অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৮

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৮
ইয়াসমিন খন্দকার

আবরাজকে দেখামাত্রই ইমরান নিঝুমের থেকে দূরে সরে গিয়ে বলে,”আরে ব্রো, আপনি। তেমন কিছু না। আমি আর নিঝুম তো একটু ফ্রেন্ডলি আলাপ করছিলাম, তাই না নিঝুম?”
নিঝুম ঘৃণাভাজন দৃষ্টি নিয়ে ইমরানের দিকে তাকায়। কিন্তু আবরাজের সামনে কিছু বলতেও পারে না লজ্জার খাতিরে। এদিকে আবরাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বলে,”ফ্রেন্ডলি আলাপ? এক বিবাহিত নারীর শরীরে হাত দিয়ে, তাকে জড়িয়ে ধরে তুমি ফ্রেন্ডলি আলাপ করছিলে?”
ইমরান আমতাআমতা করে বলে,”আপনি ভুল ভাবছেন। নিঝুম..তুই কিছু বলছিস না কেন? বল। আবরাজ ব্রো তো ভুল বুঝছে।”

আবরাজ এগিয়ে এসে ইমরানের শার্টের কলার ধরে বলে,”ভুল আমি কখনোই বুঝিনি৷ তোকে বরাবরই আমি ঠিকই বুঝেছি। তবে এতদিন অন্য একজনকে ঠিক ভেবেছিলাম যা ছিল আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল।”
নিঝুমের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে আবরাজ। নিঝুম অবাক চোখে তাকায়৷ ইমরান এটা বুঝতে পেরে উল্টো চাল দিয়ে বলে,”ওকে ব্রো, তুমি যখন বুঝেই গেছ সবটা তখন আর নাটক করে লাভ নেই। আমি আর নিঝুম একে অপরকে ভালোবাসি সেই স্কুল লাইফ থেকে। ক্লাস ৭ এ পড়াকালীন সময় থেকেই আমাদের মধ্যে রিলেশন ছিল৷ তারপর তো আমাকে পরিবারের সাথে UK তে চলতে আসতে হয় তাই আমাদের সম্পর্কে একটা ফাটল তৈরী হয়। কিন্তু এখানে এসে এত বছর পর একে অপরকে দেখে আমাদের সেই পুরাতন ভালোবাসা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷ আর তাই তো নিঝুম চায় আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে আসতে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিঝুম ইমরানের এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার শুনে হতবাক হয়ে যায়। প্রতিবাদ করে বলে,”এসব তুই কি যাতা বলছিস ইমরান? তুই খুব ভালো করেই জানিস তোকে আমি কখনোই বন্ধুর থেকে বেশি দেখিনি। তোকে আমি বন্ধু হিসেবে বিশ্বাস করেই এখানে এসেছিলাম কিন্তু তুই আমাদের বন্ধুত্বকে কলঙ্কিত করে আমার সাথে জোরজবরদস্তি করে…আর এখন আমার নামে এসব মিথ্যা বলছিস। তোর মনে কি আল্লাহর প্রতি একটুও ভয় নেই? এভাবে মিথ্যাচার করতে বাঁধছে না তোর?”

আবরাজ হাত তালি দিতে থাকে। নিঝুম অবাক চোখে দেখে। আবরাজ হাত তালি দিতে দিতে আবরাজ এর সামনে এসে বলে,”বাহ, কি সুন্দর অভিনয়। এত সুন্দর অভিনয় কিভাবে শিখলে তুমি নিঝুম?”
“আপনি ভুল ভাবছেন..”
“ভুল কিছু আমি ভাবছি না। আমি যা ঠিক তাই ভাবছি। প্রথমেই আমি তোমাকে ঠিক ভেবেছিলাম। তুমি আসলেই একটি লোভী,প্রতারক মেয়ে। তারপর আমি ভাবলাম, তুমি একটা ভালো মেয়ে। আর আমার সেই ভাবনাটাই ভুল ছিল।”

নিঝুম বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। আবরাজ পুরোপুরি তাকে ভুল ভাবছে। আবরাজ একটু থেমে বলে,”আমার যা সিদ্ধান্ত নেবার তা আমি নিয়ে ফেলেছি। তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে এই ইমরানকে বিয়ে করতে চাও তো? বেশ, ভালো কথা। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমাদের দুজনের বিয়ে দেব। শুধু তাই নয়, ডিভোর্সের পর তোমার খোরপোষের জন্য যদি টাকা লাগে সেটার জন্যেও বলতে পারো। আমি তাতেও রাজি আছি। এটাই তো চেয়েছিলে তোমরা? যাও আমি তোমাদেরই খুশি করে দিলাম।”
নিঝুমের চোখে অশ্রু চলে আসে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমি এসব কিছুই চাই না। না তো আমি ইমরানকে বিয়ে করতে চাই আর না তো আমি আপনার থেকে কোন টাকা চাই৷ আমি শুধু আত্মনির্ভরশীল হতে চাই, একজন ডাক্তার হয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। ব্যস।”
আবরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,”এখানে এই বদ্ধ রুমে কি সেই ডাক্তারি হওয়ার ট্রেনিং নিতে এসেছিলে নিজের বন্ধুর কাছে?”

নিঝুম বুঝতে পারে আবরাজ কোন দিকে ইঙ্গিত করছে। সে চরম ঘৃণা নিয়ে বলে,”মিস্টার আবরাজ!”
“হুশ, একদম চোখ রাঙাবে না। দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে। এই নাও তোমার পাসপোর্ট, ভিসা, প্লেনের টিকিট সব এখানে এসব নাও আর দূর হও। দুই মাস পর তোমার কাছে ডিভোর্স লেটারস পাঠিয়ে দেব।”
বলেই নিঝুমের মুখের উপর সব ডকুমেন্টস ছিটিয়ে দিয়ে চলে যায় আবরাজ। নিঝুম সেসব ডকুমেন্টস তুলে নেয়। অতঃপর ইমরানের দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ শুধুমাত্র তোর জন্য উনি আমার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলার সাহস পেলেন। তোকে আমি কখনো ক্ষমা করবো, কখনোই না।”
বলেই নিঝুম ইমরানের কফিশপ থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটতে থাকে লন্ডনের রাস্তা দিয়ে।

আবরাজ বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকে একের পর এক জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে থাকে৷ রাগে তার মাথা ফেটে যাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে রুমে এভাবে তাণ্ডব চালানোর পর আবরাজ একটু শান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবে,”আমি কি নিঝুমকে সত্যিই ভুল বুঝলাম? কিন্তু যা দেখলাম সব তো ওর বিরুদ্ধেই।”
এদিকে,
নিঝুম চলে এসেছে এয়ারপোর্টের সামনে। তার ফ্লাইটের সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আপাতত সে ইমিগ্রেশন বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এয়ারপোর্টের ভেতরে যাবার আগেই শেষ বারের মতো লন্ডন শহরের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসে নিঝুম। অতঃপর বলে,”এই শহর আমার দুঃখময় জীবনে সুখ আনতে পারে নি। বরং আরো বেশি দুঃখে নিমজ্জিত করেছে। এই শহরে আমি কোন আশা নিয়ে পা রাখিনি কিন্তু এতটা অপমান নিয়ে ফিরতে হবে সেটাও ভাবিনি। ভালো থেকো লন্ডন শহর।”
বলেই সে সামনের দিকে পা বাড়ায়। আর একটিবারও পেছন ফিরে তাকায় না।

কয়েক দিন পর,
আবরাজ আজ আবারো একটি বারে এসেছে। এখানে এসে ক্রমান্বয়ে মদ্যপান করে চলেছে। ম্যাক্স ঠিক তার পাশেই বসে। আবরাজকে এ অবস্থায় দেখে সে বলে,”ভাই, এবার থামো। আর কত খাবে? এবার তো শরীর খারাপ করবে। অনেক রাতও হয়ে গেছে। চলো ফিরে চলি।”
আবরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,”তোমার ঘরে তো বউ আছে, এজন্য তো ফিরতে চলেছ। বাসায় ফিরে বউয়ের সাথে সময় কাটাবে কিন্তু আমার কি হবে? আমার জন্য তো কেউ নেই আমার এপার্টমেন্টে। সেখানে গেলেই যে একাকীত্ব ঘিরে ধরবে আমায়।”
ম্যাক্স একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজের এই বন্ধুটার কষ্ট সে বুঝতে পারছে। আবরাজ যে নিজের অজান্তেই ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে নিঝুমকে। নিজের ইগো পাশে ঠেলে কতই না অনুরোধ করল নিঝুমকে তার সাথে থাকার জন্য অথচ মেয়টার তার কষ্ট বুঝল না। যদিও আবরাজ তাকে স্পষ্ট করে কিছু বলে নি, তবে যতটুকু বলেছে তাতে ম্যাক্স এতটুকু বুঝেছে নিঝুম দেশে ফিরে যাবার আগে এমন কোন ঘটনা ঘটেছিল যা তাদের মধ্যকার দূরত্ব অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ম্যাক্স এসব ভেবেই মনে মনে বলে,”আচ্ছা, নিঝুম এখন কেমন আছে? আবরাজকে এত কষ্টে রেখে সে কি সুখী হতে পেরেছে?”

“সুখ সবার কপালে থাকে না,আম্মু। আমার কপালে এই সুখ সবসময় অধরাই ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।”
হতাশ স্বরে শান্তি বেগমকে কথাটা বলে নিঝুম। শান্তি বেগম তা শুনে নিঝুমের মাথায় ভরসার হাত বুলিয়ে বলেন,”চিন্তা করিস না, মা। আল্লাহ আছেন, তার উপর ভরসা রাখ। ভালো ভাবে মেডিকেল ভর্তির প্রিপারেশন নে। তোর হাতে তো আর বেশি সময় নেই। আগামী সপ্তাহেই মেডিকেল ভর্তি এক্সাম। মনে রাখিস, যারা তোকে অপমান করেছে তাদের যোগ্য জবাব দিতে মেডিকেলে তোকে চান্স পেতেই হবে।””
“আমি লন্ডনে গিয়েও যথাসাধ্য পড়াশোনা চালিয়েছি। আশা করি, সফলতা পাবো।”
১ সপ্তাহ পর,

নিঝুম চঞ্চলতার সাথে পায়চারি করছে পুরো ঘরময়। আজ তার মেডিকেল ভর্তির রেজাল্ট আসার কথা। গতকালই সে এক্সাম দিয়েছে আজই রেজাল্ট আসবে। নিঝুম আল্লাহর কাছে দোয়া করছিল যেন চান্সটা হয়ে যায়। ছবি বেগম, শান্তি বেগম দুজনই তাকে বলে,”এতটা অস্থির হস না। দেখবি সব ঠিক হবে। চান্স পেয়ে যাবি।”
এদিকে আবির কম্পিউটারে সার্চ করছিল রেজাল্ট দেখার জন্য। একটু পরেই সে হঠাৎ করে বলে,”এটা কি হলো?”
নিঝুম হতাশ স্বরে বলে,”আমার চান্স হয় নি?”
আবির একটু হতাশ স্বরে বলে,”হয়েছে কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে হয়নি সিলেট মেডিকেলে হয়েছে।”
শান্তি বেগম বলে ওঠেন,”শোকর আলহামদুলিল্লাহ। চিন্তা করার কিছু নেই, আল্লাহ সহায় হলে এখান থেকেই কিনা হবে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৭

ছবি বেগম বলে,”আমি মিষ্টি আনছি৷ এত খুশির খবর, নিঝুম ডাক্তার হবে।”
এদিকে নিঝুম বলে,”এবার আমি সবাইকে জবাব দেব, যারা সারাটা জীবন আমায় অপমান করে গেছে।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ২৯