অন্তঃদহন পর্ব ৪৭

অন্তঃদহন পর্ব ৪৭
DRM Shohag

পরদিন রাত দশটার পর পর সন্ধ্যাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে দেয়া হয়। বাসায় আসতে আসতে রাত প্রায় ১২ টা বেজে যায়।
সন্ধ্যা বাসায় এসে আগে গোসল করেছে। তারপর নামাজ পড়ে আকাশের ঘরে শুয়ে পড়েছে। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। আকাশ কোথায় তারা কেউ এখনো জানেনা। তবে বায়ান বলেছে, আকাশ বিদেশ গিয়েছে। কোন দেশ এটা সে জানেনা।
সন্ধ্যার কান্না পায়। একটু পর পর মেয়েটার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। তার আকাশকে ছাড়া একটু-ও ভালো লাগেনা।

সৌম্য ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। আসমানী নওয়ান আনছিল। সৌম্য বাঁধা দেয়। উনাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছে। সে তার বোনুকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিবে বলেছে।
আকাশের চিন্তায় ভদ্রমহিলার চোখমুখ সবসময় মলিন হয়ে থাকে। আকাশ যে কোথায় গেল!
সন্ধ্যা সৌম্যকে দেখে দু’হাতে চোখ মুছে নেয়। এরপর ধীরে ধীরে উঠে বসে। সৌম্য সন্ধ্যার ভেজা চোখ দেখল। এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পাশে বেডের উপর বসে। ভাত মাখাতে মাখাতে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– একবার-ও না করবি না। সব ভাত খাবি। ওষুধ খাওয়া লাগবে।
সন্ধ্যা কিছু বলল না। সৌম্য ভাত মাখিয়ে সন্ধ্যার মুখের সামনে ধরলে সন্ধ্যা বিনাবাক্যে সৌম্য’র হাত থেকে ভাত মুখে নেয়। সৌম্য মৃদু স্বরে বলে,
– আকাশ ভাইয়া চলে আসবে বোনু। তুই আর কত কাঁদবি বল তো?
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে নেয়। তার খারাপ লাগলে সে কি করবে? সৌম্য আবার-ও ভাত এগিয়ে দিলে সন্ধ্যা ভাত মুখে নিয়ে চিবোয়।

নিউইয়র্কের একটি বিলাশবহুল বাড়িতে অরুণের বাসস্থান। ঘড়িতে সময় তখন দুপুর ২ টা। অরুণ দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় মাত্র গা এলিয়ে দিয়েছে। তখন-ই বাড়িতে কেউ সমানে বেল বাজায়। অরুণ বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নেয়। একটু রেস্ট নেয়ার-ও সুযোগ পায় না। পুরাই হতাশ! সে উঠলো না। গাট্টি মে’রে শুয়ে থাকলো। যে হয় হোক। তার আরামের সময় আসলে ব্যারাম ভোগ করতে হবে। কিছু করার নেই। অতঃপর অরুণ ফোনে মনোযোগ দিল। এক, দুই করে পুরো পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল। অথচ কলিংবেল এক সেকেন্ডের জন্য থামেনি। অরুণ চরম বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আলস্য ছেড়ে দু’হাতে ট্রাউজার টেনে একটু উপরে তুলল। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। ডান হাতের এক আঙুল কানের ভেতর ঢুকিয়ে ঘোরালো। কোন বে’য়া’দ’ব তার কানের বারোটা বাজাতে এসেছে কে জানে! দরজা খুলেই আগে এক থাবড়া দিবে।

অরুণ দরজা খুলেই ডান হাত তুলেছে, থা’প্প’ড় মা’রা’র জন্য। তার আগেই তার বাম গালে শক্তপোক্ত এক থা’প্প’ড় পড়ে। অরুণ হতভম্ব হয়ে যায়। তার কানের বারোটা বাজিয়ে তাকে থা’প্প’ড় মা’র’লো?
কিন্তু সামনে তাকিয়ে অরুণের চোখজোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়। ও মা! এতো স্বয়ং আকাশ তার বাড়িতে। অরুণ বা হাত বাম গালে রেখে বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– তুইইই?
আকাশ কিছু বলল না। অরুণকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে লাগেজ নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। অরুণ দরজা আটকে দ্রুত উল্টো ঘুরে তাকায়। দু’হাতে চোখ কচলে আবার-ও তাকায়। নাহ, চোখ তো একদম ঠিক আছে। তাহলে এটা কে? অরুণ দৌড়ে গিয়ে আকাশের সামনে দাঁড়ায়। আকাশ বিরক্ত চোখে তাকায় অরুণের দিকে। অরুণ আঙুল উঁচিয়ে বলে,
– সত্যি করে বল, তুই আকাশ না-কি আকাশের বেশে আমার ঘাড় মটকাতে এসেছিস? ভুলভাল প্ল্যান নিয়ে আসলে এক্ষুনি বেরিয়ে যা। কারণ আমি কোনো জ্বিন-ভূ’ত ভ’য় পাইনা। আন্টারস……
বাকিটুকু বলার আগেই আকাশ অরুণের অপর গালে আরেকটি থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। বা হাতে অরুণের টি-শার্ট টেনে ধরে রে’গে বলে,

– তোর ভাষণ শোনার জন্য আমি এখানে আসিনি। ঘুমাতে এসেছি। দূরে থাকবি আমার থেকে।
কথাটা বলে আকাশ অরুণের কলার ছেড়ে চারপাশে তাকালো। একটি রুম খোলা দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল। এদিকে অরুণের চোখেমুখে বিস্ময়। এ বাংলাদেশ থেকে নিউইয়র্কে ঘুমাতে এসেছে? জীবনের প্রথম এতো ঘুমপ্রিয় মানুষ দেখল। যার বাংলাদেশে ঘুম হচ্ছিলনা, তাই নিউইয়র্কে ঘুমাতে চলে এসেছে। বাহ!
কথাগুলো ভেবে অরুণ দু’হাত দু’গালে রেখে অসহায় কণ্ঠে বিড়বিড় করল,
– শুধু ঘুমাতে নয়, আমার ফর্সা গাল দু’টো যে আলু বানাতে এসেছিস সেটাও বুঝে গেছি।
কার ঝাল এসেই তার উপর মেটালো কে জানে! ঠাস করে দরজা লাগানোর শব্দ পেয়ে অরুণ উল্টো ঘুরে দেখল আকাশ তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। অরুণ দৌড়ে গিয়ে দরজা থাপড়ে বলে,
– এই দরজা খোল। আমার একটাই পরিষ্কার রুম!

বেশ কিছুক্ষণ থা’প্প’ড় দিয়েও আকাশের কোনো রেসপন্স না পেয়ে অরুণ হতাশ চোখে চাইল। সে একা থাকে বলে এই একটা রুম-ই ইউস করা হয়। বাকিসব রুম তালাবদ্ধ। কিন্তু এই নবাব এসে কি সুন্দর করে তার রুম দখল করে নিল! সব কপালের দোষ! তার আরামের পুরো ব্যারাম করে দিল। কিন্তু আকাশ হঠাৎ এখানে কেন? সবচেয়ে বড় কথা এর বউকে রেখে এতোদূরে এসেছে? কাজের সূত্রে আসতেই পারে। এর আগেও তো এসেছে। কিন্তু সন্ধ্যার রেখে, এই ব্যাপারটা অরুণের কাছে মারাত্মক ঘাবলা লাগলো। দরজায় থা’প্প’ড় দিয়ে চেঁচিয়ে বলে,
– এই আকাশ তুই দেশ ছেড়ে এলি কেন? কাজে এসেছিস না-কি? তাহলে তোর বউকে কোথায় রেখে এলি?
ওপাশ থেকে কোনো কথা নেই। অরুণ আরও কয়েকবার ডাকলো। কোনো সাড়া না পেয়ে অরুণ পকেট থেকে ফোন বের করল। বাংলাদেশের কাকে ফোন দেয়া যায় সেটাই ভাবছে। আসমানী নওয়ানকে কল দিতে গিয়েও দিল না। এখন বাংলাদেশে রাত। উনি হয়তো ঘুমিয়েছে। তাই অরুণ সৌম্যকে কল করল। শুনুক, আকাশ আসলে কেন এসেছে।

সৌম্য সন্ধ্যাকে খাবারের শেষ নোলা মুখে দিয়ে পানি এগিয়ে দেয়। সন্ধ্যা দু’হাতে গ্লাস ধরে পানি খেয়ে নেয়। সৌম্য হাত ধুয়ে আসে। তখন-ই তার ফোন কল আসে। সৌম্য পকেট থেকে ফোন বের করলে অরুণের নাম্বার দেখে ভ্রু কোঁচকালো। অরুণ তো আকাশের ফ্রেন্ড। হঠাৎ তাকে ফোন দেয়ার কারণ বুঝল না। এতো না ভেবে কল রিসিভ করে কল লাউডে দিয়ে অরুণকে সালাম দেয়। এরপর ফোন বিছানার উপর রেখে সন্ধ্যার ওষুধ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে,
– ভাইয়া কিছু বলবেন?
অরুণ ওপাশ থেকে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ বলব। বলছি, আকাশ হঠাৎ আমার এখানে আসলো কেন? মানে জানতে চাইছিলাম ও কী কাজে এসেছে? জানো কিছু?
অরুণের কথায় সৌম্য’র হাত থেমে যায়। দৃষ্টি উঠিয়ে সন্ধ্যার দিকে তাকালে দেখল সন্ধ্যা অবাক হয়ে চেয়ে আছে। সৌম্য বুঝল, আকাশ তার মানে নিউইয়র্ক অরুণের কাছে গিয়েছে। সৌম্য বেশ অনেকগুলো ওষুধ ছিঁড়ে একসাথে সব সন্ধ্যার হাতে দিয়ে ছোট করে বলে,

– খেয়ে নে বোনু।
এরপর সৌম্য ফোন হাতে নিয়ে অরুণকে সব বলে। সন্ধ্যার গলার অপারেশন করিয়েছে আকাশকে না জানিয়ে। আর এ কারণেই আকাশ রা’গ করে চলে গিয়েছে। অরুণ সব শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। সে নিজেই ছোটোখাটো এক শক খেয়েছে মনে হচ্ছে। সন্ধ্যার অপারেশনের ব্যাপারটা হজম করতে প্রবলেম হচ্ছে। নিজেকে সামলে বলে,
– তার মনে সন্ধ্যা এখন কথা বলতে পারে?
সৌম্য ছোট করে বলে,
– জ্বি ভাইয়া।

অরুণ হাসল। ভীষণ ভালো লাগছে তার। একটি মেয়ে যে হঠাৎ কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলে, তখন তার কত ক’ষ্ট হয়, সেই ক’ষ্ট অন্যরা অনুভব করতে না পারলেও একটু আন্দাজ তো করতে পারে। আর হঠাৎ একদিন সেই ক’ষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে গেলে, না জানি কতটা আনন্দ হয়! সন্ধ্যার সাথে অরুণের আহামরি ভালো সম্পর্ক নয়। আকাশের বউ হিসেবে যা একটু-আধটু চেনে। তাতেই তার এতো ভালো লাগছে। অতঃপর অরুণ শব্দ করে বলে ওঠে,
– সন্ধ্যাকে দ্রুত ফোনটা দাও। দেখি কথা বলি সন্ধ্যার সাথে। আমার তো ভাবতেই ভালো লাগছে। নিশ্চয়ই তোমার বোনের কণ্ঠ খুব মিষ্টি! দাও দাও দ্রু…….

বাকিটুকু বলার আগেই দেখল আকাশ দরজা খুলে তার দিকে খেয়ে ফেলা চোখে তাকিয়ে আছে। অরুণ ঢোক গিলল। আকাশকে এগিয়ে আসতে দেখে অরুণ পিছিয়ে যায়। অলরেডি আকাশের হাতে দু’টো থা’প্প’ড় খেয়েছে, আবার তার দিকে এগোচ্ছে। অরুণ আমতা আমতা করে বলে,
– এই সৌম্য আমি জীবনেও সন্ধ্যার সাথে কথা বলব না। নিশ্চয়ই তোমার বোনের কণ্ঠ জ’ঘ’ণ্য’র চেয়েও জ’ঘ’ণ্য। ছ্যাহ! আমি এতো জ’ঘ’ণ্য কণ্ঠ কখনোই শুনতে চাই না।
ওপাশে সৌম্য সন্ধ্যার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যা পানি খাচ্ছিল। অরুণের কথা শুনে সৌম্য, সন্ধ্যা দু’জনেই বিস্মিত হয়। সন্ধ্যা পানি খাওয়ায় পানি গলায় বাঁধে, ফলস্বরূপ মেয়েটার কাশি উঠে যায়। সৌম্য দ্রুত এগিয়ে এসে সন্ধ্যার মাথায় আলতো হাতে চাপড় দেয়।

এতোদিন কথা বলতে না পারায় সন্ধ্যার কাশির শব্দ ভীষণ ক্ষীণ ছিল। কিন্তু এখন কণ্ঠস্বর ঠিক হওয়ায় কাশির শব্দ জোরে হয়। যা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
অরুণের ফোন লাউডে থাকায় সন্ধ্যার কাশির শব্দ স্পষ্টভাবে ফোনের এপাশে ভেসে আসে। অাকাশ থমকায়। বুক ধুকধুক করছে তার। মনে হচ্ছে কিছু একটা তৃষ্ণা পাচ্ছে তার। সেকেন্ডে সেকেন্ডে সেই তৃষ্ণা বাড়তে লাগলো। হঠাৎ-ই কল কেটে যায়, ফলস্বরূপ সন্ধ্যার কাশির আওয়াজ থেমে যায়। আকাশ ঢোক গিলল। অরুণ আকাশের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। মৃদুস্বরে বলে,
– কি খাবি বল? রেডি করে দিচ্ছি।
আকাশ রে’গে বলে,
– তোকে।
অরুণ হতাশ কণ্ঠে বলে,

– ঠিকআছে, আমি বুঝে গেছি তুই আমাকে খেতেই এখানে এসেছিস। আমি ওভেন এর মধ্য গিয়ে বসছি। তুই একটু পর আমার গ্রিল বের করে খেয়ে নিস।
আকাশ বিরক্ত চোখে তাকালো। অতঃপর গলা ঝেড়ে বলে,
– সৌম্যকে কল কর।
অরুণ সাথে সাথে বলে,
– কেন?
আকাশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
– ওর কাশি থেমেছে কি-না শোন।
অরুণ এবার আকাশের ব্যবহারে অবাক হলো না। সে বলে,
– তোর বউ তুই শোন। আমি মানুষের বউয়ের খোঁজ নিইনা।
আকাশ অরুণের দিকে আবার-ও তেড়ে আসলে অরুণ দ্রুত কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,

– এই দাঁড়া দাঁড়া শুনছি।
এই বলে সৌম্যকে কল করতে করতে বিড়বিড় করে,
– জীবন শেষ আমার!
সৌম্য কল রিসিভ করলে অরুণ জিজ্ঞেস করে,
– সৌম্য সন্ধ্যার কাশি কি থেমেছে?
অরুণের প্রশ্ন শুনে সৌম্য’র কপালে ভাঁজ পড়ে। অরুণের কাছে এরকম প্রশ্ন আশা করেনি সে। অরুণ আবার-ও জিজ্ঞেস করলে সৌম্য ছোট করে বলে,
– জ্বি ভাইয়া।
অরুণ হেসে বলে,
– আচ্ছা বাই। পরে কথা হবে।
বলেই অরুণ কল কেটে দেয়। ততক্ষণে আকাশ অরুণের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে। অরুণ চুপচাপ দেখল আকাশের কান্ড। আকাশকে আগের চেয়ে অনেকটা চুপচাপ লাগছে।

পরদিন সকাল সকাল সন্ধ্যা ঘুম থেকে উঠে সবকাজ করে নিজেকে পরিপাটি করে বেলকনিতে আসে। মনমরা হয়ে বসে থাকে বেলকনির ধারে। দৃষ্টি বকুল গাছতলায়। আকাশকে ঘিরে এই জায়গাটি সন্ধ্যার ভীষণ পছন্দের। সন্ধ্যার মুখে হাসি ফোটে, আকাশ এই দেশে নেই ভাবতেই সে হাসি মিলিয়ে-ও যায়। কবে আসবে আকাশ? সকালে উঠে আকাশের নাম্বারে অনেকবার কল দিয়েছিল, প্রতিবার ফোন বন্ধ পেয়েছে। সন্ধ্যা মলিন মুখে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা উঠে দাঁড়ায়। উদ্দেশ্য বকুলগাছতলায় গিয়ে ফুল কুড়িয়ে আনবে।
সন্ধ্যা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানে আসে। ছোট ছোট পায়ে গাছটির দিকে এগিয়ে যেতে নিলে তার চোখে পড়ল, গাছের কাছে একটি কাপড়ের স্তূপ। সন্ধ্যা অবাক হয়। এখানে এতো কাপড় পড়ে আছে কেন বুঝল না। সন্ধ্যা পায়ের গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। সামান্য ঝুঁকে কাপড়গুলো নেড়েচেড়ে দেখে বিস্মিত হয়। এগুলো তো সব আকাশের কাপড়। কিছু কাপড় তার, যেগুলো আকাশ তাকে কিনে দিয়েছিল। সন্ধ্যা ঢোক গিলল।
তখন-ই পিছন থেকে তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে লিমা ডাকে,

– আপামণি?
সন্ধ্যা পিছু ফিরল। মেয়েটির নাম ঋতু। বয়স ২২ এর উর্ধ্বে হবে। আকাশদের বাড়ি কাজের লোক আগে থেকেই ছিল। তবে অন্যান্য কাজের জন্য। রান্নার কাজটা সবসময় আসমানী নওয়ান করতেন, এখন-ও করে। তবে এই বাড়ির কাজের মানুষেরা সবসময় নিজেদের মতো কাজ করে তাদের বাড়ি চলে যেত। আর সন্ধ্যার সাথে যেটুকু দেখা হত, সে পর্যন্ত-ই। সে কথা বলতে না পারার জন্য তার সাথে এনার তেমন ভালো সম্পর্ক নয়। গত দু’দিন আগে সন্ধ্যার অপারেশন হওয়ায় উনারা এই বাড়ি ছিলেন। আসমানী নওয়ান রেখে দিয়েছিলেন। এখন সন্ধ্যা কথা বলতে পারে, এজন্য সন্ধ্যাকে দেখে মেয়েটি এগিয়ে এসেছে। সন্ধ্যা মৃদুস্বরে বলে,

– জ্বি আপু?
মেয়েটি এগিয়ে এসে সন্ধ্যার পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বলে,
– আমি এই প্রথম দেখলাম অপারেশন কইরা কেউ কথা কইতে পারে। তোমার কণ্ঠ মেলা সুন্দর।
ঋতুর কথায় সন্ধ্যা মৃদু হাসল। অতঃপর বলে,
– এই কাপড়গুলো এখানে কেন আপু?
ঋতু মৃদুস্বরে বলে,

– এইগুলো আকাশ স্যার ফেলায় দিতে কইছে। আমরা একটু পর এইগুলা এই বাড়ি থেইকা সরায় ফেলমু।
মেয়েটির কথা শুনে সন্ধ্যা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। তার মনে আছে, সে আকাশকে জিজ্ঞেস করেছিল। আকাশ কেন সাদা পাঞ্জাবি পরে। আকাশ বলেছিল, তার পছন্দ বলে আকাশ এসব পরে। আর আজ এগুলো সব বাইরে ফেলে দিয়েছে। সন্ধ্যার চোখের কোণে পানি জমে। আকাশের এসব ব্যবহার সে নিতে পারছে না। এমনিতেই কোন সূদুরে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। তার উপর এসব কথা শুনলে কেমন লাগে? সন্ধ্যা নিজেকে সামলালো। অতঃপর মেয়েটির দিকে চেয়ে বলে,

– এগুলো ফেলা যাবেনা। সব ঘরে নিয়ে চলো।
ঋতু ঢোক গিলল। গতকাল আকাশ যা রা’গ করল। এগুলো না ফেললে যদি আরও রে’গে যায়? সন্ধ্যার দিকে চেয়ে বলে,
– এইগুলো কাপড় মনে হয় আকাশ স্যারের পছন্দ নয়। আকাশ স্যার যদি জানে এইগুলো এহনো ফালাইনি। উনি মেলা রা’গ করবো আপামণি।
সন্ধ্যা বিরক্ত হলো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে নরম করে বলে,
– আর এগুলো ফেলে দিলে আমি রা’গ করব।
ঋতু বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। ফেলে না দিলে বর রে’গে যায়। ফেলে দিলে বউ রে’গে যায়। এখন সে কি করবে?
সন্ধ্যা পা ভাঁজ করে বসে কাপড়গুলোর কিছু অংশ উঠাতে উঠাতে বলে,
– তুমি আমাকে হেল্প কর আপু।
ঋতু নিচু হয়ে সন্ধ্যার হাত আটকে দিয়ে বলে,
– আমি করতাছি আপামণি। আপনি কাজ করলে আসমানী খালাম্মা আমারে বকবো। আপনি শুধু আকাশ স্যরের থেকে আমারে একটু বাঁচাইয়েন।
সন্ধ্যা ছোট করে বলে,

– উনি দেশে নেই।
এটা শুনে ঋতু একটু স্বস্তি পায়। অতঃপর বলে,
– তাইলে দেশে আইলে আমারে বাঁচাইয়েন।
সন্ধ্যা ভ্রু কোঁচকালো। আকাশকে এতো ভ’য় পাওয়ার কি আছে? অদ্ভুদ!
পিছন থেকে আসমানী নওয়ান সন্ধ্যাকে ডেকে বলে,
– এইহানে কি করতাছস জান্নাত?
আসমানী নওয়ানের কথা শুনতে পেয়ে সন্ধ্যা এগিয়ে গেল ভদ্রমহিলার দিকে। মন খারাপ করে বলে,
– তোমার ছেলে আসলেই অনেক খারাপ খালাম্মা।
আসমানী নওয়ান থমথমে মুখে তাকায় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আসমানী নওয়ান সন্ধ্যার গালে হাত দিয়ে মৃদু হেসে বলে,

– আমার খারাপ ছেলের জন্য-ই তো কেঁদেকেটে নিজেরে অসুস্থ বানাইয়া ফালাইতাছস। খারাপ ভাইবা একটু কম কাঁদলেও তো পারিস!
এটুকু সময়েই সন্ধ্যার চোখজোড়া ভরে উঠল। আসমানী নওয়ান মৃদুস্বরে বলে,
– আবার কাঁদে। ওয় এমনেই আসবো। তা আমার ছেলে নতুন করে কি করল?
সন্ধ্যা নাক টেনে বলে,
– তোমার ছেলে আমার পছন্দের সব কাপড় ফেলে দিয়েছে খালাম্মা। ওই দেখ।
লাস্ট কথাটা ঘাড় বাঁকিয়ে আঙুল দিয়ে দেখালো। আসমানী নওয়ান কাপড়ের স্তূপ দেখে অবাক হয়। তার ছেলেকে সে নিজেই চিনতে পারছে না। ভদ্রমহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মৃদুস্বরে বলে,
– আবার ওয় তোর পছন্দের সব যত্ন কইরা কুড়াইবো মা। এহন একটু রা’ইগা আছে। তুই একটু শান্ত হ।
সন্ধ্যা কিছু বলল না। তার খারাপ লাগলে সে কি করবে?
আসমানী নওয়ান ঋতু মেয়েটিকে বললেন, সবগুলো কাপড় ওয়াশিংমেশিনে দিয়ে ধুয়ে দিতে। মেয়েটি সম্মতি দিয়ে কাপড়গুলো ভেতরে নিয়ে যায়।

ঘড়িতে তখন সময় রাত আটটা।
আকাশের ফেলে দেয়া সব কাপড় ধুয়ে শুকানোর পর সৌম্য সব স্ত্রী করে এনে দিয়েছে। সন্ধ্যা বলেছিল তাই সৌম্য বিনাবাক্যে তার বোনুর আবদার পূরণ করেছে।
সন্ধ্যা একটা একটা করে কাপড় ভাঁজ করছে কাভার্ডে তুলে রাখবে বলে। থেকে থেকে ডানহাতে চোখের পানি মুছে। ভীষণ খারাপ লাগছে তার। কিন্তু সন্ধ্যা থামলো না। সবগুলো কাপড় একাহাতে গুছাতে ব্যস্ত সে।
এদিকে নিউইয়র্কে তখন সকাল ১০ টা। আকাশের কোলের উপর ল্যাপটপ। স্ক্রিনে সন্ধ্যার কাপড় গোছানোর ভিডিও চলছে। অর্থাৎ সে লাইভ দেখছে। এগুলো যে তার ফেলে দেয়া কাপড়, আকাশ খুব ভালো করেই বুঝল। বিড়বিড় করে,

– ভালো!
সন্ধ্যা একটু পর পর চোখ মুছে। আবার কাপড় ভাঁজ করে। আকাশের চোখ এড়ায়নি সন্ধ্যার কান্নামাখা চোখ। বেশ কয়েকবার সন্ধ্যাকে এমন করতে দেখে আকাশ ডিভানে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে নেয়। বিড়বিড়িয়ে বলে,
– সন্ধ্যামালতী? মনে হচ্ছে তোমাকে শতখানেক থা’প্প’ড় দিয়ে তোমার কাছে থেকে যাওয়া ভালো ছিল!
আকাশের পিছনে অরুণ এসে দাঁড়িয়েছে। আকাশকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল আকাশের ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি পড়ায়। অরুণ মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে দেখল সন্ধ্যা কাপড় গোছাচ্ছে, সেই লাইভ চলছে বাতাস বাবুর ল্যাপটপে। অরুণ মনে মনে বিড়বিড় করে,

– ওরে বাটপার! দাঁড়া তোর ব্যবস্থা করছি।
এরপর অরুণ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ফোন বের করে সন্ধ্যার নাম্বার ডায়াল কলে আনে, সন্ধ্যার নাম্বার সে সৌম্য’র থেকে নিয়ে রেখেছে কথা বলার জন্য, অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কথা-ই বলত। এখন আকাশের কান্ড দেখে মনে হচ্ছে গুরুত্বটা আরও বেড়ে গিয়েছে। সে অপেক্ষা করছে আকাশ কখন এই ভিডিও থেকে বেরিয়ে অন্য কাজে ফোকাস করবে।

প্রায় মিনিট পাঁচ পর আকাশ সোজা হয়ে বসে। সন্ধ্যা ততক্ষণে সবগুলো কাপড় ভাঁজ করে একে একে সব কাভার্ডে তুলে ফেলেছে। লাস্ট দু’টো কাপড় কাভার্ডে রেখে সন্ধ্যা বেডের উপর এসে বসে। হাঁপিয়ে গিয়েছে। আকাশ আরও অনেকটা সময় নিয়ে সন্ধ্যাকে চুপচাপ দেখল।
পিছন থেকে অরুণ এপাশ-ওপাশ হাঁটছে। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে ডান হাত রেখে বিরক্ত চোখে তাকালো আকাশের দিকে। রা’গ লাগছে তার। গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করল,
– এই বে’য়া’দ’ব কাজ কর। সারাদিন শুধু বউকে দেখা!
কিন্তু মনের কথা আর মুখ ফুটে বের করল না। এমনিতেই এর মে’জা’জ ভালো না। সব ঝাল শুধু তার উপর মেটাতে আসে। কথাটা ভেবেই অরুণ হতাশ হলো।

হঠাৎ-ই আকাশ ল্যাপটপে আঙুল চালিয়ে অন্য কাজে মন দিলে অরুণ হাফ ছেড়ে বাঁচে। পিছনদিকে এক দৌড় দিয়ে একেবারে বাড়ির বাইরে চলে আসে। এরপর দ্রুত সন্ধ্যার নাম্বারে কল করে।
সন্ধ্যা এখনো বিছানায় বসে রেস্ট নিচ্ছিল। টেবিলের উপর রাখা ফোনটি শব্দ করে বেজে উঠলে সন্ধ্যা এগিয়ে এসে তার ফোন হাতে নেয়। নাম্বারটি সে চিনলো না। কেমন যেন বিদেশি নাম্বার মনে হলো। ফোনটি রেখে দিতে গিয়েও কি মনে করে ফোন রিসিভ করে কানে দেয়। সাথে সাথে অরুণ বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– সন্ধ্যা ঘর থেকে বের হও, বের হও। তাড়াতাড়ি।
এপাশে সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। ভ’য় পেয়েছে বেচারি। কে এটা? তার নাম জানলো কি করে? আর তাকে ঘর থেকে বেরোতেই বা বলছে কেন? ঢোক গিলে ছোট করে বলে,

– মানে?
অরুণ নিজেকে শান্ত করল। এরপর শ্বাস ফেলে বলে,
– আমি অরুণ। তুমি ঘর থেকে বের হও। তোমার সাথে খুব ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। ঘরে থাকলে কথা বলা যাবে না।
সন্ধ্যা অরুণকে চিনতে পেরে স্বস্তি পেল। অরুণের কথা মেনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মৃদুস্বরে বলে,
– জ্বি ভাইয়া এসেছি।
অরুণ একটু থামলো। এবার সন্ধ্যার কণ্ঠ মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। হেসে বলে,
– আরে সন্ধ্যা তোমার ভয়েস তো মারাত্মক সুন্দ……
এটুকু বলে থামে অরুণ। আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গলা ঝেড়ে বলে,
– মানে সুন্দর আর কি!
সন্ধ্যা কি বলবে বুঝল না। একটু চুপ থেকে বলে,

– ধন্যবাদ ভাইয়া।
অরুণ বলে,
– ইম্পর্ট্যান্ট কথাটা শোনো। তুমি চাও তো আকাশ দেশে ফিরুক তাইনা? এমনি-ও ফিরবে, চিন্তা কর না। কিন্তু দ্রুত ফিরুক এটাই চাও তো?
ইতোমধ্যে সন্ধ্যার চোখের কোণে পানি জমেছে। মৃদুস্বরে বলে,
– উনি দ্রুত ফিরবেন না ভাইয়া?
অরুণের খারাপ লাগলো। এটুকু সময়ের মাঝেই মেয়েটার গলা ভার হয়ে গিয়েছে। অরুণ বলে,
– ফিরবে। আমি যা যা বলব, সব করবে। তাহলেই দেখবে তোমার এই ব’জ্জা’ত হাসবেন্ড প্ল্যান ছাড়াই উড়ে উড়ে তোমার কোলের উপর গিয়ে পড়েছে।
অরুণের কথায় সন্ধ্যা হেসে ফেলল। অরুণ আবার-ও বলে,

– আকাশের ঘরে সিসি-ক্যামেরা আছে বুঝেছ? সিসি-ক্যামেরা ঘরের উপরদিকে কোনো এক কোণায় থাকে। তুমি একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবে। ওই ক্যামেরা দিয়ে সারাদিন বসে বসে তোমাকে দেখে। এই পথটা তুমি বন্ধ করে দাও। দেখবে কাজ হয়ে যাবে।
সন্ধ্যা অবাক হলো। তার মানে সে ঘরে যা যা করে আকাশ সব দেখতে পায়। কথাটা ভেবে সন্ধ্যার একটু অদ্ভুদ অনুভূতি হলো। অতঃপর ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কি কাজ হবে ভাইয়া?
সন্ধ্যার কথায় অরুণ বুঝল সন্ধ্যা একটু বোকা টাইপ মেয়ে। সে তো সব বলেই দিল, তবুও মেয়েটা বোঝেনি। সে বলে,

– এখানে বসে তোমাকে দেখতে পেলে সে বাংলাদেশে যাবেনা। যখন তোমার কোনো খোঁজ পাবেনা, তখন দেখবে আকাশ বাংলাদেশে গিয়ে হাজির হয়ে যাবে। বুঝেছ?
সন্ধ্যা এবার বুঝল। মৃদুস্বরে বলে,
– জ্বি ভাইয়া।
অরুণ বলে,
– সিসি-ক্যামেরার সামনে একটি কাগজ বা ঢেকে রাখার মতো কিছু দিয়ে রাখবে। তাহলেই হবে। বুঝতে পেরেছ?
সন্ধ্যা বলে, সে বুঝেছে। অরুণ কল কেটে সন্ধ্যার নাম্বারে আকাশের নতুন নাম্বার মেসেজ করে দেয়। এরপর ডানদিকে ফিরলে আকাশকে তার থেকে তিনহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরুণ চোখ বড় বড় করে তাকায়। গেল সব গেল রে! ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলে,

– ইন্নালিল্লাহ! লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজজোলিমিন। তারপর যেন কি?
আকাশ অরুণকে একা একা বিড়বিড় করতে দেখে বিরক্ত চোখে চেয়ে অরুণকে পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে যায়। অরুণ দ্রুত উল্টো ঘুরল। আকাশকে ঠান্ডা দেখে বুজল, তার কথা শোনেনি। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে টি-শার্ট উঁচু করে বুকে থুতু দেয়ার ভঙ্গি করে।
পাশ থেকে একটি মেয়ে ডাকে,
– অরুণ কেমন আছো?
অরুণ ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটিকে দেখে মৃদু হেসে বলে,
– এইতো ভালো। তুমি কবে আসলে অলিভিয়া?
– গতকাল এসেছি।
কথাটা বলতে বলতে অলিভিয়া এগিয়ে এসে অরুণকে জড়িয়ে ধরতে নিলে অরুণ দ্রুত দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলে,

– আরে আরে ডিস্টেন্স রাখো।
অলিভিয়া অবাক হয়ে বলে,
– এতো চেঞ্জ কেন?
অরুণ একটু হেসে বলে,
– এমনি-ই। বাংলাদেশি কালচার ফলো করছি বুঝলে?
অলিভিয়া মৃদুস্বরে বলে,
– হ্যাঁ ভালো। আচ্ছা তোমার বাড়ি থেকে যে ছেলেটা বেরিয়ে গেল, সে কে?
অরুণ উত্তর দেয়,
– ও আমার ফ্রেন্ড। গতকাল বাংলাদেশ থেকে এসেছে। বাড়ি ফিরলে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।
অলিভিয়া মাথা নেড়ে বলে,

– দরকার নেই পরিচয় করানোর। জানো গতকাল তোমার এই বন্ধুর পাশের সিট আমার ছিল। তোমার ফ্রেন্ড গান গাইছিল। আমি শুনে একটু প্রশংসা করলাম। ওমনি সে কি এক লুক দিল! মনে হলো, আমি তার প্রশংসা নয়, তাকে খু’ন করতে চেয়েছি। যদিও ব্যাপারটা ভীষণ ভালো লেগেছে।
অরুণ হাসল। অতঃপর বলে,
– ভালো লাগা পর্যন্ত-ই রাখো। বেশিদূর এগিয়ো না।
অলিভিয়া উল্টোদিকে যেতে যেতে বলে,
– কি যে বলো! আমি তো সব সেরে ফেলেছি।
অরুণ চোখ বড় বড় করে বলে,
– কি সব সেরে ফেলেছ?
অলিভিয়া একবার পিছু ফিরে হেসে বলে,

– সিক্রেট।
এরপর দৌড় দেয়। অরুণ কেশে উঠল। বিড়বিড় করল,
– সপ্তাহের সব বার এবার তোমার কপালে বাজবে অলিভিয়া।

পরদিন,
সন্ধ্যা মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে ওয়াশরুম থেকে। ঘরে সে একাই থাকে বিধায়, ঘরে এসেই শাড়ি পরে। এবারেও সেই কাজটি-ই করছে। শাড়ির দু’টো পার্ট ওয়াশরুম থেকে পরে, শাড়ি হাতে রেখেছে। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোমরে শাড়ির দু’টো প্যাঁচ দিয়ে থেমে যায়। হঠাৎ গতকাল রাতে অরুণের বলা কথাটি মনে পড়ল, এই ঘরে সিসি-ক্যামেরা আছে। আকাশ তাকে সবসময় দেখে। কথাটি মনে পড়তেই সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। দ্রুত শাড়ি তুলে নিজেকে ঢেকে নিল।

নিউইয়র্কে এখন রাত ৩ টা। আকাশ ঘুমোয় নি। বরং সন্ধ্যাকে দেখছিল। হঠাৎ সন্ধ্যা নিজেকে এভাবে ঢেকে নেয়ায় আকাশের চোখেমুখে বিরক্তি ভর করে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সন্ধ্যার দিকে।
সন্ধ্যা ঘরের একটি টেবিল টেনে নিয়ে আসে। টেবিলের উপর একটি চেয়ার তুলে দেয়। এরপর সন্ধ্যা হাতে একটি কাগজ নেয়। তারপর চেয়ারে পা দিয়ে টেবিলের উপর উঠে, ধীরে ধীরে টেবিলের উপর রাখা চেয়ারের উপর উঠে দাঁড়ালে সন্ধ্যার মুখ একদম ক্যামেরার সামনে আসে।
আকাশ সন্ধ্যার কার্যকলাপ বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ ক্যামেরার সামনে সন্ধ্যাকে দেখে অবাক হয়।
এদিকে সন্ধ্যা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসল। এরপর হাতের কাগজ দু’ভাঁজ করে ক্যামেরার সামনে একদম ভালোভাবে বসিয়ে দেয়।
ক্যামেরা কালো হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আকাশ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে ওঠে,

– আরে…..
আকাশের পিছন থেকে অরুণ বলে ওঠে,
– কিরে?
আকাশ রে’গে ঠাস করে ল্যাপটপের স্ক্রিন বন্ধ করে অরুণের দিকে তাকায়। অরুণ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– মাত্র এসেছি। লাস্ট সিনটা চোখে পড়ল। তোর বউটা খুব চালাক তাইনা রে?
আকাশ কোলের উপর থেকে ল্যাপটপটি ঠাস করে ডিভানের উপর রেখে অরুণের দিকে রে’গে তাকায়। অরুণ ঢোক গিলল। এর বউয়ের ঝাল আবার তার উপর না মেটায়।
আকাশ কিছু বলতে নেয়, তখন-ই তার পকেটে ফোন ভাইব্রেট হয়। আকাশ পকেট থেকে ফোন বের করে নোটিফিকেশন চেক করলে দেখল সন্ধ্যার নাম্বার থেকে একটি মেসেজ এসেছে,

– বিদেশে বসে ফ্রিতে বউকে দেখা বন্ধ করুন। দেশে এসে ফিস দিয়ে বউকে দেখুন। নয়তো বউয়ের চেহারা আল্লাহর ওয়াস্তে ভুলে যান।
মেসেজটি পড়ে আকাশ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। মুহূর্তেই চোয়াল শ’ক্ত হয়ে যায়। এই মেয়ের কতবড় সাহস, তার সন্ধ্যামালতীকে ভুলে যেতে বলে! রা’গ দমাতে না পেরে আকাশ তার ফোন আছাড় মা’রতে নিলে অরুণ দ্রুত বলে ওঠে,

– এই এই ফোন ভাঙিস না। ফোনটা আমাকে দে, আমি কোনো এক মিসকিনকে দিয়ে দিব।
আকাশ থেমে যায়। রাগান্বিত স্বরে বলে,
– ওর সাহস কি করে হয়, আমার লাগানো ক্যামেরা অকেজ করে দেয়ার? ওকে ভুলে যেতে বলার ও কে?
অরুণ হেয়ালি করে ঠোঁট উল্টে বলে,
– কি-জানি?
অরুণের এটুকু কাজে আকাশ আরও রে’গে যায়।
অরুণের দিকে তেড়ে যেতে নিলে অরুণ দৌড় দেয়। ইশ! এ আসলেই তাকে খেতে এসেছে। তার শান্তি শেষ।
এদিকে আকাশ ফোন হাতে নিয়ে ঘরের এপাশ-ওপাশ পায়চারি করছে। মানুষ নেশা করার পর, নেশাদার দ্রব্য না পেলে যেমন ছটফট করে।

অন্তঃদহন পর্ব ৪৬

সন্ধ্যাকে দেখতে না পেয়ে আকাশের তেমনি ছটফট লাগছে।
বেশ কিছুকক্ষণ পর আকাশ পায়চারি থামিয়ে দাঁড়ি যায়। রা’গে ফোঁসফোঁস করতে করতে টাইপ করে, সন্ধ্যার নাম্বারে মেসেজ পাঠায়,
– বে’য়া’দ’ব মেয়ে! আমার হক ন’ষ্ট করছ তুমি। থা’প্প’ড় কিন্তু একটাও মাটিতে পড়বে না। বি কেয়ারফুল!

অন্তঃদহন পর্ব ৪৮

2 COMMENTS

Comments are closed.