অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯২
ইয়াসমিন খন্দকার
আমিনা তার ছেলে আবরাজকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ জলে টইটুম্বুর। আমিনা বলে,”আমাকে একবার মা বলে ডাকো বাবু..তোমার থেকে মা ডাক শোনার জন্য যে আমি এতগুলো দিন চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় ছিলাম।”
আবরাজ জাঈদের দিকে তাকায়। জাঈদ তাকে ইশারা করে আমিনাকে মা ডাকতে। তখন আবরাজ বলে ওঠে,”মাম্মি!”
আমিনা কি প্রতিক্রিয়া দেবে আর বুঝতে পারে না৷ সে মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। আবরাজকে জড়িয়ে ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে। এদিকে আকাশ ক্ষিপ্তগতিতে জাঈদের দিকে এগিয়ে এসে বলে,”এরকমটা কিভাবে করতে পারলে তুমি জাঈদ ভাইয়া? তুমি জানো, আপু এই ৬ টা বছর কিভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে গেছে। তুমি যদি সত্যি তোমাদের ছেলেকে খুঁজে পেয়েছিলে তাহলে তাকে নিয়ে ফিরে এলে না কেন? কেন আমার বোনের লাইফটা এভাবে শেষ করে দিলে।”
আরুশি এগিয়ে আসেন৷ তিনিও জাঈদের গালে ঠাস করে থাপ্পড় বসিয়ে দেন। জাঈদ লজ্জায় মাথা নত করে নেয়। আরুশি বলে,”আর কত আমায় ছোট করবে তুমি? তোমায় জন্ম দিয়ে আমি কি এমন পাপ করেছিলাম যার জন্য আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরহাও নিজের ভাইকে তীব্র ভৎসনা করে বলে,”তোমার থেকে এমনটা আশা করিনি আমি ব্রো। তুমি আমিনা আপুর সাথে এত বড় অন্যায়টা কিভাবে করলে? আর রিয়ু তুই…তুই তো আমাদের সত্যটা জানাতে পারতি। তোর সাথে আমার কত কথা হতো। তবুও তুই কিছু বললি না।”
এমন সময় মাশরাফি সেখানে উপস্থিত হয়। সে এসেই রিয়াশার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারে। মাশরাফির সাথে মিসেস রুমিও ছিলেন। মাশরাফি বলে,”জাঈদ ভাই একা অন্যায় করে নি তার এই অন্যায়ে তুইও সঙ্গ দিয়েছিস রিয়াশা। এর জন্য তোকে আমরা কখনো ক্ষমা করব না।”
রিয়াশা অসহায় চোখে তাকায়। জাঈদ বলে,”রিয়াশার কোন দোষ নেই৷ আমিই ওকে ব্ল্যাকমেইল করে সবটা লুকিয়ে রাখতে বলেছিলাম। তোমরা প্লিজ ওর উপর রাগারাগি করো না। যা শাস্তি দেবার আমাকে দাও।”
আরুশি বলে ওঠেন,”হ্যাঁ, তোমাকে তো শাস্তি পেতেই হবে। তুমি যা করেছ তা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আজ থেকে তুমি আমাদের কারো কেউ নও। এত বছর যখন আমাদের থেকে আমাদের বাড়ির ছেলেকে আলাদা রেখেছ তখনই তোমার সাথে আমাদের সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে।”
“মাম্মা!”
“চুপ, আমাকে আর মাম্মা বলে ডাকবে না। এখনই বেরিয়ে যাও এখান থেকে। আমরা কেউ তোমার মুখ দেখতে চাই না।”
এমন সময় আফিফা খান বলে ওঠেন,”এত বছর পর, পরিবারটা আবার এক হলো তখন এসব ভুল বোঝাবুঝি বাড়িয়ে কি লাভ আরু? সব মিটিয়ে নে তোরা। আমি শেষ বয়সে এসে পরিবারকে একসাথে দেখতে চাই।”
এদিকে জাঈদ অপরাধবোধে ভেতর থেকে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছিল। সে বলে,”না, মাম্মা ঠিকই বলেছে। দোষী যখন আমি তখন শাস্তিও আমাকেই পেতে হবে। আমি চলে যাব সব ছেড়ে। আমাদের ছেলে রাজকে আমি আমিনার থেকে এত বছর আলাদা রেখে যে পাপ আমি করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমায় করতেই হবে। আমি আজ রাজকে আমিনার কোলে তুলে দিয়ে চলে যাব এই বাড়ি ছেড়ে। বাকি জীবনটা আমি একা কাটাবো। এটাই আমার শাস্তি।”
বলেই সে আবরাজের কাছে এসে তার কপালে চুমু খায়। আমিনা জাঈদের থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। জাঈদ আমিনার সামনে হাতজোড় করে ক্ষমা চায় অতঃপর আমিনার পায়ের কাছে বসে বলে,”পারলে আমায় ক্ষমা করো…”
বলেই সে আবরাজকে বলে,”তুমি নিজের মাম্মিকে সবসময় ফিরে পেতে চাইনে না রাজ? আজ আমি তোমাকে তোমার মাম্মির কাছে ফিরিয়ে দিলাম। এখন বাকি জীবনটা তুমি নিজের মাম্মির সাথে কাটাও।”
আবরাজ বলে ওঠে,”তুমি কোথায় যাবে পাপ্পা? আমি তো মাম্মি, পাপ্পা দুজনের সাথেই থাকতে চেয়েছি সবসময়।”
“আমি যে অনেক বড় ভুল করেছিলাম রাজ। তোমাকে আমি এতগুলো বছর তোমার মায়ের থেকে দূরে রেখেছিলাম। তার জন্য একটু শাস্তি তো আমি ডিজার্ভ করি।”
আবরাজ বলে ওঠে,”প্লিজ পাপ্পা..আমাকে ছেড়ে যেও না। আই নিড ইউ..”
“না, রাজ। ছেলেমানুষী করো না। তোমার এখন তোমার মায়ের সাথে থাকা দরকার। এতবছর আমার জন্য তুমি মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছ। এখন মা-ছেলে মিলে সেই সব অভাব পুষিয়ে নাও।”
বলেই জাঈদ বের হয়ে যেতে নেয়। আবরাজের চোখে জল৷ আমিনা সেটা দেখে বলে,”দাঁড়াও জাঈদ..”
জাঈদ দাঁড়িয়ে যায়। আমিনা জাঈদের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,”এতবছর তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ। কিন্তু আমার ছেলেকে কষ্ট দেয়ার কোন অধিকার তোমার নেই। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে, আমাদের ছেলের জন্য।”
আকাশ বলে ওঠে,”এসব তুমি কি বলছ আপু? জাঈদ ভাইয়া এত কিছু করার পরেও তুমি তাকে এখানে থাকতে বলছ। এত বছরের এত কষ্ট নিমেষেই ভুলে গেলে? তুমি কি ওকে ক্ষমা করতে চাইছ?”
আমিনা জাঈদের দিকে তাকিয়ে বলে,”ও আমার সাথে যা করেছে তাতে আমি মৃত্যুর আগে অব্দি ওকে ক্ষমা করতে পারবো না। কিন্তু তাই বলে ওর সাথে প্রতিশোধের নেশায় এখন আমি নিজের ছেলেকে কষ্ট পেতে দেব না।”
আরুশি কিছু বলতে যাবেন তখন আমিনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,”প্লিজ বড় আম্মু,,,অন্তত আমার বাবুর জন্য হলেও জাঈদকে এখানে থাকার অনুমতি দাও। আমার ছেলেটা ছোটবেলা থেকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমি চাই না, এখন আমাদের জেদ বা প্রতিশোধের নেশায় ও বাবার আদর থেকেও বঞ্চিত হোক। এতে ওর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
সায়রা খান বলে ওঠেন,”আমি আমিনার এই সিদ্ধান্তে ওর পাশে আছি। মানছি জাঈদ ভুল করেছে। কিন্তু এখন আমরা আবার সেই একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে পারি না। শাস্তি অন্যভাবেও দেয়া যায়। বারবার কেন শাস্তির নামে একজনকে পরিবার থেকে বিছিন্ন করতে হবে? প্রথমে আরহাকে, তারপর আমিনাকে..এভাবে আর কতদিন এই একই প্রতিশোধের গেইম চলবে? এবার এর ইতি ঘটুক। জাঈদ এই বাড়িতেই থাকবে।”
জাঈদ আমিনার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি আমাদের ছেলেকে এতবছর তোমার থেকে দূরে রাখলাম আর তুমি কিনা সুযোগ পেয়েও আমার থেকে আমার ছেলেকে দূরে যেতে দিচ্ছ না। তোমার এই কাজ যে আমার অপরাধবোধ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে আমিনা।”
আমিনা বলে,”আমি শুধু আমার ছেলের থেকে ওর বাবাকে আলাদা করতে চাই না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি। জীবনে যতদিন বেচে আছি ততদিন আমি শুধু তোমাকে ঘৃণাই করে যাবো।”
বলেই আমিনা তার ছেলে রাজকে কোলে তুলে নিয়ে রুমের দিকে যায়। আরুশিও বলে ওঠে,”আমার কাছেও তুমি নিজের অবস্থানটা হারিয়ে ফেলেছ জাঈদ। তুমি আর আমার ছেলে নও, শুধু আমিনার জন্য আমি তোমাকে এই বাড়িতে থাকতে দিচ্ছি। কিন্তু আমাদের কারো সাথে তোমার কোন সম্পর্ক থাকবে না। খবরদার আমাকে মাম্মা বলে ডাকবে না কিংবা আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবে না। তোমাকে দেখলেও আমার মাথাটা ঘৃণা আর রাগে ফেটে পড়ছে।”
বলে তিনিও চলে যান। সায়রা খানও বলেন,”আমার মেয়ের সাথে তুমি অনেক অন্যায় করেছ। আমি কোনদিনও তোমায় ক্ষমা করব না।”
আকাশও বলে,”আমার কাছে তুমি একসময় রোল মডেল ছিলে। কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে, তুমি যদি আমার বড় না হতে তাহলে তোমার গালে ঠাস করে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে শান্তি পেতাম।”
আরহাম ও আফিফা খান কিছু না বলে চুপচাপ চলে যান। আরহা বলে ওঠে,”আমিও তোমায় কখনো ক্ষমা করবো না ব্রো। আমার ব্রো এই দুনিয়ার সবথেকে জঘন্য মানুষ আজ থেকে আমার কাছে।”
বলেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মাশরাফি আরহাকে সামলায় আর রিয়াশাকে বলে,”আজ থেকে রিয়াশার সাথেও আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯১
রিয়াশা কান্নায় ভেঙে পড়ে। মিসেস রুমিসহ সবাই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। পাশে দাঁড়ানো সাফোয়ান রিয়াশার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে দুঃখবোধ করে। তার ভীষণ মায়া কাজ করে এই অচেনা মেয়েটার প্রতি। তাই তো নিজের পকেট থেকে টিস্যু বের করে রিয়াশার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
