তবুও বায়ানের সাথে এগোয় আর বলে,

– বায়ান, প্লিজ আমার কথা শোনো। বায়ান?
বায়ান একবার-ও তাকালো না সকালের দিকে। গ্রামের মানুষ সব সকালের দিকে তাকিয়ে ছিঃ ছিঃ করছে। গ্রামের সামান্য ঘটনাকেই মানুষ অনেক বড় করে দেখে। সেখানে সকালকে এভাবে একজন ছেলের হাত ধরা, সাথে সকালের এরকম অবস্থায় কেউ ভালো চোখে দেখছে না।
বায়ান সকালদের বাড়ির উঠানের কাছাকাছি আসলে সকালের মা বায়ানকে দেখে খুশি হয়। বায়ান মাঝেমাঝেই তাদের এখানে আসতো সকালের সাথে। বায়ানের সাথে তার মেয়ের খুব তাড়াতাড়ি বিয়েও হবে। কথাবার্তা ঠিক-ও হয়ে আছে। কিন্তু তিনি বায়ানকে দেখে যতটা না খুশি হলো, তার চেয়ে বেশি অবাক হলো সকালকে এভাবে টানতে টানতে আনতে দেখে। ভাবনার মাঝেই বায়ান সকালকে টেনে সকালের মায়ের দিকে ধাক্কা দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,

– আপনার মেয়েকে দিয়ে গেলাম। আমার মা, আমি কেউ-ই আপনাদের মতো লো মেন্টালিটির মানুষ না। তাই আপনার মেয়ে আমার জন্য নয়।
সকালের মা সকালকে আঁকড়ে ধরে অবাক হয়ে বলে,
– বুঝলাম না তোমার কথা। আমার মেয়ে কি করছে? আমি কি করছি?
বায়ান রে’গে বলে,
– কি করেছেন, সেটা আপনি-ও জানেন। আপনার মেয়েও জানে। আর না বোঝার মতো কিছু তো বলিনি। আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করছি না। বুঝেছেন?
বায়ানের কথা শুনে সকালের চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সকালের মা বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– কি কও বাবা, গ্রামের প্রায় সবাই জানে, আমার মেয়ের তোমার সাথে বিয়া ঠিক।
বায়ান রে’গে বলে,

– তো এবার সবাইকে জানিয়ে দিন, আপনাদের মা, মেয়ের ডা’ই’নি’গিরির জন্য সেই বিয়ে ভেঙে গিয়েছে।
বায়ানের কথায় সকালের মা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকায়। বায়ান কথাটি বলে উল্টো ঘুরে দু’পা এগোলে সকাল দৌড়ে এসে বায়ানকে সাপ্টে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– বায়ান আমাকে ক্ষমা কর। আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি আকাশ স্যারকে বিয়ের কথাটা সন্ধ্যাকে ক’ষ্ট দেয়ার জন্য বলেছিলাম। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি বায়ান।
বায়ান চোখ বুজে নেয়। ঢোক গিলল ছেলেটা। অতঃপর শ’ক্ত গলায় বলে,

– এমন নোংরা মনের মানুষকে আমি কখনোই আমার বউ বানাবো না।
সকাল মাথা উঁচু করে বায়ানের দিকে তাকায়। বায়ান চোখ মেলে তাকালে সকালের দিকে দৃষ্টি পড়লে দেখল সকালের ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। বায়ানের চোখেমুখে অসহায়ত্ব ঘিরে ধরল। দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় সকালের থেকে। সকাল আবার-ও কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমি ভালো হয়ে গেছি বায়ান। আমি আর খারাপ কিছু করিনা, বিশ্বাস কর। আমাকে রেখে যেও না বায়ান। আমি তোমাকে ছাড়া ম’রে যাবো।

কথাগুলো বলতে বলতে বায়ানের বুকে মুখ ঠেকিয়ে দেয়। বায়ানের বুকে চিনচিন ব্য’থা হলো। সামনে তাকালে সকালের বাবাকে চোখে পড়ল। ঢোক গিলে নিজেকে শ’ক্ত করে সকালকে টেনে তার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। কোনো কথা না বলে বড় বড় পা ফেলে সকালের বাবার পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পিছন থেকে সকালের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। বায়ান দাঁড়ালো না। এগিয়ে গেল। ডান হাতে ঝাপসা চোখজোড়া ডলে স্বাভাবিক করে নেয় একবার।
সকাল কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়েছে। মেয়ের কান্নায় সকালের মা, বাবা দু’জনেই বোবা চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে রইল। চোখের কোণে জলকণা চিকচিক করছে দু’জনের।

ঘরে এসে আকাশ সন্ধ্যাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে যতবার ঘর থেকে বেরোতে চেয়েছে, সন্ধ্যা আটকে দিয়েছে। আকাশ চোখ বুজে নিজেকে শান্ত করে। গম্ভীর গলায় বলে,
– চুপচাপ এই ঘরে বসে থাকো।
কথাটা বলে ঘর থেকে বেরোতে নিলে সন্ধ্যা দ্রুত এগিয়ে এসে দু’হাতে আকাশকে জাপ্টে ধরে। আকাশ চোখ বুজল। কি যে রা’গ লাগছে। তাকে আটকানোর কত ফন্দি তার বউয়ের! আকাশ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– রাতে তোমার ভালোবাসা টেস্ট করব সন্ধ্যামালতী। এখন আমায় ছাড়ো। নয়তো সত্যি সত্যি তোমার বে’য়া’দ’ব বোনের থা’প্প’ড় ঘুরে এসে তোমার গালে পড়বে।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। কিন্তু আকাশকে ছাড়লো না। আকাশ সন্ধ্যাকে জোর করে টেনে তার থেকে সরিয়ে দেয়। আবার-ও এক পা বাড়ালে সন্ধ্যা পিছন থেকে আবার-ও দু’হাতে আকাশের টি-শার্ট টেনে ধরে। আকাশ এবার রে’গে উল্টো ঘুরে ডান হাতে সন্ধ্যার গাল চেপে ধরে। ধমকে বলে,

– কখন থেকে ভালো করে বলছি। কথা কানে যায় না কেন তোমার? মা’র খাবে?
সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। চোখজোড়া টলমল করে ওঠে।সন্ধ্যার চোখে চোখ পড়লে আকাশ সন্ধ্যার গাল ছেড়ে দেয়। সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। আকাশ নিজেকে শান্ত করল। বউটাকে কিছু বলাও যায় না। শুধু কাঁদে, শুধু কাঁদে।
আকাশ দু’হাতে সন্ধ্যার গাল আগলে নিয়ে নরম স্বরে বলে,
– কি হয়েছে সোনা বউ? কাঁদছ কেন?
সন্ধ্যার চোখ থেকে আবার-ও পানি গড়িয়ে পড়ে। আকাশ বিচলিত হয়। সন্ধ্যার দু’গালে দু’টো চুমু খেয়ে আগের চেয়ে-ও নরম স্বরে বলে,
– আমার সোনা বউ তুমি। কাঁদছ কেন বউ? কেউ অপরাধ করলে তাকে শা’স্তি দিতে হয়। এটাও একটা গুণ, জানোনা তুমি?
সন্ধ্যা দু’হাতে আকাশকে জড়িয়ে ধরে আকাশের বুকে কপাল ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। আকাশ জড়িয়ে নিল সন্ধ্যাকে। মাথায় দু’টো চুমু আঁকে। পকেট থেকে ফোন বের করে মৃদুস্বরে বলে,

– কান্না অফ কর সন্ধ্যামালতী। কি বলতে চাও, শুনছি আমি। এই যে ফোন নাও।
সন্ধ্যা আকাশকে ছেড়ে দু’হাতে মুখ মুছে নেয়। এরপর আকাশের হাত থেকে ফোন নিয়ে কিছু টাইপ করে আকাশের দিকে ফোন বাড়িয়ে দেয়। আকাশ লেখাটি পড়ে,
– যারা জন্ম থেকে বোবা হয়, তারা জন্ম থেকেই সেভাবে নিজেকে মানিয়ে নেয়। কিন্তু জন্মের পর অনেকদিন কথা বলার পর, হঠাৎ কোনো একদিন থেকে বোবাদের মতো জীবনযাপন করতে ভীষণ ক’ষ্ট হয়। আমি চাইনা সকাল সেই ক’ষ্ট পাক। আমি জানি, আপনারা বলবেন, সকাল আমার শ’ত্রু। আমি চাইনা আমার শ’ত্রু’র সাথেও এতো নির্মম ঘটনা ঘটুক। আপনি সকালের সাথে কিছু করবেন না, বলুন?

লোখাটি পড়ে আকাশ চোখ বুজল। রা’গ লাগছে তার। এতো ভালো বউ হজম হচ্ছেনা। ডান হাত তুলে ঘাড় ডলল বার দুয়েক। এরপর হঠাৎ-ই চোখ মেলে বা হাতে সন্ধ্যাকে টেনে তার সাথে জড়িয়ে ধরে। সন্ধ্যা কিছু বোঝার আগেই আকাশ সন্ধ্যার বাম গাল কা’ম’ড়ে ধরে। সন্ধ্যা ব্য’থা পেয়ে চোখমুখ কুঁচকে নেয়।
প্রায় দু’মিনিট পর সন্ধ্যার গাল ছেড়ে আকাশ সন্ধ্যার দিকে তাকায়। ব্য’থায় সন্ধ্যার চোখে পানি জমেছে। আকাশ সন্ধ্যার গালে হালকা জ’খ’ম হওয়া স্থানটায় ডান হাতের বুড়ো আঙুল রেখে সন্ধ্যার চোখের দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আমাকে তোমার মতো এতো ভালো ভাবার দরকার নেই বউ। আর না তো আমি ভালো হতে চাই। তুমি এসব ভাবনা বাদ দাও।
সন্ধ্যার চোখজোড়া ভরে ওঠে। আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,

– আবার কি? তোমার বাবা, বোন ওরা তোমায় কেউ আপন ভাবেনা। তাদের কথা এতো ভাবতে হবে কেন তোমার?
সন্ধ্যা নাক টেনে ইশারায় বোঝায়,
– ওরা না ভাবলেও আমি ওদের আপন ভাবি।
আকাশ শীতল দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। ডান হাত সন্ধ্যার গলায় রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার কণ্ঠস্বর কে’ড়ে নেয়া মানুষকে ছেড়ে দিতে বলছ? তুমি ভাবোনা, তোমার ওই বে’য়া’দ’ব বোনের জন্য আমি আমার সন্ধ্যামালতীর কণ্ঠ শুনতে পাইনি কখনো।
আকাশের কণ্ঠ ভীষণ অসহায় শোনালো। কণ্ঠে মিশে রইল তীব্র আফসোস।
সন্ধ্যার চোখজোড়া ভরে ওঠে। মাথা নিচু করে নেয়। তার ভীষণ খারাপ লাগে, আর পাঁচজন স্বামীর মতো আকাশ তার বউয়ের কণ্ঠ শুনতে পায়না বলে! আকাশ তাকে বিয়ে না করলে, নিশ্চয়ই এক নিখুঁত বউ পেত! আর আকাশের এই আফসোস-ও হত না। সন্ধ্যার চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। আকাশকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলে আকাশ সন্ধ্যাকে শ’ক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ডান হাতে সন্ধ্যার গালে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে,

– কাঁদছ কেন বউ?
সন্ধ্যা চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকায়। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দু’টো লাল হয়ে গিয়েছে। আকাশ চেয়ে আছে সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা আজ একটা অদ্ভুদ কাজ করল। ঠোঁট নাড়িয়ে কয়েকটি কথা বোঝালো আকাশকে।
– আমি কথা বলতে চাই।
আকাশ সন্ধ্যার ঠোঁটজোড়ার দিকে চেয়ে রইল। সন্ধ্যার কথাগুলো বুঝতে পেরে, সন্ধ্যার কান্নাভেজা চোখের দিকে তাকায়। আকাশের বুকটা ভার হয়। তার বউয়ের এই ইচ্ছে যদি সে পূরণ করতে পারতো, তবে এই পৃথিবীতে সবচেয়ে খুশি হয়ত সেই হত। কিন্তু সে পারবে না। আকাশ সন্ধ্যার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,

– সম্ভব না সন্ধ্যামালতী। তোমার এই আবদার রাখতে পারব না।
আকাশের উত্তর শুনে সন্ধ্যার দু’চোখ বেয়ে জল গড়ায়। আকাশ শ’ক্ত করে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরলো। তার সন্ধ্যামালতী ক’ষ্ট পায় কথা বলতে না পেরে। কিন্তু সে কি করবে? সে তো তার সন্ধ্যামালতীকে হারাতে পারবেনা। তার যে সন্ধ্যামালতীকে ছাড়া চলে না। সে কিভাবে তার সন্ধ্যামালতীর জীবনের রিস্ক নিবে? বিড়বিড় করে,
– তোমার সব আবদার আমি পূরণ করে দিব সন্ধ্যামালতী। শুধু এটা ছাড়া।
সন্ধ্যা ফুঁপিয়ে ওঠে। তার দমবন্ধ লাগে কথা না বলতে পেরে। কেউ বোঝেনা তাকে। সন্ধ্যা ঠেলে আকাশকে তার থেকে সরিয়ে দিতে চায়। আকাশ ছাড়লো না। অসহায় চোখে তাকালো সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা কান্নামাখা চোখে আকাশের দিকে তাকায়। আবার-ও ঠোঁট নাড়িয়ে বোঝায়,

– আমি কথা বলতে চাই, প্লিজ!
আকাশের ক’ষ্ট হয়। তার সন্ধ্যামালতীর আবদার ফেরাতে তার ভীষণ ক’ষ্ট হয়। কিন্তু সে যে নিরুপায়। আকাশের চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে। ভীষণ অসহায় দৃষ্টিতে সন্ধ্যার কান্নামাখা মুখের দিকে চেয়ে ঢোক গিলল কয়েকবার।
এরপর সন্ধ্যার কপালের সাথে কপাল ঠেকায়। সাথে সন্ধ্যার ঠোঁটজোড়ায় তার ঠোঁটজোড়া ঠেকিয়ে চোখ বুজে বিড়বিড় করে,

অন্তঃদহন পর্ব ৪১

– স্যরি সোনা বউ! এক্সট্রিমলি স্যরি!
আকাশের উত্তরে সন্ধ্যার বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে জল গড়ায়। সে সত্যিই কখনো তার আকাশকে নিজের কণ্ঠ শোনাতে পারবে না। কথাটা ভেবে সন্ধ্যার দমবন্ধ লাগলো।

অন্তঃদহন পর্ব ৪৩