অন্তঃদহন পর্ব ৪৩

অন্তঃদহন পর্ব ৪৩
DRM Shohag

সৌম্য ভেতরে এসে সোফার সাথে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসল। ডান পা উঁচু করে রেখে ডান হাত, ডান হাঁটুর উপর মেলে রাখে। ইরা ধীরে ধীরে সৌম্য’র পাশে বসে। মৃদুস্বরে ডাকে,
– সৌম্য?
ইরার কণ্ঠে সৌম্য ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ইরার দিকে তাকায়। সৌম্য’র চোখজোড়া টকটকে লাল। ইরা সৌম্য’র চোখ থেকে ভ’য় পেল। ঢোক গিলল মেয়েটা। সে কিভাবে সান্ত্বনা দিবে? কি বলবে বুঝতে পারছে না। সৌম্য ডান হাত বাড়িয়ে ইরার হাত টেনে ইরাকে তার পাশ ঘেঁষে বসালো। এরপর ইরার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে নেয়। মিনিট দুই পর ভারী গলায় বলে,

– মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে ইরাবতী।
সৌম্য’র অসহায়ত্বে ঘেরা কথা শুনে ইরার চোখজোড়া ভরে ওঠে। সৌম্য
আবার-ও বলে,
– আমাদের গ্রামে থেকে আমার জীবনের আজকেই প্রথম বাজার থেকে মাছ কিনেছি।
এটুকু বলে সৌম্য আবার-ও থামলো। ইরা অবাক হলো সৌম্য’র কথায়।
সৌম্য বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– মাছ ধরা আমার নেশা ছিল। মা বেঁচে থাকতে এমন কোনো দিন ছিল না যেদিন আমি বিলে নয়তো নদীতে মাছ মা’র’তে যায়নি। মাঝে মাঝে ফিরতে রাত হলে, নয়তো পড়া ফাঁকি দিয়ে মাছ মে’রে বাড়ি ফিরলে, মা লাঠি নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসতো। বাবা এগিয়ে এসে মাকে আটকাতো। বলত,
‘ আমার ছেলেকে মা’রা’র জন্য লাঠি উঠানোর সাহস কোথায় পেয়েছ? ও মাছ ধরে এনেছে, একটু পর ঠিক-ই তো মাছ কা’ট’তে বসে যাবে। এখন ওকে মা’র’ছ কেন? ‘
কথাগুলো বলে সৌম্য একটু হাসল। বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না সেই হাসি। মিলিয়ে গেল। ঢোক গিলে বলে,

– কিন্তু মা মা’রা যাওয়ার পর আর মাছ মা’রা’র সময় পায়নি। তবুও মাঝে মাঝে যেতাম পেটের দায়ে। রাত ১২ টার পর বাড়ি ফিরলেও মা আর আসতো না লাঠি নিয়ে তাড়া করতে। বাবা-ও আর খোঁজ নিত না।
পড়ার টেবিলে না বসলে মা আগে কানের কাছে এসে কানের বারোটা বাজিয়ে দিত। আমি রে’গে বলতাম,
– তোমার ঘ্যানঘ্যান না করলে কি দিন যায় না?
আমার কথা শুনে মা আমাকে আরও কয়েকটা ধমক দিত। কখনো কখনো কান টেনে দিত আচ্ছামতো।
অথচ কয়েকদিনের ব্যবধানে, আমি একবার-ও পড়ার টেবিলে না বসলে মা এসে আর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করত না। কোনো কথাই বলত না। বোনু কত কেঁদেছে, কত ডেকেছে, আমি মাকে কত ডেকেছি, অথচ মা একটাবার আমাদের একটুখানি দোখা দিতে-ও আসেনি। আজ-ও আসেনি।
সৌম্য’র গলা বেঁধে আসে। ইরার চোখজোড়া টলমল করে ওঠে। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সৌম্য কখনো তাকে নিজেকে একটু-ও প্রকাশ করেনি। ইরা জানে, সৌম্য ভীষণ চাপা। কিন্তু আজ সৌম্য’র এই ক্ষ’ত গুলো শুনে তার বুক ভেঙে আসছে।
সৌম্য নিজেকে সামলে ভাঙা গলায় বলে,

– তুই আমার জীবনে আসার আগে আমার দু’টো পৃথিবী ছিল। আমার মা আর বোনু। যাদের একজন চিরতরে হারিয়ে গেছে! হঠাৎ তুই জীবনে এলি হারিয়ে যাওয়ার জন্য। তোর সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমার বাঁচার পথগুলো আরও কঠিন হয়ে গিয়েছিল। কারণ আমি জানতাম, তুই আমার না। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসেছিল। কিন্তু আমাকে বাঁচতে হত। আমার বোনুর যে আমি ছাড়া কেউ ছিল না।
এটুকু বলে সৌম্য ঢোক গিলল। এরপর বলে,
– মায়ের মতো করে তোরা যেন কখনো কেউ হারিয়ে যাস না ইরাবতী।
ইরার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। নাক টেনে বলে,
– ছোট ফুপি অনেক ভালো ছিল তাই না সৌম্য?
সৌম্য ঢোক গিলে মলিন হেসে বলে,

– আমরা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মুখিয়ে থাকি। আর মা মানুষকে ক্ষমা করার জন্য মুখিয়ে থাকতো।
কিছুদূরে আসমানী নওয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। সৌম্য’র বলা কথাগুলো শুনে ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ পর পর শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে থাকে। তার ছোট বোন তো অনেক আগেই হারিয়ে গিয়েছে। অথচ এই ছেলে, মেয়ে দু’টো কতই না ক’ষ্ট করেছে। এসব ভাবলেই আসমানী নওয়ানের দমবন্ধ লাগে। ক’ষ্ট টা তখন কয়েকশো গুণ বেড়ে যায় যখন মনে হয়, এই ছেলেমেয়ে দু’টোর বিতৃষ্ণায় ঘেরা জীবনটাকে ন’র’ক বানাতে তার স্বামী আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিল।
আসমানী নওয়ান আর এখানে দাঁড়ালেন না। দ্রুতপায়ে তার ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। এগিয়ে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়। দু’হাত গ্রিলে রেখে মাথা গ্রিলে ঠেকিয়ে চোখ বুজে নেয়।

তাদের খুব সুন্দর একটি পরিবার ছিল। মা মা’রা যাওয়ার পর বাবা, বড় ভাইজান তাদের তিনবোনকে একটু-ও মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি। কত সুন্দর পরিবার ছিল তাদের। হঠাৎ একদিন জ্যোৎস্না পালিয়ে গেল। আর সেদিন থেকেই তাদের জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। বাবা মা’রা গেল। ভাইজানের সাথে তাদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কতগুলো বছর এভাবেই পার হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন খোঁজ পেল, তার ছোট বোনের এক মেয়ে আছে। সে ছুটে গেল মেয়েটির কাছে। গিয়ে খবর পেল ছোট বোন আরও অনেকবছর আগে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে ওপারে চলে গিয়েছে। বোনের মেয়েকে ছেলের বউ করে আনলো। ভাবলো, এবার হয়ত একটুখানি সুখ মিলবে। কিন্তু হলো না। সেখানেও শান্তি মিলল না। তার ঘরে বসে তার-ই স্বামী ছেলে-মেয়ে দু’টোকে কতভাবে মা’র’তে চাইলো! তার বোনের ছেলে-মেয়ে বাঁচলেও কতগুলো নির্দোষ মানুষ ঝরে গেল। তার ভাইজান-ও আর রইল না। সবশেষে তার স্বামী নিজে-ও ওপারে চলে গেল।

মাঝে এক বছরে আকাশের বাবা কতবার অসুস্থ হয়েছে, সে কখনো কখনো এগিয়ে গিয়েছে। আবার কখনো এগিয়ে গিয়েও পিছিয়ে এসেছে। আবার কখনো চুপচাপ নিজেকে বেঁধে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু শেষবার অসুস্থ হয়ে একেবারেই ওপারে চলে গেল। যদি সে বুঝত, আকাশের বাবা সেদিন মা’রা যাবে, তবে সে হয়ত আরও আগেভাগেই এগিয়ে যেত। কিন্তু সে তো বুঝতে দেরি করে ফেলল। সে বুঝতে পেরে এগিয়ে গেলে, সেই মৃ’ত মানুষগুলোকেই বা কি জবাব দিত? তার স্বামী তাদের মে’রে’ছে, আর সে তার স্বামীকে বারবার বাঁচিয়েছে।

এর চেয়ে এটাই ভালো হয়েছে, সে না বুঝে দাঁড়িয়েছিল। একটু পর আবার-ও উঠে দাঁড়াবে ভেবে সে এগোয় নি। ভেবেছিল, লোকটা আবার-ও কখনো তাকে ডাকবে। সে পাশে না বসলেও দূর থেকে একবার তার স্বামীকে দেখবে, একবার সেই ডাক শুনবে। কিন্তু এসব তো অন্যায় হয়ে যাচ্ছিল। এজন্য হয়তো আল্লাহ নিজেই লোকটিকে নিয়ে নিয়েছে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আসমানী নওয়ানের বন্ধ চোখের পাতা বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সে আর শ’ক্ত থাকতে পারেনা। কতগুলো আপন মানুষ চোখের সামনে থেকে চিরদিনের জন্যহারিয়ে গিয়েছে। আজকাল তার ভীষণ ক্লান্ত লাগে। কেন যেন আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। মনে হয়, তার ছেলেমেয়েদের তো গতি হয়েছে। এবার আল্লাহ তাকে ছুটি দিয়ে দিক।

সন্ধ্যার পর পর ইরার মা ইরার তিনজন কাজিনকে নিয়ে সৌম্যদের গ্রামে এসেছে। ইরার কাজিন দু’জন মেয়ে আর একজন ছেলে যার নাম ইহাব।
সৌম্য আবার-ও বাজারে যাবে। সে জানতো না ইরার মায়েরা আসবে। হঠাৎ করে এসেছে। বাজারের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠানে আসে। পিছু পিছু ইরা আসলে সৌম্য দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,
– ভেতরে যা।
ইরা বলে,
– কেন?

সৌম্য উঠানে বসা সবার দিকে তাকালো। কাউকে নিয়ে তার সমস্যা নয়। কিন্তু ওই ইহাব ছেলেটাকে তার পছন্দ হচ্ছে না। আসার পর থেকে কয়শোবার যে ইরার পিছে ঘুরঘুর করেছে। আর ইরা-ও সায় দিয়েছে। সৌম্য বলতেও পারছে না সইতেও পারছে না। কিন্তু এখানে ইরা থাকলে ওই ছেলে পারলে ইরার কোলে উঠে বসবে। সৌম্য এবার না পেরে বলে,
– ইহাব ছেলেটাকে আমার ভালো লাগছেনা। তুই ওর থেকে দূরে থাক। আমার রা’গ উঠছে। মেহমান বলে অনেকবার কন্ট্রোল করেছি।
ইরা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। হঠাৎ ফিক করে হেসে বলে,
– আরে ও আমার নিজের ভাইয়ের চেয়েও আপন। তাছাড়া আমি ওর চেয়ে অনেক বড়। তুই কি পা’গ’ল? কিসব ভেবে বসে আছিস।
সৌম্য বিরক্তি কণ্ঠে বলে,

– যা ভাবার ভাবছি। তুই ওর থেকে দূরে থাক।
তখন-ই আসমানী নওয়ান এগিয়ে এসে বলে,
– আব্বা তুমি এহনো যাওনাই? রাত হইয়া যাইব তো!
সৌম্য মৃদুস্বরে বলে,
– জ্বি যাচ্ছি।
এরপর সৌম্য বাইরের দিকে যায়। আসমানী নওয়ান ইরার হাত ধরে ডানদিকে যায়, যেখানে সবাই বসে আছে। সৌম্য একটু পর পর পিছু ফিরে দেখছে। ইরাকে আবার-ও ওই ছেলের দিকে যেতে দেখে রা’গ হলো। সে বুঝতে পারছে, ওরা ভাই-বোন ভাবে একেঅপরকে। তবুও, নিজের তো নয়। সৌম্য’র হিসাব, আকাশ-ও ইরার কাজিন। কিন্তু ইরা আকাশের সাথে কত ডিস্টেন্স রাখে। আর ওই ছেলেটার সাথে এক ইঞ্চি-ও ডিস্টেন্স রাখছে না। যেটা সে একদম-ই নিতে পারছে না।

ইরা ঘাড় ঘুরিয়ে সৌম্য’র অবস্থা দেখে একটু হাসলো। ভালোই লাগলো সৌম্য’র এই কাজ। ওদিকে সৌম্য ঘাড় ঘুরিয়ে ইরা আর ইহাবের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে সামনে আকাশের সাথে ধাক্কা খায়। সৌম্য দ্রুত সামনে ফিরলে আকাশকে দেখল। আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– বাড়ি বউ রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না?
সৌম্য বিরক্ত চোখে তাকায়। কিছু একটা ভেবে বলে,
– বউ না বোনু। বোনুর জন্য চিন্তা হচ্ছে। ইরার একটা ছেলে কাজিন এসেছে, ও শুধু বোনুর দিকে নজর দিচ্ছে। তাই টেনশন হচ্ছিল আর কি!
আকাশ সিরিয়াস হয়ে বলে,

– সিরিয়াসলি?
সৌম্য মমে মনে হেসে উপর থেকে গম্ভীর গলায় বলে,
– আমার তো তাই মনে হলো।
আকাশ সৌম্যকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত উঠানের দিকে এগিয়ে গেল। সৌম্য প্রফুল্ল মনে এগিয়ে গেল বাজারের দিকে। সে তো থা’প্প’ড় মা’র’তে পারছে না। আকাশ ভাইয়া ছেলেটাকে দু’একটা থা’প্প’ড় দিলে দিবে। সৌম্য’র ভালো ছাড়া খারাপ লাগবেনা।
আকাশ উঠানে এসে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা এখানে আছে কি-না। দেখতে না পেয়ে বুঝল, সন্ধ্যার বাড়ির ভেতরে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ইহাবের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,
– নাম কি তোমার?

ইহাব ফোনে মগ্ন ছিল। পাশে কারো কণ্ঠ পেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশকে সালাম দেয়। অতঃপর তার নাম বলে। আকাশ সালামের উত্তর নেয়। ইহাবের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল আকাশ। এই ছেলে তো তার চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু তার বউয়ের চেয়ে বড় মনে হচ্ছে। অতঃপর ইহাবের উদ্দেশ্যে বলে,
– ইহাব তোমাকে আমার সুবিধার লাগছে না।
কথাটা শুনে ইহাব থতমত খেয়ে তাকায়। আকাশের দৃষ্টি দেখেই বেচারা দোনোমোনো করছিল। এখন আকাশের এই কথায় ছেলেটা দু’হাতে একবার শার্টের কলার টানে, আরেকবার শার্টের নিচ দিকে টানে। অতঃপর বলে,

– কেন ভাইয়া?
আকাশ একটি চেয়ার টেনে বসে। ডান পা বা পায়ের উপর তুলে রাখে। ডান হাতে ডান হাঁটু বরাবর সোজা করে রেখে বলে,
– গার্লফ্রেন্ড আছে?
ইহাব ঢোক গিলল। এটা ইরা আপুর বড় কাজিন। তার ব্যাপারে এভাবে খোঁজ নিচ্ছে কেন? ভাবনা রেখে মিনমিন করে বলে,
– নেই ভাইয়া।
আকাশ সাথে সাথে বলে,
– তাহলে তো প্রবলেম।
আকাশের কথায় ইহাব চোখ বড় বড় করে তাকায়৷ গার্লফ্রেন্ড না থাকলে সবাই ভদ্র বলে। আর এদিকে তার গার্লফ্রেন্ড না থাকায় আকাশ এটাকে প্রবলেম বলছে। ইহাব এমন কথা এই প্রথম শুনলো। আকাশ আবার-ও বলে,
– তোমার পছন্দের মেয়ে আছে?
ইহাব আবার-ও মিনমিন করে বলে,

– নেই ভাইয়া।
আকাশ চেয়ারে সামান্য গা এলিয়ে দিয়ে বলে,
– আচ্ছা। দূরে থাকবে।
ইহাব ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কার থেকে দূরে থাকব ভাইয়া?
আকাশ রে’গে তাকালে ইহাব মাথা চুলকে অবুঝ গলায় বলে,
– জ্বি ভাইয়া দূরে থাকব।

প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়েছে।
আকাশ উঠানের এক পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে খুব সিরিয়াসভাবে। ইরা বাড়ির ভেতরে গিয়েছিল। মাত্র বেরিয়ে এসে দেখল তার দু’জন কাজিন এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা তাদের দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পিছন থেকে ডাকতে গিয়ে থেমে যায় দু’জনের কথোপকথনে।
একজন বলছে,
– ইরা আপুর বরের গায়ের রঙ টা দেখেছিস? ইরা আপু ধবধবে ফর্সা। আর ইরা আপুর বর কত কালো! ইরা আপুর পাশে ওই ছেলেকে একটু-ও মানায় না। ইরা আপু অনেক বোকা। কত বড়লোক, সুন্দর ছেলে ফেলে এই গ্রামের এক কালো ছেলেকে এসে বিয়ে করেছে।
অপরজন বলে,

– ঠিক বলেছিস। ইরা আপুর বাবা নাকি ওই আকাশ নামের ছেলেটার সাথেই ইরা আপুর বিয়ে ঠিক করেছিল। আকাশ ছেলেটা আর ইরা আপু দু’জনেই কত ফর্সা আর কি সুন্দর। সাথে আকাশ ভাইয়া অনেক বড়লোক। ইরা আপুর সাথে আকাশ ভাইয়াকে একদম পার্ফেক্ট লাগতো।
কথাগুলো শুধু ইরার কানে যায়নি। একটু দূরে দাঁড়ানো আকাশের কানেও গিয়েছে। ইরা আকাশ দু’জনেই দু’জনকে খেয়াল করতেই একে-অপরের দিকে তাকায়। দু’জনেই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। যদিও তারা এখন একে-অপরকে একদম নিজের ভাই-বোন মনে করে। সেখানে এরকম কথা উঠলে অস্বস্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। আবার-ও ঔরার কাজিনের কথা কানে আসে,

– আমার তো ওই আকাশ ভাইয়ার জন্যবেশি আফসোস হয়। কি সুন্দর একটা ছেলে, অথচ বউটা যেমন কালো, সাথে বোবা। ইরা আপুর চেয়ে আকাশ ভাইয়া বেশি ঠকেছে।
এতোক্ষণ আকাশ ততটা না রা’গ’লেও এবারের কথায় আকাশ রে’গে বোম হয়ে যায়। তার সন্ধ্যামালতীকে নিয়ে উপহাস করার সাহস সে কাউকে দেয়নি। আর এই দু’দিনের মেয়েরা এসে তার সন্ধ্যামালতীকে নিয়ে কথা বলছে। ফোন ডান হাতের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ করে জ্বলন্ত চোখে তাকায় মেয়েগুলোর দিকে। তেড়ে যেতে নিলে পিছন থেকে আসমানী নওয়ান আকাশকে টেনে খানিকটা দূরে নিয়ে যায়।
তিনি মেয়েগুলোর কথা শুরু থেকে না শুনলেও লাস্ট কথাগুলো শুনেছে। আর বুঝেছে-ও আকাশ রে’গে গিয়েছে। আকাশ দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

– মা আমায় ছাড়ো।
আসমানী নওয়ান আকাশকে বোঝানোর স্বরে বলে,
– আব্বা রা’গ কমাও। ওরা সৌম্য’র বাড়ির মেহমান। এইখানে আইসা অ’প’মা’নিত হয়ে গেলে সৌম্য’র মান যাইব। মাঝে মাঝে পরিস্থিতি বোঝা লাগে আব্বা।
আকাশ হঠাৎ চিৎকার করে বলে,
– বুঝব না আমি পরিস্থিতি। কেউ আমার সন্ধ্যামালতীকে নিয়ে বা’জে কথা বলবে, আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব, এমন বান্দা আমি নই। বে’য়া’দ’ব গুলোকে জ্যা’ন্ত পু’তে ফেলব একদম।
আকাশের চিৎকারে উঠানে বসা সবাই আকাশের দিকে তাকায়। ইরার মা এগিয়ে এসে বলে,
– কি হয়েছে আসমানী?
আসমানী নওয়ান আকাশের দিকে তাকিয়ে শ’ক্ত করে বলে,

– আকাশ ঘরে যাও।
আকাশ উঠানে পেতে রাখা একটি চেয়ারে জোরেসোরে লাথি বসায়। চেয়ারটি কয়েক হাত দূরত্বে গিয়ে পড়ে। আকাশ আর এখানে দাঁড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– বা’লের মেহমান। থাকবোই না এখানে।
ইরার মা, ইহাব অবুঝ নয়নে চেয়ে রইল। ইরার কাজিন দু’টো বারবার ভীতি ঢোক গিলছে। আকাশ যে তাদের কথা শুনে নিয়েছে তারা বুঝেছে। এদিকে ইরা এগিয়ে এসে তার দু’জন কাজিনের উদ্দেশ্যে শ’ক্ত গলায় বলে,
– আমার স্বামীকে নিয়ে কি যেন বলছিলি?
মেয়ে দু’তো ঢোক গিলল। বুঝল ইরা-ও শুনে নিয়েছে তাদের কথা। ইরা এমনিতে ভালো হলেও রে’গে গেলে তারা ভ’য় পায় ইরাকে। তারা জানে, ইরা খুব জেদী সাথে তেজী। ইরা দু’জনকে চুপ দেখে আবার-ও রাগান্বিত স্বরে বলে,
– কি হলো বল কি বলছিলি?

মেয়ে দু’টো কেঁপে ওঠে। ইরার আর সহ্য
হলো না। তার থেকে ছোট ছোট মেয়ে হয়ে তার সৌম্যকে নিয়ে এসব কমেন্ট করবে আর চুপ থাকবে, এমন কখনো হয়নি। আজ*ও হলো না। ইরা চোখের পলকে ডান পাশের মেয়েটিকে ক’ষিয়ে একটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়।
ইরার কাজে সকলে হতভম্ব হয়ে যায়। ইরার মা অবাক হয়ে বলে,
– ইরা কি করছিস?
ইরার শরীর রা’গে কাঁপছে। সৌম্য কয়েক হাত দূরে ছিল। উঠানে ইরাকে তার কাজিনকে এভাবে মা’র’তে দেখে দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসেছে। হাতের বাজারের ব্যাগগুলো আঙিনায় রেখে ইরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলে,
– কি হয়েছে ইরাবতী?

যে মেয়েটি থা’প্প’ড় খেয়েছে, সে মাথা নিচু করে আছে। পাশের মেয়েটির কেন যেন ভীষণ রা’গ হলো। সৌম্য’কে দেখে রা’গ টা আরও বাড়লো। নিজের ভ’য় আপাতত সরিয়ে রেখে ইরার দিকে চেয়ে বলে,
– আমরা তো সত্যি কথাই বলেছি ইরা আপু। তোমার স্বামীর গায়ের রঙ কালো হলে সেটা আমরা বলতে পারবো না? না-কি কালো হলেও তোমার স্বামী বলে তাকে আমাদের সাদা বলতে হবে? তাছাড়া এই অজোপাড়া গ্রামে তোমার স্বামীর মতো ক্ষ্যা’ত মানুষ-ই থাকে জানি। তুমিও তার সাথে থেকে থেকে এরকম হয়ে যাচ্ছো। আম……
এটুকু বলতেই ইরা প্রথম মেয়েটির চেয়েও এই মেয়ের গালে গায়ের জোরে থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। সৌম্য এতোক্ষণ মেয়েটির কথা তব্দা খেয়ে শুনছিল। হঠাৎ ইরার থা’প্প’ড় ধ্যান ভাঙে। ইরা আবার-ও তেড়ে যেতে নিলে সৌম্য ইরাকে টেনে পিছনদিকে সরিয়ে আনে। ইরা রা’গে কাঁপতে কাঁপতে বলে,

– বে’য়া’দ’ব দু’টো। ২০০ বার জন্মালেও আমার স্বামীর মতো হতে পারবি না তোরা। আমিও দেখব কোন লাট সাহেবের সাথে তোদের বিয়ে হয়! জা’নো’য়া’র……..
সৌম্য ডান হাতে ইরার মুখ চেপে ধরে। আসমানী নওয়ানের উদ্দেশ্যে বলে,
– মা ওখানে বাজারের ব্যাগ রেখেছি। আমি ভেতরে যাচ্ছি।
আসমানী নওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৃদুস্বরে বলেন,
– যাও আব্বা।
সৌম্যআর এখানে দাঁড়ালো না। ইরাকে টেনে বাড়িয়ে ভেতরে নিয়ে গেল।
ইরার মা, ইহাব দু’জনেই থমথমে মুখে চেয়ে আছে। এতোক্ষণ এইখানে কি হলো, সেসব হজম করতে পারছে না।

সৌম্য ইরাকে নিয়ে ঘরে এসে দরজা আটকে দেয়। ইরার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
– কি হয়েছে ইরাবতী? ওরা আমাদের মেহমান। মেহমানদের সাথে এমন ব্যবহার করতে নেই, তুই জানিস না?
ইরার মাথানিচু। তার খারাপ লাগছে। সে কখনো কল্পনা-ও করেনি, তার দিক থেকে সৌম্যকে কেউ কথা শোনাবে। ওরা সৌম্য’কে কত ছোট করে কথা বলেছে, ভাবলেই ইরার কান্না পাচ্ছে।
ইরাকে চুপ দেখে সৌম্য ইরার কাঁধে হাত রেখে ডাকে,
– ইরাবতী?
ইরা মাথা তুলে তাকায়। ডান হাত বাড়িয়ে সৌম্য’র গালে রেখে বলে,
– আমার চোখে তুই ভীষণ সুন্দর সৌম্য।
সৌম্য চুপচাপ চেয়ে রইল ইরার দিকে। ইরা আবার-ও বলে,
– তোর গায়ের রঙ আমার খুব পছন্দের।
সৌম্য এবারেও চুপ থাকলো। আসলে ইরা একটু বেশি-ই ফর্সা। সেই তুলনায় সে শ্যামবর্ণের হলেও ইরার পাশে তাকে ভালোই কালো লাগে। সেই জায়গা থেকে মেয়ে দু’টোর হয়তো ইরার পাশে তাকে পছন্দ হয়নি। সৌম্য সেসব ভাবনা চাপা দিল। মৃদু হেসে বলে,

– জানি। কিন্তু দিনশেষে এই কথাটা-ও সত্য। তুই চাঁদ, আমি বামুন। তবে আমি ভাগ্যবান। বামুন হয়েও চাঁদের ভালোবাসা পেয়েছি। আর চাঁদের ভালোবাসা যে এতো নিখুঁত আর খাঁটি হয়, তা আমি কখনো জানতাম না, যদি না ইরাবতী আমায় ভালো বাসতো!
ইরার চোখ থেকে টুপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। বলে,
– তুই নিজেকে কখনো ছোট করিস না সৌম্য। আমি এসব নিতে পারিনা।
সৌম্য ইরার জলেভরা চোখের দিকে চেয়ে রইল।
ইরা এগিয়ে এসে সৌম্য’র বুকে মাথা রেখে ভাঙা গলায় বলে,
– একবার ভালোবাসি বলবি?
সৌম্য ডান হাত ইরার মাথায় রেখে মৃদুস্বরে বলে,

– এটা তো বলার জিনিস নয় ইরাবতী।
ইরা মাথা উঁচু করে সৌম্য’র দিকে চেয়ে ধরা গলায় বলে,
– তবুও বল!
সৌম্য বা হাতে ইরার চোখ মুছে দিয়ে বলে,
– তার আগে বল, তুই কাঁদছিস কেন?
ইরা নাক টেনে বলে,
– জানিনা। তোকে ফিল করলেই আমার চোখ ভিজে যায়।
সৌম্য বাকহীন হয়ে ইরার দিকে চেয়ে রইল। সৌম্য বুঝতে পারেনা, তার ঠিক কি বলা উচিৎ ইরার কথার বিপরীতে। ঢোক গিলে বলে,

– আমি তোকে ভালোবাসি বলতে পারবো না ইরাবতী। তোর ভালোবাসার কাছে আমার ভালোবাসা এক সমুদ্রের পানির কাছে এক ফোঁটা জলের মতো। যেদিন তোকে তোর সমুদ্র সমান ভালোবাসার অর্ধেকটা-ও ভালোবাসতে পারব। সেদিন বলব নাহয়।
কথাগুলো বলে সৌম্য সরে যেতে নিলে ইরা দু’হাতে সৌম্য’র দু’গাল ধরে টলমল চোখে চেয়ে আবদার করে,
– তবুও একবার ভালোবাসি বল না সৌম্য!
ইরার কাজে সৌম্য আর অবাক হয় না। শুধু মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখে তার ইরাবতীকে, দেখে তাকে ঘিরে তার ইরাবতীর পা’গ’লা’মি গুলো। দু’হাতে ইরার দু’গাল আগলে নিয়ে ইরার চোখের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে আবেগ ঢেলে বলে,
– ভালোবাসি ইরাবতী। আর-ও অনেক বেশি ভালোবাসতে চাই তোকে।
ইরার কান্নাভেজা মুখে হাসি ফুটল। নয়ন ভরে সৌম্য’কে দেখে। তার সৌম্য’কে নিয়ে কেউ কিছু বললে তার শরীরে আ’গু’ন ধরে যায়। সে কখনো কারো মুখ থেকে তার সৌম্যকে নিয়ে একটা কটুক্তি-ও শুনতে চায়না।

বিকালে সৌম্য’র কিনে আনা মাছ কা’ট’ছিল সন্ধ্যা। বাইরে চিৎকার, চেঁচামেচি শুনে উঠে বাইরে গিয়ে থমথমে পরিবেশ দেখে সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মাছ রেখে হাত ধুয়ে আসতে সময় লেগেছে। তার মধ্যেই সব ঠিকঠাক। মনে হলো, আকাশ আর ইরার গলা পেয়েছে। আসমানী নওয়ানের দিকে এগোনোর আগেই পিছন থেকে আকাশ সন্ধ্যার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা আকাশের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আকাশ ঘরের দরজা আটকে এগিয়ে এসে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে সন্ধ্যার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশ সন্ধ্যাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ভাবে, তার এতো সুন্দর বউকে নিয়ে মানুষ কেন ওরকম কথা বলে? সে তো তার সন্ধ্যামালতীর থেকে চোখ-ই সরাতে পারে না।
সন্ধ্যা ডান হাত উঠিয়ে ইশারায় বোঝায়,

– কি হয়েছে?
আকাশ ডান হাত সন্ধ্যার গালে রেখে বলে,
– তুমি অনেক সুন্দর সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যা আকাশের দিকে চেয়ে রইল। আকাশ তাকে সুন্দর বলে। সে কি আসলেই ওতো সুন্দর? আকাশের মতো তো নয়। অথচ আকাশ কথা শুনে মনে হয়, শুধু সেই সুন্দর।
আকাশ দু’হাত সন্ধ্যার গালে রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– আমার সোনা বউ তুমি। আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। আমার সাথে আজ ঢাকায় যাবে সন্ধ্যামালতী? আমি আর তুমি যাবো।
সন্ধ্যা কি বলবে বুঝল না। আকাশ আবদার করে,

– সোনা বউ, প্লিজ চলো। আবার দু’দিনের মাথায় তোমাকে নিয়ে চলে আসব এখানে। তুমি তো অনেকদিন হলো কলেজ যাওনা। এর মাঝে কয়েকদিন কলেজ যেও।
সন্ধ্যা ভাবলো, আকাশ ভুল বলেনি। সে অনেকদিন হলো কলেজ যায়না। আর আকাশের কাজ আছে বলছে, সে না করবে কিভাবে। সন্ধ্যা মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়, সে যাবে।
আকাশ খুশি হলো। অতঃপর সন্ধ্যার সারা মুখে সমানে চুমু খায়। আকাশকে থামতে না দেখে
সন্ধ্যা আকাশের দিকে রে’গে তাকালে আকাশ ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,
– এভাবে তাকাও কেন বউ? একটু চুমুই তো খাই। চুমু খেতে আমার ভালো লাগে। আমি কি করব?
সন্ধ্যা ঠোঁট নাড়িয়ে বোঝায়,

– তাই বলে এতো?
আকাশ সন্ধ্যার ঠোঁটজোড়ায় আবার-ও একটা চুমু খেয়ে সন্ধ্যার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– নাহ, এতোই না। এর চেয়েও অনেক বেশি ভালো লাগে আমার সন্ধ্যামালতীকে চুমু খেতে। মনে হয়, চুমু খেতে খেতে টুপ করে গিলে খাই তোমাকে।
কথাটা বলে আকাশ আবার-ও সন্ধ্যার নাকের ডগায় একটা চুমু খায়। সন্ধ্যা হতাশ চোখে চেয়ে রইল আকাশের দিকে। আকাশ মৃদুস্বরে বলে,
– রেডি হও। এক্ষুনি বের হব।
এক্ষুনি বের হবে শুনে সন্ধ্যা অবাক হয়ে তাকালে আকাশ সন্ধ্যার গালে একটা চুমু খেয়ে বলে,
– যা যা খেতে চাইবে সব খাওয়াবো বউ। এক্ষুনি না বের হলে লেট হয়ে যাবে।
কথাটা বলে আবার-ও সন্ধ্যাকে চুমু খেতে নিলে সন্ধ্যা দু’হাতে তার মুখ ঢেকে নেয়। আকাশ হাসলো। সন্ধ্যাকে ছেড়ে বলে,
– রেডি হয়ে নাও বউ। ফাস্ট কর।

আকাশ সবাইকে বলেছে তার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে। সকলে কিছু না বুঝলেও আসমানী নওয়ান বুঝেছে কারণ। ভদ্রমহিলা আকাশকে বারবার যেতে নিষেধ করে, কিন্তু আকাশ শোনেনা। সবশেষে হার মেনে বলেছে, সন্ধ্যাকে সাবধানে নিয়ে যেতে। আকাশ যেহেতু বলেছে, আবার কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরবে তাই সৌম্য কিছু বলেনি। সন্ধ্যাকে সাবধানে থাকতে বলেছে।

পরদিন,
আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কলেজের উদ্দেশ্যে। কলেজ থেকে একটু দূরে আকাশ গাড়ি সাইড করে সন্ধ্যাকে বসতে বলে গাড়ি থেকে নেমে যায়। সন্ধ্যা জানালার দিকে চেয়ে বাইরেটা দেখছিল। হঠাৎ চোখে পড়ল, তার সোজা একটু দূরেই সকাল দাঁড়ানো। সামনে বায়ান। সকাল বায়ানকে কিছু বলছে। বারবার বায়ানের হাত ধরছে। কিন্তু বায়ান নিশ্চুপ।
সন্ধ্যা গাড়ির দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। সকাল আর বায়ানদের দিকে এগিয়ে গেলে সকালের কান্নামাখা গলায় বলা কথাগুলো ভেসে আসে।
সকাল বায়ানের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

– বায়ান বিশ্বাস কর, আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি। তুমি যা বলবে আমি সব করব বায়ান। তুমি সবকিছু চেক করে দেখ, আমি কোনোদিন অন্য কোনো ছেলের সাথে কথা-ও বলিনি। আমি আর সন্ধ্যার-ও খারাপ চাই না।
বায়ান ঢোক গিলে বলে,
– আমিও তোমাকে আর চাইনা সকাল।
বায়ানের কথাটা শুনতেই সকালের কান্নার বেগ বাড়ে। সকাল বায়ানের বুকে কপাল ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– এমন বলো না বায়ান। তুমি আমাকে শা’স্তি দাও। আমি কিছু বলব না। তুমি শুধু আমাকে রেখে যেও না।
বায়ান সকালকে তার থেকে সরিয়ে দিয়ে শ’ক্ত গলায় বলে,

– তুমি আমার থেকে দূরে থাকো সকাল। আমি আর কতবার বলব আমি তোমাকে চাইনা!
সকাল ঝাপসা চোখে বায়ানের দিকে তাকায়। হঠাৎ-ই সকাল এগিয়ে গিয়ে বায়ানের পায়ের কাছে বসে দু’হাতে পা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ওঠে।
বায়ান হতভম্ব হয়ে যায়। সাথে সন্ধ্যা। এতোক্ষণে বুঝেছে, সকাল আর বায়ান সম্পর্ক আছে। এই ব্যাপার বুঝে যতটা না অবাক হয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ অবাক হয় সকালকে বায়ানের পা ধরে বসে কাঁদতে দেখে। ভীষণ খারাপ লাগছে তার।
সকাল কাঁদতে কাঁদতে বলে,
– আমাকে ছেড়ে যেও না বায়ান। আমি তোমার সব কথা শুনব। আমাকে ফিরিয়ে দিওনা বায়ান।
বায়ান ঢোক গিলল। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এরপর সামান্য ঝুঁকে সকালের হাত পা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে। সকাল কান্নামাখা চোখে তাকায় বায়ানের দিকে। বায়ানের চোখ দু’টো লাল। নিজেকে সামলে মৃদুস্বরে বলে,

– তোমাদের মস্তিষ্ক বি’কৃ’ত টাইপ সকাল। এরকম মানুষের সাথে আমি নিজেকে জড়াতে চাইনা। আমার মা বলে, সারাজীবনের জন্য নিজের জীবন ন’ষ্ট করার চেয়ে সাময়িক ক’ষ্ট পাওয়া ভালো। আমি সেটাই করছি। আমি তোমাকে ভালোভাবে বলছি। আমি তোমাকে চাইনা সকাল। আমার কাছে এসে লাভ নেই। তুমি তোমার লেভেলের মানুষ খুঁজে নিয়ে ভালো থেকো।
সকাল ভাঙা গলায় বলে,
– আমি অন্যকারো হলে তোমার ক’ষ্ট হবে না?
বায়ান বিদ্রুপ হেসে বলে,

– ক’ষ্ট আরও অনেক কিছুতেই হয়েছে। যত্ন করে ক’ষ্ট দেয়ার মানুষটা তুমি-ই। তাই এসব কথা তোমার মুখে মানায় না। বাদ দাও এইসব। ভালো থেকো। আমার সামনে আর কখনো এসো না।
কথাগুলো বলে বায়ান উঠে দাঁড়ালো। উল্টো ঘুরে চোখ বুজে লম্বা শ্বাস ফেলে ছেলেটা। এখানে আর দাঁড়ালো না। গটগট পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
সকাল আর শব্দ করে কাঁদলো না। শব্দহীন চোখের পানি ফেলতে লাগলো। দৃষ্টি বায়ানের পানে। রাস্তার অনেক মানুষ অনেকক্ষণ যাবৎ বাঁকা চোখে দেখছে। সকাল বায়ানের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে,
– ঠিকআছে। আর কখনো আসবো না তোমার সামনে। তুমি ডাকলেও আর আসবো না বায়ান। দেখে নিও।
কথাগুলো বলে ধীরে ধীরে সকাল উঠে দাঁড়ালো। চোখের বাঁধ এখনো ভাঙা। দুর্বল শরীর নিয়ে উল্টেদিকে এগোলে সন্ধ্যা সকালের দিকে যেতে চায়, কিন্তু আকাশ সন্ধ্যার হাত টেনে ধরে। সন্ধ্যা পিছু ফিরে আকাশকে দেখে ঢোক গিলল।

আকাশ সন্ধ্যার জন্য চকলেট, আইসক্রিম কিনতে গিয়েছিল। সৌম্য তাকে কল করে বলে দিয়েছে, সন্ধ্যা কলেজ যাওয়ার আগে এসব কিনে নেয়। আকাশ সন্ধ্যার জন্য এসব খাবার কিনে এনে এতোক্ষণ বায়ান আর সকালের কাহিনী দেখছিল। সন্ধ্যাকে সকালের দিকে এগোতে দেখে তার রা’গ হয়। সন্ধ্যাকে টেনে তার সামনে দাঁড় করিয়ে রে’গে বলে,
– তোমার কথা মেনে তোমার বে’য়া’দ’ব বোনকে ছাড় দিয়েছি। আমাকে আর রাগিয়ো না সন্ধ্যামালতী।
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। সামনে তাকিয়ে আশেপাশে চোখ বুলালে দেখল সকাল নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেয়েটা।

কলেজ ছুটির পর, সন্ধ্যা কলেজ থেকে বেরিয়ে এক পাশে দাঁড়ায়। তার ফ্রেন্ড লামিয়া আজ কলেজ আসেনি। এজন্য তার মনটা একটু খারাপ। ভেবেছিল অনেকদিন পর লামিয়ার সাথে দেখা হবে, কিন্তু সে তো আসেইনি।
নিয়াজ এদিকে একটা কাজে এসেছিল। রাস্তার পাশে সন্ধ্যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিয়াজ এগিয়ে এসে বলে,
– এই যে আকাশের বউ, কেমন আছো?
নিয়াজের কণ্ঠ সাথে এরকম সম্মোধনে সন্ধ্যা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে তাকায়। নিয়াজকে দেখে একটু হেসে মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, – ভালো।
নিয়াজ আশেপাশে তাকিয়ে আকাশকে না দেখে বলে,

– আকাশের জন্য ওয়েট করছ? ওয়েট, ওকে কল করছি।
কথাটা বলে নিয়াজ পকেট থেকে ফোন বের করে। তখন-ই সন্ধ্যা তার ফোনে কিছু টাইপ করে নিয়াজের দিকে তার ফোন বাড়িয়ে দেয়। নিয়াজ খেয়াল করতেই সন্ধ্যার ফোনে চোখ বুলিয়ে লেখাটি পড়ল,
– ভাইয়া আপনার সাথে একটা ব্যাপারে ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে চাই। আপনার কি একটু সময় হবে?
নিয়াজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আকাশের বউ তার সাথে আবার কি কথা বলতে চায়? নিয়াজ মাথা তুলে সন্ধ্যার দিকে তাকালে সন্ধ্যা কাচুমাচু মুখ করে তাকায়। নিয়াজ খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে,

– হবে সময়।
এরপর আশেপাশে তাকিয়ে বামদিকে যেতে যেতে বলে,
– আমার সাথে এসো।
সন্ধ্যা নির্দ্বিধায় নিয়াজের পিছু পিছু যায়। সৌম্য, আকাশের পর সন্ধ্যা নিয়াজকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। অবিশ্বাস করবে কেন? নিয়াজের জন্যই তো সে আর তার সৌম্যভাইয়া আজ-ও বেঁচে আছে। এই উপকার তারা কখনো ভুলবে না।
নিয়াজ সন্ধ্যাকে নিয়ে পাশেই একটি রেস্টুরেন্টে এসেছে। নিয়াজ সামনে বসে কোল্ড কফি অর্ডার করে। সন্ধ্যা তার সামনে বসেছে। নিয়াজ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলে,
– বলে ফেল।
সন্ধ্যা ফোনে কিছু টাইপ করে নিয়াজের দিকে ফোন বাড়িয়ে দেয়।
– আমার গলার অপারেশন করালে আমি কি ম’রে যাবো ভাইয়া?
লেখাটি পড়ে নিয়াজের খুবই খারাপ লাগলো। তার চৌদ্দ গুষ্টিতেও কোনো বোন নেই। সব শুধু ভাই। সন্ধ্যার দু’বার ভাইয়া ডাকটা যেমন ভালে লাগলো, তেমনি সন্ধ্যাকে বোন ভেবে সন্ধ্যার কথা না বলার ব্যাপাটায় খারাপ লাগলো। অতঃপর গলা ঝেড়ে বলে,

– আসলে ব্যাপারটা এরকম নয়। কম-বেশি রিস্ক তো সব অপারেশনেই থাকে। যেহেতু তোমার গলা অপারেশন, তাই এটা একটু সেনসিটিভ। সামান্য বেশি রিস্ক আছে বলায় আকাশ, সৌম্য দু’জনেই পিছিয়ে গিয়েছে। ওদের কাজে আমি হতাশ হয়েছি আবার ভালো-ও লেগেছে। ওরা তোমাকে নিয়ে অনেক বেশি সিরিয়াস।
সন্ধ্যা নিয়াজের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। এরপর টাইপ করে,
– আমি কথা বলতে চাই ভাইয়া। আপনার বন্ধু আর সৌম্য ভাইয়াকে আপনি একটু বোঝাবেন?
নিয়াজ সন্ধ্যার লেখাটি পড়ে একটু হাসল। ভালো লাগলো সন্ধ্যার আবদার। জবাবে বলে,
– আচ্ছা আমি ওদের দু’জনের সাথে আবার-ও কথা বলব। চিন্তা কর না।

সন্ধ্যার মুখে হাসি ফুটল। ওয়েটার তাদের টেবিলে দু’টো কোল্ড কফি রাখলে নিয়াজ একটা সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে দেয়। এরপর নিজের কোল্ড কফি তার সামনে নিয়ে কি মনে করে সামনে তাকালে দেখল আকাশ রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। নিয়াজ চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ যা পা’গ’লা’টে, এ যে সন্ধ্যার সাথে তাকে দেখেই রে’গে বোম হয়ে যাবে নিয়াজ খুব ভালোই জানে। ভেবেছিল কফিটা খেয়েই বেরিয়ে যাবে। কপালে আর নেই। কিসের খাওয়া, কিসের কি! তাকে আগে লুকাতে হবে। আশেপাশে তাকায়। কোনদিকে যাবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ করেই টেবিলের তলায় লুকিয়ে পড়ে।

সামনে বসা সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে নেয়। সে বুঝতে পারল না নিয়াজের কাহিনী। হঠাৎ এভাবে নিচু হয়ে গেল কেন? সন্ধ্যা ভাবলো, হয়ত নিয়াজের নিচে কোনো কিছু পড়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার গলা শুকিয়ে গেছে। কোল্ড কফি খাওয়ার জন্য পাইপে মুখ লাগানোর আগেই আকাশ এসে কোল্ড কফির গ্লাস সন্ধ্যার সামনে থেকে কেড়ে নিয়ে টেবিলের উপর ঠাস করে উল্টো করে রাখে। সন্ধ্যা দ্রুত মাথা তুলে তাকালে আকাশকে দেখে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। আকাশের দৃষ্টি দেখে মেয়েটা ঢোক গিলল। আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
– কোল্ড কফি তোমার এতো পছন্দ বউ?
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নিল। আশেপাশের অনেকে অবাক হয়েছে। আকাশকে সভাপতি হিসেবে মোটামুটি সবাই চেনে। সে বিবাহিত এটাও জানে। কিন্তু এই রেস্টুরেন্টে বসা মেয়েটি আকাশের বউ, এটা অনেকেই জানতো না।
আকাশ শ’ক্ত দৃষ্টি সন্ধ্যার পানে রেখে টেবিলের উপর বা হাতে জোরেসোরে একটি থাবা দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– নিয়াজ তুমি কি নিজে বেরোবে না-কি আমার হাত ময়লা করতে হবে?
নিয়াজ টেবিলের নিচ থেকেই ঢোক গিলে ভ’য়ে ভ’য়ে বলে,

– বিশ্বাস কর, আমি তোমার বোনকে একদম আমার বউয়ের চোখে দেখি।
কথাটা বলেই নিয়াজ জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলে,
– এই না না। থুক্কু। মানে বলতে চাইছিলাম, আমি তোমার বউকে বোনের চোখে দেখি। সত্যি।
সন্ধ্যা যদিও আকাশকে দেখে ভ’য় পাচ্ছে। কিন্তু টেবিলের তলা থেকে নিয়াজের কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে লুকিয়ে একটু হাসলো।
আকাশ এগিয়ে এসে সামান্য নিচু হয়ে ডান হাতে নিয়াজের শার্টের কলার ধরে টেবিলের তলা থেকে নিয়াজকে টেনে বের করে। নিয়াজ ঢোক গিলল। সে কিছু বলার আগেই আকাশ রাগান্বিত স্বরে বলে,
– এখানে কি হচ্ছিল?

নিয়াজ, সন্ধ্যা দু’জনেই ঢোক গিলছে বারবার। তারা আকাশের রা’গকেই বেশি ভ’য় পাচ্ছে। সন্ধ্যা এগিয়ে এসে আকাশকে নিয়াজের থেকে সরিয়ে দিতে চায়, ব্যাপারটি আকাশ খেয়াল করতেই নিয়াজকে ধাক্কা দিয়ে সন্ধ্যার চোয়াল শ’ক্ত করে ধরে। সন্ধ্যা গালে ব্য’থা পায়। আকাশ চোখ বুজল। রা’গে মাথা ফেটে যাচ্ছে। এই বে’য়া’দ’ব বউকে খুঁজতে খুঁজতে সে হয়রান হয়ে গিয়েছিল। আর এ এসে এখানে আরেক ছেলের সাথে গল্প করছিল। আবার এখন তার জন্য দরদ-ও দেখাচ্ছে!
আকাশ নিজেকে দমিয়ে নিতে চাইলো। চোখ খুলে
সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

– অন্যদের প্রতি দরদ দেখতে দেখতে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। সব ছুটাবো আজ।
কথাটা বলে সন্ধ্যার গাল ছেড়ে, শক্ত করে সন্ধ্যার হাত চেপে ধরে। এরপর নিয়াজের দিকে চেয়ে বলে,
– তোমার হিসাব আমি পরে করছি। আগে বউয়ের সাথে হিসাব মিটাই। খু’ন করে ফেলব তোমায়।
নিয়াজ আমতা আমতা করে বলে,
– ঠিকআছে।

নিয়াজের এমন স্বাভাবিক ভাবে বলা কথা আকাশের রা’গ আরও বাড়িয়ে দিল। আকাশ তেড়ে আসতে নিলে নিয়াজ পিছিয়ে যায়। আকাশ নিজেকে আটকালো। ভস্ম করে দেয়া দৃষ্টি নিয়াজের দিকে রেখে, সন্ধ্যাকে টেনে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়। গাড়ির কাছে এসে আকাশ দরজা খুলে দিলে সন্ধ্যা ভ’য়ে ভ’য়ে আকাশের দিকে তাকায়।
আকাশ সন্ধ্যাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে রে’গে সন্ধ্যাকে ধাক্কা দিয়ে সিটে বসিয়ে দেয়। এরপর শব্দ করে দরজা লাগায়। রা’গে মাথা কাজ করছে না। এপার-ওপার কয়েকবার হাঁটলো। এরপর হঠাৎ-ই গাড়ির দরজায় জোরেসোরে একটা লাথি বসায়। ভেতর থেকে সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। জানালা দিয়ে ভীত চোখে তাকায় আকাশের দিকে।
নিয়াজ রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে আকাশকে দেখে আবার-ও ঢোক গিলল। বেচারি কোথায় যে ফেঁসেছে। ইশ! আকাশ নিয়াজকে খেয়াল করতেই বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে দু’হাতে নিয়াজের কলার ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,

– তোদের দু’টোকেই মে’রে ফেলব একদম।
নিয়াজ মিনমিন করে বলে,
– তুমি কি আমাকে বন্ধু ভেবে তুই করে বলছ?
আকাশ চোয়াল শ’ক্ত করে নিয়াজের দিকে তাকালে নিয়াজ মেকি হেসে বলে,
– না মানে আমিও তাহলে তুই-এ কনভার্ট হতমা আর কি! তাই বলছি…….
আকাশের আর সহ্য হচ্ছে না। সে নিয়াজের কলার ছেড়ে আশেপাশে কিছু খুঁজল। নিয়াজ ছাড়া পেয়ে আর থাকে! সে একদিকে দৌড়ে দিয়েছে। আকাশ আশেপা কিছু না পেয়ে পায়ের জুতো খুলে নিয়াজের দিকে ছুড়ে মারে আর চেঁচিয়ে বলে,
– তোকে আমি খু’ন না করলে তোর নাম নিয়াজ না। বে’য়া’দ’ব!
নিয়াজ আকাশের কথা শুনতে পেয়ে বিড়বিড় করল,
– কি ছলচাতুরী! আমার এতো সুন্দর নাম বদলে দেয়ার ফায়দা লুটছে!

আকাশ সন্ধ্যাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। গাড়ি এতো জোরে চালিয়েছে, সন্ধ্যা তো ভেবেছিল আজ তাদের এক্সিডেন্ট নিশ্চিত।
সন্ধ্যা ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ ঘরে এসে শব্দ করে দরজা লাগালে সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। মাথা নিচু মেয়েটার। আকাশ বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এসে সন্ধ্যার সামনে দাঁড়ায়। সন্ধ্যা ভ’য়ে এক পা পিছিয়ে যায়। সন্ধ্যার এটুকু কাজে আকাশ আর-ও রা’গ’লো। ডান হাতে সন্ধ্যার গাল চেপে ধরে সন্ধ্যার মুখ উঁচু করে রাগান্বিত স্বরে বলে,
– কেন গিয়েছিলে ওখানে?
সন্ধ্যা আকাশের লাল চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে আবার সাথে সাথে চোখ বুজে নেয়। এমনিতেই বাড়িতে কেউ নেই, তার উপর আকাশের এতো রা’গ দেখে মেয়েটা ভ’য় পাচ্ছে ভীষণ। আকাশ দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
– সন্ধ্যামালতী, বিলিভ মি,, তোমাকে যাস্ট খু’ন করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ভদ্র মেয়ের মতো সুন্দর করে উত্তর দিয়ে আমাকে ঠান্ডা কর।
আকাশের শ’ক্ত করে বলা কথাগুলো শুনে সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ পকেট থেকে ফোন বের করে সন্ধ্যার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলে,

– দ্রুত টাইপ কর।
সন্ধ্যা চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকালে, আকাশ ধমক দিয়ে বলে,
– লিখতে বলেছি। আমার দিকে তাকাতে না। কথা কানে যায় না তোমার?
সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। মাথা নিচু করে নেয়। হা কাঁপছে তার। আকাশকে কি বলবে বুঝতে পারছে না। অপারেশনের কথা বললে যদি আরও রে’গে যায়? সন্ধ্যার কান্না পাচ্ছে। আকাশের সাথে তার একা আসা উচিৎ হয়নি একদম। লোকটা রে’গে গেলে একদম চেনা যায়না।
সন্ধ্যাকে চুপ দেখে আকাশ রাগান্বিত স্বরে বলে,
– সন্ধ্যামালতী আমি তোমাকে কিছু বলছি। আমার কথা শোনো। ওই বে’য়া’দ’ব টার সাথে কেন রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলে তুমি?
এটুকু বলে এগিয়ে এসে আবার-ও সন্ধ্যার গাল চেপে রে’গে বলে,

– বে’য়া’দ’ব মেয়ে, আমাকে বলিস নি কেন তোর রেস্টুরেন্টে যেতে ইচ্ছা করে, কোল্ড কফি খেতে ভালো লাগে? পুরো বাংলাদেশের প্রত্যেকটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে তোর সাধ মেটাতাম। কিন্তু তুই বাইরের ছেলের সাথে বসে এসব কোন সাহসে খাচ্ছিলি। বল?
সন্ধ্যা চোখ বড় বড় করে তাকায়। আকাশ সন্ধ্যার গাল ছেড়ে দেয়। এদিক-ওদিক পায়চারি করে কিছুক্ষণ। এরপর আবার-ও রে’গে বলে,

– ফোনে টাইপ কর দ্রুত। নয়তো আজ তোমাকে আমি ছাড়বো না বলে দিলাম।
সন্ধ্যা ঢোক গিলছে বারবার। তার মাথা কাজ করছে না। আকাশ দেখল, এক মিনিট, দুই মিনিট করে করে পুরো পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল। অথচ সন্ধ্যা সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আকাশ রে’গেমেগে সন্ধ্যার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে গায়ের জোরে ফোন আছাড় মা’রে। সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। তখন-ই আকাশ চিৎকার করে বলে,
– সন্ধ্যামালতী?? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস তুই?
কথাটা বলতে বলতে সন্ধ্যাকে থা’প্প’ড় মা’রা’র জন্য হাত উঠায় আকাশ। সন্ধ্যা ভ’য়ে চোখ বুজে নেয়। দু’হাতে জামা মুঠো করে ধরে।

আকাশ থেমে গিয়েছে। কি করতে যাচ্ছিল ভেবেই ঢোক গিলল। এবার নিজের উপর রা’গ হলো। সন্ধ্যার পেটে ধাক্কা দিয়ে সন্ধ্যাকে বেডের উপর ফেলে দিয়ে ঘরে বড়সড় একটি আয়না পুরো উল্টে ফেলে দেয়। আয়নাটি উপুড় হয়ে পড়ে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
আকাশ থামলো না। এগিয়ে এগিয়ে টি-টেবিলের কাচ উল্টে ফেলে দেয়। ঘরে যে কয়টা ফুলদানি ছিল সব একেএকে ছুড়ে ফেলে দেয়। জগ, গ্লাস থেকে শুরু করে সবকিছু একে একে ছুড়ে ফেলে।
সন্ধ্যা ভ’য়ে কেঁদে দিয়েছে। আকাশকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। তার ভীষণ ভ’য় লাগছে। এক পর্যায়ে ঘরে ভাঙার মতো কিছু না পেয়ে আকাশ ডিভানে একটা লাথি দেয়, যার ফলে ডিভান কয়েকহাত সরে যায়।
এরপর আকাশ থামলো। চোখ বুজে রেখেছে। শরীর কাঁপছে তার।

সন্ধ্যা দু’হাতে মুখ চেপে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। ঘরে পুরো ভূমিকম্পের মতো অবস্থা করে ফেলেছে। সন্ধ্যা বারবার শুকনো ঢোক গিলছে। এতোক্ষণ পর আকাশকে থামতে দেখে সন্ধ্যা একটু স্বস্তি পায়। প্রায় অনেকক্ষণ যাবৎ আকাশকে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্ধ্যা সাহস জুগিয়ে বেড থেকে নামতে গেলে আকাশ দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে বা হাতে সন্ধ্যার পেটে চাপ দিয়ে আটকে দেয়। মৃদুস্বরে বলে,
– নিচে নেমো না। পা কা’টবে।

সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। কিছুক্ষণ আগের আকাশ আর এখনকার আকাশের মাঝে রাত-দিন তফাৎ। কিছুক্ষণ আগেই আকাশ রে’গে কেমন পা’গ’লের মতো আচরণ করছিল আর এখন একদম ঠান্ডা! সন্ধ্যা দু’টো আকাশকে মেলাতেই পারছে না।
আকাশ খেয়াল করল, সন্ধ্যার দু’চোখ ভেদ করে নোনাপানি গড়িয়ে পড়েছে গালে। আকাশ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যার চোখে চোখ রেখে অনুতপ্ত স্বরে বলে,
– স্যরি সোনা বউ!
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। এই আকাশকেই সে সবচেয়ে বেশি চেনে। মনে হচ্ছে তার জানে পানি এসেছে।
সন্ধ্যার গালে গড়িয়ে পড়া নোনাপানি আকাশ তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে নিয়ে, আঙুলটি মুখে পুড়ে নেয়, মুখের ভঙ্গি এমন যেন আঙুলের ডগায় চকলেট ভরে খাচ্ছে। দৃষ্টি সন্ধ্যার পানে।
১০ সেকেন্ড এর মাথায় মুখ থেকে আঙুল বের করে মোহনীয় গলায় বলে,

– উম! টেস্টি সল্ট!
সন্ধ্যা অদ্ভুদ দৃষ্টিতে তাকায়। এই প্রথম শুনল, চোখের পানি টেস্টি লবণ হয়।
আকাশ সন্ধ্যার দিকে চেয়ে হিমশীতল কণ্ঠে বলে,
– আমি তোমাকে অবিশ্বাস করিনা সন্ধ্যামালতী। তবে ই’ব’লি’শকে একটু-ও বিশ্বাস করিনা। আমার ভোলাভালা বউয়ের মাথা খাওয়ার আগেই তোমার পেটে আমার বীজ দিয়ে দিচ্ছি। আমার বীজ পেটে থাকলে ই’ব’লি’শ তোমার দৃষ্টি আর এদিক-ওদিক নিয়ে যেতে পারবে না।
আকাশের কথা বুঝতে পেরে সন্ধ্যার শিরশির অনুভূত হয়। ঢোক গিলল মেয়েটা। ঠোঁট নাড়িয়ে আকাশকে কিছু বোঝাতে চায়। তার আগেই আকাশ সন্ধ্যার ঠোঁটে ডান হাতের বুড়ো আঙুল চেপে সন্ধ্যার চোখে দৃষ্টি রেখে ঠাণ্ডা গলায় বলে,

অন্তঃদহন পর্ব ৪২

– পরে শুনব। এখন আদর করতে দাও। পিপাসা পেয়েছে আমার।
কথাটা বলে সন্ধ্যার পিঠে বা হাত দিয়ে সন্ধ্যাকে উঁচু করে তার বরাবর নিয়ে আসে। ডান হাত আলতো করে সন্ধ্যার চুলের ভাঁজে নিয়ে নিজ ঠোঁটের ভাঁজে সন্ধ্যার ঠোঁট পুড়ে নেয়।

অন্তঃদহন পর্ব ৪৪