অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২২

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২২
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশিকে নিয়ে সিলেটে ফিরে আসে জাঈদ শেখ। আরিশা খন্দকারও চলে আসেন। জাঈদ শেখ সিলেটে এসেই আরুশিকে বলেন,”তোমার উপর দিয়ে এই কয়দিন যা ঝড় গেল তাতে এখনই তার তোমায় ঢাকায় যেতে হবে না। আগে কিছুদিন এখানে থেকে একটু নিজেকে স্বাভাবিক করো। পাপা সবসময় তোমার পাশে আছে।”
আরুশি আবেগপ্রবণ হয়ে জাঈদ শেখকে জড়িয়ে ধরে। আরিশা খন্দকারও আরুশির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,”শুধু তাই নয়, এই সময়ের মধ্যে নিজের জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্তও তোকে নিতে হবে আরু। আমি এমনিতেই তোকে এই বিয়েটা করতে বাধ্য করে ভুল করেছি তাই আর তোকে কোন সিদ্ধান্ত নিতে জোর করব না। তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। তাই তোর সিদ্ধান্তের উপর আমি ভরসা রাখলাম।”
আরুশি নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”ধন্যবাদ আম্মু। তোমায় আমি নিরাশ হতে দেবো না৷ এমন সিদ্ধান্ত নেব যা সবার জন্য ভালোই হবে।”
আরিশা খন্দকার মাথা নাড়ান৷ জাঈদ শেখ আরুশিকে বলেন,”এখন তুমি নিজের রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। পরে কথা হবে।”
অতঃপর আরুশি নিজের রুমে চলে যায়।

আরহাম নিজের রুমে লাইট অফ করে বসে আছে। এমন সময় আমান এসে রুমের লাইট অন করল। আরহাম চোখ তুলে আমানকে দেখেই বলল,”আমাকে একটু একা থাকতে দে ভাই। বিরক্ত করিস না প্লিজ।”
আমান এসে আরহামের পাশে বসে তার কাধে হাত রেখে বললো,”তোমার যেকোন বিপদে আমাকে তুমি নিজের পাশে পাবে ভাইয়া। নিজেকে একা মনে করো না।”
“আমি জানি সেটা। আমি হয়তো একজন ছেলে, ভাই বা স্বামী হিসেবে পারফেক্ট নই কিন্তু আমার ভাই সবদিক দিয়ে পারফেক্ট।”
“উফ..ভাইয়া এতটা পাম দিও না। যাইহোক, মূল কথায় আসি৷ আমি তোমার চোখমুখের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি তুমি আরু আপাইকে কতোটা ভালোবাসো। কিন্তু পরিবার থেকে তোমাদের এই সম্পর্কটা ভাঙার কথা উঠলেও তুমি কোন প্রতিবাদ জানালে না! এটা তুমি ঠিক করো নি ভাইয়া৷ তোমার সবাইকে নিজের মনের কথাটা জানানো উচিৎ। নাহলে কেউ তোমায় বুঝবে না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“সবাই আমাকে বুঝে কি হবে ভাই? তাতে তো আমি কোন লাভ দেখতে পাচ্ছি না। যার বোঝা উচিৎ সেই তো বুঝছে না। দেখলি না, তোর আরু আপাই কিভাবে সবার সামনে বলল আমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। সেখানে আমি কেন ওকে জোর করতে যাব? কেউ স্বেচ্ছায় থাকতে না চাইলে আমিও তাকে জোর করব না।”
“কিন্তু এসব করতে গিয়ে তো তুমি নিজেই সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছ।”
“আমার কষ্ট কি কেউ মূল্যায়ন করেও আদৌ? ড্যাড নিজের ইগো নিয়ে আছে, আরুশিও নিজের জেদ নিয়ে আছে। সবারই ইচ্ছার মূল্য আছে শুধু আমার নেই। আমাকে তো কারো মানুষ বলে মনেই হয় না৷ ইমোশনবিহীন পাথর মনে হয়৷ যাকে যত খুশি আঘাত দেয়া যায়।”
“তোমার নিজের ভালোবাসার জন্য তোমার নিজেকেই লড়াই করতে হবে ভাইয়া। যদি তুমি আরু আপাইকে ভালোবাসো আর তাকে নিজের করে পেতে চাও তাহলে এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থেকো না। প্রয়োজনে গোটা দুনিয়ার সাথে লড়াই করে তাকে নিজের করে নাও। আমি যেই ভুল করেছি, সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি তুমি করো না।”

“মানে?”
আমানের কথায় কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে আরহাম৷ আমান বলে,”কিছু না। যেটা বললাম একটু ভেবে দেখো।”
বলেই আমান বেরিয়ে যায়। আমান যাবার পরেই আফিফা খান আরহামের রুমে আসেন। তাকে দেখেই আরহাম বলে,”মম, তুমি?”
“হ্যাঁ, আমি। তোমাকে একটা পরামর্শ দিতে এসেছিলাম। তবে আমার আগেই আমান তোমাকে সেই পরামর্শ দিয়ে ফেলেছে৷ তোমার বাবার ইগো আর পাগলামীতে আমারও সায় নেই। সায়রাও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে সে আর তোমাকে বিয়ে করবে না। সায়ন ভাইয়েরও কোন মত নেই এই বিয়েতে। কিন্তু তোমার বাবা আদাজল খেয়ে নেমেছে এই বিয়েটা দিতে। এভাবে জোর করে কিছু হয় না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিলেট যাও৷ নিজের স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনো।”

আরহামের দাদি নিঝুম খানও চলে আসেন সেখানে। তিনিও বলেন,”হ্যাঁ, দাদুভাই। নিজেদের মধ্যে এসব ইগোর লড়াই সরিয়ে রেখে ভালোবাসার জন্য লড়াই করো।”
আরহাম বলে ওঠে,”ঠিক বলেছ তোমরা। আরুশি যাই বলুক, এবার আমি নিজের ভালোবাসার জন্য লড়ব।”
বলেই আরহাম নিজের ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করে। অতঃপর বেরোনোর সময় নিজের মা ও দাদির উদ্দ্যেশ্যে বলে,”তোমরা আমার জন্য দোয়া করিও আম্মু ও দাদি। আমি আমার ভালোবাসাকে যেন জয় করে ফিরতে পারি।”
নিঝুম খান বলেন,”তুমি অবশ্যই জয়ী হবে দাদুভাই।”
আফিফা খান বলেন,”আমি তোমার খালামনিকে বলে দেবো তুমি যাচ্ছ। তারপর সিলেটে যা করার আরিশাই করবে।”

আরুশি নিজের ঘরে বসেছিল। এমন সময় আরিশা খন্দকার হাতে খাবারের থালা নিয়ে এসে বলেন,”কি হয়েছে আরু? তুই এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন?”
আরুশি বলে,”আম্মু তুমি!”
“হুম, আমি। এসেছিস থেকে তো কিছু খাস নি। তাই তোর জন্য খাবার নিয়ে এলাম। নিজের প্রতি যদি তোর একটুও খেয়াল থাকে।”
“আসলে আম্মু..”
“থাক, আর কিছু বলতে হবে না। এদিকে আয়, কতদিন তোকে নিজের হাতে খাইয়ে দেই না। আজ আমি তোকে নিজের হাতে খাইয়ে দেব।”
“তাই আম্মু? কতদিন পর তোমার হাতে খাব।”
“হুম আয়।”
আরিশা খন্দকার যত্ন করে আরুশিকে খাইয়ে দিতে থাকেন৷ হঠাৎ করে বলে ওঠেন,”তুই কি সত্যিই আরহামের সাথে সম্পর্কটা রাখতে চাস না।”
“না, আম্মু।”
“কেন? আরহাম তো ছেলে হিসেবে খারাপ না। আর ও তোকে ভালোবাসে!”
“কিন্তু আমি তো ওনাকে ভালোবাসি না।”
“সত্যি কি ভালোবাসিস না?”
“মানে?”
“এই প্রশ্নটা আমাকে না করে নিজেকে কর উত্তর পেয়ে যাবি।”

আরুশি আরহামের সাথে কাটানো কিছু মুহুর্ত ভাবতে থাকে। ছোটবেলা থেকে তাদের মধ্যে বনিবনা না থাকলেও কেন জানি একে অপরের প্রতি এক অদ্ভুত টান সবসময়ই ছিল। আরুশি যখন এসব নিয়ে ভাবছিল তখন আরিশা বলেন,”বেশি চাপ নিতে হবে না এখন৷ পড়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবিস।”
এরইমধ্যে জাঈদ শেখ সেখানে চলে এসে বলেন,”বাহ, আমার প্রিন্সেস তো দেখছি নিজের মায়ের হাতে ভাত খাচ্ছে। পাপাও প্রিন্সেসকে একটু খাওয়াতে চায়।”
আরিশা জাঈদ শেখের হাতে ভাতের প্লেট তুলে দিয়ে বলেন,”নাও, নিজের প্রিন্সেসকে খাইয়ে দাও। নিজে থেকে তো না নিজের খেয়াল রাখতে পারে আর না কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা না থাকলে যে ও কি করবে।”
আরুশি বলে ওঠে,”এসব কথা একদম বলবেনা আম্মু। পাপা তুমি আম্মুকে বকে দাও তো। তোমরা সবসময় আমার সাথে থাকবে। আর আম্মু তুমি তো জানো, আমি কতোটা অগোছালো একটা মেয়ে। তাই আমার জীবন গুছিয়ে দিতে তোমাকে সবসময় আমার পাশে থাকতে হবে।”

জাঈদ শেখ আরুশিকে খাইয়ে দিতে থাকেন। এমন সময় তার ফোনে কল আসলে তিনি ভীষণ রেগে কারো সাথে কিছু সময় কথা বলেন। আরিশা খন্দকার এভাবে রাগতে দেখে জিজ্ঞেস করেন,”কি হয়েছে? তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন?”
“রেগে যাচ্ছি কি আর শখ করে? ঐ ঈশান কবীর..আমার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিবীদ আমার পার্টিতে সমস্যা তৈরি করছে। অনেক বিশ্বস্ত লোকও আমার পার্টি ছেড়ে দিচ্ছে। আমার যা রাগ হচ্ছে না। আর আমি ঠিকই বুঝতে পারছি এসবের পেছনে ওনার স্ত্রী আছেন। শুনেছি পর্দার আড়ালে থাকা সেই মহিলা ভীষণ ধুরন্ধর।”
ঈশানের নাম শুনতেই আরুশির অতীতের কথাগুলো মনে পড়ল। তাই তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিন্তু সাথে এটাও ভাবলেন, কে হতে পারে ঈশান কবীরের ধুরন্ধর স্ত্রী?

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২১

নির্ঝর, আফিফা, নিঝুম-আবরাজ, সায়ন-বৃষ্টি, জাঈদ-আরিশা সহ তাদের সন্তানদের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক মধ্যবয়সী নারী। যার চোখে জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন। তিনি বৃষ্টির ছবিতে একটা ক্রস দাগ দিলেন। অতঃপর বাকিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,”একজনের উপর তো আমার বদলা নেয়া শেষ। এবার বাকিদের পালা। খান পরিবারের সবার জীবন আমি ধ্বংস করে দেবো। এটাই আমার প্রতিজ্ঞা!”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ২৩