অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ গল্পের লিংক || ইয়াসমিন খন্দকার

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ১
ইয়াসমিন খন্দকার

“ভার্সিটিতে কি পড়াশোনা করতে আসেন নাকি মেয়েদের শরীরের দিকে নজর দিতে?”
হঠাৎ একটি চিরচেনা মেয়েলি কন্ঠ থেকে এহেন কথা শোনামাত্রই রাগী চোখে তাকায় আরহাম খান। রাগে তার চোখ যেন জ্বলছে। অথচ তার এই রাগকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে মেয়েটি আবারো বলে ওঠে,”নিজের দৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বাড়িতে গিয়ে নিজের বাবা-মাকে বলুন আপনার বিয়ে দিয়ে দিতে। তবুও ভার্সিটিতে এসে এসব নষ্টামো করবেন না।”

আরহাম এবার ভীষণ রেগে গিয়ে এগিয়ে আসে আরুশির দিকে। এসেই আরুশির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”নিজের সীমার মধ্যে থাকার চেষ্টা করো। ভুলে যেও না তোমার অবস্থান কি আর আমার অবস্থান কি…”
আরুশি আরহামের এমন প্রছন্ন হুমকিকে পাত্তা না দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,”হ্যাঁ, হতে পারে আপনি কোন বড়লোক বিজনেসম্যান বাবার অতি আদরের ছেলে, শহরের নামকরা নিউরোলজিস্ট মায়ের দুচোখের মনি এবং আপনার দৃষ্টিতে আমি এক অনাথ, আশ্রিতা..কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে কিন্তু আপনার আর আমার দুজনের অবস্থানই সমান। তাই বলছি নিজের অবস্থান নিয়ে অহংকার না করে আল্লাহকে ভয় করুন। মেয়েদের দেখলে দৃষ্টি নত করে চলুন। নিজের নজরের হেফাজত করুন। আর যদি না পারেন তো…”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বলেই একটা রুমাল বাড়িয়ে দেয় আরহামের দিকে। আরহাম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,”এসবের মানে কি?”
“যদি নিজের দৃষ্টির হেফাজত করতে না পারেন তো এই রুমালটা চোখে বেঁধে নিন। কেমন?”
বলেই একটা হাসি দিয়ে রুমালটা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে আরুশি। এদিকে আরহাম রুমালটা মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে। আরহামের থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল তার ৩ জন বন্ধু। তাদেরই একজন সাগর এগিয়ে এসে বলল,”কেসটা কি হলো? এই মেয়েটা কিভাবে বুঝল যে আমরা ক্যাম্পাসে বসে আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েদের দিকে নজর রাখছিলাম আর চোখ দিয়েই তাদের গিলে খাচ্ছিলাম।”
আরহাম দাঁত কটমট করতে করতে বলে,”সবকিছুতেই এই মেয়েটার অত্যাধিক বাড়াবাড়ি। আসলে কি বল তো, যে যা ডিজার্ভ করে না সেটা পেলে যা হয় আরকি। ছিল তো কোন এতিম খানার বাচ্চা। ভাগ্য ভালো যে আমার খালামনি ওকে এতিম খানা থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছিল নাহলে তো এতদিনে পথে পথে ঘুরত।”
আরহামের আরেক বন্ধু মুন্না এগিয়ে এসে বলে,”তবে যাই বলিস, মেয়েটা কিন্তু বেশ ভালো। সবসময় শালীন ভাবে চলাফেরা করে, ভার্সিটির সব প্রোগামেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আবার গানের গলাও তো খুব সুন্দর। আমার তো এখনো মনে আছে গতবারের প্রোগ্রামে কি সুন্দর গান খেয়েছিল। হতে পারে মেয়েটা অনাথ কিন্তু তাতে কি? রূপ, গুণ সবদিক দিয়েই তো অতুলনীয়। আমার খালামনির যদি এমন পালিত মেয়ে থাকতো তাহলে তো আমি এমন মেয়েকেই বিয়ে করতাম।”

আরহাম এবার চোখ রাঙানি দিয়ে বলে,”এখনও কর, অসুবিধা কি? তোর কোন সমস্যা না থাকলে আমি খালামনির কাছে সম্মন্ধ পাঠিয়ে দেই। তবে একটা কথা মাথায় রাখিস, এর মতো অনাথ মেয়েরা আরহাম খানের স্ত্রী তো দূরের কথা রক্ষিতা হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না।”
বলেই একটা দাম্ভিকের মতো ভাব নেয় আরহাম। যে বর্তমানে ঢাকা ভার্সিটিতে CSE নিয়ে পড়ছে। এবার ফাইনাল ইয়ারে। এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে থেকেই আলাদা দাপট নিয়ে চলে৷ ভীষণ সুদর্শন এবং ট্যালেন্টেড হওয়ার কারণে সবাই তার প্রশংসা করে। ভার্সিটির বহু মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ সে। অবশ্য স্কুল-কলেজ সবখানেই তার সমান জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু সেই স্কুল জীবন থেকেই তার জীবনের একমাত্র কালো অধ্যায় হলো এই আরুশি। তার থেকে ২ বছরের ছোট এই মেয়েটা কখনো তাকে পাত্তাই দেয় নি। সবসময় নিজের খেয়াল খুশি মতো চলেছে এমনকি সুযোগ পেলেই আরহামকে বাঁশ দিয়েছে ঠিক আজকের মতো। আরহামও অবশ্য কম যায়না। ছোট থেকে অনাথ, আশ্রিতা বলে কম অপমান করে নি আরুশিকে। আর এভাবেই দুজনের মধ্যে এক অলিখিত শত্রুতার অধ্যায় শুরু হয়েছে। যা আজো বহমান।

আরুশি ক্যাম্পাস পেরিয়ে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় তার প্রিয় বান্ধবী মারিয়া চশমা চোখে সাইকোলজি সংক্রান্ত একটি ইংরেজি বইয়ে মনোনিবেশ করেছে। আরুশি আসতেই মারিয়া বই থেকে চোখ তুলে বলে,”কিরে? আজ আবারো নিশ্চয়ই তোর ঐ খালাতো ভাইয়ের সাথে ঝামেলা করে এলি।”
মারিয়ার কথাটা শোনামাত্র আরুশি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,”কি আর বলি তোকে..আমি তো ভেবেই পাই না আবার বড় খালামনির মতো এত ভালো একজন মানুষের পেট থেকে এমন একটা বেয়াদব ছেলে কিভাবে জন্ম নিলো। জানিস, আজ ক্যাম্পাসে মেয়েদের কিভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিলো। আমার তো ইচ্ছা করছিল ওনার চোখ দুটো কানা করে দিতে।”

মারিয়া এবার হালকা হেসে বলে,”ওহ, বুঝলাম। আমাদের আরু জেলাস!”
আরুশি হতবাক স্বরে বলে,”এখানে জেলাসির কি দেখলি তুই? তোর কি মনে হয় আমি ঐ স্পয়েল কিডের প্রতি ইন্টারেস্টেড? নট এট অল। হতে পারে ও ভার্সিটির সব মেয়েদের ক্রাশ বাট টু মি, হি ইজ নাথিং।”
“হ্যাঁ, বুঝেছি বুঝেছি। তো ম্যাম বলুন, রিসার্চ পেপারসের কাজটা কতদূর এগোলো? এই উইকের মধ্যেই কিন্তু জমা দিতে হবে মনে আছে?”
আরুশি বলে ওঠে,”তা আবার মনে থাকবে না। উফ, বুঝি না। এই সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করাটাই বুঝি জীবনের সবথেকে বড় ভুল। এখন এই রিসার্চ নিয়ে কাজ করতে গেলে আবার বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে তাদের মনস্তাত্ত্ব বুঝতে হবে। কি এক ভীষণ বিরক্তিকর ব্যাপার।”
“হ্যাঁ, এসব তো তোর কাছে বিরক্তিকরই লাগবে আরু। যদি বড় খালামনির ছেলেকে নিয়ে রিসার্চ করতে হতো তো…”

“মারিয়া..এবার কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। তুই যদি আর একটা বাজে কথা বলিস তাহলে কিন্তু আমি রাজীব ভাইকে বলে দেব যে তুই ওনাকে ভালো…”
এমন সময় হঠাৎ করে সেখানে আগমন ঘটে আরুশিদের এক ব্যাচ সিনিয়র রাজীবের। রাজীব এসেই বলে,”এখানে কি আমাকে নিয়ে কোন কথা হচ্ছে?”
রাজীবকে দেখামাত্রই আরুশি বলে ওঠে,”হ্যাঁ, ভাই। আপনাকে একটা ভীষণ জরুরি কথা জানানোর আছে। আসলে মারিয়া না…”
আরুশি আর কিছু বলার আগেই মারিয়া তার মুখ চেপে ধরে বলে,”আসলে ভাইয়া তেমন কিছু না। আরুকে এতো সিরিয়াসলি নেবেন না তো।”
রাজীব ভ্রু কুঁচকে বলে,”না, ওকে বলতে দাও।”
অগত্যা মারিয়া আরুশির মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয়। আরুশি বলে ওঠে,”আসলে ও বলছিল আমাদের নতুন রিসার্চ পেপারের কাজে যদি আপনি একটু সাহায্য কর‍তেন।”

মারিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচে আরুশির কথা শুনে। এদিকে রাজীব বিনয়ী হেসে বলে,”হ্যাঁ, অবশ্যই। তোমরা রিসার্চ পেপারস নিয়ে কাজ শুরু করে দাও। আমি তোমাদের যথাসাধ্য সাহায্য করবো।”
“থ্যাংক ইউ সো মাচ ভাইয়া, আপনার মতো ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট আমাদের হেল্প করলে..”
আরুশি আর কিছু বলতেই যাবে এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে। তাই আরুশি একটু দূরে সরে যায় কথা বলতে।
এদিকে মারিয়া মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রাজীবের দিকে তাকিয়ে থাকে। মারিয়া ভাবতে থাকে, কি আছে ছিমছাম গড়নের এই শ্যামলা যুবকের মাঝে যা তাকে এতটা আকর্ষণ করে?
এদিকে রাজীব আড়চোখে আরুশিকেই দেখতে থাকে। মনে মনে বলে,”তোমার জন্য তো আমি নিজের জীবনও দিতে প্রস্তুত আরু রাণী। এই সামান্য রিসার্চ পেপার তো কিছুই না।”
এদিকে আরুশিকে ফোনে আরিশা বলেন,”কি ব্যাপার আরু? তুই কি আজ আবারো আরহামের সাথে ঝামেলা করেছিস?”

“আচ্ছা, আম্মু তোমার কেন মনে হয় যে আমি সবসময় তোমার পেয়ারের বোনপোর সাথে ঝামেলা করি?”
“কারণ তোকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। ছোটবেলা থেকে তো ছেলেটার পেছনে না লাগলে তোর পেটের ভাত হজম হয়না।”
“হ্যাঁ, আর তোমার বেচারা ছেলে তো ধোয়া তুলসীপাতা। জানো, আজ ক্যাম্পাসে মেয়েদের..”
“থাক, তোকে আর কিছু বলতে হবে না। আমি জানি, আমার আরু কখনো কোন অন্যায় করে না। যা বলে একদম ঠিক বলে। আসলে একটু আগে আরহাম আমায় কল দিয়ে অভিযোগ করছিল। তাই নিশ্চিত হবার জন্য তোকে ফোন দিলাম৷ এখন তো সত্যটা জানলাম এখন আপ্পিকে ভালো করে ওর ক্লাস নিতে পারব।”

“হুম, বড় খালামনিকে বলে দিও তো এবার নিজের বড় ছেলের একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে। নাহলে এভাবেই মেয়েদের দিকে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে নিজের পাপের বোঝা বাড়াবে।”
“আচ্ছা, ঠিকাছে। তুই নিজের যত্ন নে। রাখছি এখন।”
“আচ্ছা।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২