অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩
ইয়াসমিন খন্দকার

নির্ঝর রক্তিম চোখে তাকিয়ে ছিল জাঈদের দিকে। তার দুচোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। এদিকে জাঈদ রাস্তায় পড়ে পেটে হাত চেপে লুটোপুটি খাচ্ছে। নির্ঝর আরিশা ও আফিফার দিকে ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,”যাও, গাড়িতে উঠে বসো।”
আফিফা ও আরিশা চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে। এদিকে জাঈদের কিছু বন্ধু তাকে টেনে তোলে। জাঈদ নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে রাগী স্বরে বলে,”কে তুই? তোর এত বড় সাহস যে তুই আমায় লাথি মারলি। জানিস আমি কে?”
নির্ঝর নিজের শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,”হবি কোন বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া ছেলে। হু কেয়ারস? আমাদের বাড়ির মেয়েদের দিকে হাত বাড়ানোর চেষ্টা করলে তোর ঐ হাত আমি ভেঙে গুড়িয়ে দেব। কথাটা মাথায় রাখিস।”

জাঈদ যেন নির্ঝরের কথা শুনে ফুঁসে ওঠে। কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তার আগেই পেছন থেকে একজন বলে ওঠে,”স্যার, দ্রুত চলুন এখান থেকে। আপনার বাবা আপনাকে জরুরি ভিত্তিতে তলব করেছেন।”
জাঈদ ঘাড় ঘুরিয়ে একটা ডেভিল এক্সপ্রেশন দিয়ে নির্ঝরকে বলে,”আজকের মতো তোকে ছেড়ে দিচ্ছি। তবে এইটা আমি ভুলব না। জাঈদ শেখের সাথে পাঙ্গা নেয়ার ফল কি হতে পারে সেটা তুই খুব শীঘ্রই টের পাবি।”
বলেই জাঈদ নিজের বাইকে উঠে পড়ে হেটলেট মাথায় দিয়ে চলে যায়৷ তার পেছনে তার সাঙ্গপাঙ্গরাও যায়। নির্ঝর একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে আরিশা ও আফিফাকে বলে,”এখন গাড়ি থেকে নামতে পারো।”
দুজনেই গাড়ি থেকে নামে। নির্ঝর তাদেরকে জিজ্ঞেস করে,”ঐ ছেলেটা কে ছিল?”
আরিশা বলে,”ওর নাম জাঈদ শেখ। আমাদের এখানকার কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর শেখের ছেলে। কাউন্সিলরের ছেলে হওয়ায় এলাকায় একটু বেশি পাওয়ার দেখায়। আমাদের গাড়িটা হঠাৎ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রাস্তায় একটু দাঁড়াই সেই সময় হঠাৎ এসে আপুকে বিরক্ত করতে থাকে। অনেক অশালীন কথা বলছিল। আমার মাথা তো গরম হয়ে যায় এসব শুনে আর তাই আমি..”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আফিফা আরিশাকে থামিয়ে বলে,”তোর ওভাবে ওদের মুখে মুখে তর্ক করা ঠিক হয়নি বোনু। ঐ জাঈদ শেখ ভীষণ ভয়ানক একজন লোক। আর নির্ঝর ভাইয়া আমার তো এবার আপনার জন্যেও চিন্তা হচ্ছে। ও যেভাবে আপনাকে থ্রেট দিয়ে গেল। যদি আপনার কোন ক্ষতি করে দেয়!”
নির্ঝর স্মিত হেসে বলে,”তোমাকে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমাকে কাবু করা এত সহজ না। যাইহোক, তোমাদের গাড়ির সমস্যা কি ঠিক হলো?”
ড্রাইভার বলে উঠলেন,”না, গাড়িতে বেশ ভালোই সমস্যা হয়েছে। মেকানিকের কাছে নিয়ে যেতে হবে অনেক সময় লাগবে ঠিক হতে।”
আফিফা চিন্তিত স্বরে বলে,”তাহলে এখন কি হবে? আমায় যে দ্রুত মেডিকেলে যেতে হবে। আইটেমটা সঠিক সময় জমা দিতে না পারলে যে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
আরিশা অবশ্য খুশিই হয়। সে এমনিতেও কলেজ যেতে আগ্রহী নয়। তাই বলে,”আমি তাহলে একটা রিকশা বাসায় ফিরে যাই।”

এমন সময় নির্ঝর বলে ওঠে,”তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি একটা ক্যাব বুক করে রেখেছি। চলো তোমাদের দুইজনকে ক্যাবে করে তোমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
আফিফা স্বস্তি পায় নির্ঝরের কথায়। তবে আরিশার মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। একদিকে সে কলেজ যেতে হবে এটা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে কারণ আজ রসায়ন ক্লাসে স্যার সবাইকে পড়া ধরবে এবং পড়া না পারলে ভীষণ বকবে। অপরদিকে নির্ঝরের সাথে যেতে পারবে এটা ভেবে ভীষণ ভালো লাগছে।

ক্যাবে উঠে নির্ঝর ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে এবং আফিফা ও আরিশা পেছনের সিটে। পুরোটা সময় আরিশা আড়চোখে নির্ঝরকেই দেখে গেছে। অন্যদিকে, নির্ঝর লুকিং মিরর থেকে আফিফাকে দেখেছে। আফিফাও ব্যাপার‍টা খেয়াল করে খানিক লজ্জা পেয়েছে। একটু পরেই আরিশার কলেজের সামনে আসতেই আরিশা ক্যাব থেকে নামে। আফিফাকে বিদায় জানিয়ে অতঃপর আবেশের সাথে নির্ঝরের দিকে তাকায়। নির্ঝর স্নেহসূচকভাবে আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এবং তার হাতে একটা চকলেট দিয়ে বলে,”যাও, মন দিয়ে ক্লাস করো।”
অতঃপর ক্যাবটা আবার চলতে শুরু করে। আরিশা নির্ঝরের দেওয়া চকলেটটার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছিল৷ মনে মনে বলছিল,”নির্ঝর ভাইয়া কতোটা কেয়ার করে আমার জন্য!”

আরিশাকে নামিয়ে দেয়ার কিছু সময় পর আফিফাকেও তার মেডিকেল কলেজের সামনে নামিয়ে দেয় নির্ঝর। আফিফা তাড়াহুড়ো করে ক্যাব থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ করে তার ওড়না আটকে যায় গাড়ির দরজায়। নির্ঝর ক্যাব থেকে নেমে ব্যাপারটা খেয়াল করে সযত্নে ওড়নাটা বের করে আনে এবং আফিফাকে বলে,”সাবধানে চলাফেরা করো।”
আফিফা হালকা হাসে। অতঃপর নির্ঝরকে বিদায় জানিয়ে যেই না সামনের দিকে পা বাড়াতে যাবে এমন সময় নির্ঝর বলে ওঠে,”তোমার কলেজ ছুটি দেবে কখন?”
আফিফা পিছনে ফিরে তাকিয়ে একটা সুন্দর হাসি দিয়ে বলে,”১২ টার দিকে।”
“ঠিক আছে, আমি তাহলে এই সময় তোমায় নিতে আসব।”
আফিফার ভীষণ ভালো লাগে নির্ঝরের এই ছোট ছোট কেয়ারগুলো। তার হাসি আরো চওড়া হয় এবং সে মাথা নাড়িয়ে মেডিকেলের ভেতরে প্রবেশ করে।

আরিশার কলেজে এখন টিফিন পিরিয়ড চলছে। আরিশার পাশেই গাল ফুলিয়ে বসে আছে তার বেস্ট ফ্রেন্ড হিয়া। একটু আগেই রসায়ন ক্লাসে স্যার হিয়া ও আরিশা দুজনকেই ভীষণ অপমান করেছে কারণ তারা কেউই পড়া দিতে পারে নি। হিয়ার মনটা এই নিয়ে ভীষণ খারাপ থাকলেও হিয়া লক্ষ্য করছে আরিশা আজ সকাল থেকেই ভীষণ খুশি। এমনকি স্যারের বকুনিরও কোন প্রভাব পড়েনি তার উপর এমনকি সে যেন আজ নিজের মধ্যেই কোন ভাবনায় মগ্ন। হিয়া ব্যাপারটা খেয়াল করে আরিশার হাতের কনুইতে একটা টোকা দিয়ে বলে,”কি ব্যাপার আরু? তোকে আজ এমন লাগছে কেন?”

আরিশা হুশ ফিরে পেয়ে বলে,”এমন মানে?”
“কেমন যেন একটু বেশিই খুশি লাগছে। স্যার এত বকুনি দিল আমার তো কান্না পাচ্ছে অথচ তোর উপর কোন প্রভাবই পড়ছে না।”
আরিশা হাসিমুখে বলে,”তা তো আমি খুশিই।”
“কেন? এত খুশির রহস্য কি?”
আরিশা নির্ঝরের মুখটা মনে করে। তার দেয়া চকলেটটা সে সযত্নে ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। চকলেটটা বের করে বলে,”আমার খুব কাছের একজন মানুষের ভালোবাসা আমি উপলব্ধি করতে পারছি।”
রিয়া কিছু একটা বুঝতে পেরে বলে,”এটা কি তোর সেই লন্ডনী কাজিনটা নাকি? যার কথা তুই সবসময় আমায় বলতি?”

“হ্যাঁ, রে। আমার নির্ঝর ভাইয়া। জানিস, কাল নির্ঝর ভাই দীর্ঘ ৫ বছর পর দেশে ফিরেছে। আমার জন্য একটা আইফোনও এনেছে।”
“ওয়াও, সেই তো।”
” শুধু তাই নয় আজ সকালে..”
এরপর সে সব ঘটনা বর্ণনা করে। অতঃপর বলে,”আমার মনে হয় নির্ঝর ভাইয়াও আমাকে ভালোবাসে। নাহলে যখন ঐ জাঈদ শেখ আমার দিকে হাত বাড়ালো তখন ওকে এমন ভাবে মারত না। তাছাড়া আমাকে এত এত গিফট দেওয়া..আমার মাথায় হাত বোলানো এসব তো সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। তাই না বল?”
হিয়া একটু ভেবে বলে,”হতে পারে। তবে তুই এতোটাও নিশ্চিত হতে পারিস না এসব নিয়ে। এমনো হতে পারে তোকে উনি বোনের চোখে দেখেন তাই..”
আরিশার মনটা এবার একটু খারাপ হয়। সত্যিই কি নির্ঝর তাকে শুধুই বোনের চোখে দেখে?

ঠিক ১২ টার সময় নির্ঝর এসে দাঁড়িয়ে আছে সিলেট মেডিকেল কলেজের সামনে। কিছু সময় পর সেই কাঙ্খিত মুখের দেখা পেলো। আফিফা হাফাতে হাফাতে এসে বললো,”ভাইয়া..আসলে আমাকে এখন কিছু এক্সট্রা ক্লাস করতে হবে। এখন আমি যেতে পারব না। এটা বলতেও আসা।”
“আচ্ছা, ব্যাপার না। আমি নাহয় আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নেব।”
“আমাকে তো ৩ ঘন্টা ক্লাস করতে হবে। আপনাকে এত অপেক্ষা করতে হবে না। তারচেয়ে বরং একটা কাজ করুন, আরিশার কলেজের ছুটির সময় হয়ে এসেছে। ওকে বাসায় নিয়ে যান আপাতত। আমাকে নাহয় পরে এসে নিয়ে গেলেন।”
“বেশ।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ২

বলেই নির্ঝর গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
এদিকে হিয়ার কথা শুনে আরিশার মনে সন্দেহ ঢুকে যায়। সে ভাবছিল,”তাহলে কি আমি সত্যিই নির্ঝর ভাইয়ের কাছে একজন কাজিন মাত্র?”
এমন সময় হঠাৎ কলেজের গেইটে এসে দাঁড়াতেই সে দেখতে পায় নির্ঝরকে। নির্ঝর তারমানে তাকে নিতে এসেছে। আরিশা খুশি হয়ে বলে,”তারমানে উনি সত্যিই আমাকে নিয়ে কেয়ার করেন।আমাকে কাজিনের থেকেও বেশি কিছু ভাবেন!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪