অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫২

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫২
ইয়াসমিন খন্দকার

আরহা বিষন্ন চোখে তার বড় ভাই জাঈদকে পর্যবেক্ষণ করছিল। যদিও জাঈদ তখনো অব্দি বেশ শান্ত ছিল কিন্তু তার এই শান্ত থাকা যে বৃহৎ ঝড়ের পূর্বাভাস সেটা আরহা উপলব্ধি করতে পারে৷ আকাশ যে আরহার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সে হঠাৎ করে বলে ওঠে,”তোমার কি মনে হচ্ছে আরহা? জাঈদ ভাই কি এই হারটা সহজে মেনে নেবে?”
আরহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”মনে তো হয় না।”

জাঈদ ধীর গতিতে সবার অলক্ষ্যে স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে গেলো। আকাশ তাকে বের হতে দেখে তার পিছন পিছন গেল। আরহা শান্তভাবে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিছু সময় পর আমিনা ও রিয়াশা এলো আরহার পাশে। রিয়াশা তো এসেই বিদ্রুপ করে বলল,”কি হলো? তোকে বলেছিলাম না, আমার ভাইয়াই ম্যাচটা জিতবে। আমার কথা মিলল তো? চল এখন এই উপলক্ষে আমি তোকে বিশেষ ট্রিট দেই।”
আমিনা বলে ওঠে,”তুমি ট্রিট দেবে কেন? যে জিতেছে তাকে ট্রিট দিতে হবে। তোমার ভাইয়াকে বলো, আমাদের ট্রিট দিতে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এমন সময় মাশরাফিও সেখানে চলে আসে। মাশরাফি এসেই আরহার দিকে তাকায়। আরহা বরাবরের মতোই শান্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ছিল তবে তার চোখে ছিল অন্য এক উদ্বেগ। মাশরাফিকে দেখেই আমিনা তার সামনে গিয়ে বলে,”এই যে মিস্টার চ্যাম্পিয়ন, আমাদের ট্রিট কোথায়? এত বড় জয় উপলক্ষে ট্রিট কি পাবো না?”
মাশরাফি স্বভাবচরিত গম্ভীর স্বরে বলে,”ট্রিট তো অবশ্যই পাবে সবাই।”
আমিনা খুশি হয়ে যায়। অতঃপর রিয়াশাকে বলে,”চলো, আমরা ঐদিকে যাই। শুনলাম ওখানে নাকি অনেক খাবারের স্টল বসেছে।”
“হ্যাঁ, আপু চলো। আরহা তুই যাবি আমাদের সাথে?”
আরহা বলে,”তোরা যা, আমি আসছি।”

রিয়াশা ও আমিনা একসাথে সেদিকে যায়। আরহাও যেতে নিচ্ছিল। মাশরাফিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় সে একপলক তার দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। মাশরাফি আচমকা বলে ওঠে,”সবাই তো আমাকে শুভেচ্ছা জানালো, তুমি জানাবে না?”
আরহা থেমে যায়। মাশরাফির দিকে তাকাতেই তাদের চোখাচোখি হয়। আরহা লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলে,”অভিনন্দন..”

বলে সে আবারো সামনের দিকে পা বাড়াতে নেবে এমন সময় মাশরাফি আবারো বলে ওঠে,”আমার জয় বুঝি তোমায় আনন্দ দেয় নি তাই না?”
আরহা বলে,”তেমনটা নয়। আমি শুধু ব্রো এর জন্য..”
মাশরাফি এবার সরাসরি আরহার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,”ব্যাপার না, খেলায় হারজিত তো লেগেই থাকে। আশা করছি, তোমার ব্রো খুব শীঘ্রই কোন একটি ম্যাচ জিতবে যা তোমার খুশির কারণ হবে।”

কথাটা বলেই সে আরহার দিকে তাকিয়ে সুন্দর হাসি দিয়ে তার পথ ছেড়ে দেয়। আরহাও আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। মাশরাফি আরহার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা যেন তার জীবনে এক অন্যরকম শান্তির কারণ। বয়সে নিজের থেকে অনেক ছোট এই মেয়েটার প্রতি সেই কিশোর বয়স থেকেই মাশরাফির মনে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু আজ অব্দি তাকে সেটা বলার সাহস হয় নি। যদিও মাশরাফির চোখের দিকে তাকালেই তার মনের ভাষা পড়া সম্ভব। তবে শান্তশিষ্ট, অন্তমুর্খী মেয়েটা কখনো হয়তো সেই ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। অথচ তার এই শান্ত আচরণগুলোও মাশরাফির বুকে উথাল-পাতাল ঢেউ সৃষ্টি করে প্রতি মুহুর্তে।

আরুশি ও আরহাম তাদের বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে ছিল। আরহাম বসে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল এবং আরুশি পুরো ঘরজুড়ে পায়চারি করে চলেছিল। আরুশিকে এভাবে পায়চারি করতে দেখে আরহাম বলে উঠলেন,”এত চিন্তা কেন করছ আরুশি? একটু শান্ত হয়ে বসো।”

আরুশি হতাশ স্বরে বলেন,”কিভাবে শান্ত হবো বলো তো? আমি তো তোমার মেয়ে আরহার মতো সবসময় সুপার কুল থাকার গুণ নিয়ে জন্ম নেই নি আর না তোমার ছেলের মতো অতিরিক্ত রাগ, জেদ নিয়ে জন্ম নিয়েছি।”
আরহাম সামান্য হেসে বলেন,”তুমি তো এমনভাবে বলছ যেন, ওরা শুধু আমারই ছেলে-মেয়ে। তোমার কেউ নয়।”
“আসলে মাঝে মাঝে আমার এটাই মনে হয় যে, ওরা কি আসলেই আমার সন্তান? নাকি হাসপাতালে অদল বদল হয়ে গেছিল। একজনের মাঝেও আমার কোন গুণাবলি নই। একজন প্রশান্ত মহাসাগরের মতো শান্ত আরেকজন যেন আগ্নেয়গিরির উত্তল লাভা৷ আজ তো আবার জাঈদের ক্রিকেট ম্যাচ আছে। যদি কোন কারণে ও হেরে যায় তাহলে যে কি লঙ্কাকাণ্ড বাধাবে সেটা ভেবেই আমার শান্তিতে থাকা হারাম হয়ে গেছে।”

আরহাম বলে ওঠেন,”খেলায় তো হারজিত থাকবেই৷ এটা নিয়ে এত চিন্তার কি আছে?”
“সেটা তোমার গুণধর ছেলেকে কে বোঝাবে?”
এরকম সময়েই হঠাৎ করে তীব্র বেগে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে আবার তীব্র বেগে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় জাঈদ। তাকে এত ক্ষিপ্তগতিতে আসতে দেখে আরুশি বা আরহাম কি বলার সুযোগও পেয়ে ওঠেন না। কিছু সময় পর আকাশ চলে এলে আরুশি তাকে থামিয়ে বলে,”কি হয়েছে আকাশ? জাঈদের আচরণ তো সুবিধার লাগছে না!”
আকাশ বলে ওঠেন,”জাঈদ ভাইয়া আজকে ম্যাচটা হেরে গেছে বড় আম্মু। তাই এত রেগে আছে।”
কথাটা শোনামাত্র আরুশি মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়ে বলেন,”হয়ে গেল। আজ আর ঘরের একটা জিনিসও আর আস্ত থাকবে না।”

কথাটা বলতে না বলতেই জাঈদের রুম থেকে ভাঙচুরের শব্দ ভেসে এলো। আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,”এসবের মানে কি? জাঈদ কি এখনো ছেলেমানুষ আছে নাকি? ওকে এসব থামাতে বলো আরুশি নাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”
“তুমি গিয়ে তোমার গুণধর পুত্রকে থামতে বলো। আমাকে এসবের মধ্যে টেনো না। প্রতিদিন চেম্বারে আসা মানসিক সমস্যায় জর্জরিত ব্যক্তিদের সামলাতেও আমার এত সমস্যা হয় না তোমার গুণধর পুত্রকে সামলাতে আমায় যত ধকল পোহাতে হয়।”

এমন সময় আমান সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,”ভাইয়া, আপাই, আকাশ তোমরা সবাই এখানে? এত শব্দ কিসের হচ্ছে? মনে হচ্ছে কোন কিছু ভাঙচুর চলছে।”
আকাশ তার বাবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”জাঈদ ভাইয়া আজ ক্রিকেট ম্যাচ হেরে গেছে তাও আবার মাশরাফি ভাইয়ার বিপক্ষে। এজন্যই এতো রেগে ভাঙচুর করছে।”
আমান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”এই ছেলে আর শোধরালো না। ভাগ্যিস, মম ড্যাড সিলেটে ঘুরতে গেছেন তাহলে এসব দেখে ওনাদের বিপি হাই হয়ে যেত।”

আরুশি বলে ওঠেন,”ওনারা তো বেঁচে গেছেন কিন্তু তোমার ভাইপোর কাণ্ড দেখে আমার বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে।”
এরকম সময় আমিনা ও আরহা বাড়িতে চলে আসে। তারা এসেই ড্রয়িংরুমে সবাইকে এভাবে আলোচনা করতে দেখে অবাক হয়। আমিনা এগিয়ে এসে বলে,”কি হয়েছে তোমরা সবাই কি নিয়ে আলোচনা করছ?”
আরুশি হতাশ স্বরে বলেন,”কি আবার হবে আমিনা? জাঈদ নিজের হার মেনে নিতে না পেরে এখন নিজের ঘরের আসবাবপত্রের উপর রাগ ঝাড়ছে!”
আরহা বলে ওঠে,”কি বলছ তুমি মাম্মা? ব্রো এখনো সেই আগের মতো পাগলামি করছে!”
আমিনা তো ওড়না কোমড়ে বেধে বলে ওঠে,”তোমরা চিন্তা করো না, এই বুনো ষাড়কে কিভাবে থামাতে হয় সেটা আমার ভালোই জানা আছে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।”
বলেই আমিনা সামনের দিকে যেতে নেয়। সায়রা তখনই সেখানে এসে বলেন,”আমিনা থামো, এখন জাঈদ রেগে আছে তুমি গিয়ে ওর রাগটা আর বাড়িও না।”

কিন্তু আমিনা কারো কথা শোনার মেয়ে নাকি? সে তো দ্রুত পা চালিয়ে জাঈদের রুমের সামনে যায়। জাঈদ তখনো ভেতরে ভাঙচুর করে চলছিল, তার দরজা লক করা ছিল। আর আমিনা দরজায় টোকা দিয়ে বলে,”এই বুনো ষাড়, তাণ্ডব করার হলো বনে গিয়ে করো। থামো বলছি এখনই।”
আমিনার গলার স্বর শুনে জাঈদ এক মুহুর্তের জন্য থেমে যায়। বুনো ষাড় বলায় তার রাগ বেড়ে যায় তাই সে বলে,”এই পাকা বুড়ি! তোমার এখানে কি? আমার মেজাজ এমনি ঠিক নেই। চলে যাও বলছি।”
“এই যে মিস্টার, যদি তোমার এতই ভাঙচুর করার শখ হয় তাহলে নিজের টাকায় জিনিস কিনে গিয়ে ভাঙচুর করো। আমার বড় আব্বুর কষ্টের রোজকারে তৈরি জিনিস কেন ভাঙছ? জিততে পারে না সামান্য একটা খেলায় আবার নাটক..”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫১

জাঈদ রেগে এবার দরজা খুলে রক্তিম চোখে আমিনার দিকে তাকায়। কিন্তু আমিনাও থোরাই ভয় পায়। সেও রাগী চোখে তাকিয়ে বলে,”যত টাকার জিনিস ভেঙেছ সব ভরপাই করে দাও। নাহলে আজ থেকে এই বাড়িতে থাকা, খাওয়া, ঘুমানো সব তোমার জন্য বন্ধ।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৫৩