অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৪১

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৪১
ইয়াসমিন খন্দকার

আবরাজ রেগেমেগে নির্ঝরকে নিয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসে। নিঝুমও আসে তার পিছন পিছন। আবরাজ রাগান্বিত স্বরে বলে,”যেই স্কুলের শিক্ষকই এমন যে মানুষকে প্রাপ্য সম্মানটাই দিতে পারে না সেখানে আমাদের ছেলে কে কি শিক্ষা দেবে? আমি নির্ঝরকে এখানে পড়াব না। ওকে অন্য কোথাও ভর্তি করাবো।”
আবরাজের মুখে এহেন কথা শুনে নিঝুম অবাক হয়৷ শুধুমাত্র তাকে অপমান করেছে জন্য আবরাজ নির্ঝরকে এই স্কুলে ভর্তি করালো না৷ নিঝুমের কাছে এই বিষয়টা খুব ভালো লাগল। তার মুখে দেখা গেল হাসির রেখা। এরইমধ্যে আবরাজ গাড়িতে উঠে নিঝুমকে বলল,”চলো আরো কয়েকটা স্কুল ঘুরে দেখি। যেই স্কুলে মানুষকে প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয় সেরকম কোন স্কুলেই আমাদের ছেলেকে আমরা ভর্তি করাবো।”
নিঝুম মাথা নাড়িয়ে সহমত জানায়।

নিঝুমকে অন্য একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে এপার্টমেন্টে ফিরে আসে নিঝুম ও আবরাজ। এপার্টমেন্টে ফিরে এসেই আবরাজ নিঝুমকে বলে,”আজকের লাঞ্চটাও বাইরে গিয়ে করি, কি বলো?”
নিঝুম বলে,”আজ নাহয় আমিই কিছু একটা রান্না করি?”
আবরাজ কিছু একটা ভেবে বলে,”সেটা ঠিক আছে কিন্তু আগের মতো শুটকির কোন আইটেম করো না প্লিজ।”
বলে আবরাজ হেসে ফেলে। নিঝুমের মুখ কিছুটা গম্ভীর ছিল। আবরাজ হাসি থামিয়ে বলে,”তুমি কি আমার কথা শুনে রাগ করলে নাকি?”
এবার নিঝুমও হেসে ফেলে আর বলে,”না, রাগ করিনি। অসুবিধা নেই,আমি আজ নাহয় চিকেনের কোন রেসিপি করব। নির্ঝর চিকেন খেতে অনেক পছন্দ করে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তাই নাকি? বাহ, আমার ছেলে তো একদম আমার মতোই হয়েছে। আমারও তো চিকেন অনেক পছন্দ।”
“তাহলে তো ভালোই। আপনি যান, নির্ঝরের সাথে একটু সময় কাটান। আমি চিকেন করে নিয়ে আসছি।”
আবরাজ নিঝুমের কথা শুনে নির্ঝরের পাশে তার রুমে গিয়ে বসে। দুই বাবা-ছেলে অনেকক্ষণ গল্পগুজব করে। নির্ঝর আবরাজের কাছে লন্ডন শহরের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে চায়। আবরাজও ধৈর্য সহকারে নির্ঝরের সাথে অনেক কিছু শেয়ার করে। একই সাথে তাকে ভালো ভাবে ইংরেজি শেখানোর দায়িত্বও আবরাজ নিয়ে নেয়। যদিও নিঝুমও ইংরেজি জানে তবে বাংলাদেশে বড় হওয়ায় নির্ঝরের তেমন একটা ইংরেজি শেখা হয়নি। বাংলাদেশের ৫ বছরের বাচ্চারা কি ওতো ভালো ইংরেজি পারে নাকি? টুকটাক যা একটু বলে। ইংরেজি মিডিয়ামের স্টুডেন্ট হলে সেটা ভিন্ন কথা। তবে যেহেতু এখন নির্ঝরকে লন্ডনেই থাকতে হবে তাই তার ইংরেজি শেখা অত্যন্ত জরুরি।
তাদের আলাপচারিতার মাঝেই নিঝুম এসে বলে,”লাঞ্চ তৈরি হয়ে গেছে।”

অতঃপর বাবা-ছেলে মিলে চলে যায় ডাইনিং টেবিলে। নিঝুম তাদের খাবার পরিবেশন করে। আবরাজ নিঝুমকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,”তুমিও আমাদের সাথে বসে পড়ো। আমি তোমাকে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছি।”
আবরাজের মুখে এই কথা শুনে নিঝুম ভীষণ খুশি হয় এবং খাবার খেতে বসে পড়ে। আবরাজ নিজে নিঝুমকে খাবার পরিবেশন করে। অতঃপর পরিবারের সবাই একসাথে লাঞ্চ করতে শুরু করে। খাবার খেতে বসে বারকয়েক আবরাজ ও নিঝুমের মধ্যে চোখাচোখি হয়৷ যেন তারা সত্যিই নির্ঝরের মা-বাবা থেকে এখন ধীরে ধীরে নিজেদের সম্পর্কের দিকেও অগ্রসর হয়ে চলেছে।

সময় কেটে যায় চোখের পলকে৷ নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলে অবিচল৷ এখানেও তেমনি সময় থেমে থাকে নি৷ ধীরে ধীরে অনেক এগিয়ে গেছে৷ নিঝুমদের লন্ডনে আসার পর মাস তিনেক পার হয়েছে৷ এই ৩ মাসে অনেক পরিবর্তনই লক্ষ করা গেছে।
নিঝুম এখন লন্ডনের একটি প্রাইভেট হসপিটালে ডাক্তার হিসেবে যোগ দিয়েছে। এখানেই সে নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করেছে। আবরাজও নিজের অফিসের কাজে অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে। এদিকে ছোট্ট নির্ঝরও নিজের নতুন স্কুলে পড়াশোনায় অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। যদিওবা নিঝুম ও আবরাজের সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে। আগের মতো দা-কুমড়া সম্পর্ক তাদের আর নেই। বরং তারা একে অপরকে অনেক ক্ষেত্রেই সাহায্য করে। নিজেদের মধ্যকার মন কষাকষিও তারা অনেকাংশে কাটিয়ে নিয়েছে। তবে বাস্তব সত্য হচ্ছে, বর্তমানের পৃথিবীর কর্মব্যস্ত সময়ে পরিবার গুলো একে অপরকে দেয়ার মতো যথেষ্ট সময় পায় না৷ তারা যেন কৃত্রিম পৃথিবীর এই কৃত্রিমরূপেই জড়িয়ে যাচ্ছে। আর সেরকইমই দেখা যাচ্ছে এই ছোট্ট পরিবারটার ক্ষেত্রেও। তাই তো তারা এখন একে অপরের সাথে সময় কাটানোর তেমন সময়ই পায় না।

তবে এরমধ্যে হঠাৎ করে নির্ঝরের স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ভ্যাকেশন দেয়া হলো৷ নির্ঝর তার নতুন বন্ধুদের কাছে শুনেছে তারা সবাই এই সময় নিজেদের পরিবারের সাথে কোথাও না কোথাও ঘুরতে চায়৷ এটা শুনে তার শিশুমনে প্রভাব পড়েছে। তাই তো আজ রাতে ডিনারের সময় খেতে বসে সে আবরাজ ও নিঝুমের উদ্দ্যেশ্যে বলল,”আমার সব বন্ধুরা সামার ভ্যাকেশনে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে। আমিও যেতে চাই।”
আবরাজ বলে,”এটা তো অনেক ভালো কথা। ঘুরতে গেলে মনও ভালো হয়। আমিও ভাবছি আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া উচিত। তুমি কি বলো নিঝুম?”
নিঝুম বলে,”হুম, প্রস্তাবটা মন্দ নয়। আমরা চাইলেই কোথাও একটা ঘুরতে যেতে পারি৷ নির্ঝরের তো এই স্কুল থেকে বাড়ি-বাড়ি থেকে স্কুল এই জীবনটা ভালো লাগছে না। আমিও প্রফেশনাল জীবনে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। এসব থেকে একটু মুক্তির দরকার।”
“তাহলে এবার আমরাও সামার ভ্যাকেশনে সবাই মিলে ঘুরতে যাব।”

আবরাজের এই প্রস্তাব শুনে নির্ঝর বলে ওঠে,”ইয়াহু!”
নিঝুম বলে,”বেশ, আমি হাসপাতালে কথা বলে দেখব ছুটি ম্যানেজ করা যায় কিনা। কিন্তু আমরা যাবো টা কোথায়?”
আবরাজ কিছুটা ভেবে বলে,”কর্নওয়ালে।”
কর্নওয়ালের নাম শুনে নির্ঝর উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে,”কর্নওয়াল! বাবা, ওখানে কি সমুদ্র আছে? আমার বন্ধুরা বলেছে ওখানে অনেক বড় বড় সমুদ্রতীর আছে!”
আবরাজ হেসে মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আছে। কর্নওয়াল খুবই সুন্দর জায়গা। সমুদ্রতীর, পাহাড় আর প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য দেখতে গেলে এর চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই।”
নিঝুম বলে, “কিন্তু কর্নওয়ালে তো অনেক দূর। আমরা কিভাবে যাব? ফ্লাইট নেব নাকি গাড়ি নিয়ে যাবো?”
আবরাজ একটু ভেবে বলে, “গাড়ি নিয়েই যাই। রোড ট্রিপের মজাই আলাদা। পথে পথে ছোট ছোট শহর আর প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে পারব।”
নিঝুম মাথা নাড়ে, “বেশ। তাহলে আপনার গাড়ির প্ল্যানটাই ঠিক। তবে নির্ঝরের জন্য কিছু খাবার আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে হবে।”
“ঠিক আছে, কাল আমি অফিস থেকে ফিরে গাড়ি সার্ভিস করিয়ে নিয়ে আসব। তুমি আর নির্ঝর বাকিটা সামলাবে,” আবরাজ বলে।

কিছুদিন পর,
সকাল থেকেই ঘরজুড়ে এক অন্যরকম ব্যস্ততা। নিঝুম ছোট একটা লিস্ট করে নেয়, যেখানে ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তালিকা দেওয়া আছে। নির্ঝরও তার খেলার সামগ্রী আর প্রিয় বইগুলো ব্যাগে ভরতে ব্যস্ত। আবরাজ সকালেই গাড়ি সার্ভিসিং করিয়ে বাড়ি ফিরে বলে, “সবাই রেডি তো? আমাদের ঠিক সময়ে বের হতে হবে।”
নিঝুম বলে, “হ্যাঁ, আর মাত্র কয়েকটা জিনিস ব্যাগে ভরলেই আমি রেডি।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৪০

বিকেল নাগাদ তারা গাড়ি নিয়ে রওনা দিল। নির্ঝর পিছনের সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত। নিঝুম আর আবরাজ সামনের সিটে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে থাকে। নির্ঝরও এই ট্রিপ নিয়ে অনেক এক্সাইটেড ছিল। তার ভীষণ ভালো লাগছিল নতুন একটা জায়গা ঘুরতে যাবে এটা ভেবে। সে তার মা-বাবাকে একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিল৷ আর নিঝুম ও আবরাজ ধৈর্য সহকারে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে পর্ব ৪২