অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ১৮

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ১৮
ইয়াসমিন খন্দকার

আবরাজ ও নিঝুম পা রাখল নিউ ইয়র্কে। মিজানুর রহমান তাদের দুজনকে নিয়ে নিউ ইয়র্কে তার বাসায় এলো। নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে খুব সুন্দর একটি বাসায় থাকেন তিনি। নিঝুম তো এখানে এসে বেশ খুশি হলো। মিজানুর রহমান নিঝুমকে উদ্দ্যেশ্য করে বললেন,”এটাকে তুমি নিজেরই বাড়ি মনে করো, মা। কোন রকম কোন হ্যাজিটেশন রেখো না। যখন যা প্রয়োজন হবে জানাবে। তোমার আর আবরাজের জন্য আমি এই রুমটা গুছিয়ে রেখেছি। তোমরা এখানেই অবস্থান করো।”

নিঝুম অবাক হয়ে বলে,”আমি আর উনি একই রুমে!”
“হ্যাঁ, কেন তোমরা তো স্বামী-স্ত্রী হও। তোমাদের তো একরুমেই থাকার কথা। তোমরা কি এক রুমে থাকো না?”
নিঝুম বুঝতে পারে, মিজানুর রহমান তো আর তাদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। তাই সে ব্যাপারটা ম্যানেজ করার জন্য বলে,”না,আঙ্কেল। আমরা তো এক রুমেই থাকি। কিন্তু উনি তো এখন অসুস্থ আর তাই..”
“অসুস্থ জন্যই তো ওকে তোমার আরো বেশি দরকার। আমি তো দেখেছি, তুমি ওর কতটা খেয়াল রাখো। তোমার থেকে বেশি খেয়াল আর ওর কেউ কি রাখতে পারবে? তাই আমার মতে তোমাদের এক রুমেই থাকা উচিত।”
নিঝুম আর কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। এদিকে আবরাজ না পারছে সইতে আর না পারছে কিছু বলতে। এমনিতেই সে এটা নিয়ে চিন্তায় আছে যে আজ ডাক্তার তাকে দেখার পর যদি সব বুঝতে পেরে যায় তাহলে কি হবে তার উপর আবার এখন নিঝুমের সাথে তাকে এক রুম শেয়ার করতে হবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিজানুর রহমান তাদের রুম দেখিয়েছে দিয়েই বলেন,”তোমরা যাও ফ্রেশ হয়ে নাও৷ আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
অগত্যা নিঝুম আর আবরাজ তাদের জন্য বরাদ্দ রুমেই প্রবেশ করে। রুমে এসেই নিঝুম আবরাজকে বলে,”আপনি যান ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি এখানেই আছি।”
আবরাজ মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। আবরাজ ওয়াশরুমে যাবার পরই নিঝুম একটা গভীর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”হায় আল্লাহ! এসব কি হচ্ছে? আমি যত ওনার থেকে দূরে থাকতে চাচ্ছি পরিস্থিতি ততোই আমাকে ওনার কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু..এটা যে ঠিক হচ্ছে না। যদি এভাবে চলতে থাকে আর আমি ওনার মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে যাই তাহলে যে এর পরিণাম ভালো হবে না। হায় আল্লাহ! তুমি আমার মনটাকে একটু শক্ত করে দাও। যেন এহেন অনুভূতিতে আমি সহজে গা না ভাসাই।”

একটু পরেই আবরাজ বেরিয়ে আসলে নিঝুম বলে,”আমি একটু বিশ্রাম নিন। একটু পর আমরা খেতে যাব।”
আবরাজ বিছানায় বসে পড়ে। নিঝুম ফ্রেশ হতে চলে যায়। আবরাজ বলে ওঠে,”উফ! এত টেনশন আমি আর নিতে পারছি না৷ সব হয়েছে এই ম্যাক্স আর এলিনার জন্য। ওদের কথায় নেচেই আজ আমার এই বিপদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমার উচিৎ হয়নি ওদের কথা শোনা। এখন যদি নিঝুম জেনে যায় আমি সবটা অভিনয় করছি তাহলে আমার ইমেজ একদম খারাপ হয়ে যাবে। এটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। আমার আত্মসম্মান আমি নষ্ট হতে দেব না। কিছুতেই না!”

নিঝুম ও আবরাজ এক সাথে খাওয়া শেষ করে রুমে চলে আসে৷ আবরাজ বিছানায় শুয়ে অস্থিরতায় কাতরাচ্ছে। অন্যদিকে, নিঝুম বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি যেন ভাবছে। হঠাৎ করেই আবরাজের ফোন বেজে ওঠে। আবরাজ ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই বিপরীত দিক থেকে ছবি বেগম উদ্বিগ্ন স্বরেবলে ওঠেন,”তুমি এখন কেমন আছ আবরাজ? তোমার কি এখনো আগের কোন কথা মনে পড়ছে না?”
আবরাজ অভিনয় করে বলে,”কে বলছেন আপনি?”
“আমি ছবি বেগম। তোমার সৎ..তোমার মা।”
“আমি কিছু মনে করতে পারছি না।”

আবরাজের এমন অস্থির‍তা দেখে নিঝুম এগিয়ে এসে বলে,”ফোনটা আমায় দিন আমি কথা বলছি।”
আবরাজ ফোনটা নিঝুমকে দেয়। নিঝুম ফোনটা হাতে নিয়ে বলে,”হ্যালো,কে বলছেন?”
ছবি বেগম বলেন,”নিঝুম, আমি বলছি।”
“চাচি,আপনি। কেমন আছেন আপনারা সবাই?”
“আমরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছ নিঝুম? আর আবরাজের কি অবস্থা? ওর অবস্থার কি একটুও উন্নতি হয় নি? এভাবে আর কয়দিন চলবে?”
নিঝুম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। না, ওনার পরিস্থিতি এখন বেশ স্থিতিশীল। তবে একটা ভালো খবর আছে। ওনার মামা ওনাকে নিউ ইয়র্কে নিয়ে এসেছেন ভালো ডক্টর দেখানোর জন্য। আশা করছি, এবার উনি খুব শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

“যাক, শুনে নিশ্চিত হলাম।”
“আচ্ছা, আম্মুর কি খবর? আম্মু কেমন আছে এখন?”
“তোমার আম্মুর অবস্থা খুব একটা ভালো না। মূলত এটা জানানোর জন্যই তোমাদের ফোন করা। কয়েকদিন ধরে ও বেশ অসুস্থ। বারবার তোমার কথা বলছে। ডাক্তার বলেছেন অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তা আর মানসিক অস্থিরতার জন্য প্রেশার বেড়ে গেছে।”
নিঝুম উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,”কি বলছেন কি চাচি! কিছুদিন থেকে ব্যস্ততার জন্য খোঁজই নেওয়া হয়না তাতেই এই অবস্থা!”
“তুমি এত চিন্তা করো না। ডাক্তার দেখানো হয়েছে তোমার মার অবস্থা এখন স্থিতিশীল।”
“মায়ের সাথে একটু কথা বলা যাবে?”
“সেটা তো সম্ভব না। আসলে তোমার মাকে ডাক্তার কিছু ভারী ডোজের ওষুধ খেতে দিয়েছি। একটু আগেই ও সেসব ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই এখন তাকে জাগানো সম্ভব না।”
“আপনি একটু আম্মুর খেয়াল রাখিয়েন চাচি৷ আমি দেখি..যদি উনি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে ওঠেন তাহলে আবার বাংলাদেশে ফিরে যাব।”

“কি বলছ তুমি? তোমাদের তো ৫ মাস..”
“কিছু সম্পর্ক এমন থাকে চাচি যা ৫ সেকেন্ডেও জোড়া লাগে আবার কিছু সম্পর্ক ৫ মাস তো কি ৫ মাসেও জোড়া লাগে না। আমার আর ওনার সম্পর্কটাও ঠিক সেরকমই। তাই আমি এই সম্পর্ক নিয়ে কোন আশা রাখি না। এখন আমি শুধু দায়িত্বশীলতার কারণেই ওনার সুস্থতার জন্য পাশে আছি। একবার যদি উনি সুস্থ হয়ে যান তাহলে আমি এখান থেকে চলে যাব।”
নিঝুমের কথাগুলো শুনে আবরাজ অবাক হয়ে যায়। আবরাজ মনে মনে বলছে,”তাহলে কি আমি সত্যিই মেয়েটাকে চিনতে ভুল করেছি? ও কি তাহলে এতটাই নিঃস্বার্থ?”

এরূপ ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে তাদের দরজায় কেউ নক করে। নিঝুম ছবি বেগমের সাথে কথা বলা শেষ করে ফোনটা রেখে দেয়৷ অতঃপর গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। দরজাটা খুলতেই মিজানুর রহমান ভেতরে এসে বলেন,”নিঝুম, আবরাজ তোমরা দ্রুত রেডি হয়ে নাও। আমার ডক্টর স্মিথের সাথে কথা হয়েছে। উনি নিজের চেম্বারে বসেছেন। আমাদের এখনই সেখানে গিয়ে ওনার সাথে দেখা করতে হবে।”
আবরাজ হঠাৎ করে বেশ বিড়ম্বনায় পড়ে। সে বুঝতেই পারে না এখন সমস্ত বিষয়টা কিভাবে সামলাবে। এবার কি তাহলে তার সত্যটা ধরা পড়ে যাবে?

ডাক্তার স্মিথের চেম্বারে এসে বসে আছে নিঝুম, আবরাজ ও মিজানুর রহমান। একটু পরেই ডাক্তার স্মিথের নির্দেশনা মোতাবেক আবরাজের কিছু টেস্ট করানো হয়। সমস্ত টেস্ট শেষ হবার পর ডাক্তার তাদের সবাইকে তার চেম্বারে ডেকে পাঠান। আবরাজ ধুকুপুকু বুক নিয়ে ডাক্তার স্মিথের চেম্বারে প্রবেশ করে। ডাক্তার স্মিথ তাদেরকে বসতে বললেই তারা বসে পড়েন। অতঃপর তিনি আবরাজের সমস্ত রিপোর্ট চেক করতে থাকেন। আবরাজের হৃদস্পন্দন দ্রুত বাড়ছিল৷ পরিস্থিতি এমন যে রুমে এসি চালু থাকার পরেও আবরাজ তড়তড় করে ঘামছিল। নিঝুম আবরাজকে এভাবে ঘামতে দেখে রুমাল দিয়ে তার ঘাম মুছিয়ে দিয়ে বলে,”আপনি এভাবে ঘামছেন কেন?”
আবরাজ কিছু বলতে পারে না। এদিকে ডাক্তার স্মিথ গম্ভীর স্বরে বলেন,”কি যেন বলেছিলেন আপনি মিস্টার রহমান? আপনার nephew দূর্ঘটনার কবলে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে নিজের সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছে?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ১৭

“জ্বি।”
ডাক্তার স্মিথ বিস্ময়ের সাথে সমস্ত রিপোর্ট দেখেন। আবরাজ নিজের সত্যটা ধরা পড়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। ডাক্তার স্মিথ বলে ওঠেন,….

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ১৯