অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৮
ইয়াসমিন খন্দকার
জাঈদ আবরাজকে কোলে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিল বেলকনিতে। সে তখনো রিয়াশার বলা কথাগুলো ভাবছিল। তার কোলে বসা আবরাজ তখন মগ্ন ছিল বাইরের আদ্র পরিবেশ দেখতে। হঠাৎ করে জাঈদের ফোন বেজে উঠল। জাঈদ অবাক হলো। এই সময় কে তাকে ফোন করল। জাঈদ ফোনটা বের করে আরো অবাক হলো৷ তার বাবা আরহাম খান তাকে ফোন করেছে। ছয় বছরে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার লোকটা কল দিল। এর আগে তাকে ফোন করেছিল যখন নির্ঝর খানের মৃত্যু হয়েছিল। তাকে অনুরোধ করেছিল দেশে ফিরতে কিন্তু জাঈদ ফেরেনি। সেই অভিমান থেকে আরহাম আর কখনো তাকে ফোন করেনি৷ আজ আবার এতগুলো দিন পর বাবার ফোন পেয়ে জাঈদ অবাক হলো। আবরাজকে বললো,”রাজ, তুমি যাও নিজের রুমে গিয়ে পড়তে বসো।”
আবরাজ বাধ্য ছেলের মতো উঠে চলে গেলো। জাঈদ ফোনটা রিসিভ করে বলে উঠল,”হ্যালো, পাপা। কেমন আছ তুমি? সবকিছু ঠিক আছে তো?”
আরহামের কন্ঠস্বর ক্ষীণ। আগের মতো শক্তি অবশিষ্ট নেই তার শরীরে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে সে। তবুও বহুকষ্টে বলল,”কিভাবে ভালো থাকব আমি জাঈদ? আমার পুরো পরিবারটা তছনছ হয়ে গেছে। নিজের ভুলে আমি নিজের মেয়ে আর স্ত্রীকে হারিয়েছে। আমার ছেলেও আমার থেকে দূরে। এভাবে কি ভালো থাকা যায়।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জাঈদ আর কিছু বলল না। সে নিজের জীবনকে যেভাবে মানিয়ে নিয়েছে সেভাবেই থাকতে চায় সে। অতীতের আবেগে আর গা ভাসাতে চায় না। এরমধ্যে আরহাম খান বলে উঠলেন,”বহুদিন থেকে আমার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। আকাশের অনেক জোরাজুরির পর ডাক্তার দেখালাম, আজ রিপোর্ট এসেছে আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত। লাস্ট স্টেজ চলছে…”
কথাটা বলতে গিয়ে আরহামের গলার স্বর ভেঙে এলো। জাঈদও হতবাক হয়ে গেল। আরহাম বলতে লাগলেন,”আজ জীবনের শেষ মুহুর্তে দাঁড়িয়ে তোমাকে আদেশ করার কোন শক্তি আমার নেই। তোমার মা-বোনের সাথে যোগাযোগ করার মুখও নেই। তাই তোমাকেই যা বলার বলছি, একবার দেশে ফিরে এসো। আমি মৃত্যুর আগে নিজের পরিবারটাকে আবার জোড়া দেখতে চাই। নাহলে যে মরেও শান্তি পাবো না।”
“পাপা!”
“এটাকেই নিজের পাপার শেষ ইচ্ছা ধরে নাও। এখন আসবে নাকি আসবে না সেটা সম্পূর্ণ তোমার ইচ্ছা। আমি তোমায় জোর করব না।”
বলেই আরহাম ফোনটা রেখে দিলেন। জাঈদের চোখে জল চলে এলো। এতদিন সে নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে নি কিন্তু আজ তার মন চাইছে আবারো ছুটে যেতে নিজের দেশে। নিজের বাবার শেষ ইচ্ছা সে ফেলতে পারবে না। আরহামের ভাবনার মাঝেই রিয়াশা সেখানে চলে এলো। রিয়াশাকে দেখেই জাঈদ বলে উঠলো,”আমি কি করবো রিয়াশা? আবার কি ফিরে যাব নিজের মাতৃভূমিতে।”
“এতকিছুর পরও যদি আপনার বিবেক না জাগ্রত হয় তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আপনি নিজের ছেলের কথা ভাবছেন তাহলে নিজের বাবাও কথাও ভাবুন। মানছি ঐ লোকটা অনেক ভুল করেছেন। কিন্তু তাই বলে কি শেষ দিনগুলো তাকে এত কষ্ট বুকে নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হবে? নিজের দাদার শেষ দিনগুলোতেও আপনি তার পাশে ছিলেন না। নিজের বাবার বেলায় অন্তত তা না করুন। আর তাছাড়া, আমিনা আপুর কথাও ভাবুন..”
জাঈদ বললো,”বেশ, আমি দেশে ফিরবো৷ তবে আমিনার সাথে সবকিছু ঠিক করার আগে আমি দেখতে চাই ও আমাকে ছাড়া, আমাদের ছেলেকে ছাড়া কেমন আছে। যদি ওকে দেখে মনে হয়, ও নিজের কাজের জন্য অনুতপ্ত তাহলে ওকে একটা সুযোগ দিতে পারি।”
রিয়াশা বলে,”বেশ, তাহলে আপনি একা ফিরুন। আমি রাজকে নিয়ে এখানে আছি।”
“রাজকে ছাড়া আমি একা দেশে যাবো না। আমি এক কাজ করি, ওখানে একটা হোটেল বুক করে রাখি তুমি রাজকে নিয়ে সেই হোটেলেই থেকো।”
“বেশ, আপনি যদি তাই চান তাই হবে। কিন্তু আমিও একটা কথা বলতে চাই, আপনি যে বলছেন আপনি আমিনা আপুকে ক্ষমা করতে পারলে তবেই তার সাথে প্যাচ আপের কথা ভাববেন। কিন্তু একবারও কি ভেবেছেন আমিনা আপু আপনাকে ক্ষমা করতে পারবে কি না? আপনি তার ছেলেকে ছয় বছর তার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। এরপর কি একজন মা হিসেবে সে আপনাকে ক্ষমা করবে?”
জাঈদ কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না প্রথমে। তবে তার ইগো তখনো কমে নি। তাই সে বলে,”আমার মনে হয় না, নিজের ছেলের জন্য ও খুব একটা কষ্টে আছে। আমার মা-বোনকে ও বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, আমাকেও রাজকে নিয়ে ওর জন্য বিদেশে আসতে হয়েছে। অথচ ও এখনো খান বাড়িতে থেকে সব ঐশ্বর্য ভোগ করছে। সবই তো আছে ওর কাছে৷ তাহলে ও কষ্টে থাকবে কেন? বরঞ্চ আমাদের থেকে হাজারগুণে সুখেই আছে।”
“এসব ঐশ্বর্য দিয়ে সুখ আসে না জাঈদ ভাই। একজন স্ত্রীর সুখ তার স্বামীর কাছে, একজন মায়ের সুখ তার সন্তানের কাছে। যেই নারী এতগুলো দিন নিজের স্বামী-সন্তানের থেকে বিছিন্ন আছে সে কি সত্যিই সুখে আছে? আমার তো আপনার সঙ্গ দেয়ার জন্য নিজেই মাঝে মাঝে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে হয়। আপনার কি তা হয় না?”
জাঈদ আর কিছু বলে না। সে এবার দেশে ফিরেই যা বলার বলবে। তখন তার কাছে সবটা পরিস্কার হবে।
আমিনা নিজের রুমে বসে আছে। একটু আগেই তার আকাশের সাথে কথা হলো। আকাশ তাকে জানিয়েছে, আরহাম খানের অসুস্থতার ব্যাপারে। আমিনা সব শুনে ভেঙে পড়েছে। এখনো কাউকে বিষয়টা জানায় নি। এরমধ্যে আরুশি খান এসে আমিনাকে বললো,”আমিনা, রাত তো অনেক হলো। খেতে এসো।”
আমিনা আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”বড় আম্মু, তুমি কি আর কখনো খান বাড়িতে ফিরবে না?”
আমিনার কথায় আরুশি হতবিহ্বল হলেন। বললেন,”হঠাৎ আজ এত বছর পর এই কথা উঠছে কেন?”
আমিনা এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়লো। আরুশিকে জড়িয়ে ধরে বলল,”আমার জন্যই তোমাদের সাজানো সংসার ভেঙে গেছে। তারই কর্মফল ভোগ করছি আমি। বড় আব্বুর উপর তো এতদিন অভিমান নিয়ে দূরে থাকলে তুমি। এখন কি তার শেষ সময়েও তার পাশে থাকবে না?”
আরুশি হতবাক স্বরে বললেন,”শেষ সময় মানে? এসব কি বলছ তুমি আমিনা?”
“বড় আব্বু ক্যান্সারে আক্রান্ত। লাস্ট স্টেজ চলছে। ডাক্তার বলেছেন, তার হাতে আর বেশি সময় নেই।”
আরুশি বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন আমিনার দিকে। তার পুরো দুনিয়া কেপে উঠল। আরহাম,,,তার স্বামী,,,,যেই লোকটা একসময় তাকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছিল তার হায়াত শেষ হয়ে আসছে। আরুশি আর স্থির থাকতে পারলেন না। আরহামের সাথে কাটানো সকল সুন্দর মুহুর্ত, সব সুন্দর স্মৃতি তার মনে পড়লো। লোকটা নানা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে জীবনে, বারবার আরুশিকে কষ্ট দিয়েছে।
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৮৭
তবুও তো ঐ লোকটা আরুশির স্বামী, তার সন্তানদের পিতা, আরুশির জীবনের একমাত্র ভালোবাসা। আরুশির দুচোখ অশ্রুসিক্ত হলো। হৃদয় ছিন্নভিন্ন হতে লাগল। তিনি বলে উঠলেন,”চলে যাবে…ঐ লোকটা এবার সব অভিমানের পারদ ঠেলে দূরে চলে যাবে৷ আজীবন আমায় কষ্ট দিয়ে গেল আর যেতে যেতেও আমায় কষ্টের সাগরে ডুবিয়ে বিদায় নেবে। কেন..আমার জীবনটা কেন এমন হলো আমিনা? কি পাপ করেছিলাম আমি। কেন বারবার আমার আপনজনদের হারাতে হয়।”