অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯৩

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯৩
ইয়াসমিন খন্দকার

আমিনা আবরাজকে কোলে নিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে বসে আছে। একটু আগেই সে আবরাজকে খাইয়ে দিয়েছে। এখন আপাতত আবরাজের কাছে ওর কানাডার গল্পগুলো শুনছে৷ এসব শুনে আমিনা ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে আর ভাবছে এই কয় বছরে সে জীবনের কত গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করে ফেলেছে। আমিনার দুচোখে অশ্রু টলমল করছিল। সে আবরাজকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম ভাঙতেই আমিনা দেখে জাঈদ এসে তার পাশে বসে আছে। সাথে সাথেই আমিনা উঠে বসে। জাঈদ তাকে কিছু বলার চেষ্টা করতেই আমিনা উঠে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। জাঈদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবরাজের পাশে শুয়ে পড়ে বলে,”এটুকু শাস্তি যে আমায় ভোগ করতেই হবে৷ সবার এভাবেই আমাকে ইগ্নোর করা উচিৎ। আমি যে পাপ করেছি তার কাছে এটা কিছু না।”

দুপুরে খাবার টেবিলে সবাই এসে বসেছে। জাঈদ দূর থেকে দেখছে সবটা। সবার সাথে বসে খাবার অনুমতি তার নেই। একটু পরই আমিনা বাড়ির কাজের মহিলার হাতে খাবার তুলে দিয়ে বলে,”যান, এই খাবারটা রাজের বাবাকে গিয়ে দিয়ে আসুন।”
জাঈদ কথাটা শুনতে পায়। কষ্টের মাঝেও তার মনে কিছুটা আশা জেগে ওঠে। জাঈদ বলে,”আমি জানি আমিনা, তুমি আমার উপর রাগ করে আছ। কিন্তু তবুও যে তুমি আমার কথা ভাবছ এটাই আমার কাছে অনেক। ”
এরপর জাঈদ নিজের জন্য বরাদ্দ রুমে চলে যায়। খাবার শেষ করে নিচে আসতেই জাঈদ দেখে আরুশিকে ভীষণ চিন্তিত লাগছে। জাঈদ আরুশির কাছে গিয়ে বলে,”মাম্মা, তুমি কি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরহামের ওষুধ শেষ হয়ে গেছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে সেটা আনতে হবে। আরুশি জাঈদকে দেখে কোন কথাই বলে না। জাঈদ আরুশির হাতে ওষুধের প্রেসকিপশন দেখে বলে,”ও পাপার ওষুধ। ব্যাপার না, আমায় দাও আমি এনে দিচ্ছি।”
তখনই আকাশ চলে এসে প্রেসকিপশন নিয়ে বলে,”তুমি চিন্তা করো না বড় আম্মু। আমি ওষুধগুলো নিয়ে আসছি।”
বলেই আকাশ বেরিয়ে যায়। আরুশি জাঈদের দিকে না তাকিয়েই বলে,”আমরা বাইরের মানুষের থেকে কোন ফেভার নেই। আমাদের বাড়ির ছেলে আছে। তুমি এরপর থেকে আমাদের পার্সোনাল ব্যাপারে একদম নাক গলানোর চেষ্টা করবে না।”
জাঈদের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। আরুশি নিজের চোয়াল শক্ত করে চলে যায়। জাঈদ বলে,”কেউ বোধহয় কখনো আর আমার সাথে স্বাভাবিক হবে না।”

রিয়াশা অবস্থান করছে বাইরের একটি হোস্টেলে। তার মা-বাবা, ভাই কেউই তার কোন কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। সবাই যেন তার সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। একা বসে বসে চোখের জল ফেলছে রিয়াশা। এমন সময় তার কাছে আরহার ফোনকল আসে৷ রিয়াশা ফোনটা রিসিভ করে বলে,”আরহা..তুই ফোন করেছিস..”
আরহা বলে,”এত খুশি হবার কিছু নেই। মা বলছিল এই বাড়িতে তোর কিছু জিনিস আছে, সেসব নিয়ে যেতে।”
রিয়াশা ক্রন্দনরত স্বরে বলে,”আমি মানছি আমি অনেক বড় ভুল করেছি কিন্তু তাই বলে তোরা আমায় এভাবে পর করে দিবি।”

আরহা কিছু বলে না। এমন সময় মিসেস রুমি আরহার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলে,”শোন, তুই কোন ভুল করিস নি পাপ করেছিস। একটা বাচ্চাকে তার মায়ের থেকে আলাদা রাখা হচ্ছে এটা জেনেও তুই চুপ ছিলি। এখন তুইও বোঝ, আপনজনদের থেকে দূরে থাকতে কেমন অনুভূতি হয়।”
বলেই তিনি ফোনটা রেখে দেন। রিয়াশা নিশ্চুপ কাঁদতে থাকে। তার চোখের জলও যেন আজ আর বাধা মানতে প্রস্তুত নয়। রিয়াশা কিছুটা কেঁদে ভাবে,”নাহ, এভাবে থাকলে আমায় চলবে না। আমি যদি ভুল করে থাকি সেই ভুল আমায় শোধরাতেও হবে। আপাতত যাই বাইরে থেকে কিছু প্রয়োজনীয় খরচ করে আনি।”
বলেই রিয়াশা তৈরি হয়ে নেয় বাইরে যাওয়ার জন্য।

আকাশ ওষুধ নেয়ার জন্য ওষুধের দোকানে যাচ্ছিল। এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে সায়রা খান বলে ওঠেন,”কিরে আকাশ কোথায় রে তুই?”
“একটু ওষুধের দোকানে এসেছি আম্মু।”
“আচ্ছা, ওখানে যখন আছিস তাহলে একটা কাজ করে আমার কোমড়ের ব্যথার জন্যও ওষুধ আনিস।”
“ঠিক আছে।”
এরপরই সায়রা খান আফসোস করে বলেন,”যেই বয়সে বৌমার সেবা পাওয়া দরকার সেই বয়সে যদি না পাই তাহলে কোমড়ে ব্যথা তো হবেই।”

আকাশ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”এসব ছাড়া তোমার মুখে আর কোন কথা নেই আম্মু?”
“জানি, এখন তোর আর মায়ের কথা ভালো লাগবে না। আমার দিকটা একটু বোঝার চেষ্টা কর তুই। তোর বাবার মৃত্যুর পর এখন আমিই তোদের সব। তোর বোনের জীবনটা তো আমি গোছাতে পারছি না। কিন্তু..তোর জীবনটা আমি গোছাতে চাই। সেই সুযোগও তো তুই দিচ্ছিস না। আমি শুধু এটাই ভেবে পাই না,আমি চলে যাবার পর তোদের কি হবে। ”

“এত চিন্তা করো না আম্মু। আমরা সামলে নেব সব। এখন রাখি।”
বলেই কোনরকমে আকাশ ফোনটা রেখে দেয়। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আকাশের জীবনে প্রেম একবারই এসেছিল। আর সেটা হলো সেই মিম নামের মেয়েটা। মিমের বিয়ে হয়ে যাবার পর তার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই আকাশের। কিন্তু আকাশ আজ অব্দি মিমের কথা ভাবে। তার মনে হয়, তার জন্য মিম খুশি হতে পারে নি৷ তাই তারও খুশি হবার অধিকার নেই। এজন্য আজ অব্দি সে বিয়ে করেনি।
এসব ভাবতে ভাবতেই ওষুধের দোকানের সামনে আসে আকাশ। ওষুধটা নিয়ে দুই হাজার টাকা দেয়। তখন দোকানদার বলে,”ওষুধটার দাম তো ১৬২০, আমার কাছে খুচরো নেই।”
আকাশ ব্যস্ততায় ছিল। তাই বলে,”আচ্ছা, রেখে দিন। আমার কাছেও খুচরা নেই ”
এমন সময় হঠাৎ একটা নারী কণ্ঠ শোনা যায়,”কেন রেখে দেবে? আপনার টাকার প্রয়োজন নেই তাহলে রাস্তার গরীব বাচ্চাদের দান করুন তবুও এভাবে বড়লোকী দেখাবেন না।”

কন্ঠটা শুনেই আকাশ সেদিকে তাকায়। আর তাকাতেই অবাক হয়ে দেখে আনুমানিক ২০/২১ বছর বয়সী এক তরুণীকে। আকাশের এখন ২৮ বছর চলছে। তাই মেয়েটা তার থেকে অনেক জুনিয়র হবে। তবুও তার মুখে এমন কথা শুনে রাগ কিছুটা রাগী ভাব নিয়ে থাকে। মেয়েটা দোকানদারকে বলে,”আপনার কাছে ৫০০ টাকা আছে না?”
দোকানদার বলে,’হুম আছে।’
“তাহলে ঐ ৫০০ টাকা ওনাকে দিন। আর আপনি যে বাকি ১২০ টাকা পাবেন সেটা আমি দিচ্ছি।”
আকাশ বলে ওঠে,”এসবের দরকার নেই। আমি আপনাকে চিনি না, আপনার সাহায্য কেন নেব?”
মেয়েটি বলে ওঠে,”সাহায্য না, এটাকে ধার হিসেবে নিন। আপনার ফোন নম্বরটা আমায় দিন। আমি টাকা চেয়ে নেব।”

আকাশ বলে,”বাহ, বেশ ভালোই ধান্দা তো। হ্যান্ডসাম ছেলে দেখে এভাবেই সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন বুঝি নাম্বারের আশায়।”
মেয়েটা রেগে বলে,”ও হ্যালো, নিজেকে ভালো ভাবে আয়নায় দেখুন। যেই না তার চেহারা নাম রেখেছে পেয়ারা। জানেন আমি কে? মিম চৌধুরী। এত সস্তা মেয়ে আমি না।”
মিম নামটা শুনেই আকাশ থমকে যায়। এই নামের একটা মেয়ের জন্য তার জীবন এলোমেলো। আকাশ এবার ভালো করে মেয়েটির দিকে তাকায়। দেখতে অসম্ভব সুন্দরী এই মেয়েটি তার অচেনা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে। মেয়েটি নিজের নাম্বার লিখে আকাশের হাতে দিয়ে বলে,”এই নাম্বারে ১২০ টাকা পাঠিয়ে দেবেন৷ কোন এক্সট্রা কথা হবে না।”

রিয়াশা একা একা রাস্তা দিয়ে হাটছিল। এমন সময় কড়া রোদের তাপে সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নেয়। ঠিক সেই সময় এক পেশিবহুল হাত তাকে আগলে নেয়। রিয়াশা পিটপিট করে চোখ খুলে তাকিয়ে বলে,”আপনি?”
সাফোয়ান চৌধুরী বলে ওঠে,”আপনি ঠিক আছেন তো?”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৯২

রিয়াশা কিছু বলতে যাবে এমন সময় মিম চৌধুরী সেখানে এসে এই দৃশ্য দেখে দুচোখ ঢেকে বলে,”ওহ ভাইয়া,,,ক্যারি ওন৷ আমি কিন্তু কিছু দেখিনি। তোমাকে লজ্জা পেতে হবে না।”
সাফোয়ান সাথে সাথে রিয়াশা সোজা করে দাঁড় করিয়ে নিজের বোন মিমের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তুই ভুল ভাবছিস।।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ শেষ পর্ব