অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪১
ইয়াসমিন খন্দকার
আরিশা আজ অনেকদিন পর আফিফাদের সাথে দেখা করার জন্য খান ভিলায় এলো। আরিশার আসার খবর শুনে আফিফাও আজ বেশ সকাল সকাল তার মেডিকেল কলেজ থেকে ফিরে এসেছে। এখন আপাতত দুই বোন একসাথে বসে গল্প করছে। আফিফা কিছুটা ব্যথিত স্বরে বলে,”নিজের আসল পরিবারকে ফিরে পাওয়ার পর তো বোধহয় তুই আমাদের ভুলেই গেছিস বোনু। আজ এতদিন পর তোর আমাদের কথা মনে পড়লো?”
আরিশা বলে ওঠে,”তুমি ভুল ভাবছ আপ্পি৷ আমার তো সবসময় তোমাদের কথাই মনে পড়ে। আসলে কি হয়েছে বলো তো, বাবা-মা ওরা আমাকে সবসময় ভীষণ নজরে নজরে রাখে। আমাকে নিয়ে কত আত্মীয়র বাড়িতে গেল তাদের সাথে পরিচয় করালো৷ আবার মাঝখানে দাদিমা একটু অসুস্থ হয়ে গেছিল আবার বাবার ইলেকশনের ব্যস্ততার জন্য আমাকে আর মাকেই হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হয়েছিল। তাই আরকি..”
“হুম, বুঝেছি৷ তো এসব বাদ দে, তুই এবার তোর পড়াশোনার কথা বল। আর কয়েকদিন পরই যে তোর এইচএসসি পরীক্ষা তার খেয়াল কি আছে? এবার কিন্তু ভালো রেজাল্ট করতে হবে।”
“হ্যাঁ, মনে থাকবে না আবার? মা তো আমায় নিয়ম করে পড়তে বসাচ্ছে, কয়েকটা টিউশনিও করছি।”
“হুম, গুড। এভাবেই এগিয়ে যা। অতীত ভুলে এবার নিজের একটা পরিচয় গড়ে তোল। আচ্ছা, তুই কি এখন নিজের স্বপ্ন কি সেটা ঠিক করতে পেরেছিস?”
“হ্যাঁ, আপ্পি। আমি পেরেছি। আমি চাই এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। তারপর পড়াশোনা শেষ করে আমি একজন টিচার হতে চাই।”
আফিফা আরিশাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমি খুব খুশি যে আমার বোনুটা এবার তার জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছে।”
এমন সময় ছবি বেগম সেখানে এসে বলেন,”আরে আরিশা। এতদিন পর এলে। কেমন আছ তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমক্ন আছ দাদি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমিও আছি আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমার মনটা একটু খারাপ৷ আসলে কি বলো তো, আবরাজ, নিঝুম ওরা নাকি আবার বৃষ্টি দিদিভাইকে নিয়ে লন্ডনে যাবে। সেখানেই নাকি বৃষ্টি দিদিভাইকে পড়াশোনা করাবে। আসলে ওদের আর কি দোষ দেব, আবরাজের বিজনেস আছে ওখানে আবার নিঝুমও ওখানেই ডাক্তারি করে। ওদের ছুটি তো শেষ হয়ে আসছে তাই এবার ওদের ফিরতে হবে। তবে নির্ঝর দাদুভাই নাকি এইদেশেই নিজের আলাদা বিজনেস শুরু করবে আর আফিফা দিদিভাইকে নিয়ে এখানেই থাকবে। এটা জেনে একটু স্বস্তি পেলাম।”
হঠাৎ করেই সায়ন সেখানে চলে আসে। সায়নকে দেখেই আরিশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সায়ন সেটা বুঝতে পারে৷ আফিফা সায়নকে দেখে বলে,”আরে সায়ন ভাইয়া আপনি, আসুন ভেতরে আসুন।”
সায়ন এসে বলে,”আরিশা, আপনার সাথে আমার কিছু কথা বলার ছিল আলাদা ভাবে। যদি একটু সময় দিতেন আমায় খুব ভালো হতো..”
আরিশা বলে,”আচ্ছা, আপনার যা বলার বলুন।”
“আসলে আমি আপনার সাথে একা কথা বলতে চাইছিলাম।”
আরিশা আফিফার দিকে তাকায়৷ আফিফা আরিশাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে সায়নের সাথে যেতে বলে। আরিশা তাই রাজি হয়।
আরিশা উঠতেই আফিফা বলে ওঠে,”তোর জীবনের সব সিদ্ধান্তই তোর বোনু। তাই আমি তোকে বলব, যাই সিদ্ধান্ত নিবি ভেবেচিন্তে নিবি।”
আরিশা মাথা নাড়ায়।
অতঃপর সায়নের সাথে একটু দূরে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায়। সায়ন আরিশাকে বলে,”আসলে..কথাটা কিভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না..”
“আপনার যা বলার নির্ভয়ে বলুন৷”
“আসলে…”
“সন্ধ্যা আপু কেমন আছে? উনি কি এখনো আমার উপর রেগে আছে?”
সায়নকে স্বাভাবিক করার জন্য জিজ্ঞেস করে আরিশা৷ সায়ন একটু স্বাভাবিক হয়ে বলে,”ও ভালো আছে। আর ওর আপনার উপর রাগ নেই।”
“যাক জেনে ভালো লাগল। এবার আপনি যা বলতে চান বলুন।”
“আরিশা, আমি আপনাকে….আপনি কি অতীতের সবকিছু ভুলে আমার সাথে নতুনভাবে জীবন শুরু করবেন?”
আরিশা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। অতঃপর বলে,”আমি জানি, আপনার মনে আমার জন্য কি অনুভূতি আছে। আমি সেই অনুভূতিকে সম্মান করি। কিন্তু..আপনি যেটা চাইছেন সেটা সম্ভব না। আমি আমার জীবনটা নতুন করে শুরু করতে চাই কিন্তু সেই শুরুর জন্য আপাতত কোন সঙ্গী আমার চাই না। আর আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি জানি, আপনি মানুষ হিসেবে অনেক ভালো৷ কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তো কিছু সম্ভব নয়। আপনি বিবেকবান মানুষ, আশা করি, নিজের বিবেক দিয়ে সবটা চিন্তা করবেন। আপনার জন্য শুভকামনা রইল, আপনার জীবনে ভালো কেউ আসুক। শুধু আপনার হয়ে আসুক।”
বলেই আরিশা স্থানত্যাগ করে। সায়ন বিষন্ন চোখে আরিশার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। সে আটকায় না আরিশাকে। কারণ জোর করে আর যাইহোক ভালোবাসা হয়না। এদিকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে বৃষ্টি। তার কেন জানি, সায়নের ঐ বিষন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে ভীষণ খারাপ লাগছিল। ইচ্ছা করছিল, সায়নের সব কষ্ট মুছে দিতে। এটা কি তাহলে নতুন কোন শুরুর ইঙ্গিত?
আদৃতা নিজের রুমে বসে বসে ঈর্ষায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। শেষে কিনা, ঐ মেয়েটা, ঐ গাইয়া মেয়েটা এখন তাদের সাথে লন্ডনে যাবে! এটা আদৃতা কিছুতেই মানতে পারছে না। এখন লন্ডনে তার সব বন্ধুরা জেনে যাবে যে, আদৃতা যে আবরাজ খানের মেয়ে হওয়া নিয়ে এতো গর্ব করত সে তার আসল মেয়ে নয়। সবাই তাকে বাকা দৃষ্টিতে দেখবে। আদৃতা রাগে অন্ধ হয়ে বলে ওঠে,”এটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। ঐ সালমা কি ভাবছে? বৃষ্টি নাম ধারণ করেই ওর গ্রাম্য পরিচয় মিটে যাবে? কিছুতেই না। ও আমার স্থান দখল করতে চাইলে সেটা আমি এত সহজে হতে দেব না। ও আসার পর থেকে কেউ আমাকে মূল্যায়নই করছে না। সবার সব ভালোবাসা ও একাই পাচ্ছে। মম, ড্যাড, ব্রো সবাই ওকে মাথায় তুলে নাচছে আর এবার কিনা ও লন্ডনে গিয়েও সবার চোখের মনি হবে। আমি সেটা কিছুতেই হতে দেব না। এবার সময় এসে গেছে পথের কাঁটা সরিয়ে দেবার৷ আর পথের কাঁটা কিভাবে সরাতে হয় সেটা আদৃতা খুব ভালো করেই জানে।”
বলেই আদৃতা একটা শয়তানী হাসি দেয়। অতঃপর কিছু একটা ভেবে কাউকে একটা ফোন করে কিছু বলে।
বৃষ্টি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা সায়নের কাছে যায়। সায়ন বৃষ্টিকে খেয়াল করে। তার চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমেছিল। বৃষ্টি সায়নের দিকে একটা টিস্যু পেপার এগিয়ে দিয়ে বলে,”এভাবে কাঁদবেন না, কাউকে কাঁদতে দেখলে আমার একদম ভালো লাগে না।”
সায়ন বৃষ্টির এমন সরল ব্যবহারে কিছুটা ভালো অনুভব করে। অতঃপর তার হাত থেকে টিস্যুটা নিয়ে চোখের জল মুছে। বৃষ্টি বলে,”এবার একটু হাসুন। জানেন, যখন আমি গ্রামে ছিলাম তখন কত কষ্টে ছিলাম তবুও আমি সবসময় হাসতাম। হাসলে কষ্ট কমে।”
সায়ন এবার বৃষ্টির কথায় একটু হাসার চেষ্টা করে। দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে যেন আদৃতার গা জ্বলে ওঠে। আদৃতা বলে,”আমার পরিবার, আমার অবস্থান কেড়ে এই মেয়ের শান্তি হয়নি এখন আমার ভালোবাসার মানুষকেও কেড়ে নিতে চায়। নাহ, বৃষ্টি তোকে আমি এই সুযোগ দেব না।এবার নিজের অবস্থান আমি আবার আদায় করে নেব। তুই থাকলে আমার অবস্থান আমি কখনোই ফিরে পাবো না। তাই এবার তোকে সরিয়ে দিতে হবে।”
বলেই সে মনে মনে কিছু একটা পরিকল্পনা করে নেয়।
বৃষ্টি সায়নকে হাসতে দেখে বলে,”এভাবেই সবসময় হাসবেন।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪০
বলেই সে স্থান ত্যাগ করে। বাইরের দিকে আসতেই আদৃতা তার পথ আটকে বলে,”কি ব্যাপার? কোথায় যাচ্ছ?”
বৃষ্টি একটু ঘাবড়ে যায়। কারণ সে আদৃতাকে একটু ভয়ই পায়। আদৃতা বৃষ্টির ভীতু ভীতু মুখ দেখে বলে,”আমি জানি, তুমি আমায় ভয় পাও। হয়তো এর জন্য আমি দায়ী। তবে আমি এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। আর তাই তো তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই।”
বৃষ্টি অবাক স্বরে বলে,”বন্ধুত্ব?”
“হ্যাঁ, হবে তো আমার বন্ধু।”
বৃষ্টি সরল মনে মাথা নাড়ায়। আদৃতা বৃষ্টিকে জড়িয়ে ধরে। আর মনে মনে বলে,”এভাবেই তোর বিশ্বাস জিতে তোকে আমি শেষ করে দেব।”