অন্তঃদহন পর্ব ৪৯

অন্তঃদহন পর্ব ৪৯
DRM Shohag

বাংলাদেশে সময় তখন সকাল ১০ টা। সন্ধ্যা আজ কলেজে এসেছে। ১ম ক্লাস করে লামিয়াকে নিয়ে কমনরুমে এসে এক কোণায় বসে আছে সন্ধ্যা।
গতকাল রাত থেকে তার মনটা ভীষণ খারাপ। আকাশের পাশে অন্য মেয়ে, এরপর তার কান্নার কথা শুনে আকাশের ডোন্ট কেয়ার ভাব তাকে ভীষণ পোড়াচ্ছে। আকাশ কি তাকে সত্যিই ভুলে যাবে? সে জানে, আকাশ তাকে ভীষণ ভালোবাসে। এতো তাড়াতাড়ি কি কেউ ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যায়? সন্ধ্যা নিজেকে বোঝালো অনেক কিছু। আকাশ কেন তার পাশে একটি মেয়েকে দাঁড়াতে দিয়েছে, আবার পিক তুলেছে। সে আকাশের থেকে এসব শুনতে চায়। তাকে ইচ্ছে করে জ্বালানোর জন্যই আকাশ এমন করেছে সন্ধ্যা বুঝেছে। সন্ধ্যার ভীষণ ইচ্ছে করে, আকাশের সাথে একটুখানি কথা বলতে। নিজের ইচ্ছেকে চাপা দিল না সন্ধ্যা। তার ফোন নিয়ে অরুণের নাম্বারে কল করল। ভাবল, অরুণ যদি আকাশকে বুঝিয়ে তার সাথে একবার কলে কথা বলিয়ে দিতে পারে! তবে তার চেয়ে শান্তি আর কেউ পাবেনা বোধয়।
অরুণ কল রিসিভ করলে সন্ধ্যা মৃদুস্বরে বলে,

– ভাইয়া আপনার বন্ধুর সাথে একটু কথা বলিয়ে দিবেন?
অরুণের মুখ কালো হয়ে যায়। আকাশ এখন যা ত্যাড়া হয়েছে। ও কি কথা বলবে? জীবনেও না। এই বে’য়া’দ’ব টাকে অন্যভাবে শায়েস্তা করতে হবে। অরুণের কিছু মনে পড়তেই বলে,
– সন্ধ্যা তুমি অনেক ভালো নাচ পারো তাইনা?
সন্ধ্যা ছোট করে বলে,
– জ্বি। একটু একটু।
অরুণ হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– ওই একটু একটুই হবে। তোমাদের কলেজে সামনে যেদিন ফাংশন, সেদিন তুমি নাচবে। তবে ডেট টা আমাকে বলো। আকাশকে আমি জানিয়ো দিব। তারপর দেখবে আকাশ চোখের পলকে তোমার সামনে চলে গিয়েছে।
সন্ধ্যার পাশে বসা লামিয়া শব্দ করে তালি দিল দু’টো। সন্ধ্যা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। লামিয়া সন্ধ্যার কান থেকে ফোন নিয়ে কল কেটে দেয়। এরপর সন্ধ্যাকে তার দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে,
– আরে ঝাক্কাস এক আইডিয়া পেয়েছি বান্ধবী।
সন্ধ্যা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। লামিয়া হেসে বলে,
– আর কয়েকদিন পর কলেজে একটা ফাংশন আছে। তুই ছেলের সাথে কাপল ডান্স করবি। সেই ভিডিও তোর জামাইয়ের কাছে সেন্ড করলেই সব খেল খতম।
সন্ধ্যা বিস্মিত কণ্ঠে বলে,

– অসম্ভব। আমি জীবনেও ছেলের সাথে নাচব না। আর সবার সামনে তো আরও আগে না।
লামিয়া বিরক্ত হয়ে বলে,
– কি সমস্যা তোর? স্বামীর জন্য তো দেবদাস হয়ে যাচ্ছিস। আরে আমাদের ক্লাসের এক ফ্রেন্ডকেই বলব। ওরা কেউ খারাপ না। সবাই তোকে বোনের চোখে দেখে। তুই তো জানিস-ই। তবুও এরকম করছিস কেন?
সন্ধ্যা ঢোক গিলল। লামিয়ার কাছে এসব স্বাভাবিক হলেও সন্ধ্যার কাছে এসব একদমই স্বাভাবিক নয়। লামিয়া সন্ধ্যার পাশ থেকে উঠে কমন রুমের বাইরে উঁকি দিল। পরিচিত কাউকে দেখতে পেয়ে হাত উঁচু করে ডাক দেয়,
– এ্যাই বদনা????
ছেলেটি লামিয়ার মুখে নিজের বিকৃত নাম শুনে রে’গে তাকায়। ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে এসে দাঁত কটমট করে বলে,

– আমার নাম ভালো করে বল।
লামিয়া মেকি হেসে বলে,
– বাবিন, বদনা একই তো হলো। এসব বাদ দে। শোন, একজনের সাথে নাচতে হবে তোকে।
বাবিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কার সাথে?
– আমার বান্ধবী সন্ধ্যা।
বাবিন কেশে উঠে বলে,
– তোর বান্ধবী সন্ধ্যাকে তো পোলিও রোগী লাগে। ঠিক করে কথাই বলে না। সে আমার সাথে নাচবে?
লামিয়া বাবিনের কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলে,

– আমার বান্ধবী অনেক ভদ্র। কিন্তু এবার নাচবে। তুই নাচের রুমে যা। আমরা আসতেছি।
কথাটা বলে লামিয়া কমনরুমের ভেতরে যায়। সন্ধ্যার হাত ধরে টেনে বেরিয়ে দৌড়ে নাচের রুমে এসে থামে। সন্ধ্যা লামিয়ার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিরক্ত হয়ে বলে,
– কি প্রবলেম তোর? এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন? এমনিতেই আমার ভালো লাগছেনা।
লামিয়া হেসে বলে,
– আরে বাবা তোর ভালো লাগার মানুষকে আনার ব্যবস্থাই তো করছি। চুপচাপ আমার কথা মেনে নে।
পাশ থেকে বাবিন বলে,
– সন্ধ্যা তুমি আমার সাথে নাচবে?
সন্ধ্যা বাবিনকে দেখে বিব্রতবোধ করে। কমনরুমে হিজাব খুলে রেখেছিল। এই লামিয়ার চক্করে সেটা মাথায়-ও দিতে পারেনি। লামিয়া বাবিনকে বলে,

– নাচবে না মানে। একশবার নাচবে।
কথাটা বলে সন্ধ্যাকে টেনে বাবিনের পাশে দাঁড় করাতে গিয়ে সন্ধ্যা বাবিনের সাথে ধাক্কা খায়। সন্ধ্যা, বাবিন দু’জনেই হতভম্ব হয়ে যায়। বাবিন দ্রুত বলে,
– স্যরি স্যরি! আমি আমার জায়গায়-ই আছি। তোমার বান্ধবী ধাক্কা দিয়েছে।
সন্ধ্যা নিজেকে সামলে বাবিনের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। রে’গে লামিয়াকে একটা ধাক্কা দেয়। লামিয়া পড়তে গিয়ে পড়ল না। কোমরে হাত দিয়ে বলে,
– আরে আমি তোর উপকার করছি, আর তুই আমাকেই ছো’বল মা’রছিস? কি সেলফিস!
সন্ধ্যা রে’গে বলে,
– আমার এসব উপকার লাগবেনা। অ’সহ্য!
লামিয়া এগিয়ে এসে বলে,

– আমার তোকে উপকার করাই লাগবে।
সন্ধ্যা কিছু বলতে নিলে লামিয়া আঙুল উঁচিয়ে বলে,
– একটা কথা বলবিনা। নিজেই তো বললি, আজ নাকি কলেজের সব ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবি। আর কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। তাছাড়া স্বামীর জন্য আধমরা হয়ে যাচ্ছিস। কত ক’ষ্টে একটা প্ল্যান পাইছি, সেটাও ভেস্তে দিচ্ছিস। একদম চুপ থাক।
এটুকু বলে লামিয়া সন্ধ্যার হাত ধরে বাবিনের সামনে এনে দাঁড় করায়৷ এরপর বাবিনের দিকে চেয়ে বলে,
– এ্যাই বাবিন তুই সন্ধ্যাকে বোন ভাবিস কি-না বল!
বাবিনের দৃষ্টি সন্ধ্যার খোলা চুলের দিকে ছিল। সন্ধ্যার চুল যে এতোবড়, সে আজকেই প্রথম দেখল। নিজেকে সামলে হেসে বলে,

– এতো বড় চুলের অধিকারিণীকে বোন ভাবতে ক’ষ্ট লাগবে মনে হচ্ছে।
কথাটা শুনে লামিয়া বাবিনের দিকে রে’গে তাকায়। সন্ধ্যা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। লামিয়ার দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– আমি এই অ’সভ্য ছেলের সাথে কখনোই নাচবো না।
বাবিন গলা ঝেড়ে বলে,
– আমার পুরো কথাটা আগে শোনো। আসলে আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। তাই যত ক’ষ্ট-ই হোক, বোন-ই ভাবতে হবে।
সন্ধ্যা থমথমে মুখে তাকায়। আকাশ তাকে রেখে বিদেশে গিয়ে মেয়ের পাশে দাঁড়ায়। এই ছেলে গার্লফ্রেন্ড রেখে তার সাথে ফ্লাট করছে। ভীষণ বিরক্ত লাগলো। লামিয়া মৃদুস্বরে বলে,
– আচ্ছা তোরা একটু প্রাকটিস কর নাচের। দুমিনিট করলেই হবে।
এরপর সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলে,

– এই পিক তোর বরের কাছে পাঠাবো। এতে কাজ হলে সবার সামনে নাচার আগেই দেশে চলে আসবে।
এখন না করিস না। তুই অনেক ভালো। আমাকে একটা ভালো কাজ করতে দে, প্লিজ বইনা!
সন্ধ্যা এবার রা’গলো না। মৃদুস্বরে বলে,
– ঠিকাছে। কিন্তু আমাকে টাচ করা যাবে না।
লামিয়া বিরক্ত হলো। কিন্তু মাথা নেড়ে বোঝালো,
– আচ্ছা।
এরপর একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে একটি গান চালালো। এরপর ক্যামেরা অন করে সন্ধ্যা আর বাবিনের দিকে ফোনটি তাক করে রেখে বলে,
– নে নাচ শুরু কর।

নিউইয়র্কে তখন সকাল ১০ টা।
আকাশ অরুণকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছে। এরপর অরুণের সামনে একটি চেয়ার নিয়ে বসে বা পা ডান পায়ের উপর রাখে। ডান হাতে ছোটোখাটো একটি ছুরি অরুণের বুকে ঠেকিয়ে রেখেছে। অরুণ অসহায় কণ্ঠে বলে,
– এ ভাই, আমি কি করেছি। আমায় ছেড়ে দে বাবু।
আকাশ অরুণের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,
– কলেজের ডান্স প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার আইডিয়া ওকে কেন দিয়েছিস?
অরুণ ঢোক গিলে বলে,
– আমি দিইনি। আমি কেন দিব? সন্ধ্যা নাচ ভালো পারে, তাই আর কি…..

এটুকু বলতেই আকাশ অরুণের বুকে ছুরি ঘুরিয়ে হালকা ক্ষ’ত করে দেয়। অরুণ চেঁচিয়ে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমি বলেছিলাম। কসম, আর জীবনে তোর বউকে কোনো বুদ্ধি দিব না।
আকাশ অরুণের পকেট থেকে ফোন বের করে, ফোনে ব্লুটুথ কানেক্ট করে দেয়। এরপর ব্লুটুথ অরুণের কানে গুঁজে দিয়ে সন্ধ্যার নাম্বার উঠাতে উঠাতে বলে,
– এখন ওকে বলবি, ও যেন ডান্স প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দেয়।

অরুণের মুখে অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে। সে গতকাল রাতে সন্ধ্যাকে বলল। আজ সকালে উঠেই শুনল, সন্ধ্যা না-কি নাচের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের খাতায় নাম লিখিয়েছে। লিখিয়েছে ভালো কথা। এই খবর আকাশের কানে কোন ব্যাটা দিল? অরুণের মাথায় খুব দ্রুত ক্যাচ করল। এ নিশ্চয়ই ব্যাটা বায়ানের কাজ। মনে মনে বিড়বিড় করে,
– শা’লা বাতাস বাবুর চা’ম’চা কোথাকার!
অরুণ আকাশের দিকে চেয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– আমি কেন বলব তোর বউকে? তোর বউ তুই…..

আকাশ অরুণের বুকে ছুরিটি আরেকটু গেড়ে দেয়ার মতো করলে অরুণ চেঁচিয়ে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই বলব। নিষেধ করে দিব। তোর বউ জীবনের মতো নাচ ভুলে যাক, এবার আমায় ছেড়ে দে বাপ।
আকাশ হাতের ছুরি অরুণের বুক থেকে সরায় না। তবে আলগা করে ধরে রাখে। এরপর অরুণের ফোন থেকে সন্ধ্যার নাম্বারে কল দিলে, ফোন রিসিভ হয়। অরুণ সাথে সাথে বলে,
– সন্ধ্যা তুমি আমার মায়ের মতো। তুমি কলেজে নাচের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দাও। প্লিজ মা!
ওপাশে সন্ধ্যা তব্দা খেয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন রাত ৮ টা। আজ সকালে কলেজ যাওয়ার পর লামিয়া সত্যি সত্যি তার নাম নাচে লিখে দিয়েছে। তবে সে একা নাচবে বলেছে। লামিয়া সন্ধ্যার কথা মেনে সন্ধ্যাকে একা পারফর্ম করার কথাই বলেছে। সন্ধ্যা অনেক দোনামোনা করে, শুধুমাত্র আকাশ চলে আসবে ভেবে রাজি হয়েছে। সন্ধ্যা ভাবনা রেখে অবাক হয়ে বলে,

– কেন ভাইয়া? কি হয়েছ? আমি তো নাম দিয়ে দিয়েছি।
অরুণ কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে,
– যেভাবে হোক ক্যান্সেল করে দাও। নয়তো আমার জীবন শেষ।
সন্ধ্যা অবাক হয়ে বলে,
– মানে?
অরুণ অসহায় চোখে তাকায় আকাশের দিকে। আকাশ গম্ভীর মুখে অরুণের দিকে চেয়ে আছে। অরুণ বিড়বিড় করল,
– তোমাকে কিভাবে বলি! আমার সামনে এক জ’ম বসে আছে। জীবনডা আমার ত্যানাত্যানা করে দিল।
অরুণ গলা ঝেড়ে বলে,
– তুমি ক্যান্সেল করে দাও। আমি তোমাকে পরে সব বলব।
সন্ধ্যা মলিন মুখে বলে,

– আমি কিছু না করলেও উনি কি দেশে ফিরবেন ভাইয়া?
সন্ধ্যার কথায় অরুণের খারাপ লাগলো। মেয়েটা আকাশের জন্য কত পা’গ’লামি করছে। এই আকাশটা কিছুতেই বুঝছে না। অরুণ মৃদুস্বরে বলে,
– চিন্তা কর না। সব ঠিক হবে। তুমি ক্যান্সেল করে দিও কেমন?
সন্ধ্যা ছোট করে বলে,
– আচ্ছা ভাইয়া।
এরপর সন্ধ্যা কল কেটে দিলে অরুণ আকাশের উদ্দেশ্যে বলে,
– ক্যান্সেল। এইবার আমায় ছাড় বাপ।
আকাশ অরুণকে বেঁধে রাখা রশি খুলে দিয়ে অরুণের ফোন অরুণের পায়ের উপর রেখে চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অরুণ তার দু’হাতের দিকে তাকালো। কেমন লাল হয়ে গিয়েছে। তার শান্তি শেষ। একদম শেষ। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদা উচিৎ তার। সত্যি সত্য বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টালো অরুণ। এতো কষ্ট কেন তার? তাও আবার একখানা বন্ধুর জন্য!

আকাশ মাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। হাতে ফোন ছিল। নোটিফিকেশন পেয়ে আকাশ সাথে সাথে সেখানে ক্লিক করলে একটি ভিডিও অপেন হয়। যেখানে সন্ধ্যা আর একটি ছেলে নাচছে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, ছেলেটি সন্ধ্যার কাঁধে হাত রেখেছে। সন্ধ্যা-ও হেসে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে।
ভিডিওটি পুরোপুরি এক মিনিটের। আকাশ স্তব্ধ চোখে দেখে ভিডিওটি। এক মিনিট পর ভিডিওটি বন্ধ হয়ে গেল। আকাশ ফোন ডান হাতের মুঠোয় নিল। চোখজোড়া বুজে ঘনঘন শ্বাস ফেলে। রা’গে মাথা অকেজ হয়ে যাচ্ছে যেন! বুকে চিনচিনে ব্য’থা হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর আকাশ কাঁপা হাতে ভিডিওটি সৌম্য’র নাম্বারে সেন্ড করে নিচে লিখে দেয়,

– বোনকে এসব করতে কলেজে পাঠাস সৌম্য? তোরা দুই ভাইবোন আমার হৃদয়টা একেবারে ঝাঁঝরা করে দিলি রে!
মেসেজটি আকাশ সৌম্য’র নাম্বারে পাঠিয়ে দেয়। সময়ের সাথে সাথে ক’ষ্ট বাড়ছে বোধয়। নিজেকে সামলে নিতে না পেরে হঠাৎ-ই আকাশ সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে,
– সন্ধ্যামালতী????????
অরুণ মাত্র বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আকাশের চিৎকার শুনে অরুণ দৌড়ে এসে আকাশের সামনে দাঁড়ায়। অবাক হয়ে বলে,
– আকাশ কি হয়েছে?
আকাশ বা হাতে অরুণের কলার ধরে গমগমে স্বরে বলে,

– আমি ওকে খু’ন করে ফেলব। ওকে আমি ছাড়বো না।
এটুকু বলতে বলতে আকাশের কথা জড়িয়ে আসে। অরুণের শার্টের কলার না ছাড়লো না, তবে হাত আলগা হয়ে আসে। ক্ষীণ কণ্ঠে ভাঙা স্বরে আওড়ায়,
– আমার অনেক ক’ষ্ট হচ্ছে অরুণ। সন্ধ্যামালতী শুধু আমায় ক’ষ্ট দিচ্ছে।
অরুণ ভীষণ অবাক হয়। কিছু বলার আগেই আকাশ ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে। হাত থেকে ফোন পড়ে যায়। জ্ঞান হারাচ্ছে মনে হলো। অরুণ আকাশকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– আকাশ? এ্যাই আকাশ কি হয়েছে তোর?
ততক্ষণে আকাশ জ্ঞান হারিয়েছে। অরুণ আকাশের ভারী শরীর বহুক’ষ্টে আগলে রেখে শব্দ করে ডাকে,
– আকাশ?

সৌম্য দৃঢ়পায়ে হেঁটে সন্ধ্যার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ডান হাতে ফোন। বা হাত মুষ্টিবদ্ধ করা। আকাশের পাঠানো ভিডিওটি সে মাত্র-ই দেখেছে। এটা দেখেই তার পায়ের র’ক্ত মাথায় উঠে গিয়েছে। সন্ধ্যার উপর এই জীবনে কোনোদিন এতো রে’গেছে কি-না তার মনে পড়েনা। বা হাতে ধাক্কা দিয়ে ভিরিয়ে রাখা দরজা খুলে সৌম্য সন্ধ্যার ঘরে প্রবেশ করে।

সন্ধ্যা বিছানার উপর বসে মন খারাপ করে পায়ের নখ খুঁটছিল। নাচের নাম লেখানোর দায়িত্বে যে আছে তাকে কল করে, সন্ধ্যা নাচ থেকে তার নাম কেটে দিয়েছে। কাজটি অরুণের কথায় করেছে। তবে মন খারাপ এই ভেবে, এবার আকাশ আর আসবে কি-না! এসব ভাবনার মাঝে এতো জোরে দরজার শব্দ পেয়ে সন্ধ্যা দরজার দিকে তাকায়। ঘরে তার ভাইয়াকে দেখে সন্ধ্যা বিছানার উপর থেকে নেমে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,
– কিছু বলবে সৌম্য ভাইয়া?
সৌম্য’র চোখ দু’টো লাল। শ’ক্ত দৃষ্টি সন্ধ্যার পানে। সন্ধ্যা ভাইয়ের দৃষ্টিতে একটু ঘাবড়ালো। সৌম্য ভাইয়া তো তার দিকে কখনো এভাবে তাকায় না। তাহলে আজ এভাবে তাকিয়ে আছে কেন বুঝল না। আবার-ও কিছু বলতে নেয়, তার আগেই সৌম্য সন্ধ্যার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে সন্ধ্যার সামনে ফোন ধরে কড়া গলায় বলে,

– এটা কি তুই?
সন্ধ্যা ফোনের দিকে তাকালো। তার আর বাবিনের নাচের দৃশ্য দেখে সন্ধ্যা অবাক হলো। এটা লামিয়া আকাশকে দিতে চেয়েছিল। অথচ সে আকাশকে না দিয়ে তার ভাইয়াকে কেন দিয়েছে? সন্ধ্যা ঢোক গিলল। মিনমিন করে বলতে নেয়,
– সৌম্য ভাইয়া আমি আসলে……
সৌম্য ধমক দিয়ে বলে,
– আমি জানতে চেয়েছি এটা তুই কি-না!
সন্ধ্যা চোখ বুজল। এসব চালচলন সৌম্য ভাইয়া ভীষণ অপছন্দ করে, সন্ধ্যা জানে। সে লামিয়ার কথায় শুধুমাত্র আকাশের জন্য বহুক’ষ্টে এমন করেছিল। এখন এটা সে সৌম্যকে কিভাবে বোঝাবে? সৌম্য আবার-ও ধমক দেয়,
– কি হলো বল?

সন্ধ্যা কেঁপে ওঠে। চোখ বুজে রেখেই মাথা উপর-নীচ করে সম্মতি দেয়। সাথে সাথে সৌম্য বা হাতে সন্ধ্যার ডান গালে ক’ষিয়ে একটা থা’প্প’ড় মে’রে দেয়। সন্ধ্যা তাল সামলাতে না পেরে বামদিকে হেলে ঠাস করে মেঝেতে পড়ে যায়।
ইরা সৌম্য’র পিছু পিছু আসছিল। সন্ধ্যাকে থা’প্প’ড় মা’রতে দেখে দৌড়ে এসে সন্ধ্যার কাছে বসে সন্ধ্যাকে আগলে নেয়। সৌম্য দিকে চেয়ে অবাক হয়ে বলে,
– সৌম্য তোর বোনুকে তুই মা’রলি?
সৌম্য হাতের ফোন ছুড়ে ফেলে চিৎকার করে বলে,
– হ্যাঁ মা’রলাম। ও আমার বোনু নয়। আমার বোনু এতো উচ্ছৃঙ্খল নয়। আমি আমার বোনুকে এসব শিক্ষা দিইনি। ও ছেলেদের সাথে কোন সাহসে ঘেঁষাঘেঁষি করেছে? ওকে পড়ার জন্য কলেজে ভর্তি করিয়েছিলাম আমি। আর ও আমার নাক কা’টতে কলেজে যায়।

কথাগুলো বলে সৌম্য হনহন করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ইরা কি বলবে বুঝল না। সন্ধ্যার ওই ভিডিওটা দেখে তার নিজের-ও খারাপ লেগেছে। কিন্তু মেয়েটা ছোট। কি করতে কি করেছে!
সন্ধ্যা মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সৌম্য’র বলা ‘ও আমার বোন নয়’ কথাটা একদম বুকে এসে লেগেছে। সে যদি জানতো তার ভাইয়া এতো ক’ষ্ট পাবে, তবে সে কখনোই এমন করত না। আকাশের জন্য এমনি এমনিই অপেক্ষা করত।
আসমানী নওয়ান নিচতলা থেকে এসে সন্ধ্যাকে মেঝেতে এভাবে পড়ে কাঁদতে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে। সন্ধ্যার পাশে বসে বলে,

– কি হইছে জান্নাত? কানতাছস ক্যান?
সন্ধ্যা হেঁচকি তুলে কাঁদে। আসমানী নওয়ান ইরার দিকে তাকালে ইরা ছোট করে বলে,
– সৌম্য সন্ধ্যাকে মে’রেছে ফুপি।
আসমানী নওয়ান বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়৷ যেন এক অবাস্তব কথা শুনেছে। নিজেকে সামলে সন্ধ্যাকে টেনে জড়িয়ে নিল। পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
– কাঁদিস না মা। ছেলে মানুষের রা’গ বেশি হয়। ওরা কি করতে কি করে, বোঝে না।
সন্ধ্যা আসমানী নওয়ানের বুকে পড়ে পড়ে ফোঁপালো।

পেরিয়েছে সাতদিন।
ধরনীর বুকে সকালের আরাম ভাব ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। মেঘের আড়াল থেকে সূর্য একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে।
সন্ধ্যা বেলকনির কোণায় বসে আসে। দৃষ্টিতে প্রাণ নেই। গত সাতদিন আগে শুনেছিল আকাশ আবার-ও হার্ট-অ্যাটার্ক করেছে। কথাটা ভাবতেই সন্ধ্যার পুরো শরীরে একটা ঝাঁকুনি লাগে, ঠিক যেমন কান্নার পর হয়। খবরটি শুনে আসমানী নওয়ানের মতো শ’ক্ত মানুষটা খুব কেঁদেছিল। সন্ধ্যা-ও কত কেঁদেছে! কত দোয়া করেছে! আল্লাহর রহমতে আকাশ এখন সুস্থ আছে। আকাশকে পাঁচটি রিং পড়ানো হয়েছে। অরুণ ভাইয়ের মতো নিজ দায়িত্বে আকাশের চিকিৎসা করিয়েছে। আসমানী নওয়ান যেতে চাওয়ায় আকাশ কল করে বারণ করে দিয়েছে। আকাশ এখন সবার সাথেই কথা বলে। শুধু তার সাথে কথা বলে না। সন্ধ্যা কতশত মেসেজ, কল দিয়েছে আকাশকে। আকাশ একটা উত্তর-ও দেয়নি।

সৌম্য তার সাথে কথা বলে। তবে আগের মতো করে কথা বলে না। খাওয়ার খোঁজ, সব খোঁজ নিতে ইরাকে পাঠায়। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলে। যার মধ্যে একটি কথা ছিল,
– আমি বা আকাশ ভাইয়া কেউ শিক্ষিত তোকে চাইনা। সুশীল তোকে চাই। পড়াশোনার কথা ভুলে যা।
কথাটা ভেবে সন্ধ্যার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। সবাই শুধু তাকে ভুল বুঝল। কেউ বুঝল না, তার আকাশকে ছাড়া থাকতে ভীষণ ক’ষ্ট হয়। আর সেই ক’ষ্ট কমানোর লোভে সে ভুল কাজ করে ফেলেছে।
সন্ধ্যা অনেকটা সময় বসে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। এরপর বেলকনি থেকে ঘরের ভেতর আসে। ফোন নিয়ে অরুণের নাম্বারে কল করে। তার দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে এবার আকাশের সাথে কথা না বললে সে দম আটকে ম’রে যাবে। অরুণ কল রিসিভ করে বলে,

– বলো সন্ধ্যা।
সন্ধ্যা নিজেকে সামলাতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। ফোঁপানো কণ্ঠে বলে,
– ভাইয়া উনার সাথে একবার কথা বলিয়ে দিন না! শুধু একবার কথা বলব।
অরুণের ভীষণ খারাপ লাগলো। সন্ধ্যার কাজটা ভুল ছিল। কিন্তু ওকেই বা কি বলা যায়? বাচ্চা মেয়ে। আকাশের জন্য পা’গ’লামি করতে গিয়ে কি না কি করেছে। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সন্ধ্যাকে ওয়েট করলে বলে আকাশকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে আসে।
নিউইয়র্কে এখন সময় রাত ১০। আকাশ ছাদের কোণায় দাঁড়িয়ে এক প্যাকেট সিগারেট শেষ করে আরেকটি প্যাকেট খোলে, আবার-ও সিগারেট ধরিয়ে ফুঁকতে শুরু করে। অরুণ এগিয়ে এসে আকাশের কান্ড দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,
– আর কত খাবি? তুই কি ভুলে গেলি, তুই তোর সন্ধ্যামালতীর জন্য সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলি?
আকাশ ভাবলেশহীনভাবে বলে,

– কোথায় লেখা আছে এটা?
অরুণ তব্দা খেয়ে যায়। হতাশ কণ্ঠে বলে,
– সভাপতির পদ টা-ও তো সন্ধ্যার জন্যই ছেড়েছিস। এটাও অস্বীকার করবি?
আকাশ গম্ভীর গলায় বলে,
– ভুল ইনফরমেশন। মন্ত্রীর পদ নিব বলে রেস্ট নিচ্ছি।
অরুণ থমথমে মুখে তাকায়। একে কি করা উচিৎ? বে’য়া’দ’ব টা দিনদিন ত্যাড়ামির উপর পিএইচডি করছে। অরুণ তার হাতে ধরে রাখা ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
– কথা বল।
আকাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কে?
অরুণ উত্তর দেয়,
– তোর জানপ্রাণ সব। এবার কথা বল।
আকাশ বোধয় বুঝল। মাথা সোজা করে গম্ভীর গলায় বলে,

– আমার কেউ নেই। এতো কথা বলার ইচ্ছে হলে একা একা বকবক করতে বল। কারো ফা’ল’তু ভ’য়েস শোনার টাইম আমার নেই।
অরুণ কি বলবে বুঝল না। সে দ্রুত কল কেটে দিল। সন্ধ্যা আকাশের এই কথাগুলো শুনে আরও ক’ষ্ট পাবে।
অরুণ রে’গে বলে,
– তুই ইচ্ছে করে সন্ধ্যাকে ক’ষ্ট দিচ্ছিস আকাশ।
আকাশ চুপ থাকলো। ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ব্যস্ত সে। অরুণ আবারও রে’গে বলে,
– কিছু বলছিস না কেন?
আকাশ তবুও চুপ। পুরো সিগারেটটি শেষ করে, ছোট্ট পোড়া সিগারেট ছুড়ে ফেলে অরুণের সামনে বরাবর দাঁড়ায়। একটু হেসে বিষাদ কণ্ঠে বলে,
– সন্ধ্যামালতীর ক’ষ্ট আমি আকাশকে ভীষণ বাজেভাবে পো’ড়ায় অরুণ। অথচ যার জন্য এই জ্বা’লা, সে অবুঝ কন্যা সেজে থাকে।

কথাটা বলে আকাশ ছাদ থেকে নেমে যায়। অরুণ আকাশের গমনপথে চেয়ে রইল। ছাদে লাইটের আলোয় অরুণ স্পষ্ট দেখল, আকাশ যেদিক দিয়ে হেঁটে গিয়েছে প্রতিটি জায়গায় র’ক্তের কণা ছড়িয়ে আছে। অরুণ দ্রুত আকাশের দু’হাতের দিকে খেয়াল করলে দেখল, আকাশের বা হাত থেকে এখন-ও টপটপ করে র’ক্ত পড়ছে। অরুণ বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়।
ঘাড় ফিরিয়ে বামদিকে খেয়াল করলে দেখল ছাদের কোণায় অনেকগুলো কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে। সেখানে র’ক্তের ছিঁটেফোঁটা। অরুণ ঢোক গিলল। সে জানে আকাশ ইচ্ছে করে করেছে এসব। কি বলবে সে?
সন্ধ্যাকে ক’ষ্ট দিয়ে নিজে আরও কতগুণ ক’ষ্ট পায়! অথচ তবুও আকাশ শ’ক্ত প্রাচীরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে!
অরুণ বিড়বিড় করে,
– অদ্ভুদ!

রাত তখন ১২ টা।
আকাশ আবার-ও ছাদে এসেছে। ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে দূর অজানায় দৃষ্টি রেখে সিগারেট ফুঁকছে। সে যেন পণ করেছে, রাতগুলো এভাবে সিগারেট পু’ড়িয়েই পার করবে।
আকাশের পিছনে অলিভিয়া এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকক্ষণ যাবৎ আকাশকে খেয়াল করছে। আকাশের পরনে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। ডান হাতে সিগারেট, বা হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে রাখা। কি নিখুঁত সুন্দর মানুষটা। আকাশকে দেখে অলিভিয়ার মুগ্ধতার রেশ কাটেনা। গত সাতদিনে আকাশ অসুস্থ হওয়ায় সে আরও আকাশের কাছাকাছি ছিল। যদিও আকাশের জন্য সেভাবে পারতো না। তবে যেটুকু পেরেছে থেকেছে। মাত্র এই কয়টা দিনেই আকাশকে কেন যে তার এতো ভালো লেগে গেল, সে বুঝতে পারেনা। তার মনে হয়, আকাশ এখানেই পার্মানেন্ট হয়ে যাবে। আর শুনেছিল, আকাশের সাথে তার বউয়ের ঝামেলা আরও বেড়েছে। সে ধরেই নিয়েছে, আকাশ তার বউকে ভোলার পথে।
এসব ভাবনার ইতি ঘটিশে অলিভিয়া ধীরেপায়ে এগিয়ে এসে আকাশের পিছনে দাঁড়ায়। কয়েকবার মৃদুস্বরে ডাকে,

– আকাশ?
আকাশ নিরুত্তর। অলিভিয়া ঢোক গিলে বলে,
– আমি তোমাকে ভালোবাসি।
এবারেও আকাশের কোনো নড়চড় নেই। অলিভিয়ার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। চোখ বুজে দু’বার লম্বা করে শ্বাস নিয়ে এবার গলার জোর কিছুটা বাড়িয়ে বলে,
– আকাশ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আকাশ ভাবলেশহীন। অলিভিয়া আশানুরূপ ফল না পেয়ে এগিয়ে এসে ডান হাত বাড়িয়ে আকাশের বা হাতের বাহু ধরে।
রা’গে আকাশের চোয়াল শ’ক্ত হয়ে যায়। মনে হলো অলিভিয়া যেখানে ধরেছে, সেখানে ফোসকা পড়েছে তার। ফুটন্ত টগবগে পানির মতো ফুলে ওঠে।

আকাশ আর চুপ থাকলো না। উল্টো ঘুরে চোখের পলকে অলিভিয়াকে ছাদ থেকে ধাক্কা দেয়। অলিভিয়া ভ’য়ে চিৎকার করে ওঠে। সে নিচের দিকে পড়ে যেতে নিলে আকাশ একটু ঝুঁকে অলিভিয়ার হাত টেনে ধরে। শ’ক্ত কণ্ঠে বলে,
– আর আমি ভালোবাসি আমার সন্ধ্যামালতীকে। আমি কেবলমাত্র আমার সন্ধ্যামালতীর হক। সন্ধ্যামালতীর হকের দিকে ফের দৃষ্টি দিলে তোর জান নিতে যাস্ট এক সেকেন্ড-ও টাইম নিব না। মাইন্ড ইট।
অরুণ ছাদে এসে আকাশকে ছাদের কিনারায় নিচু হয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে আকাশের পাশে দাঁড়ায়। বেখেয়ালে বলে,

– আরে এখানে কি…..
কথাটা বলতে গিয়ে থেমে যায় অরুণ। চোখে পড়ে আকাশ অলিভিয়াকে ঝুলিয়ে রেখেছে।
অরুণকে দেখে আকাশ অলিভিয়ার হাত ছেড়ে দিলে অরুন চোখ বড় বড় করে দ্রুত অলিভিয়ার হাত টেনে ধরে। অলিভিয়া আরেকটি চিৎকার দিয়েছিল, ভেবেছে আজ সে শেষ। কিন্তু অরুণ ধরেছে বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অরুণ অলিভিয়াকে টেনে ছাদের মেঝেতে দাঁড় করায়। দু’হাত কোমরে রেখে একটু হাঁপায়। এরপর আকাশের দিকে চেয়ে রে’গে বলে,

– তুই কি পা’গ’ল? ও ম’রে যেতে পারতো।
আকাশ ভাবলেশহীনভাবে বলে,
– তো? ভালোবাসে বলে মুখের ফেনা তুলে ফেলছে। তাই প্রুফ নিতে চাইছিলাম।
কথাটা বলে আকাশ ছাদের রেলিঙের উপর উঠে দাঁড়ায়। দৃষ্টি দূর অজায়নায়। মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ।
অরুণ হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আকাশ আবার-ও আগের মতো হয়ে গিয়েছে। একদম হাসতো না। সন্ধ্যা জীবনে আসার পর কত প্রাণবন্ত হয়েছিল। আর এখন আগের চেয়েও পানসে হয়ে গেছে।
অরুণ অলিভিয়ার দিকে চেয়ে ধমকে বলে,
– তোমার প্রবলেম কি? তুমি ওর পিছু ছাড়বে না। ম’রে গেলে ভালো হতো তাই না?
অলিভিয়া মাথা নিচু করে রইল। বুক কাঁপছে তার। ভ’য়ে চোখে জল চলে এসেছে। মনে হচ্ছে এখনো সে ঝুলে আছে।
অরুণ বিরক্ত হয়ে অলিভিয়ার হাত ধরে টেনে ছাদ থেকে নেমে গেল। তার হয়েছে যত জ্বা’লা!

একঘণ্টা পেরিয়েছে। আকাশ ছাদ থেকে নেমে এসেছে। ল্যাপটপ অন করে তার কোলের উপর রেখে সন্ধ্যার ঘরের ফুটেজ অন করে। সন্ধ্যা কাগজটি সরিয়ে দিয়েছিল বোধয়।
আকাশ দেখল, সন্ধ্যা বিছানার কোণায় বসে কাঁদছে। আকাশ চুপচাপ চেয়ে রইল। পুরো এক ঘণ্টা এক দৃষ্টিতে আকাশ ল্যাপটপের স্ক্রিনে চেয়ে রইল। সন্ধ্যা মাঝা মাঝে মাথা উঠিয়েছে। তবে একবারের জন্য-ও কান্না থামায়নি। আকাশ ঢোক গিলল। খেয়াল করল সন্ধ্যা মাথা তুলে ফোনে কি যেন টাইপ করল। সাথে সাথে তার ফোন ভাইব্রেট হয়। আকাশ পকেট থেকে ফোন বের করে নোটিফিকেশন চেক করলে দেখল, সন্ধ্যা একটি মেসেজ পাঠিয়েছে। মেসেজটিতে চোখ বুলায় আকাশ,

– শুনেছি,
সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে পা’গ’ল প্রেমিক রূপকথার রাজকুমার রূপে তার প্রিয় রাজকুমারীকে ভালোবাসতে আসে। আমি কি আপনার সেই ভাগ্যবতী রাজকুমারী হতে পারি না শুভ্র-পুরুষ?
লেখাটি পড়ে আকাশের হৃদয় ঠান্ডা হলো। ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকালে দেখল সন্ধ্যা ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। আকাশের চারপাশে তৈরী অদৃশ্য শ’ক্ত প্রাচীর নিমিষেই যেন ভেঙে গেল। ঠোঁটে কোণে হাসি ফুটল। বিড়বিড় করল,
– আমার সন্ধ্যামালতী।

আকাশ মৃদু হেসে সন্ধ্যার নাম্বারে মেসেজটির উত্তর করে। এরপর সাথে সাথে সন্ধ্যার নাম্বারে কল দিয়ে ফোন কানে রাখে। দৃষ্টি ল্যাপটপের স্ক্রিনে।
সন্ধ্যা আকাশের মেসেজটি পড়তে গিয়ে দেখল, আকাশের নাম্বার থেকে কল এসেছে। সন্ধ্যা ঢোক গিলল। আকাশ নিজে তাকে কল করেছে? সন্ধ্যার যে বিশ্বাস হয়না। বা হাতে ভেজা চোখ মুছে কাঁপা হাতে কল রিসিভ করে ফোন কানে ধরে।
আকাশ ঢোক গিলছে বারবার। সে কিছু বলতে চাইছে। তবে পারছে না। মনে হচ্ছে, বারবার গলা বেঁধে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কত যুগ পর তার সন্ধ্যামালতীর সাথে কথা বলবে? চোখ বুজল সে। নিজেকে সামলায়। এরপর চোখ মেলে সন্ধ্যার দিকে তাকায়। ফোন এগিয়ে এনে ঠোঁটের সাথে চেপে ধরে ধরা গলায় ডাকে,

– সোনা বউ?
আকাশের মুখে এই ডাক শুনে সন্ধ্যার পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিরশির করে ওঠে। কতদিন পর আকাশের মুখে এই নামে ডাকলে। সন্ধ্যা নিজেকে সামলাতে পারেনা। ফুঁপিয়ে ওঠে। চোখ বুজে নেয়। বন্ধ চোখের পাতা টুপটুপ করে নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। সে ভেবেছিল, আকাশ হয়ত তাকে সত্যিই আর কখনো তার সাথে কথা বলবে না। কিন্তু বলেছে তো। আকাশ তাকে আবার-ও ডেকেছে।
আকাশ আবেগী কণ্ঠে বলে,

অন্তঃদহন পর্ব ৪৮

– স্যরি সোনা বউ! আর কাঁদাবো না তোমাকে। কান্না অফ কর প্লিজ!
সন্ধ্যার ফোঁপানো থামে না। আকাশ আবার-ও একই সুরে বলে,
– অনেক ভালোবাসি তোমাকে।

অন্তঃদহন পর্ব ৫০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here