অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩২

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩২
ইয়াসমিন খন্দকার

আরিশা মন খারাপ করে নিজের ঘরে বসেছিল। এমন সময় আফিফা আরিশার রুমে আসে। সে এসেই আরিশার পাশে বসে বলে,”আরিশা..তুই এমন মন খারাপ করে বসে আছিস কেন? ঈশিতার কাছে শুনলাম যে ঐ জাঈদ শয়তানটা নাকি আজ আবার তোকে বিরক্ত করছিল। কথাটা কি সত্যি? এবার তাহলে এর একটা বিহিত করতেই হবে। কি পেয়েছে টা কি ও?”
আরিশা বলে,”তুমি এসব কথা বাদ দাও আপ্পি। ওকে আমি যেভাবে অপমান করেছি আমার মনে হয় না..ও আবার আমার কাছে আসবে।”
“কি জানি, ওরকম ছেলেদের একদম বিশ্বাস নেই। যেভাবে আমার পেছনে পড়ে ছিল..আচ্ছা বাদ দেই সেসব কথা। তুই এখন ঠিক আছিস তো?”
“হুম।”
“জানিস, তোকে একটা কথা জানানোর আছে।”
“কি কথা?”

আফিফা এর হাসপাতালের সমস্ত ঘটনা আরিশাকে খুলে বলে। সব শুনে আরিশা অবাক হয়ে যায়। হতবাক স্বরে বলে,”কি বলছ কি তুমি? আদৃতা আপু তোমার চাচাতো বোন নয়? মানে অন্য কেউ তোমার চাচাতো বোন?”
“হ্যাঁ, সেটাই তো শুনলাম। মেয়েটার নাম নাকি সালমা আক্তার বৃষ্টি। এতদিন ও গ্রামে বড় হয়েছে৷ তবে এখন থেকে বোধহয় শহরেই থাকবে। জানিস, দাদি আমায় বলেছিল ওবাড়িতে ফিরে যেতে, নির্ঝরও আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলাম যে আমি ও বাড়িতে ফিরব না।”
আরিশা বলে,”তুমি কেন ওদের না করতে গেলে আপ্পি?”
“ওরা তোকে যেভাবে অপমান করেছে তারপর আমি আর ওবাড়িতে ফিরব না।”
“আমার জন্য তোমরা শুধুশুধুই এত ভাবছ। কে হই আমি তোমাদের? তোমাদের সাথে আমার না কোন রক্তের সম্পর্ক আছে আর না তো অন্য কোন কিছু৷ তাহলে আমার জন্য কেন তোমরা এভাবে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে থাকে? তোমার আর নির্ঝর ভাইয়ের সম্পর্কই বা কেন শুধুমুধু আমার জন্য খারাপ হবে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“একটা থাপ্পড় দেব তোকে। খুব পাকা পাকা কথা শুনেছিস তাই না? আমার যা ভালো মনে হয়েছে আমি তাই করেছি। তুই বলার কে? আর কি বললি তুই আমার কেউ না? তুই আমার বোন। এ কথা আর কতবার বলতে হবে তোকে? নাকি তুইও আমায় আপন ভাবিস না?”
“না, না আপ্পি। তোমার থেকে আপন আর আমার এই দুনিয়ায় কে হয়েছে? আমি ভুল করে বলে ফেলেছি। আমায় ক্ষমা করে দাও।”
“ক্ষমা করতে পারি তবে একটা শর্ত আছে?”
“কি শর্ত?”
“আর কোনদিন যেন তোর মুখে এমন কথা না শুনি।”
“ঠিক আছে।”

“তবে যাইহোক, আমার একটা জিনিস ভেবে ভালো লাগছে যে অন্তত এতদিন পর সালমা তার আসল পরিবারটাকে ফেরত পেল। আদৃতার যা খারাপ ব্যবহার ও যে আমার চাচাতো বোন নয় এটা জেনে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।”
হঠাৎ করে আরিশার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আফিফা সেটা খেয়াল করে বলে,”তোর মুখটা হঠাৎ এভাবে শুকিয়ে গেল কেন?”
আরিশা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”আমার আসল পরিবারকেও কি আমি কখনো এভাবে খুঁজে পাব? হ্যাঁ, আমি জানি তারা নিজেরাই একদিন আমায় ত্যাগ করেছিল। কিন্তু তবুও তাদের প্রতি আমার ভীষণ মায়া জাগে। একবার হলেও আমি তাদের মুখোমুখি হতে চাই। তাদের মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই, কেন তারা আমায় ত্যাগ করেছিল। কেন আমায় পর করে দিয়েছিল।”
আফিফা আরিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”একদম কষ্ট পাবি না। ওরা তোকে পর করেছে তো কি হয়েছে? আমরা আছি না? আমরাই তো তোর আপনজন।”
আরিশা মাথা নাড়ায়।

ছোট বাচ্চাদের কিছু পুরাতন পোশাক হাত দিয়ে স্পর্শ করছেন মিসেস রাহেলা খন্দকার। তার দুচোখ ভড়া জল যেন তার দীর্ঘ ২০ বছরের কষ্টের সাক্ষ্য দিচ্ছে। তার সামনেই বসে আছেন তার শ্বাশুড়ী সিতারা বেগম। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন,”এসব দেখে আর কি হবে বৌমা? আল্লাহ তো তোমার ভাগ্যে সন্তান সুখ রাখেন নি। বিয়ে সুদীর্ঘ ১২ বছর পর তুমি একটা সন্তানের মা হলে। সেই সন্তানকেও আল্লাহ তোমার থেকে কেড়ে নিল। আর তুমি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে তোমার সন্তানের জন্য বানানো জামা-কাপড় সব আগলে রেখেছ।”

রাহেলা খন্দকার এবার জামাগুলো নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন,”আপনার মনে আছে আম্মা? আমার সন্তান যখন আমার পেটে ছিল তখন আমি৷ নিজের হাতে সেলাই করে এইসব জামা বানিয়েছিলাম। কত আশা নিয়ে ছিলাম যে একদিন আমার সন্তান জন্ম নেবে আর এই জামাগুলো পড়বে। অথচ আমার সন্তান জন্মের পরপরই কিনা আমায় শুনতে হলো যে আমি একটা মৃত বাচ্চার জন্ম দিয়েছি। আজো আমি ঐ দিনটা ভুলতে পারি না।”
সিতারা বেগম চশমা খুলে নিজের চোখের জল মুছে বলেন,”এসব ভেবে কোন লাভ নেই, বৌমা। তার থেকে ভালো, তুমি আল্লাহর কাছে দোয়া করো। দোয়ার থেকে বেশি কার্যকর আর কিছু হয় না।”
এমন সময় হঠাৎ করে তাদের বাড়ির ড্রাইভার এসে বলে,”ম্যাডাম, আমি গাড়ি বের করেছি।”
সিতারা বেগম বলে ওঠেন,”এই ভর দুপুরবেলায় আবার গাড়ি কেন বের করেছ?”
“ম্যাডাম নাকি কোথাও একটা যাবেন।”

রাহেলা খন্দকার বলেন,”আমি এখন একটু অনাথ আশ্রমে যাব আম্মা। জানেনই তো, ঐ অনাথ বাচ্চাগুলোর সান্নিধ্য পেলে আমার মনে হয় যেন আমার বাচ্চা আমার পাশেই আছে।”
“আচ্ছা, বেশ সাবধানে যেও।”
রাহেলা খন্দকার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। তিনি যেতেই সিতারা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,”ভাগ্য করে একটা বৌমা পেয়েছিলাম। কত ভালো মন ওর, কি সুন্দর ব্যবহার। কারো কষ্টই সহ্য করতে পারে না মেয়েটা। অথচ ওর কপালেই কষ্টের সুখ নেই। আল্লাহ, তুমি একটু ওর দিকে মুখ তুলে তাকাও। অন্তত ওর জীবনে একটা সুখের কারণ নিয়ে এসো।”

আফিফা আরিশাকে নিয়ে একটু শপিং করতে বের হয়েছে কারণ আরিশার মন ভালো ছিল না। শপিং করা শেষে আফিফার মনে পড়ে সে কিছু জরুর জিনিসপত্র একটা দোকানের সামনে রেখে এসেছে। তাই আফিফা আরিশাকে বলে,”বোনু, তুই একটু এখানে দাঁড়া। আমি ভেতর থেকে আসছি জিনিশগুলো নিয়ে।”
“আচ্ছা, আপু। তাড়াতাড়ি এসো।”
আফিফা ভেতরে চলে যায়। এদিকে আরিশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ করে সে খেয়াল করে রাস্তার মধ্যে দিয়ে একটা মহিলা হেটে যেতে যেতে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। আরিশা তৎক্ষণাৎ গিয়ে সেই মহিলাটিকে ধরে বলে,”আপনি ঠিক আছেন তো?”

মহিলাটা মাথা নাড়িয়ে হু হা করে। আরিশার কাছে পাতির বোতল ছিল সে সেখান থেকে মহিলাটিকে পানি খাওয়ায়। আরিশা দেখতে পায় মহিলাটির হাতে অনেক গুলো চকলেটের বক্স।
এদিকে একজন ড্রাউভার ছুটে এসে বলে,”আপনি ঠিক আছেন তো ম্যাডাম?”
রাহেলা খন্দকার ততক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছেন। তাই তিনি বলেন,”হুম। ঠিক আছি।”
অতঃপর তিনি আরিশার দিকে তাকান তাকে ধন্যবাদ দিতে। কিন্তু আরিশার দিতে তাকাতেই তার কেন জানি ভীষণ কান্না পায়৷ আরিশাকে দেখে তার মনে হতে থাকে এ যেন তার ভীষণ কাছের কেউ। আরিশা রাহেলা খন্দকারের দিকে খেয়াল করে বলেন,”আন্টি, এই পানিটুকু সম্পূর্ণ খেয়ে নিন, তাহলে আরো সুস্থ বোধ করবেন।”
রাহেলা খন্দকার পানিটুকু খেয়ে নেন। আরিশা মিষ্টি স্বরে বলে,”যদি বেশি সমস্যা হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে যান।”
রাহেলা খন্দকার হালকা হেসে বলেন,”না, মা তার প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩১

“আপনাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
রাহেলা খন্দকার আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”কেন জানি আমার মনে হচ্ছে, তোমার সেবাই আমাকে সাড়িয়ে তুলেছে। তোমাকে নিজের ভীষণ কাছের কেউ মনে হচ্ছে।”
আরিশাও বিনয়ী হাসে তার কথা শুনে। রাহেলা খন্দকার জিজ্ঞেস করে,”কি নাম মা তোমার?”
“আমার নাম আরিশা।”
“আরিশা..খুব সুন্দর নাম।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৩