অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ২০

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ২০
তেজস্মিতা মুর্তজা

বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলো ওরা, তখন ইশার আজান পড়ছে চারদিকে। কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি। ঠান্ডায় অন্তূ থরথর কোরে কাঁপছিল, কিন্তু চেহারা উদ্দীপনাহীন। ক্ষত-বিক্ষত আমজাদ সাহেবের অচেতন বিশাল দেহটা বহন করা মানসিকভাবে ক্ষত-বিক্ষত অন্তূর পক্ষে অসম্ভব। আমজাদ সাহেব এখন পুরোপুরি অচেতন।
সিঁড়ি দিয়ে যখন উনাকে নামাচ্ছিল জয় বলল, “এইখানে নিয়ে আসার অল্পক্ষণ আগেই ড্রাগ দেয়া হইছে হয়ত।ʼʼ
অন্তূ তাকাল না। তার ভয় হচ্ছে। জয় এখন তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? সে এক কুকুরের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে আরেক নেকড়ের সাথে পথ চলছে না তো! অন্তূর শুধু চোখের সামনে ভাসছে, জয়ের চোখের সেই লোলুপ দৃষ্টি–যখন তার পর্দা হটানো হচ্ছিল, কী বিশ্রী আগ্রহ নিয়ে চেয়ে ছিল জয় আমির!

জয় যখন আমজাদ সাহেবকে তুলে নিয়ে বেরিয়ে আসছিল, পলাশ কিছু বলেনি। হয়ত পিস্তল অথবা জয়ের ক্ষ্যাপা স্বভাবের জন্য বলেনি তৎক্ষণাৎ কিছু। অথবা রহস্য! জয়ের জানা নেই পলাশের শিকার ছিনিয়ে নেয়ার পেক্ষিতে পলাশ কী করতে পারে পরবর্তিতে।
সিঁড়িটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল। একবার পা ফসকালে তিনজনই ঘাঁড়ের শিরা ছিঁড়ে মরার চান্স ছিল। জয় আমজাদ সাহেবকে নিজের লম্বাটে শরীরের সাথে ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের কোরে ফ্লাশ অন কোরে অন্তূর হাতে দিয়ে বলেছিল, “ধরো এইটা।ʼʼ
অন্তূর বুকের ধরফড়ানি তখনও থামেনি, আর না ঘেন্নার আগুন নিভেছে। তবু সে যান্ত্রিক হাতে ধরল ফোনটা। গোটা ঘটনাটার হিসেব মিলছে না। তার মনে হচ্ছে, এখানে যা দেখা গেছে, তার চেয়ে বেশি অদৃশ্যমান ঘাপলা ঘটনাটিতে ভরপুর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

অন্তূ আব্বুর একটা বাহু আগলে ধরে হাঁটছিল। আমজাদ সাহেব অচেতন, ব্যথা বোধহয় টের পাচ্ছেন না। কিন্তু অন্তূর বুকের ব্যথা উপশমের ওষুধ কোথায়? এই বিদারক ঘা কি জীবনে ভরাট হবে?
জয়ের হুট কোরে তার মাথায় এলো, সে এসব করছে? কেন? ননসেন্স কাজকর্ম সব। সে যুব-সেবক হিসেবে এসব করতেই পারে! তবে সেটা খেয়ালমতো! তাই বলে আরমিণের বাপের সাহায্য? একবার তীব্র ঘৃণার চোখে দেখল আরমিণকে। চোখদুটো আক্রোশে জ্বলজ্বল করে উঠল।
অন্তূ টের পেল ঠান্ডায় অথবা আতঙ্কে তার হাত এবং হাঁটু বিশেষত, খুব বাজেভাবে কাঁপছে। শরীরের চাদরটা ওখানেই ধস্তাধস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। এখন এক টুকরো ওড়না আছে বুকে। মাথায় কিছু নেই। সে অল্প একটু ওড়না তুলে মাথায় রাখল। অভ্যাসবশত, যেই মুখটা আবৃত করার জন্য আপনা-আপনিই হাতের ওড়না মুখে উঠে যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে হাত নামিয়ে ফিক কোরে হেসে ফেলল, চোখে এসে পানি জমলো এক দলা।

ভেতরের যন্ত্রণারা ধিক্কার দিলো ওকেকে, “বোকা মেয়ে! তুই তো জবাই হয়েই গেছিস! তোর আর কিছু বাকি আছে? মুখ ঢেকে এখন আর নাটক না করলেই নয়? যা সংরক্ষিত রাখতে হয়, তা শতভাগ অক্ষত রাখতে হয়। সেখান থেকে এক রত্তি দানা খসলে পুরো সংরক্ষণের মান হারায়, সেটা অসংরক্ষিত হয়ে ওঠে। এই আবরণ খোলার পর তা দর্শনে কতকগুলো পুরুষ মজা লুটেছে! নাটক না কোরে সামনে হাঁট। বাইশ বছরের এই সংরক্ষণের খোলশে আজ ইঁদুর ঢুকেছে। তাও সেই ইঁদুর তাড়িয়েছে কে জানিস? আরেকটা পশু। যে তোকে ধরলে হয়ত শুধু তোর সম্ভ্রমই নয়, বোধহয় গোটা তোকে খাবলে খেয়ে ফেলবে।ʼʼ

বাঁশের ঝাড়টার দিকে তাকিয়ে লম্বা লম্বা টান দিচ্ছিল মুস্তাকিন সিগারেটে। সামনে চোখ যেতেই মনে হলো, অন্তূ আসছে। একা নয় সে, তার পাশে আরও দুটো পুরুষ অবয়ব চট করে হোলস্টারে হাত গেল। পিস্তলটা বের কোরেই তাক করে ধরল। জয় হেসে উঠল, “আরে! আরে! মুস্তাকিন সাহেব যে!ʼʼ
হাসি থামিয়ে মিছেমিছি গম্ভীর হলো, “ভেতরে যাননি কেন? আর একটু হলেই খানিক পর তিনটা লাশ উদ্ধার করতে হতো আপনার! আমাদের কথা না-ই বা ভাবলেন, অন্তত লেডিস..ʼʼ
এই পরিস্থিতিতেও এমন নোংরা মশকরা…অবশ্য জয়ের কাছে আশা করাই যায়। অন্তূর দিকে তাকিয়ে মুস্তাকিনের মুখ কালো হয়ে এলো। পর মুহুর্তে দ্রুত আমজাদ সাহেবকে আগলে নিলো জয়ের কাছ থেকে। অন্তূর মুখটা মুস্তাকিন প্রথমবার দেখল। ক্ষণকাল চোখ ফেরালো না। জয় সিগারেট ধরিয়ে একপাশে গিয়ে দাঁড়াল।

আমজাদ সাহেবের নড়বড়ে দেহটা দুজন কনস্টেবলের ভারে দিয়ে শরীরে থাকা চাদরটা খুলে অন্তূর দিকে এগিয়ে দিলো। অন্তূ যন্ত্রের মতো হাত বাড়িয়ে চাদরটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়। মুস্তাকিন প্রায় রুষ্ট কণ্ঠে বলল, “মুখ ঢেকে নিন, অন্তূ! ওখানে কী হয়েছিল পরে শুনছি।ʼʼ অধিকারবোধ অথবা কর্তব্য! যাই হোক, ছিল মুস্তাকিনের স্বরে।
জয় মুস্তাকিনকে বলল, “তোহ! যান তাইলে আমার গাড়ি আসবে। ভিআইপি লোক তো!ʼʼ চোখ মারল কথা শেষে।
মুস্তাকিন হাসল, “খুব শীঘ্রই দেখা হবে।ʼʼ
জয় মাতালের মতো কাধ দুলালো।
ওরা চলে যেতেই জয় পেছনে তাকায়। পুরোনো দুতলার রুফটপ থেকে পলাশের জ্বলজ্বলে চোখদুটো যেন জয়কেই দেখছিল। পুরো দলসহ দাঁড়িয়ে দেখছে এদিকের কাণ্ড।

আমজাদ সাহেবকে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করালো মুস্তাকিন। সে লোক পাঠিয়েছে রাবেয়াকে আনতে।
রাত দশটা বাজবে। অন্তূ বসেছিল বেঞ্চের ওপর। বেশ কিছুক্ষণ নির্লজ্জের মতো দেখল মুস্তাকিন মেয়েটাকে। আসলেই যা সহজে পাওয়া যায় না, তা হুট কোরে পেলে মানুষের আগ্রহ পেয়ে বসে। মুস্তাকিনও রেহাই পেল না সেই আগ্রহ থেকে। অন্তূকে দেখা যায়না, আজ যাচ্ছে। যদিও বিষয়টা মুস্তাকিনের ভালো লাগছিল না।
ধীরে হেঁটে এসে অন্তূর পাশে বসল।
রক্ত শুষে বেরিয়ে গেলে মানুষের মুখের বর্ণ বোধহয় অন্তূর মতো হয়! প্রাণ নেই মুখে, উদ্দীপনার বড্ড অভাব। হাঁটুর ওপর দুহাত একত্র কোরে থুতনিতে ঠেকিয়ে আনমনে চেয়ে আছে। অন্তূর দেহ সেখানে বসা ছিল, তার নজর ছিল না এই জগতের কোথাও!

প্রথমে কিছু বছর অন্তিকের অস্বাভাবিক হয়ে যাওয়া। তারপর সেদিন তার নিখোঁজ হওয়া। এরপর আব্বুর। এরপর অন্তূকে ডাকা। বাকিটা আরও ঘোলাটে। জয়ের আচরণ আরও রহস্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। হিসেবটাকে সাধারণভাবে সমাধান করা যাচ্ছে না। কোথাও একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে।
-“স্যারকে ওরা কেন নিয়ে গিয়েছিল?ʼʼ মুস্তাকিন ঝুঁকে বহল মেঝের দিকে।
-“কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ʼʼ
একরোখার মতো বলে উঠল মুস্তাকিন, “আপনার ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিতে ইচ্ছে করছে না আমার। বলুন।ʼʼ
অন্তূ সেই নিস্তেজ স্বরেই কিছুক্ষণ পর বলল, “ইচ্ছে দুজনের দুটো। কারটাকে প্রাধান্য দেব?ʼʼ
-“আমারটাকে!ʼʼএ পর্যায়ে জেদি লাগল মুস্তাকিনকে।
-“জোর করছেন?ʼʼ
চোখ তুলে তাকাল অন্তূ। মুস্তাকিন চমকে উঠল। ভয়ানক সেই চোখ। লাল টকটকে। এক ধরণের জেদ ও যন্ত্রণার সংমিশ্রণে ভরপুর।
-“যা ভাববেন তাই। কী হয়েছিল ওখানে?ʼʼ একটু থেমে অপরাধীর মতো বলল, “আমার উচিত হয়নি, সময় এক ঘন্টা দেওয়া। আমি ভাবছিলাম, সাধারণ কিডন্যাপিং কেইস।ʼʼ

-“গিয়ে কী করতেন?ʼʼ
-“কিছুই করার ছিল না বলে মনে হয় আপনার? এইহাতে মার্ডারও করেছি, ম্যাডাম! যখন উপরমহল থেকে ঘুষ খেয়ে আমাকে অর্ডার করা হয়েছে প্রমাণ নষ্ট কোরে আসামী ছেড়ে দিতে, রাতের অন্ধকারে লাশ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছি আসামীদের। সিনিয়রদের কথা অমান্য করিনি।ʼʼ মুস্তাকিনের কথাবার্তা উগ্র লাগছিল শুনতে, সেই চেনা ভদ্রলোককে ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে এক গোপন বিপ্লবী সত্ত্বা।
অন্তূ কথা বলল না। তার নিজের কথা ভাবার অবকাশই নেই মস্তিষ্কে। সবটুকু জায়গা ভিড়ে আছে আব্বুর কানের সেই সিগারেটে পোঁড়া ক্ষত।
ছুটে পালাতে ইচ্ছে করছিল কোনোদিকে। এই নোংরা দেহ, কুলষিত জীবনকে ফেলে নির্জন জনমানবশূন্যের দিকটা তাকে ডাকছিল। চোখের সম্মুখটা অন্ধকার হয়ে এলো যখন, তখন ওপার থেকে আমজাদ সাহেব ডাকছেন। ওই তো আমজাদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। আরে! পরনে সাদা ধবধবে পাঞ্জাবী! এত্ত অভিজাত লাগছে আব্বুকে দেখতে। অন্তূ ছুটে যায় আব্বুর দিকে। আব্বুর ডান হাতের তর্জনী আঙুলটা চেপে ধরে তারা হেঁটে যাচ্ছে। যাচ্ছে, যাচ্ছে, তারা চলছে.. আর আসছে না দৃশ্যটা। সবটা অন্ধকার। রাত হয়ে গেছে। এই তো সবে বসন্তের বিকেল ছিল। এত্ত তাড়াতাড়ি রাত নামল? সব ফুরিয়ে গেল!

মুস্তাকিন চমকে উঠল। ধপ কোরে পড়ে গেছে অন্তূর শরীরটা বেঞ্চি থেকে উপুড় হয়ে। ওকে ধরে উল্টাতেই মুস্তাকিন থমকাল। অন্তূর নাক বেয়ে রক্তের প্রবাহ নেমেছে। ঠোঁটের কাছে দাঁত আঁটকে আছে! দাঁত ছাড়ালে নিশ্চিত ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে আসবে।
ডাক্তার পার্লস রেট চেইক করতে কব্জি ধরেই বললেন, “কীসের ট্রমায় আছে এইটুকু মেয়ে! পোশাকের এই হাল কেন? আপনার কে হয় মেয়েটা?ʼʼ
মুস্তাকিন জবাব দিলো না। কে হয় অন্তূ ওর? জানেনা ও।

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ১৯

অন্তূকে জানানো হলো না মুস্তাকিনের, আঁখির কেইসটা হাতে নেয়ার পর পলাশই তাকে হুমকি দেয়া চিরকুট পাঠিয়েছিল। ফোনকলে বাজে ভাষায় গালি দিয়েছিল, খুন করার ধমকি দিয়েছিল। আঁখির রেপ এবং মার্ডারের সাথে অতপ্রোভভাবে জড়িত পলাশ! তবে সে একা নয়। আরও কেউ বা কারা আছে।

অবরুদ্ধ নিশীথ পর্ব ২০ (২)