অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭৩
ইয়াসমিন খন্দকার
আরহা আরুশির সাথে এই নতুন ফ্ল্যাটেই নিজের জীবনযুদ্ধ শুরু করল। সামনেই তার এইচএসসি পরীক্ষা। তাই চাপ অনেক। আরহাকে পুরোদমে পড়াশোনায় মনযোগ লিপ্ত করতে হলো। জীবনের সব পিছুটান ভুলে তার সব ধ্যানজ্ঞান এখন শুধু পড়াশোনায়। ভালো রেজাল্টের আশায় সে সম্পূর্ণ মনোযোগে পড়ল। আরুশি নিজের মেয়েকে যথাসম্ভব সামলালো। তার মনে কোন খারাপ চিন্তা আসতে দিত না। সবসময় আগলে আগলে রাখত। মাশরাফিও যথাসম্ভব খেয়াল রাখত। সাথে রিয়াশা তো রয়েছেই।
তাদের বাড়ি থেকেও জাঈদ, সায়রা ও তার দাদা-দাদি আরহার খোঁজ নিত। এতে করে আরহা অনেকটাই হাল্কা বোধ করল। এভাবেই সময় পেরিয়ে গেল। আরহার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হলো। সে অনেক মনযোগের সহিত সব পরীক্ষা দিল। দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষও হয়ে গেল৷ আরহার সব পরীক্ষা মোটামুটি ভালোই হয়েছিল৷ তাই সে অনেকটাই নিশ্চিন্ত। পরীক্ষার পরের দিনগুলো সে মাশরাফির সাথে মাঝে মাঝে ঘুরতে যেত, রাত জেগে অনেক কথা বলত। একইসাথে তখন থেকেই সে মেডিকেলের প্রিপারেশন নেয়াও শুরু করেছিল৷ কয়েক মাস পর, আরহার পরীক্ষার রেজাল্ট এলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে কিছুটা চিন্তিত ছিল৷ কিন্তু বরাবর ভালো ছাত্রী হওয়ায় তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসও তুঙ্গে ছিল৷ আর আরহার রেজাল্ট ভালো এলো৷ গোল্ডেন A+ পেয়েছে সে। আরহা ভীষণ খুশি হয়। আরুশি নিজের মেয়ের এই খুশি উদযাপন করে। সাথে মাশরাফিও। আরহা নিজের বাবা আরহামকে ফোন করে তার খুশির খবরটা দিতে চায়। কিন্তু আরহাম ফোন রিসিভই করে না। আরহা কষ্টে ডুবে যায়। আরুশি সেই সময় আরহাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,”যেই বাবা তোমার কথা ভাবে না তার কথাও তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি এখন পড়াশোনায় মন দাও। তোমার লড়াই কিন্তু এখনো শেষ হয়নি। তোমাকে একটা ভালো মেডিকেলে চান্স পেতে হবে। তবেই তোমার লড়াই পূর্ণতা পাবে।”
আরহা তার মায়ের কথায় কিছুটা শান্ত হলো। এরপর মনোনিবেশ করল পড়াশোনায়। কিছু মাস খুব ভালো ভাবেই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিল। এরমাঝে রাজীব হাসান নিশ্চিত ছিলেন যে আরহা মেডিকেলে চান্স পাবেই৷ তাই তো দেরি না করে রেজাল্ট পাবলিশের আগেই তিনি মাশরাফি ও আরহার বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে নিলেন৷ আগামী মাসের শুক্রবারই আরহা ও মাশরাফির বিয়ে।
আরহা ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বসেছিল নিজের রুমে। আজ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দেবে৷ মাশরাফি ধীর পায়ে আরহার পাশে এসে বসল। তার কাধে হাত রেখে বলল,”এত ভয় পাবার কিছু নেই। আমি নিশ্চিত ঢাকা মেডিকেলেই তোমার চান্স হবে।”
আরহা কিছুটা আশা পেল। একটু পরই রেজাল্ট ঘোষণা হলো। আরহা নিজের রেজাল্ট দেখতেও ভয় পাচ্ছিল। মাশরাফিই কম্পিউটারে আরহার রেজাল্ট চেক করে। আরহার বুক তখন কাপছিল৷ রেজাল্ট দেখেই মাশরাফি তাকায় আরহার দিকে। আরহার হৃদস্পন্দন বন্ধ হবার জোগাড়। সহসা মাশরাফি আরহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি জানতাম, তুমি পারবে। তুমি ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছ আরহা। আরহার চোখে খুশির অশ্রু।”
রিয়াশাও এই আনন্দের খবরে ছুটে এসে নিজের বান্ধবীকে অভিনন্দন জানায়। সে নিজেও এইচএসসিতে A+ পেয়েছিল এখন আপাতত সে ভার্সিটিতে এডমিশনের চিন্তাভাবনা করছে। আরহার সাফল্যে সে ভীষণ আনন্দিত। আরুশি ছুটে আসলে আরহা গিয়ে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে। আরুশি গর্বের সহিত বলেন,”আমি জানতাম, আমার মেয়ে সফল হবেই।”
রাজীব হাসান এসে বলেন,”আমি তো আগে থেকেই নিশ্চিত ছিলাম যে আরহা ঢাকা মেডিকেলে চান্স পাবেই। এজন্য মাশরাফি ও আরহার বিয়ের কার্ডও ছাপিয়ে রেখেছিলাম।”
মাশরাফি ও আরহা দুজনেই লাজুক হাসে। রাজীব হাসান বলেন,”অনেক মান অভিমান এর পালা হয়েছে। এবার মাশরাফি আরহা তোমরা দুজনে মিলে খান বাড়িতে যাও। আরহার পরিবারকে ছাড়া ওর বিয়ে কিভাবে হবে? তোমরা গিয়ে ওদের আমন্ত্রণ জানাও।”
আরুশি বলে ওঠেন,”এর কি প্রয়োজন রাজীব ভাই? ওরা শুধু শুধু আমার মেয়েটাকে আবার অপমান করবে, ওকে খারাপ কথা শোনাবে।”
“আহ, আরুশি। তুমি অভিমান করে আছ তাই এসব বলছ। কিন্তু আরহার কথাটা একবার ভাবো। ও এত সাফল্য পেল কিন্তু একা একা ওকে সব সেলিবেট করতে হলো। ওর পরিবার পাশে নেই। এখন ওর বিয়েতেও যদি কেউ না থাকে সেটা কেমন দেখায়? আর আজ ও এত বড় সাফল্য পেল ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেল এটার জন্য হলেও তো পরিবারের সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো উচিৎ। সাথে বিয়ের আনন্দ তো আছেই।”
মাশরাফিও বলে,”আব্বু একদম ঠিক বলেছে। আরহা ওর পুরো পরিবারকে ছাড়া নিজের বিয়েতে কিভাবে আনন্দ করবে? আমি জানি, ও মুখে না বললেও সবাইকে ভীষণ মিস করে। তাই আমরা গিয়ে পরিবারের সবাইকে আমন্ত্রণ করে আসব।”
আরুশি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”ঠিক আছে, তোমরা যা ভালো মনে করো৷ কিন্তু ওরা যদি এবার আমার মেয়েকে কোনভাবে অপমান করে তাহলে আমি ওদের সাথে চিরতরে সম্পর্ক ছিন্ন করব।”
জাঈদ খুশি হয়ে তার দাদি আফিফা খান ও চাচি সায়রা খানকে বলে,”দাদি, চাচি তোমাদের জন্য অনেক বড় সুখবর আছে। আমার সিস, আরহা ও ঢাকা মেডিকেল চান্স পেয়েছ।”
দুজনেই খুশি হয়। আফিফা খান বলেন,”আমি জানতাম ও পারবে। আমার পর আমার ফ্যামিলিতে কতদিন পর একজন নতুন ডাক্তার হলো আমি খুব খুশি।”
সায়রা আফসোস করে বলেন,”ইশ, আজ যদি আমান বেচে থাকত কত আনন্দ পেত। ওর তো ইচ্ছা ছিল নিজের ভাইজিকে ডাক্তার হিসেবে দেখবে। যদি সবকিছু ঠিক থাকত আমরা সবাই মিলে কত আনন্দ করতাম।”
এমন সময় আকাশ ভার্সিটি যাবার জন্য বের হচ্ছিল। সে এখন ঢাকা ভার্সিটিতে “আইন” নিয়ে পড়ছে। সে থেমে গিয়ে বলে,”কি ব্যাপার? সবাই এত খুশি কেন?”.
সায়রা বলেন,”খুশি হবো না? আরহা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে ”
“একটা খু*নির জন্য তোমাদের এত আনন্দ কেন বুঝি না।”
সায়রা রেগে বলেন,”এসব তুই কি বলছিস আকাশ? ও তোর বোন হয়। এভাবে বলিস না।”
“আমার একমাত্র বোন আমিনা আপু। আর কেউ না।”
বলেই সে বের হতে যাবে এমন সময় মাশরাফি ও আরহা বাড়িতে প্রবেশ করে। আকাশের কথা শুনে আরহার পা থমকে যায়। জাঈদ অবাক হয়ে বলে,”সিস..তুমি!”
মাশরাফি ব্যাপারটাকে সহজ করতে বলে,”আরহা নিজের সাফল্য আপনাদের সাথে উদযাপন করতে এখানে এসেছে। আর সামনে আমাদের বিয়ে সেটার আমন্ত্রণ জানাতেও।”
এমন সময় আমিনা সেখানে এসে হুংকার দিয়ে বলে,”এই মেয়েটার কিভাবে সাহস হলো এই বাড়িতে আসার? ও কিভাবে মনে করলো যে ওর মতো একটা খু*নির সাফল্য আমরা উদযাপন করব বা ওর বাড়িতে যাব?”
আমিনা এখন ৯ মাসের প্রেগন্যান্ট। কোন রকমে সে এলো হেলেদুলে। আরহা অস্ফুটস্বরে বলল,”আমিনা আপু..”
“চুপ..একদম চুপ। আমি তোমার কেউ না।”
জাঈদ বলে ওঠে,”আমার সিসের সাথে ভালো ভাবে কথা বলো আমিনা।”
“একজন খু*নির সাথে আমি ভালো ভাবে কথা বলতে পারবো না।”
এমন সময় আরহাম খান সেখানে এসে বলেন,”কি হয়েছে? কি নিয়ে এখানে এত ঝামেলা হচ্ছে?”
আরহাকে দেখেই তিনি থমকে যান। আমিনা এগিয়ে এসে বলে,”দেখো বড় আব্বু…এই খু*নিটা আবার এই বাড়িতে এসেছে। আর সবাই চাইছে ওর সাফল্য আমরা উদযাপন করি। আজ তুমি যা বলার বলে দাও। আমি আর আকাশ সবার চোখে খারাপ হয়ে গেছি। তুমি যদি বলো, আরহা এই বাড়িতে ফিরে আসুক। আর আমরা চলে যাই এই বাড়ি থেকে।”
আরহাম খান চোয়াল শক্ত করে বলেন,”আমার যা বলার আমি অনেক আগেই বলেছি, তবুও কেন এই মেয়ে নির্লজ্জের মতো এই বাড়িতে এসেছে?”
আরহা অস্ফুটস্বরে বলে,”পাপা!”
জাঈদ বলে,”এসব তুমি কি বলছ পাপা? আরহা আমার বোন, তোমার মেয়ে। ওর সাফল্য আমরা উদযাপন করবো না?”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৭২
“আমার কোন মেয়ে নেই। মরে গেছে ও আমার জন্য।”
আরহার চোখে জল। মাশরাফি এগিয়ে এসে বলে,”আমরা আমাদের বিয়ের জন্য আপনাদের দোয়া চাই। সেজন্যই..”
আরহাম খান বলেন,”দোয়া নই..এই মেয়ের জন্য আমার অভিশাপ রইল। ও জীবনেও সুখী হতে পারবে না, জীবনেও না।”