অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৬

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৬
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশাকে সাথে নিয়ে খান ভিলায় এসে উপস্থিত হয় আফিফা। আরিশা তখনো খান ভিলায় প্রবেশ করার সাহস পায় না। হতাশ স্বরে আফিফাকে বলে,”আমার খুব ভয় করছে আপ্পি৷ না জানি আমায় দেখে সবাই কেমন রিয়্যাক্ট করবে। বিশেষ করে দাদি। উনি তো আমাকে এখন সহ্যই করতে পারেন না।”
আফিফা আরিশাকে ভরসা দিয়ে বলে,”তুই এতো চিন্তা করিস না৷ আমি আছি তো, আমি সব সামলে নেব।”
বলেই আফিফা আরিশাকে নিয়ে এসে বাড়িএ সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজায়। কিছু সময় পর আনিকা খান এসে দরজা খুলে দেয়৷ তাকে দেখেই আফিফা বলে ওঠে,”আম্মু, তোমার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। আরিশাকে আমি নিয়ে এসেছি।”

আনিকা খান কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ছবি বেগম এসে বলেন,”কোন সাহসে তুই এই মেয়েকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছ আফিফা দিদিভাই? তুমি কি ভুলে গেছ, এই মেয়েটার জন্য আমাদের কতোটা হেনস্থার স্বীকার হতে হয়েছিল?”
আফিফা বলে,”আরিশার সাথে অনেক অন্যায় হয়েছে দাদি। তুমি আগে সব কথা শোনো, তারপর কোন সিদ্ধান্ত নিও।”
এমন সময় আদৃতা সেখানে উপস্থিত হয়ে বলে,”আর তোমরা দুই বোন মিলে আমার সাথে যে অন্যায় করেছ, তার কি হবে?”
আদৃতার চোখে জল৷ তার সাথে তার মা-বাবা আবরাজ খান, নিঝুম ও ভাই নির্ঝরও এসে উপস্থিত হয়। আদৃতা সবার সামনে বলে,”এই আরিশাই সেই মেয়ে যার কারণে সায়ন আমায় প্রত্যাখ্যান করেছে। ওর জন্য আমার বিয়েটা ভেঙে গেছে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আফিফা বলে ওঠে,”তুমি আমার বোনুকে এভাবে দোষারোপ করতে পারো না। আমার বোনুর উপর আমার বিশ্বাস আছে, ও কখনোই এমন কাজ করবে না।”
নির্ঝর এবার খানিক রাগী কন্ঠে বলে,”তার মানে তুমি কি বলতে চাইছ? আমার বোন মিথ্যা বলছে?”
“নির্ঝর, তুমি অনন্ত আমায় বোঝার চেষ্টা করো। আরিশার সাথে কি কি হয়েছে সেটা সবার জানা দরকার। আরিশা মোটেই স্বেচ্ছায় ঐ জাঈদকে বিয়ে করে নি। ঐ জাঈদ শেখ বন্দুকের মুখে ভয় দেখিয়ে আরিশাকে বিয়ে করে। আর পরবর্তীতে আরিশা আমার আর তোমার নিরাপত্তা দেয়ার জন্য ওর সব কথা মুখ বুজে সহ্য করেছে। আমাদের জন্যই আজ ও এতো দূর্দশার মধ্যে পড়েছে।”
আনিকা খান বলে ওঠেন,”এসব তুই কি বলছিস আফিফা? আরিশা আমাদের কথা ভেবে এত কষ্ট করেছে?”
আবির খানও ততক্ষণে হুইল চেয়ারে করে সেখানে উপস্থিত হন। তিনি এসেই বলেন,”আমি জানতাম, আমার আরিশা কখনো আমাদের কষ্ট দিতে পারে না। আমি তো তোমাদের আগেই বলেছিলাম। কিন্তু তোমরা কেউ আমার কথা শোনো নি।”

আদৃতা রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,”নাটক! নাটক! এ সমস্ত কিছুই এই মেয়েটার নাটক। আমি তো বুঝতে পারছি না, তোমরা এই মেয়েটাকে এখনো সহ্য করছ কেন? না ওর এই বাড়ির কারো সাথে কোন রক্তের সম্পর্ক আছে আর না তো অন্যকিছু। তাহলে কেন? কেন ওকে নিয়ে এত মাতামাতি করতে হবে।”
ছবি বেগমও আদৃতার সুরে সুর মিলিয়ে বলেন,”আমিও আদৃতা দিদিভাইয়ের সাথে একমত। এই মেয়েটাকে আমি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করি না। এসব কিছুই এর নাটক। ওকে কোনমতেই আমি এই বাড়িতে প্রবেশ করতে দেব না।”
আফিফা দৃঢ় কন্ঠে সকলের বিরোধিতা করে বলে,”আরিশা, এই বাড়িতেই থাকবে। কারণ ও আমার বোন। ওর এই বাড়িতে ঠিক ততোটাই অধিকার আছে যতটা অধিকার আমার কিংবা আদৃতার।”
নির্ঝর এবার এগিয়ে গিয়ে আফিফাকে বলে,”ব্যস, এতদিন ধরে তোমার অনেক অন্যায় আবদার আমি মেনে নিয়েছি। বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছি, তুমি আমাদের সম্পর্কের থেকে তোমার বোনকে বেশি মূল্যায়ন করছ, তবে আর না। এবার তোমাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিতে হবে তুমি কি চাও!”

আফিফা হতবাক স্বরে বলে,”মানে?! এসব তুমি কি বলছ?”
“তোমার তথাকথিত বোন আরিশার জন্য আমার বোন আদৃতা কষ্ট পেয়েছে, ওর চোখ থেকে জল পড়েছে। এটা আমি মেনে নেবো না। তোমার কাছে এখন দুটো রাস্তা খোলা আছে, হয় তুমি আমায় বেছে নাও আর নয়তো আরিশাকে। এখন তুমি ভেবে দেখো, তুমি কি করবে!”
“নির্ঝর!”
আবরাজ খানও বলে ওঠেন,”এই আরিশার জন্য আমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে। ওর সাথে আমরা কিছুতেই এক ছাদের তলায় থাকব না।”
তবে নিঝুম বলেন,”আমাদের মনে হয়, এভাবে রাগের মাথায় কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়। আফিফার কথাটাও আমাদের শোনা উচিত।”

ছবি বেগম নাখোশ স্বরে বলেন,”তুমি চুপ করো নিঝুম। বরাবরই তুমি একটু বেশিই বোঝো। নিজের মেয়ের থেকে তোমার এই বাইরের মেয়েটার জন্য চিন্তা হচ্ছে?”
আফিফা নির্ঝরের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। যেই মানুষটাকে সে এতোটা ভালোবাসত আজ সেই কিনা তাকে এমন কথা শোনাচ্ছে! আফিফার দুচোখ অশ্রুতে ভড়ে ওঠে। তবে সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগেই আফিফা সেটা মুছে নিয়ে আরিশার হাত শক্ত করে ধরে বলে,”তোমাদের দুজনের মধ্যে যেকোন এক জনকে বেছে নিতে হবে, তাই তো? বেশ, আমি আমার বোনকেই বেছে নিলাম।”
আরিশা উৎকন্ঠার সাথে বলে ওঠে,”আপ্পি! এসব তুমি কি বলছ?”

“আমি যা বলছি ঠিকই বলছি। আমার যেই বোন আমার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছে তাকে বিপদের দিনে আমি একা ছেড়ে দিতে পারব না। আপনারা কেউ আরিশাকে এই বাড়িতে থাকতে দেবেন না, তাই তো? বেশ আমি আরিশাকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি। ওর সাথে আপনাদের কারো রক্তের সম্পর্ক না থাকতে পারে কিন্তু আমি ওকে নিজের বোন বলেই মানি। তাই ওকে রক্ষা করার দায়িত্বও আমি নেবো। ”
ছবি বেগম বলে ওঠেন,”তোমার মাথা কি একদম খারাপ হয়ে গেছে দিদিভাই? এই বাইরের মেয়েটার জন্য তুমি তোমার বাড়ি ছেড়ে দেবে?”

এমন সময় আবির খান হুইল চেয়ারে করে আফিফা ও আরিশার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,”আরিশা বাইরের মেয়ে নয় আম্মু, ও আমার মেয়ে। হয়তো আমি ওকে জন্ম দেইনি কিন্তু ওকে আমি নিজের মেয়েই ভাবি। তোমরা যদি ওকে এই বাড়িতে ঠাঁই না দাও, তাহলে আমারও এখান থাকার কোন ইচ্ছা নেই। প্রয়োজনে আমি আমার দুই মেয়েকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাব।”
ছবি বেগম হতবাক স্বরে বলেন,”আবির!”
আনিকা খানও সমস্ত দ্বিধা-দ্বন্দ ভুলে আবির খানের পাশে দাঁড়ান।
ছবি বেগম হতাশ স্বরে বলেন,”বৌমা! তুমিও?!”

আনিকা খান বলেন,”এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকে আমি কখনো আপনার অবাধ্য হইনি আম্মা, আপনি চেয়েছিলেন বলে, আরিশাকে এর আগে যখন জাঈদ নিজের সাথে নিয়ে গিয়েছিল তখন আমি বাধা দেই নি। আরিশাকে আমি আফিফার মতো ভালোবাসা দেই নি, সেটাও ছিল আপনার ইচ্ছাতে। তবে আজ আমি নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে চাই, আমার স্বামী, আমার দুই মেয়ের পাশে থাকতে চাই আমি।”
আবরাজ খান বলে ওঠেন,”এসব হচ্ছেটা কি? তোরা সবাই এভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি কেন? তার থেকে ভালো, আমিই আমার পরিবারকে নিয়ে লন্ডনে চলে যাচ্ছি। তোরা থাক এখানে।”
ছবি বেগম বলে ওঠেন,”না, আবরাজ। তুমি এখানেই থাকবে। তোমার ছোটবেলায় আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি তার পুনরাবৃত্তি আমি হতে দেবো না। ওদের যখন একটা বাইরের মেয়ের প্রতি এতোই টান তাহলে ওদেরকেই যেতে দাও।”

নির্ঝর আফিফার কাছে গিয়ে বলে,”মনে রেখো, এই বাড়ির বাইরে পা রাখা মানেই তোমার সাথে আমার সম্পর্ক সেখানেই শেষ হয়ে যাবে।”
আফিফা মলিন হেসে বলে,”এতো ঠুনকো সম্পর্ক আমি রাখতেও চাই না, যেই সম্পর্কে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান নেই।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৫

বলেই সে আরিশার হাত শক্ত করে ধরে বেরিয়ে যায়। তার সাথে সাথে আবির খান ও আনিকা খানও বেরিয়ে যান। নিঝুম বলে ওঠেন,”এটা ঠিক হলো না। নির্ঝর, আবরাজ, চাচি আপনার চুপ থাকবেন না। ওদেরকে আটকান। এভাবে পরিবারকে ভাঙতে দেবেন না।”
আদৃতা এসব দেখে স্বস্তি পেয়ে বলে,”বেশ হয়েছে। আমার জীবন নষ্ট করতে চাইছিল না, এখন ওদের দুই বোনকেই বাড়িছাড়া হতে হলো।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২৭