অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৫

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৫
ইয়াসমিন খন্দকার

নির্ঝর ও আফিফাকে একসাথে দেখে সেই দৃশ্য আর বেশি সময় সহ্য করতে পারল না আরিশা। কাঁদতে কাঁদতে এবং চোখের জল মুছতে মুছতে ছুটতে লাগল সে৷ একটু দূরে গিয়েই বসে পড়ল কেবিনের বাইরে রাখা টুলে। অতঃপর বলতে লাগল,”কেন? কেন আমার সাথে এমন হলো আল্লাহ? আমার তো যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে তখন থেকে আমি শুধু ঐ একটা মানুষকেই ভালোবেসে গেছি৷ তাকে নিয়েই হাজার স্বপ্ন সাজিয়েছি৷ তাহলে তুমি কেন তাকে আমার ভাগ্যে রাখলে না? এতটা নিষ্ঠুরতা কেন করল আমার সাথে আমার ভাগ্য?”

বলেই সে কাঁদতে লাগল।
ওদিকে কেবিনের ভেতর নির্ঝর আফিফার উত্তর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আফিফা কিছু সময় লজ্জায় স্মিত থেকে একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলে। তার লাজে রাঙা গাল এবং মুখে বিরাজমান কিঞ্চিৎ হাসিই বুঝিয়ে দিচ্ছে তার উত্তর। আফিফাও যে তাকে পছন্দ করে এই ব্যাপারটা নিশ্চিন্ত হতেই নির্ঝর খুশিতে ফেটে পড়ে এত শারীরিক আঘাতের মাঝেও তার মুখে ফুটে ওঠে হাসি। সে আফিফার উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমার টানেই আমি লন্ডন থেকে সিলেটে ছুটে এসেছিলাম। এখন যখন নিশ্চিত হতে পেরেছি যে তুমিও আমাকে পছন্দ করো তাহলে এবার আমি আমাদের এই সম্পর্কটাকে পূর্ণতা দেয়ার ব্যাপারে ভাবব। তুমি আমাকে বিয়ে করবে তো আফিফা?”
আফিফা এবার যেন লজ্জায় মিলিয়ে গেল৷ তাই একটু গম্ভীর স্বরে বলল,”এসব ব্যাপারে পরে কথা বলি। বাড়ির লোকের অনুমতিরও তো দরকার।”
“এসব তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। তুমি রাজি এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। বাকি সবাইকে মানানোর দায়িত্ব আমার।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চোখের পলকে সপ্তাহ খানেক পেরিয়ে গেল। নির্ঝর এখন অনেকটাই সুস্থ হয়ে খান ভিলায় ফিরে এসেছে। বর্তমানে সে খান ভিলার ডাইনিং রুমে ডিনার করার জন্য বসে আছে এবং তার সামনেই বসা আফিফার দিকে মাঝে মাঝে আড়চোখে তাকিয়ে হাসল।
ছবি বেগম সবার মধ্যমনি হয়ে বসে ছিলেন। তিনি নির্ঝরের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”তোমায় এত দিন পর সুস্থ অবস্থায় দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছে দাদুভাই। এই ক’দিন আমার উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেছে সেটা আমি বলে বোঝাতে পারব না। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে তোমার বেশি কোন ক্ষতি হয়নি। নাহলে যে আমি তোমার মা-বাবাকে নিজের মুখও দেখাতে পারতাম না।”
নির্ঝর বলে,”তুমি শুধু শুধুই এত চিন্তা করছ গ্রানি। আমার দূর্ঘটনা ঘটেছে এতে তোমার কি দোষ? দূর্ঘটনা তো আর বলে কয়ে হয় না। তাই না?”

“সেটা জানি কিন্তু তবুও মনে একটা খচখচানি তো থেকেই যায়।”
আনিকা খান ছবি বেগমের পাতে ভাত তুলে দিতে দিতে বলেন,”আপনি আর এই নিয়ে চিন্তা করবেন না আম্মা। নির্ঝর তো এখন সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ এটাই অনেক।”
ছবি বেগম ডাইনিং টেবিলে ভালো করে লক্ষ্য করে বলেন,”আচ্ছা, আরিশা কোথায়? ও ডিনার করতে আসেনি কেন?”
আনিকা খান বলেন,”ও বলছিল ওর নাকি মাথাব্যথা করছে তাই ওর ঘরে খাবার দিয়ে আসতে, পরে খেয়ে নেবে।”
“ওর আবার কি হলো? কিছুদিন থেকেই লক্ষ্য করছি ওর ব্যবহার গুলো।”

আফিফা বলে,”হ্যাঁ, আম্মু। বোনু কিছুদিন থেকে চুপসে আছে ভীষণ। আমি কয়েকবার ওকে এর কারণও জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু ও কিছুই বলছে না তেমন। আমার ওকে নিয়ে ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। তাই ঠিক করেছি কালই ওকে নিয়ে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাব। আমার চঞ্চল বোনটা হঠাৎ এভাবে শান্ত হয়ে গেছে এটা দেখে আমার ভালো লাগছে না।”
আনিকা খান হতবাক স্বরে বলেন,”কি বলছ এটা তুমি আফিফা? আমি তো খেয়ালই করি নি।”

ছবি বেগম এবার বেশ রাগী ও গম্ভীর স্বরে বলেন,”তুমি কবে আরিশার দিকে নজর দিয়েছ শুনি? তুমি তো নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে এত ব্যস্ত যে নিজের মেয়ের ভালো,খারাপ কোন কিছুই তোমার চোখে পড়ে না। আমি কিন্তু তোমার জব নিয়ে কিছু বলছি না৷ ডাক্তারি অবশ্যই একটা মহান পেশা। কিন্তু নিজের মেয়েদের প্রতিও তো একটু দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন তাই না?”
আনিকা খান মাথা নত করে বলেন,”আমি ভীষণ লজ্জিত আম্মা। আমি আরিশার সাথে কথা বলে দেখছি ওর কি সমস্যা।”
সবাই খাওয়া শেষ করে যে যার নিজের রুমের দিকে যায়। আফিফা নিজের রুমের দিকে যেতে নেবে এমন সময় নির্ঝর তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়। আফিফা কিছুটা ভীত হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলে,”কি করছেন ভাইয়া? কেউ দেখে ফেলবে তো।”

নির্ঝর হালকা হেসে বলে,”এই সময় কেউ নেই এখানে আমাদের উপর নজর রাখার জন্য। সবাই নিজেদের ঘরে চলে গেছে৷ তাছাড়া দেখলেও বা কি? আমার মনে হয়, এবার আমাদের সবার সামনে আমাদের অনুভূতিটা ব্যক্ত করা উচিৎ।”
আফিফা কিছুটা নম্র স্বরে বলে,”আমার একটু ভয় করছে। জানি না, এসব জানার পর সবাই কেমন রিয়্যাক্ট করবে।”
আফিফার একটা চুল তার চোখের কাছে এসে পড়েছিল। নির্ঝর সেই চুলটা আফিফার কানে গুজে দিয়ে বলে,”চিন্তা করো না, আমি সবকিছু সামলে নেব।”

একটু দূরে দাঁড়িয়ে আফিফা আর নির্ঝরকে একসাথে দেখছিল আরিশা। তার বুকের বাঁ-পাশটা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছিল। চোখ পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল অশ্রুজলে। তবুও সে এত কষ্টের মধ্যেও বলে,”নির্ঝর ভাইকে অন্য কারো পাশে মেনে নিতে হবে এটা আমি কখনোই ভাবি নি। কিন্তু সেটা যদি আমার আপ্পি হয় তাহলে আমি আমার আপ্পির জন্য খুশি। তোমরা একসাথে সুখী হও। আমার ভালোবাসাটা নাহয় একতরফা আর অপ্রকাশিতই থেকে যায়।”

পরদিন দুপুরে খান ভিলায় সবাইকে ড্রয়িংরুমে জড়ো করে নির্ঝর। আবির খান হুইলচেয়ারে করে এগিয়ে আসতে আসতে বলেন,”হঠাৎ করে আমাদের সবাই কে এভাবে ডেকে পাঠালে কেন নির্ঝর? কোন কি সমস্যা হয়েছে?”
আনিকা খানও বলেন,”হ্যাঁ, কেন ডাকলে আমাদের?”
ছবি বেগম নির্ঝরের দিকে চেয়ে ছিলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল আরিশা। সে বুঝতে পারছিল নির্ঝর কি নিয়ে কথা বলবে৷ আফিফা নির্ঝরের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। নির্ঝর হঠাৎ করে আফিফার হাত শক্ত করে ধরে বলে,”আমরা তোমাদের সবাইকে একটা কথা জানাতে চাই যে, আমি এবং আফিফা একে অপরকে ভালোবাসি। আমরা আমাদের এই সম্পর্কটা গোপন রাখতে চাই না তাই তোমাদের সামনে প্রকাশ করলাম। এখন তোমরা ভেবে দেখ কি সিদ্ধান্ত নেবে?”

সবাই অবাক হয়ে যায়। তবে ছবি বেগম অবাকের পাশাপাশি খুশিও হন। এদিকে আফিফা ভীষণ চিন্তিত ছিল যে সবাই কেমন রিয়্যাক্ট করবে। ছবি বেগম ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে নির্ঝর ও আফিফার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”তোমরা যে আমার কত বড় চিন্তার সমাধান করে দিলে সেটা তোমরাও জানো না। আমি তো অনেক আগেই ভেবে রেখেছিলাম যে তোমাদের দুজনের চার হাত এক করব। তোমরা না জানালে তো এবার আমিই এই কথাটা তুলতাম। আফিফা ও নির্ঝর যে এক হবে এটা আমার অনেক দিনের পুরাতন আশা। যাক, এবার ভালোয় ভালোয় তোমাদের সম্পর্কটা এগোক। আবির, আনিকা তোমাদের কোন সমস্যা আছে?”

আবির খান বলেন,”আমার তো কোন সমস্যা নেই। নির্ঝর তো একদম হিরের টুকরো ছেলে। ওকে মেয়ের জামাই হিসেবে পাওয়া তো সৌভাগ্য। কি বলো আনিকা?”
“হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে আবরাজ ভাইজান আর নিঝুম আপুরও মতামত জানাটা প্রয়োজন।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৪

ছবি বেগম বলেন,”এই নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না। আবরাজ আমায় জানিয়েছে ওরা এই কালকেই আসবে৷ নির্ঝর দাদুভাইয়ের এক্সিডেন্টের খবর জানার পরই ওরা আসতে চেয়েছিল কিন্তু ভিসা জটিলতায় আসতে পারেনি। ওরা এলে এবার আমি আফিফা আর নিঝুমের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করবো।”
আরিশার চোখ জলে টইটুম্বুর করছিল। তবুও আফিফার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোমার খুশিতেই আমি খুশি আপ্পি। তুমি সুখী হও এটাই কামনা করি।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ২ পর্ব ৬