অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৩
ইয়াসমিন খন্দকার
সন্ধ্যা আরিশার সাথে কথাই বলছিল এমন সময় সায়ন সেখানে চলে আসে। সায়ন এসেই অপলক দৃষ্টিতে আরিশার দিকে তাকায়৷ সায়নকে আসতে দেখেই সন্ধ্যা তড়িঘড়ি করে আদৃতার ছবিটা সরিয়ে ফেলে। সায়ন ব্যাপারটা স্বাভাবিক করতে সন্ধ্যাকে প্রশ্ন করে,”কি নিয়ে কথা হচ্ছিল?”
সন্ধ্যা বলে ওঠে,”তেমন বিশেষ কিছু না। আচ্ছা, ভাইয়া তুমি না আমার হাতের রান্না খেতে চেয়েছিল। আজ আমি তোমার জন্য অনেক স্পেশাল কিছু বানিয়েছি। চলো তো খেয়ে দেখবে কেমন লাগে।”
“আচ্ছা, চল।”
সন্ধ্যা এভাবে ব্যাপারটাকে এড়িয়ে সায়নকে নিয়ে খেতে চলে যায়। এদিকে আরিশা বসে বসে ভাবতে থাকে,”যদি মিস্টার সায়নের সাথে আদৃতা আপুর বিয়ে হয় তাহলে কি এতদিন পর আমায় আবার ও-বাড়ির লোকদের মুখোমুখি হতে হবে?”
ব্যাপারটা ভেবেই আরিশার অস্বস্তি বোধ হতে থাকে। আবারো ঐ বাড়ির লোকদের মুখোমুখি হলে ব্যাপারটা কিভাবে মোকাবিলা করবে সে? এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায় না আরিশা।
সায়নরা সপরিবারে রওনা দিলো খান ভিলার উদ্দ্যেশ্যে। সাজিদ চৌধুরীর বন্ধু আবরাজ খান তাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে এটা জেনেই সায়ন মূলত রওনা দিলো৷ তবে সাজিদ খান ভিলায় পা রাখতেই বুঝতে পারে এটা কোন সাধারণ দাওয়াত নয়। আবরাজ খান ও তার স্ত্রী নিঝুম খান তাদের একটু বেশিই খাতিরদারি করছিল। সায়নকেও কেমন জানি জামাই-আদর করার মতো আচরণ করছিল৷ সায়ন খেয়াল করে আদৃতাও বারবার তার দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল যা তাকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। নিজের বোনের বান্ধবী হিসেবে সে সবসময় আদৃতাকে বোনের নজরেই দেখেছে এবং সেই অনুযায়ীই স্নেহ করেছে। তবে আদৃতার দৃষ্টিতে এখন সে অন্যকিছু দেখতে পারছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবার মাঝে ছবি বেগম, আবির খান, আনিকা খান, নির্ঝরও উপস্থিত আছে। সন্ধ্যা নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। একসময় তো এই লোকটাকে ভীষণ ভালোবাসত সে। কিন্তু ভাগ্যে বোধহয় ছিল না। তাই তো আজ উনি অন্য কারো স্বামী। সন্ধ্যার খুব ইচ্ছা করছিল নির্ঝরের স্ত্রীর মুখোমুখি হতে। নিজের চোখে সেই ভাগ্যবতী মেয়েটিকে দেখতে। তাই তো সে প্রশ্ন করে বসে,”আচ্ছা, নির্ঝর ভাইয়া, আপনার স্ত্রী কোথায়? তাকে তো কোথাও দেখছি না?”
নির্ঝর কিছু বলার আগে আদৃতা বলে,”কি আর বলবো বল, আমার ভাবি যা ব্যস্ত মানুষ। সারাটা দিন তো মেডিকেল কলেজেই কাটিয়ে দেয়। ওখানেই আছে।”
আবরাজ খান খানিক রেগে নিজের মেয়েকে বলেন,”এভাবে বলছ কেন আদৃতা? আফিফা তো মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করতেই গেছে। এমনি এমনি ঘুরতে তো যায় নি।”
ছবি বেগম বিরক্তির স্বরে বলেন,”এখন বাদ দাও তো এসব কথা, আসল কথায় আসো। যার জন্য আজ আমরা সবাই এখানে একত্রিত হয়েছি।”
সাজিদ চৌধুরীও বলে ওঠেন,”হ্যাঁ, খালাম্মা আপনি ঠিকই বলেছেন।”
ইভা চৌধুরী গিয়ে আদৃতার পাশে বসেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”আপনাদের এই মেয়েকে আমি আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে চাই। সেই জন্যই তো আজ আমাদের এখানে আসা।”
এই কথাটা শুনে উপস্থিত সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলেও সায়নের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তার চোখ মুখে যেন আঁধার নেমে আসে। অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে যায় সায়ন।
সন্ধ্যাও বলে ওঠে,”হুম, আমার প্রিয় বান্ধবীকে এবার আমার ভাবি করে ঘরে তোলার পালা।”
আবরাজ খান খুশি হয়ে বলেন,”আমার সাথে মিস্টার সাজিদ চৌধুরীর অনেক দিন থেকেই ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে তবে তার থেকেও বেশি আমরা একে অপরের বন্ধু৷ এখন এই বিয়েটার মাধ্যমে এই সম্পর্কটাকে আরো গাঢ় করাই আমাদের উদ্দ্যেশ্য।”
সায়ন এসব শুনে ভীষণই অস্বস্তি বোধ করছিল। সে তো তার মন দিয়ে ফেলেছে আরিশাকে। তাহলে এখন কিভাবে সে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারে? সায়ন লন্ডনে বড় হয়েছে৷ তাই সে ব্যক্তিস্বাধীনতায় অনেক বিশ্বাসী এবং নিজের মনের কথা লুকিয়ে রাখারও ছেলে নয়। তাই তো সায়ন আর অপেক্ষা না করে স্পষ্ট করে বলে দেয়,”মাফ করবেন আমায়, তবে আপনাদের উদ্দ্যেশ্যে আমি একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই। আমার পক্ষে এই আদৃতাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। কারণ আমি ওকে সবসময় নিজের বোনের নজরেই দেখেছি। আর সবথেকে বড় কথা আমি অন্য একটি মেয়েকে পছন্দ করি।”
সায়নের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হতবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। সবার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সাজিদ চৌধুরী বলে ওঠেন,”এসব কি বলছ তুমি সায়ন?”
সায়ন বলে,”হ্যাঁ, আমি ঠিকই বলছি।”
আবরাজ খান, আবির খান, নিঝুম, ছবি বেগম, নির্ঝর সবার মুখে বিরক্তি এবং ক্রোধ প্রকাশ পায়। এদিকে আদৃতার চোখে জল টলমল করতে থাকে। আদৃতা বলে ওঠে,”এটা তুমি কি বলছ সায়ন ব্রো? তুমি আমায় পছন্দ করো না।”
“ব্যাপারটা এমন নয় আদৃতা। আমি তোমায় পছন্দ করি কিন্তু তোমায় বিয়ে করতে পারব না। কারণ আমি তোমায় বোনের নজরেই দেখি এবং সেই হিসেবেই পছন্দ করি।”
আবরাজ খান রেগে সাজিদ চৌধুরীকে বলেন,”এসবের মানে কি মিস্টার চৌধুরী? আপনি তো আমায় বলেছিলেন সায়নের মত আছে এই বিয়েতে তাহলে ও এসব কথা কেন বলছে?”
সাজিদ চৌধুরী এবার রাগী চোখে সন্ধ্যার দিকে তাকিয়ে বলেন,”তুমি তো বলেছিলে তোমার ভাইয়া নাকি তোমায় বলেছে তার আদৃতাকে পছন্দ।”
সন্ধ্যা বলে,”ভাইয়া তো আমায় সেদিন বলেছিল তার যেই মেয়েকে পছন্দ তার নামের প্রথম অক্ষর “আ” এবং যেসব বৈশিষ্ট্য বলেছিল তাও তো আদৃতার সাথে মিলে গেছিল।”
সায়ন বলে,”আমি সেদিন তোকে আদৃতার কথা বলি নি। বলেছিলাম, খালার বাড়িতে আশ্রিতা মেয়েটার কথা। ”
সন্ধ্যা চরম পর্যায়ের হতবাক হয়ে যায়। আদৃতা এবার কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমের দিকে দৌড় দেয়। নির্ঝর এগিয়ে এসে সায়নের কলার চেপে ধরে বলে,”হাউ ডেয়ার ইউ? তোমার সাহস কি করে হলো আমার বোনকে এভাবে কাঁদানোর? ভালোয় ভালোয় বলছি এক্ষুনি বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে।”
সন্ধ্যা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”নির্ঝর ভাইয়া, রেগে যাবেন না। এখানে ভাইয়ার কোন দোষ নেই। দোষটা আমার। আমি গিয়ে আদৃতাকে সামলাচ্ছি।”
বলেই সে আদৃতার রুমের দিকে যায়। এদিকে ইভা চৌধুরী বলে ওঠেন,”তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে সায়ন? তুমি কিনা শেষমেষ একটা আশ্রিতা মেয়েকে পছন্দ করলে। তাও আবার একটা বিবাহিত মেয়েকে যাকে কিনা তার স্বামী ত্যাগ করেছে৷ তুমি ভাবলে কি করে এমন মেয়েকে আমরা মেনে নেবো?”
সাজিদ চৌধুরীও রাগী স্বরে বলেন,”তোমাকে আমরা স্বাধীনতা দিয়ে বড় করেছি তার মানে এই নয় তোমার সব আবদার মেনে নেবো। ঐ মেয়েকে আমরা কিছুতেই তোমার জন্য মেনে নেবো না। ভালো এটাই হয় যদি তুমি আদৃতাকে বিয়ে করে নাও।”
সায়ন উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমি একজন এডাল্ট, ড্যাড, তাই তোমরা কোন কিছু আমার উপর এভাবে চাপিয়ে দিতে পারো না। আমি যখন বলেছি, আমি আদৃতাকে বিয়ে করবো না তখন আমি করব না। আমি আমার পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করব।”
বলেই সায়ন ধুপধাপ পা ফেলে খান ভিলা থেকে বেরিয়ে যায়। সাজিদ চৌধুরী ও ইভা চৌধুরীও আর কোন উপায়ন্তর না দেখে খান বাড়ির সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে বেরিয়ে যান।
এদিকে সন্ধ্যা আদৃতাকে সামলানোর চেষ্টা করছিল। আদৃতা কান্না করতে করতে বলে,”আমার মধ্যে কি এমন কমতি আছে যে তোর ভাই আমাকে পছন্দ করলো না।”
“তোর মধ্যে কোন কমতি নেই আদৃতা৷ কিন্তু..যাইহোক দোষটা আমারই। আমি তোর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।”
আদৃতা চোখের জল মুছে বলে,”না, আমি নিজের চোখে ঐ মেয়েটাকে দেখব যাকে তোর ভাই পছন্দ করেছে। যাতে আমি নিজের কমতিটা বুঝতে পারি। তুই আমাকে দয়া করে নিয়ে চল ঐ মেয়েটার কাছে।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২২
“পাগলামী বন্ধ কর আদৃতা।”
“না, তুই আমাকে নিয়ে চল এখনই। আমি ঐ মেয়েকে দেখতে চাই।”
অগত্যা সন্ধ্যা রাজি হয়ে যায়।