অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২১
ইয়াসমিন খন্দকার
আরুশি মারিয়াকে টানতে টানতে তাকে পুলিশের সামনে নিয়ে যায়। মারিয়া হতবাক হয়ে যায়৷ আরুশি বলে,”তুই অনেক অন্যায় করেছিস মারিয়া। এবার তোকে তার শাস্তি পেতে হবে৷ আপাতত আমি তোকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছি। এরপর ওনারাই সিদ্ধান্ত নেবে কি করা যায়। তোকে এসাইলামে পাঠাবে নাকি অন্যকিছু তা ওনারাই ভেবে নেবেন।”
বলেই সে মারিয়াকে পুলিশের সামনে রেখে তার মা আরিশা খন্দকারের সামনে গিয়ে বলে,”আম্মু, আজ তো তুমি সব সত্য জানলে এরপরও কি আমায় ভুল বুঝবে? আমাকে নিজের বুকে টেনে নেবে না?”
আরিশা খন্দকার নিজের মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন,”আমাকে তুই ক্ষমা করিস না, আরু। আমি তোকে ভুল বুঝেছি। আমি সত্যিই খুব খারাপ মা। তাই তোর সবথেকে খারাপ সময়ে যখন তোকে আমার সবথেকে বেশি দরকার ছিল তখন আমি তোর পাশে ছিলাম না। এরজন্য আমি লজ্জিত। আমাকে তুই কখনো ক্ষমা করিস না।”
“না, আম্মু। এভাবে বলো না প্লিজ৷ সন্তান হাজারো ভুল করলে তো মায়েরা তাদের সহজেই ক্ষমা করে দেয় তাহলে সন্তানরা কি মা-বাবার কিছু ভুলকে উপেক্ষা করতে পারে না?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দুই মা-মেয়ের মধ্যে অনেক আবেগঘন মুহুর্তের সৃষ্টি হয়। মারিয়ার হাতে পুলিশ হাতকড়া পড়ায়। মারিয়ার বাবা নীরব থাকলেও মারিয়ার মা মনোয়ারা খাতুন এবার একটু অস্থির হয়ে ওঠেন। মারিয়াকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছিল তখনো সে রাজীবের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি তোমার জন্য নিজের জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাব রাজীব ভাই। আমি প্রমাণ করে দেবো যে, আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিল না। ঐ কারাগারের চার দেয়াল তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা এক চিমটিও কমাবে না। সবাই কি ভাবে? শুধু আরুর মতো মেয়েরাই ভালোবাসতে পারে আর মারিয়ার মতো মেয়েরা যাদের সমাজ তথাকথিত ভিলেন বলে তারা কি ভালোবাসতে পারে না? আমি কথা দিচ্ছি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বজায় রাখব। এই জেলে যাওয়া নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই। আমার আক্ষেপ শুধু একটাই, তোমাকে এক সিন্ধু পরিমাণ ভালোবেসে বিনিময়ে এক বিন্দু বিন্দু ভালোবাসাও পেলাম না!”
কথাটা বলতেই মারিয়ার মুখে একটা মলিন হাসি ফুটে ওঠে৷ রাজীব নিরুত্তর থাকে।
জাঈদ শেখ এগিয়ে এসে আরুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”এতদিন তো সবাই আমার প্রিন্সেস অনেক কিছুই বলেছেন কোন কিছু বিচার না করে। আজ কি তারা সেসবের জন্য ক্ষমা চাইবে না।”
কথাটা বলেই কিছু দূরে দাঁড়ানো নির্ঝর খানের দিকে তাকান তিনি। নির্ঝর খান কিছুটা থতমত খেয়ে যান। তবে নিজের ইগো বজায় রাখতে তিনি বলে ওঠেন,”এসব যা হয়ে গেল সবটাই অনাকাঙ্ক্ষিত। আমরা সবাই ভুল বুঝেছিলাম কিন্তু সেটা পরিস্থিতির জন্য। তবে এখন যখন সব সত্য সামনে এসেছে তখন এইসব ভুল থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। আরহাম আর আরুশি তো কোন সম্পর্কে ছিল না;এই বিয়েটা একটা মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে হয়েছে৷ তাই এবার এই মিথ্যা সম্পর্কটা ভেঙে ফেলার সময় হয়ে এসেছে।”
আফিফা খান নিজের স্বামীর মুখে এহেন কথা শুনে বলেন,”এসব কি বলছ তুমি?”
“আমি ঠিকই বলছি, সায়রা সেদিন বিয়ের আসরে কতোটাই না অপমানিত হলো। হ্যাঁ, আরুশিরও অনেক অপমান হয়েছে যা দুঃখজনক কিন্তু সায়রা কষ্টটাও কম না। ও বেচারি তো ছোটবেলা থেকেই নিজের মাকে ছাড়া কত কষ্টে বড় হয়েছে। সেখানে আরুশিকে সামলানোর জন্য ওর মা-বাবা আছেই৷ তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেহেতু আরহাম ও আরুশির বিয়েটা জোরপূর্বক হয়েছিল তাও একটা মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে তাই এই বিয়েটা ভেঙে দিতে। তারপর আবার সায়রার সাথে আরহামের বিয়ে দিতে।”
জাঈদ শেখও বলেন,”এই বিষয়ে আমিও আপনার সাথে একমত। আমিও চাইনা, আমার মেয়ে এই অসুস্থ সম্পর্কে থাকুক। আরহাম আর আরুশির আলাদা হওয়াই সব সমস্যার সমাধান হবে।”
আরিশা খন্দকার বলে ওঠেন,”জাঈদ, নির্ঝর ভাইয়া আপনারা একটু শান্ত হন। এভাবে হঠকারী ভাবে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না। আর জীবনটা আরহাম ও আরুর। তাই ওরা একসাথে থাকবে নাকি আলাদা হয়ে যাবে সেই সিদ্ধান্তটাও ওদেরকেই নিতে দিন।”
আফিফা খানও বলে ওঠেন,”হ্যাঁ, বোনু একদম ঠিক বলেছে। তাছাড়া আরহাম তো..”
আফিফা খান নিজের কথা সম্পূর্ণ করার আগেই আরুশি বলে ওঠে,”আমরাই এই সম্পর্কের ইতি টানতে চাই খালামনি। মিথ্যের উপর তৈরি একটা সম্পর্ক কখনো ভালো হয় না।”
আরুশির কথাটা শুনে আরহাম হতবাক হয়ে যায়। তার বুকের বা-পাঁশটা ব্যাথায় জ্বলতে থাকে। তার চোখেও যেন সেই ব্যথা ফুটে ওঠে। আরুশি আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ মারিয়ার সত্যটা সামনে আনতে আপনি আমায় অনেক সাহায্য করেছেন, এমনকি এভাবে মারিয়াকে ভয় দেখিয়ে সত্যটা বের করে আনার বুদ্ধিটাও আপনার ছিল। সেজন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনার প্রতি চিরায়ত বৈরী সম্পর্ক দূর করে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়তো আমার সম্ভব। কিন্তু আপনাকে ভালোবাসা কিংবা আপনার সাথে সংসার করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। তাই আমি এই সম্পর্কের ইতি টানতে চাই।”
জাঈদ শেখ নিজের মেয়ের কথা শুনে সমর্থন জানিয়ে বলেন,”তুমি একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তোমার পাপা এই সিদ্ধান্তে তোমার পাশে আছে।”
আরিশা খন্দকার বলে ওঠেন,”কিন্তু আরহাম তো..”
এমন সময় আরহাম দীর্ঘ সময়ের নীরবতা ভেঙে বলে,”আমি আরুশির সিদ্ধান্তটা মেনে নিতে প্রস্তুত। ও যদি এই সম্পর্কটা রাখতে না চায় তাহলে আমিও ওকে জোর করব না। আমাকে ছেড়ে দিয়েই যদি ও সুখী হতে পারে তাহলে তাই হোক।”
অভিমান থেকেই কথাগুলো বলে আরহাম। অতঃপর সাথে সাথেই সেই স্থান ত্যাগ করে বেরিয়ে যায়। আমান যে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল সে আরহামের পেছন পেছন যায় নিজের ভাইকে সান্ত্বনা দিতে। কারণ সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারে তাই বড় ভাই কতোটা কষ্ট ও অভিমান নিয়ে এসব কথা বলেছে।
নির্ঝর খান জাঈদ শেখের উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”তাহলে ঐ কথাই রইল। খুব শীঘ্রই আরহাম ও আরুশির পথ আলাদা হতে চলেছে।”
রাজীব যে সেখানেই উপস্থিত ছিল সে এসব কথা শুনে মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। মনে মনে ভাবে,”তাহলে আরুকে আবার নিজের করে পাওয়ার একটা সুযোগ আমি পাবো!”
এই ভাবনা থেকেই সে আরুশির পাশে এসে তার কাধে হাত রেখে বলে,”তোমার সিদ্ধান্তে আমিও তোমার পাশেই আছি আরু, একজন বন্ধু, সিনিয়র ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। আর হয়তোবা তোমার ভবিষ্যতের সঙ্গী হিসেবেও।”
শেষের কথাটা মনে মনে বলে রাজীব।
এদিকে আরিশা খন্দকার ও আফিফা খান দুজনেই হতাশ চোখে একে অপরের দিকে তাকান। আরিশা খন্দকার আফিফা খানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,”এসব কি হয়ে গেল আপ্পি? এভাবে আরহাম ও আরুর সংসারটা ভেঙে যাবে?”
আফিফা খানও হতাশ স্বরে বলেন,”আমি কিছুই বুঝতে পারছি না বোনু। আমার বর আর তোর বর এই দুজনই হলো যত নষ্টের গোড়া। নিজেদের ইগো বজায় রাখতে শুধুশুধু এসব করছে!”
“শুধু ওনাদের দোষ দিয়ে কি হবে? আরুও কম নয়। আরহামের ভালোবাসাটা ও বুঝতে পারছে না। যেভাবেই হোক, বিয়েটা তো হয়েছে। এখন এই ডিভোর্সটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না। আমার মনে হয়, আরহামের সাথেই আরু সুখী হতে পারবে।”
অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২০
“আমারও তাই মনে হয়৷ তাছাড়া আমার ছেলেটাও আরুকে ভালোবাসে। এবার যা করার আমাদেরই করতে হবে। কিছুতেই ওদের সম্পর্কটা আমরা ভাঙতে দেবো না।”
“আমিও এই ব্যাপারে তোমার পাশেই আছি আপ্পি। আমরা দুজন মিলে যে করেই হোক এই অঘটন আটকাবোই।”
বলেই দুজনে একসাথে হাত মেলায়। অন্যদিকে জাঈদ শেখ ও নির্ঝর খান দুজনের দিকেই চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকেন। যা তাদের দুজনের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধ ফুটিয়ে তোলে।