অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৭
ইয়াসমিন খন্দকার
আমিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে। এমন সময় আরুশি এসে আমিনার হাত ধরে ভরসার সুরে বললেন,”এখানে যা হচ্ছে ভালোর জন্যই হচ্ছে। দয়া করে রাগারাগি করো না।”
আমিনা বলে ওঠে,”কিন্তু ওনারা কারা আর এখানে কেনই বা এসেছেন? তুমি আমাকে ওনাদের সামনে সেজেই বা আসতে বললে কেন বড় আম্মু?”
এমন সময় সালমা চৌধুরী বলে ওঠেন,”এই কি তবে পাত্রী?”
আমিনা দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নেয়। অতঃপর অভিমানী দৃষ্টিতে আরুশির দিকে তাকায়। ব্যথিত স্বরে বলে,”এসবের মানে কি বড় আম্মু? আমি তোমাদের কাছে এতটাই বোঝা হয়ে উঠেছি যে আমাকে এভাবে তাড়াতে চাইছ।”
আরুশি কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু আমিনা তার কোন কথা না শুনেই সালমা চৌধুরী ও সাফোয়ান চৌধুরীর সামনে এসে হাতজোড় করে বলে,”আপনাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এখানে কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আপনারা হয়তো এখানে আমাকে দেখতে এসেছেন। কিন্তু এটা সম্ভব নয়, কারণ আমি একজন বিবাহিতা নারী।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কথাটা শুনেই সালমা চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন। হতবাক স্বরে বলেন,”মানে কি এসবের? আমাদের এটা আগে জানানো হয় নি কেন?”
আকাশ এগিয়ে এসে বলে,”আপু! কিসের বিবাহিত তুমি? বিগত ৬ বছরে তোমার স্বামী তোমার কোন খোঁজ নিয়েছে? তুমি বেঁচে আছ না মরে গেছ সেটাও তো জানতে চায়নি। তাহলে তুমি কেন মিছিমিছি সম্পর্কটা বয়ে নিয়ে যেতে চাইছ? কোন সম্পর্ক কি এভাবে একতরফাভাবে টিকে থাকে। জাঈদ ভাইয়ার মতো একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন, নির্দয় পুরুষের সাথে তোমাকে আমি আর মানতে পারব না।”
আমিনা আকাশের গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। আকাশ হতবাক স্বরে বলে,”তুমি আমায় মারলে আপু!”
“হ্যাঁ, মারলাম৷ তোর স্পর্ধা কিভাবে হয় জাঈদকে নিয়ে এমন কথা বলার? আর আমার লাইফের ডিশিসন কি এখন তুই নিবি? তোরা ছেলেরা কি বুঝিস সম্পর্কের মূল্য? একজন নারীই বোঝে সম্পর্ক কতোটা মজবুত। যেদিন আমি কবুল বলে জাঈদকে নিজের স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম সেদিন থেকে আমার মনে শুধু জাঈদেরই নাম লেখা। ওর স্থান আমি কখনোই কাউকে দেই নি আর না তো কখনো দেব।”
“এতকিছুর পরও তুমি এই কথা বলছ আপু?”
“বলছি৷ কারণ আজ যা হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী৷ আমার জন্য আমার বাবু হারিয়ে গেছে। এজন্যই জাঈদ আজ আমার থেকে এত দূরে চলে গেছে। যদি এমনটা না হতো তাহলে কি জাঈদ শুধু শুধু আমার থেকে দূরে যেত নাকি?”
সাফোয়ান চৌধুরী অবাক হয়ে আমিনার দিকে তাকায়৷ এই নারীর জীবনের কাহিনি সে জানে না। তবে এখন সে কিছুটা উপলব্ধি করতে পারছে কেন তখন ওনার চোখে কিসের কষ্ট ছিল৷ তাদের কথোপকথন শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে, এই নারীর জীবন কত কষ্টের। রোহন বলে উঠল,”আমিনা ম্যাম কি তাহলে চাচ্চুর বউ হবে না?”
সালমা চৌধুরী বলে ওঠেন,”আমি একটা বিবাহিত মেয়ের সাথে নিজের অবিয়াত্তা ছেলের বিয়ে দিতে চাই না। আমারই ভুল হয়েছে ঠিকভাবে খোঁজ না নিয়ে এখানে চলে আসা। সাফোয়ান, রোহন চলো এখান থেকে। আমি আর এক মুহুর্ত এখানে থাকতে চাই না।”
বলেই তিনি সামনে এগোতে থাকেন। আকাশ তাকে আটকানোর জন্য বলে,”দাঁড়ান..এভাবে যাবেন না।”
কিন্তু তিনি হুড়মুড় করে বেরিয়ে যান৷ সাফোয়ান কি মনে করে যেন আমিনার দিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে বলে,”এখানে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হলো তার জন্য আমি দুঃখিত। আমার মায়ের ব্যবহারে কষ্ট পাবেন না।”
আমিনা করুণ স্বরে বলল,”জীবনে এত কষ্ট সহ্য করেছি যে এখন এসব আমার আর গায়ে লাগে না। আমার মনে হয়, আমার মনে কষ্ট সহ্য করার ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গেছে। যাইহোক, আপনাদের কাছেও আমি ক্ষমাপ্রার্থী আমার ভাই আর বড় আম্মু যে এমন পরিস্থিতিতে ফেলবে তা ভাবতে পারিনি।”
সাফোয়ান আর কিছু না বলে চলে যায়।
আমিনা এবার আরুশির দিকে তাকিয়ে বলে,”আকাশ নাহয় ছোট বড় আম্মু কিন্তু তুমি কিভাবে পারলে এমনটা করতে? তুমি কি বোঝো না, আমি জাঈদের স্থান কখনো কাউকে দিতে পারব না। যদি পারতামই তাহলে ৬ বছর এভাবে কাটাতাম না৷ অনেক আগেই নতুন জীবন শুরু করতাম। তোমার থেকে আমার এটা আশা ছিল না বড় আম্মু। এভাবে আর কত কি সহ্য করব আমি? যদি আত্ম–হ**ত্যা হারাম না হতো তাহলে এতদিনে..”
“আমিনা!”
কেপে ওঠে আরুশির কন্ঠস্বর। আমিনা নিজের ঘরের দিকে দৌড় দেয়। আকাশ ও আরুশি তার ঘরের দিকে যেতে চাইলে সায়রা খান তাদের পথ আটকে বলে,”তোমাদের জন্য আমার মেয়ের আজ এই অবস্থা। কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে হঠকারী সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলে তোমরা? আমিনা শুধু জাঈদকে ভালোবাসে। আর ওর সাথে জাঈদের আবার একদিন পুনঃমিলন হবেই। ওরা একে অপরের জন্য তৈরি। তাই তোমরা দয়া করে, ভবিষ্যতে আর কখনো ওদের আলাদা করার চেষ্টা করো না।”
বলেই সায়রা খান চলে যান আমিনার রুমে। আকাশ আরুশির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”যে যাই বলুক বড় আম্মু, আমি নিজের আপুকে আর বেশিদিন এই লাইফ লিড করতে দেখতে পারব না। তুমি এবার নিজের গুণধর ছেলেকে দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা কর। মনের দিক থেকে তো ওদের সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ হয়েছে এবার খাতায় কমলেও শেষ হোক। তারপর আমার বোনের আর নতুন জীবন শুরু করার কোন বাঁধা থাকবে না।”
জাঈদের থেকে বিয়ের প্রস্তাব শুনে জমে গেল রিয়াশা। সে বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। জাঈদ বলে ওঠে,”এছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই রিয়াশা৷ আবরাজের সুস্থতার জন্য হলেও..”
রিয়াশা বলে ওঠে,”এটা কখনোই সম্ভব নয়। আমি আপনাকে সবসময় নিজের ভাইয়ের নজরে দেখেছি। আমি কখনোই আপনার সাথে এমন সম্পর্কে জড়াতে পারব না। আর সবথেকে বড় কথা, আপনি বিবাহিত। আমিনা আপু আপনার স্ত্রী। এমতাবস্থায় আপনি কোন আক্কেলে এসব বলছেন।”
“আমিনার সাথে আমার সম্পর্ক শুধু খাতায় কলমে টিকে আছে।”
“তাই? একবার নিজের মনকে প্রশ্ন করে দেখুন তো, আপনার মনে কি আমিনা আপুর প্রতি কোন অনুভূতি নেই?”
জাঈদ নিজের দুই চোখ বন্ধ করে। তার সামনে ভেসে ওঠে আমিনার সাথে কাটানো সুন্দর মুহুর্ত গুলো। জাঈদের দুই নেত্র জলে টইটুম্বুর হতে থাকে। সে বুঝতে পারে, মুখে যতোই অস্বীকার করুক তার মনে এখনো আমিনার জন্য অনুভূতি আছে। রিয়াশা বলে,”সম্পর্ক ভাঙা কাচের মতো ময়, ছেড়া দড়ির মতো যাকে চাইলেই নতুন করে বাঁধা যায়। কিন্তু চেষ্টা থাকতে হয়। আপনাদের এই বিয়ের সম্পর্ক কোন সাধারণ সম্পর্ক নয়। আমার মা বলতো, বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন। আমি চাই না, আপনি এই পবিত্র বন্ধনটা নষ্ট করুন৷ আমার মনে হয়, আপনার দেশে ফিরে আমিনা আপুর সাথে সব সম্পর্ক মিটিয়ে নেয়া উচিৎ। জীবনটাকে আরেকটা সুযোগ দেয়া উচিৎ। এমনটা হলে আবরাজও নিজের আসল মাকে নিজের কাছে পাবে। আপনি একবার ভেবে দেখুন, এটাই বেস্ট হবে।”
“কিন্তু..”
“কোন কিন্তু নয়। জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত থাকে। আপনাদের মাঝে অনেক মান-অভিমান আছে সেসব আপনারা চাইলে কথা বলে মেটাতে পারেন। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তিকে নিজেদের মাঝে জড়িয়ে নিজেদের জীবনটা আরো জটিল করা কোন সমাধান নয়। আমি আরহার ব্যাপারে আপনাদের খান পরিবারের বহু প্রজন্মের গল্প শুনেছি। আপনার পরদাদা আবরাজ থেকে শুরু করে আপনার দাদা নির্ঝর, আপনার বাবা আরহাম সবার বৈবাহিক জীবনে অনেক ঝামেলা ছিল।
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৬
সকলেরই অশ্রুজলে বোনা বিয়ের ইতিহাস ছিল। কিন্তু এতকিছুর পরেও তাদের সম্পর্ক কখনো ভেঙে যায়নি। এটাই আপনাদের পরিবারের ঐতিহ্য। আপনাদের পরিবারে কখনো কারো ডিভোর্স হয়নি। সম্পর্কের সুন্দর মূল্যায়ন, ভুল থেকে দ্বিতীয় সুযোগ এসব তো আপনাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আপনি এর ব্যত্যয় হতে দেবেন না প্লিজ। তাই আমার অনুরোধ থাকবে, সব ঝামেলা মিটিয়ে আবার নতুন করে সব শুরু করুন। এতেই সবার মঙ্গল হবে।”
বলেই রিয়া্শা উঠে যায়। জাঈদ তার বলা কথাগুলো ভাবতে থাকে।