অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৯

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৯
ইয়াসমিন খন্দকার

জরিনা হতবাক চোখে রাহেলা খন্দকারকে দেখছিল। তার মনে পড়ে যাচ্ছিল অতীতের কিছু কথা। জরিনা মনে মনে বলে,”আজ এত দিন পর কি তাহলে সব সত্য সামনে আনার জন্যই আল্লাহ আজ আমায় এখানে আনলেন?”
এদিকে আনিকা খান আফিফাকে বলে ওঠেন,”আফিফা, তুমি গিয়ে আরিশাকে ডেকে নিয়ে এসো। আরিশাকে গিয়ে বলো ও যার সাথে দেখা করার জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিল সে এখন এখানে এসে গেছে।”
আফিফা বলে,”কি বলছ তুমি আম্মু? কে এসেছে?”
“আরিশার আসল মা, জরিনা।”

আফিফা হতবাক হয়ে যায় নিজের মায়ের কথা শুনে। এদিকে রাহেলা খন্দকারও অবাক হয়ে বলেন,”কি বলছেন আপনারা? আরিশা জরিনার মেয়ে। জরিনা, তুমি তাহলে নিজের সন্তানকে ত্যাগ করেছিলে। কিন্তু কেন?”
আফিফা রাহেলা খন্দকারকে জিজ্ঞেস করে,”আপনি এনাকে চেনেন আন্টি?”
“হ্যাঁ, চিনবো না কেন। জরিনা তো আমাদের বাড়িতে কাজ করত আগে। আমি যখন প্রেগন্যান্ট ছিলাম তখন ঐ আমার দেখভাল করত। এমনকি আমার সন্তানের জন্মদানের মুহুর্তেও ও আমার পাশে ছিল৷ তারপর আমার মৃত সন্তান জন্ম নেয়ার পর যখন আমি ভেঙে পড়েছিলাম তখন জরিনাই তো আমায় সামলেছিল। এরপর যদিওবা কিছুদিনের মধ্যেই ও কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।”
আফিফা বলে,”আমি আরিশাকে ডেকে নিয়ে আসছি। ওর নিজের আসল মায়ের সাথে দেখা করা দরকার।”
বলেই আফিফা ছুটে যায়। এদিকে আনিকা খান জরিনাকে চেপে ধরে বলেন,”নিজের মেয়ের কথা কি এতদিনে একবারও মনে পড়ে নি তোমার? একটা মা এতটা নির্দয় কিভাবে হতে পারে। সন্তানের প্রতি তো একটু হলেও টান থাকার কথা।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জরিনা দুচোখ বন্ধ করো নেয়। সে বুঝতে পেরে যায় এখন আর কোন কথা লুকিয়ে লাভ নেই। এতদিন পর যখন আজ সবাই একসাথে হয়েছে তখন নিশ্চয়ই মহান সৃষ্টিকর্তাই তাকে আজকে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে নিজের অতীতের সব পাপ মুছে ফেলার। এই পাপের ভার আর কত বয়ে বেড়াবে সে? জরিনা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়,পরিণাম যাই হোক না কেন আজ সে সব সত্য সবাইকে বলবে৷ এতে যদি তার পাপ কিছুটা হলেও লাঘব হয় সেটাই অনেক। তাই জরিনা বলে ওঠে,”ঠিক বলছেন আপনে ম্যাডাম। আমার ঐ মেয়ের প্রতি কোন টান নেই। কারণ ও আমার মেয়েই নয়।”

আনিকা খান হতবাক স্বরে বলেন,”তোমার মেয়ে নয়, মানে? আরিশাকে তো তুমিই হাসপাতালে ফেলে চলে গেছিলে। আর এখন বলছ ও তোমার মেয়ে নয়৷ তাহলে ওর আসল মা কে?”
জরিনা দুচোখ বন্ধ করে রাহেলা খন্দকারের দিকে ইশারা করে বলে,”ইনি..ইনি হলেন বাচ্চাটার আসল মা।”
কথাটা শোনামাত্রই সবাই হতবাক হয়ে যায়৷ রাহেলা খন্দকার চরম পর্যায়ের অবাক হয়ে বলেন,”এসব কি বলছ তুমি জরিনা? আরিশা আমার মেয়ে, মানে? আমার মেয়ে তো জন্মের পরপরই মারা গেছিল। তাহলে ও আমার মেয়ে হয় কি করে?”

জরিনা এবার কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে রাহেলা খন্দকারের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে,”আমায় ক্ষমা করে দেবেন মালকীন। আপনার নুন খেয়েছি কিন্তু সেই বিশ্বাস রাখতে পারিনি। আপনি যখন গর্ভবতী ছিলেন তখন রাজনৈতিক শত্রুতার জন্য আপনার স্বামীর বিরোধী দলের কিছু লোক টাকা দিয়ে আমায় কিনে নেয়। তারা আমায় দায়িত্ব দেয় যেন আপনার সন্তান জন্মানোর পরই আমি তাকে পাচার করে দেই। আর আজ থাকি ২০ বছর আগে, যখন হাসপাতালে আপনার বাচ্চা জন্ম নেয় সেই ঝড় বাদলের রাতে হাসপাতালের কিছু লোক যারা শিশু পাচারের সাথে যুক্ত ছিল তারাই আপনার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল আর বলেছিল কোন পতিতাপল্লিতে গিয়ে বাচ্চাটাকে বিক্রি করে দিতে। আমি যেহেতু তাদের টাকা খেয়েছিলাম সেহেতু আমি আর না করতে পারিনি। কি করব বলুন, ঘরে আমার অসুস্থ স্বামী, তিন তিনটে সন্তান। তাদের কথা ভেবে আমার নৈতিকতা বিসর্জন দিতে বাধ্য হই। কিন্তু মাসুম বাচ্চাটাকে দেখে আমার অনেক মায়া হয়। আমি পারিনা তাকে ঐ নোংরা জগতে বিক্রি করে দিতে। আর তাই তো হাসপাতাল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে অন্য একটা হাসপাতালে যাই। সেই হাসপাতালেই আনিকা ম্যাডামের সাথে আমার দেখা হয়। আমি তখন নিজের দরিদ্রতার অজুহাত দিয়ে আনিকা ম্যাডামের হাতে বাচ্চাটাকে তুলে দিয়ে পালিয়ে আসি।”

বলেই জরিনা হু হু করে কাঁদতে থাকে। রাহেলা খন্দকার যেন চোখে অন্ধকার দেখতে থাকেন। এতদিন থেকে যেই মেয়েকে তিনি মৃত ভেবেছেন সেই মেয়ে বেঁচে আছে। তার সঙ্গে মেয়েটার দেখা হয়েছে অথচ তিনি নিজের মেয়েকে চিনতে পারেন নি। এজন্যই কি তাহলে মেয়েটাকে তার এতোটা আপন আপন লাগত।
এদিকে আনিকা খান, নিঝুম এনারা দুজনেও অবাক হয়ে যান এত কথা শুনে। তারা ভাবতেই পারেন না যে অতীতে এত কিছু হয়ে গেছে। এরইমধ্যে আফিফার ডাকে আরিশাও নিচে চলে আসে। সে এসেই করুণ স্বরে বলে,”কোথায় আমার মা? আমি আমার মায়ের সাথে দেখা করতে চাই। তাকে জিজ্ঞেস করতে চাই কেন এতগুলো দিন আমায় দূরে ঠেলে রেখেছিল সে।”
বলেই সে জরিনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,”আপনি আমার মা হন?”
জরিনা দুদিকে মাথা নাড়ায়। আরিশা বলে ওঠে,”তাহলে আমার মা কে? কার কোল থেকে আপনি আমায় তুলে এনেছিলেন বলুন।”

রাহেলা খন্দকার অশ্রুসিক্ত নয়নে, ভঙ্গুর কন্ঠে বলে ওঠেন,”আমিই তোমার সেই অভাগী মা, যার কোল থেকে জরিনা তোমায় আলাদা করে দিয়েছিল।”
কথাটা শোনামাত্রই আরিশা অবাক চোখে রাহেলা খন্দকারের দিকে তাকায়। তার চোখ থেকে অনবরত বৃষ্টির ফোটার মতো অশ্রুপাত হতে থাকে। রাহেলা খন্দকার নিজের দুহাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,”নিজের মায়ের কাছে আসবে না?”
আরিশা ঝাপিয়ে পড়ে রাহেলা খন্দকারের কোলে। দুই মা-মেয়ের পুনঃমিলনে পরিবেশ পুরো ভারী হয়ে ওঠে। দুজনেই সমান স্বরে কাঁদতে থাকে। আবেগ যেন আজ বাধা মানতে রাজি নয়। আরিশা ফুপিয়ে বলতে থাকে,”কেন আমাকে নিজের থেকে দূরে করে দিয়েছিলে মা? আমি কি দোষ করেছিলাম?”
“তুমি কোন দোষ করো নি, মা। দোষ তো আমার ছিল। নিজের দূর্ভাগ্যের জন্য তো আমি তোমায় আটকে রাখতে পারি নি।”
আনিকা খান এবার আরিশাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। সব শুনে আরিশা অবাক হয়ে যায়।
নিঝুম বলে ওঠে,”জরিনা, তুমি টাকার লোভে যা করেছ তা অত্যন্ত অন্যায়। তোমার জন্য দুই মা-মেয়ে এত গুলো বছর বিছিন্ন ছিল। এর শাস্তি তোমায় পেতেই হবে। আমি পুলিশ ডেকেছি ওনারা এসে তোমায় গ্রেফতার করবে। এছাড়া এসবের পেছনে আরো যারা ছিল তাদের নামও তো জানা দরকার। তুমি একদম পালানোর চেষ্টা করবে না।”
জরিনা বলে,”আমার অন্যায়ের শাস্তি পেতে আমি প্রস্তুত। একইসাথে পুলিশকে যতটা সাহায্য করা যায় আমি করবো।”

জরিনাকে পুলিশ এসে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। বর্তমানে রাহেলা খন্দকার আরিশাকে জড়িয়ে ধরে খান বাড়ির সোফা দখল করে বসে আছেন। খান বাড়ির সকল সদস্য ড্রয়িংরুমে উপস্থিত। সবাই সবটা শুনেছে।
ছবি বেগম তো হা-হুতাশ করে বললেন,”আহারে! আরিশা কত বড় পরিবারের মেয়ে। ওর তো এতদিনে রাজকুমারীর মতো থাকা উচিৎ ছিল অথচ মেয়েটার জীবন পুরো কষ্টে ভরা।”
আবরাজ খান বলেন,”ঠিক বলেছেন আপনি। সত্যি, বাস্তবতা কতটা নিষ্ঠুর। আমার মেয়েটাকেও তো এতগুলো বছর আমাদের থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। কিন্তু আজ আমরা ওকে আবার ফিরে পেয়েছি। ”
বলেই বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দেন তিনি। রাহেলা খন্দকার আরিশাকে বলে,”আরিশা, মা, তুমি এবার তোমার আসল বাড়িতে চলো। তোমার বাবা-দাদি তাদের সাথে যে এখনো পরিচয় বাকি।”
আরিশা হতবাক স্বরে বলে,”আসল পরিবার!”
আবির খান বলে ওঠেন,”তুই সবসময় আমাদের কাছে আপনই থাকবি কিন্তু এবার যে সময় এসেছে তোর আসল পরিবারের সাথে দেখা করার।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৩৮

আরিশা এবার একে একে বাড়ির সকলকে বিদায় দেয়। আফিফা আরিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”যা বোনু! তোর আসল পরিবারে ফিরে যা। কিন্তু আমাদের ভুলে যাসনা। আমরা সবসময় তোর আপন থাকব যেমন এখন আছি।”
“তোমাদের ভুলে গেলে যে আমার অস্তিত্বই থাকবে না।”
বলেই আরিশা সবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দেয় নিজের আসল গন্তব্যে।

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪০